রাজবধূ পর্ব ৫৮

রাজবধূ পর্ব ৫৮
রেহানা পুতুল

রাজের এত বিভৎস রূপ পরিবারের কেউই এর আগে দেখেনি। জুবায়ের ভাবছে অন্যকিছু। রাজ তার দিকে তাকালে সে শিখাকে দেখিয়ে ইঙিতে অর্থপূর্ণ কিছু বোঝালো।
রাজের উত্তেজিত মস্তিষ্ক বুঝতেই পারল না,জুবায়ের তাকে কি বোঝাতে চাচ্ছে। রাজ দ্বিতীয়বার ভ্রুক্ষেপ করল না জুবায়েরের দিকে। রানির দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যমাখা স্বরে বলল,
“জুবায়ের, একে হসপিটালে নিয়ে যা। বরকত যাবে তোর সঙ্গে। ডাক্তারদের কি বলবি,তা তুইও ভালো জানিস। কাটা অংশ নিয়ে যাস। যদি লাগিয়ে দিতে পারে। তাহলে দিতে বলবি।”
“তুই একটু শান্ত হ। আমি যাচ্ছি তাকে নিয়ে।”
বিমর্ষ গলায় বলল জুবায়ের।

বরকত,জোছনা,মতির মা রান্নাঘরের চৌকিতে অবস্থান করছিলো। ওঁৎ পেতে থাকা শিকারির ন্যায় তাদের কান সজাগ রয়েছে ঘরের বৈঠকখানার দিকে। যদিও থেমে থেমে রাজের গর্জন ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না। জুবায়ের হেঁড়ে গলায় তাদের তিনজনকেই ডাক দিলো। তারা এলো ভয়ার্ত চোখমুখ নিয়ে।
জুবায়ের তাদের নির্দেশ দিয়ে বলল,
“বরকত গিয়ে গাড়ি নিয়ে আয় দ্রুত। চাচী এর হাত পরিস্কার করে পেঁচিয়ে দেন।”
“করতাছি বাবা।”
ঘরের মেঝে রানীর হাতের টকটকে তাজা র* ক্তে ভেসে গেলো। এমন নৃশংস দৃশ্য দেখে মতির মা ও জোছনার কাঁপা-কাঁপি শুরু হয়ে গেলো। তারা রানিকে ধরে হাত পরিস্কার করে দিলো। বরকত ট্যাক্সি নিয়ে চলে এলো। রানিকে মাঝখানে বসালো। দুইপাশ থেকে তাকে ধরে বসলো বরকত ও জোছনা। ব্যাগের মধ্যে নিয়েছে হাতের খন্ডিত অংশটি। তারা চলে গেলো। পিছন দিয়ে জুবায়ের তার বাইক নিয়ে পথ ধরলো। হাতের তীব্র যন্ত্রণা প্রতিমুহূর্তে মৃত্যুর সমান অনুভূত হচ্ছে রানীর কাছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আদুরী আধমরা হয়ে পড়ে আছে। রাজ আদুরীর হাতে পাড়া দিলো। আদুরী,ভাইয়া…বলে আর্তনাদ করে উঠলো। রাজ আদুরীর ডান হাত তুলে ধরলো। হাতের চাকুটি উপরে তুলতেই সুফিয়া কলিজা ফাটা চিৎকার দিলেন। তারবাবা ধমকে উঠলেন রাজ বলে।
“আমি এখন মানুষ রাজ নই বাবা। অমানুষ নওশাদ তালুকদার। রাজের ভালো সত্তা বিলীন এইমুহূর্তে। নওশাদ তালুকদারের খারাপ সত্তা জাগ্রত এখন। ঘরের বপেন আর বাইরের বলেন,কিছু মানুষের নীতি বিবর্জিত অমানুষিকতাই আমাকে অমানুষ করে তোলে। আমার কি ভুল তাহলে?”
গমগমে স্বরে বলল রাজ।
তালুকদার থম মেরে রইলেন। সুফিয়া আদেশের মতো করে অধিকার ফলিয়ে বললেন,

