রিদ মায়ার প্রেমগাঁথা পর্ব ৬৪

রিদ মায়ার প্রেমগাঁথা পর্ব ৬৪
রিক্তা ইসলাম মায়া

রাত একটার ঘরে। চাঁদবিহীন আকাশে জ্বলজ্বল করছে অসংখ্য তারার মেলা। পথঘাট জনমানবহীন শূন্য। থেকে থেকে দু-একটা অটোরিকশা দেখা গেল যাত্রীবিহীন চলে যেতে। ল্যাম্পপোস্টের হলুদ আলো মাড়িয়ে কিছুটা দূরে গাড়ি দাঁড় করাল আয়ন। এখানটায় বেশ অন্ধকার। আলোছায়া গাছতলায়। গাড়ির আলো নিভিয়ে দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে অদূরে তাকাল একটা দোতলা বাড়ির গেটের সম্মুখে। এই রাস্তা ধরেই জুই দ্রুত পায়ে হেঁটে আসছে আয়নের দিকে। ব্যস্ত ভঙ্গি আর ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে শরীরের ওড়নাটাও গায়ে পেঁচিয়ে মাথায় ঘোমটা টেনে মুখ ঢেকে আছে জুই। আয়ন সেদিকে নিষ্ক্রিয় চোখে তাকিয়ে রইল। তাকে এই মধ্যরাতে জুই ডেকে এনেছে জরুরি কথার তাগিদে। জুইয়ের ডাকে আয়নও চলে আসল তৎক্ষণাৎ।

বউ ডেকেছে মানে আয়নকে আসতেই হতো। তাছাড়া জুইয়ের এই মধ্যরাতে আয়নকে ডাকার যথাযথ কারণও আছে। হয়তো পরিবারের ভয়ে আয়নের সঙ্গে দিনের আলোয় দেখা করতে পারবে না বলেই নিভে যাওয়া অন্ধকারে আয়নকে ডাকল। আয়ন নিরস ভঙ্গিতে জুইয়ের গতানুগতিক দেখল। জুই ব্যস্ত পায়ে আয়নের সম্মুখে দাঁড়াতে দাঁড়াতে হাঁপাতে লাগল। বড়ো বড়ো শ্বাস ফেলে খানিকটা হাঁপিয়ে বলল…
“আপনার সাহস কী করে হলো আমার বাবাকে ফোন করার? কেন বারবার ফোন দেন আপনি?”
জুইয়ের প্রথম কথায় রাগ প্রকাশ পেল। অথচ আয়ন জুইয়ের রাগের ধার ধারল না, বরং গাড়ির দরজা খুলে ভেতর থেকে একটা পানির বোতল হাতে নিয়ে জুইয়ের দিকে বাড়িয়ে দিতে দিতে স্বাভাবিক গলায় বলল…
“আপনার বাবা আমার শ্বশুর হন জুই। আমি আমার শ্বশুরমশাইকে ফোন করতেই পারি, এতে আপনার অনুমতি প্রয়োজন মনে করছি না আমি। নিন, আপনি পানিটা খান জুই।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আয়নের কথায় জুইয়ের নাকের পাটা ফুলে উঠল রাগে। তেজি হাতে ঠাস করে আয়নের হাতের বোতলটা সরিয়ে দিতে দিতে ঘন ঘন শ্বাস ফেলে বলল….
“একদম আমার বাবার থেকে দূরে থাকবেন আপনি। যখন আমাদের বিপদের সময় আপনাকে পাইনি, তাহলে আজ কেন আদিখ্যেতা দেখাতে আসছেন? আপনাকে আমি বলেছি আমাদের সম্পর্কের কথা আমার বাবাকে জানাতে? আমি নিজেই যেখানে এই সম্পর্কটা মানি না, সেখানে আমার বাবার খোঁজ করছেন কেন আপনি?”
জুইয়ের ফিরিয়ে দেওয়া বোতলটা আয়ন পুনরায় জুইয়ের দিকে বাড়িয়ে দিতে দিতে বলল…
“আগে পানিটা পান করুন জুই। স্বস্তি পান। আমার কথাটা শুনুন। যেটা চলে গেছে, সেই পরিস্থিতি আমি অতীতে ফিরে ঠিক করতে পারব না। সেই ক্ষমতা আমার নেই। তবে সামনে যে পরিস্থিতি হবে, সেটা অবশ্যই সামলানোর দায়িত্ব আমার। আমার অবশ্যই আপনার বাবার সঙ্গে কথা বলে সবকিছু জানাতে হবে। উনাকে বোঝাতে হবে যা কিছু হয়েছে, সবটা আমাদের ভুল বোঝাবুঝি থেকে হয়েছে। এসব কিছু এবার আমাদের ঠিক করা উচিত। তাছাড়া এই বিয়ের…..

“ওই ওইখানে কে রে তোরা? কী করছিস ওইখানে?”
হক ছেড়ে ডাকা পথলোকের ডাকে জুই ধড়ফড়িয়ে চমকে উঠল। আতঙ্কে মাথা ঘুরিয়ে পাশে তাকিয়ে দেখল ওদের পাশের বাড়ির নাইব চাচা নামক লোকটা টর্চ হাতে এদিকেটায় দৌড়ে আসছে অপর হাতে লুঙ্গি চেপে। টর্চের আলো আয়ন ও জুইয়ের ওপর পড়ল। আয়ন বিরক্তিতে মুখ হাত দিয়ে আলোর রশ্মি ঠেকাতে চাইল, অথচ জুই আতঙ্কিত ভঙ্গিতে কাঁপতে শুরু করল যখন নাইব নামক লোকটা চিৎকার করে মানুষ জড়ো করতে চাইল মধ্যরাতে একত্রে দাঁড়ানো জুই আর আয়নকে আটকাতে চেয়ে। জুই আতঙ্কিত ভঙ্গিতে কী করবে হুট করে বুঝতে পারল না। বরং অতিরিক্ত ভয়ে আয়নের বগলের নিচ দিয়ে ঢুকে পড়ল গাড়ির ভেতর। আয়ন এতক্ষণ খোলা দরজা চেপে দাঁড়িয়ে ছিল জুইয়ের জন্য পানি নিয়ে। এর মধ্যে এসব ঘটনা ঘটে যাওয়ায় আয়ন নিজেও চমকে উঠে মুহূর্তে মাথা নিচু করে জুইয়ের দিকে তাকাতে জুই আতঙ্কিত ভঙ্গিতে গাড়ির দরজা টেনে লাগাতে চেয়ে আয়নকে হুঁশিয়ার করে বলল….

