রাজবধূ পর্ব ৬৬

রাজবধূ পর্ব ৬৬
রেহানা পুতুল

বিষম খেল রাজ। একি! শিখার চিঠি নয় এটা। এই হাতের লেখা তার অতি পরিচিত। অতি চেনা। জুবায়েরের হ্যান্ডরাইটিং এটা। রাজ তার ভাবান্তর চিত্ত নিয়ে চিঠিটি পড়তে শুরু করলো।
“কেমন আছিস জানতে চাইবো না। কারণ আমি জানি তুই আমার চেয়ে ভালো আছিস। ভালো থাক এটাই আমার অনন্ত প্রার্থনা তোর জন্য। তুই যখন এই চিঠি পড়ছিস, তখন আমি তোর থেকে হাজার মাইল দূরে। আসলে দোস্ত,ব্যক্তিগত কারণে আমি আমি ভালো নেই। তুইতো জানিস সেটা। সেই মেয়েটাকে মাঝে মাঝে মার্কেটে দেখি। হাজব্যান্ডের হাত ধরে শপিং করছে। ঘুরছে।

তখন ভিতরটা জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যায়। অবশ্য তুই এটা অনুধাবন করার কথা নয়। কারণ তুই আমার স্থানে নেই। তুই পারিবারিক নিয়মে বিয়ে করেছিস পিতার পছন্দে। তারপর বউকে ভালোবাসতে শুরু করলি। যাক, সবই লাক। তাকে ভুলে থাকার জন্যই বাইরে চলে আসলাম। তোকে আগে জানালে কিছুতেই আসতে দিতিনা। এটা নিশ্চিত। তাই লুকিয়ে চলে আসলাম। ভুল বুঝিস না আমাকে। বাড়িতে এখন বাদশা আছে। ইনশাআল্লাহ শিখার বা অন্যদিকে কারো কোন সমস্যা হবে না আশাকরি। আর শিখার মাঝেও দিনে দিনে ম্যাচুরিটি বাড়ছে। এটা খুবই ভালো। ও হ্যাঁ দোকান আগের মতই চলবে ম্যানেজারের দায়িত্বে। তোর কাছে বিশেষ অনুরোধ, আমার মাকে দেখে রাখিস। খোঁজ খবর নিস। আর কি লিখবো। তোদের সবাইকে খুব মনে পড়ছে। ভালো থাকিস।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ইতি জুবায়ের।”
রাজের আশ্চর্যের সীমা রইলো না। গলায় বিস্ময়ের ঝাঁপি ঢেলে নিজে নিজে বলল,
ওহ মাই গড! এতো দেখি পুরাই দেবদাস হয়ে গেলো। কোন এক হুর-পরীকে মন দিয়ে মজনু হয়েছে আল্লায় জানে। তুই সত্যিই একদিন মরবি শালা। দেখিস। পাগলামির একটা লিমিট থাকা চাই। নিজের মা,বাড়িঘর, দেশ ছেড়ে নিজেকে নির্বাসনে পাঠালি? বলদ কোথাকার! এজন্যই এই শীতে তুই সবাইকে এক করেছিস। বুঝলাম।
কথাগুলো আওড়ে নিয়ে বাঁকা হাসলো রাজ। চিঠিটা ডেস্কে রেখে নিজের কাজে মনোনিবেশ করলো।
রাতে সবাই ঘুমিয়ে গিয়েছে। আমেনাও বসে বসে পান চিবোচ্ছে। শিখা জুবায়েরের রুমে গেলো। ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিলো। চেয়ার টেনে বসলো। টেবিলের একপাশে থাকা ক্যাসেট প্লেয়ারে জুবায়েরের রেকর্ড করা অডিও ক্যাসেটটি ঢুকিয়ে নিলো। ভলিউম স্লো করে সুইচ অন করলো। টেবিলের উপরে মাথা পেতে শুয়ে কান পেতে রইলো নিবিড়চিত্তে। তার আর ক্যাসেটের দূরত্ব মাত্র কয়েকইঞ্চি। আঁখিজোড়া বন্ধ করলো শিখা। শুনতে লাগলো জুবায়েরের অব্যক্ত প্রণয়গাঁথার নিদারুণ ইতিহাস।

