রাজবধূ পর্ব ৬৭
রেহানা পুতুল
এদিকে রাজও মনে মনে বলল,
“শিখা, তোমাকে আমার জীবনের একটা গল্প শোনাবো। তবে এখন নয়। আরো পরে। তোমার জন্য গল্পটা নতুন। সত্য অপ্রিয় হলেও চিরসুন্দর!”
শিখা আল্লাহর নাম জপতে জপতে খাম থেকে চিঠিটি বের করে নিলো। উদ্বিগ্ন চোখে ভালো করে পড়ে নিলো চট জলদি। জোরে স্বাস ছাড়লো বুক হাত দিয়ে। রাজ বের হলো। শিখার হাতে জুবায়েরের চিঠিটি ধরা।
জিজ্ঞেস করলো,
“পড়েছো?”
“হুম।”
“তোমাকে চিন্তিত মনে হচ্ছে?”
রাজের কথা শুনে শিখার রুহ কেঁপে উঠলো। তবুও থিতু গলায় কৌশলী জবাব দিলো চতুরতার সঙ্গে।
“আপনি পঁচা সাবান। আমাকে ভয় পাইয়ে দিলেন। যেভাবে বললেন পড়তে, আমি ধরে নিলাম উনার কি না কি খারাপ খবর।”
শিখা ভয় কাটানোর জন্য মাথা ঝুঁকিয়ে বুকে থুথু ছিটে দিতে লাগলো। সেইক্ষণে রাজ নিজের মাথাকে শিখার বুকে চেপে ধরলো। শিখা রাজের মাথা সরিয়ে দিয়ে বলল,
“কি করছেন?”
“কই কি করছি? তোমার হার্টবিট শোনার চেষ্টা করলাম। আসলেই ভয় পেলে কিনা দেখতে হবে না?”
হেসে বলল রাজ।
” আপনাকেও একটু আগে চিন্তিত মনে হলো।”
রাজ শিখার দুগালে নরম চুমু খেয়ে বলল,
“চিন্তিত নয়। সবসময় আমি বাড়ি আসলে জুবায়ের গেট খুলে দেয়। কিন্তু এই প্রথম ও নেই। তাই ঘরে পা রাখতেই মনটা কেমন করে উঠলো। ওর চিঠিটা তোমাকে পড়তে দিলাম, তার অবস্থা বুঝানোর জন্যই। আমার লাইফে এমন উম্মাদ, আজব প্রেমিক আর একটাও দেখিনি।”
“উনাকে কোনভাবে দেশে আনানো যায় না? তারপরে আমরা সবাই মিলে বিয়ে করাবো। সম্ভব?”
বলল শিখা।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“জুবায়ের মানুষ হিসেবে একের। কিন্তু এইক্ষেত্রে বেয়াড়া সে। সহজে সে দেশের মাটিতে পা রাখবে না। আর বিয়ে? আমার মনে হয় না। হয়তো বড় কোন কারণ তার সামনে এলে করতে পারে। শুয়ে পড়ো। ঘুম আসতেছে।”
হাই দিতে দিতে আলস্য ভঙ্গিতে বলল রাজ।
শিখা পালংকের উপরে উঠে দাঁড়ালো। চার খুঁটিতে মশারির চারকোনা আটকিয়ে নিলো।
“তোমার কাছে মশা লাগছে বধূ?”
“কেন? আপনার কাছে লাগছে না?”
“লাগলেও কিচ্ছু করার নেই। রাতভরে আনন্দ করবো। তাদের দু’চারটা কামড় সহ্য করতে পারব না? মশারি আমার কাজে বাধা সৃষ্টিকারী।”
শিখা সরু চোখে রাজের দিকে তাকালো। চোখের পাতা ঝাপটিয়ে বলল,
“ফাজিল আপনি। মশারির ভিতরে আরও নিরাপত্তা বেশী। মশার কামড়,মানুষের কামড়,এত রকম কামড় খেতে পারব না আমি। দুঃখিত!”