“কী করছেন ডাক্তার সাহেব? দাঁড়িয়ে আছেন কেন? তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠুন, গাড়ি স্টার্ট দিন, নয়তো আমরা ধরা পড়ে যাব। দ্রুত করুন প্লিজ।
জুইয়ের কথা আয়ন মানতে নারাজ। আয়নের ধারণা মতে ওরা স্বামী-স্ত্রী, সেই ক্ষেত্রে রাতে একটা নয় চারটে বাজলেও দেখা করলে সমস্যা হওয়ার কথা নয় কারও। সেজন্য আয়ন জুইকে বোঝাতে চেয়ে বলতে চাইল….
“জুই আপনি ভয় পাচ্ছেন কেন? ওরা আমাদের কিছু করবে না। আমরা স্বামী-স্ত্রী, এটা সবাইকে বুঝিয়ে ব…
আয়নকে বলতে না দিয়ে জুই অস্থির উত্তেজিত ভঙ্গিতে বলল…
“আল্লাহর ওয়াস্তে আপনি গাড়িতে উঠুন ডাক্তার সাহেব। আপনি আমার এলাকার মানুষদের চেনেন না। ওরা আপনার পরিচয় জানবে পরে, তার আগে লাঠিপেটা করবে। বলবে আমরা মধ্যরাতে কট খেয়ে মিথ্যা বলছি। প্লিজ আপনি গাড়িতে উঠুন, আমার কথা শুনুন।

আয়ন জুইয়ের কথায় কিছু বলতে গিয়েও হৈচৈ পড়া রাস্তার দিকে তাকিয়ে থেমে গেল, সত্যি সত্যি দেখল আশেপাশে বাড়ি থেকে মানুষ হৈচৈ করে লাঠি হাতে বের হচ্ছে ওদের মারতে। আয়ন আর ভাবার সময় নিল না, বরং জুইয়ের কথা মতো ঘুরে গিয়ে তৎক্ষণাৎ বসল ড্রাইভিং সিটে। পূর্ব থেকে গাড়িটি ঢাকা মহাসড়কের দিকে ঘোরানো ছিল বলে আয়ন জুইকে নিয়ে গাড়িটি সেই রাস্তায় টানল। আতঙ্কিত জুই মুখ ঘুরিয়ে বাইরের দিকে তাকাল লোকজন কতদূর আছে সেটা দেখতে। তক্ষুনি চোখাচোখি হলো নিজের বাবা সাজিদুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি নিজেও মধ্যরাতে লাঠি হাতে বের হয়েছিলেন কট খাওয়া ছেলেমেয়ে পেটাতে, কিন্তু অদূরে গাড়ির সিটে জুইকে বসে থাকতে দেখে উনার দৌড় থেমে যায়। হাতের লাঠিও মুহূর্তে পড়ে যায় রাস্তায়। তক্ষুনি শোনা গেল সাজিদুল ইসলামের সম্মুখে থাকা নাইব লোকটার চিৎকার। সাজিদুল ইসলামের সঙ্গে নাইব লোকটাও জুইকে গাড়িতে বসা দেখল কোনো ছেলের সঙ্গে। তিনি মুহূর্তে চিৎকার করে পিছনে দৌড়ে আসা লোকগুলোকে বললেন….

“আরে এইডা আমাগো সাজিদের মাইয়া ভাইগা যাইতাছে কোন পোলার লগে। তোরা কেউ গাড়িডারে ধর রে ধর।”
নাইব লোকটার চিৎকার জুইয়ের কানেও আসল। হতভম্ব, হতবুদ্ধি হয়ে বাকহারা হয়ে গেল মুহূর্তে। গাড়িতে ওঠার আগে জুই এত কিছু ভাবেনি, শুধু সবার চোখ ফাঁকি দিতে সে গাড়িতে উঠেছিল মাত্র। সবাই চলে গেলে সেও নেমে যেত, কিন্তু এখন না চাইতেও সে বদনাম হয়ে গেল। এলাকাবাসীর সামনে ওর বাবার মানসম্মানে টান দিল। প্রথমে মায়া আর এখন জুই। না চাইতেও কলঙ্কের দাগ লেগে গেল ওদের চরিত্রে। ওর বাবা কীভাবে সমাজে মুখ দেখাবে? জুই দু-হাতে মুখ চেপে আবার তাকাল গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে, দেখা গেল সাজিদুল ইসলাম রাস্তার মাঝে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন। চারদিক থেকে মানুষ দৌড় থামিয়ে সাজিদুল ইসলামকে ঘিরে দাঁড়াচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। বাবার লজ্জিত মুখটা দেখেই জুই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। আয়ন জুইকে কাঁদতে দেখে বিচলিত ভঙ্গিতে গাড়ি থামাতে চাইলে জুই মুহূর্তে বাধা দিয়ে বলল….

“গাড়ি থামাবেন না ডাক্তার সাহেব। আপনার বাড়ি চলুন প্লিজ।
আয়ন জুইয়ের কথায় বিষণ্ণ হয়ে বলল…
“আপনি আমার বাড়ি যাবেন জুই?
জুই অশ্রুসিক্ত চোখে আয়নের দিকে তাকিয়ে রইল। আয়ন জুইয়ের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বলল…
“রাতের আঁধারে পালিয়ে নয় জুই। আপনাকে আমি সসম্মানে আপনার বাবার কাছ থেকে চেয়ে আনব আমার বাড়িতে। তারপরও এভাবে পালিয়ে নয়।
আয়নের কথায় জুইয়ের ভেতরের কষ্ট বাড়ল। কান্না আটকাতে চেয়ে চোয়াল শক্ত করে বলল….
“সেই রাস্তা অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে ডাক্তার সাহেব। এখন আর সেটা সম্ভব নয়।
“আমি আপনার জন্য সবকিছু করতে পারব জুই। আপনি আমার ওপর বিশ্বাস রাখুন।
জুই একই গলায় বলল….

