রিদ মায়ার প্রেমগাঁথা পর্ব ১
রিক্তা ইসলাম মায়া
‘এই যে শুনছেন? কে আপনি? কী হয়েছে আপনার? এমন করছেন কেন? এই যে!
অর্ধ জ্ঞান হারানোর অবস্থায় রক্তাক্ত ছেলেটির সম্মুখে বসে পড়ল মায়া। নির্জন রাস্তায় মানুষের চিহ্নমাত্র নেই। অথচ এমন নির্জন রাস্তায় কপাল ফাটিয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে যুবকটি। উদ্বিগ্নতায় মায়া অচেনা লোকটির সাহায্য করতে চাইল। তাই হাঁটু গেড়ে লোকটির সম্মুখে বসে আলতো হাতে লোকটির গাল নাড়িয়ে সজ্ঞানে আনার চেষ্টা করে পুনরায় একই ভঙ্গিতে ডাকল মায়া…
“এই যে শুনছেন? এই যে!
ডাকতে ডাকতে মায়া নিজের বাসন্তী রঙের শাড়ির আঁচলটা দিয়ে তৎক্ষণাৎ অচেতন লোকটার কপাল চেপে ধরল রক্ত পড়া বন্ধ করতে। অস্থির মায়া আবারও ডেকে বলল…
“এই যে, আমাকে শুনতে পারছেন? কে আপনি? এখানে এভাবে পড়ে আছেন কেন? আপনি কি একা? আপনার সাথে আর কেউ নেই? এই যে শুনছেন?
মায়ার অনবরত ডাকে অর্ধ-বেহুঁশ লোকটি নিভে যাওয়া দুর্বল চোখে তাকাতে চাইল। চোখ পড়ল মাথায় লাল হিজাবধারী ঝাপসা একটি মেয়েলি মুখ। দুর্বলতার রেশ এতটাই যে ঠিকঠাক চোখ মেলে তাকাতে পারল না লোকটা। তবে ঝাপসা চোখে মায়ার উদ্বিগ্নতা দেখে অস্পষ্ট স্বরে ঠোঁট নাড়িয়ে কী যেন আওড়াতে চাইলে মায়া সেটা বুঝতে পেরে তৎক্ষণাৎ মাথা ঝুঁকে কান পাতল লোকটির সম্মুখে। অচেনা লোকটি নিভে যাওয়া দুর্বল গলায় বলতে চাইল…
“আ-আমার…মিষ্টি প্রয়োজন! আ-আমাকে মিষ্টি জাতীয় কিছু দেন মিস!
লোকটির অস্পষ্ট স্বরে কথাগুলো মায়া বুঝতে পেরে মাথা তুলে তাকাল লোকটির দিকে। বেশ অদ্ভুত লাগল লোকটিকে মায়ার কাছে। মাথা ফাটিয়ে রাস্তায় পড়ে আছে, নিজের জীবন-মরণ সমস্যা নিয়ে সেদিকে লোকটার খেয়াল নেই। অথচ সেসব চিন্তা না করে মায়ার কাছে এই অসময়ে মিষ্টি চাইছে? মিষ্টি দিয়ে কী করবে এই লোক? মায়া তখনো বুঝল না হঠাৎ লোকটির মিষ্টি চাওয়ার কারণটা। তাই শাড়ির আঁচলে লোকটির কপাল চেপে রেখে আগের মতো বলল মায়া…
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“মিষ্টি? মিষ্টি দিয়ে কী করবেন আপনি? আপনার কপালের যা অবস্থা, আপনাকে দ্রুত ডাক্তারের কাছে না নিলে আপনি আরও অসুস্থ হয়ে যেতে পারেন ভাইয়া। আপনাকে সাহায্য করতে…
মায়াকে বলতে না দিয়ে লোকটি ফের হাঁপিয়ে উঠে দুর্বল গলায় বলল…
“আমার ডায়াবেটিস কমে গেছে মিস। সুগার প্রয়োজন। মিষ্টি ব্যবস্থা করুন কুইক।
মায়া চমকে উঠল লোকটির কথায়। ডায়াবেটিসের সমস্যা মায়ার বাবারও হয় মাঝে মধ্যে। তখন হাতের কাছে মিষ্টি প্রয়োজন হয়। মায়া দ্রুত নিজের কাঁধের ছোট পার্সটা ঘেঁটে একটা কিটক্যাট চকলেট হাতে নিল। চকলেটের উপরের কাগজটা ছাড়িয়ে দ্রুত এক টুকরো চকলেট লোকটার মুখে তুলে দিল। আজ মায়ার ষোলোতম জন্মদিন ছিল। বড় ভাই আরিফের সঙ্গে জন্মদিন উপলক্ষে ঢাকায় এসেছিল ঘুরতে। বেশ ফুরফুরে সারাটা দিন কাটাল আনন্দ করে। সাথে অবশ্য চাচাতো বোন জুইও ছিল।
এই যে অচেনা লোকটাকে মায়া নিজের চকলেট খাওয়াচ্ছে, সেটাও জন্মদিনের উপহার পাওয়া চকলেট ছিল মায়ার। আরিফ দিয়েছিল মায়াকে আজ। এতক্ষণ যাবত মায়া আরিফের সঙ্গেই ছিল। দিন গিয়ে সন্ধ্যা হওয়ার পর সবাই পুনরায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উদ্দেশে ফিরে যাচ্ছিল। কিন্তু পথিমধ্যে হঠাৎ আরিফের বাইক চলতে চলতে থেমে যায়। তারপর! তারপর আরিফ গাড়ি চেক করতে গিয়ে বুঝল গাড়ির তেল ফুরিয়ে গেছে, সাথে গাড়ির টায়ার পাংচার। এজন্য মূলত আরিফ বিপাকে পড়ে আর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উদ্দেশে যেতে