রাজবধূ পর্ব ৭২
রেহানা পুতুল
শিখা বেরিয়ে যায় রাজের অফিস হতে। রিকশায় যেতে যেতে এক বুক বিতৃষ্ণা নিয়ে মনে মনে বলে,
“সেই মাদক ব্যবসায়ী বা জড়িত ব্যক্তির নাম যদি হয় নওশাদ,জুবায়ের কিংবা বাদশা। তাদের কারোই রক্ষা নেই। কারোই না। সময় আমাকে শিখা থেকে অগ্নিশিখাতে রূপান্তরিত করেছে।”
শিখা বাসায় পা রাখতেই নূরী এগিয়ে এলো। আগ্রহান্বিত স্বরে জানতে চাইলো,
“কিরে, কী খবর পাইলি?”
শিখা ডাইনিং টেবিলের উপর থেকে এক গ্লাস পানি খেয়ে নিলো। নূরীকে সব খবর জানালো। যা সে জানলো। শুধু কার্টুনগুলোর কথা চেপে গেলো। মায়ের মন,এককে এগারো ভেবে দুঃশ্চিন্তায় ভেঙে পড়বে। শুনে নূরী হাপিত্যেশ করে বললো,
“মাবুদ জানে আর কতদিন আমার থাইকতে হয়। চারদেয়ালের ভিতর ক্যামন জানি হাঁসপাঁস লাগতাছে আমার। কবে যে নিজের ভিটায় পা রাখতে পারুম।”
“আম্মা,তোমাকে কালকেই পাঠিয়ে দিবো। তুমি চলে যেও তোমার স্বামীর ভিটায়।”
অভিমানী সুরে বলল শিখা।
“এতো রা*গ করস কেন মা? আমি মন্দ কী কইলাম আবার?”
“নাহ। মন্দ বলনি। খুব আনন্দের কথা বলছো তুমি।” বলল শিখা।
তার দুইদিন পর রাজের অফিসের ম্যানেজার এলো শিখার বাসায়। বাসায় শিখাকে পেল না। সে বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছে। শিখার মা ও কাজের খালা ছিলো। ম্যানেজার নূরীকে জানালো,
“খালাম্মা,ম্যাডাম আসলে জানাবেন, গ্রাম থেকে বসের বাবা গতকাল টেলিফোন করেছে। উনার মেয়ের ঘরের নাতনির নাম রাখবে এবং আকিকা দিবে। ম্যাডাম পারলে যেন বাড়িতে যায় অবশ্যই। অনুষ্ঠান করবে না কি তারা।”
“আইচ্ছা, শিখা আসলেই আমি কমুনি।”
ম্যানেজার চলে গেলো। বিকেলে শিখা এলে নূরী তাকে জানালো। শিখা বললো,
“ভালো করে জানতে হবে। আমি অফিসে গিয়ে ভালো করে শুনে নিবো। শহর থেকে গ্রামে চাইলেই কি হুট করে যাওয়া যায়?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“তাইলে গিয়া জিগাইস তুই।”
পরেরদিন শিখা ক্যাম্পাসে যাওয়ার আগে অফিসে গেলো। ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করলো বিষয়টা। ম্যানেজার বললো,
“হ্যাঁ। যা শুনেছেন সেটাই। খালু বললো, আমার ছোট ছেলেও দেশে নাই। তার বউও না থাকলে মনে বুঝবে না। আর সমস্যা তো নেই ম্যাডাম। গাড়িতো দুটো আছেই। চাইলে বাসায় থাকা কারে করে যেতে পারেন। নয়তো অফিসের জিপে করেও যেতে পারেন। ড্রাইভার ত আছেই।”
শিখা একটুখানি ভাবলো। স্বশুর যেখানে টেলিফোন করে বলেছে। সেখানে না যাওয়াটা অপরাধ হয়ে যায়। সে জিজ্ঞেস করলো,
“অনুষ্ঠান কবে?”
“সামনের শুক্রবারে।”
“আপনাদের বস টেলিফোন করেছে?”
“নাহ। আপনি এসে যাওয়ার পর আর করেনি।”
“আচ্ছা। উনি টেলিফোন করলে বিষয়টা জানাবেন। আমি আমার আম্মাসহ গ্রামে যাবো বুধ বা বৃহস্পতিবারে।”
” অবশ্যই জানাবো ম্যাডাম
জিপে না কারে করে যাবেন?”
