রিদ মায়ার প্রেমগাঁথা পর্ব ৬১ (২)

রিদ মায়ার প্রেমগাঁথা পর্ব ৬১ (২)
রিক্তা ইসলাম মায়া

রাত প্রায় ১ঃ৪৫ ঘরে। অন্ধকার কারাগারে চেয়ারে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় বসা কেউ। মাথার উপর ঝুলছে হলুদ আলোর লাইট। সামনেই চৌদ্দ শিকলের জেল। সন্ধ্যার পথ থেকে লোকটাকে একইভাবে হাত পা বেঁধে বসিয়ে রেখেছে থানার পুলিশ। বসে থাকতে থাকতে একটা সময় ঝিমিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো চেয়ারে বসা লোকটা।

হঠাৎ কোনো কিছুর টংটং শব্দ কানে যেতে চেয়ারে বসা লোকটার ঘুম হাল্কা হয়ে আসলে সে ঘুমন্ত চোখ টেনে সামনে তাকাতে চাইল, কিন্তু ঘুমের তাড়নায় ঝাপসা চোখে দেখলো শিকলের তালা খোলছে বয়স্ক এক পুলিশ। লোকটার হেলিয়ে পড়া ঘাড়টা মূহুর্তে সোজা করতে করতে দেখলো পুলিশ নয় বরং একজন ভদ্র মহিলা মাথা নুইয়ে জেলে প্রবেশ করছে। চেয়ারে বাঁধা লোকটার ঘুম তৎক্ষনাৎ ছুটে গেল। সে চোখ টেনে সামনে তাকাতে দেখলো খুব পরিচিত একটা মুখ। কিন্তু তিনি তৎক্ষনাৎ মনে করতে পারলো না এই মুখটা আসলে সে কোথায় দেখেছিলো? অজ্ঞাত
লোকটার কপাল কুঁচকে আসে ভদ্র মহিলাটি কে তা স্বরণ করতে চেয়ে, ততক্ষণে পরিপাটি শাড়ি আর লম্বাটে মহিলাটি লোকটার মুখোমুখি চেয়ার টেনে বসতে বসতে কৌতুক স্বর করে বলল…

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘ কিরে জসিম? কি অবস্থা তোর? আগের মতোই হারা*মি আছিস নাকি আরও লেভেল বাড়িয়ে নিজের উন্নতি করেছিস কোনটা? আমাকে তোর সামনে হাজির করেছিস মানে অবশ্যই তোর হারা*মিপনা লেভেল বেড়েছে। শুনলাম আমাকে নাকি খুব মিস করছিলি? দেখ তোর টানে চলে আসলাম। নাইস টু মিট ইউ এগেইন দোস্ত।
কথাটা বলেই সুফিয়া খান হাত বাড়ালো চেয়ারে বাঁধা জসিমের দিকে। কিন্তু দুজনের মধ্যে দূরত্ব বেশ। মধ্যস্ততার টেবিলের একপাশে জসিম অন্যপাশে সুফিয়া খান বসায় সুফিয়া খান উঠে দাঁড়াল জসিমের সঙ্গে হাত মিলাতে। অল্প ঝুকে খুব স্বাভাবিক নেয় জসিমের সঙ্গে হাত মিলাল যেন খুব পুরাতন সম্পর্কে অবগত দুজন। জসিম লোকটা তখনো কেমন অবাক চোখে তাকিয়ে সুফিয়া খানের দিকে। লোকটার চোখ মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে তিনি ভারি আশ্চর্য হয়েছেন এই রাতে সুফিয়া খানের দেখা পেয়ে। কতোটা বছর পর দুজনের আবার দেখা হলো। চোখের সামনে যেন ভেসে উঠলো সেই ভার্সিটিকালের পুরাতন স্মৃতি গুলো। দূরদর্শী সুফিয়া আর তার মোহনীয় সৌন্দর্য, মধ্যবয়সে এসেও যেন ভাটা পড়েনি বরং গোছালো পরিপাটি শাড়িতে মোহনীত লাগছে সুফিয়াকে। জসিম অবাক নেত্রে তাকিয়ে সুফিয়া খানের দিকে অথচ তার খানিকক্ষণ বাদই সে চেঁচিয়ে উঠলো সুফিয়া খানের হাত মিলানোর সঙ্গে সঙ্গে। সুফিয়া খান ঝটকায় হাত সরিয়ে নিতে নিতে বলল…

‘ স্যরি দোস্ত ব্যথা পেলি নাকি? আমিতো তোর সঙ্গে হাত মিলাতে চেয়েছিলাম, আফটার অল তুই আমার পুরাতন ফ্রেন্ড বলে কথা। অনেকদিন পর দুজনের দেখা ভাবলাম তোর সাথে আন্তরিকতা দেখায়। কিন্তু মনে হচ্ছে তুই তার যোগ্য না। আচ্ছা দে দেখি তোর হাতটা কোথায় ব্যথা পেলি।
কথাটা বলে সুফিয়া খান টেবিল ঘুরে এগিয়ে আসল জসীমের দিকে। জসীমের একহাতের বাঁধন খোলে হাতটা টেনে দেখলো বাম হাতের তালুতে ছোট একটা সুই ঢুকে। সুফিয়া খান দরদ দেখিয়ে সেই সুইটা টেনে বের করে তিনি গলা উঁচিয়ে ডাকলো শিকলের বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকা তারেক নামক ছেলেটিকে, গম্ভীর মুখে বলল কক্ষে পানি দিয়ে যেতে। সুফিয়া খানের আদেশ অনুযায়ী ছেলেটি তাই করলো। দ্রুত একটি ছোট বোতলের পানি এগিয়ে দিয়ে গেলো সুফিয়া খানের দিকে। পানির বোতলটি হাতে নিয়ে সুফিয়া খান কোমর ঠেকিয়ে বসল টেবিলের উপর জসীমের মুখোমুখিতে। ক্যাপ খোলে হাতের বোতলটা জসীমের মুখ বরাবর ধরতে ধরতে বলে….