“আপনার আমাকে নিয়ে যেতে না চাইলে এখানে নামিয়ে দিয়ে যান। অযথা কথা ভালো লাগছে না।
জুইয়ের কথায় আয়ন কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায় জুইয়ের নীরব অশ্রুজড়া দেখে। আয়ন দীর্ঘশ্বাস ফেলল। প্রিয়সীর কান্নাটা তার বুক ব্যথার কারণ হলো, তারপরও এই মুহূর্তে আয়নের কিছু করার নেই। সে চেয়েও জুইয়ের এই কান্নাটা এই মুহূর্তে মুছতে পারবে না। তবে খুব শীঘ্রই তার প্রিয়সী হাসবে। শুধু গাড়ির পাশের সিটে নয়, বরং তার বুকেও ঠাঁই নেবে জুই।

রিদের বাড়িতে উপস্থিত খান বাড়ির সকলেই। হেনা খান, আরাফ খান লন্ডন থেকে ফিরে খান বাড়ি কিংবা চট্টগ্রামে না গিয়ে রিদের বাড়িতে উঠেছেন সুফিয়া খানের কাছে। নিহাল খানের নির্বাচনের একমাস বাকি বলে রাদিফ ঢাকাতে নেই। চট্টগ্রামেই আছে বাবার সঙ্গে। রিদ চট্টগ্রাম যায় না জেদ করে। নিহাল খানও ছেলেকে ডাকেনি রিদের অসুস্থতার কথা চিন্তা করে। তারপর দিন এভাবেই যাচ্ছে। মায়াকেও আগের থেকে বেশ সুস্থ দেখাচ্ছে। তবে সে আগের মতো কারণে অকারণে কারও সঙ্গে চঞ্চলতা দেখিয়ে কথা বলে না। আর না কারও কাছে যায়। মায়াকে সারাদিন সুফিয়া খানের পেছন পেছন ঘুরঘুর করতে দেখা যায় চুপচাপ। এর মাঝে রিদ অবশ্য বেশ কয়েকবার মায়ার পথ আটকে দাঁড়িয়ে ছিল। পরপর প্রশ্ন করেছে, কিন্তু মায়া প্রতিবারই চুপ থেকে রিদের থেকে পালিয়ে গেছে, নয়তো সুফিয়া খানের সঙ্গে থেকেছে রিদকে এড়াতে চেয়ে।

রিদ মায়ার ডাক্তারি রিপোর্টগুলো পরপর চোখ বুলিয়ে চেক করল হাতে নিয়ে। রিপোর্টে মায়ার সবকিছু আগের থেকে বেশ স্বাভাবিক দেখাচ্ছে। রিদ মায়ার মেন্টাল হেলথ ৮৭% স্বাভাবিক দেখে হাতের ফাইলটা বন্ধ করতে করতে অপর হাতের কফিতে চুমুক বসাল। খানিকটা ডিল মারার মতোন করে ফাইলটা ফেলল সোফার টেবিলে। এটা মায়ার গতকাল রিপোর্টের ফাইল ছিল যেটা সুফিয়া খানের কাছে না গিয়ে রিদের কাছে আসল। অবশ্য রিদ নিজেই বলেছিল মায়া জড়িত সকল রিপোর্ট যেন তার হাতে আসে। বিগত দু-মাসে মায়ার রিকভারি হয়েছে ৮৭% মানে মায়া প্রায় রিকভার হয়ে গেছে বলে ধরা যায়। মূলত মায়া আজকাল যেটা করছে সেটা স্বেচ্ছায় রিদকে এড়িয়ে যাচ্ছে। বিষয়টা রিদ আরও আগেই বুঝতে পেরেছিল।

শুধু মায়ার স্বাভাবিক রিপোর্টের অপেক্ষায় ছিল এতদিন, যেটা আজ রিদ পেয়েও গেল। রিদ হাতের কফিতে চুমুক দিতে দিতে কী মনে করে হাতের কফি মগটা নিয়েই বেরিয়ে গেল রুম থেকে। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতে তীক্ষ্ণ চোখে মায়ার সন্ধান করল। পেয়েও গেল হলরুমের ফ্লোরে বসে খাবার খাওয়া অবস্থায়। রিদ সেদিকে তাকিয়ে নিচে নেমে আসল। সুফিয়া খান সোফায় বসে মায়ার চুলের বেণি করছে আর মায়া মাথা ঝুঁকে পরপর চামচ নাড়িয়ে কিছু মুখে তুলছে। রিদ সেদিকে এগোতে এগোতে মায়ার বাটির দিকে লক্ষ করে দেখল মিষ্টি জাতীয় কোনো ডেজার্ট খাচ্ছে মায়া। রিদ ডেজার্ট দেখেই বুঝতে পারল তার মা বানিয়েছে এটা। বেশ ভালো খাবার বানাতে পারেন তিনি। সবসময়ের স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ হওয়ায় সুফিয়া খান ছোটবেলা থেকে রিদ ও রাদিফকে উনার হাতে বানানো খাবারই খাওয়াতেন। মায়ার ক্ষেত্রেও তাই। প্রতিবার মায়াকে তিনি নিজের হাতেই খাবার বানিয়ে দেন। রিদ সুফিয়া খানের পিছনে দাঁড়াতে দাঁড়াতে গম্ভীর গলায় বলল…

“তোমাকে উপরে ডাকছে আম্মু!
সুফিয়া খান স্বাভাবিকভাবে মায়ার চুলে রাবার বেণি পেঁচাতে পেঁচাতে রিদের দিকে তাকিয়ে বলল…
“কে ডাকছে?”
“দাদাভাই!”
আরাফ খানের নাম শুনতে সুফিয়া খান বলল….
“বাবা ঘুম থেকে উঠেছেন?”
সুফিয়া খানের কথার উত্তর না দিয়ে রিদ নিজের কথায় বলল….
“সম্ভবত দাদাভাইয়ের বুক ব্যথা করছে। ইউ শুড গো অ্যান্ড চেক হিম!
রিদের কথায় সুফিয়া খান চমকে ওঠার মতো তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়ালেন। আরাফ খানের হার্টে সমস্যা আছে। হার্ট ব্লক হয়ে যাওয়ার কারণে উনার হার্টে রিং বসানো হয়েছে সেই কবেই। এই অবস্থায় আরাফ খানের সামান্য বুক ব্যথাও ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে ভেবে সুফিয়া খান খানিকটা অস্থির গলায় বলল…

