রাজবধূ পর্ব ৮

রাজবধূ পর্ব ৮
রেহানা পুতুল

শিখা নিরালা দুপুরে মায়ের কাছে গিয়ে নিরিবিলি বসলো। কৌতুহল মিশ্রিত কন্ঠে জানতে চাইলো,
“আম্মা বুঝলাম না, বিয়ার পর ওরা আমারে আলাদা রাখলো ক্যান? উনিও প্রতিবাদ করল না। হাসিমুখেই মাইনা নিলো। আবার উনার কথায় মনে হইলো সহজে আর গ্রামে আইব না। আমি শরমে এসব উনারে জিগাইনাই। উনি কইলো তোমার থেইকা জাইনা নিতে।”
নূরী সরস হেসে মেয়েকে বলল,
“অবসর হইয়া সব কইতাছি মা। রান্ধন শ্যাষ হউক।”

দুপুরে খাওয়ার পর নূরীর চোখে ভাতঘুম নেমে এলো। আলোও ঘুমিয়ে পড়লো। তার স্বামী মতিন চলে গেলো নিজের বাড়িতে। আলো, ছোটবোন আছে বিধায় রয়ে গেলো মায়ের কাছে। শিখা স্বভাবে চঞ্চল! দুরন্ত! তার ঘুম আসছে না কিছুতেই। পড়া নিয়ে বলা রাজের কথাটা তাকে আরো মনোযোগী করে তুলল পড়ার দিকে। ভালো করে অধ্যায়ন করতে হবে। এত সুন্দর ও ভালো বরের মনে ব্যথা দেওয়া যাবে না। বরং খুশি রাখতে হবে তার উপর। তার সাত জনমের কপাল রাজের মতো ছেলে তাকে বিয়ে করেছে। শিখা পড়ার টেবিলে বসে কিছুক্ষন পড়াশোনা করলো উড়ুউড়ু মন নিয়ে৷ সামনে টেস্ট পরিক্ষা। উজানপুর স্বশুর বাড়িতে গেলে আবার কয়দিন পড়াশোনা হবে না। যদিও পড়তে পড়তে মনঃস্থির করলো গুরুত্বপূর্ণ বইখাতাগুলো নিয়ে যাবে যাওয়ার সময়।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

দিনের আলোকে বিদায় জানিয়ে সাঁঝের আগমন হলো। প্রকৃতিজুড়েও ভর করলো অবাধ নিরবতা। ঝুপ করে ধরনীতে নেমে এলো মায়াবি আঁধার। সেই আঁধারে মিশে আছে হেমন্তের মৃদু ঠান্ডা আমেজ। বাড়ির প্রতিটি ঘরে ঘরে জ্বলে উঠলো একশো ওয়াটের বৈদ্যুতিক বাল্ব। যখন নূরীর বিয়ে হয় তখন পুরো মধুপুর গ্রামেই বিদুৎতের সংযোগ ছিল না। এখন শুধু নূরীর ঘরে নেই। তার ভাগ্য আজো তাকে হারিকেন, প্রদীপের আলোতেই রাখছে। তার বড় মেয়ে জন্মাবার পর মকবুল শখ করে নাম রেখেছে আলো। সেদিন নূরীর চিবুক উঁচিয়ে মকবুল বলেছিলো,
” নূরী আর নূর ওই একই। আলো। আর এখন আমার ফুটফুটে কন্যার নামও রাখিলাম আলো। আমার ঘর এমনিতেই আলোয় মাখামাখি হইয়া যাইবো। মানুষের সৃষ্টি বিদ্যুৎ লাগবে না।”