“জিপে কেন যাবো? বাসার গাড়িতেই যাবো। কারে করে।”
“ঠিক আছে ম্যাডাম।”
কথা শেষে শিখা আগের মতই পুরো অফিস ঘুরে দেখলো। কোথাও কোন কার্টুন বাক্স দেখতে পেল না। নাকেও কোন কটু গন্ধ লাগল না। সে ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করলো,
“সেদিন দেখা বাক্সগুলো কী নিয়ে গিয়েছে?”
“হ্যাঁ ম্যাডাম। যার মাল সে এসে নিয়ে গিয়েছে। বলে দিয়েছি আমাদের অফিসে যেন এমন নিষিদ্ধ বস্তু আর না আনা হয়।”
“ওহ!” বলে শিখা স্মিত হেসে অফিস থেকে চলে গেলো।
শিখা তার মাকে নিয়ে গ্রামে গেলো। সে নূরীকে বাড়িতে পৌঁছে দিলো। নূরী প্রাণ ফিরে পেলো নিজের গাঁয়ের মাটির সোঁধা ঘ্রাণ পেতেই। তারপর ড্রাইভার শিখাকে নিয়ে গেলো উজানপুর গ্রামের তালুকদার বাড়িতে। শিখা ঘরের জন্য অনেক কিছু নিয়ে গেলো। আদুরীর মেয়ের জন্য দুই সেট জামাকাপড় নিয়ে গেলো। শিখাকে দেখতে পেয়ে তালুকদারের চোখ ছলছল করে উঠলো। ফুল, মতির মা, বাদশা,দৌড়ে এলো শিখার সামনে। শিখা তাদের প্রত্যেকের সাথে মধুর কণ্ঠে কুশলাদি বিনিময় করলো হাসি হাসি মুখে। নিচ তলায় নিজের রুমে গিয়ে ভ্যানিটি ব্যাগ রাখলো। জামা কাপডের ব্রিফকেস ফুল এনে রাখলো। হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেস হয়ে নিলো শিখা।
তারপর একে একে সবার কাছে গিয়ে সে যেচে কথা বললো। শাশুড়ীর রুমে গেলো। সুফিয়া বিবি প্রায় শয্যাশায়ী! তিনি তার কক্ষে পালংকের একপাশে শুয়ে আছেন। শিখা তার চরণধূলি নিলো সালাম দিয়ে। বিমূঢ় চোখে চেয়ে রইলো সুফিয়া বিবির দিকে। বিছানায় যেন কোন মানুষ নয়,মানুষের কায়া শুয়ে আছে।
সুফিয়া বিবি অস্পষ্ট ক্ষীণ গলায় বললেন,
“বহো। ভালা আছো?”
শিখা মাথায় ওড়নাটা ভালো করে টেনে দিলো। শাশুড়ীর শিয়রের পাশে বসলো মার্জিত ভঙ্গিতে।
“মা আপনার এই অবস্থা কেন? চিকিৎসা চলছে না?”
ব্যথিত কোমল গলায় জানতে চাইলো শিখা।
“সময় শ্যাষ আমার। মরনের বেমারে ধরছে। আমার রাজ কবে দ্যাশে আইবো? রাজের মুখ না দেইখা মরুম না।”
“এভাবে বলবেন না মা। উনি দেশে আসলেই আপনাকে শহরে নিয়ে যাবো। আপনি সুস্থ হয়ে যাবেন।”
বিগলিত স্বরে বলল শিখা।
“আর ক্যামনে কইতে পারি কও। তুমি আমার উপর দিলে কোন দুখ রাইখো না। মাফ কইরা দিও আমারে। বহুত সময় বহুত কথা বইলা তোমারে শাসন করছি।”
“মাফ করার মালিক আল্লাহ। তিনি আপনাকে মাফ করে দিক। আপনিও আমাকে মাফ করে দিয়েন মা।”
“আমি মাফ কইরা দিছি। তুমি আওনে খুশি হইছি। আদুরীর মাইয়ার উছিলায় সবাই আইছে। একটু শান্তি লাগতাছে। সবার মুখখানা দেইখতে পারুম।”
“বড় ভাইজানরাও আসছে নাকি বাড়িতে?”