“কী বলছিস? কবে থেকে হচ্ছে বাবার এমন?
“এইমাত্র হলো!
সুফিয়া খান মায়াকে রেখে বড়ো বড়ো পা ফেললেন সিঁড়ির দিকে। মায়াও সুফিয়া খানের পেছন পেছন হাঁটতে চাইলে রিদ মায়ার বেণি টেনে ধরল। চুলে টান খেতেই মায়া ভয়ার্ত মুখ ঘুরিয়ে তাকাল রিদের দিকে। তক্ষুনি সুফিয়া খান অর্ধেক সিঁড়ি উঠেও ঘুরে তাকাল রিদের দিকে। তাড়াহুড়ো করে বলল….
“বাবু তোর জন্য ডাইনিংয়ে খাবার দেওয়া আছে। খেয়ে যাবি কেমন? না খেয়ে অফিসে যাবি না কিন্তু।
কথাগুলো বলে সুফিয়া খান দ্রুত পা ফেলে উপরে উঠে গেলেন, তাড়াহুড়োয় মায়াকে সঙ্গে নিয়ে যেতে মনে রইল না। অথচ রিদ মায়ার বেণি চেপে দাঁড়িয়ে। মায়া বাটি হাতে হাঁসফাঁস করে সুফিয়া খানের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। আবারও চুলে টান পড়ায় মায়া মুহূর্তে পিছন গেল দু-কদম। রিদ মায়ার লম্বা চুলের বেণি নিজের হাতে পেঁচাতে পেঁচাতে বলল…

“উপরে তাকিয়ে লাভ নেই ম্যাডাম? পালানোর সুযোগ বন্ধ।
মায়া চুপসে যাওয়ার মতো দু-হাতে মুঠোয় বাটি চেপে ম্লান হয়ে দাঁড়াল। রিদের কথার উত্তর করছে না আর না ঘুরে তাকাচ্ছে রিদের দিকে। রিদ মায়ার দিকে এগিয়ে আসতে গিয়েও কদম বাড়াল না দ্বিধায়। মায়াকে ছোঁয়াটা তার জন্য হালাল কিনা এই প্রশ্নের উত্তরটা না পেয়ে সে ছোঁয়াবে না এই নারীকে। রিদ বিগত দিনের মতো মায়াকে সরাসরি বিয়ে নিয়ে প্রশ্ন করল না। বরং প্রথমে মায়াকে ওর সুস্থ মস্তিষ্কতার প্রমাণ দিতে চেয়ে এলোমেলো কথা বাড়াল। মায়া বিগত দিনে নিজের অসুস্থতার দোহাই দিয়ে বরাবরই রিদের প্রশ্নগুলো এড়িয়ে গেছে। রিদও এতদিন সহ্য করেছে মায়ার অসুস্থতার কথা চিন্তা করে। কিন্তু আজ সে ছাড় দেবে না এই নারীকে। বরং রিদের সামনে মায়াকে স্বীকারোক্তি দেওয়াবে এই নারীর সবকিছু মনে আছে বলে। রিদ প্রথমে চলে যাওয়া সুফিয়া খানের দিকে আঙুল তাক করে মায়ার উদ্দেশ্যে বলল….

“মহিলাটি তোমার কী হয় জানো?”
মায়া রিদের তাক করা আঙুল অনুসরণ করে সুফিয়া খানের দিকে তাকাল। সময় নিয়ে মিনমিন করে বলল….
“আম্মু হয়!”
“তোমার আম্মু কার কাছে যাচ্ছে?”
“দাদাভাইয়ের কাছে।”
“দাদাভাইয়ের নাম কী?”
“আরাফ খান!”
“উনার বউয়ের নাম?”
“হেনা খান।”
“তোমার আম্মুর নাম কী?”
“সুফিয়া খান।”
“তাহলে আমি কে?”
“আম্মুর বড়ো ছেলে।”
“তোমার সাথে আমার সম্পর্ক কী?”

রিদের শেষ প্রশ্নে মায়া আবারও চুপ করে যায়। মায়াকে চুপ করে যেতে দেখেই রিদের চোয়াল শক্ত হয়। সবাইকে এই নারী চেনে, তার বেলায় আসলেই শব্দ ফুরিয়ে যায় এই মহিলার। চেনেও তাকে না চেনার মতো এড়িয়ে যায় কী কারণে? সে কী করেছে? বরং এই নারীই তার জীবনে অশান্তি বয়ে এনেছে। সে জীবিত থাকা অবস্থায় অন্য নাগরকে বিয়ে করে নিল। তার অসুস্থতার সুযোগ পর্যন্ত নিয়ে এখন তাকে এড়িয়ে যাচ্ছে কেন এই নারী? নতুন নাগরের সঙ্গে সংসার করবে বলে? রিদের শক্ত হওয়া চোয়ালে দাঁতে দাঁত পিষে রাগে কটমট করে তাকাল মায়ার দিকে। মায়া রিদের দিকে পিঠ দিয়ে মাথা নিচু করে তখনো দাঁড়িয়ে। রিদ শক্ত গলায় মায়াকে হুঁশিয়ার করে বলল…

“সবই চিনিস, তাহলে আমার বেলায় না চেনার নাটক করছিস কেন? আর কত চুপ থাকতে পারিস আজ আমিও দেখব। হয় তুই আজ আমার প্রশ্নের উত্তর দিবি, নয়তো মরবি।
রিদের কথায় মায়ার নত মস্তিষ্কটা আরও নত হয়ে আসল, তারপরও মুখ ফুটে টু-শব্দটিও বের করল না। রিদ প্রথমেই মায়ার সঙ্গে উগ্রতা দেখাতে চাইল না, সেজন্য সে নিজের রাগটা নিয়ন্ত্রণ করতে চাইল। কিন্তু মায়া যেন আজ চুপ থাকার শপথ করেই দাঁড়িয়ে রইল। না কথা বলছে, না রিদের প্রশ্নের উত্তর করছে। রিদ ধৈর্য ধরতে চেয়ে পুনরায় একই গলায় বলল…