নূরী বহু পুরোনো হারিকেনটায় কেরোসিন তেল ঢেলে নিলো। এই হারিকেনটার সাথে মিশে আছে তার মায়া মায়া কিছু মধুর সুখ জাগানিয়া স্মৃতি। নওজোয়ান মকবুলের সঙ্গে তার বাসর হয়েছে এই হারিকেনের আলোয়। ভোর অবধি এই হারিকেনের আলো মকবুকলকে সাহায্য করেছিল নূরীর চাঁদের মতো অপরুপ কচি মুখখানা দেখতে। আহা জীবন! তুমি এই ভাঙো এই গড়ো। নূরী বুক ভরে আক্ষেপের দম ছাড়ে। কালিতে ভরা কাঁচের সিমনিটা মুছে জ্বালিয়ে নেয়। ঘরের মাঝখানে রেখে দিলো। এতে দুই রুমের ছোট্ট দোচালা বেড়ার ঘরটি পুরোটায় হালকা আলো ছড়িয়ে যাবে।
বড় মেয়ে আলো, কূপি জ্বালিয়ে সামনের রুমে টেবিলের উপর রাখলো। শিখা ছোঁক ছোঁক করছে মাকে অবসর পাওয়ার অপেক্ষায়। নূরী ঘরে ভাজা মচমচে মুড়ি ও রাজের আনা মিষ্টি আনলো মেয়েদের সামনে। বড় স্টিলের বাটিটা ঠেলে দিয়ে বলল,

“রসগোল্লা দিয়া মুড়ি মাখায়া খা। স্বাদ আছে এইটা। জামাইর আনা কত কিছু পইড়া আছে। খাইস যেইটা মন চায় নিয়া। সবাইরে বিলায়াও কত রইলো। এত না আনলেও হইতো।”
আলো বলে উঠলো,
“আম্মার যা কথা। তোমার আমির জামাই। স্বশুর বাড়িত প্রথম আইলো। আনবো না? আনছে ভালো হইছে। কিপটা হইলেতো আমরা শরম পাইতাম। ”
খাটের উপরে বসে বসে মা মেয়েরা নাস্তা খাচ্ছে। রসগোল্লা দিয়ে মুড়ি মাখা এক মুঠি মুখে পুরে দিলো শিখা। চিবানোর মাঝেই বলল,
“আম্মা, দুপুরে যে কইছিলা ওগুলা কইবা,কওনা এখন?”
“কি? ও মনে হইছে? এইটা মুখের খাওন শ্যাষ হইলে জিগান যাইতো না? কতদিন কইছি মুখে খাওন রাইখা কথা কইবি না। ভালো দেখায় না এইটা। শব্দ অসুন্দর ও অপরিস্কার শুনা যায়। হয় আগে কইবি নয় পরে কইবি। বদ খাসলত এডি চেঞ্জ কর। এখন বড় ঘরের বউ হইছোত। সবকিছু বড়,উন্নত হওয়া চাই। পরিবেশ থেইকা শিখিস কিছু।”

শিখাকে শাসনের সুরে বলল তার আদর্শবাদী,স্পষ্টবাদী,প্রতিবাদী বিধবা মা নূরী।
“এই যে গিললাম। এবার কও।”
আলো বলল,
“কি আম্মা? শিখা কি জানতে চায় তোমার কাছে।”
“কথা না কইয়া হুইনা যা আমার কথা।”
আলোকে বলল নূরী। এখন খাওয়ার চেয়েও আলো ও শিখার অধিক মনোযোগ মায়ের দিকে। নূরী বলতে শুরু করলো,