“হ। আইজই আইলো। তুমি আওনের আগেই।”
“বাহ। খুব ভালো হয়েছে।”
“আচ্ছা মা,থাকেন। আমি বাকিদের সাথে গিয়ে দেখা করি।”
শাশুড়ির অনুমতি নিয়ে শিখা রুম হতে বেরিয়ে গেলো। রানীর রুমে গেলো।
“ভাবি আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন?”
“যেইভাবে থাকনের কথা সেইভাবেই আছি।”
নিরস গলায় বলল রানী।
আদুরীর রুমে গেলো শিখা। আদুরীর মেয়েকে কোলে তুলে নিলো। আদর করতে করতে বললো,
“ও কার মতো হয়েছে আপা? কী নাম রাখবেন কাল, ঠিক করেছেন?”
“হ্যাঁ। ওর দাদী ঠিক করছে। খাদিজা বেগম আসমা।”
“আসমা। সুন্দর নাম। এর অর্থ জানেন আপা?”
“জানি। মহান বা উন্নত।”
“যাক। মাশাল্লাহ। আলহামদুলিল্লাহ।”
বাকি দুই জায়ের সঙ্গেও শিখা কথা বললো।
ঘরের সবাই শিখার সঙ্গে আগের চেয়ে ভালো আচরণ করলো। শিখা মনে মনে আক্ষেপ করে বললো,
আজ ওকালতি পড়ছি বলে ভালো আচরণ করছেন। গুরুত্ব দিয়ে কথা বলছেন। অথচ আগে ছিলাম আমি আপনাদের সবার চক্ষুশূল! বিষকাঁটা! ক্ষুদ্র পোকার ন্যায়। আহা! সময়। আহা! মানব জনম!
শিখা চাচী শাশুড়ীর রুমে গেলো। আমেনা শিখাকে দেখেই বুকে জড়িয়ে ধরলেন। শিখার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। স্নেহপূর্ণ আদ্রকণ্ঠে বললেন,
“মা, বহো। তুমি চইলা যাওনের পর অনেক মন পুড়ছে আমার। খুব ভালো লাগতাছে তুমি আসনে। জুবায়ের ত আমার লগে কথা কইলেই তোমার কথা বলে। একদিন নাকি তোমার লগে কথা কইলো টেলিফোন কইরা? থাকবা নি কয়দিন?”
” হ্যাঁ জুবায়ের ভাই ফোন করেছে আমাকে। আর উনিতো নাই দেশে। তাই থাকবো কয়দিন। যদিও ক্লাস আছে। সেটা অতো সমস্যা হবে না।”
“আইচ্ছা মা। কি খাইবা?”
“চাচী এত ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? পরে খাওয়া যাবে। আমি আছি তো বাড়িতে।”
আমেনার সাথে কিছুক্ষণ গল্প করে শিখা চলে গেলো।
পরেরদিন আদুরীর মেয়ের নাম রাখা হলো মিলাদ পড়ানোর মাধ্যমে। ভরপুর ভোজন শেষে কার নিয়ে ড্রাইভার ঢাকায় চলে গেলো। কয়দিন পর এসে শিখাকে নিয়ে যাবে। সেই অনুষ্ঠানে নূরী ও তার বড় মেয়ে আলোও এলো। তালুকদার বরকতকে পাঠিয়ে নূরীকে দাওয়াত দিলো। নূরী সোনার আংটি উপহার দিলো আদুরীর মেয়েকে। রাজের একমাত্র ফুফু জাহানারাও এলো। সীমান্ত, কুসুমও এলো।
শিখা ও কুসুম দুজন দুজনকে পেয়ে উল্লসিত হয়ে উঠলো। দুজনে ঘরের আড়ালে নিরিবিলি স্থানে চলে গেলো। স্কুল ও কলেজ জীবনের অম্লমধুর স্মৃতিচারণে মগ্ন হয়ে গেলো দুই সখী। এভাবে উৎসবমুখর আয়োজনে অনুষ্ঠান শেষ হলো। শিখা কুসুমকে যেতে দিল না। রাতে দুজন একসঙ্গে ঘুমালো অনেক আশা জাগানিয়া গল্প শেষে। বি.এ ভর্তি হওয়ার জন্য শিখা কুসুমকে অনুপ্রাণিত করলো বেশ। কুসুম রাজী হলো। পরেরদিন কুসুম চলে গেলো জাহানারার সঙ্গে। নূরীও চলে গেলো।
সেদিন বিকেলেই খালেদ ও আসলাম পা চালিয়ে তালুকদারের রুমে প্রবেশ করলো। হতভম্ব গলায় জিজ্ঞেস করলো,
“বাবা,কী ব্যাপার? মনসুরদের থেকে আমাদের কেনা জমিতে তারা ফসল ফলায় কীভাবে? আপনি জানেন না?”