চাইল না। বরং ঢাকার পার্শ্ববর্তী এলাকায় থেকে গেল। আশেপাশে খুঁজে একটা হোটেলের দুটো রুমও বুকিং করল। একটা নিজের জন্য, অন্যটা জুই আর মায়ার জন্য। হোটেল থেকে খাওয়া দাওয়া করে বেশ রাতে বোনদের নিয়ে পার্শ্ববর্তী মার্কেটে বের হয়েছিল আরিফ, অল্পস্বল্প কেনাকাটা করতে। কিন্তু মায়া কীভাবে কীভাবে যেন তাদের হাত ছুটে যায় এবং এই অচেনা লোকটির খপ্পরে পড়ে যায় সাহায্য করতে। তারপর থেকে মায়া আর বলতে পারছে না সে কোথায় আছে। আর এই অচেনা লোকটিই বা কে? মায়া লোকটিকে পরপর বেশ অর্ধেকটা চকলেট খাওয়ানোর পর লোকটা খানিকটা স্বস্তির পায়। বড় বড় নিশ্বাস ফেলে মায়ার কোল ঘেঁষে শরীর ছেড়ে দেয় দুর্বলতায়। মায়া চমকাল, ভড়কাল, হতবিহ্বল হয়ে গেল লোকটির হঠাৎ কাণ্ডে। জড়তায় সিঁটিয়ে শিরশির করে উঠল শরীর-মন। কম্পনের দেখা মিলল ওর ছোট শরীরে। মায়া কাঁপা কাঁপা হাতে ফের লোকটির মাথায় শাড়ির আঁচলটা ভালো করে চেপে ধরে বলল…
“এই যে শুনছেন ভাইয়া! আপনার ফোনটা দিন। আপনার আর আমার বাড়িতে ফোন করে জানিয়ে দিই যে আমরা বিপদে পড়েছি রাস্তায়। আমাদের যেন তারা জলদি জলদি এসে এখান থেকে নিয়ে যায়। বাহিরের আবহাওয়া ভালো না! দেখুন, কী রকম ঝড়-ঝাপটার বাতাস বইছে আশেপাশে, হয়তো যেকোনো সময় তুফান আসতে পারে। তাই দ্রুত আপনার ফোনটা আমায় দিন প্লিজ। বাসায় কল করব।
লোকটির কান অবধি পৌঁছাল না মায়ার কথাগুলো। দুর্বলতায় চোখ বন্ধ করে পড়ে আছে মায়ার কোলে। মায়া নিজের অবস্থানের কথা চিন্তা করে ঠোঁট ভেঙে কান্নায় ভেঙে পড়ল। আচ্ছা মতো ফেঁসে গেছে সে। না নিজের একটা ফোন আছে, আর না লোকটা কিছু বলছে। এদিকে রাতটা অনেক বেশি হয়ে গেল। তার উপর আবার আকাশের অবস্থাটাও বেশ খারাপ। যেকোনো সময় আকাশ ফেটে বৃষ্টি নামল বলে। প্রবল বাতাসে ফুটপাতের ধুলো পর্যন্ত গোল গোল ঘুরছে। এমন অবস্থায় মায়া চোখে মুখে অন্ধকার দেখছে অচেনা লোকটিকে নিয়ে এই মাঝ রাস্তায়। মায়া প্রবল কান্না পেল অসহায়ত্বে। সে নিজেও এই শহরের রাস্তাঘাট চেনে না। বর্তমানে যে জায়গায় মায়া বসে আছে, সে জায়গাটার নামটাও জানা নেই ওর। মায়া কীভাবে কী করবে বুঝতে পারছে না আপাতত। শূন্য মস্তিষ্কে অসহায়ত্ব প্রকাশ করে ঠোঁট ভেঙে এবার কেঁদেই ফেলল। তারপরও অচেনা লোকটিকে একা ছেড়ে গেল না। মায়া চলে যেতে চাইলেও সেই রাস্তা বন্ধ। কারণ এখানের কোনো কিছুই মায়ার পরিচিত নয়। দেখা গেল এই লোকটাকে রাস্তায় ফেলে সে চলে গেল, কিন্তু কিছু দূর যেতেই আরও বড় কোনো বিপদের সম্মুখীন হয়ে গেল, তখন মায়া কী করবে? ভয়ার্ত মায়া মুখ তুলে আশপাশ পর্যবেক্ষণ করল। আপাতত আশেপাশে কোনো মানুষের চিহ্ন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। যে কারও কাছ থেকে সাহায্য চাইবে ওহ। অসহায় মায়া লোকটির কাঁধ চেপে কোনো মতে ধরে বসাতে চাইলে দুর্বলতায় লোকটি ফের নেতিয়ে পড়ল মায়ার কাঁধের উপর কপাল ঠেকিয়ে। অদ্ভুত শিহরণে মায়ার কিশোর মন কেঁপে উঠল। কাঁপা কাঁপা হাতে মায়া লোকটির দু-বাহু ধরে বলল…
“এই যে ভা..ভাইয়া আ..আমাকে শুনতে পাচ্ছেন? আপনার ফোনটা কোথায় বলুন না প্লিজ।
তৎক্ষণাৎ শোনা গেল লোকটার মৃদু স্বরের ধ্বনি…
“দ্রুত কোনো সেইফ জায়গায় চলুন মিস। নয়তো বিপদ আমাদের সন্নিকটে। এই এরিয়াটা ভালো নয়।