“প্যাঁচগোছের কিছু না। সোজাসাপটা কাহিনি। তোর আব্বায় ছিলো কিছু পড়াশোনা জানা মানুষ। ব্রেনও ভালো ছিলো। অভাবী ঘরের ছেলে বইলা পরিবারের চাপে,পরিস্থিতিতে সে কাজেকর্মে ঢুইকা গ্যালো পড়ায় ইস্তফা দিয়া। এসব আমার শুনা কথা। এরপর সময় হইলে তার মা,বাবা তার লগে আমার বিয়া দেয়। আমি বেশী পড়িনাই। সুন্দর ছিলাম বইলা আমার বাপমায়ে বেশী বিদ্যা গ্রহণের সুযোগ দেয়নাই আমারে। এরপর আলো যখন প্যাটে আসে, তখন এক অমাবইস্যার রাইতে ঘরের দাওয়ার দুজন বইসা গল্প করতাছিলাম। তোর দাদা,দাদীসহ ঘরের সকলেই ঘুমায়া গেছিলো। তখন এক দুই কথায় তোর আব্বা আমারে কইছিলো,
দেখো নূরী দিনের আলোয় সবকিছু কি সুন্দর দেখা যায়। আর রাতের এই ঘোর আঁধারের সুযোগ নিয়া মানুষ যতসব আকাম কুকাম,দুই নাম্বারি কাজ কইরা বেড়ায়। আবার ধরা খাইলে সব শেষ। আল্লায় বাঁচাইলে ছেলে হোক আর মেয়ে হোক আমার সন্তানদের আমি সূর্যের তীব্র আলোর মতো মানুষ করমু। যেনো সমাজে তারা মাথা উঁচু কইরা চলতে পারে। মানুষ সম্মানের চোখে দেখবো তাদের। আমি আমার শরীরের শেষ রক্তবিন্দু দিয়া হইলেই আমার সন্তানদের পড়াশোনা করামু। এইটা মনে রাইখো নূরী। আমার জীবনের একমাত্র চাওয়া এইটাই। আর কিচ্ছুইনা।
কথাগুলো বলে নূরী দীর্ঘস্বাস ছাড়ল। ফের বলল,

কিন্তু নিয়তির ইশারা আটকানোর সাধ্যি কারোই নাই মা। আলোর বয়স যখন ছয়। ক্লাস ওয়ানে ভর্তি করছি। কত আনন্দ নিয়া ওরে সকাল, রাইতে আমি পড়তে বসাইতাম। এই বাড়ির ওই বাড়ির স্কুলের পোলাপানদের হাওলা কইরা ওরে স্কুলে দিতাম। শিখার ও জন্ম হইছে তখন। বয়স একবছর তার।
আচম্বিতে আমাগো জীবনে ভয়ংকর তুফান আইলো। তোর আব্বা মইরা গ্যালো। আমি দুই চোখে অন্ধকার দেখি খালি। কি করমু দিশা পাইনা। কই যামু। বাবারাওতো গরীব। তোর আব্বারে,আমারে সবাই পছন্দ করতো। তাই সবাই সাহায্যের হাত বাড়ায়া দিলো। আমিও মজবুত হইয়া উঠি। নয়তো সবাই গুঁড়ায়া দিতো। তোর আব্বার স্বপ্ন পূরণের লাইগা আলোর পড়া বন্ধ করিনাই। ওরে ম্যাট্রিক পাশ করাইলাম খাইয়া না খাইয়া। তখন চারদিক থেইকা ভালো ভালো সম্বন্ধ আসতে লাগলো। তোগো বড় চাচা,ফুফু,খালারা আমারে রাইতদিন এক কইরা বুঝাইলো। কইলো,

স্বামী নাই। দুই মাইয়া কান্ধের উপর নিয়া বইসা থাকন বোকামি হইবো। এসএসসি পাস দিলো। কম কি। আলোরে বিয়া দিয়া দাও। আর মকবুলের স্বপ্ন শিখারে দিয়া পূরণ কইরো। এক মাইয়া নিয়া চাপ হইব না। আমরাতো আছি। দিলাম আলোরে বিয়া। তোর পড়াশোনা চালাইতে লাগলাম।
আলোর বিয়ার ঘটক ছেরু মিয়া যখন তোর লাইগা প্রস্তাব আনলো। আমিতো একপায়ে খাড়া। কিছুতেই রাজী হইনা। ছেরু মিয়া তোর বড় চাচারে ধরলো। উনি আমারে বুঝাইলো। তখন আমি ছেরু মিয়ারে কইলাম,
“চাচা আমার কিছু আরজি আছে। এগুলো যদি তারা হাসিমুখে মাইনা নেয়, তাইলে ভাইবা দেখতে পারি।”
সে কইলো, “কওতো হুনি।”