“গলা নামায়া কথা ক কইলাম। আমি তাদের জমি ফিরায়া দিছি দলিল কইরা।”
দুই ভাই দৃষ্টি বিনিময় করলো কপাল কুঁচকে। অবাক স্বরে আবার জানতে চাইলো,
“ফিরায়া দিছেন মানে? কেন? চাচায় কী মাগনা কিনছে নাকি এই জমি? তারা কত টাকা দিলো?”
“তোর চাচায় তাদের যত দিলো, তত দিছে তারা। পঞ্চাইশ হাজার।”
দুই ভাই উত্তেজিত হয়ে গেলো। বললো,
“মগের মুল্লুক নাকি? এই জমির এখন দাম আছে তিনলক্ষ টাকা। আর সেই দিলো মাত্র পঞ্চাশ হাজার টাকা? মনসুর এত বছর চুপ ছিলো। হঠাৎ তার এতবড় সাহস কীভাবে হলো? কার প্রশ্রয়ে? কার ইন্ধনে? ইচ্ছে করতাছে তারে জিন্দা পুঁতে ফেলি।”
“তোদের দিয়া সেটাই মানায়। যখন তাদের সাথে ঠকবাজি কইরা তোর চাচায় পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়া কিনলো। তখন জমির বাজার দর কত ছিলো? এই টাকাই ছিলো?”
জেদের বশে হড়বড় করে কথাগুলো বলে ফেলল তালুকদার। পরক্ষণেই জিভে কামড় বসিয়ে দিলো আফসোস করে। খালেদ ও আসলামের দু’ জোড়া চোখ খরগোশের চোখের ন্যায় জ্বলজ্বল করে জ্বলে উঠলো তীব্রভাবে। পুরু গলায় তারা জিজ্ঞেস করলো,
“আমাদের দিয়া সেটাই মানায়? কী মানায় বাবা? বুঝলাম না আমরা? বুঝিয়ে বলেন।”
“বুঝানোর কিছু নাই। জিদ্দে ভুলভাল কিছু মুখ ফসকাইয়া বাইর হইয়া গ্যাছে। জমির প্রমাণাদি নিয়াই ফেরত দিছি। আকামে চেতিস না। কামের দিকে নজর দে। মনসুরদের কারো কোন ক্ষতি করার চেষ্টা করবি না। নয়তো জানে মরে যাবি। মনে রাখিস, বাপের ও বাপ আছে। যেই কিনা সেরের উপর সোয়াসের ঢালতে জানে।”
“কারে ইঙ্গিত করে আপনি আমাদের হুমকি দিতাছেন বাবা? আপনার গুণধর ওকালতি পড়া ছোট পুত্রবধুর? আমাদের কাছে ও একটা মাছি মাত্র। ওরে ওড়ায়ে দিতে আমাদের এক আঙ্গুলের তুড়িই যথেষ্ট।”
শিখা এতক্ষন রুমের বাইরে চৌকাঠে দাঁড়িয়ে পিতা পুত্রদের বাক্য বিনিময় শুনলো। আর স্থির থাকতে পারল না। এগিয়ে রুমের ভিতরে গেলো। খালেদ, আসলামের দিকে চেয়ে ধীর গলায় বললো,
“ভাইজান, মাছির ত সারা মাথায় চোখ। খুব সজাগ চোখ। সামনে পিছনে মিলিয়ে পাঁচটি। আজ অবধি একটা মাছিও মারতে পেরেছেন কী? আর তুড়ি? এটা বাজাতে দুই আঙ্গুলের সাহায্যের প্রয়োজন হয়। জানেন ত?”
