রিদ মায়ার প্রেমগাঁথা পর্ব ৬৫
রিক্তা ইসলাম মায়া
রাত দশটা। মায়ার অবস্থান চট্টগ্রাম খান বাড়িতে। অন্ধকার ঘরের আলো নিভিয়ে বিছানায় শুয়ে মায়া। এই ঘরটা রিদের। অসময়ে মায়ার শুয়ে থাকার কারণ দুটো—এক, লং-টার্ম জার্নিতে মায়ার শরীর বেশ ক্লান্ত। দ্বিতীয়ত, সে রিদের সাথে এই বাড়িতে আসতে চায়নি, কিন্তু রিদ জোর করে নিয়ে আসায় সে জেদ দেখিয়ে একা ঘরে শুয়ে আছে। খালি বাড়িতে সার্ভেন্ট আর দলের লোকজন ছাড়া পরিবারের কেউ উপস্থিত নেই। রিদ মায়াকে খান বাড়িতে পৌঁছে তৎক্ষণাৎ চলে গিয়েছিল হসপিটালের উদ্দেশ্যে। আরাফ খান, হেনা খান ঢাকায় আছেন।
তারা নিহাল খানের উপর হওয়া হামলার কথাটা শুনেছেন। ইতিমধ্যে উনারা রওনাও হয়েছেন হয়তো, ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পৌঁছাতে আরও কিছুটা সময় লাগতে পারে তাদের। খালি বাড়িতে মায়ার খোঁজ করার মতো সার্ভেন্ট ছাড়া অন্য কেউ না থাকলেও রিদ আর সুফিয়া খান ঠিকই মায়ার খেয়াল রাখছে বারবার কল করে। দুপুরে মায়াকে নিয়ে রিদ খান বাড়িতে আসার পরপর ব্যস্ততায় সে বেরিয়ে গেলেও মায়ার জন্য সার্ভেন্ট ঠিক করে যায় যাতে অসুস্থ মায়ার খেয়াল রাখতে পারে কেউ। কিন্তু দুপুর থেকে মায়া না খেয়ে জেদ করে কক্ষে শুয়ে আছে—এই বিষয়টা সুফিয়া খানের কানেও পৌঁছাল। মায়ার অসময়ে শুয়ে থাকার মাঝেই দরজায় নক করলো কেউ। প্রথমে বিষয়টি মায়া কানে না নিলেও পর মুহূর্তে কানে এল বাড়ির সার্ভেন্ট তানির গলার স্বর শুনতে পেয়ে। সে অনবরত দরজা ধাক্কিয়ে মায়াকে ডাকতে লাগল…
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
‘ভাবিমনি, দরজাটা খোলেন। বড়ো ম্যাডাম কল দিয়েছেন, আপনার সাথে কথা বলতে চান। ভাবিমনি! ও ভাবিমনি! শুনছেন?’
কাজের মেয়ের গোছানো সুন্দর কথায় মায়া তৎক্ষণাৎ বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠল। সুফিয়া খান মায়াকে কল দিয়েছে বুঝতে পেরে তৎক্ষণাৎ দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিল। মায়াকে দেখে কাজের মেয়েটি হাতের ফোনটা এগিয়ে দিতেই মায়া সেটি স্বাভাবিকভাবে হাতে নিল। দরজা বন্ধ করে ফোনটি কানে তুলতে তুলতে ফোনের ওপাশ থেকে শোনা গেল সুফিয়া খানের গম্ভীর গলার স্বর…
‘কী হয়েছে তোমার? খাচ্ছো না কেন?
সুফিয়া খানের কথায় মায়া মিনমিন গলায় বলল…
‘আমার এখানে ভালো লাগছে না, আম্মু। আমি আপনার কাছে যাব। আমাকে এখান থেকে নিয়ে যান প্লিজ।
মায়ার কথায় যেন সুফিয়া খানের মনে কোথাও শান্তি পেল। এই প্রথম হয়তো কেউ উনার কাছে থাকার জন্য আবদার করছে। নয়তো উনার সন্তান কিংবা স্বামী—কেউ উনার সাথে থাকতে চায় না। উনার একটা মেয়ে থাকলে নিশ্চয়ই মায়ার মতো করে আবদার করে বায়না করত উনার সাথে থাকার? সুফিয়া খান দীর্ঘশ্বাস ফেলে মায়াকে বোঝাতে চেয়ে বলল…
‘অবশ্যই নিয়ে যাব, আম্মু। আপাতত তুমি দু’দিন ঐ বাড়িতে থাকো, তারপর আম্মু রাদিফকে বলব তোমায় দিয়ে যেতে, কেমন?
