রিদ মায়ার প্রেমগাঁথা পর্ব ৪৯
রিক্তা ইসলাম মায়া
দীর্ঘ সময়ে কান্নার দারুণ দু’চোখ ফুলে উঠেছে মুক্তার। রক্তিম চেহারায় ফোন কানে চেপে বসে বিছানায়। ফাহাদ পাশেই বসা নিরুপায় হয়ে। বউকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা তার এই মূহুর্তে নেই। মুক্তার অঝোরে কাঁন্না একটা সময়ে ফুপানোতে পৌঁছালো। তারপরও বারবার কল মিলাল আরিফকে। রাগ, অপমান, কষ্ট, সংমিশ্রণে যখন তুঙ্গে তখনই ওপাশ থেকে কল রিসিভ করল আরিফ। হ্যালো’ বলার আগেই মুক্তার অঝোরে কান্নার শব্দে উত্তেজিত হলো আরিফ। অস্থির নেয় জানতে চাইল কিছু হয়েছে। আপনজনের গলা শুনতে পেয়ে মুক্তা আরও ফুপাতে লাগল। অস্থির আরিফ বারবার জানতে চাইল…
‘ কি হয়েছে তোর? এইভাবে কাঁদছিস কেন? আমাকে বল! ফাহাদ কিছু বলেছে তোকে?
মুক্তার অঝোরে কাঁন্নার দারুণ কথা আঁটকে আসল ফুঁপানোতে। ফুপাতে ফুপাতে বলল মুক্তা..
‘ ভাই! ভাই!
সারাদিন পর মাত্র বাসায় ফিরেছিল আরিফ। গরমে ঘামন্ত শরীরে বসার ঘরের ফ্যান চালিয়ে সবে সোফায় বসেছিল সে। হাতে তখনো নিজের পাসপোর্টের সাথে আরও বেশ কিছু ডকুমেন্টস চাপা, এরমাঝেই মুক্তার ফোন পেয়ে অস্থির উত্তেজিত হলো আরিফ বোনের কান্নায়। হাতের কাগজ গুলো সেইভাবেই এলোমেলো সোফার টেবিলে রেখে তৎক্ষনাৎ উঠে দাঁড়াল অস্থির ভঙ্গিতে, মুক্তার ভাই, ভাই বলে কান্নার ফুঁপানোতে। বাসার চাবি পুনরায় মুঠোয় নিতে নিতে উত্তেজিত ভঙ্গিতে মুক্তাকে শুধিয়ে আরিফ বলল….
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
‘ কি হয়েছে তোর? এইভাবে কাঁদছিস কেন? ঐ বাড়ির মানুষ তোকে কিছু বলেছে মুক্তা? তোর শশুর শাশুড়ী বা অন্য কেউ? ফাহাদ তোর গায়ে হাত তুলেছে?
‘ না ভাই!
‘তাহলে এইভাবে কাঁদছিস কেন? কি হয়েছে আমাকে?
আরিফের ভরসা পেয়ে মুক্তা ফুপাতে ফুপাতে বলল..
‘ ভাই! ভাই! মায়া বিয়ে করে ফেলেছে আমার ভাসুরের সাথে।
কথাটা বলেই মুক্তা আবারও ফুপাতে লাগল অঝোর কান্নায়। অথচ মুক্তা মুখে মায়ার বিয়ের সংবাদ শুনে আরিফের মাঝে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। বরং এতক্ষণ মুক্তাকে নিয়ে যে অস্থিরতা আর ভয় আরিফের মাঝে ছিল সেটা যেন এক মূহুর্তে গায়েব হয়ে গেল। আরিফ মুক্তার কথা শুনে পুনরায় জায়গায় বসে পড়ল। দীর্ঘ শ্বাস গোপন করে শান্ত হলো! ছোট করে উত্তর দিয়ে বলল…
‘ ওহ!
