রিদ মায়ার প্রেমগাঁথা পর্ব ৬২
রিক্তা ইসলাম মায়া
রাত নয়টা পনেরোর ঘরে। সারাদিন পর রিদের গাড়ি প্রবেশ করলো বাড়ির চত্বরে। পার্কিং এরিয়াতে গাড়ি থামতে একজন দেহরক্ষী এগিয়ে আসলো দ্রুত। তাড়াহুড়োয় গাড়ির দরজা টেনে ধরতে গম্ভীর মুখোর রিদ নামলো তাতে। হাতের কোটটা পাশের দেহরক্ষীকে এগিয়ে দিতে দিতে হাঁটলো বাড়ির ভিতরে। পিছনে আসিফ তখনো ড্রাইভারের সাথে বসা। রিদের পরপর সেও গাড়ি থেকে নামল তবে রিদের পিছন পিছন বাড়ির ভিতরে গেলো না। দেহরক্ষীর হাত থেকে রিদের কোটটা নিজের হাতে নিতে নিতে ফের ঘুরে তাকালো রিদের চলে যাওয়ার পথে।
আজ বিগত একমাস বারোদিন হতে চললো রিদ বাংলাদেশে ফিরেছে অথচ প্রয়োজনের বাইরে রিদ আসিফের সঙ্গেও দু’টো কথা বলে না। কাজের সূত্রে দুজনের সার্বক্ষণ একত্রে থাকায় হয় তারপরও রিদ বিগত দিনের কথা জানতে চাইনি আসিফের কাছে, কেনো আসিফ মায়ার খবর নেয়নি রিদের অনুপস্থিতিতে? আসিফ থাকতেও কেনো মায়ার বিয়েটা হলো? কেনো আসিফও রিদের পরিবারের মতোই মায়ার ব্যাপারে উদাসীন রইলো? সবাই না জানুক আসিফ তো জানতো তার রিদ ভাই কতোটা পাগল ছিলো তার বউয়ের জন্য তারপরও সে কেনো হেফাজত করলো না তার রিদ ভাইয়ের আমানতকে? সত্যি বলতে আসিফ এতোদিন ভয় পেতো এসব প্রশ্নের মুখোমুখি হতে, তার কাছে উত্তর নেই এসব প্রশ্নের? কিন্তু আজকাল আসিফ খুব করে চাই তার রিদ ভাই এসব প্রশ্ন গুলো করুক আসিফকে!
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আসিফ কি উত্তর দিবে তা জানা নেই, তারপরও সে খুব করে চাই রিদ অন্তত আসিফের উপর আগের মতো অধিকার বোধ দেখিয়ে প্রশ্ন করুক। মানুষ প্রশ্ন তাঁকেই করে যার উপর মানুষ অধিকারবোধ রাখে। আসিফের উপর তার রিদ ভাইয়ের অধিকারবোধ ছিল সর্বত্র। মূলত রিদের সঙ্গে আসিফের শুধু প্রফেশনাল সম্পর্কে সীমাবদ্ধ ছিলো না। রিদের পার্সোনাল মানুষ গুলোর মধ্যে আসিফও একজন ছিল। দুনিয়া না জানলেও আসিফ জানতো রিদের প্রফেশনাল কিংবা পার্সোনাল বিষয়ের সম্পর্কে। কিন্তু আজকাল রিদ শুধু আসিফকে প্রফেশনাল কাজের মধ্যেই রাখে। পার্সোনাল কোনো বিষয়ে ভিড়ায় না। রিদের এই অদৃশ্য দূরত্বটা আসিফকে খুব করে পুরায়। তার রিদ ভাইয়ের পার্সোনাল মানুষ গুলোর মধ্যে সে নেই সেটা মানতে নারাজ আসিফের মন। সেজন্য আসিফ খুব করে চাই রিদ তাঁকে মায়াকে ঘিরে অসংখ্য অসংখ্য প্রশ্ন করুক। দিন রাত প্রশ্ন করুক। আসিফ উত্তর দিতে না পারলে অপরাধী হয়ে থাকবে তারপরও রিদ প্রশ্ন করুক, অধিকার দেখাক আসিফের উপর। রিদের চলে যাওয়ার দিকে আসিফ আরও একবার তাকালো। ভিতরকার কষ্ট চাপিয়ে হাঁটলো নিজের বরাদ্দকৃত বাগানের কোয়ার্টারের ঘরটার দিকে।
বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করতে করতে রিদের পা থেমে গেলো আলো বিহীন অন্ধকারময় ড্রয়িংরুমটা দেখে। আবছা আলোয় রিদ চারপাশে তাকাতে তার কপাল কুঁচকে এলো বিরক্তিতে। বাড়িতে এতোগুলা কেয়ারটেকার থাকতে রাত নয়টা অবধি এখনো ঘরের আলো জ্বালেনি এই বিষয়টিতে ক্ষিপ্ত হলো রিদ। এমন না বাসায় বিদুৎ নেই। বাহিরে আলো জ্বলছে মানে বাসায় বিদুৎ আছে। বিদুৎ না থাকলেও জেনারেটর আছে বিদ্যুৎতের সমস্যা হওয়ার কথা না। ক্ষিপ্ত রিদ বিরুক্তিতে এগিয়ে গেলো ড্রয়িংরুমের আলো জ্বালাতে, সুইচবোর্ডের অনুসন্ধান করতে হঠাৎই রিদের পা থেমে গেলো অদ্ভুত কিছুর গোঙ্গানির শব্দে। মূহুর্তে সুইচবোর্ডের থাকা রিদের হাতটা স্থির হলো। আলো না জ্বালিয়ে কান খাড়া করলো শব্দের উৎস খোঁজে। ক্রমশয় রিদের বিরক্তি কপালটা শীতল হয়ে আসলো সুফিয়া খানের বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে। এই ঘরটায় সুফিয়া খান আর মায়া থাকে।
এই মূহুর্তে তার মা সুফিয়া খান বাসায় নেই বাহিরে আছেন কোনো কাজে। বাড়িতে রাফা মেয়েটাও নেই বিগত একমাস হলো। মায়াকে ঢাকা নিয়ে আসার বারোদিন পর রাফাকে ওর পরিবার নিয়ে যায়। তারপর থেকে মায়া সুফিয়া খানের সঙ্গেই থাকছেন। তবে আজ মায়া একা ছিলো বাড়িতে কেয়ারটেকারের সঙ্গে। সকলের অনুপস্থিতিতে মায়ার কক্ষ হতে অদ্ভুত গোঙ্গানির শব্দটা পেতে রিদের বুক মুচড়ে উঠলো ভয়ে। আবারও মায়ার প্যানিক অ্যাটাক করেছে ভেবে ঘরের আলো না জ্বালিয়ে তৎক্ষনাৎ দৌড়ালো সেদিকে। দরজার সম্মুখে যেতে যেতে রিদের পা থমকে দাঁড়ালো আবছায়া আলোয় অন্ধকার রুমের দৃশ্য দেখে। স্তব্ধতার নেয় মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো মূহুর্তে। অন্ধকার রুমের আপত্তিকর দৃশ্যে রিদের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ার মতোন অনুভব করলো।
সমস্ত সত্তা নাড়িয়ে কেঁপে উঠলো বুক। রিদ স্থির পায়ে, কম্পিত হাত উঠিয়ে ছাপানো দরজাটা ভিতরে ঠেলতে দৃশ্যমান হলো যৌ*ন*তায় লিপ্ত হতে কাউকে। রিদ অনূভুতি চোখে তাকালো সেদিকে। দেখলো খুব জো*ড়া*জুড়ি করেই লোকটা তার যৌ*ন*তা মিটাচ্ছে মেয়েটির সঙ্গে। রিদের মনে হলো কক্ষে মেয়েটি তার রিত। এই কক্ষে, এই বেডে, তার রিতই শুয়ে থাকে সবসময়। আজ সকলের অনুপস্থিতিতে তার অসুস্থ্য রিতের সুযোগ নিলো অন্যকেউ। রিদ আবারও দেরি করলো তার রিতের কাছে পৌঁছাতে। রিদের ভিতরকার সত্তা তীব্র ভাবে ধিক্কার জানালো রিদকে। তার এতো ক্ষমতা, এতো পাওয়ার থাকার পরও সে দুই দুইবার ব্যর্থ হলো নিজের বউকে বাঁচাতে। রিদের ব্যর্থতা যেনো রিদের উপরই হাসালো। সে তার বউকে প্রথমে অন্যের সাথে বিয়ে হওয়া থেকে আটকাতে পারলো না আর আজ অন্যের লালসা স্বীকার হতে রক্ষা করতে পারলো না।
রিদ নিস্তব্ধ শীতল চোখে তাকিয়ে রইলো সেদিকে। ঠান্ডা পরিবেশেও রিদের কপালের ঘাম ঝরছে কার্নিশ বেয়ে। দরজার উপর হাতটা কাঁপছে তিরতির করে। রিদের গলার গলগণ্ডটাকেও বারবার উপর নিচ হতে দেখা গেল। মানুষ রিদ খানের বাড়ি অবধি আসবে তো দূর রিদের সামনে দাঁড়াতেও ভয় পায় না জানি প্রাণ নিয়ে ফিরতে না পারে সেই ভয়ে। অথচ আজ তাঁর বাড়ি, তার ঘরে, এতো পাহারাদারের মাঝেও রিদের বউ সেইফ রইলো না। লালসার স্বীকার হলো অন্য কারও হাতে। মায়া তো মানসিক রোগী সেজন্য কেউ তার সুযোগ নিলেও সে ঠিকঠাক বলতে পারবে না। এজন্য হয়তো তার অসুস্থ্য বউয়ের সুযোগ নিলো অন্য কেউ? আচ্ছা কার এতো বড়ো কলিজা হলো? যে রিদ খানের বউকে অপবিত্র করলো? কে ছুলো তার বউকে?