“সাল উনিশশো আটাশি। মধুপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার অনুষ্ঠান চলছে। উজানপুর গ্রামে আমাদের একটা ক্লাব ছিলো ‘যুবসংঘ’ নামে। সেই সুবাদে ক্লাবের পরিচালক হিসেবে স্কুল কমিটির পক্ষ হতে আমন্ত্রণ পাই। এবং টিচার ও যুবকদের সাইকেল প্রতিযোগিতা, স্কুলের দিঘিতে সাঁতার প্রতিযোগিতা,এসবের আয়োজন করি আমরা ক্লাবের যুবক বন্ধুরা।
যাইহোক, একটা খেলা ছিলো
‘যেমন ইচ্ছে তেমন সাজো’ নামে। তুমি সেজেছিলে নতুন বউ। টুকটুকে লালশাড়ি পরেছিলে বা হয়তো অন্যকেউ পরিয়ে দিয়েছিলো।
তোমার স্নিগ্ধ লাস্যময়ী কচি মুখখানা দেখেই আমার ভিতরে আকস্মিক এক অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করেছে। হয়তো প্রেম এভাবেই আসে জীবনে বুনোফুলের সুবাস নিয়ে। মনে হলো স্বর্গ থেকে কোন অপ্সরা মর্ত্যে নেমে এসেছে ভুল করে। সেই প্রতিযোগিতায় হেরে যাও তুমি। মাঠের একপাশে দাঁড়িয়ে ফ্যালফ্যালিয়ে কাঁদছিলে। তখন অন্য একটা মেয়েকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম,

” এই মেয়েটা কাঁদছে কেন? কি হয়েছে তার?”
মেয়েটি জানালো,
“ও জিতেনাই। তাই কাঁদছে।”
“কিসে পড়ে ও?”
“আমার সাথেই। অষ্টম শ্রেণীতে।”
তখন তোমার জন্য আমার ভিতরে এক ধরনের মায়া অনুভব করি। মনে হলো কোন অচিন রাজ্যের দুঃখী রাজকন্যা তার খেলার সাথী রাজকুমারকে হারিয়ে কাঁদছে। তোমার স্কুলের অফিসে মাঝে মাঝে যাওয়া পড়তো। গেলেই অষ্টম শ্রেনীর ক্লাসের জানালায় উঁকি মেরে দেখতাম তোমাকে। বলতে পারো, আমার যৌবনের প্রথম প্রভাতে তুমি ছিলে সুগন্ধি বিলানো ঝরা বকুলের মতো। এভাবে তোমাকে স্কুলে গিয়ে মাঝে মাঝে দেখি। তুমি আমাকে কখনো দেখনি। ইচ্ছে করেই ধরা দেইনি।আমার হিসেবটা ছিলো, তুমিতো ছোট। একটু বড় হও। বা আরো দুটো বছর যাক। তারপর বলবো, তোমাকে ভালোলাগে,তোমাকে ভালোবাসি। এভাবে তোমাকে স্কুলে আসা যাওয়ার সময় দূরে থেকে,আড়ালে থেকে দেখতাম। ফ্রক পরা তুমি দুই বেনী দুলিয়ে ছন্দে ছন্দে হাঁটতে। বান্ধবীদের সাথে কথা বলতে বলতে রিনিরিনিয়ে হেসে উঠতে তুমি। তোমার হাসিতো নয়,যেন শত মুক্তা ঝরে পড়তো।

