রিদ মায়ার প্রেমগাঁথা পর্ব ৭১

রিদ মায়ার প্রেমগাঁথা পর্ব ৭১
রিক্তা ইসলাম মায়া

‘ আই লাভ ইউ জান।
মায়া তখনও কাঁপছে। রিদের উষ্ণ নিশ্বাস গলায় অনুভব হতে মায়ার অদ্ভুত শিহরণ জন্মাল সর্বাঙ্গে। কম্পিত মায়া এক হাতে রিদের বুকে ধাক্কা দিতে চাইলে রিদ আরও ঘনিষ্ঠতা বাড়ায়। মায়ার বাধা দেওয়া হাতটা চেপে রিদ মাথা তুলে তাকায় মায়ার বন্ধ দু’চোখের পাতায়। নিস্তব্ধ রুমজুড়ে শুধু ঘড়ির টিকটিক শব্দ ভেসে বেড়াচ্ছে দুজনের উষ্ণ নিশ্বাসের শব্দ। কম্পিত মায়ার বুক ধড়ফড় করলো। রিদের উষ্ণ নিশ্বাস মুখের উপর অনুভব করে চোখ মেলে তাকাতে মুহূর্তে দৃষ্টি মিললো রিদের অদ্ভুত দৃষ্টিতে। ঘায়েল মায়া আরও ঘায়েল হলো। রিদের দৃষ্টিতে আড়ষ্ট হয়ে লজ্জায় নত মস্তিস্কের হতে চাইলে তৎক্ষণাৎ অধরে অধর মিললো।

রিদ মায়ার অধরে মগ্ন হতে মায়া ভাসা ভাসা চোখে তাকালো, রিদের ভালোবাসার আকুতি বুঝতে চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে নিলো রিদের শার্ট মুঠোয় পিষে। অন্ধকার ঘরে সময়ের খেয়াল কারও নেই। তবে অন্ধকার ঘরের ঘোর বাড়িয়ে রিদ মায়ার শাড়ি ভেদ করে উন্মুক্ত কোমরে বাঁধলো নিজের শক্ত দু’হাতে। মায়াতে মগ্ন রিদের ঘোর কাটিয়ে ফের দরজায় নক করল কেউ। পরপর শব্দে রিদ বিরক্ত ভঙ্গিতে মায়ার ঠোঁট ছেড়ে কপালে কপাল ঠেকালো। দুজনের উষ্ণ নিশ্বাস একে অপরের মুখে আছড়ে পড়ার মাঝে আবারও শোনা গেলো দরজার অপর পাশের শশীর গলা। রিদকে ডেকে বলল…

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘রিদ ভাই দরজাটা খোলো। তোমাকে নিচে যেতে বলেছে নানাভাই। রিদ ভাই? শুনছো?
রিদ বিরক্তিতে অতিষ্ঠ হয়ে মায়াকে ছেড়ে দাঁড়ালো। এবার বেশি বেশি হচ্ছে ব্যাপারটা। রিদের চট্টগ্রামে আসার পর থেকে পার্সোনাল স্পেস পাচ্ছে না। যেখানে কেউ রিদের সঙ্গে কথা বলতে সম্মতি প্রয়োজন হয় সেখানে যখন তখন তার ব্যক্তিগত মুহূর্তে হস্তক্ষেপ করছে। যেটা রিদ মোটেও পছন্দ করে না। এই রাতে অন্তত রিদকে ডিস্টার্ব করাটা মোটেও পছন্দ হয়নি তার। রিদ তপ্ত মেজাজে বন্ধ দরজার দিকে এক পলক তাকিয়ে মায়ার দিকে দৃষ্টি ঘুরাতে খানিকটা শান্ত হয়ে আসলো মায়াকে তখনো কম্পিত শরীরে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে নত মস্তিস্কের ঘনঘন শ্বাস ফেলতে দেখে। বিরক্ত রিদ কপালের একপাশ চুলকে মায়াকে শান্ত গলায় বললো…
‘বিছানায় যাও। আমি আসছি।