আরিফের শান্ত কন্ঠ আর উদাসীন উত্তরের উত্তেজনা বাড়ল মুক্তার মাঝে। এতবড় একটা সংবাদ শুনার পর মুক্তার মতোই আরিফের মাঝেও একই অস্থির, উত্তেজনা দেখা যাওয়ার কথা অথচ সেই জায়গায় আরিফ নিরুত্তর, শান্ত। মুক্তা অস্থির ভঙ্গিতে বলল…
‘ তুমি ওহ বলছো ভাই? মায়া এতবড় একটা কাজ করলো আর তুমি শান্ত? তুমি জানো আমার শশুর বাড়িতে এই মূহুর্তে কি ঝড় বয়ে গেছে? কতকিছু শুনতে হয়েছে আমাকে? আমার খালা শাশুড়ী বলে আমার বাবা নাকি মেয়ে দিয়ে ব্যবসা করে, এজন্য প্রথমে আমি, তারপর মায়াকে লেলিয়ে দিয়েছেন আমার ভাসুরের পিছনে বড়লোক ছেলেকে পটাতে। আমরা ছোটলোক, ছোটজাতের মানুষ, টাকা পয়সা দেখি নাই সেজন্য বড়লোক ছেলেদেরকে পটিয়ে বেড়ায়। তুমি মনে হয় শুনেছো আমার খালা শাশুড়ী মেয়ে শশী আপুর সাথে রিদ ভাইয়ের ছোট থেকে বিয়ে ঠিক ছিল। আজ পারিবারিক ভাবে উনাদের বিয়ের ডেট ফিক্সড হওয়ার কথাটা উঠলে রিদ ভাই মায়ার সঙ্গে উনার বিয়ের কথাটা সবাইকে জানায়। এরপর থেকেই বাড়িতে ঝামেলা হচ্ছে। আমার ভাসুর শশী আপুর গায়ে হাত তুলেছেন। এজন্য আমার শশুর বাড়ির সবাই আমার উপর রেগে। তারা কেউ চাইছে না আমি মায়াকে নিয়ে এই বাড়িতে আর থাকি। এই প্রথম আমার শাশুড়ী আমাকে মায়ার জন্য কতো কথা শুনিয়ে গেল। উনাদের ভালো ছেলেটাকে মায়া কিভাবে পটিয়ে বিয়ে করে ফেলল সেটা নিয়ে আমাকে কথা শুনিয়ে গেল। ভাই! ভাই!মায়া কেন এই কাজটা করলো। মায়ার জন্য এখন আমার সংসারটাও ভাঙ্গতে বসেছে।
মুক্তার দীর্ঘ কথায় আরিফ নিশ্চুপে শুনলো। আরিফ আগে থেকেই জানতো এমন কিছু হবে। মায়ার জন্য মুক্তার সংসার এফেক্ট হবে সেটাও জানে। কিন্তু যেটা হয়ে গেছে সেটার বলে কিছু করার নেই। বরং এই উত্তাপ পরিস্থিতি সামাল দিতে যা করণীয় তাই করতে হবে। আরিফ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে আবারও শান্ত কন্ঠে মুক্তাকে বুঝাতে চেয়ে বলল…
‘ ফাহাদকে বল তোকে আর জুইকে আমার কাছে দিয়ে যেতে। তুই কিছুদিন আমার ফ্লাটে থাক দেখবি সবকিছু এমনই ঠিক হয়ে গেছে।
আরিফের কথায় মুক্তা আতঙ্কিত গলায় বলল…
‘ আর মায়া? মায়াকে আনব না ভাই? ওহ কই থাকবে?
আরিফ আগের নেয় শান্ত কন্ঠে বলল…
‘ মায়া ঐখানেই থাক। তুই চলে আয় জুইকে নিয়ে।
মায়ার চিন্তায় মুক্তা ফের বলল…
‘ না ভাই আমি মায়াকে এখানে রেখে একা আসতে পারবো না। তুমি জানো না ভাই, আমার শশুর বাড়ির সবাই আমার আর মায়ার উপরই ভিষণ রেগে আছে। আর এই পরিস্থিতিতে যদি আমি ওকে সবার মাঝে একা ফেলে চলে যায় তাহলে সবাই মায়াকে কি করবে তু….