ভয়ে মায়া হাঁসফাঁস করল। মনে কিছু সাহস জুগিয়ে অচেনা লোকটিকে ধরে উঠাতে চাইল। কিন্তু বলিষ্ঠবান লোকটির ওজনের সঙ্গে পারল না মায়া। ধিমে হাঁপিয়ে উঠল লোকটিকে দাঁড় করাতে গিয়ে। সেই সাথে উঠতে গিয়ে বেখেয়ালি নিজের পায়ের নিচে শাড়ির কুঁচিগুলো পড়ে খুলে গেল তরতর করে। আঁতকে উঠার মতোন তৎক্ষণাৎ মায়া বাম হাতে খুলে যাওয়া শাড়ির কুচিগুলো ধরে এলোমেলোভাবে পুনরায় কোমরে গুঁজল। লোকটাকে ধরে দাঁড় করাতে গিয়েও মায়া আরেক ঝামেলায় পড়ল যখন দেখল মায়ার হাইটে লোকটির কাঁধ সমান হলো তখন। তারপর আবার লোকটির ওজনও মায়ার সাধ্যের বাইরে ছিল। এত বড় মানুষকে কীভাবে মায়া কাঁধে ভর দিয়ে সামনে এগোবে? যদি সে লোকটিকে পুরোপুরি নাগাল-ই না পেল? অসহায় মায়া এবার বেশ ছুটে কান্না পেল।
মায়া আর একটু লম্বা হলে কী এমন হতো? অন্তত লম্বা জোরে নাহয় এই লোকটিকে এই মুহূর্তে ঠিকঠাক সাহায্য করতে পারত। মায়া ভাবনার মাঝে পুনরায় আঁতকে উঠল যখন বুঝতে পারল অচেনা লোকটি মায়ার কাঁধ চেপে নিজের ভর ফেলছে মায়ার উপর। লোকটি বেশ লম্বা হওয়ায় মায়ার দিকে অনেকটাই ঝুঁকে পড়তে হয়েছে তাকে। মায়া তরতর করে কেঁপে উঠে বাঁধা দিতে চাইলে বুঝতে পারল লোকটির অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। লোকটি নিজের দুর্বলতায় ঠিকঠাক দাঁড়াতে পারছে না বলে সে মায়ার উপর নিজের ওজন ছেড়ে দিচ্ছে ধীরে ধীরে। তাছাড়া মায়া যদি দ্রুত এই ঝড়-ঝাপটার মাঝে লোকটিকে নিয়ে সেইফলি কোনো জায়গায় না পৌঁছায়, তাহলে আরও বিপদে পড়বে তারা দু-জন। অচেনা লোকটি যেকোনো সময় জ্ঞান হারাতে পারে বলে মনে করছে মায়া। অসহায় মায়া নিজের কাঁধের উপর লোকটির হাত চেপে ধরে সামনে এগোল। লোকটার হাইট আর ওয়েট সামলাতে গিয়ে মায়া বারবার খেই হারিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়তে গিয়েও নিজের ব্যালেন্স সামলিয়ে সামনে এগোল। বেশ অনেকটা পথ এলোমেলো হাঁটার পর দেখা মিলল এক অর্ধবয়স্ক লোকের সাথে।
দ্রুত পদে হাঁটছিলেন তিনি। কিন্তু ভাগ্যক্রমে দেখা মিলল মায়াদের সাথে। মায়া বেশ আকুতি মিনতি করে সাহায্য চাইল নিজের আর অচেনা লোকটির জন্য। বয়স্ক লোকটি প্রথমে অচেনা যুবক-যুবতীকে সাহায্য করতে মন বাঁধলেও মুখে কিছু বলল না মানবতার খাতিরে। বরং নিশ্চুপে এগিয়ে আসল মায়াদের সাহায্য করতে। মায়ার কাঁধ থেকে অচেতন লোকটিকে নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে এগোল নিজের বাড়ির পর্যন্ত। মায়া তাদের পিছন পিছন গেল। কিন্তু বিপত্তি বাজল অর্ধবয়স্ক লোকটির বয়স্ক বৃদ্ধ বাবাকে নিয়ে। তিনি মায়া আর র’ক্তা’ক্ত লোকটির অবস্থা দেখে বেঁকে বসলেন। সাহায্য করতে দ্বিমত জানালেন। উনার ধারণা মায়া আর অচেনা লোকটি প্রেমযুগল। এবং তারা পরিবারের চাপে পালিয়ে এসে হোটেল রুমে আশ্রয় নিয়ে আকাম করতে গিয়ে দুজন পুলিশের কাছে ধরা খেয়েছে এই ঝড়-ঝাপটার রাতে। উনার ধারণা মতে মায়া আর ছেলেটি পুলিশের হাতে মার খেয়ে পালিয়ে এসেছেন উনার বাড়িতে আশ্রয় নিতে। বয়স্ক লোকটির এমন চিন্তা-ভাবনা অনুযায়ী মায়াকে এক চোট কথা শুনিয়ে ফেলেছেন এসব বিশ্লেষণ করে। অবশ্য বৃদ্ধা লোকটির এমন সব বিশ্লেষণ করার পিছনে যথেষ্ট কারণও আছে।
আর সেটা হলো মায়ার পরিহিত এলোমেলো শাড়ি আর অচেতন যুবকটির ইন করা শার্ট-প্যান্টের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসার জন্য মূলত উনার অপবিত্র ধারণা আসল মনে মায়াদের নিয়ে। বৃদ্ধা লোকটার কথায় মায়া কান্না করতে করতে নিজের দিকে তাকায়। অচেনা লোকটিকে নিয়ে টানাটানি করাতে মায়ার গায়ের শাড়িটা অগোছালো হয়ে গেছে, সঙ্গে অবশ্য রক্তের লাল লাল দাগের ছিটায় সমস্ত শাড়ির তলিয়ে আছে। দূর্ভাগ্যবশত মায়ার মাথার হিজাবটাও ঠিক নেই। শাড়ির আঁচলটাতে পূর্ব থেকেই লোকটির রক্তে ভেজা ছিল। তাই উনার ধারণা হতেই পারে মায়া অসৎ কাজে বেরিয়েছিল এই অচেনা লোকটির সাথে। মায়া ঠোঁট চেপে কান্না আটকাতে চাইল। এই কেমন পরিস্থিতির শিকার হলো সে।