রিদের কথাটা অল্প কিন্তু মায়ার কাছে ভয়ংকর শোনালো। বিছানায় যাও মানে? মায়ার শরীরের কম্পন তীব্র থেকে তীব্র হলো রিদের কথায়। রিদ দরজা খুলে বাহিরে যেতে মায়া রিদের গমন পথের দিকে চোখ তুলে এক পলক তাকিয়ে দৃষ্টি ঘুরাল খালি বিছানায়। মুহূর্তে শরীরের অদ্ভুত শিহরণে আছড়ে সিটিয়ে গেলো দেয়ালের সঙ্গে। ভয়ার্ত মায়া হঠাৎ করে ভীষণ তৃষ্ণা অনুভব করলো। গলা শুকিয়ে আসতে পানির খোঁজ করলো। তৃষ্ণার্ত মায়া আবছা আলোয় সোফার দিকে এগিয়ে গেলো। ট্রে-তে রাখা খাবারের সঙ্গে পানির জগ হতে পানি ঢেলে পান করতে করতে ভাবলো রিদ ফিরে আসার আগেই মায়া ঘুমিয়ে যাবে। ভয়ার্ত মায়ার ভাবনা অনুযায়ী তাই করলো। বিছানার পাশ ঘেঁষে শুয়ে শরীর কুঁজো করে। ঘুমের ভান ধরতে রিদ দরজার বাইরে দেখলো শশীকে অস্বস্তিতে দাঁড়িয়ে থাকতে। রিদের উপচে পড়া বিরক্তি বাড়লো শশীকে দেখে। তপ্ত মেজাজে বলল…

‘ কী সমস্যা? কী চাই?
‘ তোমাকে কখন থেকে ডাকছি শুনছো না কেন? রুমে এতক্ষণ কী করছিলে?
রিদকে করা শশীর অযাচিত প্রশ্নটা রিদের বাড়াবাড়ি মনে হলো। রিদের মেজাজ এমনই চটে ছিলো এর মাঝে শশীর রিদের কাছে কৈফিয়ত চাওয়ার মতন প্রশ্নটা করতে রিদ ক্ষেপে গিয়ে বললো…
‘ আমি রুমে কী করছিলাম সেই কৈফিয়ত তোকে দিতে হবে? আমি আমার রুমে কতক্ষণ থাকবো, না থাকবো সেটা নিশ্চয়ই তুই ঠিক করে দিবি না আমাকে?
রিদের শক্ত গলায় শশী মিনমিন করে বললো…
‘না মানে আমি অনেকক্ষণ যাবত তোমার দরজায় নক করছিলাম। তুমি খুলছিলে না তাই…
শশীকে শেষ করতে না দিয়ে রিদ একই তেজে বললো…
‘তোকে আমি বলছিলাম আমার দরজা নক করতে? কী বলতে এসেছিস সেটা বলে বিদায় হ।
রিদের শক্ত গলায় শশী বলল…
‘নিচে পুলিশ এসেছে। তোমাকে নিচে যেতে বলেছে নানাভাই।
‘তুই যা।

শশী তৎক্ষণাৎ চলে যায় না। ওর চোখ ভেজা নোনা জলে। বারবার আড়চোখে বন্ধ দরজার দিকে তাকাচ্ছে। হয়তো শশী বুঝতে পারছে রিদ এতক্ষণ যাবত মায়ার সঙ্গে বন্ধ দরজার ভিতরে সময় কাটাচ্ছিল। শশীর ডাকে রিদ বিরক্ত হয়েছে। শশী জানে স্বামী-স্ত্রীর ব্যাপারে প্রশ্ন করতে নেই তৃতীয় পক্ষ হয়ে। রিদ-মায়ার সম্পর্কে শশী এখন তৃতীয় পক্ষ এটা জেনেও শশীর মন মানতে নারাজ। মায়ার আগে রিদের জীবনে শশী প্রথমে এসেছিলো। আজ মায়া না থাকলে হয়তো রিদের ভবিষ্যৎ নারী শশীই হতো। শশী ফের রিদকে একটা অযাচিত প্রশ্ন করে বললো..
‘মায়া তোমার রুমে?
শশীর কথাটা শুনতেই রিদের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠে, রাগে দাঁতে দাঁত পিষে তৎক্ষণাৎ বললো…
‘আউট।
ভেতরকার কষ্টে শশী ভাঙা গলায় আকুতি স্বরে ডাকতে চাইল রিদকে…
‘রিদ ভা..
রিদ ফের একই ভঙ্গিতে শশীকে থামিয়ে চিবিয়ে বলল…
‘তোকে যেতে বলছি আমি। আউট।