‘ পানিটা খা-তো জসীম! তোর ভালো লাগবে।
ব্যথা পেয়েও জসীম লোকটা হতবাক চোখে সুফিয়া খানের দিকে তাকিয়ে কম্পিত স্বরে আওড়াল…
‘ সুফিয়া তুমি?
সুফিয়া খান জসীমের মুখে পানি দিতে দিতে বলল…
‘ চিনতে পেরেছিস তাহলে? নে ধর আগে পানি খা। হাতের ব্যথা কমে যাবে। তোর সাথে গল্প করতে আসলাম জসীম। জমিয়ে আড্ডা দিবো দুজন। তুই আর আমি বুঝলি।
সত্যি সত্যি জসীম লোকটা সুফিয়া খানের দিকে তাকিয়ে হা করলো। ছোট বোতলের সম্পূর্ণ পানিটাই পান করলো সুফিয়া খানের হাতে সে। সুফিয়া খান খালি বোতলটা হাতে নিয়ে পুনরায় জসীমের মুখোমুখি চেয়ারের উপর বসতে বসতে খেয়ালি করে বলল….

‘ দেখলি দোস্ত তোর জন্য আমার কতো ভালোবাসা? নিজ হাতে তোকে পানি পর্যন্ত খাওয়ালাম। আমার এতো ভালোবাসা রেখে তুই শুধু শুধু আমার জামাইটার পিছনে পড়ে থাকিস। শুনলাম তুই নাকি আমার জামাইরে খুব জ্বালাস? এখন আবার আমার ছেলেটাকেও এসবে টানলি। দিস ইজ নট ফেয়ার দোস্ত।
সুফিয়া খানের কথায় জসীম থমথমে মুখে বলল…
‘ বিশ্বাস করো সুফিয়া আমি কারও পিছনে কিছু করিনি। আমি এসবের কোনো কিছু জানি না। আমাকে ফাঁসানো হচ্ছে। তুমি আমাকে বিশ্বাস করো আমি নির্দোষ।
জসিম লোকটার কথায় সুফিয়া খান তাল মিলিয়ে বলল…

‘ বিশ্বাস তো আমারও করার কথা না দোস্ত। তুই তো জানিস, আমার দৃষ্টি হারা*মিদের চিন্তে ভুল করে না। তুই হা*রামি ছিলি, আছিস, থাকবি এটা আমি জানি। কিন্তু আমার জামাইটা বুঝে না বারবার একই ভুল করে তোকে বিশ্বাস করে। আসলে আমার জামাইটা বোকা-সোকা নরম মনের মানুষ তো সেজন্য তুই বারবার অপরাধ করেও ছাড় পেয়ে যাস। আমি বুঝি না ভাই, নরম মনের মানুষ হয়েও সে কিভাবে রাজনীতি করতে আসে? নরম মন নিয়ে কি কখনো রাজনীতি হয় তুই-ই বল? রাজনীতি করতে হলে কলিজা হতে হবে লোহার মতো শক্ত, যেন এক থাবাই শত্রুর কলিজা ছিঁড়ে হাতে নিয়ে খেলতে পারে তাহলেই না সে হলো আদর্শ নেতা। কিন্তু তার সরলতা দেখে আমি তাঁকে আরও পনেরো বছর আগেই না করছিলাম রাজনীতি তোমার জন্য না নিহাল।

তুমি ছেড়ে দাও। সামাল দিতে পারবা না ঝামেলায় পড়বা। আমার ছেলেদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যাবে তোমার জন্য। তুমি ছেড়ে দাও রাজনীতি কিন্তু সে শুনলো না আমার কথা। তার পারিবারিক ঐতিহ্য রাজনৈতিক দলকে তার-ই সামাল দিতে হবে এটা নাকি তার দায়িত্ব। আচ্ছা তুই-ই বল, এইভাবে সামাল দিবে সে? আমার ছেলেদের রক্ত জড়িয়ে? আমি তার জন্য কয়টা ছেলে জন্ম দিছি যে, তার জন্য বারবার রক্ত ঝড়াবে? সারাবছর আমার বড়ো ছেলেটাকে রাজনৈতিক দন্ডের ভিড়ে রাখে। তাও ঠিক ছিল যদি আমার ছেলেটার কথা শুনে সে কাজ করতো তাহলে, কিন্তু না তার অতিরিক্ত মানবতার জন্য শেষ পর্যন্ত আমার ছেলেটার জান নিয়ে পর্যন্ত টান দিলো সে। মা হয়ে আমাকে তো এসবে আসতেই হতো তাই না বল?

সুফিয়া খানের পরপর কথায় জসীমের শরীরে চিকন ঘামের রেশ দেখা দিল। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের ফোঁটা জমা হতে জসীম ভয়ার্ত মুখে অস্থির ভঙ্গিতে বলল…
‘ আমি কিছু করিনি সুফিয়া। আমি সত্যি তোমার ছেলের এক্সিডেন্ট করাইনি। আমিতো সেদিন চট্টগ্রামেই ছিলাম না যেদিন রিদ খানের এক্সিডেন্ট হলো। আমি কিভাবে তোমার ছেলের এক্সিডেন্ট করাবো বলো? আমাকে অন্যভাবে জেলে আনা হয়েছে আমি নির্দোষ।
জসীমের কথায় দারুণ হাসলো সুফিয়া খান। হাতের বোতলটা পাশের টেবিলের উপর শব্দ করে রাখতে রাখতে বলল…

‘ তোর নিজের সাক্ষী তুই কেন দিচ্ছিস জসীম? আমি কি তোকে মে*রেছি? নাকি কারও এক্সিডেন্টের কথা ম্যানশন করেছি? না পিটানো অবধি তুই সাক্ষী দিবি না জসীম। কারণ আমি জানি তুই নিষ্পাপ। সেজন্য তোকে জেলে ধরে আনা হয়েছে। থানার পুলিশরা হলো বেয়াদব তারা আমাকে ফোন করে জানালো তোর মতো এতো নিষ্পাপ নেতা নাকি তাদের পেটে হজম হচ্ছে না। দ্রুত তোর সাথে কথা বলতে যাতে তোর হা*রামিপনার লেভেল আপডেট হয়। নয়তো বদ-হজমে মারা যাবে তাঁরা বুঝলি?