“রিত আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিস না। তুই জানিস আমি বরাবরই অধৈর্য পুরুষ। মুখ খোল, উত্তর দে, কেন তুই আমাকে রেখে অন্য কাউকে বিয়েটা করলি? পরিবারের চাপে অন্য কাউকে বিয়ে করার মতো বেইমানি তুই আমার সঙ্গে করবি না। তাহলে এরপরও কী কারণ থাকতে পারে যার জন্য তুই আমাকে রেখে অন্য কাউকে কবুল বলতে হলো? কারণটা বল।
রিদের কথার পিঠে মায়াকে তখনো নত মস্তিষ্কে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মুহূর্তে রিদ অধৈর্য হয়ে রাগে ফেটে পড়ল। তৎক্ষণাৎ হাতের কফির মগটা ছুড়ে মারল ফ্লোরে। বিকট শব্দে মায়া চমকে উঠতেই রিদ মায়ার চুল টেনে নিজের কাছে আনল। মায়ার পিঠ রিদের পেটে ভারি খেতেই রিদ মায়ার বাহু টেনে দক্ষ হাত চালাল মায়ার গালে। রাগে রি রি করে বলল…

“মুখ চলে না তোর? বোবা হয়ে গেছিস? চোখে পড়ে না আমারে? প্রশ্ন করছি, কানে যায় না তোর? নাকি নাগরের সাথে হাসপাতালে ভর্তি হতে চাস, কোনটা?
রিদের হেঁচকা টানে হাতের বাটি পড়ল ফ্লোরে। ঝনঝন শব্দে মুহূর্তে কয়েক খণ্ডে বি-খণ্ডিত হয়ে গেল বাটিটি। রিদের শক্ত হাতের গাল পিষায় মায়ার গালের চামড়া লেগে গেল মাড়িতে। অসহনীয় ব্যথায় কুঁকড়ে উঠে মায়া ছটফটিয়ে উঠল রিদের হাত ছাড়াতে চেয়ে। কিন্তু রিদের শক্তিতে উঠতে না পেরে মায়া ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল, তারপরও জেদি মায়াকে রিদের কোনো প্রশ্নের কোনো উত্তর করতে দেখা গেল না। মায়াকে নিশ্চুপ দেখে রিদ একইভাবে রাগে মরিয়া হয়ে বলল….

“মুখ খোল! কথা বল রিত? কেন আমার সাথে বেইমানি করলি? বল?”
মায়ার জেদি কাণ্ডে রিদের রাগ তরতর করে বাড়ল, কমল না। সে এমনিতে রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। এজন্য সে এতদিন অসুস্থ মায়ার পাশ ঘেঁষেনি নিজের প্রশ্নের উত্তর চেয়ে। রিদ জানে যদি এই নারী তার কথার ঠিকঠাক উত্তর না করে, তাহলে সে নিজের মেজাজ হারাবে। হলোও তাই। বরাবরই এই নারী তার ধৈর্যের পরীক্ষা নেয়। সেও আজ ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়। এই নারীর সুস্থতা নিশ্চিত করে সে আজ এই নারীকে তার মুখোমুখি দাঁড় করাল। সে তার মনে দীর্ঘদিনের কিছু তিক্ত প্রশ্ন বয়ে বেড়াচ্ছে অন্তরে, যেটা এবার পরিষ্কার না করলেই নয়। রিদ একইভাবে মায়ার গাল চেপে বলল…

“উত্তর দে রিত! উত্তর দে! আমার উত্তর লাগবে। এই একটা প্রশ্ন আমাকে গোটা দু-মাস শান্তিতে ঘুমাতে দেয়নি। বল আমার অনুপস্থিতিতে অন্য কাউকে বিয়ে করলি কেন? তুই জানতি আমার তোকে ছাড়া কলিজা নড়ে না, তারপরও আমার জায়গায় অন্য কেউ কেন আসল? কেন?
অসহনীয় ব্যথায় মায়ার গাল রিদের হাতে পিষ্ট হতেই মায়ার গাল বেয়ে অশ্রু গড়াল পরপর। মায়ার স্মৃতিতেও কিছু বিষাক্ত অতীত নাড়া দিতেই মায়া দু-হাতে শক্তি লাগিয়ে রিদকে নিজের থেকে সরাতে চাইল। কিন্তু মায়া সুবিধা করতে না পেরে সুযোগ বুঝে গালে থাকা রিদের হাতটায় কামড়ে ধরল মুহূর্তে। আকস্মিক ঘটনায় রিদ হাত ঝটকালো মৃদু চেঁচিয়ে ‘উফফ’ বলে।
রিদের হাত থেকে ছাড়া পেতেই মায়া প্রাণপণে দৌড়াল সুফিয়া খানের উদ্দেশ্যে। মায়াকে পালিয়ে যেতে দেখে রিদও দৌড়াল মায়ার পেছন পেছন। কয়েক সিঁড়ি যেতেই মায়া আটকা পড়ল রিদের বাহুতে। মায়ার দু-পা শূন্যে উঠে যেতেই মায়া ভয়ার্ত চিৎকার করতে চাইল সুফিয়া খানের উদ্দেশ্যে….