“রাজ,আমি যদি তোরে পয়দা কইরা থাকি। যদি তুই মায়ের স্তন পান কইরা থাকস, তাইলে সেই দুধের কসম দিয়া কইতাছি, হাতের চাক্কু মাটিতে ফালা। আদুরী তোর একটা মাত্র বইন। ওরে মাফ কইরা দে। তোর বাপ এতক্ষণ ওরে কি পিটান পিটাইলো। তাইলে আর তুই কি শাস্তি দিবি ওরে?”
রাজ হাতের চুরি মাটিতে রাখলো। পা সরিয়ে নিলো বোনের হাতের উপর থেকে। চেয়ারে বসলো। হাঁফানো স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
“তুই কেন শিখার ভর্তায় বিষ মিশিয়েছিলি এটা বল? একটা বর্ণ মিথ্যা বলবি ত মেরে ফেলবো।”
“আমার চোখের সামনে সে ঘরে বাইরে সবকিছুতে কর্তাগিরি দেখায়। আর আমি তালুকদারের একমাত্র মেয়ে হয়ে তার সামনে অকর্মার মতো থাকতে হয়। এতে আমি খুব হীনমন্যতায় ভুগতাম। তারে সহ্য হতো না। প্রতিটিমুহূর্তে তাকে বিষফোঁড়া মনে হয়। তাই তাকে মেরে ফেলার জন্য বিষ মিশিয়েছি।”

মরাকণ্ঠে জানাল আদুরী।
“বাহ! বাহ! বাহ! ওয়ান্ডারফুল! শুনলেন ত সবাই? আমি পরিশ্রম করে কাদের জন্য এত টাকা পাঠাই? যারা কিনা নিরপরাধ একটা মেয়েকে মেরে ফেলতে চায়? বন্ধ্যা বানিয়ে দিতে চায়? তাদের জন্য? সামনের মাস হতে আর কোন টাকা দিবনা আমি। বড় দুই ভাই ভালো। তাদের বউরাও ভালো। তাদের টাকা দিয়েই সংসার চলুক। আজ হতে শিখা আলাদা খাবে। সবাইকে এখন আমার ডাউট হচ্ছে। তাই আর একত্রে খাবে না সে। তার রান্না সে করে নিবে।”
শিখা স্তম্ভিত চোখে এক নতুন চরিত্রের রাজকে দেখছে।
রাজ শিখার দিকে চেয়ে বলল,
“তুমি আলাদা রান্না করে খেতে পারবে?”
“পারবো।”
“গুড।”
রাজ আদুরীর দিকে দৃষ্টি তাক করে বলল,

“বাবা,মায়ের জন্য পার পেয়ে গেলি আমার হাত থেকে। আজ থেকে শিখাকে নাম ধরে ডাকবি না। ভাবি বলবি শ্রদ্ধার সঙ্গে। তুমি নয়, আপনি সম্বোধন করে কথা বলবি। মনে থাকে যেনো।”
রাজ তার চাকুটি নিয়ে ভারি ভারি পা ফেলে দোতলায় চলে গেলো। বাথরুমে গিয়ে কল ছেড়ে চাকুখানা ধুয়ে নিলো। জানালায় রোদে রাখলো পানি শুকিয়ে যাওয়ার জন্য। জোরে জোরে স্বাস ফেলতে লাগলো রাজ। এমন কিছুতো সে একদম চায়নি। বড় ভাবির সঙ্গে এমন অমানবিক নিষ্ঠুর আচরণ করতে সে কখনোই প্রস্তুত ছিল না। ভাবির অমানুষিক স্বার্থপরতাই তাকে বাধ্য করলো এমন বর্বরোচিত ঘৃণ্য কাজ করতে। শিখার গর্ভে যদি তার সন্তান না জন্ম নেয়,সে কোনদিন বাবা ডাক শুনতে পারবে না। শিখাও তাকে ছেড়ে চলে যাবে। একজন মেয়ের নারী জনমের পূর্ণ সার্থকতাই তার মাতৃত্বের মাধ্যমে। আর সেই স্বাদ না নিতে পারলে কেনই বা শিখা পড়ে রবে তার জীবনে। রানির হাতের কবজি কেটে ফেলার জন্য ঠিক এই চিন্তাটা রাজের জন্য যথেষ্ট ছিলো।