আরিফ মুক্তার কথা শেষ করার আগেই বলল…
‘ কেউ কিচ্ছু করতে পারবে না। মায়া ওর জায়গায় আছে। তোকে যা বলছি তুই তাই কর। তুই জুইকে নিয়ে আমার কাছে চলে আয়। বাকিটা আমি দেখে নিব।
মুক্তা জেদ্দি গলায় বলল…
‘ কিন্তু ভাই মায়া? ওকে কিভাবে আমার শশুর বাড়িতে রেখে আসব?
‘ তোকে এতোসব চিন্তা করতে হবে না, ঐটা তোর না মায়ার শশুর বাড়ির। মায়াকে প্রটেক্ট করার জন্য ওর হাসবেন্ড আছে। বরং তোর জায়গাটা ঐ বাড়িতে শূন্য। তোর দিকে ঐ বাড়ির সবাই সহজে আঙ্গুল তুলতে পারবে কিন্তু রিদ খানের বউকে কিছু বলার সাহস কেউ করতে পারবে না। সেজন্য বলছি, এই পরিস্থিতিতে তুই ফ্যাসে যাবি যদি এরপরও খান বাড়িতে থাকিস। তুই আমার কাছে চলে আয় দেখবি সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। রিদ খান নিজের বউয়ের হেফাজত করতে জানে।
আরিফের কথায় মুক্তা কান্না থেমে গেল। থ মেরে বসে রইল হতবাক হয়ে। ভেবে দেখল আরিফের কথা গুলো আসলেই সত্য! এই উত্তাপ পরিস্থিতিতেও কেউ মায়াকে কিছু বলতে যাচ্ছে না। আর না কেউ মায়াকে দোষী করছে। সবাই মুক্তাকেই দোষী করছে সবকিছুর জন্য! মায়ার হয়ে মুক্তাকেই অপমান করছে বারবার। হয়তো রিদের ভয়ে মায়াকে কেউ কিছু বলতে যাচ্ছে না। তাছাড়া মায়ার পক্ষে তো স্বয়ং নিহাল খানও দাঁড়িয়ে। মায়াকে খান বাড়ির ইজ্জত বলেও দাবি করেছেন তিনি। এতোকিছুর পর অবশ্যই কারও সাহস হবে না এই মূহুর্তে মায়াকে কিছু বলতে যাবার? কিন্তু মুক্তার পিছনে কে আছে? ওর শশুর -শাশুড়ী আর না ওর স্বামী? ফাহাদ তো ভদ্র ছেলের খেতাব নিয়ে বসে অবশ্যই বউয়ের জন্য কথা বলার সাহস তার হবে না। সকল ঝড় ঝাপটা তো এখন মুক্তার উপর দিয়েই যাবে।
কিন্তু তাই বলে মুক্তা নিজের বোনকে এভাবে সকলের মাঝে একা ছেড়ে দিতে পারে না অন্যের ভরসায়। সবার সামনে সাহস না থাকলে যে সবার অগোচরে মায়ার ক্ষতি করতে চাইবে না এটাও বা কি গ্যারান্টি আছে? শশীর মা যে পরিমাণ মায়ার উপর রেগে আছেন শশীকে রিদের থাপ্পড় মারা নিয়ে এর শোধ অবশ্যই তিনি মায়ার উপর তুলবেন? মায়ার উপর রাগ আছে সেটা ভিন্ন কথা কিন্তু তাই বলে মায়াকে বিপদে মুখে ফেলে একা চলে যাওয়ার কোনো বড় বোনের কাজ নয়। মুক্তা যাবে না মায়াকে একা ফেলে। যত যা কিছু হবার হোক। তারপরও মুক্তা মায়াকে ফেলে যাবে না বলে মনস্থির করলো। আর এতে করে মুক্তা নিজেকে বিপদের মুখে ফেলল। মূলত মুক্তা আরিফের কথার যথাযথ অর্থই বুঝেনি। মায়া যে একা সকলের মাঝে রয়েছে সেই চিন্তা রিদ খানের মাথায়ও আছে। সে নিশ্চয়ই নিজের বউয়ের হেফাজত করবে যেকোনো মূল্যে? অথচ মুক্তা আরিফের কথাটা বুঝলো উল্টো। মায়ার টেনশনে সেও খান বাড়িতে থেকে গেল। বরং আরিফের সঙ্গে রাগারাগি করে বসল নিজের মনের সন্দিহা পোষণ করে। আরিফকে শক্ত গলায় প্রশ্ন করে বলল…
‘ তুমি কি মায়ার বিয়েটা আগে থেকে জানতে ভাই?