শিখা চারপাশে মশারি গুঁজে দিয়ে শুয়ে পড়লো। রাজ ঠোঁট ভিড়িয়ে হাসতে লাগলো অন্যদিকে তাকিয়ে। কুমার সানুর গাওয়া একটা হিন্দি ক্যাসেট প্লে করে দিলো রাজ লো ভলিউমে। নাম ‘আশিকি।’১৯৯০ সালের তুমুল জনপ্রিয় রোমান্টিক সিনেমা এই ‘আশিকি’। একে একে বেজে চলছে,
‘এক সনম চাহিয়ে’
‘তু মেরি জিন্দেগি হে’,
‘নাজার কে সামনে’,
‘মে দুনিয়া বুলা দুঙ্গা’
‘জানে জিগার জানেমন/আব তেরে বিন জিলেংগে হাম’
এবং ‘ধিরে ধিরে সে’ গানগুলো।
রাজ মশারি তুলে ধরে পালংকে উঠে গেলো।
“আপনি কি সবসময় সাদা চেকের লুঙ্গিই পরতে পছন্দ করেন?”
“হ্যাঁ। কেন? তোমার পছন্দ নয়?”
“নাহ তা কেন হবে। আপনাকে লুঙ্গিতে দারুণ মানায়।”
“ওহ আচ্ছা। হিন্দি গান পছন্দ করো?”
“বাংলা,হিন্দি,ইংলিশ, ভারতীয় বাংলা, সব ঘরানার গানই আমার আমার অসম্ভব ভালোলাগে। ক্যাসেটটা কি সারারাত ধরে বাজতে থাকবে?”
“না সজনী। ক্যাসেট প্লেয়ার এটা অটো সিস্টেমের। এক পিঠের ছয়টি গান শেষ হলে অপর পিঠের ছয়টি চলবে। পরে ক্যাসেট নিজেই অফ হয়ে যাবে।”
“ওহ! আপনি আমাকে নিতে এসেছেন না?”
“কি মনে হয় তোমার?”
“মনে ত হয় এটাই।”
“তাহলে এটাই। ভার্সিটি ভর্তির জন্য পড়াশোনা করতে হবে। বই, গাইড কিনতে হবে।”
“আমি মধুপুর থেকে ঢাকায় যাবো। এই বাড়ি থেকে নয়। আম্মা বলছে যাওয়ার সময় এটা ওটা বানিয়ে দিবে আমাদের জন্য।”
ঘুম জড়ানো স্বরে বলল শিখা।
“জো হুকুম মহারানী। তাই হবে। যা আপনি চান।”
“দেখা যাবে সেটা কাছে গেলেই।”
“ওরে কত কথা বলে আমার মন বধূয়া।”
বলে রাজ শিখাকে পা দিয়ে পেঁচিয়ে নিলো নিজের বাহুডোরে। ডুবুরির ন্যায় সুখের অতলান্তে হারিয়ে গেলো।
জুবায়েরের মন মেজাজ অতিশয় খারাপ। কিছুতেই মন বসাতে পারছে না। নিবিড় কোন বনরাজিতে চলে যেতে ইচ্ছে করে তার। কেন তার জীবনটা বিধাতা এমন করে দিলো? এ কোন নিষ্ঠুর খেলা খেলল ভাগ্য তারসঙ্গে! কেন শিখার বিয়ে অন্য ছেলের সাথে হলো না? তাহলে তার জীবনের এত বড় ছন্দপতন হতো না। কোন পাপের শাস্তি হিসেবে স্রস্টা শিখাকে তার চোখের সামনে এনে দিলো। উহু!