এখন মায়া কিছু বললেও যে কেউ কিছু বিশ্বাস করবে না, সেটা লোকটার তীক্ষ্ণ কথা শুনেই বুঝতে পারছে মায়া। মায়া নিশ্চুপ কান্না করল, তারপরও মুখে কিছু বলল না। সাহায্যকারী অর্ধবয়স্ক লোকটির বাবা মসজিদের ইমামতির সাথে সাথে তিনি এলাকার গণ্যমান্য কাজী হিসেবে বেশ পরিচিত। তিনি শুধু অত্র এলাকার ছেলে-মেয়েদের বিয়েই নয়, বরং আশেপাশের পাঁচ এলাকার মানুষের বিয়েও দিয়ে থাকেন তিনি। এমন সম্মানিত ব্যক্তির ঘরে কখনোই পাপধারক মানুষের জায়গা হবে না বলে তিনি মনে করেন। কিন্তু এই ঝড়-ঝাপটার রাতে এদের সাহায্য না করে বের করে দেওয়াটাও ঠিক হবে না। এতে আল্লাহ নারাজ হতে পারেন। অসহায় মানুষের সাহায্য করা উনার ধর্মের শিক্ষা। উনি অচেনা ছেলে-মেয়েদের সাহায্য করবেন, তবে হালালভাবে। বৈধভাবে। বৃদ্ধা কাজী লোকটা নিজের মোটা ফ্রেমের চশমার ভিতর দিয়ে চোখ উঁচিয়ে আবারও এক পলক তাকাল মায়া আর র’ক্তা’ক্ত যুবকটির দিকে। অন্ধকারের ঘোরে কারও চেহারা স্পষ্ট হলো না উনার কাছে। তবে অচেনা যুবকটিকে বেশ চেনা চেনা লাগল উনার কাছে। তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে যুবকটিকে আরও এক পলক দেখে নিয়ে নিজের ছেলেকে অনুমতি দিলেন সবাইকে নিয়ে ভিতরে যেতে।
“ওদের ভিতরে নিয়ে যাও হাফেজ।”
“জ্বি আব্বা!”
বাবার অনুমতি পেয়ে অচেতন যুবকটিকে নিয়ে ভিতরে গেল হাফেজ সাহেব। পিছন পিছন মায়াও গেল। যুবকটিকে ধরে বিছানায় শুইয়ে দিতেই পিত্তে চমকে উঠল হাফেজ সাহেব। আতঙ্কিত চোখে বিছানায় শয্যাশায়ী যুবকটির দিকে তাকিয়ে তৎক্ষণাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল মায়ার দিকে। মায়াকে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে দেখে দ্রুত বের হয়ে গেল রুম থেকে নিশ্চুপে। মায়া হাঁসফাঁস করল হাফেজ সাহেবের অদ্ভুত দৃষ্টিতে। তিনি চলে যেতেই মায়া স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। ধীরে পায়ে এগিয়ে গেল যুবকটির কাছে। হালকা ঝুঁকে পড়ল যুবকটির অবস্থান চেক করতে। ছেলেটির নড়াচড়া না দেখে মায়া আস্তে করে বসল লোকটির পাশে। কিছুই ভালো লাগছে না ওর। অচেনা জায়গায় অচেনা মানুষের সাথে বসে থেকে মায়ার বিপদের ভয় হচ্ছে মনে।
আবার না জানি কিসের মধ্যে পড়ে যায় ওহ। ভীতু মায়া কলিজা পর্যন্ত কাঁপছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। মায়া ম্লান হয়ে ঠায় বসে রইল অচেতন লোকটির পাশে। কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই ওর। তাছাড়া এই বাড়ির হুজুর টাইপের লোকটার কথাও মায়ার ভালো লাগেনি। মায়াকে তখন কিসব ভুলভাল বলল। মায়া মোটেও বাজে মেয়ে নয়, এখনো অবধি প্রেম করেনি। কলেজে উঠে একটা প্রেম করবে ভেবে নিয়েছে ওহ, তবে পরিবারের বিরুদ্ধে যাবে না কখনো। নোংরামি তো ভুলেও না। মায়া দু-হাতে মাথা চেপে বিছানার পাশে ঝুঁকে বসল। আপাতত টেনশনে মাথা ফেটে যাচ্ছে নিজের ভাইয়ের সাথে কীভাবে যোগাযোগ করবে সেটা নিয়ে। মায়ার ভয়-ডর, টেনশন, আতঙ্ক সবকিছু বাড়িয়ে দিয়ে হাজির হলো কাজী মোল্লা ও তার ছেলে হাফেজ সাহেব। তাদের পিছন পিছন হালকা পাতলা গঠনের আরও একটা ছেলেও প্রবেশ করল বাসার গেঞ্জি গায়ে দিয়ে। চোখে মুখে ঘুম ঘুম ভাব ছেলেটির। হয়তো ছেলেটিকে ঘুম থেকে ধরে এনেছে হাফেজ সাহেব। দেখে তো তাই মনে হলো মায়ার। কাজী মোল্লা সাহেব হাতে মোটা করে রেজিস্ট্রি খাতাটা বুকে চেপে মায়ার সম্মুখে দাঁড়ালেন। এক পলক ঘৃণাভরা দৃষ্টিতে মায়া ও বেহুঁশরত ছেলেটিকে দেখে নিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে তাকালেন হাফেজ সাহেবের দিকে। বাবার বিরস দৃষ্টির মানে বুঝতেই হাফেজ সাহেব নিজের ছেলেকে তাড়া দিয়ে বললেন…