সুফিয়া খান সম্পর্কে জসীমের ধারণা পুরাতন। ভার্সিটি লাইফ থেকে তিনি সুফিয়া খানকে চিনেন। অসম্ভব মেধাবী আর চতুর মানুষ সুফিয়া। শান্ত মস্তিষ্কে মানুষ খু*ন করার মতোন ক্রিমিনাল মাইন্ড এই মহিলার আছে। কিভাবে, কাকে, কোথায় ফাঁসিয়ে দিবে সামনের মানুষটা নিজেও বুঝবে না। জসীম লন্ডনে পড়তে গিয়েই পরিচিত হয়েছিল সুফিয়ার সঙ্গে। অপরুপ সুন্দরী আর অসম্ভব মেধাবী স্টুডেন্ট দেখে সে একটা সময় ভালোবেসেছিল সুফিয়াকে। কিন্তু তখন সুফিয়ার সঙ্গে নিহাল খানের প্রেম ছিল সবে তিনমাসের। নতুন প্রেম হওয়ায় জসীম চেয়েছিল সহজ সরল নিহালকে টপকে সুফিয়াকে জিতে নিবে। নিহালের সঙ্গে জসীমের বন্ধুত্ব না থাকলেও ওরা মিউচুয়াল ফ্রেন্ডে পরিচিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওরা একই ভার্সিটিতে পড়াশোনা করতো বলে রোজ দেখা হতো তাদের। সেজন্য জসীম চেয়ে ছিল নিহালকে ভুল বুঝাতে সুফিয়ার সম্পর্কে। এতে সে সফলও হতো যদি না সুফিয়া কাছে সে ধরা পরতো। সহজ সরল নিহালকে অনেকটায় কনভিন্স করে ফেলেছিলো সুফিয়ার বিরুদ্ধে।

কিন্তু চতুর সুফিয়ার কাছে জসীম অল্পতেই ধরা পরে যায় এবং সেদিনই জসীমকে ভার্সিটির মাঠে পিটিয়ে ক্যাম্পাস ছাড়াও করলো সুফিয়া। লন্ডনের মাটিতে দাঁড়িয়ে সুফিয়ার বিরুদ্ধে অ্যাকশন নেওয়ার মতোন ক্ষমতাও ছিল না জসিমের কারণ তখনকার সময়ে লন্ডনের রয়েল পরিবারের সদস্যের মধ্যে সুফিয়ার পরিবারকেও গনা হতো। সুফিয়ার পরিবারের পূর্ব পুরুষদের ব্রিটিশআমল থেকেই তাদের আধিপত্য ছিল লন্ডন শহরে। তাদের ক্ষমতা দাপটও দেখার মতোন ছিল। সুফিয়া নিজেও অস্ত্র বিদ্যা, শাস্ত্র বিদ্যা এমনকি ট্রেইনার হিসাবে পারদর্শি ছিল। সুফিয়ার হাতের ধনুক বা বন্দুকের গুলি কোনটায় নিশানা মিস হওয়ার মতোন গল্প আজও নেই। সে এক পারদর্শী নারী। জসীম সেসময়ে সুফিয়ার হাতের মার খেয়ে লোক লজ্জায় ভয়ে সে বাংলাদেশে চলে আসে। তারপর একটা রাজনৈতিক দলে যোগদান করে, এক নেতার মেয়েকেও বিয়ে করল। বছর তিনেক পর দেখা গেল নিহালও সুফিয়াকে নিয়ে বাংলাদেশে হাজির হয়। তখন সুফিয়ার কোলে ছয়মাসের ছেলে সন্তান।

দেখতে ঠিক সুফিয়ার মতোই অপরুপ সুন্দর হয়েছিল। খুব সম্ভবত সুফিয়ার বড়ো ছেলে রিদ খান হবে। জসীমের ভুলে যাওয়া শত্রুতা পুনরায় তাজা হয় যখন নিহাল জসীমের বিরোধী রাজনৈতিক দলে যোগদান করে তখন। পাশাপাশি একই এলাকাতে বিপক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে নিহালের যোগদান করাতে পার্সোনাল শত্রুতা থেকে রাজনৈতিক দন্ডে পৌঁছাল জসীমের ক্ষোভ। সুযোগ পেলে নিহালকে হেনস্ত করতে পিছু পা হতো না জসীম। সুফিয়া তখন নিজের ক্যারিয়ারের সবকিছু ছেড়ে-ছুড়ে স্বামীর সংসারে মনোনিবেশ করে কিন্তু বেশ কয়েক বছর পর নিহালের বেগতিক পরপর রাজনৈতিক দন্ড দেখে সুফিয়া আর নিহালের মধ্যে আনবান শুরু হতে লাগলো। তারপর কিভাবে কি হলো আর কেন সুফিয়া নিহালকে ছেড়ে চলে গেল সেটা আজও জানে না জসীম। তবে সুফিয়ার চলে যাওয়ার খবরটা জসিমের কানে এসেছিল সেজন্য জসীম বহুবার চেয়েছিল সুফিয়ার অনুপস্থিতিতে নিহালের সুযোগ নিতে সেজন্য কারণে অকারণে এমন বহুবার বহুরকম মিথ্যা কে*স-মা*ম*লা দিয়ে নিহালকে ফাঁসাতে চেয়েছিল কিন্তু থানা-পুলিশ করে সবগুলো কে*স মা*ম*লা কোট পর্যন্ত যেতে যেতে কেমন গায়েব হয়ে যেতো।

