রাজবধূ পর্ব ৭৩
রেহানা পুতুল
কথাগুলো বলেই তারা বাদশার শরীর হাতড়ে চা * কু টি নিয়ে নিলো। আবার বিশ্রী এক গালি দিয়ে উঠলো। এবং ছু* রি টি বাদশার গলার নিচে ঠেকিয়ে ধরলো।
বাদশা অসহায়ের মতো গাঁইগুঁই শুরু করলো। কিছুতেই নিজেকে বাঁচানোর উপায় খুঁজে পাচ্ছে না।
তখনই সামনে থেকে একটি টচ লাইটের আলো এসে ঠিকরে পড়লো খালেদ ও আসলামের মুখ বরাবর। সামনে দাঁড়ানো মানুষটিকে দেখতে পেয়েই আসলামের কম্পিত হাত থেকে চু* রি* টি মাটিতে পড়ে গেলো। নিশিরাতের ভূত দেখার মতন তারা আঁৎকে উঠলো। এবং ভয়াবহ রকমের ক্রোধান্বিত হয়ে উঠলো।
“কী হচ্ছে এখানে?”
মারমুখী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো রাজ।
“তুই না দেশের বাইরে?”
রোষপূর্ণ গলায় জিজ্ঞেস করলো খালেদ।
“আমি বাইরে থাকলেই ত সবার বেশি সুবিধা। তাই না?”
বলেই রাজ টর্চের আলো ফেলে ফেলে কবরের পাড়ে গিয়ে দাঁড়ালো। বাদশার হাতের বাঁধন মুক্ত করলো। কবরের ভিতরে আলো ফেললো। দেখতে পেলো মৃত মানুষের কংকাল। দুই ভাইয়ের দিকে চেয়ে ধারালো সুরে ফের প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো রাজ।
“এই কবর কার? কে দিয়েছে? এত রাতে এখন কী দামাচাপা দেওয়া হচ্ছে?”
খালেদ ও আসলাম পাথর হয়ে আছে। কিছু বলছে না। তাদের মুখাকৃতি থমথমে ও ভীতসন্ত্রস্ত!
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“এই বাদশা, তুই বল কাহিনী কী?
একচুলও মিথ্যা বলবি মেরে ফেলবো।”
র*ক্ত চক্ষু নিয়ে জানতে চাইলো রাজ।
বাদশার ঠোঁট ও গলা শুকিয়ে এলো। বার দুয়েক শুকনো ঢোক গিললো। জিভ দিয়ে শুষ্ক ঠোঁটজোড়াকে ভিজিয়ে নিলো। সে যতটুকু জানে সব বললো রাজকে। আসলাম ও খালেদ মাথা হেঁট করে কবর পাড়ে ভিক্ষুকের ন্যায় বসে রইলো।
এত নৃশংস বর্ণনা শুনে রাজ স্থির থাকতে পারল না। বড় দুই ভাইয়ের গায়ের দিকে লাথি মারতে গিয়েও পা থামিয়ে নিলো।
তাদের জিজ্ঞেস করলো,
“আজগর দাদাকে কেন জীবন্ত মাটিচাপা দিয়েছেন?”
তারা মুখ খুলছে না কিছুতেই। রাজ তাদের মুখ খোলার জন্য মিথ্যে করে বললো,
“আপনারা যদি সত্যিটা না স্বীকার করেন, তাহলে এখন আপনাদের দুজনের বউকে আপনাদের সামনে অপদস্থ করা হবে খুব বাজেভাবে। এবং সেটা বরকতকে দিয়ে করাবো।”
“আচ্ছা বলতেছি। বাড়িতে চল। এই বাদশা কবরটা সমান করে ফেল।”
বলল খালেদ।
“বাদশা কিছুই করতে হবে না তোর। এগুলো এভাবেই থাক এখন।”
বলল রাজ।
তখন আসলাম বলার জন্য প্রস্তুতি নিলো।
কিন্তু পারলো না। বরকত ও মনসুর, তিনজন পুলিশকে সাথে নিয়ে সোজা কবরস্থানে চলে এলো। খালেদ ও আসলাম পালাতে দৌড় দিলো। পারলো না। রাজ ও বাদশা খরগোশের মতো তিনলাফ দিয়ে ধরে ফেলল দুজনকে।
পুলিশ তাদের হাতে হাতকড়া পরিয়ে ফেললো। বাদশাকে দিয়ে মৃত ব্যক্তির কিছু হাড়গোড় তুলে নিলো ব্যাগে করে।
রাজের দিকে চেয়ে বড় দুই ভাই ঘৃণামিশ্রিত নির্বাক কণ্ঠে বললো,
“এই প্রতিদান দিলি মায়ের পেটের ভাই হয়ে? এমন জানলে তোকে ছোট থাকতে পুকুরে ফেলে মেরে ফেলতাম।”
“পাপ করেছেন। এবার তার সাজা পেতে চলে যান আসল ঠিকানায়। পুলিশকে আমি খবর দিইনি।”
তারা কাতর স্বরে পুলিশদেরকে অনুনয় করে বললো,
” থানায় নেওয়ার আগে আমাদের কথা শুনুন।”