এসব কতোদিন ধরে হচ্ছে তার বাড়িতে? রিদের অবহেলায় কি সে তার রিতকে হারিয়ে ফেললো? রিদ অনূভুতিহীন চোখে হঠাৎই ঝিমিয়ে উঠলো, নাকে তরল কিছু গড়িয়ে পরল গলগল করে। বামহাতের উল্টো পিঠে রিদ নাক মুছতে মুছতে দেয়াল ধরে দাঁড়াল শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখতে। কিন্তু তারপরও সেই একই ভাবে গড়িয়ে যাওয়া তরল পদার্থ অনুভব করতে রিদ নিজের ভারসাম্য হারালো। দূর্বলতা নেয় পরে যেতে নিলে পিঠ ঠেকে গেল দেয়ালে। অসাবধানতায় রিদের হাত লেগে ফ্লাওয়ার প্যাশনটা পরলো ফ্লোরে। মূহুর্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল মাটির প্যাশনটা।
উচ্চ শব্দে ধড়ফড়িয়ে উঠলো ধ*র্ষ*ণ কারী লোকটা। তড়িঘড়ি করে বিছানা হতে মেয়েটিকে ছেড়ে ফ্লোর থেকে শার্ট, প্যান্ট উঠিয়ে জড়াল গায়ে। প্যান্টের চেইন টানতে টানতে বাহিরে বেড়িয়ে আসতেই দরজার সম্মুখে রিদকে নিস্তব্ধে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভয়ে থতমত খেয়ে বসল বয়স্ক ডাইভার হাশেম। রিদ তখনো অনূভুতিহীন শূন্য চোখে তাকিয়ে রইলো বয়স্ক ড্রাইভার লোকটার দিকে। ক্রমেই চোখ ঘুরাল লোকটা খোলার প্যান্টের চেইনের দিকে। থমথমে বয়স্ক হাশেম রিদের দৃষ্টি অনুসরণ করে ভয়ে তৎক্ষনাৎ বাহিরের দিকে দৌড়াতে দৌড়াতে প্যান্টের চেইন আটকালো। ঘরের ভিতর থেকে কারও ফুঁপানো কান্নার শব্দ রিদের কানে যেতেই রিদ দেয়াল ধরে বসলো ফ্লোরে। রুমের মেয়েটির আর্তচিৎকার যতোটা গাঢ় হচ্ছিল রিদের নিশ্বাসের গতি ততই ধ্রীর হচ্ছিল। অন্ধকারে মেয়েটির আর্তচিৎকার বলছে রিদ আবারও ব্যর্থ হয়েছে তার রিতকে হেফাজত করতে।
সোফায় হাত পা ছড়িয়ে গা এলিয়ে বসে রিদ। ডানহাত ঝুলছে ফ্লোরের উপরে। সেই হাতে ধারালো ছু*রিটা চুইয়ে চুইয়ে র*ক্ত ঝরছে ফ্লোরে। সামনেই লা*শ হয়ে উপুড় হয়ে পরে আছে তখনকার ড্রাইভার হাশেম লোকটা। তার তাজা র*ক্তে রঞ্জিত ফ্লোর। রিদের ছাই রঙের শার্টটা কালো হয়ে আছে রক্তে*র ছিটায়। দু’পায়ের নিচ অবধি ভেসে গেলো সেই র*ক্ত। নিস্তর রিদের একটা পা-টা হাশেমের পিঠে রেখে বাগানের খোলা বাংলোতে গা এলিয়ে সোফায় শুয়ে সে। সামনেই আসিফ থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে। নিস্তব্ধ পরিবেশে কারও মুখে কোনো কথা নেই। রিদের ভয়ে আসিফ কথা বলতে সাহসও পাচ্ছে না। বাড়ির ড্রাইভারকে রিদ হঠাৎ কেনো কুঁপিয়ে মারলো তাও বুঝতে পারছে না আসিফ। তবে রিদ যে অকারণে কিছু করবে না তাও জানে আসিফ। ড্রাইভার চাচাকে মারার পিছনে নিশ্চয়ই কোনো মারাত্মক কারণ হবে রিদ ভাইয়ের এটাও আসিফের ধারণা। কিন্তু হাশেম লোকটা হঠাৎ কি করেছে সেটাই ভয়ে জিগ্যেসা করতে পারছে না আসিফ। পিনপিন নিরবতা বিচ্ছিন্ন করে হঠাৎই গেইট ধরে প্রবেশ করলো সুফিয়া খানের সাদা গাড়িটি। গাড়ির হর্ণের শব্দে আসিফ সেদিকে তাকিয়ে দেখলো সুফিয়া খানের সঙ্গে মায়াকে নামতে। দুজনের হাতেই শপিং ব্যাগ চাপা। তবে মায়া একহাতে কয়েকটা শপিং ব্যাগ নিয়ে অন্য হাতে সুফিয়া খানের হাত জড়িয়ে রেখেছে ভয়ে। আসিফ সুফিয়া খানকে এদিকটায় আসতে দেখে ভয়ে জড়সড় হয়ে তৎক্ষনাৎ রিদকে ডেকে বলল….
‘ ভাই আপনার আম্মু এদিকেই আসছেন। হাশেমের লা*শটা কি করবো? সরিয়ে ফেলবো?
আসিফের ডাকে নিরুত্তর রিদের কোনো হেলদোল দেখা গেল না। আর না চোখ মেলে তাকালো। আসিফ রিদের নড়াচড়া দেখতে না পেরে তৎক্ষনাৎ আবারও তাকালো সুফিয়া খানের দিকে। তিনি মায়ার হাত চেপে এদিকটাই হেঁটে আসছেন। সুফিয়া খান যেমন তেমন মায়ার তো মানসিক অবস্থা ভালো না। মায়ার এই অবস্থায় খু*ন খারাবি কিংবা র*ক্ত দেখাটাও বিপদজনক। একটা স্বাভাবিক সুস্থ মানুষই খু*ন-খারাবি র*ক্ত দেখলে অস্বাভাবিক হয়ে যায়, সেখানে মায়া অসুস্থ্য হয়ে লা*শ দেখলে আরও উত্তেজিত অস্থির, হয়ে পরবে সেটাও স্বাভাবিক। আসিফ মায়াকে দেখে রিদকে সর্তক করতে চেয়ে বলল….
‘ ভাই আপনার মার সাথে ভাবিও আছেন। লা*শটা দেখলে উনি ভয় পাবেন। লা*শটা কি আমি সরিয়ে ফেলবো?
আসিফের কথাটা রিদের কান অবধি পৌঁছালেও রিদের মস্তিষ্ক সেটা ধারণ করতে পারেনি। বেখেয়ালি নিস্তব্ধ নিশ্চুপ রিদ তখনো এককইভাবে শুয়ে। অথচ ততক্ষণে সুফিয়া খানের হাত ধরে মায়া রিদের নিকটবর্তী এসে থমকে দাঁড়ালো র*ক্তে রঞ্জিত লা*শ দেখে। ভয়ার্ত মুখে উত্তেজিত ভঙ্গিতে সুফিয়া খানের হাত টেনে আঙ্গুল তাক করলো রিদের পায়ের নিচে থাকা হাশেমের লা*শটির দিকে, কম্পিত স্বরে বলল…
‘ রর*ক্ত!