“চাচা এক, আমার মাইয়া ছোট। বয়স কম। আঠারো বছর পূর্ণ হওয়ার আগে জামাই আলাদা থাইকবো। এমনিতে দেখা সাক্ষাৎ ত হইবোই তাগো। একসঙ্গে থাকলে শিখার পড়াশোনা নষ্ট হইবো। তার বাপের স্বপ্ন পূরণে আমি মা হিসেবে চেষ্টার কমতি রাখতে চাইনা।
দুই, শিখার পড়াশোনা বন্ধ করা যাইব না। এবং ক্ষতি করা যাইব না। শুনছি হ্যাগো বড় ঘর। কাম বেশি।”
তিন,কলেজ পাশ করন পর্যন্ত শিখা আমার কাছেই থাকবো। পরেরটা পরে চিন্তা করমু।”
চাইর,
শিখার মন চাইলে জামাকাপড় পরবো। কাপড় পরতে পারে না সে। পরে উষ্ঠা খাইয়া পইড়া দাঁতমুখ ভাঙ্গবো।”
তিনি কইলেন,

“আইচ্ছা। আমি আজই তালুকদার সাহেবরে তোমার আরজিগুলা জানাইতাছি।”
তার দুইদিন পর এক সকালে ছেরু মিয়ারে নিয়া তোর স্বশুর নিজেই হাজির হইলো। আমি শরমে মইরা গ্যাছি। কি দিমু। পরে দিলাম যা দেওনের। তিনিও অনেককিছু নিয়া আইলেন। তিনি আমারে কইলেন,
“আপনার সকল চাওয়া ও শর্তে আমি রাজী আছি। আমাদের বড় ঘর। কয়েকজন কাজের লোক আছে। আর আমাদের তালুকদার ঘরের নিয়ম হইলো তিনদিন পর্যন্ত ছেলে বউয়ের থেকে দূরে থাকবে। চর্তুথ দিনের দিন বউয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে। এই নিয়ম আমার বিবি চালু করছে। ক্যান করছে সেটা আপনার আপাতত না জানলেও চলবো। আর আমার ছেলেতো শহরে থাকে। সেখানে তার বিরাট কাজকারবার। ছয়মাসেও বাড়ি আসেনা। আপনে নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন। তালুকদারের কথার বরখেলাপ হবে না। এক মৃত পিতার স্বপ্ন পূরণে আমি ও আমার ছেলের সর্বাত্মক সহযোগিতা থাকবে। পোশাক পরার বিষয়েও শিখার স্বাধীনতা থাকবে। কথা দিলাম।”
আমি হ্যারে কইলাম,

” ভাইসাহেব, আপনি নাকি আমার ছোট মাইয়ারে দেখছেন? কবে, কই দেখলেন? এখন ত শিখা নাই ঘরে। স্কুলে চইলা গ্যাছে। সকালে প্রাইভেট থাকে। আপনার ছেলে দেখছে শিখারে?”
“আমি না দেখলে সম্বন্ধ ক্যামনে পাঠাইলাম? আমার ছেলে দেখেনাই। দেখবেও না। এটাও তালুকদার ঘরের নিয়ম। পিতামাতার পছন্দেই বিয়া করতে হয় ছেলেমেয়েদের। আর শিখা মাকে আমার ছেলে ক্যান,কোন ছেলে পছন্দ না করবো। বলেন?”