ঠোঁট কামড়ে নিজেকে সংযত করে রিদের সম্মুখ থেকে দৌড়ে পালালো শশী। শশীকে দৌড়ে চলে যেতে দেখলো সিঁড়ি বেয়ে ওঠা রাদিফও। সে তৎক্ষণাৎ কিছুই বুঝলো না। তবে সামনে থেকে রিদকে রাগান্বিত ভঙ্গিতে হেঁটে আসতে দেখে ব্যাপারটা আংশিক বুঝতে পারলো রাদিফ। রাদিফের শশীর জন্য মায়া হলেও তার কিছু করার ছিলো না। জীবনে সবকিছু স্যাক্রিফাইস করে ভালো থাকা যায় কিন্তু ভালোবাসা স্যাক্রিফাইস করে জীবনে ভালো থাকা যায় না। আর রিদ খানের মতো শক্ত পার্সোনালিটির মানুষ কখনো নিজের ভালোবাসা স্যাক্রিফাইস করবে না বরং না পেলে ছিনিয়ে নিবে তারপরও ছেড়ে দিবে না। তাই এক্ষেত্রে শশীর রিদের আশা ছেড়ে যত দ্রুত বাস্তবতা মেনে নিবে তত শশীর জন্যই ভালো হবে। তবে রাদিফের মনে হলো সে একবার শশীর সঙ্গে এই ব্যাপারে কথা বলবে। আজ না-হয় কাল অবশ্যই। রাদিফ সিঁড়ির গোঁড়ায় দাঁড়িয়ে পড়তে রিদ সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে রাদিফ রিদের পিছন পিছন যেতে যেতে বললো…

‘ ভাই পুলিশ কমিশনার এসেছে তোমার সঙ্গে দেখা করতে। ব্যাপারটা সিরিয়াস কিছু না হলে আমরা তোমায় ডাকতাম না।
রাদিফের কথায় রিদকে শুধু গম্ভীর দেখাল। নির্বাচনের সম্মুখে রেখে বাসায় বসে থাকা যায় না সেটা রিদ নিজেও জানে। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনও পিছনে ফেলা যায় না, দুটো সামলিয়ে চলতে হয়। রিদ সময় নিয়ে গম্ভীর মুখে পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে কথা বলল। নির্বাচন নিয়ে তেমন কোনো জটিলতা নেই আবার নিশ্চিন্তেও থাকা যাচ্ছে না। প্রতিবছরের মতো এবার নিহাল খানের প্রতিদ্বন্দ্বী জসিম নেই। বাকিরা যারা আসনে আছেন সবার একত্রে ভোটের চেয়েও নিহাল খানের একপাক্ষিক বিপুল ভোটে জয়লাভ করবে এমনটা সবাই আশাবাদী। এতকাল নির্বাচনে নিহাল খান যে হারে জয়লাভ করেছেন এবছরও তাই করবেন। কিন্তু এর মাঝে জটিলতার বিষয়টি হচ্ছে জসিম জীবিত নেই তাহলে নিহাল খানের উপর সেদিন কে আক্রমণ করেছিল সেটি শনাক্তকরণের জন্য রিদ কাজ দিয়েছিল পুলিশ কমিশনারকে। সেই খবর নিয়েই মাঝরাতে হাজির হন কমিশনার সাহেব।