মায়ার ভয়ার্ত গলার স্বর অল্প শুনালো রিদের কানে, অথচ তড়াক করে খোলে গেলো রিদের দু’চোখ। মূহুর্তে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো অদূরে মায়ের সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকা মায়ার দিকে। গায়ে সাদামাটা একটা পোষাক জড়িয়ে মায়া ভয়ার্ত মুখে তাকিয়ে রিদের পায়ের নিচে লা*শটার দিকে। রিদ মায়াকে নিজের মায়ের সঙ্গে সহিসালামত দেখে কেমন নিশ্চুপ চোখে তাকিয়ে রইলো মায়ার আদলের নিষ্পাপ মুখটার দিকে। রিদের চোখ দেখে তার ভিতরকার গভীরতা প্রকাশ করা দায়। অথচ মায়া পুনরায় একই ভাবে সুফিয়া খানের হাতটা টেনে রিদের পায়ের নিচে লা*শটা দেখিয়ে ভয়ার্ত, অস্থির, উত্তেজিত ভঙ্গিতে বলল….
‘ আম্মু র র*ক্ত! আম্মু ররর*ক্ত!
মায়ার আঙ্গুল তাক করার দিকে সুফিয়া খান কপাল কুঁচকে তাকালো, দেখলো ড্রাইভার হাশেমের লা*শটাকে। তারপরও চোখ ঘুরালো রিদের অনূভুতিহীন শূন্য চোখের দিকে। মায়া তখনো একই ভাবে সুফিয়া খানের হাত টানছে ভয়ে। হাতের শপিং ব্যাগগুলোও ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলেছে ততক্ষণে। মায়াকে ভয় পেতে দেখে সুফিয়া খান রিদের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মায়াকে সামলাতে চাইলে মূহুর্তে উঠে দাঁড়াল রিদ। র*ক্তা*ক্ত ছু*রিটি হাতে নিয়েই তৎক্ষনাৎ দৌড়ালো মায়ার দিকে। আতঙ্কিত মায়া আরও আতঙ্কিত হলো রিদকে ছু*রি হাতে ওর দিকে দৌড়ে আসতে দেখে। ভয়ে উত্তেজিত মায়া বড়ো বড়ো নিশ্বাস নিতে নিতে কোনো রকমে সুফিয়া খানের হাত টেনে বলল….
‘ আম্মু র!ক্ত! আম্মু! আম্মু…
মায়ার কথা গুলো বলতে বলতে রিদ ততক্ষণে
র*ক্তের উপর দিয়ে দৌড়ে মায়াকে দু’হাতে ঝাপটে জড়িয়ে ধরল আক্রোশে। হাইটে রিদ লম্বা হওয়ায় মায়ার পা উঠে গেলো ভাসমান শূন্যে। আতঙ্কিত মায়া আরও আতঙ্কিত হলো রিদের শরীরের তাজা র*ক্তে লেপ্টে। রিদের বক্ষে ছটফটিয়ে চিৎকার করে জ্ঞান হারালো তক্ষুনি। মায়াকে জ্ঞান হারাতে দেখে রিদের হাতে ছু*রিটাও পরলো মাটিতে। তার এতক্ষণ মনে হয়েছিল সে ব্যর্থ হয়েছিলো এই নারীকে হেফাজত করতে। কিন্তু এখন সশরীরে নিজের মায়ের সঙ্গে মায়াকে দেখে রিদের শুকিয়ে যাওয়া কলিজাতে যেনো পানি আসলো। রিদ দু’হাতে মায়াকে জড়িয়ে মায়ার গলায় মুখ ডোবাতে সুফিয়া খান মায়ার হাতটা ছেড়ে হাঁটলো বাড়ির ভিতরে।
মা হিসাবে এই মূহুর্তে এখানে দাঁড়ানোটা উনার কাম্য নয় বলে তিনি চলে যেতে যেতে কপাল কুঁচকে তাকালো হাশেমের লা*শটার দিকে। সুফিয়া খানের দৃষ্টি অনুসরণ করে আসিফও উনার পিছন পিছন হাঁটলো বাড়ির ভিতরে। মূলত কারও জানা নেই রিদ কেনো মারলো বাড়ির ড্রাইভারকে তবে হাশেমকে মারার পিছনে যে মায়ার কোনো কারণ থাকতে পারে সেটা ঠিক বুঝলো আসিফ। নয়তো এতোদিন পর হঠাৎ করেই কেন রিদ ভাই মায়া ভাবির জন্য উতলা হয়ে উঠবে। নিশ্চয়ই মায়া ভাবিকে নিয়ে রিদ ভাই কোনো বিষয়ে ভয় পেয়েছে ভিষণ সেজন্য বিগত দিনের ভুল বিভ্রান্তি ভুলে নিজের বউকে কাছে টানছে সে। এর থেকে ভালো আর কি হতে পারে? দুজন মিলে গেলেই হয়। সবার করা অপরাধবোধও কমে আসবে তাতে। তাছাড়া এবার নিশ্চয়ই মায়া ভাবি দ্রুত ঠিক হতে পারবে রিদ ভাই সাথে থাকলে সবই সম্ভব। আসিফ রিদকে প্রাইভেসি দিয়ে সরে যেতেই দীর্ঘদিনের টানাপোড়া চাপিয়ে মায়াকে জড়িয়ে পরপর ঠোঁট বুলালো মায়ার গলায়। বেহুশ মায়া রিদের বক্ষে শরীর ছেড়ে দিতে রিদ মায়াকে নিয়ে বসলো জায়গায়। দু’হাতে মায়ার মাথা চেপে মুখটা মুখোমুখি ধরতে কপাল ঠেকালো মায়ার কপালে। রিদ বিরবির করে বললো…
‘ স্যরি রিত! খুব করে স্যরি!