সে সব মা*ম*লামকদ্দমার আর কোনো পাত্তা পাওয়া যেতে না। এমন ঘটনা বহুবার হওয়াতে, মা*ম*লা গুলো হঠাৎ গায়েব হয়ে কি হয়? সে সব তথ্য যোগাড় করতে একটা সময় জসীম গোপনীয় ভাবে লোক লাগাল তদন্ত করতে আসলে মা*ম*লা গুলো কি হয় সেটা জানতে। অনেক তদন্তের পর বুঝতে পারলো সুফিয়া স্বামীর সংসার নাম মাত্র ছাড়লেও সে স্বামীর সঙ্গ ছাড়েনি কখনো। নিহালের ছোট বড়ো রাজনৈতিক, পারিবারিক, ব্যবসায়ীক, সকল মা*ম*লা গুলোই সুফিয়া নিজে দেখাশোনা করে। প্রফেশনাল এডভোকেট হওয়ায় অবশ্যই আইন সুফিয়ার হাতেই থাকবে। তাই জসীম কোনো ভাবে নিহালের সঙ্গে আইনি ভাবে পেরে উঠবে না সেটা বুঝতে পেরে জসিম আইনের আশ্রয় নেওয়া ছেড়ে দেয় এবং সরাসরি আক্রমণ করতে শুরু করলো নিহালে উপর। সুযোগ পেলে অপদস্ত করতে চাইতো নিহালকে। নিহালের লোকদের পিটিয়ে রাস্তায় ফেলে রাখত। নয়তো জোর করে, ভয় দেখিয়ে নিহালের লোকদের নিজের দলে নিয়ে আসতো। বলতে গেলে রাজনৈতিক খেলায় জসীমের হাত চলতো সব জায়গায়।

ভেবেছিলো ইলেকশনটাও সেবার জসীমের হাতেই হবে। কিন্তু সেইবার ইলেকশনের আগে আগে হঠাৎ করে একদিন শুনা গেল নিহালের বড়ো ছেলে রিদ খান নিজের পড়াশোনা শেষ না করেই বিদেশ থেকে চলে এসেছে বাবার রাজনৈতিক দলের সাপোর্টে দাঁড়াতে। জসীম বিষয়টা শুনেও বিশেষ একটা পাত্তা দেয়নি। নিহালের ছেলে নিহালের মতোই সরল মনের মানুষ হবে ভেবে উড়িয়ে দেওয়া বিষয়টা একটা সময় জসীমের মাথা ব্যথা হয়ে দাঁড়াল। বুঝতে পারলো ছেলে নিহালে হলেও স্বভাব সুফিয়ার থেকেও দশ কাঠি উপরে পেয়েছে রিদ খান। ক্রমাগত জসীমের কাজে জসীমকে ফাঁসাতে লাগল রিদ খান। সকল দিক থেকে হঠাৎ করে জসীমের দলকে ব্লক করতে লাগল। জসীমের দলের ছেলেরা দল ছেড়ে নিহালের ছেলের পিছনে ছুটতে লাগল। চোখের পলকে যেন জসীমের সাজানো গুছানো রাজনৈতিক দলটা ভেঙ্গে নিস্তেজ হয়ে গেল। চারদিকে শুধু নিহালের ছেলে রিদ খানের নাম ছড়াতে লাগল। যে নাম কামাতে জসীমের বছরের পর বছর রাজনৈতিক মাঠে ষড়যন্ত্র ছক আঁকতে হয়েছিল সেই মাঠ বছর ঘুরতে না ঘুরতে নিহালের ছেলে রিদ খানের হয়ে গেল। নিহালও নিজের বড়ো ছেলে রিদ খানের উপর রাজনৈতিক দল নিয়ে নির্ভরশীল হয়ে পরলো।

অথচ রিদ খান একহাতে বাবার রাজনৈতিক দল সামলাতে লাগলো অন্যদিকে মাসের এ মাথা ঐমাথা করে লন্ডনে যাতায়াত করতো নিজের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে। বাবার পাশাপাশি রাজনৈতিক দলে থেকে রিদ খান নিজের বাকি পড়াশোনাটাও শেষ করতে করতে ব্যবসায়ীক কাজে জড়িয়ে পড়ল। পারিবারিক ব্যবসার পাশাপাশি নিজের একটা ব্যবসাও দাঁড় করাল, সব মিলিয়ে রিদ খানের নামটা হঠাৎ করেই অনেক বড়ো হয়ে গেল। এতে জসীম হিংসা*ত্মকে জ্বলে পুড়ে নিজের দুই ছেলেকেও রাজনৈতিক মাঠে নামাল। কারণে অকারণে রিদ খানের সঙ্গে ঝামেলা জড়াতে লাগল কিন্তু এতেও রিদ খানের সঙ্গে কোনো সুবিধা করতে পারছিল না বলে, নিহালের ছোট ছেলেকে টার্গেট করলো ওরা। এতে কাজের কাজও হলো। নিহালের বড়ো ছেলে রিদ খান যতোটা চতুর মাইন্ডের ছিল ততটাই নরম মনের ছিল ছোট ছেলেটা।

কিন্তু খান পরিবারের সদস্যরা সবাই মিলে যে রাদিফ খানকে প্রটেক্ট করে সেটা জসীম লাস্টবার আক্রমণ করতে গিয়ে বুঝতে পারলো। জসীমের বড়ো ছেলে যখন লোকজন নিয়ে এয়ারপোর্টে থেকে আসা রাদিফ খানের উপর আক্রমণ করল তখন সেই যাত্রায় রিদ খান বাঁচিয়ে নেয় তার ভাইকে এবং সেখানের মা*রামা*রিতে রিদ খানের হাতে উনার বড়ো ছেলেটা পঙ্গুও হয়ে যায় সারাজীবনের জন্য। দু’টো পা কেটে আজও বেড রেস্টে আছে সে। সেজন্য তিনি শপথ করে রেখেছিল অন্য কাউকে নয় বরং এবার রিদ খানকে জা*নে মে*রে শান্ত হবেন তিনি। সেই অনুযায়ী তিনি গোপনীয় ভাবে লোক লাগিয়ে রেখেছিল রিদ খানকে মারতে। বহুদিন চেষ্টা করার পর একদিন সুযোগে পেয়ে রিদ খানের এক্সি*ডেন্টও করালো। ট্রাকের চাপায় রিদ খানের মৃ*ত্যু নিশ্চিত হবে এমন খবরও জসীম পেয়েছিল কিন্তু এতো ধকলের মধ্যেও সুফিয়া নিজের ছেলেকে বাঁচিয়ে আনলো।