মতির মা,সুমনা,ডলি ঘরের মেঝে পরিস্কার করে নিলো। শিখা সুফিয়ার মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়ালো। বলল,
“আমি জানি আপনি নিজেকে নিয়ে খুব চিন্তিত ছিলেন। আপনার গুণধর কন্যা ও বড় পুত্রবধূর মতো যদি আপনার সবকিছুও উপস্থাপন করে দিই সবার সামনে। কিন্তু আমি তা করিনি। কেন জানেন? আপনি আমার স্বামীর জননী জন্মধাত্রী। তাই। মায়ের গুরুত্ব ও মর্যাদা আমার কাছে সর্বশ্রেষ্ঠ! তাই বলে এটা ভাববেন না যে, সামনের সময়গুলোতে এমন করলে চুপ থাকবো।”

কথাগুলো একটানে বলে ধীর পায়ে শিখা তাররুমে চলে যায়। ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিলো। বিছানার এক কিনারায় বসলো দু’হাত দুদিকে ছড়িয়ে রেখে। তার বুকের হৃৎস্পন্দন পারদের ন্যায় গড়াগড়ি খাচ্ছে কি এক অজানা দুর্ভাবনায়। বহু প্রশ্নবাণে নিজের অন্তরটাকে ঝালাপালা করে ফেলছে সে। রাজের দুই সত্তা? তার জেদ এত বন্য? এত হিংস্র! এত ক্ষ্যাপাটে? ভেবে কোন থইয়ের নাগাল পায় না শিখা।
জেলার সবচেয়ে বড় সরকারি সদর হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগে রানিকে ভর্তি করা হলো। ডাক্তাররা দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দিলো। হাতের কাটা অংশ ব্যান্ডেজ করে দিলো র*ক্ত বের হওয়া বন্ধ করে। কাটার কারণ হিসেবে জুবায়ের অকপটে তাদের বলল,
“রান্নাঘরে কাজ করার সময় হাতের পাতায় শিলপাটা পড়েছে। অসহ্যকর যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে সে নিজেই নিজের হাতের কবজি কেটে ফেলল কেউ দেখার আগেই। আমাদের গাছের ডাল কাটার দা ছিলো সেটা। খুব ধারালো দা। তাই এক কোপেই আলগা হয়ে গেলো। আর এক কোপে গাছের ডাল কাটার অভ্যাস ভাবির বহু পুরনো। লোহার ব্যথা কেমন তা আপনারা আমার চেয়ে ভালো জানেন।”

ডাক্তার বলল,
“ভেরি স্যাড! ভেরি স্যাড!”
সার্জন অভিজিত সরকার জুবায়েরকে বললেন,
“রিকনস্ট্রাকশন সার্জারি করলে সফল হতে পারে। তবে ঢাকায় নিয়ে যেতে হবে। এখানে হবে না।”
“তাহলে কি আমরা ঢাকায় নিয়ে যাবো পেশেন্টকে?”
” হ্যাঁ ইমিডিয়েটলি এম্বুলেন্সে করে নিয়ে যান ঢাকা মেডিক্যাল হসপিটালের বার্ন ইউনিটে।শরীর হতে বিচ্ছিন্ন কবজি স্বাভাবিক তাপমাত্রায় ৬ ঘণ্টা ভালো থাকে। আর পাশে বরফের প্যাকেট থাকলে ১২ ঘণ্টা ভালো থাকে। যতই ঝুঁকি থাকুক রিকনস্ট্রাকশন সার্জারি করার কথা চিকিৎসাশাস্ত্রেই বলা আছে। অন্যান্য ক্ষেত্রে ঝুঁকি বেশি থাকলে সাধারণত অস্ত্রোপচার করা হয় না।”
“আচ্ছা আমরা সেই হিসেবেই নিয়ে যাবো।”

