রাজবধূ পর্ব ৭০
রেহানা পুতুল
শিখা আইনবিভাগের অফিস-রুমে গেলো। মাত্র একজন স্যার বসে কাগজপত্র দেখছে। রিসিভার নামানো আছে টেবিলের উপরে। শিখা রিসিভার কানে তুলে নিলো। মার্জিত এবং অপ্রস্তুত গলায় বললো,
“হ্যালো আসসালামু আলাইকুম। কে বলছেন?”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছো কিশোরী?”
শিখা চমকালো। গলা শুকিয়ে এলো খানিকটা। কিছুই বলতে পারছে না। এটা তার স্বপ্নের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অফিস। পাশে স্যার বসা। অথচ এখানে টেলিফোন করে বসলো জুবায়ের। কি অসভ্য জুবায়ের ভাই। পরিবেশ নেই। নয়তো জুবায়েরকে এখন ঝেড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে তার। ভাবছে কী সে? তার কথা শুনেই প্রেমে আঁকুপাঁকু করবে সে? জুবায়েরের কণ্ঠ শুনে শিখার হৃদয়ে অতিরিক্ত কোন আবেগ,অনুভূতির সঞ্চার হলো না। বরং রাশি রাশি বিরক্তি জমা হলো সারা অবয়বজুড়ে। কথা না বললেও এখন বিপদ। সে চালাকি করে জবাব দিলো এপাশ হতে। ভাই বলে কথা বললে যদি পাশে বসা স্যার মাইন্ড করে বসে। তাই সে বললো,
“ভালো আছি মামা। আমার ভার্সিটির অফিসের টেলিফোন নাম্বার কোথায় পেলেন?”
জুবায়ের ভিমড়ি খেলো শিখার মুখে মামা শব্দটি শুনে। বুঝলো পাশে স্যাররা আছে। তাই অভিনয়ের আশ্রয় নিলো। শিখার কিন্নরী গলা শুনেই জুবায়ের সুদূর দুবাইতে বসে বুকের একপাশ হাত দিয়ে চেপে ধরলো। কেমন টনটন করে উঠলো পাঁজরের খাঁজগুলি। সে ব্যাকুল গলায় বলল,
“আমি বুঝতে পেরেছি তোমার সমস্যা। সুতরাং তুমি শুনবে শুধু,আমি বলে যাবো। এত বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম্বার যোগাড় করা মামুলি বিষয় আমার জন্য। রাজের কাছে শুনলাম এখানে চান্স পেয়েছো। তাই নিজ মুখে কংগ্রাচুলেশনস জানানোর জন্যই টেলিফোন করা। অভিনন্দন মাই লাভ! মাই কিশোরী!”
শিখার বুকের ভিতর চ্যাত করে উঠলো। কেননা জুবায়েরের কথার ভঙ্গি অনেকটা রাজের মতই। তবুও থিতু গলায় সে বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
” আমাকে অভিনন্দন জানানোর জন্য ধন্যবাদ মামা। হ্যাঁ মামা বলেন, আমি শুনতেছি। আপনাদের ঘর হলো একটা অশান্তির আখড়া।”
জুবায়ের ফোনের ওপাশে মুচকি হাসলো। মনে মনে বলল,
কী স্বতঃস্ফূর্তভাবে তুমি মামা মামা বলে কথা চালিয়ে যাচ্ছে। ভালোই ত লাগছে। ভাই বলে গোমড়া মুখে কথা বলার চেয়ে মামা বলে বলাই ত দেখি ভালো। ইউ আর রিয়েলি ট্যালেন্টেড!