“আলহামদুলিল্লাহ। পিতামাতাকে মান্য করা,শ্রদ্ধা করা ছেলে মেয়ে আমার অনেক পছন্দ।”
“বুঝলি এবার? তখন সব এত তাড়াহুড়ো কইরা হইছে তোরে কওনের সময় সুযোগ হয়নাই। হেরা ধনী বইলা তোর মা লোভে পড়েনাই। গইলা যাইনাই। সব কাটছাঁট কইরাই বিয়া দিছি। তাগোরে হুজুর হুজুর কইরা দেইনাই। বরং তালুকদার অনুরোধ কইরা আমার মাইয়া নিছে। উলটাপালটা করলে আমি কি করতে পারি, হেইটা ত আমিই জানি।”
আত্মবিশ্বাসী সুরে বলল নূরী।
আলো বলল,
“ও। এসব ত জানি। ভাবলাম নতুন কি।”
শিখার সারামুখ আনন্দে ভরে উঠলো। পড়াশোনা করতে পারবে ও বাবার বাড়িতে থাকতে পারবে বলে। বলল,
“আম্মা বুঝলাম। শুইনা খুব ভালো লাগতাছে। কিন্তু হেরা কেমন একটা রুমে আমারে থাকতে দিলো। ব্যবহারও ভালো না আমার সঙ্গে।”

“সেইটা ত আর আমি জানিনা মা। ক্যান অমন রুমে থাকতে দিছে। সেটা তারাই জানে। হাতের পাঁচ আঙ্গুল সমান না। তারা এত সম্পদশালী। তুই গরিবের মাইয়া। তোর লগে হেগো চালচলনে কথাবার্তায় কিছু টুকটাক বড়াই ত থাকবোই। আসল হইলো স্বামী। সেই মেইন। জামাইতো ঠিক আছে। এটাই শুকরিয়া আদায় কর একবার।”
“এএহ আম্মা! একবার নয়। শতবার করছি শুকরিয়া আদায়। কত দামী আংটি দিছে। আম্মা দেখো। আপা দেখনা।”
মুচকি হেসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল শিখা।
আলো বলল,

“হইছে। থাম বইন। আর কয়বার দেখাইবি এই হিরার আংটি। রাতেই ত দেখাইলি। যা এখন তোর কাম হইলো, শুধু ভালো রেজাল্ট করে সবার মুখ উজ্জ্বল করা। এবং জামাইর সঙ্গে চিঠি বিনিময় করে প্রেম করা।”
” ওহ আম্মা। আমিতো উষ্ঠা খাইয়া বৌভাতের দিন হ্যাগো উঠানে পইড়া গ্যাছি। মতির মা খালা ম্যালা ভালা। আমারে রাইতে দিনে সেবা করছে নিজের মাইয়ার মতন। গরিবের মনই বেশি ভালা আম্মা। যা দেখলাম।”
“আল্লাহ! কস কি। নাহ কাপড় পিন্দনের কাম নাই। মাঝে মাঝে পিন্দিস। কোন অনুষ্ঠান হইলে।”
শিখা উঠে গিয়ে পড়তে বসলো। পরেরদিন স্কুলে ক্লাসে গিয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু কুসুমকে সব বলল। কুসুম চমকিত সুরে বলল,

“তোর একখান কপাল। আগে দুইবছর প্রেম করবি প্রেমিকা হয়ে। পরে বউ হয়ে করবি সংসার। প্রেমিকের মতো সে মাঝে মাঝে এসে তোকে দেখে যাবে। বড় জোর হাত ধরা। ইসসস। খুব জ্বলছেরে আমার।”
শিখা ও কুসুম রিনরিনিয়ে চুড়িভাঙ্গা হাসিতে মেতে উঠে।
রাজ শহরে চলে গিয়েছে। তার মেঝো ভাই খালেদ ও সেজো ভাই আসলামও চলে গিয়েছে। বিয়ে উপলক্ষেই তারা গ্রামে এসেছে। তাদের দুই ভাইয়ের একসঙ্গে ব্যবসা। রাজের আলাদা ব্যবসা। রাশেদ বাড়িতেই থাকে। বাড়ির চারপাশ সামলানোর দায়িত্ব তার।