“সুমন যা, তোর দাদার জন্য দ্রুত একটা চেয়ার নিয়ে আয়।
বাবার কথা অনুযায়ী তাই করল সুমন। চোখের পলকে পাশের ঘর থেকে চেয়ার এনে দিল দাদা কাজী মোল্লা সাহেবকে বসতে। কাজী সাহেব কোনো রকম ভনিতা ছাড়াই চেয়ার টেনে খাতা খুলে বসলেন মায়ার সম্মুখে। শব্দ করে গলা খাঁকিয়ে মায়ার উদ্দেশ্যে হুমকি স্বরূপ বললেন…
“মানুষের সাহায্য করা আমার ধর্ম। তাই বলে আমার কাছে পাপের জায়গা নেই। আমি যেনাকারীদের ঘৃণা করি। তোমরা অপবিত্র হয়ে আসছ আমার দুয়ারে। আমার ঘর পবিত্র ঘর, তোমরা অপবিত্র করছ। তাই আমি আল্লাহর নামে তোমাদের পবিত্র করতে চাই কালিমা পড়িয়ে। আমার কাছে মিথ্যার সুযোগ নেই। তোমাদের অবস্থা বলে দিচ্ছে তোমরা নোংরামি করে পালিয়ে আসছ এখানে। আর এই মেয়ে তুমি! যে ছেলের সঙ্গ ধরে নিজের পরিবারকে ছেড়ে আসলে, সেই ছেলে তোমার কতটুকু আপন হবে, সেটা তুমি কয়েক দিনের মাঝেই বুঝে যাবে আশা করছি। এই ছেলে যে কারও আপন না, সেটা পুরা দেশ জানে। ক্ষমতার অহংকার যার রন্ধ্রে রন্ধ্রে, সে তোমাকে কতটুকু ভালো রাখবে আল্লাহ জানে। যাই হোক, আল্লাহ তোমার সহায় হোক। আমি এখন বিয়ে পড়াচ্ছি। সুন্দরভাবে বিয়েটা শেষ করো। নয়তো আজ তোমার ক্ষমতাধর প্রেমিকও প্রাণ নিয়ে বাসায় ফিরবে না। তার অবস্থা এমনিতেও ভালো নেই। এজন্য বলছি, আমার সাথে তর্কে গিয়ে নিজেদের ঝামেলা বাড়িও না। আমার কিন্তু বেশ সময় লাগবে না এই এলাকার মানুষকে জড়ো করে তোমাদের বিচার করতে। আমার তোমাদের নিয়ে মাথা ব্যথা নেই। আমার সমস্যা হলো পাপ করা নিয়ে। আমি আবার সহজে পাপ কাজ মানতে পারি না। তাই বলছি, আমি যা বলব, তাই চুপচাপ মেনে বিয়েটা করে নিবে, বুঝেছ মেয়ে?
চশমার ফাঁকে চোখ উঁচিয়ে তাকাল মায়ার দিকে কাজী সাহেব। মনোভাব অন্তত শক্ত উনার। বিরক্তির সাথে সাথে রুষ্টও তিনি। যদি মায়া উনার কথা না শুনে, তাহলে যেকোনো সময় শক্ত কিছু ঘটিয়ে ফেলতেও দ্বিধা করবেন না তিনি। তারপরও পাপটা মেনে নিবেন না সহজে। মায়া হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল বৃদ্ধ কাজীর দিকে। কোথায় থেকে কোথায় চলে গেল এই লোক? মায়া কখন কিসের পাপ করল? উপকার করা কি পাপ নাকি? কারও উপকার করা তো নেকির কাজ, তাহলে মায়া পাপি হলো কীভাবে? ভীতু মায়া আরও সিঁটিয়ে গেল ভয়ে। এতক্ষণের দমে রাখা কান্নাটা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল ততক্ষণে। মায়ার হঠাৎ কান্নায় ধমকে উঠলেন কাজী সাহেব। মায়া ভয়ে আরও সিঁটিয়ে গেল মুখের ভিতর শাড়ির আঁচল চেপে বসে। মায়ার তখনো জানা নেই কীভাবে জটিল পরিস্থিতি সামাল দিতে হয়। পরিস্থিতির ফ্যাসাদে পড়লে কীভাবে বাঁচতে হয়। অতিরিক্ত ভয় পেলে মায়ার শুধু বুক ফেটে কান্না আসে। এখনো তাই আসছে। মায়া ভয়ে জড়সড় হয়ে বসল। কাজী সাহেব কামিলা পড়তে পড়তে মায়াকে শক্ত গলায় কবুল বলতে বললেন। মায়া ধমক খেয়ে ভয়ে কান্না করতে করতে কবুল বলে দিল।