“যা বলার আদালতে বলবেন। আপনাদের নামে মানুষ হত্যার মামলা হয়েছে। চলুন।”
কাচারিঘরের উঠানে পুলিশের গাড়ি অপেক্ষা করছে। তালুকদারসহ বাড়ির সবাই সেখানে জড়ো হয়ে আছে। সুমনা ও ডলি কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো নিজের স্বামীকে জড়িয়ে ধরে। পুলিশ, খালেদ ও আসলামকে টেনে গাড়িতে তুলে ফেললো। সুফিয়া বিবি দুই ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন নিরব অশ্রু ফেলতে ফেলতে। তালুকদার মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে রইলেন। তিনি পাহাড়ের মতো অবিচল ও পাথরের মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ছেলেদের সাথে কোন কথা বললেন না। তারাও পিতার দিকে তাকালো না।
শিখা ও ফুল গুটিসুটি মেরে গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে রইলো। খালেদ ও আসলাম আজরাইলের মতো করে শিখার দিকে তাকালো এক পলক। আসলাম দাঁতে দাঁত পিষে গোপনে উচ্চারণ করলো,
“একবার যদি ছাড়া পাই,দুই ভাই তোরে উদাম কইরা ডাইরেক্ট একশান নিমু। মনে রাখিস রুপসী মা * গী।”
সুমনা, ডলি ছুটে গিয়ে রাজের পায়ে পড়ে বললো,
“এমন নিষ্ঠুর হইয়েন না ছোট ভাই। আপনার ভাইদের বাঁচান।”
রাজ পা সরিয়ে অন্যদিকে সরে গেলো। ভার কণ্ঠে মনসুরকে জিজ্ঞেস করলো,
“কাকা এত রাতে আপনারা কীভাবে খবর পেলেন?”
“বরকত গিয়া কইলো আমাদের। তখন আমরা সাথে সাথে থানায় চইলা গ্যাছি বাবা।”
“আচ্ছা দিনে আলাপ হবে৷ আপনারা এখন চলে যান।”
মনসুর, তারসাথে আসা লোকজন নিয়ে চলে গেলো তাদের বাড়ি। রাজ বরকতকে জিজ্ঞেস করলো,
“তোকে কে আদেশ দিলো তাদের বাড়ি যেতে?”
“ভাবি।”
নোয়ানো স্বরে উত্তর দিলো বরকত।
রাজ ঘাড় ঘুরিয়ে শিখার দিকে চাইলো। সবাইকে বললো ঘরে গিয়ে শুয়ে যেতে। সবাই চলে গেলো। শিখাও দোতলায় চলে গেলো।
বাদশা রাজের কাছে এসে চাপাস্বরে জিজ্ঞেস করলো,
“ভাই কখন আইলেন বাড়ি? আপনারে কবরের কথা কে কইলো? ভাবি?”
“হুম। কিন্তু কবরের বিষয়ে সে কিছুই বলেনি। আদুরী ঘরের দরজা খুলে দিলো। আমি দোতলায় গিয়ে রুমে ডুকে মানিব্যাগ রেখে নিচে নেমে এলাম। তোর ভাবির রুমে গিয়ে ওকে দেখতে না পেয়ে সব রুমে খুঁজলাম। পরে মাকে জিজ্ঞেস করলাম। মা উঠে গিয়ে বাবাকে বললো। এভাবে সবাই জেনে গেলো। সবাই মিলে উঠানে বের হলাম। রান্নাঘরে গিয়ে দেখলাম মতির মা চাচী একাই ঘুমিয়েছে। পরে তোর থাকার ঘরের সামনে গেলাম সবাই। দরজায় টোকা মারতেই তোর বউ উঠে এসে দরজা খুলে দিলো। পিছন দিয়ে শিখা উঠে এলো। আকস্মিকভাবে আমাকে দেখে তারা দুজনই ভড়কে গেলো।
তখন শিখা বললো,
” আপনাদের বাড়ির শেষ মাথার বাগানের, শেষ মাথায় আছে বাদশা ভাই। ফুল একা বলে আমাকে তার কাছে রেখে গেলো।”
কারণ জিজ্ঞেস করলাম। বললো,
“গেলেই দেখতে পাবেন। আপনার বাকি দুইভাইও আছে সেখানে। পরে আমার সাথে সবাই আসতে চাইলো। আমি আনিনি। সবাইকে উঠানে দাঁড় করিয়ে আমি একাই গেলাম। বুঝলি?”
“বুঝলাম।”
বাদশা চলে গেলো তার থাকার ঘরে। রাজ ঘরে ঢুকে কারো সঙ্গে কোন কথা বলল না। ভারি ভারি পায়ে উপরে চলে এলো। শিখাকে জিজ্ঞেস করলো,
“মনসুর কাকার কাছে বরকতকে কখন পাঠালে?”
“আপনি বাগানের দিকে যাওয়ার পর।”
“আগে পাঠালে না কেন?”