“আম্মু বাঁচা….”
মায়া থামে। থামে নয়, ওকে থামতে হয় রিদের শক্ত হাতের চাপে। রিদ এক হাতে মায়ার পেট চেপে শূন্যে তুলল, অন্য হাতে মুখ চেপে। মায়া ছাড়া পাওয়ার জন্য এলোমেলো হাত-পা ছুড়াল। মায়ার পিঠ রিদের বুকে ঠেকতেই রিদ মায়াকে নিয়ে হাঁটলো বাহিরের পথে। রিদ মায়াকে নিয়ে বাহিরের পথে যেতে দেখে মায়ার মুখটা আতঙ্কে সিঁটিয়ে গেল। দ্বিগুণ ছটফটাল রিদের থেকে ছাড়া পেতে। রাগান্বিত রিদকে গাড়ির দিকে যেতে দেখেই ড্রাইভার তৎক্ষণাৎ গাড়ির পিছনের দরজা টানল, রিদ মায়াকে গাড়ির ভিতরে এক প্রকার ছুঁড়ে মারল। মায়া হুমড়ি খেয়ে গাড়ির ভিতরে পড়তে রিদ ঠাস করে গাড়ির দরজা বন্ধ করল উচ্চ শব্দে। মায়া ভয়ে দু-হাত থাপড়াল গাড়ির গ্লাসে। চিৎকার করে সবাইকে ডাকল ওকে বাঁচাতে। কিন্তু মায়ার চিৎকার গাড়ির গ্লাস ভেদ করে বাড়ির ভিতর অবধি পৌঁছাল না। রিদ ড্রাইভারকে রেখে সে নিজে ড্রাইভিং সিটের দিকে এগোতে এগোতে আসিফের উদ্দেশ্যে হাঁক ছেড়ে বলল….

“আসিফ? কাজীর ব্যবস্থা কর কুইক।”
আসিফ সবেমাত্র রিদকে দেখে দৌড়ে এদিকটা আসছিল রিদের সঙ্গে যাবে বলে। কিন্তু কাছাকাছি আসতে মায়াকে গাড়ির ভিতরে চিৎকার করতে দেখে সে থেমে যায় ভয়ে। আবারও মায়াকে আঘাত করবে কিনা সেই চিন্তা ভাবনার মাঝেই রিদের আদেশ আসল তার উদ্দেশ্যে। আসিফ রিদের পুরো কথার মানে তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারল না। হঠাৎ তার রিদ ভাইয়ের কাজী কেন লাগবে? আর সে কাজী নিয়েই বা কই যাবে? কার বাড়িতে উঠবে? রিদের প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গে আসিফ প্রশ্ন করে বলল….
“ভাই কাজী নিয়ে কই যাবো? কার বিয়েতে?”
রিদ গাড়ির দরজা টেনে ড্রাইভিং সিটে বসতে চেয়ে দাঁড়িয়ে গেল, রাগে কটমট করে তাকাল আসিফের দিকে। রিদের শক্ত দৃষ্টিতে আসিফ হাঁসফাঁস করল। বুঝতে পারল সে এই মুহূর্তে এই প্রশ্নটা করা ঠিক হয়নি। কিন্তু সে প্রশ্নটা না করলেও বা কীভাবে বুঝবে আসলে কাজী সাহেবকে নিয়ে আসিফ যাবে কার বিয়েতে? আসিফ ভয়ে ভয়ে আবারও আমতা আমতা করে বলল…

“ভাই বিয়ে কার সেটা না বললে কাজী নিয়ে কোথায় যাব আমি।
রিদ রাগে তপ্ত মেজাজে বলল….
“তোর জন্য পাত্রী দেখেছি, সেজন্য কাজী নিয়ে সোজা আমার অফিসে যাবি। আমি পৌঁছানোর আগে যেন কাজী পৌঁছে যায় মনে রাখিস।
কথা বলেই রিদ ড্রাইভারকে রেখে সে নিজে গাড়িতে বসল। দক্ষ হাতে গাড়ি চালাল চেনা গন্তব্যে। আসিফ বিস্মিত দৃষ্টিতে রিদের গাড়ির দিকে তাকিয়ে রইল। আসিফের বিয়ে মানে? রিদ ভাই এখন তাকে বিয়ে দেবে? কিন্তু কার সাথে? সে না রাফাকে পছন্দ করে? রাফার কথা স্মরণে আসতেই আসিফ উদাস হয়। মেয়েটা গিয়েছে সেই কবে। অথচ আজ এত দিন পরও রাফার সঙ্গে কথা হয়নি আসিফের। রাফার মা-বাবার সঙ্গে প্রায় কথা হয় আসিফের, কিন্তু রাফা কখনো আসিফের সঙ্গে কথা বলে না। হয়তো সবার মতো করে রাফাও আসিফের উপর মায়ার অনাকাঙ্ক্ষিত বিয়েটা নিয়ে রেগে আছে। কেন আসিফ রাফাদের বিপদে পাশে থাকেনি সেজন্য। কিন্তু আসিফ তো আর জানত না মায়া ভাবি যে সত্যিই বিপদে ছিল। কেউ তাকে এসব বিষয়ে অবগত করেনি কখনো। যদি আগের থেকে করত, তাহলে অবশ্যই আসিফ সবকিছু অপেক্ষা করে হলেও মায়া ভাবির পাশে দাঁড়াত। কিন্তু আফসোস কেউ আসিফের দিকটা দেখতে চায় না। আর না কেউ শুনতে চায় কিছু। আসিফ না ওর রিদ ভাইকে বুঝতে পারছে আর না রাফা। ভালোবাসার মানুষ দুটোই আসিফের উপর রেগে।

রিদ অফিসে পৌঁছানোর আগে সত্যি সত্যি কাজীকে উপস্থিত পেল রিদ নিজের কেবিনে। রিদ মায়ার হাত শক্ত করে চেপে কাজীর সম্মুখে সোফায় বসল। মায়া সেই তখন থেকে কান্নাকাটি করছে রিদের ভয়ে। চোখ মুখ লাল হয়ে উঠল কান্নার দাপটে। মুরুব্বি কাজী সাহেব রিদের সঙ্গে মায়াকে কাঁদতে দেখে তিনি সংকোচ বোধ করলেন বিয়ে পড়াতে। তিনি ছেলে মেয়ে দুজনকে দেখে বুঝতে পারলেন বিয়েটা আসলে এদেরই। কাজী সাহেব মায়ার দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে রিদকে বলতে চাইলেন….
“বাবা মেয়ে তো কাঁদছে।”
রিদ শক্ত গলায় উত্তর আসল তৎক্ষণাৎ। বলল….
“মেয়ে বিয়ের মেকাপ করতে কাঁদছে! আপনি বিয়ে পড়ান।