“কত বড় বেয়াদব মেয়ে। স্বশুর আর ভাসুরদের কথার মাঝখানে মাতব্বরগিরি দেখাতে আসে।”
রুক্ষ স্বরে বলল খালেদ।
শিখা নিচু মাথায় রুম হতে বেরিয়ে গেলো। গিয়ে চুপিচুপি বাদশাকে সব জানালো। সাবধান বানী শুনিয়ে আরো বললো,
“বাদশা ভাই, আপনি সতর্ক থাকবেন। বাবায় যখন এটা বলছে। তারা তো নিশ্চিত আপনিই কিছু বলছেন বাবাকে। কারণ নিশি রাতের সেই নৃশংস কাজের সাক্ষী একমাত্র আপনি।”
“ভাবি, তাদের টার্গেটে আপনিও পইড়া গ্যাছেন। তারা আপনার সাহস সম্বন্ধে জাইনা গ্যাছে। মনসুর কাকায় আপনার জন্য জমির কথা কইতে সাহস পাইছে। এইটা তারা দুইভাই বুইঝা গ্যাছে তালুকদারের কারণে।”
“বুড়ো হলে এই এক বিপদ। সরল মনে মুখ দিয়ে সব বেরিয়ে যায় গলগল করে। কী বিপদের আশংকা হয়ে গেলো বলেন ত। বসে থাকলে হবে না।”
“ভাবি,মনে হয় মনসুর কাকারে কবরের বিষয় জানানো দরকার। আমি তো ফুলরে নিয়া অন্য ঘরে ঘুমাই। আপনে তাদের পাশাপাশি রুমে আছেন। রাইতে একটু খেয়াল রাইখেন। যেই দু’ চারদিন তারা বাড়িতে আছে,চোখ কান খোলা রাখতে হবে।”
“হুম। রাখবো। আবার একটা বিপদের পূর্বাভাস পাওয়া গেলো। কী যে হবে।”
শংকিত মনে বলল শিখা।
“দেখলেন ভাবি,পাপ করলো তারা দুইজন। অথচ বিপদ আসতাছে আমাগো দুইজনের দিকে।”
“আমার ভয় হচ্ছে আপনাকে নিয়েই। আমি ঘরের বউ। রাজের বউ। আমার ক্ষতি করতে তারা দু’বার ভাববে। কিন্তু আপনার কিছু করতে তারা একটিবারও ভাববে না। আপনি নাহলে কোথাও চলে যান কাজের কথা বলে৷”
“নাহ ভাবি। নাহ। জুবায়ের ভাই নাই।রাজ ভাই নাই। আমিও আপনাকে ফেলে চলে গেলে বিপদ ঘটে যাবে। প্রাণ যায় যাবে। তবুও আপনাকে বিপদের মুখে রেখে আমি এ বাড়ি ছাড়ব না।”
এরপর সবার মতো আছে। রাত হলে শিখা খেয়াল রাখে দুই ভাসুরের রুমের দিকে।
তারপর খালেদ ও আসলাম চুপিচুপি অনেক শলা পরামর্শ করলো। তাদের কথোপকথনের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলো শিখা,বাদশা ও আজগর আলীর কবর। অনেক ফন্দী আঁটলো তারা শিখা ও বাদশাকে ঘায়েল করার বিষয়ে।
খালেদ বললো,
“এটার একটা গতি করার জন্য ঢাকায় যেতেও পারছি না।”
“একটা ব্যবস্থা না করলে নিজেরাই এবার ফেঁসে যাবো।”
বললো আসলাম।
তারপর এক রাতে শিখা আবিষ্কার করলো খালেদ ও আসলাম তাদের রুমে নেই। শিখা ভয়ে শিউরে উঠলো। নিশ্চিত হওয়ার জন্য চাতুরী শুরু করলো। মিথ্যে বাহানায় দুই রুমের দরজায় গেলো। দেখলো দরজা ভিতর থেকে বন্ধ নেই। শিখা আস্তে করে দরজা ফাঁক করলো। ডিম লাইটের উজ্জ্বল আলোয় দুই বিছানার উঁকি মেরে দেখলো সত্যিই খালেদ ও আসলাম নেই। সুমনা ও ডলি অঘোরে ঘুমুচ্ছে। ঘরের বাকিরাও অর্ধমৃত হয়ে বিছানায় ঘুমাচ্ছে।
শিখা সন্তপর্ণে পা টিপে টিপে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। বাদশা ও ফুল ঘুমানো, চৌচালা ঘরের পাশে গেলো। জোরে জোরে টোকা মারলো। ফিসফিসিয়ে ডাকলো,
“বাদশা ভাই আছেন? ফুল.. এই ফুলবানু…দরজা খোল। আমি।”
শিখার গলা কানে যেতেই বাদশা উঠে গিয়ে চোখ দরজা খুলল। শিখা ঘরের ভিতর ঢুকে গেলো। হিসহিসিয়ে বলল,
“তারাতো নাই রুমে। আমি ঘাবড়ে গেলাম৷ মনে করলাম আপনেরে ধরে নিয়ে গেলো না কি।”
বাদশা চমকে উঠে বললো,
“আপনে ফুলের কাছে শুইয়া থাকেন। পশুগুলা কই কী করতাছে আমি দেখতাছি।”
“একা যাবেন ওই গহীন জংগলে? আমিও আসি?”