“আপনাকে দেখার পর সাহস দুঃসাহসে পরিণত হলো। যেটা তার পূর্বমুহূর্তে ছিল না। ঘটনা এতক্ষণে জেনে গিয়েছেন নিশ্চয়ই।”
“হুম। তবে এটা আমি কল্পনাই করতে পারিনি। আমার ভাইদের দ্বারা এত বর্বরোচিত ঘটনা ঘটতে পারে। ভেবেছিলাম বাদশার কোন কুকীর্তি। তাই তারা দুইভাই তাকে ধরতে গিয়েছে। বা শাস্তি দিতে গিয়েছে।”
“আপনি কি আমার উপর মনঃক্ষুণ্ন?আর ঢাকায় কবে এলেন?”
রাজ শিখাকে টেনে নিজের বুকের ওমে মিশিয়ে নিলো। সারাগালে উষ্ণ অধরের পরশ বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,
“একদম নাহ। বরং তাদের পুলিশে সোর্পদ করা আরো আগেই দরকার ছিলো। আমি গতকাল এসেছি। এসেই জানতে পারলাম তুমি বাড়িতে এসেছে। দেরি কি সহ্য হয় আমার? আর মায়ের অসুস্থতার কথাও জানতে পারলাম। ও হ্যাঁ, আদুরীর মেয়ের জন্য একটা চেইন এনেছি। সকালে দেখাবো তোমাকে। একটা মাত্র ভাগনি আমার। এই প্রথম মামা হলাম।”
“বেশ করেছেন। আমি কয়েকবার এটা ভেবেছি। আমি একা আর কী দিবো। তাই শুধু দুইসেট বেবিড্রেস নিয়ে এসেছি তাওয়েলসহ।”
“তোমার স্থানে তুমি ঠিক করেছো। আচ্ছা আমি বাবা হবো কবে?”
“আল্লায় জানে। আমি জানি না।”
“কেবল আল্লায় জানলে হবে প্রজাপতি? তোমারও জানতে হবে যে?”
শিখা রাজের শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে গলায় উদ্বেগ ঢেলে বললো,
” বাদ দেন একথা। আচ্ছা,এখন উনাদের কী সাজা হবে? আপনি কী উনাদের জামিনের ব্যবস্থা করবেন?”
রাজ ভ্রু কুঁচকে হাসলো। বলল,
“ওকালতি পড়ছো তুমি। আর জিজ্ঞেস করছো আমাকে? দেশের প্রচলিত ‘ল’ অনুযায়ী হ* ত্যার সাজা যা হওয়ার তাই হবে। তাদের বউরা যদি কোন লইয়ার নিযুক্ত করে। করবে। সেটা তাদের বিষয়। আমার কিছুই করার নেই।”
শিখার ঠোঁটের আগায় একটা বাক্য এসে ভর করলো। তার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে রাজকে,
আপনিও কি কোন দুই নাম্বার কাজের সাথে জড়িত? কিন্তু বলল না। এতদিন পর তার প্রাণের মানুষটা কাছে এলো। চাক্ষুষ প্রমাণ না পেয়ে এভাবে জিজ্ঞেস করা সমীচীন হবে না। শিখা গিলে ফেললো বাক্যটা। যে মানুষটার জন্য তার একটা নিশ্চিত ও উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়তে যাচ্ছে, তাকে হুট করে কিছু বলে আঘাত করা অনুচিত।
রাজ ফ্রেস হয়ে নিলো। শিখাকে কোলে তুলে পালংকের উপরে শুইয়ে দিলো। নিজেও লুঙির কুচি আগলে তুলে শুয়ে পড়লো। কাত হয়ে শিখার কানের নরম লতিতে আলতো কামড় বসালো।
রোমাঞ্চিত স্বরে জানতে চাইলো,
“আমাকে কখন কখন মনে পড়তো?”
“যার বাস আমার হৃদয় কুঠুরিতে। তাকে আলাদা করে মনে পড়ার কারণ নেই। সেতো মিশে আছে আমার প্রতি মূহুর্তের কল্পনায়।”
“যুক্তি চমৎকার। মনঃপূত হলো।”
“একই জিজ্ঞাসা,আমারও। উত্তর দিন।”
রাজ শিখার খোলা পেটে হাত রেখে নাড়াচাড়া করতে করতে বললো,
“মিশে আছো নিঃশ্বাসে। ভোলার নেইতো সুযোগ।”
“হাত সরান। ফাজলামো করছেন কেন?”