‘এই বাড়িতে আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে, আম্মু। সবকিছু অসহ্য লাগছে। আমি এখানে দু’দিন থাকতে পারব না। প্লিজ আমাকে এখন নিয়ে যেতে বলুন, আম্মু। আমার এখানে ভালো লাগছে না।
মায়ার ভিতরকার অস্থির ছটফট যেন ফোনের ওপাশে বসে থাকা সুফিয়া খান ঠাহর করতে পারলেন। তিনি মায়ার অস্থিরতার কারণ বুঝতে পেরে গম্ভীর গলায় বললেন…
‘আমার মনে হয় তোমার এবার রিদের মুখোমুখি হওয়া উচিত, মায়া।
সুফিয়া খানের কথায় মায়া তৎক্ষণাৎ জেদি গলায় উত্তর করে বলল…
‘আমি আপনার ছেলের মুখোমুখি হতে চাই না, আম্মু। আমার উনাকে প্রয়োজন নেই। আমি আপনার সাথেই থাকতে চাই সবসময়। আমাকে এখান থেকে নিয়ে যান প্লিজ।
‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে, দুজনের সমান অপরাধ—সেটা তুমি বিশ্বাস করো তো? সবকিছু চুপ করে সহার চেয়ে মুখ খুলে প্রতিবাদ করাটা উত্তম। তুমি চুপ করে থাকলে তোমার হয়ে কেউ এগিয়ে এসে কথা বলবে না, মায়া। ব্যক্তির নিজের লড়াই নিজেকেই করতে হয়। অন্যের আশা করাটা বোকামি। তোমার প্রতিবাদ তোমাকেই করতে হবে। তাছাড়া চুপ থেকে থাকলে কোনো কিছুর সমাধান করা যায় না, মায়া। তোমার রাগ, ক্ষোভ, অভিমান প্রকাশ করার জন্য হলেও তোমার রিদের সঙ্গে কথা বলা উচিত। প্রয়োজনে চুপ নয়, প্রতিবাদ করতে শিখো।
সুফিয়া খানের কথার ইঙ্গিত মায়া বুঝতে পারল। রিদের মুখোমুখি হওয়ার ইচ্ছা মায়ার ফুরিয়ে গেছে। যেখানে বিশ্বাস নেই, সেখানে কিসের ভালোবাসা? রিদের অনুপস্থিতিতে মায়া কী কী পরিস্থিতির শিকার হয়েছিল, সেটা রিদ একবারও শুনতে চেয়েছে ওর কাছে? নাকি মায়াকে বিশ্বাস করেছিল কোনো কিছুতে? রিদও সবার মতো করে মায়ার দিকে আঙুল তুলেছে, ভুল বুঝেছে, অপমান করেছে, আঘাত করেছে—কিনা করেছে রিদ মায়ার সঙ্গে? তাহলে মায়া কেন রিদকে সাফাই দিতে যাবে কী হয়েছে না হয়েছে তা নিয়ে? মায়াকে পাগল বানানোর পিছনে কি শুধু মায়ার পরিবার আর রিদের পরিবারই দায়ী ছিল? রিদ ছিল না? সে কতটুকু বিশ্বাস করেছিল মায়াকে? শুরু থেকে মায়া এই সম্পর্কটার জন্য পাগল ছিল। তাহলে রিদ ভাবল কীভাবে মায়া ওর স্বামীকে রেখে অন্য কাউকে বিয়ে করে নেবে? বিয়ে কি খেলাঘর?
যে আজ একজনকে বিয়ে করলাম, কাল আবার আরেকজনকে বিয়ে করে খেলবে? মায়ার যদি এতই বিয়ে করার ইচ্ছা থাকত, তাহলে মায়া শুরু থেকেই হারিয়ে যাওয়া স্বামীর খোঁজ করত না কখনো। বরং মায়া অন্য কাউকে বিয়ে করতে চায় না বলেই ও নিজের নিখোঁজ স্বামীর সন্ধান এত খোঁজাখুঁজি করে বের করেছিল। মায়ার এত ভালোবাসার স্বামীকে রেখে সে অন্য কাউকে বিয়ে করবে—এটা কীভাবে রিদের মাথায় এল? কেন কখনো মায়ার ভালোবাসা রিদের চোখে পড়ে না? এখন মায়ার সুস্থ হওয়ার পরই কেন রিদকে সাফাই দিতে যাবে আসলে মায়া সেদিন বিয়েটা করেছিল কি না এই নিয়ে? কেন বলতে যাবে সে এত কিছু? যেখানে অলরেডি মায়াকে বেইমান, প্রতারক নারী হিসেবে রিদের মেনে নেওয়া হয়ে গেছে, সেখানে মায়া পুনরায় কিসের হয়ে সাফাই দেবে?
মায়ার আত্মসম্মান নেই? মায়াকে বারবার মিথ্যা অপবাদ দেবে আর মায়া সেটা মেনে নেবে? কেন, কিসের জন্য? স্বামীকে ভালোবাসে বলে? হ্যাঁ, এটা সত্য মায়া ওর স্বামীকে ভালোবাসে, তার মানে এই না যে মায়া ভালোবাসায় অন্ধ, ওর কোনো আত্মসম্মান নেই। মায়াকে এতগুলো মিথ্যা অপবাদ দেওয়ার আগে রিদ ভেবেছিল এর বিপরীতে মায়ার কী হতে পারে? কিছুই তো ভাবেনি, তাহলে আজ কেন মায়া রিদের হয়ে ভাবতে যাবে? মায়ার বিপদে কে ছিল? রিদ ছিল সেদিন? ছিল না। সেদিন যদি সুফিয়া খান মায়াকে ওর বাড়ি থেকে নিয়ে না আসতেন, তাহলে আজও মায়াকে ঐ বাড়িতে থাকতে হতো, রিদও কখনো মায়ার খোঁজ করত না—মরে গেলেও না। সুফিয়া খান মায়াকে দয়া করে নিয়ে এসেছেন, সুস্থ করেছেন বলেই আজ রিদের এত প্রশ্নের উত্তর চায় মায়ার থেকে। আর মায়াও নির্লজ্জের মতন উত্তর দিয়ে যাবে—এটা আশা করে তারা?