“আপনে মেয়ে মানুষ। আপনারে এত রাইতে আমার সাথে কেউ দেইখা নিলে বদনাম রটাইয়া দিবো। আমার শরীরে তালুকদার বংশের র* ক্ত। সাথে আছে আমার মায়ের দোয়া। আল্লাহ আমারে রক্ষা করবো। দরজা লাগাইয়া দেন। আমি আইসা টোকা দিলে খুলবেন।”
বাদশা একটা চাকু গুঁজে নেয় লুঙ্গির কোঁচার ভিতরে। গায়ে আছে টিলে একটি হাফহাতার গেঞ্জি। হাতে নিয়ে নেয় একটা লাঠি। দুই ফিতার একটা চপ্পল পায়ে বাদশা বেরিয়ে যায় খালেদ ও আসলামের সন্ধানে। তার প্রথম টার্গেট আজগর আলীর কবরস্থান।
গভীর নির্জন রাত। প্রকৃতিজুড়ে অমাবস্যার ঘোর আঁধার। যথাসম্ভব নিঃশব্দে আজগর আলীর কবর খুদে চলছে আসলাম ও খালেদ। দুজনের পুরোমুখ কালো কাপড় দিয়ে বাঁধা। এক দেখায় এদের কেউই চিনতে পারবে না। একজনের হাতে কোদাল। অন্যজনের হাতে শাবল। একজনের খোদা মাটি অন্যজন কোদাল দিয়ে সরিয়ে নিচ্ছে। বাদশা একটু অদূরেই একটি গাছের আড়ালে দুই হাঁটু ভেঙ্গে বসে বসে দৃশ্যটি অবলোকন করছে। বাদশা বুঝতে পারলো এদের এহেন কর্মকাণ্ডের হেতু। সে দাঁড়ালো না ভয়ে। বসে বসে সামনের দিকে এগোতে লাগলো। তার উদ্দেশ্য মনসুরদের বাড়ি গিয়ে বিষয়টা জানানো। কিন্তু তার আগেই সে ধরা পড়ে গেলো।
রাতের নিরবতায় পাতার মাড়ানো শব্দ শুনতে পেলো খালেদ ও আসলাম।তারা এগিয়ে গিয়ে পিছন থেকে বাদশাকে ঝাপটে ধরে ফেললো। কাঁধে থাকা গামছা দিয়ে বাদশার মুখ বেঁধে ফেলল। যেন চিৎকার দিতে না পারে। দুই ভাই মিলে বাদশাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেলো কবরের কাছে। একটি সুপারি গাছের সাথে পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলল। দাঁত কিড়মিড়িয়ে দুজন বাদশাকে বললো,
রাজবধূ পর্ব ৭১
“শুয়োরের বাচ্চা। বে* শ্যা মা* গী*র ছেলে। এত বড় আস্পর্ধা তোর! আমাদের খেয়ে আমাদের বিরুদ্ধে লাগিস। এই কবরের কথা বাবা কীভাবে জানলো? এখন সেই কবরের ভিতরে তোরে জ্যান্ত গেঁড়ে ফেলবো।”
কথাগুলো বলেই তারা বাদশার শরীর হাতড়ে চা * কু টি নিয়ে নিলো। আবার বিশ্রী এক গালি দিয়ে উঠলো। এবং ছু* রি টি বাদশার গলার নিচে ঠেকিয়ে ধরলো। বাদশা অসহায়ের মতো গাঁইগুঁই শুরু করলো। কিছুতেই নিজেকে বাঁচানোর উপায় খুঁজে পাচ্ছে না।