রাজ শিখার পেট থেকে হাত সরিয়ে নিলো। কাঁধ থেকে চুল সরিয়ে ঘাড়ে ঠোঁট চেপে ধরে বলল,
“ফাজলামো করবো কেন? সুখপান করছি সুখপেয়ালা হতে। ভালই নাদুসনুদুস হয়েছো। এখন মজা হবে ডাবল ডাবল। ছক্কা মারতে আরাম হবে।”
পরেরদিন সকালে নাস্তা খাওয়ার পর রাজ ভাগনিকে কোলে নিয়ে গলায় চেইন পরিয়ে দিলো। এতে আদুরীসহ সবাই বেশ খুশী হলো। তারপর রাজ চাচীর সাথে গিয়ে দেখা করলো। জুবায়েরের বিষয়ে অনেক কথা বললো দুজনে। সে আমেনাকে আস্বাস দিলো যে করেই হোক জুবায়েরকে দেশে আনবে ও বিয়ে করাতে রাজী হবে। আমেনাও ভরসা পেলো ভাতিজার কথায়।
তারপর রাজ গিয়ে মায়ের পাশে বসলো। মাকে অনুরোধ করলো তাদের সাথে ঢাকায় যাওয়ার জন্য। সে উন্নত চিকিৎসা করাবে মাকে। কিন্তু সুফিয়া নাছোড়বান্দা। তার হাতে গড়া সংসার ফেলে সে কোথাও যাবে না। দুই ছেলে জেলে। তারজন্য সে মানসিকভাবেও মর্মাহত! পযুদস্ত! কাহিল!
তার বিশ্বাস, সে শহরে গেলে আর বেঁচে ফিরবে না। রাজ হতাশ মনে মায়ের পাশ হতে উঠে গেলো।
সেদিন বিকেলে রানির গলা ফাটা চিৎকার শুনে সবাই বেরিয়ে গেলো ঘর হতে। রাজ শিখা কেউই বাকি রইলো না সুফিয়া বিবি ছাড়া। পুকুর পাড় ঘেঁষা বাগানের ভিতর রানিকে দেখতে পেলো তারা। তার লম্বা চওড়া দেহখানি গড়াগড়ি করছে ময়লা পাতার স্তুপের উপর।
“কী হয়েছে?”
জিজ্ঞেস করলো সবাই।
রানি সীমাহীন যন্ত্রণায় কোঁকাতে কোঁকাতে পরনের কাপড় কিছুটা উপরে তুলে তার পায়ের গোড়ালি দেখিয়ে বললো,
“কালসাপে ছোবল মারছে আমার ঠ্যাংগে। ওমাগো! আল্লাহগো! মইরা যাইতেছিগো মা।”
রাজসহ সবাই দেখলো সত্যি তার পায়ে সাপের ছোবল। কিন্তু আশেপাশে কোন সাপ নেই। রাজ হেঁড়ে গলায় বরকতকে ডাক দিলো। বললো,
“দৌড়ে যা। অলি ওঝাকে নিয়ে আয়। যা। কুইক।”
বরকত লুংগি হাঁটুর উপর তুলে দৌড়াতে লাগলো। আমেনার নির্দেশ পেয়ে আদুরি, ফুল, ডলি মিলে এক টুকরো পাটের দড়ি খুঁজে বের করলো। শক্ত করে রানির পায়ের হাঁটু থেকে শুরু করে পাতা অবধি পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে বেঁধে ফেললো। ফুল দৌড়ে গিয়ে সামনের উঠানে বড় একটি পাটি বিছিয়ে নিলো। বাদশা,
আদুরী,সুমনা,ডলি, শিখা মিলে রানিকে ধরাধরি করে উঠানে,নিয়ে গেলো। রাজ স্পর্শ করল না রানিকে। সে তাদের সাথে সাথে উঠানে গেলো।
আদুরী দরদ মেশানো আহত গলায় বললো রানিকে,
“ভাবি আল্লাহকে ডাকো। কেন গেছিলা সেখানে? কীভাবে সাপে দংশন করলো তোমারে?”
“কুত্তায় কামড়াইছে আমারে। পাকা আতাফল দেখতে গেছিলাম। পাতার ভিতরে সাপ আছিলো। তার গায়ে আমার ঠ্যাং পড়তেই সে মাথা তুইলা আমার ঠ্যাংগে পটাপট ছোবল মাইরা চইলা গ্যালো অন্যদিকে। এই সাপরে না মারলে বিপদ আছে কইলাম।”
মুখ বিকৃত করে বলল শিখা।
“কুত্তায় কামড়াইলে ত বাঁচতি। কি হাপ চিনবার পারছস? ঢোঁড়াহাপ নি?”