“মায়ের কাছে তোমার কথা শুনেছি। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও তোমার সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি। শত বিরহের মাঝেও ভালো লাগছে এই ভেবে,তুমি ক্রমশ সফলতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছো। ভেবনা ভালো আছি। আমার ভালো থাকা হয়তো এ জনমে আর হবে না কিশোরী। তাই বলে যে আমি বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারি না তা কিন্তু নয়। অবশ্য তার যথেষ্ট প্রমাণ তুমি পেয়েছো। আমি জানি মানুষ চাইলেই সবসময় সব অবস্থান থেকে ফিরে আসতে পারে না। চাইলেও ভালবাসতে পারে না। সময় সবকিছু পরিবর্তন করে দেয়। উলটপালট করে দেয়। তবুও তুমি আমার কল্পনার কিশোরী। বাস্তবে তুমি অন্য কারো হাত ধরো। অন্য কারো আকাশে রঙিন ফানুস ওড়াও। কিন্তু বেলাশেষে এই আমাকেই কল্পনায় মারো। ছারখার করে দাও। আমি কল্পনায় তোমার কাছে ছুটে আসি। কল্পনার আকাশে তুমি,আমি একসাথে উড়ি হাত ধরাধরি করে।”
বলতে বলতে জুবায়েরের গলা ধরে এলো। সে অপরপ্রান্তে চুপ হয়ে রইলো। শিখা টের পেলো জুবায়েরের হৃদয় পোড়া ঘ্রাণ। আন্তরিক গলায় বললো,
“মন খারাপ করবেন না মামা। এক মামীকে হারিয়েছেন তো কী হয়েছে। আপনি বিয়ে করেন। দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে। পৃথিবীতে কোন সমস্যাই চিরস্থায়ী নয়। পুরাতনকে ভুলে নতুনকে আঁকড়ে ধরাই পকৃতির নিয়ম। জগতের নিয়ম।”
জুবায়ের আদ্রকণ্ঠে শিখাকে বললো,
” খুব দার্শনিক হয়ে যাচ্ছো মেয়ে। নিজের খেয়াল রেখো। পড়াশোনা করো মন দিয়ে। মর্যাদার শিখরে আরোহণ করাই যেন হয় তোমার একমাত্র ধ্যান। আমি কিছুদিন পরে সময় করে আবার টেলিফোন করবো। একটু সময় দিও এমন করে। শুনতে দিও তোমার মধুর স্বর। চির কৃতার্থ থাকবো। ভালোবাসি আজও। বিদায়।”
শিখা কিছু বলতে পারল না। জুবায়ের রিসিভার রেখে দিলো। শিখাও ক্লাসে চলে গেলো। জুবায়েরকে নিয়ে সামান্যক্ষন ভাবলো। বুঝে নিলো জুবায়ের আগের মতই তাকে এখনো ভালোবাসে। ফিল করে। কিন্তু এটা তার একান্তই অনুচিত। নেহাৎ অন্যায়। পরস্ত্রী নিয়ে এভাবে গভীরভাবে কল্পনা করা খুব বাজে বিষয়। রাজকে কী বলে দিবে নাকি? এতে যদি হীতে বিপরীত হয়? ক্লাসে স্যার প্রবেশ করায় শিখার ভাবনায় ছেদ ঘটলো। সে ক্লাসে মনোনিবেশ করলো।
দুবাইতে বেকার বসে থাকতে ভালো লাগছে না জুবায়েরের। নিজেকে এতিম বা ভিক্ষুক মনে হয়। তাই সমঝোতার ভিত্তিতে হারিসের বিজনেসে যুক্ত হলো। হাতে টাকা আসতে লাগলো। ঊর্মি মেয়েটার সঙ্গে দেখা হয় তার। তাদের বাসায়ও যায় মাঝে মাঝে। হারিসও যায়। পারিবারিকভাবেই তাদের সঙ্গে একটি সুসম্পর্ক গড়ে উঠে জুবায়ের ও হারিসের। উর্মিকে জুবায়েরের ভালোলাগে। মেয়েটি চটপটে। মিষ্টিভাষী! বন্ধুবৎসল! মিশুকও বটে। কিন্তু এই ভালোলাগা ঠিক একজন মানুষ হিসেবেই। এর বাইরে আর কিছুই নয়। নবপুষ্পের সুগন্ধির ন্যায় তার হৃদয়ে কেবল সেই ছোট্র শিখাই। যাকে যে চাইলেও ভুলতে পারেনা এক মুহূর্তও।
তার কিছুদিন পর হারিস জুবায়েরকে নিয়ে গহনার মার্কেটে গেলো। তার স্ত্রীর জন্য সে গহনা সেট কিনবে। সেজন্য। সে জুবায়েরকে বললো,