তারপর কিভাবে কি তদন্ত করে জসীমের নামও বের করে নিলো এ-সবের মাঝে। হঠাৎ এক রাতে পুলিশ জসীমকে ওর পার্টি অফিসের বাহির থেকে ধরে আনে এবং কোথাকার কোন কারাগারে গায়ের করে রাখে। আজ প্রায় একমাস হতে চলল সে সূর্যের আলো দেখে না। জসীমের পরিবারের কারও খবর নেই। জসীমের পরিবার আদৌও ওর খবর জানে কিনা সেটাও বলা দায়। আজ এই মূহুর্তে সুফিয়া জসীমের সামনে দাঁড়িয়ে আছে মানে জসীমকে এতোদিন গায়েব রাখার পিছনে যে সুফিয়ার হাত রয়েছে সেটা তিনি ঠিক বুঝতে পারছেন। তবে জসীম এটা জানে না ওকে সন্দেহের বশে সুফিয়া এখানে আটকে রেখেছে নাকি সত্যিটা জেনে বুঝে আঁটকে রেখেছে।

যেটাই হোক না কেন, আগে সুফিয়ার মনোভাব বুঝে তারপর জসীম কিছু বলবে নয়তো আগ বাড়িয়ে কিছু বলে নিজের বিপদ ডেকে আনবে না। কারণ এই মূহুর্তে জসীমের হাতে কিছু করার নেই, যতক্ষণ না পযন্ত সে কারাগার থেকে মুক্তি পাচ্ছে ততক্ষণ পযন্ত। যদি সুফিয়া সত্যিটা জেনেও যায় তাহলে বড়জোর কি করবে? জসীমকে কোটে চালান করে দিয়ে আদালতে সর্বোচ্চ বিচার দাখিল করবে এটাই তো? বিচারে বড়োজোর কি করবে? যাবত জীবন কারাদন্ড দিবে ব্যস? কারণ রিদ খান এখনো জীবিত আছে, মরেনি, তার মানে জসীমকেও মৃত্যুদন্ড দিবে না আদালত। জসীম বেঁচে থাকলে, কিছু ক্ষমতা তো জসীমেরও আছে। বাংলাদেশের আইনকে কিনে সেও শাস্তি কমিয়ে নিতে পারবে। তাই আপাতত সুফিয়া যা বলতে চাচ্ছে তাই বলুক। জসীম বারাবাড়ি কিছু বলে পরিস্থিতি নষ্ট করবে না। বরং বুদ্ধি খাঁটিয়ে চুপ থাকাটায় শ্রেয় হবে। জসীমের মনস্তাত্ত্বিক ভাবনার মাঝেই সুফিয়া খান ফের বলে উঠলো…
‘ তুই তো আমাকে চিনিস জসিম। বিনা উদ্দেশ্যে সুতা বহন করার মতোন পাবলিকও আমি না। আমার এখানে আসার উদ্দেশ্যটা নিশ্চয়ই তোর মাথাও চলছে।

চলাটাও স্বাভাবিক। দেখ আমি এই পলিটিক্স খেলতে চাইনি বলে আরও অনেক বছর আগে স্বামী সংসার ছেড়েছিলাম। আজ আবার সন্তানের জন্য ফিরে আসলাম। নিহাল সহজ সরল বলে সেজন্য তুই বারবার খেলতে পারিস। সে মন থেকে চিন্তা করে কিন্তু আমি ভাই এই নষ্ট মন বুঝি না। আমার মনে খুব অল্প সংখ্যক মানুষ বসবাস করে। আমি শুধু আমার পরিবার বুঝি এর বাহিরে সব বাদ। আমি অপরাধীকে বারবার ক্ষমা করতে পারি না। এতো বড়ো কলিজা নিয়ে ঘুরি না। আমার কলিজা ছোট। সেজন্য যে আমার সাথে যেমন আমি তার সাথে তেমন। তুই ভালো তো আমি ভালো, তুই খারাপ তো আমি তোর থেকে দ্বিগুণ খারাপ। আমার বড়ো ছেলেটার রক্ত গরম সেজন্য হুটহাট রেগে যায়। রাগ কন্ট্রোল করতে পারে না জেদ বেশি। তবে আমি কিন্তু সেরকম না। আমার সহজে রাগ আসে না। খুবই শান্ত মস্তিষ্কে থাকি। হৈ-হুল্লোড় করে লোক জানিয়ে কাজ করা আমার স্বভাবে নেই। আমি ডান হাতে কাজ করলে বামহাত টের পাবে না। এই যেমন ধর আজ এখানে এসেছি তোকে চিরবিদায় দিতে। বাহিরে পুলিশ ভিতরে তোর সাথে আমি। বাহিরের পুলিশও টের পাবে না তোর মৃত্যুটা কিভাবে হলো বুঝলি?

সুফিয়া খানের কথায় অস্থির উত্তেজিত হলো জসীম। চেয়ারে বসা অবস্থায় ছটফটিয়ে বলল….
‘ কি বলছো তুমি এসব সুফিয়া। আমার মৃত্যু মানে তুমি কি আমার সাথে মজা করছো?
জসীমের কথায় সুফিয়া খান হেয়ালি করে বলল…
‘ এতো হাইপার হচ্ছিস কেন জসীম? তোর এই মূহুর্তে হাইপার হওয়া খুবই রিস্ক বুঝলি? তুই যতো শান্ত থাকার চেষ্টা করছি ততই তোর লাইফটাইম বাড়বে। নয়তো অতিরিক্ত হাইপার হলে তোর ব্লাড প্রেশার বেড়ে তুই যেকোনো সময় হার্ট অ্যাটাক করে মারা যেতে পারিস বুঝলি?
সুফিয়া খানের কথায় জসীম রাগে চিৎকার করে বলল…
‘ পাগল পেয়েছিস আমাকে? আমি কিছু বুঝি না মনে করেছিস? শুধু শুধু কেউ মারা যাবে কেন? আমার গায়ে হাত দিলে রক্ষা তুইও পাবি না সুফিয়া। আমাকে মারা দায়ে তুইও ফেঁসে যাবি।
জসীমের কথায় সুফিয়া খান নাক মুখ কুঁচকে বলল….