“নাগো চাচী। ডেঞ্জারাস সাপ এইটা।”
মতির মা তার জানা ঘরোয়া টোটকা প্রয়োগ করছে রানীর শরিরের উপরে। আদুরী তার মাকে আস্তে আস্তে উঠানে নিয়ে একটি মোড়ায় হেলান দিয়ে বসিয়ে দিলো। রাজ একটি চেয়ার নিয়ে মায়ের কাছে বসলো। মায়ের মাথাকে নিজের বুকের দিকে হেলান দিয়ে নিলো আরাম দেওয়ার উদ্দেশ্যে।
বরকত, ওঝাকে নিয়ে আসলো। ওঝা তার হেকিমি চিকিৎসা শুরু করলো। কিন্তু লাভ হলো না। ততক্ষণে সময় গড়ালো বেশ কিছুক্ষণ। মুখ দিয়ে ফেণা বের হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লো তালুকদার পরিবারের অনেকের প্রিয় নিঃসন্তান বড়বধূ রানী।
সবাই বিদ্যুৎ শকের মতো স্তম্ভিত হয়ে গেলো। আদুরী,সুফিয়া,ডলি,ফুল,মতির মা কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। শিখার দু-চোখ অশ্রুতে সিক্ত হলো। বরকত গিয়ে রানির বাবার বাড়ি খবর দিলো। তারা রানির লাশ নিয়ে যেতে চাইলো। কিন্তু তালুকদার তা হতে দিলনা। রাতেই রানির দাফন সম্পন্ন হলো।
তালুকদার পরিবারে আবারো নেমে এলো ভয়াবহ বিপর্যয়। একদিকে দুই ছেলে জেলে। মারা গেলো পরিবারের বড় বউ। তার মন্দ কাজগুলো বাদ দিলে তালুকদার পরিবারে তার শ্রম,ত্যাগ,ধৈর্য মনে রাখার মতো। আদুরী একটি ক্ষণের জন্যও ভুলতে পারছে না তার প্রিয় বড় ভাবিকে। সুফিয়া বিবিও থেমে থেমে স্মরণ করছে বড় ছেলের বউকে।
রাজ,শিখাকে নিয়ে স্বশুর বাড়িতে গেলো। একদিন বেড়ালো সেখানে। আসার সময় নূরিকে অনুরোধ করে বললো,
“আম্মা, আপনি নাকি বাড়িতে আসার জন্য খুব অস্থির হয়ে গিয়েছেন? আপনার আদরের ছোট মেয়ে ঢাকায় থাকে। তার নিজের ফ্ল্যাট। পাঁচ, ছয় বছর পরে সে এডভোকেট হয়ে যাবে। সবইতো আপনার আনন্দ, গর্ব আম্মা। তাই বলি কী, আপনি শহরে থাকার ও ভালোলাগার অভ্যাসটা গড়ে তুলুন। মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিন আম্মা।”
নূরী কৌতুক করে জামাইকে বললো,
“তুমি এমনভাবে কইতাছো,যেন বহু বছরের লাইগা তুমি উধাও হইয়া যাইবা? যাও যামুনি আমার মাইয়ার কাছে।”
রাজ হেসে ফেললো। বললো,
“আম্মা আসি। আমার জন্য দোয়া করবেন।”
রাজ ঝুঁকে বসে নূরীর দুপা ছুঁয়ে সালাম দিলো। নূরী মাতৃস্নেহে রাজের মাথায় হাত বুলিয়ে আশীর্বাদ করে দিলো।
বাড়িতে চলে গেলো রাজ ও শিখা। তার দুদিন পর রাজ শিখাকে নিয়ে ঢাকায় চলে এলো। আসার সময় সুফিয়া বিবি রাজকে জড়িয়ে ধরে অনেক কাঁদলো। তালুকদার, আদুরীসহ ঘরের অনেকেই কাঁদলো রাজের জন্য। সবার কান্নার হেতু হলো,একে একে এই ঘরের সবাই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছে। রাজের এক ভাই মরে গেলো। হয়তো বাকি দুই ভাইয়েরও ফাঁসী হবে। বাকি আছে একমাত্র রাজ। সে সবার আদরের ও প্রিয়।।আল্লাহ যেন তাকে শহরে সহী সালামতে রাখে।
রাজ ও শিখা তাদের বাসায় পৌঁছে গেলো। কাজের খালাও রোজ এসে তার কাজ করে দিয়ে যাচ্ছে। শিখা তার পড়াশোনায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো। কিছুদিন পর শিখার আবার পরিক্ষা শুরু হলো। রেজাল্ট প্রকাশ হলো। তার রেজাল্ট দেখে রাজের খুশীর সীমা নেই।
শিখা ও রাজের যুগল জীবনের চতুর্থ বিবাহ বার্ষিকী এলো। তা উদযাপন করার জন্য রাজ শিখাকে নিয়ে কক্সবাজারে গেলো। বিচের পাশাপাশি একটি মনোরম হোটেলে উঠলো তারা। দিনে দুজনে চলে যায় সমুদ্রে সৈকতে। সমুদ্রের নোনা জলে নেচে কুদে আনন্দ করলো। এ যেন এক মহোৎসব। ফেনিল উচ্ছ্বাসে প্রায় ডুবে যাওয়া শিখার অনেকগুলো ছবি তুললো রাজ। পরে অপরিচিত একজনকে দিয়ে নিজের ও শিখার বিভিন্ন রকম রোমান্টিক পোজের ছবি ক্যামেরাবন্দী করলো। দুজন দুজনের ভালোবাসায় ব্যাকুল। এক সপ্তাহ ভ্রমন শেষে পরে রাজ শিখাকে নিয়ে ঢাকায় ফিরলো। এভাবে উপভোগের মধ্য দিয়ে বিদায় নিলো সাল ১৯৯৪।