সেদিনের রাদিফ ও নিহাল খানের উপর হওয়া হামলার পিছনে আসামি তথ্য জানতে রিদের কপাল কুঁচকে আসে খানিকটা অবিশ্বাসে। তারপরও কোনো রূপ প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে বরং আসিফকে দিয়ে কমিশনারকে বিদায় জানিয়ে রিদ তার ঘরে ফিরল। অন্ধকার ঘরে মায়ার কথা স্মরণে আসতে রিদ বিছানার দিকে তাকাল। মায়াকে কুঁজো হয়ে শুয়ে থাকতে দেখে রিদের বিরক্তি আরও বাড়ল। অসময়ে যে মায়া ঘুমিয়ে পড়েছে রিদ ব্যাপারটা বুঝতে পেরে শব্দ করে দরজা লাগাল। দরজার হঠাৎ শব্দে জাগ্রত মায়া খানিকটা নড়ে উঠতে সেটা রিদের চোখে পড়ল। রিদ হু হ্যাঁ আর কোনো শব্দ না করে গিয়ে বিছানায় শুয়ে চোখের উপর হাত ঠেকিয়ে। নিস্তব্ধ ঘরে জুড়ে ভয়ংকর নীরবতা ছেয়ে যেতেই মায়া চোখ মেলে তাকাল রিদের সাড়াশব্দ না পেয়ে। সেকেন্ডের কাঁটা মিনিট পেরিয়ে ঘন্টায় চলে যেতে মায়া মাথা তুলে তাকাল পিছনে। রিদকে চিত হয়ে চোখের উপর হাত ঠেকিয়ে অপর হাতটা বুকে রেখে পায়ের উপর পা তুলে শুয়ে থাকতে দেখে মায়া ভাবল রিদ ঘুমিয়ে পড়েছে। রিদ রুমে এসেছে প্রায় ঘন্টা পেরোতে চলল। এতোটা সময় নিশ্চয়ই রিদ জেগে থাকবে না? জড়তার মায়া সহজ ভাবেই রিদের দিকে এগিয়ে গেল। ঘুমন্ত রিদের বুকে রাখা হাতটা ছুঁতে মুহূর্তে রিদ মায়ার দিকে পিঠ বেঁকে শুয়ে পড়ল।

রিদের হঠাৎ কাজে মায়া থমকে বসল। রিদ ঘুমন্ত অবস্থায় মায়ার দিকে পিঠ মুড়ে শুয়েছে নাকি জাগ্রত অবস্থায় সেটা মায়া তখনও বুঝল না। হাঁসফাঁস করা মায়া কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে ফের রিদের বাহু টেনে নিজের দিকে ঘুরতে চাইলে রিদ মায়ার হাতটা ঝাঁকিয়ে ফেলে দিতে মায়া বুঝতে পারল রিদ জাগ্রত। শুধু জাগ্রত নয় বরং মায়ার সঙ্গে রাগ করে শুয়ে। কিন্তু কেন? মায়া তখন রিদের কথা শুনে অপেক্ষা না করে ঘুমিয়ে পড়েছে বলে সেজন্য? কিন্তু মায়াতো ঘুমায়নি? বরং ঘুমের ভান করেছিল ভয়ে। মায়া জানে ব্যাপারটা এবার বেশি বেশি হচ্ছে কিন্তু মায়া বিষয়টা সহজ ভাবে নিতে পারছে না। ভয় লাগছে ভীষণ। জড়তার মায়া ফের রিদের বাহু টানতে রিদ একই কাজ করল মায়ার হাতটা ঝাঁকিয়ে ফেলে দিতে মায়া রিদের পিঠ ঘেঁষে শুয়ে পেট জড়িয়ে। রিদের পিঠে মুখ গুঁজে গুনগুনিয়ে বলল…

‘ আমি ঘুমাইনি তো। এই যে দেখুন জেগে আছি।
রিদের পেটের উপর মায়ার হাতটা রিদ ঝটকায় ফেলে দিয়ে খানিকটা এগিয়ে শুতে শুতে বললো…
‘ নট ইন্টারেস্টেড। গেট আউট।
রিদের কথায় মায়া বেশ অপমানিত বোধ করলো। নীরবে চোখ ভিজল নোনা জলে। মায়া ফের রিদের শরীর ঘেঁষে একই ভাবে রিদের পেট জড়িয়ে ধরতে ধরতে বললো…
‘ আই অ্যাম ইন্টারেস্টেড। আমি এভাবেই শুবো।
রিদের সাড়াশব্দ পাওয়া গেলো না আর। কয়েক সেকেন্ড পেরোতে মায়া মাথা তুলে রিদের কানে মুখ ঠেকিয়ে ফিসফিস করে বলল…
‘ সরি। আর হবে না এমন। এবার থেকে আপনার সব কথা শুনবো সত্যি বলছি।
রিদকে তখনো জেদ দেখিয়ে শুয়ে থাকতে দেখে মায়া রিদের পিছনে হতে সামনে আসলো রিদের উপর ডিঙিয়ে। রিদের বুকে নিজের জায়গা করে দু’হাতে রিদকে জড়িয়ে ধরতে রিদ তপ্ত মেজাজে বললো….
‘ কী সমস্যা তোমার? ঘেঁষাঘেঁষি করছো কেন? দূরে যাও। ঘুমাবো আমি।
মায়া মাথা তুলে টুপ করে রিদের গালে চুমু খেয়ে পুনরায় রিদের গলায় মুখ ডুবাতে ডুবাতে বলল…
‘ওকে ঘুমান, গুড নাইট।