“বিয়েতো একদিন না করবিই। চাইলে একসেট কিনে নিতে পারিস। স্বর্ণ মার্কেটবিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে কম দামে খাঁটি স্বর্ণ পাওয়া যায় যে দেশে, সে দেশটি হলো এই সংযুক্ত আরব আমিরাত। দুবাই শহরবাসীরা নিজেরাই একে স্বর্ণের দেশ বলে দাবি করেন।”
কিছু গহনা বেশ কিছুক্ষন নেড়েচেড়ে দেখলো জুবায়ের। পরে চমৎকার কারুকাজ খচিত দুই সেট গহন কিনে নিলো জুবায়ের। হারিস জুবায়েরের পিঠ চাপড়ে হেসে বলল,
“কিরে,এক্কেবারে ডাবল নিয়ে নিলি দেখি? যাক আমার কথা হেলাফেলায় গেল না।”
“মায়ের জন্য একসেট। আর বাকিটা যেই নারীর কপালে আছে,সেই পরবে।”
সেই রাতে জুবায়ের ঘুমের ঘোরে শিখাকে নিয়ে কল্পনার ভেলায় ভেসে গেলো। ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ার পর বললো, ঘুম না ভাঙ্গলেই ভালো হতো। অন্তত স্বপ্নের মাঝে শিখাকে নিয়ে সংসার করা যায়। বালুচরে ঘর বাঁধা যায়।
কয়মাস হয়ে গেলো শিখার শহুরে জীবনের। আস্তে আস্ত সে নাগরিক জীবনে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। দুজনের ছোট্ট সংসার, তার পড়াশোনা, ও ক্যারিয়ার এসব নিয়ে শিখা মোটামুটি ব্যস্ত সময় থাকে। শুরুর দিকে রাজ তাকে ভার্সিটি পৌঁছে দিতো। কিছুদিন পর থেকে শিখা একাই যাওয়া আসা শুরু করলো। ক্যাম্পাসের চারপাশ মোটামুটি চিনে নিয়েছে সে।
একদিন ভর দুপুরে প্রিয় ইগলু কাপ আইসক্রিম খেতে খেতে শিখা গলায় অনুযোগ ঢেলে রাজকে বললো,
“আপনি না দেশের বাইরে যাবেন?”
“হ্যাঁ যাব তো। একটা কাজে পিছিয়ে গেলো।”
“ওহ! কিন্তু আপনার ওই বাসায় তো আর নিলেন না আমাকে। গাজীপুর ফ্যাক্টরিতেও তো নিলেন না।”
রাজ তার কাপ থেকে আঙুলের ডগায় ঠান্ডা আইসক্রিম তুলে নিলো। শিখার গালের একপাশে লাগিয়ে দিলো। পরে মুখ ঝুঁকিয়ে জিভ দিয়ে চেটে খেয়ে নিলো।
“উঁহু! কী করছেন?”
শিরশির অনুভব করে বললো শিখা।
শিখার চিবুক নেড়ে রাজ বললো,
” দিনের আলোয় একটু রোমাঞ্চ! দুজনের সময় সুযোগ এডজাস্ট হচ্ছে না বলেই তোমার যাওয়া হচ্ছে না। কবে কোথায় যেতে চাও বলো?”
“আগে আপনার পোশাক শিল্প দেখবো। পরে বাসা। দূরেরটা আগে দেখবো। কাছেরটা পরে দেখবো। শুক্রবারে নিয়ে চলেন।”
শুক্রবার সকালে রাজ তার প্রাইভেট কারে করে শিখাকে নিয়ে বের হলো। বাইরে একটা রেস্টুরেন্টে দুজনে নাস্তা খেলো। নানরুটি ও বিফ নেহারি। সাথে মুগডাল রান্না। শেষে মালাই চা। জম্পেস নাস্তা খেয়ে আবার দুজন বেরিয়ে পড়লো। শিখা রাজের ড্রাইভিং সিটের পাশে বসেছে। তার বেশ আমুদে লাগছে। ভ্রমণ করতে তার খুব ভালোলাগে। শিখা রাজের বাহুর উপরে মাথা হেলিয়ে রেখেছে। রাজ শিখার কপালে চুমু খেলো। শিখাকে নিয়ে রাজ সাভার স্মৃতিসৌধ গেলো। সেখান থেকে গাজীপুরে ফ্যাক্টরিতে গেলো। সেলাই কর্মীরা রাজ ও শিখাকে দাঁড়িয়ে সালাম দিলো। কিছুক্ষণ ঘুরে দেখে শিখা বেরিয়ে এলো।
শিখা চোখ কপালে তুলে রাজকে বললো,
“আপনি এত বড় ফ্যাক্টরির মালিক?”
“একদম না। আমি কি কখনো তোমাকে বলেছি এটা? বড় বিজনেস অনেক সময় পার্টনারে হয়। এখানে আমরা চারজন আছি পার্টনারে।”
“তাওতো বিরাট ব্যাপার।”
তার পরেদিন রাজ শিখাকে বললো,
“সেই বাসায় ত এখন আমার থাকা হয় না। ভাবছি ছেড়ে দিবো। আমার সবকিছু এই বাসায় নিয়ে আসবো।”
শিখা বলল,
“বাসা আপনার। সিদ্ধান্তও আপনার। প্রয়োজন না হলে অবশ্যই ছেড়ে দিবেন।”
“তাহলে তুমি আর গিয়ে কী করবে? নাকি বলো?”