শীতকে সঙ্গী করে শুরু হলো নতুন বছর। সাল ১৯৯৫। শীতে শিখার ঘুরতে ভালোলাগে। তাই রাজ তাকে নিয়ে ঢাকার অদূরে কিছু জেলায় ঘুরতে গেলো। টাঙ্গাইল, গাজিপুর,মানিকগঞ্জ, নরসিংদীর ভ্রমনের স্পটগুলোতে সে শিখাকে নিয়ে গেলো।
সব মিলিয়ে রাজ ব্যক্তিগত জীবনে সুখী শিখাকে নিয়ে। শিখাও তার ব্যতিক্রম নয়। শিখা এলএলবির দ্বিতীয় বর্ষে উঠে গেলো। যত সময় গড়ায় ততই শিখার চোখে রঙিন স্বপ্ন গভীর থেকে গভীর হতে থাকে । একদিন সে নামকরা আইনজীবী হবে। সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে লড়বে সে। চোখের সামনে কোন অন্যায়,অপরাধ হতে দিবেনা। আপোষ করবে না দেহে প্রাণ থাকতে।
সেই শীতের প্রকোপ না শেষ হতেই সুফিয়ার ইহলীলা সাঙ্গ হলো। ঢাকায় টেলিফোন এলে রাজ উম্মাদের মতো শিখাকে নিয়ে গ্রামে চলে গেলো। রাজ মায়ের শবদেহের পাশে আছড়ে পড়লো। ছোট বাচ্চার মতো হাউমাউ করে অশ্রুপাত করতে লাগলো। আদুরী ভাইয়ের গলা পেঁচিয়ে বিলাপ জুড়ে দিলো। থানায় গিয়ে জানানো হলো রানি ও সুফিয়ার মৃত্যু সংবাদ। কর্তব্যরত প্রহরী খালেদ ও আসলামকে সংবাদ দিলো। শিখার উপর তাদের ঘৃণা পাহাড়সম হয়ে গেলো। তবে তারা মাকে দেখতে ইচ্ছাপোষণ করল না। ভাবলো মায়ের মৃতমুখ দেখে কী আর হবে। বরং সবাই লা* শ ফেলে তাদেরকে দেখবে সার্কাসের মতো।
গোটা তালুকদার বাড়ি শোকে শোকাচ্ছন্ন। পরিবেশ মেঘাচ্ছন্ন। থমথমে। সুফিয়ার জন্য প্রতিটি মানুষ চোখের জল ফেললো। রাজ ও আদুরী মাকে নিয়ে নিজেদের ছোটবেলার নানা স্মৃতি মনে করেই কান্নায় ভেঙে পড়ে। তালুকদার ঘোলাটে চোখে আকাশপানে চেয়ে থাকে সারাক্ষণ। দুটো গরু জবাই করে মহা আয়োজনে সুফিয়া বিবির কূলখানি সমাপ্ত করলো রাজ। উজানপুর গ্রামের সব দরিদ্র মানুষ, মাদ্রাসার এতিম ছাত্র সবাইকে ভরপুর খাওয়ালো। মসজিদের কয়েকজন হাফেজ দিয়ে কোরান খতম, মিলাদ পড়ানো,দরুদপাঠ কিছুই বাকি রাখল না রাজ। রাজ ও আদুরী রোজ কয়েকবার মায়ের কবরের পাশে গিয়ে বসে থাকে। দুই ভাইবোন বলে উঠে,
“বাঁচার সাধ মরে গেলো। মা কেন আমাকে তার সাথে নিয়ে গেলো না। আহারে মা। যত কিছুই হোক মায়ের মতো কেউ নাই। মা মেরেও চায়। বুকে নিয়েও চায়। মায়ের তুলনা কেবলই মা।”
জীবনকে আর থামিয়ে রাখা যায় না। তাকে তার গতিতে চলতে দিতে হয়। তাই সুফিয়া বিবির মৃত্যুর পনেরো দিন পর রাজ শিখাকে নিয়ে ঢাকায় চলে গেলো। আসার সময় শিখা শাশুড়ীর কবরে গিয়ে খুব কাঁদলো। ভুলে গেলো তার উপর শাশুড়ীর করা অমানবিক অত্যাচারগুলো।
মৃত ব্যক্তিকে ক্ষমা করে দিতে হয়। তার উপর ক্ষোভ ধরে রাখা কোন মুমিন মুসলমানের কাজ নয়।
রাজ তার বাবাকে নিয়ে যেতে চাইলো। তিনি কিছুতেই রাজী হলেন না। বললেন বাড়িতেই ভালো আছেন তিনি। শহরে গেলে মন টিকবেনা।
রাজের মন খারাপ থাকে। শিখা রাজকে আলিঙ্গন ও ভালোবাসা দিয়ে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক করে তুললো।
“আল্লাহ তার বান্দাকে ততটুকু দুঃখ বেদনা দেন। যতটুকু বান্দা সহ্য করতে পারবে।”
তাই মাস দুয়েকের ভিতরে রাজ কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে উঠলো। নিয়মিত অফিসে যাচ্ছে। কাজকর্ম করছে মন দিয়ে। পার্টিদের সাথে মিটিংয়ে বসছে।
একদিন শিখা বারান্দায় বসে বসে পত্রিকা পড়ছে। দৈনিক ইনকিলাব। পত্রিকার ভিতরের একটি শিরোনামে তার চোখ আটকে গেলো।
‘ অবশেষে শহরের শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীর সন্ধান মিললো।’
শিখা ডিটেল পড়লো। বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো সে। পূনরায় লেখাটি আবার পড়লো শিখা। তারপর হতে শিখা রাজের সঙ্গে একটু দূরত্ব বজায় রেখে চলে। যা কিনা দুদিন বাদেই রাজের চোখে পড়লো। রাজ শিখাকে বললো,
“কী ব্যাপার শিখা? এনি প্রবলেম? কোন কারণে তুমি আপসেট?