রিদের কথায় কাজী সাহেব অবাক চোখে মায়ার দিকে তাকালেন। সামান্য মেকাপ করার জন্য এই মেয়েটা এইভাবে কাঁদছে? তিনি মায়াময় গলায় আবারও রিদকে কিছু বলতে চাইলেন মায়ার হয়ে। কিন্তু রিদ তেতে উঠে বলল…
“বাল! আপনাকে প্রশ্ন করতে আনছি? বিয়ে পড়ান জলদি!
রিদের ধমকে কাজী সাহেব আর কথা বাড়ালেন না। ওইভাবে বিয়ে পড়াতে শুরু করলেন। রিদ-মায়া আর কাজী এই তিনজন ছাড়াও কক্ষে আরও চারজন সদস্য উপস্থিত রিদের অফিসের। রিদ আগের গাড়িতে চলে আসায় আসিফ তখনো এসে পৌঁছায়নি, অথচ ততক্ষণে বৃদ্ধ কাজী সাহেব বিয়ের কাগজপত্র গোছাতে চেয়ে নতুন করে কাবিননামা লিখতে চাইলেন, কিন্তু রিদ বাধা দিয়ে বলল…

“এসব নাটকের দরকার নেই। আমরা পূর্বের বিবাহিত দম্পতি। এসব কাবিননামা চুক্তিপত্র আমার কাছে আছে। আপনি শুধু আমাদের বিয়েটা শুদ্ধিকরণ করতে ধর্মীয়ভাবে পড়াবেন, এতেই চলবে।
রিদের কথায় কাজী সাহেব বিষয়টা বুঝতে পেরে হাতের কাবিননামা বইটা বন্ধ করে ধর্মীয়ভাবে বিয়ে পড়াতে শুরু করলেন। মায়াকে কবুল বলতে বললে মায়া মুখ এঁটে বসে রইল। টু-শব্দ পর্যন্ত করল না। কাজী সাহেব একবার নয়, দুবার নয়, বারবার বিয়ে পড়াতে লাগলেন। প্রতিবারই মায়াকে কবুল বলার তাগিদ দিতে দিতে তিনিও একটা সময় ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দিতে লাগলেন, অথচ মায়ার কবুল বলার বিন্দু মাত্র রেশ নেই। দীর্ঘ ত্রিশ মিনিট এইভাবেই চলল। রিদের ধৈর্যের সীমা অতিক্রম করেও সে শক্ত চোয়ালে বসে।

হিংস্র দৃষ্টিতে মায়াকে ভস্ম করার ক্ষোভে তখন থেকে তাকিয়ে। সবাই ভয় পাচ্ছে রিদকে, কখন না জানি হিংস্রতার গর্জন উঠে মায়ার উপর। কাজী সাহেব এবার নিজেও ভয়ে আছেন রিদের দৃষ্টিতে। সেই কখন থেকে হিংস্রতার দৃষ্টিতে একইভাবে তাকিয়ে মেয়েটার দিকে। মূলত কাজী সাহেব মায়াকে বাঁচাতে চেয়ে বারবার মায়াকে কবুল বলার তাগিদ দিতে লাগলেন। অথচ জেদি মায়া প্রাণ দেবে, তারপরও রিদের নামে কবুল বলবে না বলে যেন শপথ করল। রিদ হিংস্রতার রাগটা গিলতে চাইছে, সে মূলত মায়াকে আঘাত করতে চাইছে না, কিন্তু জেদি মায়ার জন্য সে নিজেও তার রাগটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।

অতিরিক্ত রাগে কখনো না জানি আঘাত করে বসে এই নারীকে। রিদ রাগে দু-হাত মুষ্টিবদ্ধ করে পিষল। ঠান্ডা হওয়ার এসির মধ্যেও রিদকে ঘামতে দেখা গেল অতিরিক্ত রাগের তোপে। মায়া তখন থেকে মুখ এঁটে ঘাপটি মেরে কেঁদেই চলেছে। না কাজীর কথা শুনতে চাইছে আর না অন্য কারও। হিংস্র রিদ তখনই ফেটে পড়ল। দু-হাতে তৎক্ষণাৎ ঘুষি বসাল সামনের সোফার টেবিলে। মুহূর্তে বিকট শব্দে ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল অসংখ্য কাঁচের টুকরো। আকস্মিক ঘটনায় সকলেই ভয়ে আতঙ্কিত হলো। মায়া চিৎকার করে ভয়ে সোফার দিকে চেপে যেতে রিদ শক্ত হাতে মায়ার বাহু টেনে গাল চেপে মুখোমুখি করে বলল….
“তোর আমার সাথে পাপে লিপ্ত হওয়ার শখ? আয় তাহলে! তোর বিয়ে করা লাগবে না। তুই হারামই থাক আমার, হালাল হতে হবে না।

রিদ মায়ার হাত টেনে দাঁড়াতে চাইলে মায়ার পা পড়ল কাঁচের টুকরোর ওপর। মুহূর্তে মায়া পা ধরে চিৎকার করে উঠল, রিদ মায়াকে রেখে বগল থাবা করে একটা চেয়ার মাথার উপর উঠিয়ে আছাড় মারতে এক লাফে কাজী সাহেব উঠে দাঁড়ালেন ভয়ে। মায়াও ভয়ে আতঙ্কে তৎক্ষণাৎ কবুল বলে উঠল বারবার। একবার নয়, দুবার নয়, কতবার মায়াকে কবুল বলতে শোনা গেল সেটি আতঙ্কিত কাজী সাহেবও হিসাব করেননি। কিন্তু মায়াকে কবুল বলতে দেখে যেন কাজী সাহেবের প্রাণে প্রাণ আসল। সে তোলপাড় রিদকে থামাতে চেয়ে উত্তেজিত ভঙ্গিতে চিৎকার করে বলল….
“বাবা মেয়ে কবুল বলেছে, কবুল বলেছে। আলহামদুলিল্লাহ! আলহামদুলিল্লাহ! তুমি থামো। তুমি থামো।”