তখন বুকের অতলে কি যে সুখ সুখ লাগতো তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। এভাবে কয়েকমাস কেটে গেলো। তোমার সম্পর্কে খোঁজ খবর নিলাম। জানলাম তোমার নিয়তির গল্প। হতাশ হই। বাড়িতে এসে মাকে বলি। শুনে মা কি বলল,তাতো মায়ের চিঠিতেই জেনেছো।
বিশ্বাস করো শিখা,ওই খোদার নামে শপথ করে বলছি ,তারপর তোমার কথা ভেবেই আর তোমাকে বলা হয়নি। কারণ তোমাকে বললে হয়তো তুমিও আমার প্রেমে পড়ে যেতে। কিন্তু পরিণতি হতো জিরো। উঁচু নিচুর বৈষম্য আমার বাবা করতোই। আর তখন তোমার মা ও তুমি ধরে নিতে ধনীর ছেলে গরিবের মেয়ের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। মন নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে। তাই আর বলিনি। কিন্তু তোমার প্রতি আমার অনুরাগ,আবেগ,আকুতি,সব একইভাবে আছে। অন্য কোথাও আমার জন্য পাত্রী দেখলে মানা করে দিতাম। মৌনাকাশে কেবল তোমার সেই মায়াবী মুখখানি ভেসে উঠলো রঙধনুর মতো।

তারপর যখন বিয়ে করবো বলে সিদ্ধান্ত নিলাম। তখনই ঘটে গেলো ভয়াবহ ঘটনা। রাজের বিয়ের বরযাত্রী হয়ে যাই তোমাদের বাড়ি। রাজের বউ হিসেবে তোমার পরিচয় জানতে পারি। তার আগে তোমার সম্পর্কে যতটুকু জেনেছি সেটা তোমার স্কুল থেকেই। কিন্তু তুমি মীর বাড়ির মেয়ে, এটা জানতাম না।
তোমাদের বাড়িতে থাকতেই আমি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ি। বিশ্বাস করো শিখা,এত ভয়ানক কষ্ট লেগেছে এটা অবর্ননীয়! অকল্পনীয়! মনে হলো রাজ বা তুমি নিজে আমার বুকের পাঁজরগুলো হাতুড়ি দিয়ে ভেঙ্গে গুঁড়ো গুঁড়ো করে দিচ্ছো। দুঃখ আমার একটাই লেগেছে, যেই পরিবারের কথা ভেবে চুপ হয়ে গেলাম। সেই একই পরিবারে তুমি বউ হয়ে গেলে। সেদিন সারারাত বাড়িতে ছিলাম না। নেশায় বুঁদ হয়েছিলাম বাইরে। সবার সঙ্গে ভান করা হাসি দিয়ে চলছি। কিন্তু আমার হৃদয়ভূমিতে থরে থরে নীল বিষাদ স্তুপাকারে জমা হয়ে গেলো। নিজের অজান্তেই আমার মত পালটে যায়।

আমার প্রেমিক সত্তা জানিয়ে দেয়,তুই অন্য মেয়েকে বিয়ে করে সুখী হবি না। সেই মেয়ের জীবন নষ্ট হবে। তুই সেই মেয়ের বুকে মাথা রেখে কল্পনা করবি শিখাকে। তুমি যদি আমাদের ঘরের বউ না হতে,তাহলে আমার এত নরক যন্ত্রণা বইতে হতো না। যেদিন তোমাদের বাসর হয়,সেদিন ইচ্ছে করেই বের হয়ে গিয়েছি। সারারাত মদ গিলেছি তোমার বিরহে। সকালে বাইক এক্সিডেন্ট করি। যেদিন তোমাকে নিয়ে কাকাকে দেখতে গেলাম রাতে। সেদিনও একই সমস্যা হয়েছে তোমার সান্নিধ্য পেতেই। তাই নেমে সিগারেটের ধোঁয়ায় গোপন ব্যথাগুলোকে উড়িয়ে দিয়েছি তৎক্ষনাৎ! চোখের সামনে তুমি। সেজন্যই আমার এই সীমাহীন দুর্ভোগ! আর তোমাকে দেওয়া সব চিরকুটের মালিক আমি। রাজ হাতের লেখা ধরতে পারেনি। কারণ আমি কয়েকরকমের হাতের লেখা রপ্ত করে নিয়েছি তার আগেই।
শোন, রাজ এসবের কিছুই জানে না। তোমার নিজের ভালোর জন্যই তা সারাজীবন গোপন রাখবে।