মায়ার কি কোনো সেলফ-রেসপেক্ট থাকতে নেই? মায়ার পাগল হওয়ার পিছনে শুধু মায়ার পরিবার কিংবা রিদের পরিবার একা দায়ী নয়, বরং রিদ নিজেও শতভাগ দায়ী ছিল। সেদিন যদি রিদ সবার মতো করে মায়াকে ভুল না বুঝে অন্তত সত্য জানতে চাইত, তাহলে মায়া সত্যটা বলত। রিদকে কাছে পাওয়ার খুশিতে হয়তো মায়াও অসুস্থতা কাটিয়ে সুস্থ হয়ে উঠতে পারত। কিন্তু রিদ তা করেনি, বরং মায়াকে অসংখ্য অপমান, অপবাদ দিয়ে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিয়েছিল যাতে মায়া পাগল হয়ে যায়। হয়েছিলও তাই। মায়া এতসব যাতনা সহ্য করতে না পেরে অতিরিক্ত মানসিক চাপে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে পাগল হয়ে যায়। এসব কিছুর জন্য মায়া কখনো রিদকে ক্ষমা করবে না আর এসব কিছু এত সহজে ভুলে যাবে না। মনস্তাত্ত্বিক ভাবনায় মায়াকে চুপ থাকতে দেখে সুফিয়া খান গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে পুনরায় বললেন…
‘মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ দু’পিঠই তোমার দেখা উচিত, মায়া। আমার ছেলে মুখে ভেঙে ভিতরকার খবর প্রকাশ করতে পারে না বলে তার মানে এই না যে ওর নিজের একটা দিক নেই। অবশ্যই আছে। সেজন্য বলছি তোমার রিদের সঙ্গে অন্তত একবার কথা বলা উচিত। আপনজন সুযোগ চাইলে একবার নয়, বারবার সুযোগ দিতে হয়, মায়া।
‘তাহলে আপনি কেন বাবাকে একবারও সেই সুযোগটা দিলেন না, আম্মু?
মায়া সুফিয়া খানকে প্রশ্নটা করেই থমথমে মুখে হয়ে যায়। সে আসলে এই প্রশ্নটা করতে চায়নি। কিন্তু কীভাবে যেন কৌতূহলবশে মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল। তবে তক্ষুনি শোনা গেল সুফিয়া খানের শক্ত গলার উত্তর। তিনি বললেন…
‘সে আমার কাছে কখনো সুযোগ চায়নি। স্বাধীনতা চেয়েছিল। যা চেয়েছে, তাই দিয়েছি।
কথা বলতে বলতে সুফিয়া খান ঠাস করে কলটা কেটে ডিল মেরে ফেললেন সোফার উপর। চোখের মোটা ফ্রেমের চশমাটা খুলে টেবিলের উপর রাখতে রাখতে সোফায় গা এলিয়ে বসলেন। আজ অনেকটা বছর পর আবারও এই শূন্যতা উনাকে ঘিরে ধরল।
নিহালকে নিয়ে উনার এই মুহূর্তে অনুভূতি শূন্য। দীর্ঘ একটা পথ একা পাড়ি দিয়ে এসেছেন তিনি। বাকিটা পথও একা কাটাতে পারবেন। তবে আজ হঠাৎ করেই কেন যেন শূন্যতা অনুভব হচ্ছে উনার।
স্বামী, সন্তান, সংসার—সবকিছু থেকেও যেন ছন্নছাড়া একাকী জীবন পাড় করতে হচ্ছে উনাকে। এমনটা নয় যে তিনি এই একাকী জীবনের সাথে পরিচিত নন। অবশ্যই পরিচিত! আর সেটা এক-দু’দিনের নয়, বরং গোটা পনেরো বছরের এই একাকীত্বের জীবনের অভিজ্ঞতা উনার। কিন্তু হুট করে মায়াকে পেয়ে উনার একাকিত্ব জীবনটা ভুলে বসে ছিলেন প্রায়। কিন্তু আজ হঠাৎ করে রিদের মায়াকে নিয়ে ঐভাবে চলে যাওয়াতে উনার একাকিত্ব জীবনটা যেন পুনরায় মাথা নাড়া দিয়ে উঠল। মনে এল উনি আসলেই একা। উনার আবারও একা থাকতে হবে।
মায়া কান থেকে ফোনটা নামিয়ে থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে রইল। সুফিয়া খানকে প্রশ্নটা করা ঠিক হয়েছে কি না দ্বিধায় ভুগল। তবে মায়া খুব করে চায় সুফিয়া খান সবার সাথে একত্রে থাকুক। আজও উনার কথায় খান বাড়ির ছোট থেকে বড় পর্যন্ত মেনে চলেন, সম্মান করেন, ভয় পান। সুফিয়া খান দূরে থেকেও যেন এই সংসারটা আজও উনার হয়েই আছেন। মায়া প্রায় শুনেছিল দাদা-দাদিকে সুফিয়া খানকে বলতে তিনি যেন উনার সংসারে ফিরে আসেন। উনাদের ছেলে নিহালের সঙ্গে একত্রে এক ঘরে থাকতে না চাইলে দুজন আলাদা ঘরে থাকবে, তারপরও যেন তিনি খান বাড়িতে ফিরে আসেন। কিন্তু দাদা-দাদির কথায় সুফিয়া খান কখনো উত্তর করতেন না, বরং বরাবরই নীরবতা পালন করতেন। মায়ার কেন মনে হয় সুফিয়া খান উনার স্বামী নিহাল খানের অপেক্ষা করছেন আজও।