“ওকে। আশাকরি অস্ত্রোপচার সফল হবে। যেহেতু আপনারা দেরি করেন নি পেশেন্টকে নিয়ে আসতে।”
জুবায়ের এম্বুলেন্স ঠিক করলো তার ঘনিষ্ঠ দুই বন্ধুর সহযোগিতা নিয়ে। বরকতকে ও জোছনাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলো। বাড়িতে তাদেরকে সারাদিন কাজে লাগে। পাশাপাশি সেও বাইক চালিয়ে বাড়ি এলো। সবাইকে সব জানালো। যেহেতু ঢাকায় থাকতে হবে,তাই ডলি যাবে রাজের নির্দেশে। ডলি নিজের ও রানির প্রয়োজনীয় পরিধেয় কাপড় চোপড় গুছিয়ে নিলো তোড়জোড় করে। তখন রাত দশটা বাজে।
জুবায়ের রাজের রুমে গেলো উপরে।
রাজকে বলল,
“তোর দুঃসাহসের তারিফ করতে হয়। ওরেবাপ্পস! দিনে দুপুরে কি খেলটাই না দেখালি দোস্ত!”
রাজ জুবায়েরের কলার চেপে ধরে। শক্ত চোয়ালে বলে উঠে,

” তবুও তোর চেয়ে পিছিয়ে আছি ইয়ার। আমিতো মাত্র একটা হাতের কবজি কেটেছি অপরাধীর। আর তুই? দুই দুটো জ্যান্ত মানুষকে মেরে ফেললি। তার পর ড্রামা সাজালি তাদের মৃত্যু নিয়ে। অভিনয় এতো চমৎকার হলো, দুই পরিবারের সহজ সরল মানুষ তা নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করে নিলো।”
“তাতো তোর শিখার জন্য। এবং পরিবারের কথাই ভেবে!”
“হ্যাঁ আমার শিখার জন্য। তখন কি যেন একটা বলতে চাইলি ইঙ্গিতে?”
“বলতে চাইছি,তোর এমন রূপ দেখে শিখা আবার ভুল বুঝে বসবে নাতো?”
“কেন ভুল বুঝবে? তারজন্যই তো এমন নির্মম শিক্ষা দিতে বাধ্য হলাম।”
“না বুঝলেতো ভালোই। আচ্ছা যাই। এম্বুল্যান্স নিয়ে ওরা অপেক্ষা করছে। তুই আমাদের সাথে এখন যাবি? গেলে ভালো হয়। ঢাকার বিষয়গুলো আমার চেয়ে তুই ভালো হ্যান্ডেল করতে পারবি।”

“আমি যাব না ওই কালপ্রিটের হাত ভালো করায় ভূমিকা রাখতে। আমি একদিন পর যাবো। যেতে শিখাকে নিয়ে যাবো ঢাকায়। কি রকম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এটা নিশ্চিত হতে হবে। সেই হিসেবে তাকে বাইরে নিয়ে যাবো দরকার হলে। কাল আমার অফিসে টেলিফোন করে বলে দিব। স্টাফরা মেডিক্যাল গিয়ে তোকে হেল্প করবে। কেবিনের ব্যবস্থাও করবে তারা। আমি সেট করে দিবো সব তাদের বলে।”
তারপর জুবায়ের, ডলিকে নিয়ে চলে যায় হাসপাতালের দিকে। রাতে আদুরী ছাড়া বাকি সবাই একসাথে নৈশভোজ সারলো বিষাদমুখে। কেউ কারো সঙ্গে কোন কথা বলল না। শিখা উঠে নিজের রুমে চলে গেলো। রাজের খাওয়া পরে শেষ হলো। সে শিখার রুমে গিয়ে বলল,
“তাড়াতাড়ি উপরে আসো। ঘুম পাচ্ছে আমার।”

শিখা মৌন রইলো। রাজ পরনের সাদা লুঙ্গিটার একপাশ খানিক তুলে ধরে নবাবী ধাঁচে হেঁটে গেলো দোতলার দিকে। শিখা দরজায় এসে রাজের হাঁটা দেখতে লাগলো মুগ্ধকর চোখে। রাজের এই হাঁটার ধাঁচ তার
ভালোলাগে।
তার পিছন দিয়েই শিখা উপরে দোতলায় গেলো। পালংকের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে বসলো। এবং বলল,
“আপনার ঘুম আপনি যাবেন। আমার কাছে কি?”
রাজ তার খোলা বুকের উপরে শিখাকে তুলে নিলো। ঘোর লাগা চোখে তাকিয়ে বলল,

“মেজাজ টগবগে ফুটন্ত পানির মতো। শীতল করতে হবে। কিছু একটা খেতেও হবে। শরীরে মনে হয় ভিটামিনের অভাব। আমার রঙিন প্রজাপতি, তোমার ভরপুর চঞ্চলতা দিয়ে এই তৃষিত দেহমনকে সিক্ত করো। সুখী করো।”
রাজ শিখাকে ভুলাতে চাচ্ছে এসব বলে। কিন্তু শিখা ভুলে না৷ শিখা প্রশ্ন ছুঁড়ে মারে,
“পেশাদার কসাইয়ের মতো ভাবির হাত কিভাবে যে এককোপে আলাদা করে ফেললেন। উফফস!”
রাজ শিখার নিটোল বুকের ভাঁজে হাত চালাতে চালাতে বলল,
“আমার জায়গায় তুমি হলে কি করতে? বলো?”
“আমি তাকে মেরেই ফেলতাম ডাইরেক্ট।”
রাজ চট করেই শিখাকে পাশে শুইয়ে দেয়। শিখার মাথাকে নিজের বাহুর উপর টেনে নিলো। নিজের এক পা দিয়ে শিখাকে পেঁচিয়ে ধরলো। বলল,

“একজেটলি। তুমি যখন সেদিন টেলিফোনে বললে,কোন অঘটন হলে যেন তোমাকে দায়ী না করি। তখনই আমি তোমার ভিতরে বারুদ জ্বলার গন্ধ পেয়েছি। আমার বউর নামের পাশে খু*নীর তকমা যেন না লেগে থাকে। তাই তোমার হয়ে আমি পানিশমেন্ট দিয়েছি তাকে। আবার জোড়া লাগাতে বলেছি পারিবারিক ঐতিহ্যের নানানদিক ভেবেই। নয়তো চারদিকে ধিক ধিক রব পড়ে যাবে। তালুকদারের বড় পুত্রবধূর হাত নেই বলে। তবে তাতে তোমার নূন্যতম ক্ষতি হবে না আর। এটা জেনে রাখো। সারাজনমের জন্য সে সরলরেখার মতো চলবে সে। বাকি দুজন, আদুরীও শিক্ষা পেয়ে গিয়েছে।”
” হুম। তবে সেই বিষয় জানার পর হতে মেজো ভাবি এমনিতেই এখন ভালো ব্যবহার দেয় আমাকে। পছন্দ না করলেও অপছন্দ যে করে না,তা সত্যি।”