পাঁচদিন পরের এক বিকেলে শিখা বাবার বাড়ি থেকে চলে এলো উজানপুর গ্রামে। তাকে বাদশা ও ফুলবানু গিয়ে নিয়ে এসেছে। শিখা সবাইকে সালাম দিলো। কাউকে পায়ে ধরে কাউকে মুখে। কেউই ভালো করে তার সঙ্গে কথা বলছে না। সেও চুপচাপ রইলো। নূরী শিখিয়ে দিয়েছে অতিরিক্ত কথা যেন বেশি না বলে কারো সঙ্গে।
সন্ধ্যায় শিখা পিছনের উঠানে গিয়ে দাঁড়ালো। জোছনা, দোতলা পাকা খোয়াড়ে হাঁস মুরগী ঢোকাচ্ছে। শিখাকে দেখেই জোছনা বলে উঠলো,
“আসেন আমগো রূপসী ভাবি। মনে হয় একযুগ আপনেরে দেখিনাই। রাজভাই ক্যামনে থাকবো শহরে।”
শিখা ঈষৎ হেসে বলল,

“হাঁস উপরে উইঠা যাইবো?”
“হ। উনারা দামী মানুষ। দোতলায় থাকে। আর মুরগীরা নিচের তলায় থাকে। বজ্জাত আছে। বহুত জ্বালায় আমারে। চিনে না আমারে ভালো কইরা। তাই।”
শিখা রান্নাঘরের পিছনের দিকটায় গেলো একটা পাখি দেখতে পেয়ে। অমনি তার কানে এলো, সুফিয়া বিবিকে কোন এক অচেনা নারী জিজ্ঞেস করছে,
“ভাবি রাজের বউ আইছেনি বাপের বাড়ি বেড়ায়া?”
“হ আইছে।”
“রাজতো চইলা গ্যালো। কে আনলো গিয়া? ভাইয়েনি?”
“নাহ। ভাইয়ে আনব ক্যান? বাদশা আর ফুলবানু গিয়া আনছে।”
“এইটা হইলো ভাবি? তালুকদার ঘরের নতুন বউ কাজের লোক গিয়া আনলো? ঘরের মানুষ গিয়া ইজ্জত কইরা আনলে কি তোমরা বেইজ্জত হইতা?”

“তোমার হগল সময় মুখকাটা কথা। নিচু ঘরের মাইয়ারে নিচু মানুষই গিয়া আনব না কি তালুকদার গিয়া আনবো?এইটাই মানায় হ্যারে। যার যদ্দুর ইজ্জত পাওন দরকার। হ্যারে তদ্দুরই দিতে হয়। নইলে লায় পাইয়া চান্দে উঠবো।”
এরপর আর কারো কথা শিখার কর্ণগোচর হলো না। বুঝলো দুজনেই স্থান ত্যাগ করেছে। শিখা কল থেকে মাগরিবের নামাজের জন্য অযু করে নিলো। নিঃশব্দ পায়ে নিজের রুমে চলে গেলো। আযান দিলে নামাজ পড়ে নিলো। ভাবলো,
আমাদের বাড়ি গ্যালে উনারে চিঠি লিখমু। এইখানে ত কিছুই চিনিনা। জানিনা। উনিও মনে হয় আমাদের বাড়ি গেলেই আমারে চিঠি দিবো।

রাজবধূ পর্ব ৭

উমমম! আমি আগে না। আগে উনি কি লেখে দেখি। পরে আমি সেইটার উত্তর দিমু। ভেবেই কল্পলোকের অচিন রাজ্যে হারিয়ে যায় শিখা। আপন মনে হেসে কুটিকুটি হয়ে যাচ্ছে।
তার সাতদিন পরের এক নির্জন দুপুরে শিখা কিছু একটার জন্য তার খাটের নিচে যায়। তখন সে যা দেখলো,
তার কোন মানে খুঁজে না পেলেও তার মাঝে বিস্ময় ও কৌতুহলের সীমা রইল না।

রাজবধূ পর্ব ৯