আমার এই বিষাদের গল্প মাত্র দুজন ব্যক্তি জানে। তুমি আর মা। সন্তানের দুঃখ,বেদনার কথা মায়ের জানার অধিকার আছে। আর যার জন্য আমার এই ছন্নছাড়া জীবন। তারও জানার অধিকার আছে। নয়তো একদিন আমি বা তুমি মরে যাবো। কিন্তু তুমি জানতেই পারলে না,এই পৃথিবীতে এমন একজন মানুষ আছে। যে তোমাকে রাজের চেয়েও অনেক বেশী ভালোবাসে। তুমি তার হয়ে আছো রাজের হয়ে যাওয়ার পূর্ব থেকেই। সে নিজের জীবনের রিস্ক নিয়ে দুজন মানুষকে মেরে ফেলল শুধু তোমার জন্যই। ধরা পড়লে তার ফাঁসী কিংবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারতো।

আরেহ শিখা! তোমাকে তো আমি ভালোবাসি কতটা বছর ধরেই। আর রাজ? সেতো ভালোবাসে তুমি তার স্ত্রী হওয়ার পরে। সে স্বামী। তাই ভালোবাসতে বাধ্য। এটা চিরাচরিত নিয়ম। আর আমি? তুমিতো আমার কেউ ছিলে না। আজও কেউ নই। কোনদিনও আমার কেউ হবে না। সেটা আমি চাইও না। তবুও ভালোবেসেছি,ভালোবাসি,ভালোবেসে যাবো অনন্তকাল। তাহলে বল কে মহান? আমি না তোমার রাজ? রাজ আমার প্রাণের দোস্ত। তুমি আমার প্রাণের কিশোরী। ফুলে ফুলে সিক্ত হোক তোমাদের যুগল জীবন।
চিঠি দুটো ছিঁড়ে ফেলে দিও। অডিও ক্যাসেটের ফিতা টেনে বের করে পুড়ে ফেলো। নয়তো কোনভাবে রাজ টের পেলে তোমার ভালোথাকা হবে না আর হয়তো। যাকে নিজের জীবনের চেয়েও বেশী ভালোবাসি। তার সুস্থ থাকা, সুখে থাকাটাই আমার একান্ত কাম্য।

ভালোবাসা যদি অপরাধ হয়,ক্ষমা করো আমায়। বেঁচে থাকলে আমাদের দেখা হবে। বিদায় আমার কিশোরী।”
মানবিকবোধের জায়গা থেকে শিখার চোখজোড়া অশ্রুসিক্ত হয়ে গেলো ক্ষণিকের জন্য হলেও। জুবায়েরের খালি বিছানার দিকে অপলক চোখে চেয়ে রইলো মিনিট খানেক। অচল পায়ে বেরিয়ে গেলো জুবায়েরের রুম হতে। ওয়াশরুমে গিয়ে চোখেমুখে পানির ঝাপটা মারলো। ঘুমন্ত আমেনার পিঠ ঘেঁষে শুয়ে পড়লো। চিঠি দুটো ছিঁড়ে কুটিকুটি করে ফেললো। ক্যাসেট রেখে দিলো।

দিনে নষ্ট করবে। শত চেষ্টায়ও আঁখিজোড়ায় ঘুম নামাতে পারলো না সে। জুবায়েরের কথা কল্পনা করতেই সে স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে। এমন নিঃস্বার্থ প্রেমিক সে আর কাউকেই দেখেনি। কাউকেই না। ভালোবাসা মানুষকে কতটা মহান করে তোলে। তার যেন জ্বলন্ত উদাহরণ জুবায়ের।
শিখা নিজেকে সামলে নিলো। বয়সের দোষে আবেগকে প্রশ্রয় দিলে চলবে না। সে রাজের বউ। তার সমস্ত অনুভূতি, আকাঙ্খা, আকুতি একমাত্র রাজের জন্যই। দ্বিতীয় কারো জন্যই না। সে অন্য কারো জন্য প্রথম হতে পারে। বিশেষ হতে পারে। শ্রেষ্ঠ হতে পারে। কিন্তু তার এসব কিছু শুধু একজন পুরুষ। তার স্বামী নওশাদ তালুকদার রাজ।
শিখা বাদশার সঙ্গে দেখা করলো নিরিবিলি। বলল,
“বাদশা ভাই,উনি বাড়ি আসবে। আমাকে ঢাকা নিয়ে যাবে। আজগর দাদার হত্যাকারীদের কিভাবে সাজা দেওয়া যায় ভাবছেন?”