হারিস তাকে নিয়ে ঘুরতে বের হলো এক সকালে। জুবায়ের আগেই মানা করে দিয়েছে সে কোন রেস্তোরাঁয় বা বারে যাবে না। তাই হারিস তাকে নিয়ে গেলো ‘পাম আইল্যান্ড’ এ। যেতে যেতে গাড়ির কাঁচের ভিতর দিয়ে সব দেখাচ্ছে হারিস তাকে।
“বুঝলি,দুবাই হলো সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাতটি প্রদেশের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয়, প্রধান শহর। আর দুবাই শহরের মধ্যে এই ‘পাম আইল্যান্ড’ দ্বীপটা বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় একটি পর্যটন কেন্দ্র। যা মানুষের তৈরি কৃত্রিম দ্বীপগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোড়ন সৃষ্টিকারী। প্রাকৃতিক নদী,দ্বীপতো এই মরুভূমির শহরে নেই। পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন ও পর্যটকদের আকৃষ্ট করার উদ্দেশ্যে সাগরের মাঝবুকে মানুষের হাতে নির্মিত করা হয়েছে মোট তিনটি কৃত্রিম দ্বীপ। পুরো দ্বীপটি পাম গাছের আকৃতি ধারণ করে। সমুদ্রের ওপর বালি দিয়ে তৈরি তিনটি দ্বীপ এমনভাবে বসানো হয়েছে যা ওপর থেকে দেখতে অবিকল একটি পাম গাছের মতো লাগে। আমি এর আগে আরও দুইবার আসছি এই দ্বীপে ঘুরতে।
দ্বীপের কাছাকাছি পৌঁছে তারা গাড়ি থেকে নামলো। জুবায়ের মনোমুগ্ধকর চোখে দ্বীপটি দেখতে লাগলো মুগ্ধকর চাহনিতে। প্রকৃতির ছোঁয়া নেই। কিন্তু গাঢ় নীলাভ স্বচ্ছ জলের গভীরতা ও উদার আকাশের বিশালতা তাকে ভুলিয়ে দিলো কিছুক্ষণের জন্য হলেও। দ্বীপের অপরূপ সৌন্দর্যের কাছে স্তিমিত হলো তার হৃদয়ছেঁড়া সীমাহীন যন্ত্রনা!
হারিস বলল,
“আমি ওই বাথরুম থেকে আসছি। তুই দেখতে থাক সব।”
লম্বা,হালকা গড়নের উজ্জ্বল শ্যামরঙা বর্ণের জুবায়ের বালুকাময় দ্বীপের পাড় ধরে হাঁটছে। গায়ে নীল,সাদা ও আকাশী রঙের মিশেলে লুজ টির্শাট। পরনে ধূসর রঙের লুজ প্যান্ট। হাতে ঘড়ি। পায়ে চামড়ার মেরুন কালারের স্যান্ডেল। মাথার শুকনো এলোমেলো চুলগুলো হাওয়ায় উড়ছে।
সামনে একটু এগিয়ে যেতেই দেখলো একাকী একটা মেয়ে সমুদ্রের দ্বীপের নীল জলে পা ডুবিয়ে হাঁটছে। জুবায়ের আর এগিয়ে গেল না। পিছনে পা ঘুরিয়ে চলে আসতেই শুনতে পেলো অচেনা মেয়েলি কণ্ঠস্বর।
“আমাকে দেখলে সবাই দূরে সরে যায়। যেন আমি এক অভিশপ্ত আত্মা!”
জুবায়েরের ব্যক্তিত্বে লাগলো বাক্যটি। সে আবার উল্টো ঘুরে মেয়েটির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলো,
“নাম কি?”
“ঢেউ।”
“ঢেউ?”
“ঊর্মি মানে ঢেউ।”
কাটকাট গলায় বলল মেয়েটি।
জুবায়ের মলিন হাসলো। বললো,
“নিজেই যেখানে আস্ত ঢেউয়ের সমাহার। সেখানে অতটুকুন জলে পা ডুবালে চলে?”
“চলে।”
“নিজেকে অভিশপ্ত মনে করার কারণ?”
মেয়েটি তার ভ্যানিটিব্যাগ হতে কলম ও ছোট্ট একটি নোটপ্যাড বের করলো। ঠিকানা লিখে জুবায়েরের হাতে গুঁজে দিয়ে বললো,
“শুনতে চাইলে এই ঠিকানায় আসবেন। নয়তো পরশু এসময় এখানে আসবেন।”
জুবায়ের অদ্ভুত চোখে মেয়েটিকে দেখলো। কেমন অস্বাভাবিক মনে হলো মেয়েটির কথা বলার ধরন। প্রথম দেখায় কোন অচেনা ছেলেকে কোন মেয়ে নিজের এড্রেস দিয়ে দেয়?
সে মনে মনে বলল,
“তুমি দেখি সত্যি সত্যি আত্মা। নয়তো রহস্যময়ী!”