‘ তওবা! তওবা! তোর এই মনে হয়? তোকে মেরে হাত নষ্ট করবো আমি? এতো বছরের তুই আমাকে এই চিনেছিস? তুই তো এমনি মরে যাবি ভাই?তোকে মেরে আমার আবার হাত নষ্ট করতে হবে কেন? বড়োজোর তুই আর ছয় ঘন্টা লাস্টিং করবি তারপর ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
‘ তুই আমাকে মিথ্যা বুঝাতে চাচ্ছিস। আমি বিশ্বাস করি না তোর কথা। তুই আমাকে জানে না মারলে আমি কেন মারা যাব? আমিতো সুস্থ।
সুফিয়া খান আগের নেয় বলল…
‘ অবশ্যই তুই সুস্থ। সেটা আমি দেখছি, থানার পুলিশরা দেখছে, কারাগারে সিসি ক্যামেরা দেখেছে আমরা সবাই জানি তুই সুস্থ। কিন্তু তুই তো মরবি হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক করে। অতিরিক্ত ব্লাড প্রেশার হাই হয়ে রক্ত চাপে মারা যাবি। ডক্টরের রিপোর্টে তাই এসেছে দেখবি?
সুফিয়া খানের কথায় মনে ভয় জমা হলো জসীমের। সে উত্তেজিত গলায় বলল…
‘ রিপোর্ট? কিসের রিপোর্ট?
‘ তোর ডেডবডির পোস্টমর্টেমের রিপোর্ট দেখবি?

কথা বলেই সুফিয়া খান জসীমের সম্মতির অপেক্ষা না করে গলা ছেড়ে ডাকল তারেক ছেলেটিকে। সুফিয়া খানের ডাকা সঙ্গে সঙ্গে হাতে ফাইল নিয়ে তৎক্ষনাৎ দৌড়ে আসল তারেক। সুফিয়া খানের হাত বাড়ানো সঙ্গে সঙ্গে সে এগিয়ে দিল বেশ কিছু ডাক্তারি রিপোর্টস। সুফিয়া খান হাতের ইশারায় ছেলেটিকে চলে যেতে বলে, পরপর কাগজ গুলো জসীমের সম্মুখে ছড়িয়ে রাখতে রাখতে বলল…
‘ এই যে দেখ তোর ডেডবডির সাটিফিকেট গুলো। তুই কতো ভাগ্যবান দেখলি জসীম? মরার আগে নিজের পোস্টমর্টেমের রিপোর্ট গুলো দেখে যেতে পারছিস। তোর সাত কপাল ভাই আমার মতোন এমন বান্ধবী পেয়েছিস জীবনে। তোর কতো খেয়াল রাখছি আমি দেখ।
ডাক্তারী রিপোর্ট গুলো দেখে জসীম তীব্র আক্রোশে ফেটে পড়লো। বাঁধন খোলা হাতটা দিয়ে সকল কাগজ পত্র গুলো দুমড়ে মুচড়ে ছিঁড়ে ফেলতে ফেলতে চিৎকার করে বলল….
‘ তুই আমাকে মিথ্যা ফাদে ফেলতে চাচ্ছিস। আমি জানি আমার কিছু হবে না। অকারণে কারও ব্লাড প্রেশার হাই হয়না। আর না হার্ট অ্যাটাক হয়।

‘ অকারণে কেন হবে দোস্ত। অল্প ব্রেইন তো চালা নিজের। আমি এখানে আসতে দুজন হাত মিলালাম প্রথমে? তারপর তোর হাতে সুই বিঁধে ছিল? আমি আবার দরদ দেখিয়ে তোকে পানিও খাওয়ালাম মনে আছে সেগুলো? আসলে প্রথমে সুইটা কোনো সাধারণ সুই ছিল না। ঐটা বিষাক্ত পয়জন তোর বডিতে পশ করা হয়েছে। যেটা তোর হার্ট ব্লক করতে সাহায্য করবে দ্রুত। তারপর যে পানিটা খেলি আমার হাতে? সেটার মধ্যেও আরেকটা পয়জন ছিল। যেটা তোর ব্লাড সার্কুলারকে মাত্রাতিরিক্ত হাইপার করতে সাহায্য করবে। দুটো বিষের প্রতিক্রিয়ায় তোর হায়াত বড়োজোর পাঁচ ঘন্টা। এর মধ্যে তৃতীয় ঘন্টা থেকে তোর শরীর রেসপন্স করা ছেড়ে দিবে। একদম ম*রা লা*শের নেয় পরে থাকবি, তোর শরীরে রুহ তো থাকবে কিন্তু রেসপন্স করার জন্য শক্তি থাকবে না। মজার বিষয় কি জানিস? ছয় ঘন্টা হতে হতে তোর শরীর থেকে দুটো বিষই ভ্যানিস হয়ে যাবে। কারণ বিষ দুটো একটা অপরের প্রতিষেধক, অ্যান্টিডোট হিসাবে কাজ করবে। তাই তোর বডির পোস্টমর্টেম করার সময় রিপোর্টে আসবে তোর সাধারণ হার্ট অ্যাটাক থেকে মৃত্যুর হয়েছে।