“তাহলেতো খুবি ভালো। এভাবে দেখবে একসময় সবাই তোমাকে পছন্দ করবে।”
“হাত সরান না। কি ফাজলামো করছেন?”
“সমস্যা কি? কমে যাচ্ছে নাকি? মুখ দিয়ে কথা বলছি। হাতের কাজ হাত করছে।”
“আচ্ছা, আপনার রুমে চাকু থাকে কেন?”
কৌতুহলমাখা চোখে জানতে চাইলো শিখা।
রাজ হোহোহো করে হেসে উঠলো। বলল,
“নিরাপত্তার জন্য আমাদের ঘরের প্রতি রুমেই এমন ধারালো অস্র রয়েছে। জুবায়েরের রুমেও আছে। আগে অনেক চোর,ডাকাত প্রবেশ করতো বাড়িতে। একটা ঘটনার পর থেকে এটা প্রায় কমে এসেছে। বুঝলে এবার?”
শিখা বুকে হাত দিয়ে স্বস্তির দম ফেলল। বলল,
” তখন না বুঝলেও বুঝলাম এবার। আমার আম্মাকেও দেখতাম বিছানার কাছে দা,ম্যাচ,হারিকেন রেখে ঘুমাতো রোজ।”

“তোমাকে আমার সঙ্গে কাল ঢাকায় নিয়ে যাবো। একজন বিশেষজ্ঞ দেখাবো। সত্যিই কি তোমার মা হওয়ার ক্ষমতা নষ্ট হয়েছে কিনা জানতে হবে।”
“আমার কোচিং, ক্লাস?”
“দু’ তিনদিনে কিছু হবে না। লেট এত বড় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে একদিনও অপেক্ষা করতে রাজী নই আমি। স্যারদের কাছে বলে এসো কিছু একটা।”
“আচ্ছা।” বলে সায় দিলো শিখা।
“আসো দু’জন দুজনাতে যাই মিশে, যেমন করে নদী মিশে ওই মোহনাতে।”
রাজের হৃদয়ে অশান্ত ঝড় শুরু হয়। সেই ঝড় থামে শিখার রাঙা অধরযুগলের নিবিড় ছোঁয়ায়।
তালুকদার বাড়ির পরিবেশ অস্থিতিশীল। যেন একসঙ্গে জোড়ায় জোড়ায় লা*শ পড়েছে। প্রতিটি মানুষের মাঝেই চাপা উত্তেজনা ও আতংক বিরাজ করছে। রাজের দিকে সবাই ভীত লুকানো চোখে তাকাচ্ছে।
রাজ শিখাকে নিয়ে ঢাকায় চলে গেলো।
একটি হোটেলে উঠলো দুজন।

সে শিখাকে জিজ্ঞেস করলো,
“এর আগে আর কখনো ঢাকায় এসেছো?”
“নাহ। তবে ছোটবেলায় আম্মার সাথে এসেছি। নানু হাসপাতালে ভর্তি ছিলো তখন।”
“তোমাকে আমার বাসায় নিয়ে যাইনি। একবারে নতুন করে আনবো তোমাকে। আর সেখানে আমি বেরিয়ে গেলে তুমি একা ভয় পাবে খালি বাসায়। এখানে আমি চলে গেলেই পাশাপাশি রুমে আরো ফ্যামিলি আছে। দায়িত্বরত লোকজন আছে। লোনলি ফিল হবে না তোমার।”
“আচ্ছা।”
রাজ বড় ডাক্তার দেখালো শিখাকে। ডাক্তার পরিক্ষা নীরিক্ষা করে জানালো তেমন ক্ষতি হয়নি। কিছু মেডিসিন দিয়ে বলল,
“লেট করেন নি তাই রক্ষা। যতটুকু বিষক্রিয়া হয়েছে জরায়ুতে,এই মেডিসিনগুলো খেলে তা রিকভার হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।”