মুক্তার কথায় আরিফ কিছুটা সময় নিশ্চুপ থেকে উত্তর দিল…
‘ জানতাম।
বসা থেকে চেঁচাল মুক্তা….
‘ কিহ? তুমি এতবড়ো একটা কথা জানার পরও আমাদের কাউকে জানাও নি ভাই? এজন্য মায়ার সাথে নাহিদের বিয়েটা তুমি ভেঙ্গে দিতে চাইছিলে?
‘ হুম!
‘ কবে থেকে জানো তুমি এসব?
‘ তিনমাস হবে।
‘ এর মানে তুমি মায়াকে সাহায্য করেছো আমার ভাসুরের সাথে বি…
মুক্তার কথা শেষ করার আগেই আরিফ ধমকে উঠে বলল…
‘ বাজে কথা বলবি না মুক্তা। আমি এসবের কিছুই জানতাম না। আমি বিয়ের ব্যাপারটা শুনেছি সেটার তিনমাস হয়েছে। আমি কাউকে সাহস করেনি।
মুক্তা নিজের রাগ প্রকাশ করে বলল…
‘ সাহায্য না করলে তুমি তিনমাস ধরে এতবড়ো একটা কথা আমাদের থেকে লুকিয়ে রেখেছো কেন? অন্তত আমাদের ঘরে জানাতে পারতে এই বিষয়টা। তাহলে আব্বা, চাচা তারা হয়তো চেয়ারম্যান পরিবারের কথা দিয়ে রাখতো না। তুমি জানো আব্বা কতোটা ওয়াদাদার মানুষ। কথা খেলাফ তিনি পছন্দ করেন না। আমি এক্ষুনি ফোন করে সবাইকে বলে দিব সবটা। আমি মায়ার এই বিয়ে মানি না।
মুক্তার কথায় অস্থির উত্তেজনা দেখাল আরিফের মাঝে। আরিফ অধৈর্য্য নেয় মুক্তাকে বলল…
‘ খবরদার মুক্তা! কাউকে কিছু এখন বলতে যাবি না তুই। আপাতত তোর শশুর বাড়ির পরিস্থিতি ঠান্ডা হোক তারপর আমি বাড়িতে কথা বলবো। দুইদিন পর আমি বাড়িতে যাব তখন আব্বা আর চাচার সাথে এই নিয়ে কথা বলবো। নিহাল আঙ্কেলের কল এসেছিল আমার কাছে একটু আগে। তিনি আমাদের বাড়িতে যেতে চাচ্ছেন আব্বার সাথে কথা বলতে। আমি উনার কাছে এক সাপ্তাহ সময় চেয়েছি বাড়িতে সবাইকে বুঝানোর জন্য। তাই আমার বাড়িতে যাওয়ার আগে তুই কাউকে ফোন দিয়ে কিছু বলিস না প্লিজ। আব্বা হার্টের রোগী, চাচা মাথা গরম মানুষ, দেখা যাবে বাড়িতে তান্ডব বয়ে গেছে। তুই আমার কথাটা রাখ মুক্তা, আপাতত কাউকে ফোন দিস না। আমাকে দুইটা দিন সময় দে। আমি ঠান্ডা মাথায় সবাইকে বুঝানোর চেষ্টা করবো। ভরসা রাখ!