“হুম সেটাই। থাক আর যাব না। কোথায় যেন আপনার সেই বাসা?”
” লালবাগ। অফিস থেকে খুব দূরে নয়। দশ,পনেরো টাকা রিকশা ভাড়ার দূরত্ব।”
“বুঝলাম। এলিফ্যান্ট রোড টু লালবাগ। লালবাগ কেল্লার কাছে নাকি?”
“কিছুটা বলা যায়।”
বলে রাজ চিনিয়ে দিলো শিখাকে।
শিখার শার্প ব্রেইন। বিশেষ করে মানুষের নাম,লোকেশন, সাল ও ঐতিহাসিক কোন স্থানের নাম শিখার মস্তিষ্কে গেঁথে যায়।
তার পরের সপ্তাহে রাজ চলে যায় দেশের বাইরে। যাওয়ার আগে গ্রামে গিয়ে শাশুড়ীকে ঢাকায় নিয়ে আসে। এবং তার সেই বাসা থেকে কিছু জিনিসপত্রও ‘রাজবধূ’ ফ্ল্যাটে নিয়ে আসে সে।
একদিন ভর দুপুরের কথা। ক্লাস শেষ। একদিকে রাজ নেই। আরেকদিকে বাসায় মা আছে। কাজের খালাও আছে। তাই ক্লাস শেষ হওয়ার সাথে সাথেই তোড়জোড় করে বাসায় যাওয়ার তাড়া নেই শিখার মাঝে। ওরা কয়েকজন মিলে লালবাগ কেল্লায় ঘুরতে এলো। ক্লাসমেট রিতুর বাসা এখানেই। রিতু বন্ধুদের বললো,
“আমার বাসা এই অদূরেই। আয় সবাই বাসায় ঘুরে যা।”
শিখাসহ অন্যরা রিতুর আবদারকে অগ্রাহ্য করতে পারলো না। সেই বাড়ির নিচে যেতেই শিখা দেখলো রাজের বাসার ঠিকানাও তো ‘সুখ নিবাস’ নামের এই বাড়িই বলছিলো। কিন্তু কয়তলা সেটা শিখা জানে না। সে আস্তে আস্তে সিঁড়ি ডিঙিয়ে উঠতে লাগলো। অন্যদের বোঝালো, যেহেতু সে ঢাকায় নতুন,তাই সবকিছু আগ্রহ নিয়ে দেখছে।
রিতু অন্যদের নিয়ে তাদের তিনতলায় চলে গেলো। শিখা দেখলো দোতলা থেকে বড় বড় কার্টুন বক্স বের করছে কয়েকজন দিনমজুর। তার খটকা লাগলো। সে তাদের জিজ্ঞেস করলো,
“এটা বাসা ছিলো না?”
” হ বাসাই ত।”
বলল একজন।
“কার বাসা ছিলো জানেন?”
“নাহ। আমরা ক্যামনে জানুম।”
” বাসার মালামাল এমন হয় নাকি? কার্টুন বক্সের মতো?”
“তা আমরা কেমনে জানি কন? আপনে কে? এত তদন্ত করতাছেন?”
বললো একজন মজুর।
রাজবধূ পর্ব ৬৯
শিখা তার কথার জবাব দিল না। তার ধারণা হলো রাজের বর্ননানুযায়ী এটাই রাজের বাসা। মানুষ স্বভাবতই কৌতুহল প্রিয়। তাই শিখাও মনেও কৌতুহল জাগলো। সে ভিতরে গেলো এমনিতেই একটু দেখার জন্য। কেউ নেই ভিতরে। বাসা খালি। সেই শ্রমিকেরা তাকে বাধা দিলো। সে শুনলো মা। শিখা সব রুম দেখে বাথরুমের সামনে যেতেই তার নাকে অদ্ভুত একটা বোটকা গন্ধ এলো। সে ঠিক ধরতে পারছে না। বাথরুমের বাইরে থেকে দরজা লক করা। একই গন্ধ রাজের অফিসের পিছনের রুমেও পেলো সে। শিখা বাথরুমের দরজায় একটু নাক লাগালো গন্ধটা চেনার জন্য।
তখনই ভিতর থেকে শোনা গেলো কারো মৃদু গোঙানি। মানুষের মতই ত লাগছে আওয়াজটা। শিখার হৃৎপিণ্ড বেরিয়ে আসার উপক্রম।