রিদ ততক্ষণে হাতের দ্বিতীয় চেয়ারটাও ফ্লোরে উল্টে ফেলল। কাজী সাহেব ভয়ে কলিজা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে। শেষ বয়সে এসে তিনি এমন আতঙ্কিত বিয়ে পড়াতে হবে জানলে তিনি কখনোই এখানে আসতেন না। এখানে এসেও ফেঁসে গেছেন রিদ খানের লোক দেখে। সাত সকালে ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ। তারপরও তিনি রিদের মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন কবুল বলার আশায়। এতক্ষণ মেয়ে কবুল বলেনি আর এখন ছেলে কবুল বলছে না। এদের যদি বিয়ে করার ইচ্ছা না থাকে তাহলে উনাকে কেন ধরে আনল এই অসময়ে? উনি বয়স্ক অসুস্থ মানুষ। এদের জ্বালায় বারবার কলিজা শুকিয়ে যাচ্ছে ভয়ে? এবার যদি রিদ খান আর একটিও চেয়ার তোলে, তাহলে তিনি সোজা চোখ মুখ বন্ধ করে আল্লাহর নাম নিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যাবেন এখান থেকে। এখানে থাকলে তিনি এমনই আতঙ্কে মরে যাবেন। কাজী সাহেবের ভাবনার মাঝেই মায়া সোফার থেকে উঠে হঠাৎ দৌড়াতে চাইল, কিন্তু দরজা অবধি যাওয়ার আগে পুনরায় রিদের হাতে আটকা পড়ল। রিদ মায়াকে দু-হাতে আটকে তিরতির মেজাজে একত্রে তিন কবুল বলে, কাজীকে উদ্দেশ্য করে বলল….

“কবুল বলা শেষ। বিয়েও শেষ। আপনারা এখন যান।
রিদের কথায় কাজী সাহেব এক লাফে ফ্লোর থেকে নিজের খাতাপত্র উঠিয়ে দৌড়াল দরজার দিকে। এতক্ষণ জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা আসিফ ও কর্মচারীরাও কাজী সাহেবের পেছন পেছন ছুটল। রিদ মায়াকে নিয়েই হাত বাড়িয়ে দরজা লক করল। মায়া রিদের বক্ষে ছটফট করে শব্দ করে কেঁদে উঠল। এতোকিছুর পরও মায়া রিদের সঙ্গে কথা বলছে না। রিদ রাগে ক্ষোভে মায়াকে উঠিয়ে সোফার উপর ছুঁড়ে মারতে মারতে সে গায়ে শার্টে হাত দিল। রাগে একই মেজাজে বলল…

“ভদ্রতার ভাষা বুঝিস না। অভদ্রতার ভাষা ঠিকই বুঝবি তুই আমার।”
মায়া ভয়ার্ত মুখে উঠতে চাইলে রিদ মায়ার পা টেনে ধরে নিজের কাছে টানল। মায়াকে জড়িয়ে ঘনিষ্ঠ হতে চেয়ে মায়ার গায়ের ওড়না টেনে ফেলল ফ্লোরে। মায়া ছটফটিয়ে নিজেকে ছাড়াতে চাইলে রিদ মায়ার দু-হাত বাঁধল নিজের এক হাতে সোফায় চেপে। মায়ার সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে চেয়ে মায়ার গলায় মুখ গুঁজে দিতেই মায়া শব্দ করে কেঁদে উঠল হু হু করে। কিন্তু মায়ার কান্না অপেক্ষা করেই মায়াতে মগ্ন হতে চাইল রিদ। রিদের ঘনিষ্ঠতার মাঝে সে নিজেই নমনীয় হয়ে আসল। সময়ের খেয়াল রিদের ছিল না। কিন্তু রিদের কাছে বিশ মিনিটের মাথায় দরজায় ধাক্কা পড়ল আসিফের। অস্থির উত্তেজিত আসিফ আতঙ্কিত গলায় বারবার বন্ধ দরজায় ধাক্কিয়ে রিদের উদ্দেশ্যে বলতে শোনা গেল….

“ভাই আপনার বাবার উপর কারা যেন আবার হামলা করেছে। রাদিফ ভাই আহত হয়েছে। চট্টগ্রাম থেকে ফোন এসেছে আপনার জন্য। ভাই আমি কি গাড়ি বের করব? ভাই? ভাই?”
আসিফের পরপর চিৎকারে রিদের মস্তিষ্ক সজাগ হয়। সে মাথা উঠিয়ে রক্তিম চোখে তাকাল বক্ষ নিচে পিষ্ট হওয়া মায়ার দিকে। বন্ধ দু-চোখের পাতা অনবরত কাঁপছে মায়ার ঠোঁট নাড়িয়ে। মোহিত রিদ মায়াকে কম্পন অবস্থায় দেখে পুনরায় মায়াতে মগ্ন হতে চাইলে আসিফ একইভাবে দরজা ধাক্কাল রিদের কাজে ব্যাঘাত ঘটিয়ে। রিদের শান্ত হওয়া মেজাজটা পুনরায় খিঁচিয়ে গেল আসিফের উপর। এই মুহূর্তে তার আসিফকে গুলি করলে কম হবে বলে মনে হলো। রিদ মায়াকে ছেড়ে উঠে বসতে বসতে দু-হাতে মাথা চেপে ধরল।

রিদ মায়ার প্রেমগাঁথা পর্ব ৬৩

রিদের হঠাৎ করে বেশ মাথা ব্যথা অনুভব হলো। অথচ আসিফ তখনো দরজা ধাক্কাচ্ছে থামার নাম নেই। রিদকে সরে যেতে দেখেই মায়া ফ্লোর থেকে রিদের শার্ট উঠিয়ে গায়ে চাদরের মতো জড়াতে জড়াতে মুখ লুকাল সোফার কুশনে। রিদ শূন্য চোখে এক পলক মায়ার দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি ঘুরাল বন্ধ দরজার উপর। রিদের সবে জাগ্রত হওয়া ফিলিংস-এ ব্যাঘাত ঘটাতে রিদের শান্ত হওয়া মেজাজটা খিঁচিয়ে গেল রাগে। গর্জে ওঠার মতোন ভাঙা টি-টেবিলটিকে লাথি মারতে মারতে বলল….
“বালের একটা বিয়ে করছি আমি। বউ ছুঁতে গেলেই গজব আসে কোথা থেকে। বালের বাসর করব আমি ছেহ!

রিদ মায়ার প্রেমগাঁথা পর্ব ৬৫