রাত বারোটা পেরিয়ে একটা। রিদ সবেমাত্র ঘরে ফিরল। অন্ধকার ঘরে প্রবেশ করতে কপাল কুঁচকে এল তার। ঘুটঘুটে অন্ধকারে কাটিয়ে সে অল্প আলোর লাইট জ্বালালো। আবছা আলোয় মায়াকে বিছানায় কুঁজো হয়ে শুয়ে থাকতে দেখে রিদ সেদিকে এগোল। মায়ার কপালে হাত রেখে শরীরের তাপমাত্রা চেক করলো। গায়ের তাপমাত্রা স্বাভাবিক দেখে সে মায়ার গায়ে ব্ল্যাঙ্কেট জড়িয়ে গায়ের শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বেড সাইড টেবিলের উপর মায়ার ওষুধগুলোতে চোখ বোলাল। হাতে নিয়ে দু-একটা ওষুধের পাতা নিয়ে চেক করে দেখল মায়া ওষুধ খেয়েছে কি না। খোলা ওষুধের প্যাকেট দেখে রিদ বুঝতে পারল মায়া মেডিসিন নিয়েই শুয়েছে। রিদ শরীরের ক্লান্তি দূর করতে লম্বা একটা শাওয়ার নিল। গায়ে কালো টি-শার্ট আর কালো ট্রাউজার প্যান্ট জড়িয়ে বের হলো। সময় নিয়ে কফি মেকারে ব্ল্যাক কফি বানাতে বানাতে পুনরায় দৃষ্টি ঘোরাল বিছানায় শুয়ে থাকা মায়ার উপর। আজ নিয়ে দ্বিতীয় রাত হবে দুজনের একত্রে একই বিছানাতে থাকা।
বিয়ে, ভালোবাসা, বৈধতা থাকার পরও দুজনের একত্রে থাকা হয়নি কখনো। রিদ এবার ঠিক করে রেখেছে যত কিছুই হোক না কেন, সে তার বউকে নিজের সাথে রাখবে সব কিছুতে। রিদ মরে গেলেও মায়াকে যাতে কেউ অবহেলা করতে না পারে সেই ব্যবস্থাও সে ইতিমধ্যে করে ফেলেছে। জীবনে মানুষ বাঁচে আর কত দিন? রিদ চায় বাকিটা জীবনে এই নারী তার পাশে থাকুক। হাতের ধোঁয়া ওঠা গরম গরম কফিতে রিদ চুমুক বসাতে বসাতে সে বারান্দার দিকে হাঁটল। বাবার নির্বাচনের বাকি আর এক মাস। এই একটা মাস রিদ ঢাকা টু চট্টগ্রাম যাওয়া-আসা করবে।
কারণ তার নিজেরও কোম্পানি আছে ঢাকায়। তার নিজের কোম্পানিতে সময় দিতে হয়। বাকি রইল ওর বাবার ওপর হামলা করার বিষয়টা তো, রিদ যতটুকু জানে জসিমের চ্যাপ্টারটা ওর মা সুফিয়া খান আরও দু’মাস আগেই শেষ করে গিয়েছিলেন, তাহলে এখন কারা ওর বাবার উপর আক্রমণ করতে পারে সেই খবর কাল সকালের মধ্যে রিদের হাতে এসে যাবে। রিদের ধারণা মতে জসিমের পরিবার এসব করবে না। কারণ জসিমের তিন ছেলের ভিতর একটা ছেলে মাত্র সুস্থ-সবল জীবিত আছে, বাকি একটা পঙ্গু হয়ে বেডে শুয়ে, অন্যটা মৃত। জসিম নিজেও মৃত, তাহলে জসিমের পরিবারের কারও সাহস হবে না রিদের পরিবারের আর কারও সঙ্গে টক্কর নেওয়ার। রিদের ধারণা, সবকিছু আড়ালে থেকে খুবই সূক্ষ্মভাবে তৃতীয় পক্ষের কেউ রিদের বাবাকে টার্গেট করছে? রিদের মনস্তাত্ত্বিক ভাবনার মাঝেই হঠাৎ পিছনে কারও উপস্থিতির টের পেল রিদ। কফিতে চুমুক বসাতে বসাতে রিদ বুঝতে পারল বন্ধ দরজার ভিতরে তার পিছনে কে দাঁড়াতে পারে। রিদ খুব শান্ত ভঙ্গিতে পিছন ঘুরে দাঁড়াল। দরজার সম্মুখে মায়ার দিকে হাত বাড়িয়ে মিহি স্বরে ডাকল…
‘ কাছে আসো!
রিদ হাত বাড়িয়ে মায়ার হাতটা ছুঁতে গেলেই মায়া পিছিয়ে গেল একদম। কপাট রাগ দেখিয়ে বলল…
‘ আমাকে ছুঁবেন না আপনি।
মায়ার কথায় রিদকে তখনও শান্ত স্বাভাবিক দেখাল।
রিদ আবছা আলোয় মায়ার রাগী মুখটার দিকে তাকিয়ে কফিতে চুমুক বসাতে বসাতে আগের মতো বলল….
‘ তাহলে কাকে ছোঁব?
‘ যাকে খুশি তাকে গিয়ে ছোন!
‘ বউ ছাড়া যাকে খুশি তাঁকে ছোঁয়া হারাম। বউকে ছোঁব বলেই একই বউকে তিন তিনবার বিয়ে করলাম। এখন নিষেধ করলেও তো হবে না জান।
রিদের হেঁয়ালি কথায় মায়ার রাগ বাড়ল। সে মূলত সুফিয়া খানের কথা মানতে রিদের মুখোমুখি হচ্ছে, নয়তো মায়ার রিদের প্রতি রাগ বিন্দুমাত্র কমেনি। মায়া রাগে নাকের পাটা ফুলিয়ে জেদি গলায় বলল…
‘ আপনি আমার কেউ নন।
রিদের একই ভাবের উত্তর এল তক্ষুনি…
‘ আমি আপনার সব।
‘ আমি আপনাকে অপছন্দ করি।
‘ কিন্তু আমি আপনাকে পছন্দ করি।
রিদের পরপর কথার উত্তরে মায়া খানিকটা চুপ হয়ে গেল। মায়া যা-ই বলছে রিদ তার বিপরীতে উত্তর করছে বলে মায়া মুখে মুখে তর্ক করতে মন চাইল না। কিন্তু সে রিদের উপর সন্তুষ্টও না। বিগত দিনে যা কিছু হয়েছে সেসব মায়া কক্ষনো ভুলবার নয়। মায়া চাইলেও ভুলতে পারবে না, আর না রিদকে ক্ষমা করতে পারবে। কিন্তু মায়া সে-সব কোথা থেকে শুরু করবে সেটা বুঝল না। রিদ তো প্রশ্ন করছে না, তাহলে মায়ার কোথা থেকে শুরু করা উচিত? তাছাড়া যখন রিদ মায়ার থেকে সবকিছু শুনতে চাইত তখন মায়া কিছুই বলেনি। আর এখন রিদ হয়তো মায়ার থেকে সবকিছু শুনতে ইচ্ছুক নাও হতে পারে। তাই মায়া স্বেচ্ছায় কিছু বলাটা কেমন যেন দৃষ্টিকটু লাগছে। মায়া দ্বিধায় দ্বিমনা করে চলে যেতে চাইলে শান্ত থাকা রিদ যেন মায়ার অস্বস্তির কারণটা বুঝতে পারল। মায়াকে থামিয়ে বলল….