কিন্তু যখন কাজী সাহেব অর্ধ-বেহুঁশ ছেলেটিকে কবুল বলতে বললেন, তখন ছেলেটি ওই অবস্থায় ঘোরের মাঝে তিন ‘কবুল’ বলে ফেলল। মায়াদের বিয়ে সম্পূর্ণ হলো। কিন্তু মায়া একটা জিনিস লক্ষ করল, কাজী সাহেব মায়ার স্বামী নামক লোকটির থেকে কোনো রকম নাম ঠিকানা জিজ্ঞাসা করলেন শুধু মায়াকে ছাড়া। যেন তিনি পূর্ব থেকেই ছেলেটির বাপ-দাদার নাম জানেন এবং সেই অনুযায়ী তিনি নিজেই সবকিছু লিখে নিয়েছেন কাবিননামায়। মায়া পরিবারের কথা জিজ্ঞাসা করলে। মায়া শুধু নিজের বাবার নাম আর জায়গার নাম ব্রাহ্মণবাড়িয়া এতটুকুই বলল, ব্যস। মায়াকে কাবিননামায় সিগনেচার করতে বললেন। মায়া কলম হাতে সিগনেচার করতে গিয়ে এক পলক চোখ আওড়িয়ে কাবিননামায় নিজের সদ্য হওয়া স্বামীর সিগনেচারটাতে চোখ বুলাল একটু করে। বরের জায়গায় স্বামীর নামটা মায়া ভালোভাবে দেখেও বুঝল না আসলে সেখানে লোকটা কী নাম লিখেছে। কেমন ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে দ্রুত একটা নাম লিখে নিল লোকটা। অথচ নামটা মায়া বুঝতেই পারছে না কী লেখা আছে তাতে। মায়া নামটা ভালো করে পরখ করে বুঝল এটা ইনিশিয়াল সাইন করা। তাই মায়া শত চেষ্টা করলেও সিগনেচারটা মায়ার ছোট মাথায় ঢুকবে না। অসহায় মায়া সিগনেচারের উপর এক নজর বুলিয়ে চোখ ভর্তি জল নিয়ে তাকাল অর্ধ-বেহুঁশ স্বামীর দিকে। সেদিকে এক পলক তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে সেও কাবিননামায় সিগনেচারটা করে বিয়েটা সম্পূর্ণ করতেই কাজী সাহেব উঠে দাঁড়ালেন খাতার পত্র গুছিয়ে। এক পলক মায়াকে দেখে নিজের ছেলে ও নাতিকে নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে যেতে যেতে নিজের বউকে ডাক ছেড়ে বলে গেলেন…
‘ মেহমানদের কিছু খাওয়ার জন্য।
রাতের প্রায় শেষ প্রহর। হাতের মুঠোয় বাটন ফোনটি চেপে বিষণ্ণ ভগ্ন হৃদয় নিয়ে অন্ধকার ছন্ন খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে টিন শিটের জানালা দিয়ে মায়া। ওর ছোট মনের আকাশে আজ ভীষণ মেঘ জমেছে। সেই মেঘের বাঁধ ভাঙ্গা বৃষ্টি হয়ে বারবার গাল গড়িয়ে পড়ছে ক্ষণে ক্ষণে। মায়া বারবার হাতের উল্টো পিঠে গাল মুছতে ব্যস্ত। সেই সাথে মুঠোয় ফোন চেপে নিজের ভাইকে কল করছে অনবরত। এই ফোনটি বাড়ির ওয়ালার ছেলের বউয়ের। খাবার দিতে আসায় তখন মায়া ফোন চেয়েছিল মহিলাটির কাছ থেকে। তিনিও মায়ার মনের অবস্থা বুঝে নিজের ফোনটি দিয়ে সাহায্য করেছিলেন মায়াকে। কিন্তু মায়ার ভাগ্য সহায় হলো না। সেই মধ্য রাত থেকেই একনাগাড়ে কল করে যাচ্ছে আরিফকে কিন্তু আরিফের ফোন বন্ধ। বারবার নট রিসেভেবল দেখাচ্ছে। মায়ার কান্নার বেগ বাড়ে। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বিছানায় শয্যাশায়ী স্বামীর দিকে তাকায়। নাম-দাম পরিচয় কিচ্ছু জানে না মায়া অথচ এই লোক নাকি মায়ার স্বামী? ভাগ্যের কি পরিহাস! তাছাড়া এখন মায়া পালিয়ে গেলে ইহজীবনে এই লোকের সাথে মায়ার আর দেখা হবে কিনা তাও সন্দেহ।
দেখা না হওয়াটা শতভাগ নিশ্চিত। এই লোকটা হয়তো নিজেও জানে না মায়া এই লোকের বউ। জানবে বা কীভাবে? লোকটা সজ্ঞান থাকলে তো জানবে নাকি? সে তো অজ্ঞানরত বেহুঁশ অবস্থায় মায়াকে বিয়েটা করল। মায়ার মতো করে সেও, মায়ার নাম-ঠিকানা জানে না। এমনকি মায়াকে হয়তো চোখের দেখাও দেখেনি লোকটা। হুশ ফিরার পর এই লোককে মায়া কী বলবে? বলার মতো কি আদৌ কিছু আছে মায়ার কাছে? বিয়ের বিষয়টা জানতে পেরে যদি লোকটা উঠে মায়ার সাথে খারাপ আচরণ করে তখন কী করবে মায়া? ভয়ার্ত মায়া আরও ভয়ার্ত হলো। চুপিসারে এখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার পায়তারা করল। যাওয়ার আগে কী মনে করে স্বামী নামক অচেনা লোকটার সম্মুখে দাঁড়াল। ইতিমধ্যে লোকটার মাথায় মোটা করে ব্যান্ডেজ পরেছে। ডাক্তার দিয়ে করানো হয়েছে, বাড়ির ওয়ালার ছেলে করিয়েছে। অসুস্থতার জন্য এখন বেঘোরে ঘুমাচ্ছে লোকটা।