ক্লাসে,ক্যাম্পাসে কোন ঝামেলা? শেয়ার করো প্লিজ।”
শিখা এড়িয়ে যায়। কারণ প্রত্যক্ষ প্রমাণ না পেয়ে সে রাজকে কিছু বলতে চায়না। সে গোপনে সত্যতা জানার চেষ্টা করছে। তারপর রাজের মুখোমুখি হবে। সে কথা ঘুরিয়ে বলে,
“নাহ। আপনাদের বাড়ির কথা মনে হলেই মন খারাপ হয়ে যায়। এই। আর পড়াশোনার চাপতো আছে।”
এভাবে দিন কেটে যাচ্ছে। রাজের সাথে শিখার অভিব্যক্তির পরিবর্তন হলো না। রাজ আর তাকে আগের মতো ছুঁতে পারছে না। ভালোবাসতে পারছে না। শিখার মাঝে কেমন দূর দূর ভাব রাজকে নিয়ে। রাজ মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছে। রাজ আর পারছে না। এক রাতে সে শিখাকে হাত টেনে ধরলো জোর করে। জিজ্ঞেস করলো,
“বলবা তো কি হয়েছে? তোমাকে আমার কিছু বলার ছিলো। কিন্তু দেখো,বলার সময় সুযোগই হচ্ছে না।”
“আপনি আমাকে ছোঁবেন না বলছি।”
শিখার কন্ঠে বিতৃষ্ণা! অসহিষ্ণুতা!
রাজ শিখার চিবুক উঁচিয়ে ঠান্ডা সুরে বললো,
“সূর্যের চেয়েও প্রখর তুমি/তোমার তেজে পুড়ে যাই আমি।
একটু হও শীতল জোছনা/ দূর করে দাও অসীম যন্ত্রণা।”
“সরে যান বলছি।”
“তুমি আসমান,তুমি জমিন/ তোমাতে হই আমি বিলীন।”
“আমাতে বিলীন হতে হবে না আর। অনেক হয়েছে।”
শিখা রাজের হাত থেকে ছুটে গিয়ে অন্যরুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো।
তার পরেরদিন রাতে রাজ শিখার কোমর চেপে ধরলো। শিখা না চাইলেও রাজ নিজ থেকে শিখার সারা শরীরে ঠোঁটের স্পর্শ দিলো। শিখা গভীর স্বাস ছাড়লো। রাজ নেশাতুর চোখে বললো,
“জোছনার আলো নিভে গিয়েছে তোমার দীর্ঘস্বাসে।”
“ছিহ! আপনি নেশা করে এসেছেন? গায়ের থেকে কেমন বাজে স্মেল আসছে।”
“ইয়েস। নেশা করেছি। একশোবার করবো। যার ঘরে শান্তি নেই। তার মনেও শান্তি নেই। আর যার মনে শান্তি নেই,সেতো শান্তি খুঁজবে শরাবের পেয়ালায়।”
শিখা সরে যেতে চেয়েও হেরে গেলো রাজের বাহুওশক্তির কাছে। রাজ জোর করে সেই রাতে অভিসারে মেতে উঠলো। শিখা ভোরেই গোসল সেরে নেয়। নামাজ পড়ে মোনাজাতে আকূল কান্নায় লুটে পড়ে।
ঘটনা তার তিনদিন পরের।
চৈত্রের এক তপ্ত মধ্যদুপুর। মাথার উপরে ঘুরের সিলিং ফ্যান। রাজ ও শিখা দুপুরের ভাত খেয়ে উঠলো। শিখা রাজকে বললো,
“আপনি অফিসে যান না কেন আজকাল?”
রাজ শিখার পায়ের কাছে হাঁটু গেঁড়ে বসলো। দুহাত জোড় করে মিনতি করে বললো,
“তুমি নেই তো আমার কিছুই নেই। তোমার কী হয়েছে? কেন আমাকে ভালোবাসো না? অপরাধ কী আমার? প্লিজ বলো। নয়তো খোদার কসম আমি নিজেকে নিঃশেষ করে দিবো।”
“আপনি আমাকে কিছু বলতে চেয়েছেন?”
“বলবো। এক্ষুনি বলবো মাই লাভ। মাই লাইফ। আগে তুমি আমার সম্পর্কে কী শুনেছো কোথায়? বলো?”
“বলছি। তার আগে যেটা বলতে চাই তা হলো,
শিখা একটি স্ফুলিঙ্গের নাম। যেখানে অনিয়ম, অবিচার দেখবে। সেই ময়দানে শিখা খোলা বারুদ হয়ে ছড়িয়ে পড়বে। জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ভস্মীভূত করে দিবে মুখোশদারীদের কালো মুখোশ।
এবার বলুন,আপনি কী কোন অবৈধ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত? কোন নিষিদ্ধ কাজ করেন আপনি?”