‘ যেটা বলতে এসেছ সেটা শেষ করে যাও। আমি শুনছি।
রিদের কথায় ক্ষেপে উঠল মায়া। সে কি বলতে এসেছে এই লোককে? পিছন ঘুরে শক্ত গলায় বলল মায়া….
‘ আমি আপনার মতন লোককে কোনো কিছুর সাফাই দিতে আসিনি। আর না কখনো দেব। আমি শুধু আম্মুর কথা রক্ষার্থে আপনার সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। নয়তো আপনি যে অবিশ্বাসে এই সম্পর্কটা শেষ করেছিলেন, আমি সেই দৃঢ়তায় এই সম্পর্কে ফুলস্টপ লাগাতাম। সম্পর্কের নীভ বিশ্বাসের চলে আপনি কখনো আমাকে বিশ্বাস করতে পারেননি। সবসময় আমার দিকে, আমার ভালোবাসার দিকে আঙুল তুলেছেন। আমি বেঈমান, প্রতারক, আমি দুনিয়ার জঘন্যতম নারী। যে স্বামী জীবিত থাকা অবস্থায় অন্য পুরুষকে বিয়ে করে ফেলেছে। কথা শুনতে যতটা কঠিন লাগে তার থেকে কঠিন হচ্ছেন আপনি। আপনি আমার দিকে একটা আঙুল তুললে বাকি চারটা আঙুল কিন্তু আপনার দিকে উঠে আসে। আপনাকে আমি ভালোবেসে ছিলাম, আপনার খোঁজেও আমি বেরিয়েছিলাম, আপনার জন্য পাগল আমিই ছিলাম। আপনাকে না দেখে স্বামী হিসাবে আমিই মানতাম।
বলতে গেলে এই সম্পর্কে আমি শুরু থেকে শতভাগ দিয়েছিলাম। যে মেয়ে তার স্বামীকে জানে না, কখনো দেখেনি, অপরিচিত একটা মানুষকে শুধু অন্ধের মতো ভালোবেসে গেছে, সেই মেয়ে স্বামীর খোঁজ পাওয়ার পর, স্বামীকে ভালোবাসার পর, কিভাবে সে অন্য পুরুষ বিয়ে করবে এটা কেন আপনার মনে এল না? একদিকে আমার পরিবার বিয়ের জন্য চাপে ফেলে, অন্যদিকে আপনি বিয়ে করার জন্য আমাকে আঘাত করেছেন। দুদিক থেকে আমিই পাপী, আমিই দোষী। আর আপনারা হচ্ছেন মহাবিচারক। কিছু না করেও বারবার আমাকেই কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়। আর আমি আপনার বিরহে মরতে গিয়েছিলাম….
কথাটা বলতে বলতে মায়া নত মস্তিস্কে দু’হাতে মুখ চেপে ফুপিয়ে কেঁদে উঠল বিষাক্ত অতীত মনে করে। মায়ার কান্না রিদ স্থির দাঁড়িয়ে। তার হেলদোল নেই আর না জায়গা ছেড়ে এগিয়ে এল মায়াকে সান্ত্বনা দিতে। বরং রিদ সেভাবে হাতের কফি মগটা চেপে দাঁড়িয়ে রইল। মায়া খানিকটা সময় নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করতে চাইল। সে ঠিক করেছিল রিদের সামনে কক্ষনো কাঁদবে না এসব বিষয়ে। কিন্তু তারপরও কেন জানি মায়া নিজেকে আটকাতে পারছে না কান্না করা থেকে। নিস্তব্ধতা চাপিয়ে মায়া নিজের কান্না আটকাতে চেয়ে ভাঙা গলায় বলল…
‘ আপনার অ্যাক্সিডেন্টের পর আপনার পরিবারের কেউ আমার খোঁজ করেনি। এমনি অ্যাক্সিডেন্ট স্পটে আপনার জ্ঞান হারানোর পরপর আমাকেও আপনার থেকে আলাদা করে দিয়েছিল, শেষবারের জন্য দেখতে পর্যন্ত দেয়নি কেউ আমাকে। আমার কান্না, আমার চিৎকার, আমার আর্তনাদ শোনার মতন সেদিন কেউ ছিল না আমার পাশে। আপনি অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে জ্ঞান হারিয়ে ছিলেন, অথচ আমি বেঁচে থেকে হাজার বার মরেছিলাম ক্ষণে ক্ষণে। আমার আর্তনাদ কেউ শুনতে আসেনি, বরং মানুষ উপহাস করেছে আমাকে নিয়ে – আমি পাগল। আপনাকে হারিয়ে অসুস্থ ছিলাম, কিন্তু মানুষের উপহাসের পাগল উপাধি পেতে পেতে মানসিক চাপে পড়ে গেলাম! আপনার অনুপস্থিতিতে সেদিন প্রথমবারের মতন মনে হয়েছিল আমি যাদের আপন মনে করেছিলাম তাঁরা আসলে কেউ আমার ছিল না। আমার ‘আমি’ বলতে আমার স্বামী ছাড়া সকল সম্পর্কই ঠুনকো ছিল। সবাই আপনার উপস্থিতিতে আমার আপন ছিল। আপনাকে হারিয়ে পাগল প্রায়, তারপরও কারও সাহায্য আমি পাইনি অবহেলা ছাড়া।