তখন হারিসের ডাকে জুবায়ের চলে যায়। একটু দূরে গিয়ে দেখে ঊর্মি নামের মেয়েটি এখনো সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। সেও জুবায়েরের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে আছে।
পরে হারিস তাকে দ্বীপের এপাশ ওপাশ ঘুরে দেখালো। দীর্ঘসময় দুজন ঘোরাঘুরি করে খাওয়াদাওয়া করে বাসায় ফিরে গেলো।
মনসুর তার এক ভাতিজাকে নিয়ে তালুকদার বাড়ি আসা যাওয়া করছে সকাল বিকাল। রাজের চোখে পড়লো সেটা। সে তালুকদারকে জিজ্ঞেস করলো,
“বাবা,এদের কি সমস্যা?”
“বস। কইতাছি।”
রাজ বসলো। তালুকদার মানসুরদের জমির বিষয়টা বললো। কবরের বিষয়টা লুকালো রাজের কাছে। রাজ বললো,
“দলিল কই। দেখিতো?”
তিনি দলিল বের করে দিলেন রাজের সামনে। রাজ পড়ে দেখলো সত্যিই। চাচার উপর ঘৃণা ঢেলে ফোঁস করে শব্দ করলো রাজ। বলল,
“তাহলে তো বলা যায় তাদের এই জমি ফিরে পাচ্ছে শিখার জন্যই।”
“সত্য কথা। নয়তো হেরা ডরে আমার সামনে আইতো না কোনদিন।”
রাজ আরো কিছুক্ষণ পিতার সঙ্গে কথা বলল তাদের পারিবারিক বিষয় নিয়ে।
বের হয়ে পুকুর পাড়ের দিকে গেলো। বাদশা পাড় থেকে নিচে নেমে জাল ফেলে পুকুরে মাছ ধরছে। ফুল, খলুই হাতে পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাজকে দেখেই মাথায় ওড়না টেনে দিলো লম্বা করে। রাজ থামলো।
হেসে বললো,
” ফুল মনে হয় আমাকে আজ প্রথম দেখলো।”
ফুল কাঁচুমাচু শুরু করলো। বাদশা স্ত্রীর পক্ষ নিয়ে জবাব দিলো।
“ভাইজান, সে আমার বউ হওয়ার পর মনে হয় আপনারে এই প্রথম দেখলো। তাই লজ্জা পাচ্ছে।”
হাঃহাঃহাঃ করে রাজ উচ্চস্বরে হেসে ফেলল। বললো,
“ওহ আচ্ছা। তাই বল। মাছ পেলি?”
“নাহ। বান্দর মাছ। আমার সাথে তামাশা শুরু করছে।”
“তাহলে বাদ দে।”
“বাদ দেওনের সুযোগ নাই ভাইজান। আপনার আম্মাজানের হুকুম। রুই মাছ ধরতে কইছে। কইলো, রাজ বউ নিয়া যাইবো। আর কবে আহে বাড়িতে,ঠিক নাই। মা মইরা গ্যালে কেউ আর তালাশ কইরা পছন্দের খাওন খাওয়াইবো না।”
রাজের মন ভিজে গেলো মায়ের কথা শুনে। যত কিছুই হোক। মাতো মাই। রাজ হেঁটে সামনের দিকে চলে গেলো। বাদশার গ্লানিকর অতীত নিয়ে সে কোন কিছুই জিজ্ঞেস করলো না। শুধু সে নয়, বাদশা ফিরে আসার পর পুরো তালুকদার পরিবারের কেউই বাদশাকে কিছু জিজ্ঞেস করলো না। রাজ সবাইকে সেই বিষয়ে সাবধান করে দিয়েছে। কাঁটা গায়ে লবণ ছিটে দেওয়া কোন সভ্য মানুষের কাজ নয়।
সুফিয়া বিবির শরীর খারাপ যাচ্ছে কয়েকদিন ধরেই। দিনের বেশিরভাগ সময় নিজের কক্ষেই থাকেন। কেউ কোন প্রয়োজন হলে তার রুমে গিয়ে কথা বলে বা জিজ্ঞেস করে নেয়। তার হাঁপানি রোগটা ঝেঁকে বসেছে ছোটবেলার মতই। রাজ পুকুরপাড় ঘুরে এসে সোজা মায়ের রুমে প্রবেশ করলো। তাকে দেখেই রানী পর্দার আড়াল হয়ে গেলো। কথা বলার তো প্রশ্নই আসে না। রানী বর্তমানে যতটা ঘৃণা করে রাজকে, তারচেয়ে কয়েকগুণ বেশী ভয় পায়। তার কাছে সাক্ষাৎ যম মনে হয় দেবর রাজকে।
“কিরে ছোড় বাপ আমার, আয়। বয়।”
রাজ মায়ের শিয়রে বসলো গা ঘেঁষে। মায়ের ক্ষীণ গলা শুনে ব্যাকুল গলায় জিজ্ঞেস করলো,
“মা,ইনহেলার নেন না? শেষ?”