শুনে রাজের মুখ খুশীতে ছলছল করে উঠলো। কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে ডাক্তারকে ধন্যবাদ জানালো। আল্লাহর প্রতি কোটি শুকরিয়া আদায় করলো। পরেরদিনই শিখাকে নিয়ে একটি এতিমখানায় গেলো। তার হাত দিয়ে এতিম বাচ্চাদের জন্য বেশ পরিমাণ অর্থ প্রদান করলো। সেখান থেকে শিখাকে নিয়ে মলে গেলো। শিখার পছন্দে দুটো থ্রিপিস,স্যান্ডেল ও ভ্যানিটিব্যাগ কিনে দিলো।
হোটেলে এলে শিখা রাজকে অনুরোধ করে বলল,
“সকালে আমাকে বাড়িতে দিয়ে আসেন। আর তো থেকে কাজ নেই। আমার পড়াশোনার ক্ষতি হচ্ছে। ডাক্তার দেখানো ত শেষ হলো।”
“উমমম! আমার ত কাজ আছে। ড্রাইভার দিয়ে তোমাকে পাঠাতেও মন চাচ্ছে না। আচ্ছা আমিই নিয়ে যাবো।”
শিখা রাজের বুকে মাথা রাখলো। বলল,
“মন চায় সারাক্ষণ আপনার সাথে গল্প করি। কিন্তু যেতে ত হবেই।”
শরতের মিষ্টি সকাল। রাজধানীর পিচঢালা ব্যস্ততম পথ মাড়িয়ে চলে যাচ্ছে কত রকমের,কত পেশার যানবাহন ও মানুষ। রাজ ড্রাইভ করছে তার জিপ। শিখা তার পাশের সিটে বসে আছে। তার উৎসুক চাহনি জিপের কাঁচ ভেদ বাইরে। রাস্তার দুপাশের দোকানপাট,কল কারখানা, কাঁচা বাজার,শপিংমল রঙ বেরঙের সবকিছুতেই শিখা অনাবিল ভালোগালা খুঁজে পেলো। জিপের মধ্যে চমৎকার একটি গান বেজে চলছে।

‘মাঝ রাতে চাঁদ যদি আলো না বিলায়
ভেবে নেবো আজ তুমি চাঁদ দেখোনি
আকাশের নীল যদি আধাঁরে মিলায়
বুঝে নেবো তারে তুমি মনে রাখোনি।’
রাজ শিখার দিকে চেয়ে বলল,
“এই মেয়ে বাইরে কি দেখছো ব্যাকুল হয়ে? গান শুন না? ‘অবসিকিউর’ ব্যান্ডের টিপুর ভোকালে গাওয়া এই গানটা আমার দারুন প্রিয়।”
শিখার দৃষ্টি তখনো বাইরে। সে ছোট্ট শিশুর নতুন পৃথিবী দেখার মতো করে জ্বলজ্বলে চোখে বাইরের সবকিছু দেখছে। সে মায়া মায়া স্বরে বলল,
“কান দিয়ে শুনছি,চোখ দিয়ে দেখছি।”
“কপি করলে নাহ? দুস্ট কোকিল কোথাকার।”
হুম বলে শিখা রিনরিনিয়ে হেসে ফেলল।
চলন্ত গাড়ির ভিতর থেকে সব দেখতে দেখতে শিখার দৃষ্টি থেমে গেলো একটি মাঝারি সাইজের বিলবোর্ডের উপরে। শিখা চমকানো গলায় বলে উঠলো,

রাজবধূ পর্ব ৫৭

” এই গাড়ি থামান। থামান না। একটু পিছনে নিন না।”
রাজ বুঝতে পারলো। সে জিপ চালিয়ে নিতে নিতে বলল,
“আহ বাটারফ্লাই! কি হয়েছে বলো? ছেলেমানুষী করছ কেন? মাঝপথে কিভাবে গাড়ি থামাবো?”
“একটা বিলবোর্ডে আপনার ছবি দেখলাম। দুই কাঁধে দুটো মেয়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আপনি মডেল? বলেন?”
অবিশ্বাস্য ও বিস্ময়ভরা চোখে রাজের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলো শিখা।
রাজ মনে মনে উচ্চারণ করলো,
” যেখানে বাঘের ভয়,সেখানে রাত হয়। হায় খোদা! সহায় হও।”

রাজবধূ পর্ব ৫৯