রাজ লম্বা স্বাস ফেললো। বললো,
“যা ধারণা করেছিলাম। শিখা তোমার মনে আছে? যেদিন দিনের আলোয় তোমার আমার প্রথম দর্শন হয় আমাদের বাড়িতে। আমি দরজায় দাঁড়িয়ে কী বলেছিলাম?”
“কী।”
“তুমি আমার জীবনে অজস্র কাঁচের গুঁড়ির মাঝে জ্বলজ্বলে এক টুকরো হীরকখণ্ড!”
“হুম মনে আছে।”
“কেন বলেছি প্রজাপতি? এর ভাবার্থ কী বুঝেছো তুমি? বা কখনো একটিবারের জন্যও জানতে চেয়েছো কেন বললাম অমন কথা? চাওনি। তাই নিজ থেকেই বলার জন্য ইচ্ছুক হলাম।”
“বলেন শুনি।”
শিখার কণ্ঠে কোমলতা। চাহনিতে আকুলতা।
“শোন, সত্যের মাঝেও কিছু সত্য লুকিয়ে থাকে। আমরা সেই সত্যের তল খোঁজার চেষ্টা করি না। বাইরের দৃষ্টি দিয়ে যা দেখি,যা শুনি, তার উপর বিচার করেই কাছের মানুষটাকে সন্দেহ করি। ভুল বুঝি। দূরত্ব বাড়াই। উৎসটা কোথা হতে,কীভাবে, কার জন্য তা বুঝতে চাই না।”
শিখা রাজের বুকে মাথা রাখলো নরম করে। মায়া মায়া সুরে বলল,
“আমি আপনাকে ভুল বুঝিনি। বা বুঝবোও না। আমার যত কষ্ট,যত দহন, তা হলো আপনি লুকালেন কেন আমার কাছে?”
“আমি কিছুই লুকাতে চাইনি। এই তোমায় ছুঁয়ে বলছি। বলতে গিয়েও বলতে পারিনি আমার একটা গল্প। যেই গল্প আঁধারের। মরিচীকার।”
“বলেন। আমার হৃদয় শোনার অপেক্ষায়।”
রাজ বলতে গিয়েও থামতে হলো কলিংবেলের কর্কশ আওয়াজে। রাজ উঠে গিয়ে বাসার দরজা খুলে দিলো। শিখাও রাজের সাথে দরজায় এসে দাঁড়ালো। চারজন পুলিশ দেখে রাজ খানিক ভড়কে গেলো।
“আপনি নওশাদ তালুকদার?”
“ইয়েস।”
“থানায় চলুন। আপনার নামে মামলা হয়েছে অবৈধ ব্যবসার।”
আপনারা ভিতরে এসে বসুন। আমি রেডি হয়ে নিচ্ছি। রাজ শিখাকে নিয়ে ভিতরে চলে গেলো। শিখা রাজকে জড়িয়ে ধরে আর্তনাদ শুরু করলো। তাদের কাছে এসে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
“দয়া করুন। উনাকে এরেস্ট করবেন না। উনি যদি কোন খারাপ কাজ করে থাকে,তবে সেই পথ ছেড়ে দিবে। আমি কথা দিচ্ছি আপনাদের।”
“ম্যাডাম আইন ত আপনার মুখের কথায় চলে না। উনি নির্দোষ প্রমাণ হলে এমনিতেই ছাড়া পেয়ে যাবে।”
শিখার পাগল পাগল দশা। রুমের ভিতরে গিয়ে রাজের পায়ে লুটিয়ে পড়লো।
“আমি আপনাকে ছাড়া বাঁচবো কীভাবে? আমিও আপনার সাথে যাবো।”
রাজ শিখাকে ধরে দাঁড় করালো। নির্লিপ্ত গলায় বললো,
” পাগলামি করো না। তুমি বাসায় থাকো। কোরান তেলওয়াত করো। আচ্ছা রাজবধূ, তুমি কী এই ভিতরে অন্য কারো হয়ে যাবে?”
রাজবধূ পর্ব ৭২
“কোনদিনও না। ভুলেওনা। মরনেও না। জীবনেও না। আমার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আমি রাজবধূ হয়েই বেঁচে রবো। আমি আপনাকে মুক্ত করার ব্যবস্থা করবোই। ইনশাআল্লাহ। যেকোন উপায়ে হোক। আপনাকে ভালোবাসি এক পৃথিবী। ভালোবাসিইই।”
রাজ শিখার কপালে নরম চুমু খেলো। বললো,
“কারাগারে বেঁচে রবো কেবল তোমার এই কথাগুলো স্মরণ করে করেই। আমাদের দেখা হবে ঠিক পাঁচ বছর পরে। নিজের যত্ন নিও।”
পুলিশ রাজকে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে গেলো। শিখা বারান্দায় দাঁড়িয়ে দৃষ্টির আড়াল হওয়া পর্যন্ত তাকিয়ে রইলো গাড়িটার দিকে।