“নাহ আছে। আরেকটা নতুন পইড়া আছে। ওইটা ব্যবহার করার আগে মনে হয় চইলাই যামু।”
“কি অলুক্ষণে কথা বলছেন মা। অসুখ হলেই কি মানুষ মরে যায়? বাবা যে আপনার চেয়েও বেশী অসুস্থ হয়ে গেলো, কই কিছু হয়েছে বাবার?”
“কইতে পারুম নারে বাপ। ক্যান জানি দিলটা উচাটন উচাটন করে।”
“তাহলে ঢাকায় চলেন। শিখাও থাকবে। কাজের জন্য আলাদা কাউকেও রেখে দিবো। আপনার যত্নের সমস্যা হবে না।”
“না বাপ। শহর আমারে টানে না। আমার গেরামই শান্তি। মাটিই খাঁটি।”
বাদশা মাছ ধরে নিয়ে এলো। সবাই মিলে মাছ কাটলো। টাটকা রুই মাছ ভাজা হলো। এক জোড়া পালা রাজহাঁস ভুনা হলো। গাছের বেগুন চচ্চড়ি হলো বাড়িতে তৈরি করা পুঁটি শুটকি দিতে। ক্ষেতের পাটশাক ভাজা হলো। সাথে শুকনো মরিচ।
শিখাসহ সবাই একসঙ্গে দুপুরে বসে খেলো। শিখা এখন আর ভিন্ন রান্না করে না। ভিন্ন খায় না। কারণ সে দেখলো রানীর হাতের কবজি কেটে ফেলার পর হতেই ঘরের দৃশ্যপট বদলে গেলো। তার প্রতি কেউ আর আগের মতো আক্রমণাত্মক আচরণ করে না। ঘরের প্রতিটি মানুষ সদয় আচরণ করছে তার সঙ্গে। তাই সে ঠিক করলো ঢাকা চলে যাওয়ার আগ অবধি একসঙ্গেই খাবে।
মানুষ বাঁচে আর কয়দিন। কিন্তু তার কর্মগুলো বেঁচে থাকে যুগের পর যুগ।
হিংসা, বিদ্বেষ, অহংবোধ, বৈষম্য মানুষের সুসম্পর্কের মাঝে চিড় ধরায়।
রাজ ও শিখা বাড়ি থেকে বিদায় নিলো। শিখা নতুন একটি জর্জেটের থ্রিপিস পরে নিলো। অন্যসময়ের মতো তৈরি হয়ে নিলো। শহরে যাচ্ছে বলে কোন স্পেশাল সাজগোজ করলো না।
শিখা মাথায় ওড়না দিয়ে, স্বশুর,শাশুড়ির পা ছুঁয়ে কদমবুসি করলো। সবার থেকে মাফ চেয়ে নিলো কোন ভুলত্রুটির জন্য। সব জা থেকে শুরু করে বাড়ির প্রতিটি মানুষ থেকে বিদায় নিলো আন্তরিক স্বরে।
তালুকদার, মতির মা,ফুল,বরকত,আমেনা,বাদশা অশ্রুসজল চোখে তাদের বিদায় দিলো। রানী ছাড়া বাকি দুই জা সুমনা ডলিও উঠানেও বেরিয়ে এলো।
রাজ উঠানে তার কারে গিয়ে বসলো ড্রাইভিং সিটে। বরকত, ব্রিফকেস, সাইডব্যাগ নিয়ে কারের পিছনে রাখলো। মধুপুর চলে গেলো দুজনে। নূরী ও আলো মিলে আগে থেকেই সব প্রস্তুত করে রেখেছে। নারকেলের চিড়া, ঝালনাড়ু, ফুলঝুরি পিঠা, কাঁথা, আরো নানানকিছু। কেননা শিখা বরকতকে পাঠিয়ে মাকে জানিয়ে রেখেছে আজ যাবে। বোন চলে যাবে,তাই আলোও দুইদিন ধরে বাবার বাড়িতে আছে।মা,বোনের কাছে শিখা দুইদিন বেড়ালো স্বামীকে নিয়ে।