মায়া লোকটাকে গভীর চোখে দেখে নিয়ে চুপিসারে চলে যেতে গিয়েও পা থেমে গেল। হাতের বাটন ফোনটা চেপে সময়টা দেখে নিল। ৩:৪০ প্রায় ভোর। মায়া হাঁসফাঁস করল লোকটাকে এই অসুস্থ অবস্থায় একা রেখে যেতে। একটা মাত্র স্বামী মায়ার। এই অসুস্থতার মাঝে যদি মায়া চলে যায় তখন মায়ার পাপ হবে না? না থাক! মায়া নাহয় আর একটু কষ্ট করে কেটেকুটে স্বামীর পাশে থেকে গেল পাহারা দেওয়ার জন্য। তবে স্বামী চোখ খোলার আগে মায়া পালিয়ে গেলে তখন লোকটাও মায়াকে অপ্রকাশিত বিয়েটার জন্য আর দায়ী করতে পারবে না। মায়া বেঁচে যাবে সারাজীবনের জন্য। এমনই লোকটা মায়াকে ভালোভাবে দেখেনি এরপর আবার মায়ার সম্পর্কে সে কিছুই জানেও না। এখন যদি মায়া পালিয়ে যায় তাহলে জীবনে মায়াকে খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনাও নেই। স্বস্তির মনে মায়া ততক্ষণ বসে রইল যতক্ষণ পর্যন্ত না আরিফ মায়ার কলটা রিসিভ করছে। মায়ার কল তার ভাই রিসিভ করে ভোর ৪:৫৬ দিকে। তখন প্রায় ভোর ধরণীর বুকে। উৎফুল্ল মায়া নিজের ভাইকে ওর অবস্থানের কথা জানিয়ে সবকিছু ছেড়ে-ছুড়ে তৎক্ষণাৎই পালাল খোলা জানালা দিয়ে। তবে যাওয়ার আগে নিজের হাতের বাটন ফোনটা রেখে গেল স্বামীর সাহায্যের জন্য। মায়ার অচেতন স্বামীর ঘুম ভাঙে প্রায় সাতটার দিকে। মাথা চেপে উঠে বসতেই রুমে ঢোকে কাজী সাহেব। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রুমের আশেপাশে তাকিয়ে মায়ার খোঁজ করে বলল…
“মেয়েটি কোথায়?
গম্ভীর কণ্ঠ কানে আসতে ভারি মাথা চেপে চোখ তুলে কাজী সাহেবের দিকে তাকাল ছেলেটি। মাথা ব্যথায় এমনই মাথা হ্যাং হয়ে আছে। তার উপর আবার অপরিচিত জায়গায়, অপরিচিত মানুষের মুখে, অপরিচিত কোনো মেয়ের খোঁজ তার কাছে করছে ভেবে বিরক্তিতে খানিকটা কপাল কুঁচকে আসে ছেলেটির। সে উত্তর করল না। বরং মাথা চেপে বলল…
“আমাকে এখানে কে নিয়ে এসেছে?
“আমার ছেলে।
কাজী সাহেবের কথার পিঠে তেমন কিছু বলল না যুবকটি। শুধু একটু করে বলল…
“একটা ফোন পাওয়া যাবে?
কাজী সাহেব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ছেলেটির হাবভাব বোঝার চেষ্টা করে বলল…
“তোমার সামনেই রাখা আছে দেখো।
ছেলেটির চোখ আওড়িয়ে নিজের সামনে থেকে মায়ার রেখে যাওয়া বাটন ফোনটি হাতে তুলে নিতে চাইলে কাজী সাহেব আবারও মায়ার খোঁজ করে বলল….
“তোমার সাথের মেয়েটি কোথায়?
ফোনটি হাতে নিতে নিতে কপাল কুঁচকে তাকায় কাজী সাহেবের দিকে ছেলেটি। মূলত সে তখনো বুঝতে পারছে না তাকে বারবার কার কথা জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে।
“কিসের মেয়ে?
অকপটে সোজাসাপ্টা উত্তর করল কাজী সাহেব..
“তোমাকে নিয়ে রাতে যে মেয়েটি এসেছিল এখানে। আমি তার কথা জিজ্ঞাসা করছি। সে কোথায়? তাকে দেখছি না কেন?
ছেলেটি কপাল কুঁচকে কিছুক্ষণ ম্লান থেকে মনে করার চেষ্টা করল আসলে কাজী সাহেব কার কথা বলতে চাচ্ছে তাকে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে স্মরণে আসল একটা ঝাপসা লাল হিজাবধারী মেয়েলি মুখ। রাস্তায় দেখা হয়েছিল মেয়েটার সাথে তার। দুর্বলতায় ঠিকঠাক মেয়েটার ফেসটাও দেখা হয়নি তার। এরপর থেকে সে নিজের হুশে ছিল না বলতে গেলে। অথচ এখন সকাল হতে না হতেই সেই মেয়ের খোঁজ তার কাছে করছে, অদ্ভুত তো। যে মেয়েকে দেখেনি জীবনে সেই মেয়ের খোঁজ কীভাবে দেবে সে? বিষয়টি সে তেমন একটা আমলে না নিয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বাটন ফোনে নাম্বার টাইপিং করতে করতে অকপটে উত্তরে বলল ছেলেটি…
“আমি জানি না সে কোথায়।
কাজী সাহেব খানিকটা অসন্তুষ্ট গলায় বলল…
“তুমি জানো না মানে?