আপনার অনুপস্থিতিতে গোটা একটা পাহাড় সমান চাপে পড়ে আমার পরিবার। আমাদের বিয়ের খবরটা জেনে আমার পরিবার তোলপাড় শুরু করে। ঘরে অশান্তি হয়। আরিফ ভাই সবাইকে আমার বিয়ের ব্যাপারটা বোঝাতে চাইলে তাঁরা আমার আর আরিফ ভাইয়ের কাছে আমাদের বিয়ের প্রমাণপত্র চায়। যা আমার আর আরিফ ভাই কারও কাছে ছিল না বলে আরিফ ভাই আসিফ ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে, কিন্তু আসিফ ভাইও জানায় আপনার পার্সোনাল কাগজপত্র উনার কাছে নেই। আমাদের বিয়ের কাবিননামা, কাজী, এমনকি আমাদের দুজনের একত্রে কোনো ছবি পর্যন্ত আমার পরিবারকে দেখাতে পারিনি বলে তাঁরা মনে করেন আমি আর আরিফ ভাই মিলে সবাইকে মিথ্যা বলছি আমার আপনার সাথে বিয়ে হয়েছে এটা বলে। তাঁরা কেউ আমাদের কথা বিশ্বাস করছিল না। এটা নিয়ে রোজ অশান্তি শুরু হয় আমাদের ঘরে। একদিকে আপনাকে হারিয়ে দিশেহারা অবস্থা আমার, অন্যদিকে সপ্তাহ পর সপ্তাহ অসুস্থ হয়ে থাকতে হতো আমাকে হসপিটালের বেডে। তারপর আবার আমাদের এলাকায় রটে গেল আমি আমার আপুর বড়োলোক ভাসুরের প্রেমে পাগল হয়ে হসপিটালের পরে থাকি।
চারপাশে আমার পাগল হওয়া বদনাম রটল। সেজন্য আমার পরিবার চাইত এই বদনামের হাত থেকে আমাকে বাঁচাতে তাঁরা দ্রুত আমাকে বিয়ে দিয়ে দেবে। নতুন জায়গা কিংবা স্বামীর সঙ্গ পেলে আমি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠব এমনটা তাদের ধারণা ছিল। কিন্তু বিয়ের জন্য আমি বা আরিফ ভাই রাজি হচ্ছিলাম না বলে আমাকে নিয়ে ঘরে আরও অশান্তি বাড়ল। আরিফ ভাই বাসায় থাকলে কেউ কিছু বলার সাহস পেত না, কিন্তু আরিফ ভাই বাসায় না থাকলে সবাই আমাকে যা-তা শোনাত। এই নিয়ে আমার ফুফিদের হাতে বেশ কয়েকবার মার খেয়েছিলাম আমি, কেন আপনাকে ভুলতে পারছি না তা নিয়ে। আপনার বিরহে দিনদিন মানসিক চাপে পড়ছিলাম, অন্যদিকে আপনার পরিবারের কারও খোঁজ পাচ্ছিলাম না যে আমাকে এসব থেকে বের করবে। আমি নিঃসঙ্গ একা হয়ে গেলাম। এরমধ্যে আরিফ ভাইকেও হঠাৎ করে ব্যবসায়িক কাজে ইন্ডিয়া যেতে হল।
ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে আমার উপর চাপ বাড়ল। আমার ফুফিরা আর কাকারা মিলে ঠিক করল আরিফ ভাই ইন্ডিয়া থেকে ফেরার আগে আগে আমাকে বিয়ে দিয়ে দেবেন। হলও তাই। আমাকে এক রাতের মধ্যে ছোট ফুফির গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হল। চেয়ারম্যান পরিবারের শুধু আমার অসুস্থতা বিষয়টা ছাড়া সবকিছু লুকানো হল। এক রাতের মধ্যে বিয়ে ঠিক করা হল। বিয়ের বাজারও করা হল সেই রাতে। পরদিন বিয়ে। আমার অবস্থা এমন ছিল যে আমি আপনার বউ হয়ে বেঁচে থাকতে না পারলে মরে যাব। তারপরও আপনার বউ হয়েই থাকব। অন্য কাউকে বিয়ে করব না। তাই সেদিন রাতে সবার ঘুমিয়ে যাওয়ার পর বাসায় যত ধরনের ওষুধ ছিল সবকিছু একত্রে করলাম। আমার ওষুধ থেকে ধরে বাবার, ফুফিদের সবার ওষুধ নিয়ে প্রায় তিনশো মতো ট্যাবলেট একত্রে খেতে গিয়ে আমার ছোট ফুফির হাতে ধরা পড়ে যাই। তিনি হৈচৈ চিৎকার করে বাসার সবাইকে একত্র করেন রাত দুটোয়। রাগে জেদে সেদিন রাতে আবারও ফুফিদের হাতে মার খেলাম।
সবসময় আমার গায়ে জ্বর থাকত। সেদিন রাতে উনাদের হাতে মার খেয়ে রক্তবমি করে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। আম্মু, জুঁই, রাফা, ছোট চাচী অনেক জোরাজুরি করে সেদিন ফুফিদের থামিয়ে আমাকে নিয়ে গ্রামের একটা হসপিটালে যায়। সাত ঘণ্টা হসপিটালে রাখার পর পরদিন সকাল এগারোটার দিকে আমাকে আবারও বাসায় আনা হয় বরযাত্রী আসার আগে। আমার আব্বু, কাকা, ফুফিরা মনে করছিল আমি বিয়ে করতে চাই না বলে বারবার নাটক করছিলাম জ্ঞান হারানোর, অথচ তাদের আঘাতে আমার ব্রেইনে চাপ পড়ে। গায়ের জ্বর বাড়ল। আমার শরীর অতিরিক্ত দুর্বল হওয়ায় বিয়ের দিন প্রায় অচেতন অবস্থায় ছিলাম। যে যা বলছিল আমি কাঠের পুতুলের মতো সেটাই করছিলাম। আর এই সবটাতে রাফা আমার পাশে ছিল বিশ্বস্ত বন্ধুর মতন। জুঁইকে ওর বাবা আর ফুফিরা আমার আশেপাশে ঘেঁষতে দিচ্ছিল না, যাতে ও আমার বিয়েতে বিঘ্ন না ঘটাতে পারে সেজন্য। কিন্তু তীব্র অসুস্থতার মাঝেও আমি আশা ছাড়িনি। ভেবেছিলাম বিয়ের আসরে নাদিম ভাইকে বলব আমি এই বিয়েতে রাজি না।