“ভাবি, এই দুইটা পালোয়ানরে হুট কইরা শাস্তি দেওন যাইব না। প্ল্যান কইরা করতে হইবো। টাইম লাগবো। আপনে চইলা যান শহরে। সমস্যা নাই। আপনি কি আর বাড়ি আইবেন না? থাকবেন না? শাস্তি দেওন যাইবো। আর যদি সম্ভব হয় আমিই শাস্তি দিমু আপনের বদলে।”
“তাহলেও চলবে। আপনার শাস্তিতো আবার ডাইরেক্ট একশান। একবারে ওপারে পাঠিয়ে দেওয়া। অতি সাবধানী হয়ে করতে হবে। আমি হলে অন্যভাবে দিতাম শাস্তি। খু*নাখু*নিতে আমি নাই।”
ঠোঁট ভিড়িয়ে চাপা হাসি হেসে বলল শিখা।

বাদশা গাড়ির ব্রেকফেলের মতো নড়ে উঠলো। ‘ভাবি’ বলে মৃদু আর্তনাদের মতো শব্দ করে উঠলো। শিখা কিছু বলল না। চলে গেলো নিজের রুমে। বাদশা নির্বাক চোখে চেয়ে রইলো শিখার যাওয়ার দিকে।
শিখা এক বিকেলের দিকে তালুকদারের সাথে দেখা করলো। নমনীয় গলায় বললো,
“বাবা,আপনার ছেলে আসলেতো আমি চলে যাবো। মনসুর কাকাদের জমিটা যদি ফিরিয়ে দিতেন।”
“অবশ্যই দিমু। তুমি চইলা যাইও। সমস্যা নাই। তোমার কিছু করণ লাগবে না আর। আমি মনসুররে খবর দিয়া আনাইতাছি। কিন্তু খায়রুল যে তাদের ঠকাইছে। সব টাকা দেয়নাই। এইসব জাইনতে পারলে ভালো হতো।”
“আপনি অসুস্থ হয়ে যাবেন এখন সেসব শুনলে।”
“কিছুই হইবো না। কও।”

“তাহলে আসেন। সবাইকে বুঝাবেন এমনিতে আমাকে নিয়ে হাঁটতে বের হয়েছেন।”
তালুকদারকে নিয়ে শিখা সেই বাগানে চলে যায়। কবরটি দেখিয়ে বলে,
“এই কবর কার এখানে? জানেন?”
তালুকদার আতংকিত চোখে কবরটার দিকে চেয়ে বলে,
“নাতো? এই ঝোপঝাড়ের মাঝে এই কবর কার? কবে থেইকে? কে দিলো?”
শিখা সব বলল। ঘৃণায়, লজ্জায় তালুকদারের মাথা কাটা পড়লো পুত্রবধূর সামনে। আধভাঙ্গা স্বরে বলল,
“চাচার মতো হারামী হইছে। তাদের দুইটারেও জিন্দা মাইরা ফালাইতে মন চাইতাছে। কত ভালো লোক ছিলো আজগর।”

“বাবা দয়া করে আপনি শান্ত হোন। আপনি শারীরিকভাবে এখন খুব নাজুক অবস্থায় আছেন। সবল দুই ছেলের সঙ্গে পেরে উঠবেন না। তাই উনাদের বুঝতেও দিবেন না আপনি যে এটা জেনেছেন। জমির বিষয়টাতো জেনেই যাবে। সেটা বলবেন যে,তারা আপনার কাছে এসে সব বলেছে। আপনি তাদের জমি ফিরিয়ে দিয়েছেন। ব্যাস। তবে মনসুর কাকারেও বলবেন না কবরের বিষয়। তারা জানে তারা বাবা নিখোঁজ।”
“কিন্তু তারা কেন মারলো তারে? এটাইতো বুঝলাম না?”
“বাবা,এটা কেউই জানেনা। এটার উত্তর একমাত্র তারা দুইভাই দিতে পারবে।”