সুফিয়া খানের কথায় জসীমের সর্বাঙ্গে কাঁপতে লাগল। মৃত্যুকে সবাই ভয় পায়। জসীমও তীব্র ভাবে পাচ্ছে। সে সুফিয়া খানের কাছে জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করে বলল….
‘ আমাকে ক্ষমা করে দাও সুফিয়া। আমাকে প্রাণে মেরো না। লাস্ট একটা সুযোগ দাও তারপরও প্রাণে মেরো না আমায়। আমি মরতে চাই না।
জসীমের আর্তচিৎকার সুফিয়া খানের মন গলল না। তিনি আগের নেয় বলল….
‘ তোর অপরাধের লিস্ট তো অনেক বড়ো দোস্ত। ক্ষমা করা যাচ্ছে না। আমার ছেলে আর স্বামী দুজনই তোকে খুঁজছে মারতে সেজন্য আমি ভাবলাম মা হয়ে তোর চেপ্টার ক্লোজ করে যায় বাপ ছেলে অবধি যাওয়ার আগে। শুন জসিম তোরে একটা মনের কথা বলি, তুই তো আমার ব্যাচমেটছিলি, তুই জানিস নিহালকে আমি লাভ ম্যারিজ করেছিলাম। কিন্তু ওকে আমি প্রেম করে বিয়ে করেও ঠকে গেলাম। পনেরো বছর ধরে একসাথে নেই। শালা বুইড়া খাটাশ আমার ফিলিংস বুঝে না। অথচ তুই বুঝলি, আমাকে বিশ্বাস করে বিষও পান করলি। তোর আসলে আমার ইমোশন ধরে টান দেওয়াটা ঠিক হয়নি। আমার ছেলেটা আমার ইমোশন ছিল। আচ্ছা যায় হোক তারপরও আমি দোয়া করবো তুই জাহান্নামে ভালো থাক। আল্লাহ তোকে সর্বোচ্চ জাহান্নাম দান করুক আমিন।

কথাটা বলে সুফিয়া খান জায়গায় ছেড়ে উঠে দাঁড়াল চলে যেতে। সামনে কদম বাড়াতে জসীম হাউমাউ করে চিৎকার করতে লাগলে সুফিয়া খান বিরক্তি স্বরে বলল…
‘ তোর মতোন আমার পরিবারও এমন করেই কেঁদেছিল সেদিন কিন্তু তুই শুনতে আসিস নি তাই আজ আমিও শুনবো না। তারপরও তোর ভালো জন্য বলে যায়, তুই যতো হাইপার, চিৎকার করবি তত দ্রুত তোর শরীরের বিষ এক্টিভ হয়ে কাজ করবে। পাঁচ ঘন্টার জায়গায় তুই এক ঘন্টায় মারা যাবি। সেজন্য চিল্লাচিল্লি না করে আল্লাহকে ডাক হারামি। এখানে তোর চিৎকার শুনার মতো কেউ নেই।

সকাল পাঁচটার ঘরে। বাড়ির গেইট পেরিয়ে পার্কিং এরিয়াতে গাড়ি এসে থামল সুফিয়া খানের। গম্ভীর মুখোর সুফিয়া খান গাড়ি থেকে নামতে নামতে চোখে পরলো বাগানের খোলা বাংলোর চেয়ারের হাত পা ছড়িয়ে গা এলিয়ে বসা থাকা রিদকে। রিদ চোখের উপর ডানহাত রেখে বামহাত ঝুলছে ফ্লোরে উপরে। গম্ভীর সুফিয়া খান রিদের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে হাতের ঘড়িটায় সময় দেখতে পুনরায় কপাল কুঁচকে তাকাল রিদের দিকে। এতো সকালে রিদ না ঘুমিয়ে জাগ্রত অবস্থায় বাগানঘরে কি করছে? ছেলেটা এখনো অনেক অসুস্থ। এই মূহুর্তে রিদের বেশি বেশি ঘুমের প্রয়োজন মস্তিষ্ক ঠান্ডা রাখার জন্য। নয়তো মায়া পাগল হয়ে বেঁচে থাকলেও রিদ বাঁচবে না যদি কোনো কারণে রিদের মস্তিষ্কে পুনরায় রক্ত ক্ষরণ হয় তাহলে। রিদের ফুলবেড রেস্টে থাকার কথা অথচ রিদ দুই দন্ড বেডে থাকছে না সারাক্ষণ অফিসে কাজে দৌড়াদৌড়ি করছে । রেগুলার চেক-আপ পযন্ত করাচ্ছে না সে। বাড়িতেও ফিরে না। আবার সুফিয়া খানের সঙ্গেও কথা বলে না। উনি ফোন দিলে কল রিসিভ করে না। আয়ন, রাদিফ এমনকি নিজের বাবার কলটা পযন্ত রিদ রিসিভ করছে না।

সুফিয়া খান বুঝতে পারছে রিদ পরিবারের সকলের উপর রেগে আছে বলে হয়তো কারও সঙ্গে কথা বলছে না। রিদের রাগটা যে মায়াকে ঘিরে সেটাও তিনি জানেন। রিদের অনুপস্থিতিতে মায়া খেয়াল না রাখাতে রিদ অভিমানে সবাইকে এরিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এভাবে আর কতোদিন? যা হবার তা হয়ে গেছে। অতীতে ফিরে উনারা কিছু ঠিক করতে পারবে না কিন্তু বর্তমান আর ভবিষ্যৎ যেন ভালো হয় সেটার খেয়াল রাখতে হবে উনাদের। সবকিছু ভুলে আপাতত সবার মায়ার পাশে দাঁড়ানো উচিত। এই মূহুর্তে মায়া মানসিক ভারসাম্যহীন রোগী। কাউকে চিন্তে পযন্ত পারছে না। মানুষ দেখতে ভয় পাচ্ছে, কান্নাকাটি করছে। চট্টগ্রাম থেকে ফিরে তিনি সোজা হসপিটালের গিয়েছিল মায়া কাছে তারপর রাতভর মায়ার সঙ্গে থেকে মাত্র রিদের বাড়িতে ফিরল ফ্রেশ হতে। তারপর আবার যাবেন হসপিটালের। মায়ার সুস্থতা নিশ্চিত করতে যা যা করা লাগে তিনি সেই সবটায় করবেন। কিন্তু স্বামী হিসাবে এই মূহুর্তে রিদকে খুব প্রয়োজন মায়া নয়তো একা মায়া নিজের মানসিক চাপ কাটিয়ে উঠতে পারবে না। মনস্তাত্ত্বিক ভাবনার সুফিয়া খান রিদের খোলা চাউনিঘরে প্রবেশ করতে করতে বলল….