আমি বিবাহিত, এটা জেনেও আমার পরিবার জোর করে উনার সাথে আমাকে বিয়েটা দিচ্ছেন। উনি যেন চলে যান। আমার শেষ চেষ্টা এটাই হত। কিন্তু রাফা আমাকে তেমন কিছুই করতে দিল না। কারণ ও শুরু থেকে সবটা দেখেছিল। ও বুঝতে পেরেছিল আমি এমন কিছু করলে হয়তো আমার ফুফিরা আমাকে আরও আঘাত করবে সেজন্য রাফা তখন আমাকে আশ্বস্ত করে ও সবটা সামলে নেবে। আমি যেন চুপ থাকি। দুনিয়ার সবাই আমার হাত ছেড়ে দিলেও রাফা আমার সঙ্গ ছাড়বে না বলে ওয়াদা করল। সেই সময় পথহারা পথিকের মতন রাফার কথায় মেনে নিলাম আমি। আমাকে বিয়ের শাড়ি গয়না পড়ানো হলেও আমি বিয়ের কবুল বলিনি, কারণ সেই সময় আমি রাফাকে জড়িয়ে ছিলাম অসুস্থতায়। আশেপাশে অনেক মানুষ থাকলেও আমি রাফাকে ছাড়ছিলাম না আর না রাফা আমাকে ছাড়ছিল। মূলত বিয়ে পড়ানোর সময় আমার তেমন হুঁশ ছিল না, তবে আমার কানে এসেছিল কারও কবুল বলার শব্দটা। সেদিন রাফা কি করেছিল? আমার জায়গায় কে কবুল বলেছে আমি তাও জানি না।
নাদিম ভাইয়ের সাথে কার বিয়ে হয়েছিল তাও বলতে পারি না। কারণ আমি হুঁশে ফিরি বিয়ে প্রায় ঘণ্টা দেড়েক পর। আমাকে যখন নাদিম ভাইয়ের হাতে সঁপে দিচ্ছিল তখন আমার হুঁশ আসে। রাফা আমাকে আগেই সতর্ক করে রেখেছিল পরিবারের মানুষের সামনে ঝামেলা না করতে, কারণ এতগুলো মানুষের সাথে আমরা ঝামেলা করে পেরে উঠব না তাই। তাছাড়া যেহেতু সবাই জানে নাদিম ভাইয়ের সঙ্গে আমার বিয়েটা হয়েছে সেজন্য আমিও চুপ ছিলাম। কারণ আমি আর রাফা জানতাম আসলে বিয়েটা হয়নি। এবার কার সাথে বিয়ে হয়েছে সেটা রাফা জানে। আমি শুধু রাফার ভরসায় ছিলাম রাফা আমাকে এসব থেকে বাঁচাবে এই বলে। আমাদের ধারণা ছিল আমরা আমার পরিবারের থেকে দূরে গেলে সুযোগ করে নাদিম ভাইয়ের সঙ্গে এই বিষয়ে কথা বলব। উনি ভালো মানুষ, নিশ্চয়ই আমাদের কথা শুনবেন। কিন্তু পথিমধ্যে কোথা থেকে আপনি লোক নিয়ে আমাদের উপর রাস্তায় হামলা করলেন। গাড়ি ভাঙচুর করলেন। বরযাত্রী পেটালেন। নাদিম ভাইকেও মারলেন। আমাকে আঘাত করলেন।
জুঁইয়ের বাবাকে আঘাত করলেন। সবচেয়ে বেশি যেটা আমাকে হিট করেছে সেটা হল আপনি আমাকে মিথ্যা অপবাদ দিলেন। সম্পর্ক ছিন্ন করলেন। একটাবার আমার দিকটা শুনতে চাইলেন না। আমাকে বিশ্বাস করলেন না। ঝড়ের বেগে এলেন সবকিছু তছনছ করে আবার চলে গেলেন আমাকে একা রেখে। আপনার অনুপস্থিতিতে আমি তাও লড়ছিলাম, কিন্তু আপনার অবিশ্বাসে, অপবাদে মনে হল আমি মিথ্যা একটা সম্পর্কের পিছনে ছুটছি। আমার এত লড়াই, এত যুদ্ধ করা সবকিছুই এক মুহূর্তের জন্য মিথ্যা হয়ে গেল যখন আপনি আমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করলেন তখন। আমি আর নিজের মানসিক ভারসাম্য ধরে রাখতে পারিনি। আমার মনে হয়েছিল আমি শেষ। আমার সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেছে। আমি ব্যর্থ। আমার সব সম্পর্ক ব্যর্থ আমার মতন। মানুষ বলে আমি পাগল। আসলেই আমি পাগল। আমি কারও যোগ্য না। তারপর থেকে সবটা আপনার চোখের সামনে।
সবার অবহেলা মেনে নিয়েছিলাম আপনার ফেরার আশায় ছিলাম, কিন্তু আপনি ফিরেও যখন সবার মতন করে একই আচরণ করলেন সেটা আর সহ্য হয়নি আমার। আমাকে মানসিক রোগী থেকে পুরো পাগল আপনি বানিয়েছেন। সেদিন যদি আপনার মা আমাকে নিয়ে না যেত তাহলে হয়তো আজও আপনি আমাকে অবিশ্বাস করে মুখ ফিরিয়ে রাখতেন। আপনার অবহেলায় আজ আমার মনেও আপনার জন্য তীব্র অনিহা জন্ম নিয়েছে। আমার আপনাকে ছাড়াও চলবে। পাগল থেকে যখন সুস্থ হতে পেরেছি তাহলে বাকিটা জীবনও আমার আপনাকে ছাড়া চলবে। আপনার ঠুনকো লোক দেখানো ভালোবাসার আমার আর প্রয়োজন নেই। আপনার মতন স্বার্থপর মানুষ আমার জীবনে না হলেও চলবে।
মায়ার দীর্ঘ কথায় রিদ টু শব্দটি পর্যন্ত করল না। মায়া আবছা আলোয় অশ্রুসিক্ত চোখ তুলে তাকাল রিদের দিকে। আলোর বিপরীতমুখী হওয়ায় মায়া বুঝল না রিদের মনোভাব। মায়া লাস্ট কথাগুলো বেশ শক্ত আর ধারালো শোনাল। রিদের শক্ত হয়ে থাকা চোয়ালে ঠাহর করতে না পেরে মায়া পুনরায় একই ভাবে বলল….