তালুকদার আর দেরী করলো না। মনসুরকে ডেকে পাঠালো। স্ট্যাম্প রেডি করতে বললো।
দুবাইতে জুবায়ের ট্যুরিস্ট ভিসায় গিয়েছে। হাত খরচের জন্য যে তার একটি ডিপিএস তুলে নিয়েছে। হারিস নামে তার এক বন্ধুর বাসায় উঠেছে সে। একদিন রাতে জুবায়েরেরকে নিয়ে হারিস একটি বার এন্ড নাইটক্লাবে গেলো। উদ্দেশ্যে জুবায়েরের বিষন্ন মনকে একটু প্রফুল্ল করা। সব ভুলিয়ে দেওয়া কিছু সময়ের জন্য হলেও। যেখানে নারী পুরুষ অবাধে মদ গেলা যায়। ফূর্তি করা যায়। জুবায়ের মদের গ্লাসে কয়েক চুমু দিতেই তার সামনে একটা যুবতী মেয়ে চলে এলো। মেয়েটির হাতেও মদের গ্লাস। মিনিস্কার্ট পরা মেয়েটিকে দেখতে বাঙালী মনে হলো। মেয়েটি জুবায়েরের কাঁধের উপর হাত রাখলো। বলল,
“হেই লাভার বয়,কাম অন,কিস মি প্লিজ।”

বলেই মেয়েটি জুবায়েরের গালে চুমু খেয়ে বসলো। জুবায়ের গ্লাস থেকে ঠোঁট সরিয়ে নিলো। মেয়েটির দিকে ক্রুর চোখে চাইলো। চড় বসাতে যাবে,অমনি হারিস জুবায়েরের হাত ধরে থামিয়ে দিলো। বলল,
“তুই এখানে নতুন। ঝামেলায় যাসনা। এই বারে এসব খুবই সিম্পল। একটু অপেক্ষা কর,দেখবি এই মেয়েটাই কয়টা পুরুষের কোলে উঠে দুলছে। মাস্তি করছে।”
জুবায়ের বিস্মিত হলো শুনে। বলল,
“চল। এসব দেখার রূচি নেই আমার। ভালোলাগছে না।”
তারপর তারা দুজন টলতে টলতে ক্লাব থেকে বেরিয়ে যায়।
রাজ বাড়িতে এলো রাতে। আদুরী ঘরের গেট খুলে দিলো। রাজ দোতলায় চলে গেলো ফলমূলের ব্যাগগুলো আদুরির হাতে দিয়ে। আদুরী মাকে ও শিখাকে জানালো রাজের আগমনী সংবাদ। শিখা আনন্দচিত্তে দোতলায় গেলো। দরজায় দাঁড়িয়ে রাজকে সালাম দিলো।
রাজ সালাম নিলো বিফ্রকেস খুলতে খুলতে। টুকটাক কিছু জিনিস বের করলো। সেই সঙ্গে খামবন্দী একটা চিঠি বের করলো।

ঠান্ডা সুরে শিখাকে বললো,
“জুবায়েরের এই চিঠিটা পড়ো।”
বলে সে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো।
শিখা জমে গেলো গোপনে। গোলাপি আভার অধরযুগল ফ্যাকাসে বর্ণ ধারণ করলো।চোরের মন পুলিশ পুলিশ। তাই মনে মনে বলল,

রাজবধূ পর্ব ৬৫

“জুবায়ের ভাই আমাকে সাবধান করে নিজেই জানিয়ে দিলো সব। হায় আল্লাহ! আমার মৃত্যু দাও এখন।”
এদিকে রাজও মনে মনে বলল,
“শিখা, তোমাকে আমার জীবনের একটা গল্প শোনাবো। তবে এখন নয়।আরো পরে। তোমার জন্য গল্পটা নতুন। সত্য অপ্রিয় হলেও চিরসুন্দর!”

রাজবধূ পর্ব ৬৭