তোকে হারিয়ে বেঁচে থাকার মতো সাহসী আমি নয়।
রিদের শরীরের স্যাঁতস্যাঁতে র*ক্তে মায়ার শরীরেও লেপ্টে গেলো তাতে। রিদের হাতের র*ক্তে মায়ার গলা গাল লেপ্টে যেতে রিদ কপাল উঠিয়ে তাকালো মায়ার আদলে মুখটার দিকে। এই মুখটা তার খুব শখের। এই মুখটা ছাড়া তার দিন যায় না রাত পোহায় না। অথচ তার অনুপস্থিতিতে এই মুখটার প্রতি সকলের অবহেলা জড়িয়ে। রিদ জানে না এই নারীকে ছুয়া তার জন্য কতটুকু হালাল? তারপরও সে এই নারীকে তার অবহেলায় অন্য কাউকে ছুঁতে দিবে না। এই নারী তার না হোক তারপরও রিদের কাছে হেফাজত থাকুক এই নারী। এই নারীকে হারিয়ে সে প্রাণে বাঁচতে পারবে না এই বিষয়টা সে অনেক আগেই উপলব্ধি করেছিলো। তারপরও রিদ বিগত দিনে অনেক চেষ্টা করছিলো এই নারী থেকে দূরে থাকার। কিন্তু রিদ ব্যর্থ এই নারীকে ভুলতে।
রিদ জানে না তখন অন্ধকার রুমে মায়ার জায়গায় কে ছিলো সেই কক্ষে তবে এখন এক মূহুর্তে জন্য মনে হচ্ছে অন্য মেয়ের জায়গায় আজ মায়া থাকতে পারতো। রিদের অবহেলায় কেউ মায়ার অসুস্থ্যতার সুযোগ নিতে পারতো। কিন্তু আজ নিজের মায়ের জন্য রিদ মায়াকে হেফাজতে পেয়েছে। গুমোট নিশ্বাসে রিদ মায়াকে কোলে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। বড়ো বড়ো পা ফেলে হাঁটলো বাড়ির ভিতরে। ড্রয়িংরুমে একপাশে রহিমা মাথা নুইয়ে সুফিয়া খানের পা চেপে কান্নাকাটি করছে হাশেমের হাতে ধ*র্ষি*তা স্বীকার হয়ে। আসিফ তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বড়ো বড়ো চোখ করে। রিদ খানের বাড়িতে যে কেউ এসব করার সাহস করতে পারে সেটা রহিমার কাছে এসব না শুনলে বুঝতো না আসিফ।
সুফিয়া খান চোখ মুখ কেমন শক্ত করে দাঁড়িয়ে দাঁতে দাঁত চেপে। রিদ বেহুশরত মায়াকে কোলে করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যেতে গম্ভীর সুফিয়া খান চোখ ঘুরিয়ে তাকালো সেদিকে। দেখলো রিদ মায়াকে নিজের রুমে না নিয়ে তার পাশাপাশি অন্য রুমে ঢুকতে। রিদের তখনকার হাশেমকে মা*রার কারণটা চট করে বুঝে গেলো সুফিয়া খান। একজন নারীকে অসম্মান করার বিষয়টা সুফিয়া খানের নীতিমালার বাইরে। নারীকে অসম্মান করা পুরুষ সমাজে নোংরা কীট হয়। আর এসব কীট সমাজে জীবিত থাকলে ক্রময় সমাজটা দূর্ষিত হতে থাকবে। তাই এসব কীটের বেঁ*চে থাকা থেকে ম*রে যাওয়ায় উত্তম। সুফিয়া খান শক্ত চোয়ালে আসিফকে ডেকে বললো…