আরিফের কথায় মুক্তা রেগেমেগে কল কাটতে কাটতে বলল…
‘ আমি পারব না। আমি এক্ষুনি ফোন করে সবাইকে বলে দিব।
কথাটা বলেই মুক্তা কল কেটে দিয়ে হাতের ফোনটা ছুড়ে মারলো দূরে। রাগে জেদ্দে দু’হাতে মুখ ডেকে আবারও কাঁদতে বসল। তখন রাগে আরিফকে হুমকি দিয়ে বললেও মুক্তা বাড়িতে কল দিল না। কারণ সে জানে এই মূহুর্তে কল দিলে হিতের বিপরীতে চলে যাবে পরিস্থিতিতে। মুক্তা যেমন মায়ার এই বিয়ে মানে না তেমনই ওদের পরিবারের কেউও মানবে না। এই সম্পূর্ণ সময়টাতে ফাহাদ ছিল নিরব দর্শক। একদিকে বউ ও তার শশুর বাড়ির মানুষ, অন্যদিকে নিজের পরিবার। ফাহাদ গুড বয় হওয়াতে রিদের মতোন নিজের বউয়ের পক্ষ টেনে কথা বলতে পারছে না আর না অন্যায়কে অন্যা বলতে পারছে। শুধু চুপচাপ দেখা ছাড়া।
সেজন্য হয়তো আরিফ বারবার মুক্তাকে বুঝাতে চাইছিল ফাহাদ, রিদ খান নয় যে পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে নিজের বউয়ের সম্মান বাঁচাবে। অন্যায় না থাকা শর্তেও সবাই খুব সহজে ফাহাদের বউয়ের দিকে আঙ্গুল তুলতে পারবে কিন্তু অপরাধী হয়েও কেউ রিদ খানে বউয়ের দিকে আঙ্গুল তুলতে পাববে না। সেজন্য রিদ খানের বউ রিদের কাছেই হেফাজত আর ফাহাদ বউ চলে যাক ভাই কাছে। অতি সূক্ষ্মভাবে বিষয়টা ভেবে ফাহাদ মন্ত হয়ে বসে রইল মুক্তার পাশে। আসলেই ফাহাদ ছোট থেকে ভদ্র। বাবা-মার নেওটা আর ভালো ছেলে সেজন্য কখনো ন্যায় থাকার পরও বউয়ের পক্ষ নিয়ে কথা বলতে পারে না। যেমন আজও পারেনি। আসলে মানুষ ঠিক বলে, পরিবারের বেয়াদব, অভদ্র ছেলেদের বউরা সবসময় সম্মানে থাকে, ভালো থাকে, তাদের দিকে কেউ সহজে আঙ্গুল তুলতে পারে স্বামীর ভয়ে। কিন্তু দিনশেষে অসুখী তো ভদ্র, ভালো খেতাব পাওয়া পুরুষদের বউরাই থাকে।
সকাল গড়িয়ে দুপুর হলো। মায়াকে নিয়ে ঘর বন্দী হয়ে বসে জুই। অতিরিক্ত কান্নার ফলে দু’চোখ মুখ ফুলে একাকার। জুই মায়ার পাশেই অপরাধী নেয়। সান্ত্বনা দেওয়ার মতোন ভাষা এই মূহুর্তে জুইয়ের কাছেও নেই। এমন পরিস্থিতিতে পড়বে সেটা আগে থেকেই জানতো কিন্তু তারপরও ভয়ে আছে জুই। সকালের ঘটনার পর মুক্তাকে কোথাও দেখা যায়নি। এমনকি খান বাড়ির কাউকে দেখা যায়নি ওদের কক্ষে আশেপাশে। তবে জুইয়ের হাতের ফোনটাই কিছুক্ষণ পরপর, রাদিফ,আসিফের কল আসছে বারবার। মায়ার খোঁজ নিচ্ছে তাঁরা। এর মাঝে দুবার আয়নেরও কল এসেছে জুইয়ের ফোনে। মায়ার পাশাপাশি জুইয়ের খবরও নিচ্ছে সে। এতে জুই ভিষণ খুশি। যাক অবশেষে আয়নের সঙ্গে অল্প ফোনালাপ হয়েছে এটাই অনেক। জুই আয়নের বিষয়ে ভিষণ অনুতপ্ত। অন্তত আয়ন যদি এবার জুইকে ক্ষমা করে এতেই অনেক। মায়া কান্না করতে করতে একটা সময় জুইয়ের কোলে মায়া এলিয়ে ঘুমিয়ে। জুই তখন হাতের ফোনটা পাশে রেখে অনেকটা সময় নিয়ে মায়ার মাথায় হাত বুলাচ্ছিল। হঠাৎ ফোনের ভাইব্রেট শব্দে পাশে তাকাতে দেখল ফোনের স্ক্রিনে আয়নের নামটা ভাসছে। আনন্দিত মনে তাড়াহুড়োয় আয়নের কলটি রিসিভ করে কানে দিতেই সালাম দিল জুই…
‘ আসসালামু আলাইকুম।
আয়ন রয়েসয়ে সালামের উত্তর দিয়ে সরাসরি মায়ার কথা জানতে চেয়ে বলল…
‘ মায়া কই?