‘ মানুষ বিশ্বাসে ভালোবাসার ঘর বানায়। আমাদের সম্পর্কে বিশ্বাস শব্দটা অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। খালি ঘরটার কোনো মূল্য নেই আমার কাছে। আপনার মাও তো অবিশ্বাসের ঘর না বেঁধে একা জীবন পার করছেন। আমি পারব উনার মতন করে একা থাকতে। আপনি আমাকে ছেড়ে দি….
মায়ার বাকি কথা শেষ করার আগেই রিদের দীর্ঘ সময়ের নীরবতা ভাঙল। মুহূর্তের মাঝে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল রিদের হাতের কফির মগটা ফ্লোরে পড়ে। মায়া ভয়ে দু-কদম পিছিয়ে যেতেই রিদ হুঙ্কার ছাড়ার মতন গর্জে উঠে বলল….
‘ সামনে থেকে যা রিত।
রিদের কথায় মায়াও তেজ দেখিয়ে বলল….
‘ যাবই তো। আপনার মতন লোকের সামনে থাকার কোনো ইচ্ছা নেই আমার। আমি কালই আম্মুর কাছে ঢাকা চলে যাব।
মায়া তেজ দেখিয়ে হনহন করে রুমে চলে যেতেই তীব্র ভাঙচুরের শব্দ হল বারান্দায়। রিদের তোলপাড়ে মায়াও ভয় পেল। এগিয়ে গিয়ে রিদের কাছে না গিয়ে জেদ দেখিয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়। দীর্ঘ মনোমালিন্যে মায়া আবারও ফুপিয়ে কেঁদে উঠল। একটা সময় রিদের ভাঙচুরের শব্দ থেমে গেল। পরিবেশ শীতল হল। অন্ধকার ঘরে মায়ার নাক টানার শব্দ ছাড়া অন্য কোনো শব্দ হল না। মায়া বুঝতে পারল রিদ মায়ার শেষ কথাগুলো শুনে হয়তো ক্ষেপে গেছে। রিদ আগেই মায়াকে সাবধান করেছিল ছাড়াছাড়ি শব্দটা যেন মায়া কখনো রিদের সামনে উচ্চারণ না করে, অথচ মায়া রাগে বশে রিদকে বারবার ছাড়াছাড়ির হুমকি পর্যন্ত দিয়ে এল। বেশ করেছে মায়া ছাড়াছাড়ির কথা বলেছে। এই লোক এটারই প্রাপ্য।
মায়া এই লোকের সঙ্গে কখনো সংসার বাঁধবে না। কাল কেউ মায়াকে নিয়ে না গেলে মায়া একাই চলে যাবে ঢাকা, তারপরও এই লোকের সঙ্গে এক ঘরে থাকবে না। মায়া দীর্ঘ ফুঁপানিতে ঘুম ধরছে না। ভিতরকার কষ্ট যেন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে অভিমানে। এর মধ্যে হঠাৎ এসে রিদ ধুপ করে শুয়ে পড়ল বিছানায়, এতে মায়ার শরীর ঝাঁকিয়ে উঠল বিছানার কম্পনে। মায়া রিদকে এড়াতে চেয়ে আরও চেপে গেল বিছানার পাশে। শরীর বটে কুঁজো হয়ে যেতেই হঠাৎ রিদ ঝটকা মেরে টানল মায়াকে। মায়ার পিঠ রিদের বুকের ঠেকে যেতেই তীব্র থেকে তীব্রতর ছটফট করল মায়া রিদকে ছাড়াতে চেয়ে। অস্পষ্ট স্বরে কাঁদতে কাঁদতে মায়া আওড়াল….
রিদ মায়ার প্রেমগাঁথা পর্ব ৬৪
‘ অসভ্য লোক, ছাড়ুন আমাকে। ছুঁবেন না আপনি আমাকে। আমি থাকব না আপনার সাথে। ছাড়ুন।
রিদ পিছন থেকে মায়াকে দু’হাতে ঝাপটে জড়িয়ে মায়ার দু’পা বাঁধল নিজের পায়ে। মায়ার মাথায় গাল চেপে স্পষ্ট স্বরে আওড়াল….
‘ দীর্ঘ দিনের নির্ঘুম আমি বউ। আমাকে একটু ঘুমাতে দে। তোর বিরহে পাগল আমিও হয়েছি। তোর অসুখ আমাকেও ছুঁয়েছে। ভিতরটা পুড়ে ছারখার হয়েছে। এবার একটু শান্তি দে।