‘ আসিফ! লা*শটা পুলিশ ম*র্গে পাঠিয়ে দে। ওরা সামলে নিবে।
আসিফ সম্মতি দিয়ে তৎক্ষনাৎ বলল…
‘ জ্বি ম্যাডাম
রেস্টুরেন্টের মুখোমুখি চেয়ারে বসে আয়ন আর জুই। জুইকে এই অবধি আয়নের সঙ্গে দেখা করতে মানাতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে আয়নকে। বিগত দেড়মাসে অনেক চেষ্টা পর আজ জুই রাজি হলো আয়নের সঙ্গে দেখা করবে বলে। জুই এসেছে সবে বিশ মিনিট হলো। অথচ অল্পতেই বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে বসে আছে। আয়ন সেই তখন থেকে জুইকে বুঝানো চেষ্টা করে যাচ্ছে বিগত দিনে যা হয়েছে তাতে আয়ন ইচ্ছাকৃত ভাবে হার্ট করতে চাইনি কাউকে। একটা ভুল বুঝাবুঝি থেকে এসব কিছু হয়েছে বলে দাবি করলো তারপরও অবুঝ জুই মানতে নারাজ আয়নের কথা। আয়নের বাক্যের মাঝেই জুই কেমন অসন্তুষ্ট গলায় বলল….
‘ আপনার কথা শেষ হয়েছে? আমার আর শুনতে ভালো লাগছে না। আমি বাসায় যাব।
জুইয়ের কথায় আয়ন খানিকটা শক্ত গলায় বলল…
‘ জুই আপনি এবার বাড়াবাড়ি করছেন। একবার অন্তত শান্ত মাথায় আমার কথা গুলো বুঝার চেষ্টা করুন প্লিজ!
জুঁই ত্যাড়া উত্তরে বললো..
‘ আমার মুড নেই আপনার কথা শুনার। সময় থাকলে অন্য একদিন শুনবো আজ আসি। বাই!
কথা বলেই জুঁই দাঁড়িয়ে যায় চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। জুঁইকে দাঁড়িয়ে যেতে দেখে খপ করে জুঁইয়ের হাতটা চেপে ধরলো আয়ন। জুঁইকে টেনে জায়গায় বসাতে চেয়ে বললো…
‘ আমার কথা শেষ না হওয়া অবধি আপনি কোথাও যেতে পারবেন না জুঁই। জায়গায় বসুন।
আয়নের হাত ধরাতে চেতে উঠলো জুঁই। নিজের হাত মুচড়া মুচড়ি করে ছাড়াতে চেয়ে বললো….
‘ অসভ্যতামির একটা লিমিট থাকে। আপনি সকল লিমিট ক্রস করে ফেলেছেন। আমার পারমিশন ছাড়া আপনি আমাকে ছুঁলেন কিভাবে? হাতটা ছাড়ুন বলছি অসভ্য লোক।
জুঁইয়ের কথা বাতাসে উড়িয়ে দেওয়ার মতোন করে আয়ন তৎক্ষনাৎ উত্তর দিয়ে বলল….