জুই উত্তর দিয়ে বলল…
‘ পাশেই! কাঁদতে কাঁদতে মাত্র ঘুমোচ্ছে।
আয়ন স্বাভাবিক নেয় পুনরায় জানতে চাইল…
‘ আপনাদের কেউ কিছু বলেছে জুই?
‘ না।
‘ মায়া খেয়েছে কিছু?
‘ না।
‘ আপনি?
‘ না।
‘ কেউ খাবার দিয়ে যায়নি আপনাদের?
‘ না।
আয়ন চুপ করে গেল ইতস্ততায়। কেউ যে ওদের দুপুরের খাবার দিয়ে যাবে না এমনটা ভাবেনি আয়ন। সবাই না হোক অন্তত হেনা খান এমন নয় যে বাড়ির অতিথিদের না খাইয়ে রাখবে। অথচ আয়নের ধারণাতেই ছিল না খান বাড়িতে রান্নায় হয়নি তখনো। আর না কেউ খেয়েছে। সবাই শশীকে নিয়েই ব্যস্ত। অস্থির, উত্তেজনায়, দূর্বল মানসিকতা জন্য জ্ঞান হারিয়ে বেডে শুয়ে শশী। যার জন্য হেনা খান কক্ষ হতে বের হয়ে মায়াদের খোঁজ নিতে পারেন নি তিনি। এরমাঝে খান বাড়ির পারিবারিক ডক্টর এসে শশীর চেক-আপও করে গেছেন একবার। শশীকে রেস্ট নিতে বলে তিনিও বেড়িয়ে গেছেন এই বলে যেন শশীকে মানসিক চাপ থেকে দূরে রাখেন সবাই। শশীকে ঘুমে দেখে আশ্বস্ত হয়ে সবাই এসে বসল বাড়ির ড্রয়িংরুমে। তোড়জোড় চালিয়ে হেনা খান ছুটলো বাড়ি সদস্যের জন্য দুপুরের খাবারের আয়োজন করতে। সময় তখন বারোটা পার হয়ে একটার ঘরে। অসময়ে ফোন আসলো আয়নের জুইয়ের ফোনে। আয়ন জুই দুজনেই জানে না নিচে কি হচ্ছে। আয়ন খানিকটা সময় চুপ থেকে জুইকে ডাকল ঠান্ডা স্বরে…
‘ জুই!
আয়নের শান্ত কন্ঠ জুইকে অশান্ত করলো। বুকের ভিতর এক মূহুর্তে জন্য তোলপাড় হলো আয়নের ভেজা লহাময় স্বর। জুই টিপটিপ বুকে ছোট করে উত্তর দিল মিহি স্বরে….
‘ হুম!!
‘ আমি কিছু চাইলে আপনি সেটা আমাকে দিবেন?
আয়ন কিছু চাইবে আর জুই তা দিবে না সেটা কক্ষনো হবা নয়। জুইয়ের সাধ্যের ভিতর থাকলে অবশ্যই দিবে সে। আয়নের কথার যথাযথ অর্থ না বুঝেই জুই তৎক্ষনাৎ সম্মতি দিয়ে বসল…
‘ অবশ্যই দিব! কি চাই আপনার বলুন?