‘ তুমি সারারাত ঘুমাওনি রিদ? এখানেই ছিলে?
সুফিয়া খানের কথায় রিদের মাঝে হেলদোল দেখা গেল না। সুফিয়া খান কপাল কুঁচকে তাকাল রিদের দিকে, রিদ জাগ্রত নাকি ঘুমিয়ে আছে তিনি আপাতত বুঝতে পারছে না। তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রিদকে পরখ করতে দেখতে পেল রিদের ঝুলন্ত বামহাতটা ছুঁয়ে ছুঁয়ে র*ক্ত ঝরছে ফ্লোরে। তাজা র*ক্তে তিনি আঁতকে উঠল। বুঝতে পারলো রিদ জাগ্রত অবস্থায় বসে। সুফিয়া খান বড়ো বড়ো পা ফেলে রিদের আহত হাতটা টেনে নিতে নিতে বলতে চাইল….
‘ তোমার হাতে র*ক্ত কিসের রিদ? তুমি আবার মারামারি করেছো? তোমাকে না বলেছিলাম মারামারিতে না জড়াতে, তুমি অসুস্থ। তোমা….
সুফিয়া খানের কথা শেষ হওয়ার আগে রিদ ঝটকায় হাতটা ফেলে দিল নিজের মায়ের। রিদের ব্যবহারে সুফিয়া খান শক্ত গলায় বলল….

‘ রিদ আমি কিছু বলছি তোমাকে।
সামনের টি-টেবিলটা ঠাস করে উল্টে ফেলতে ফেলতে উঠে দাঁড়াল। তিরতির মেজাজে বলল….
‘ তোমাকে না করেছিলাম না আমাকে ভারতি দরদ না দেখাতে। তারপরও কাহিনি করো। বালের নাটক আমাকে দেখাবা না। যাও!
রিদের কথায় সুফিয়া খান শক্ত গলায় বলল….
‘ তুমি বেয়াদবি করছো রিদ।
মায়ের কথায় যেন রিদ আরও চেতে উঠলো। রাগে রি রি করে বলল…

‘ আমি বেয়াদবি করলে তুমি কি করেছো আমার সাথে? তুমি জানতে না আমি বিবাহিত ছিলাম? আমার একটা বউ ছিল? তাহলে কেন তোমরা সবাই মিলে আজ ওকে পাগল বানিয়ে ছাড়লে? আমার সুস্থতার প্রতিদান কি তোমরা আমার বউকে পাগল বানিয়ে নিয়েছো? আজ আমি সুস্থ হয়েও তীব্র মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছি। তোমরা সবাই স্বার্থপর। আজ আমি সুস্থ না হলে তোমরা কখনোই মায়ার খোঁজ করতে না? আমার আমানতের খেয়াল তোমরা রাখনি, সেজন্য সে আজ অন্যের বউ হয়ে গেছে। আমি পেয়েও হারিয়ে ফেললাম ওকে। এই যন্ত্রণা তুমি বুঝবে কখনো?
রিদের কথায় সুফিয়া খান নরম হয়ে আসলো। তিনি নিজেও মায়ার ব্যাপারটা নিয়ে অপরাধ বোধে ভুগছেন। যতবার মায়ার দিকে তাকায় ততবার নিজের করা ভুলটা তীব্র ভাবে মাথা নাড়া দিয়ে উঠে। তিনি বাহিরের মানুষের কাছে শক্ত হলেও নিজের পরিবারের দিকটায় তিনি দূর্বল। রিদ কষ্ট পাচ্ছে ভেবে তিনি রিদকে নরম সুরে বুঝাতে চেয়ে বলল…
‘ কোনো কিছু খুব বেশি দেরি হয়নি রিদ তুমি চাইলে সবকিছু আবার ঠিক করতে পারবে। এই মূহুর্তে মায়ার পাশে তোমার থাকা উচিত। সি নিড ইউ।

মায়ের কথায় রিদ তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো আরও। সবটা শেষ করে বলছে কোনো কিছু খুব বেশি দেরি হয়নি। আর কি বাকি আছে যেটা ঘটেনি রিদের জীবনে? রিদ রাগে তিরতির করে বলল…
‘ কোনটা বেশি দেরি হয়নি তুমি আমাকে বুঝাও। আমার বউ অন্যের বউ হয়ে গেছে সেটা নাকি মায়ার পাগল হওয়াটা। আর কি দেরি হওয়া বাকি আছে তোমার জন্য আমাকে বলো। আমার বউ আমার জন্য হারাম হয়ে গেছে। তাঁকে চাইলেও দেখতে পারছি না, ছুঁতে পারছি না, দুটো কথা বলতে পারছি না, সারাক্ষণ মনে হয় আমার বউ আমার আর নেই। এখন আমার তার দিকে তাকালেও পাপ হবে। আমার এই দ্বিধাকে কে কাটাবে বলো? তুমি? তুমি যে সিচুয়েশনে বাবা সঙ্গে আছো? সেইম সিচুয়েশনে তোমরা আমাকেও দাঁড় করিয়েছো। সম্পর্কে না রাখতে পারছি আর না বহন করতে পারছি। এর থেকে ভালো ছিল আমি মরে যেতাম তোমাদের ঝামেলাও শেষ হয়ে যেতো।

রিদ মায়ার প্রেমগাঁথা পর্ব ৬১

কথাটা বলেই রিদ হনহনিয়ে বাড়ির ভিতরে হাঁটল। সুফিয়া খান ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল রিদের চলে যাওয়ার দিকে। উনি সহজে কান্না করতে পারে না নয়তো এই মূহুর্তে খুব করে কেদে নিজের ভিতরকার কষ্টটা প্রকাশ করতো। সন্তানদের কষ্টে মায়েদেরও সেইম কষ্ট হয় সেটা প্রকাশ করতো। এই পরিস্থিতি তিনি কিভাবে ঠিক করবেন জানা নেই। তবে তিনিও সহজে হার মানার মানুষ নয়। যেকোনো মূল্যে মায়ার সুস্থতার সঙ্গে ছেলের মনের জোড়াও তিনি লাগাবেন ইনশাআল্লাহ। এই সবকিছুর জন্য প্রয়োজন মায়ার দ্রুত সুস্থতা নিশ্চিত করা।

রিদ মায়ার প্রেমগাঁথা পর্ব ৬২