‘ আমার আপনাকে ছুঁয়ার অধিকার আছে বলেই ছুঁয়েছি জুঁই। আমার শুধু আপনার হাত না আরও অনেক কিছু ছুঁয়া বা দেখার অধিকার আছে। আপনার সাথে আমার সকল লিমিট ক্রস করার রাইটও আছে। তাই চুপচাপ আমার কথা গুলে শুনুন নয়তো আমি বাধ্য হবো আপনার সাথে জোর করতে।
জুঁই জেদ্দি গলায় বললো…
‘ আপনার যা করার আপনি তা করেন। আমার কিছু যায় আসে না। আর কি বাকি রেখেছেন আপনারা আমাদের সাথে করতে? আমার পরিবারের প্রতিটা সদস্য ছন্নছাড়া জীবন পার করছে। মায়া পাগল হয়ে বাড়ি ছাড়লো। আরিফ ভাই কাকীকে নিয়ে ঘর ছাড়লো। মুক্তা আপু স্বামীর সংসার ছাড়লো। কাকা অসুস্থ্য হসপিটালে আছেন। আপনাদের দয়া আমাদের সুন্দর পরিবারটা ধ্বং*স হয়ে গেলো,এতো কিছুর পর যদি আরও কিছু করা বাকি থাকে তাহলে সেটাও করে যান প্লিজ। আমরা সয়ে নিবো, আমাদের চামড়ায় সয়ে গেছে এসব কিছু।
জুঁইয়ের কথায় আয়ন জুঁইয়ের হাতটা চেপে নিজের কাছে টেনে বললো…
‘এসবের পিছনে আমাকে কেন দোষী করছেন জুঁই? আমি সত্যি বুঝতে পারিনি আমাদের অনুপস্থিতিতে আপনাদের পরিবারের এতো কিছু ঘটে যাবে?
‘ আপনাদের আর কিছু বুঝতেও হবে না। যা হওয়ার আমাদের সাথেই হয়েছে। আপনারা ভালো থাকুন। প্লিজ এবার আমাকে যেতে দিন। ভালো লাগছে না আমার। হাতটা ছাড়ুন।
আয়ন জুইয়ের হাতটা না ছেড়ে বরং আরও জোড়ালো ভাবে চেপে ধরে অসহায় গলায় বললো…
‘ আপনি কখনো আমাকে বুঝতে চান না জুঁই। আমার ভালোবাসা কখনোই আপনার চোখে পরে না। আপ…
আয়নের কথা শেষ হওয়ার আগেই জুঁই চেতে উঠে বললো…
‘ আপনার কি ভালোবাসা বুঝবো আমি? মুখে মুখে চিল্লালে বুঝি ভালোবাসা হয়? ভালোবাসার মানে বুঝি না আমি? আপনি বুঝেন ভালোবাসা কি? আজ যদি রিদ ভাইয়ের জায়গায় আপনি অসুস্থ্য থাকতেন তাহলে রিদ ভাই কখনোই নিজের বউয়ের খোঁজ না নিয়ে থাকতো না আপনার মতোন। আপনার বউ ছাড়া চলে কিন্তু রিদ ভাইয়ের বউ ছাড়া চলে না বলেই সে এতো হাঙ্গামা করতে পারে মায়াকে ঘিরে। আপনার বিয়ে করা বউও তো আমি ছিলাম। কই আমার প্রতি কি দায়িত্ব পালন করেছেন আপনি? খোঁজ নিয়ে ছিলেন আমার বিপদের সময়ে? জানতে চেয়েছিলেন কেমন আছি আমরা? দায়িত্ব কি শুধু আপনার নিজের পরিবারের প্রতিই? আমি আপনার দায়িত্বের মধ্যে পড়ি না? বিয়ে করলেই সকল দায়িত্ব শেষ? মনে করেছেন বিয়ে করে আমাকে পেয়ে গেছেন তাই না? তাহলে শুনে রাখুন। আমিও বলছি আপনার মতোন মানুষের সংসার আমি জুঁই কখনো করবো না বেঁচে থাকতে।
আয়ন জুঁইয়ের হাত ছেড়ে গালে হাত রাখতে রাখতে অসহায় গলায় বললো….
রিদ মায়ার প্রেমগাঁথা পর্ব ৬১ (২)
‘ জুঁই প্লিজ এমনটা বলবেন না। আমাকে অন্তত একটা সুযোগ দিন নিজের ভুল গুলো ঠিক করার প্লিজ।
জুঁই ছিটকে আয়নের হাতটা নিজের গাল থেকে সরিয়ে দিতে দিতে বলল…
‘ একদম আমাকে ছুঁয়ার চেষ্টা করবেন না আপনি। আমার থেকে দূরে থাকুন।
কথাটা বলেই জুঁই আয়নের হাত ছাড়িয়ে চলে যায় বাহিরের দিকে। আয়ন অপরাধী মুখে তাকিয়ে রইলো জুঁইয়ের চলে যাওয়ার দিকে। এসব টানাপোড়ার সম্পর্ক গুলো কবে ঠিক হবে আল্লাহ জানে। তবে আয়ন মনে মনে ঠিক করলো একবার জুঁইয়ের বাবার সঙ্গে দেখা করবে দুজনের বিষয়টা জানাতে।