জুইয়ের তাড়াহুড়ো বাচ্চামিতে আয়ন স্নিগ্ধতায় হাসলো। আয়নের চাইতে দেরি অথচ জুইয়ের রাজি হতে দেরি হলো না। কিন্তু আয়ন জানে যখন আয়ন সত্যি সত্যি জুইয়ের থেকে কিছু চাইবে তখন এই জুই-ই সবার আগে আয়নকে ফিরিয়ে দিবে। আয়নের হাসির শব্দ জুইয়ের কানে বাজালো। মূহুর্তে ভালো লাগে চেয়ে গেল মনে ভিতর। আজ কতোদিন পর সেই আয়নের মনমাতানো স্নিগ্ধ হাসির শব্দটা পেল জুই। এই হাসি যেন জুইয়ের চির চেনা অতি পরিচিতি। বেখেয়ালি জুইয়ের ধ্যান ভাঙতে আয়ন আবার বলল…
‘ এখন রাজি হচ্ছেন পরে আবার পল্টি নিবেন নাতো জুই? আমার কিন্তু আপনার থেকে দরকারি কিছু চাই।
জুই স্বতঃস্ফুতার সঙ্গে বলল…
‘ অবশ্যই দিব! পল্টি নেওয়া আমার স্বভাবে নেই।
আয়ন জুইকে খোঁচা মেরে বলল…
‘ আপনার স্বভাব সম্পর্কে আমি অবগত জুই। আপনি পল্টি না শুধু অস্বীকার করেন, সত্যকে মিথ্যা বানান ব্যাস এতটুকুই।
আয়নের কথায় জুই চুপ করে গেল মন খারাপে। জুই বুঝতে পারছে আয়ন পূর্ব কথার রেশ ধরেই এখন জুইকে খোঁচা মারছে। অপরাধী জুই তাও সয়ে নিলো। সে অপরাধী! আয়নের সাথে সম্পর্কটা সে অস্বীকার করেছিল এজন্য এখন এই এতটুকু খোঁচা তো জুই সহ্য করতেই পারে তাই না? আয়ন জুইয়ের মন খারাপের চুপ্তিতা বুঝে সিরিয়াস গলায় বলল…
‘ আমার সাথে কাল দেখা করবেন জুই?
জুই মন খারাপের আয়নের কথা শুধিয়ে বলল…
‘ আচ্ছা! কিন্তু কাল কেন? আপনি চাইলে এখনই দেখা করতে পারেন। আমিতো আপনার নানু বাড়িতে আছি।
‘ তা আছেন হয়তো। কিন্তু আমি খান বাড়িতে ফিরতে ফিরতে আপনি হয়তো থাকবেন না জুই। একটুপর আসিফ আসবে আপনাকে নিয়ে যেতে। তাই কাল আমি মুরাদপুরে আসব আপনার সাথে দেখা করতে।
আয়নের কথায় জুই খানিকটা অধৈর্য্যের নেয় শুধিয়ে বলল…
‘ আমি একা যাব? মায়া যাবে না আমার সাথে? ওহ কোথায় থাকবে? এখানে?
‘ রিদের বউ, রিদ জানে সে কোথায় রাখবে? আপনার এতো চিন্তা না করলেও চলবে। আপনার তো জামাই নেই, সেজন্য আমি আপনার হয়ে তদারকি করছি। আপনার যখন একটা ব্যক্তিগত মানুষ চলে আসবে তখন আমিও নাহয় দূরে চলে গেলাম।
আয়নের কথায় জুই বেশ কষ্ট পেল। মুখ ফোটে বলতে পারলো না আপনি তো আমার ব্যক্তিগত মানুষ ডাক্তার সাহেব। আমার ভুল হয়েছে এবারের মতোন আমাকে ক্ষমা করে দিন। জুইয়ের নিশ্চুপতায় আয়ন ফের বলল…
‘ কাল আসলে দেখা করবেন তো জুই?
‘হুম।
‘ তাহলে আশা করা যায় আপনি আমাকে ফিরাবেন না?