যুবকটি বাটন ফোনে টাইপ করে কাউকে মেসেজ পাঠিয়ে দুর্বল শরীরে উঠে দাঁড়াল। আপাতত নিজের গন্তব্যের জন্য বের হবে সে। এখানে আর এক মুহূর্তও নয়। কিন্তু কাজী সাহেবের বরাবর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এড়িয়ে পকেটে দু-হাত গুঁজেতে গুঁজেতে বলল ছেলেটি…
“আপাতত বলতে পারছি না আপনার অনুসন্ধানকৃত মেয়েটি কোথায়। আর না তার খোঁজ আমি নিতে ইচ্ছুক। আমি চলে যাচ্ছি। আমাকে সাহায্য করার জন্য ধন্যবাদ।
যুবকের কথায় খানিকটা তেতে উঠলেন কাজী সাহেব। তিনি চেনেন এই পাষাণ ছেলেকে। খান পরিবারের নিহাল চৌধুরীর বড়ো ছেলে আব্রাহাম রিদ খান। রাগী আর উগ্র চলাফেরার জন্য বেশ বদনাম এই ছেলে। ক্ষমতা জোরে মাটিতে পা পড়ে না এই ছেলের। তবে মেয়েলি বাজে বিষয়ে কখনোই খান পরিবারের কাউকে জড়াতে শোনেননি তিনি। এমনকি এই রিদ খানকে কখনো কোনো মেয়েকে নিয়ে জড়িয়ে বাজে কিছুর বদনাম শোনা যায়নি। তিনি মনে করেন খান বাড়ির মানুষজন আর যেমনই হোক না কেন তাদের বাড়ির বউরা অন্তত মর্যাদা নিয়ে চলাফেরা করেন সমাজে। হয়তো এই ছেলের ক্ষেত্রেও তাই হবে। বউকে সম্মান দেবে। কিন্তু এই ছেলে সকাল হতে না হতেই রাতে বিয়ে করা বউকে অস্বীকার করছে। কাজী সাহেব অন্তত রুষ্ট গলায় রিদের উদ্দেশ্যে বললেন…
“মেয়েটি তোমার বউ। স্বামী হয়ে তার খোঁজ রাখা তোমার দায়িত্ব। তাছাড়া মেয়েটা বেশ ছোট দুনিয়ার সম্পর্কে তার ধারণা নাই থাকতে পারে। এজন্য বলছি, স্বামী হয়ে তার খেয়াল রাখা তোমার উচিত।
কপাল কুঁচকে কাজী সাহেবের দিকে তাকিয়ে থাকল রিদ। একটা অচেনা মেয়ে তার বউ হয় কীভাবে? রিদ ভাবল হয়তো রাতে রিদের সাথে মেয়েটিকে দেখে কাজী সাহেব ভুল ভাবছেন, যে মেয়েটি তার বউ হতে পারে। রিদ কাজী সাহেবের ভুল ধারণা ভাঙ্গার চেষ্টা করল না। এত বেশি কথা সে কারও সাথে বলার প্রয়োজন মনে করে না। তার এখানে কোনো কাজ নেই বিদায় সে এখান থেকে চলে যাওয়ায় উচিত মনে করে, কাজী সাহেবকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চাইলে তৎক্ষণাৎ কাজী সাহেব রিদকে আটকিয়ে পকেট থেকে একটা কাবিননামার কাগজ বের করে রিদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে তিনিও নিশ্চুপে রুম ত্যাগ করলেন।
রিদ কপাল কুঁচকে হাতের কাগজটির দিকে তাকাতেই এক আকাশ সমান বিস্মিত পরে গেল যখন দেখল বরের জায়গায় তার নিজস্ব সিগনেচার করা। রিদ খানিকটা চমকানো সাথে সাথে বিরক্তবোধ করল এমন হুটহাট অপ্রকাশিত বিয়ের জন্য। হাতের কাবিননামাটায় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চোখ বুলিয়ে বউয়ের নামটা দেখে নিল এক পলক। সেখানে আনাড়ি হাতে এলোমেলোভাবে লেখা ‘রিক্তা ইসলাম মায়া’। রিদ বুঝতে পারল তার অচেনা বউয়ের নাম রিক্তা ইসলাম মায়া। নামটা সে তৎক্ষণাৎ মনে মনে বেশ কয়েকবার আওড়িয়ে স্মরণে গেঁথে নিল। তবে বউয়ের আনাড়ি হাতের লেখাটা দেখে রিদের কপালের ভাঁজ আরও গাঢ় হলো। ভাবল তাকে রাতে কোনো নাবালিকা প্রাইমারি বাচ্চার সাথে বিয়ে দিয়ে দেয়নি তো? গড নো’স!
সদ্য বিয়ের হওয়া বউয়ের সম্পর্কে কৌতূহল জাগতে গিয়েও আকর্ষণ হারিয়ে ফেলল রিদ। আবেগি হয়ে গা ভাসাবার মানুষ সে নয়। তাই বউ সম্পর্কে জানার আর আগ্রহ রইল না। হাতের কাবিননামাটা বেখেয়ালিভাবে সেখানেই ফেলে দিল রিদ। সাথে নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করল না। আর না মায়ার খোঁজ করতে চাইল। উদাসীন রিদ কর্মক্ষেত্রে গিয়ে নিজের বিয়েটাকে ভুলে গেল। বিয়ের মতোন পবিত্র সম্পর্কটা ভুলে দুজন সামনে এগোতে চাইল। হলোও তাই। দুজনের কারও মাঝে তাদের বিয়েটা নিয়ে মাতামাতির দেখা গেল না। এমনকি সেদিনের পর আজ পর্যন্ত কেউই এই অপ্রকাশিত বিয়েটা নিয়ে কারও সাথে মুখ পর্যন্ত খোলেনি। রিদ এই বিয়েটা নিয়ে কারও কাছে বলা প্রয়োজন মনে করেনি আর মায়া পরিবারের ভয়ে কাউকে কিছু বলেছে। ভাগ্যের ফেরে এক হওয়া মানুষের দুটি হৃদয় পুনরায় সম্মুখে দাঁড়াবে কিনা তাও জানা নেই।