বিদায় ক্ষণে নূরী মেয়েকে জড়িয়ে পাগলের মতো কাঁদলো। একইভাবে শিখাও কাঁদলো মা, বোনকে জাপটে ধরে।
গাঁয়ের মেঠোপথ মাড়িয়ে কার উঠে গেলো পিচঢালা পথে। শিখা গাড়ির পিছনের সিটে বসলো। গাড়িতে ধীরলয়ের একটানা রবীন্দ্রসংগীত বেজে চলছে।
‘আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়েছিলে,দেখতে আমি পাইনি,তোমায়…’
তাতে শিখার হৃদয় দুলছে না। আন্দোলিত হচ্ছে না। তার হৃদয়টা হু হু করছে কেবল। মৌনাকাশে মা,বোনের শুভ্র মুখখানা থাকি থাকি ভেসে উঠছে বিবর্ণ মেঘের মতো। নব জীবনের উত্তাপ,উচ্ছ্বলতা তার মাঝে নেই।
জানালার কাঁচ ভেদ করে পাংশুটে মুখে বাইরে চেয়ে আছে শিখা। কত গাছপালা, বিস্তীর্ণ ফসলি জমি, শস্যক্ষেত, পশুপাখি, খালবিল, নদীনালা,মাঝি,কৃষক,কৃষাণ-কৃষাণী দেখছে। তবুও তার উদাস উদাস লাগছে। শিখাকে ঘাটাচ্ছে না রাজ। সে আপনমনে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে দৃষ্টি সামনে রেখে। কারণ সে জানে মা,বোনের জন্য শিখার প্রচন্ড মন খারাপ।
কুমিল্লার খাবার হোটেলের সামনে গাড়ি থামলো। বের হয়ে দুজন হালকা কিছু খেয়ে নিলো। রাজ শিখার চিবুক ধরে বললো,
“বেশী খারাপ লাগছে? তাহলে চলো বাড়িতে রেখে আসি তোমায়।”
শিখা নিঃশ্চুপ। মৌনমুখে গাড়িতে গিয়ে পূর্বের স্থানে বসলো। রাজও পিছন দিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসলো। শিখার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো।
অনুযোগের সুরে বললো,
“এমন ভাব করছো যেন,আমি তোমাকে জোর করে নিয়ে আসছি।”
শিখা নিরুত্তর। রাজও আর দ্বিতীয় কোন বাক্য আওড়ালো না।
রাজবধূ পর্ব ৬৬
সময় রাত দশটা। শহরের একটি অভিজাত এলাকায় কারটি প্রবেশ করলো। তারপর প্রবেশ করলো একটি বিলাসবহুল এপার্টমেন্টের নিচে। বাড়ির কেয়ার টেকার কার থেকে মালামালগুলো উপরে নিয়ে বাসার সামনে রাখলো। রাজ লিফটে চড়ে চারতলায় চলে গেলো শিখাকে নিয়ে। তিন ইউনিটের ফ্ল্যাট। তাদের ফ্ল্যাটের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। রাজ ওয়ালেট হতে চাবি বের করে নিলো। দরজা খুলে বাসার ভিতরে সব জিনিসপত্র নিয়ে রাখলো। চোখ দিয়ে শিখাকে ইশারা দিলো ভিতরে যাওয়ার জন্য।
শিখা ঠায় দাঁড়িয়ে বিস্ময়কর চোখে দরজার উপরে তাকিয়ে রইলো। রাজ ভরাট গলায় বলল,
“শিখা,ভিতরে আসবে না?”