জুই মন খারাপে বলল…
‘ কি চাই এক্ষুনি বলে দেন। সাধ্যে থাকলে অবশ্যই দিব। সাধ্যে না থাকলে দরকার হলে যোগাড় করে দিব তারপরও আপনাকে ফেরাব না।
‘ আসলেই দিবেন? সত্যি তো?
‘ হুমম।
‘ তাহলে চাইবো?
‘ বলুন কি চান।
‘ সত্যি তো!
‘ বললাম তো দিব।
আয়ন বেশ সিরিয়াস গলায় বলল…
‘ ঠিক আছে। আপনাদের একটা শ্যামা সুন্দরী ফ্রেন্ড আছে না লম্বা করে? কি জানি নাম? নাদিয়া নাকি কি একটা আছে না? ওর নাম্বারটা আমাকে দিবেন প্লিজ? আসলে মেয়েটার প্রেমে পরেছি আমি। তাই আমার আপনার ফ্রেন্ডের নাম্বারটা লাগবে জুই।
আয়নের কথায় জুই স্তব্ধতা মৃদু চেঁচাল বলল…
‘ কিহ? আপনি আর নাদিয়া অসম্ভব!
‘ কেন অসম্ভব জুই? সত্যি আমার আপনার ফ্রেন্ড নাদিয়াকে ভালো লাগে। আমরা দুজনই একই রঙের মানুষ, সেজন্য আমাকে নাদিয়া অস্বীকার করবে না। আপনার মতোন সুন্দরী প্রেমিকা বানাতে গেলে তো দুইদিন পরপর আমাকে অস্বীকার করবে কালো বলে। এজন্য নিজের সেফটি হিসাবে ভাবলাম নিজের গায়ের রঙের সাথে মিল রেখে কাউকে পছন্দ করি। জুই কাল যখন আপনি আসবেন তখন অবশ্যই নাদিয়াকে সঙ্গে করে নিয়ে আসবেন। দুজনের অফিসালি মিটআপও হয়ে যাবে কি বলুন? করবে না আমার জন্য এতটুকু?
রাগে দুঃখে মেজাজ দেখিয়ে জুই ঠাস করে কল কেটে দিল। আয়নের কথায় জুইয়ের ভিষণ কান্না পাচ্ছে। আয়ন জুইয়ের কাছে নাদিয়া নাম্বার চাইবে সেটা স্বপ্নেও ভাবিনি জুই। ওর মন ভাঙ্গা কষ্ট যখন চোখের নোনা জল হয়ে গাল গড়িয়ে পরছিল ঠিক তখনই দূর্বল শরীরে কক্ষে প্রবেশ করলো শশী। ফুলা ফুলা চোখ আর খোলা চুলে দরজা ঠেলে সোজা এসে বসল মায়ার পায়ের কাছে ফ্লোরে। দু’হাতে মায়ার দু’পা চেপে ফ্লোরে বসল বিছানায় কপাল ঠেকিয়ে। শরীর ঝাঁপিয়ে গোঙ্গাল কান্নায়।
রিদ মায়ার প্রেমগাঁথা পর্ব ৪৮ (২)
মায়া তখন জুইয়ের কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে। শশীর হঠাৎ আগমনে জুই নিজের কষ্ট ভুলে ভয়ে আতঙ্কে উঠলো ঘুমন্ত মায়াকে দু’হাতে ঝাপটে জড়িয়ে। মায়ার গাঢ় ঘুমে হঠাৎ ছুটে গেল কারও কান্নার ফুঁপানোতে। ঘুমন্ত মায়া ধরফরিয়ে উঠে বসতে চাইলে টান পরলো পায়ে। আতঙ্কিত ভঙ্গিতে পায়ের কাছটায় তাকাতে দেখল শশী দু’হাতে মায়ার দু’পা চেপে বিছানা কপাল ঠেকিয়ে ফুপাচ্ছে কান্নায়। তাড়াহুড়োয় মায়া শশীর হাত হতে নিজের পা ছাড়াতে চেয়ে বলল…
‘ আপু কি করছেন? উঠে বসুন। আমার পায়ে…