কথাটা বলেই মায়া রিদকে দু’হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করতে রিদের ফুসফুসের তপ্ত নিশ্বাসের শব্দ কানে আসলো মায়ার। হয়তো মায়ার কথাটা পছন্দ হয়নি রিদের। তারপরও মায়া আর প্রতিক্রিয়া দেখাল না। বরং রিদকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে যেতে চাইল। সময় নিয়ে ঘড়ির কাঁটা ঘুরতে রিদের হাত নেমে আসল মায়ার পিঠে। মায়ার চোখ সবে ঘুমে বুজে এসেছিলো কিন্তু রিদের বেগতিক হাতের স্পর্শে তড়াক করে তাকাতে মায়া কিছু বলবে তার আগেই রিদের দক্ষ হাত ততক্ষণে মায়ার শাড়ির আঁচল টেনে ফ্লোরে ফেলতে ফেলতে রিদ বিরক্তি গলায় বললো…
‘কী পড়েছো তুমি? কাপড়ে বাজে স্মেল আসছে কেনো? জানো না আমার বাজে স্মেল সহ্য হয়না।
মায়ার ঘুমিয়ে যাওয়া মস্তিষ্ক সজাগ হলো। শরীরের কম্পন দেখা দিলো তক্ষুনি। কম্পিত মায়ার মুখ রিদের গলায় ঠেকে যেতেই ভয়ার্ত গলায় বলতে চাইল…
‘আমার ভয়…
রিদ মায়াকে জড়িয়ে উপরে উঠতে মায়ার গলায় মুখ ডুবাতে ডুবাতে বললো…
‘বাজে কথা বললে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিবো রিত।
মায়া গোঙাল। ছটফট করার মতন রিদের বক্ষে সিঁটিয়ে যেতে রিদ ঘনিষ্ঠ মুহূর্তে মায়ার কানে ফিসফিস করে বলল…
‘আমার অসুখের সুখ তুমি। আমার বসন্তের ফুল তুমি। আমার বেপরোয়া জীবনের চাওয়া তুমি, আমার রাজ্যের রানী তুমি। তোমাতে পূর্ণ আমি।

একটা সুন্দর সকালের সূচনা। রিদ ফোনটোন বন্ধ করে উপুড় হয়ে ঘুমিয়ে। রুমে জুড়ে অন্ধকারের বিচরণ। সকালের মিষ্টি আলো মোটা পর্দা ভেদ করে ঘরে ঢুকতে অক্ষম। সকাল তখন নয়টার ঘরে। রিদ এতো বেলা করে ঘুমায় না। রাতে অসময়ে ঘুমের জন্য আজ এতো বেলা অবধি তার ঘুমানোর কারণ। ঘুমন্ত রিদের হঠাৎ ঘুমের রেশ হালকা হয়ে আসতে বিছানা হাতড়িয়ে মায়ার সন্ধান করল। আশপাশের কোথাও মায়াকে না পেয়ে বন্ধ চোখে কপাল কুঁচকাল বিরক্তিতে। রিদ কতবার বলেছে বেয়াদব বউটাকে তাকে ঘুমন্ত অবস্থায় রেখে যেন কোথাও না যায়। বেয়াদব নারী কথাটা শুনলে তো?

রিদ বিরক্তি নিয়ে উঠে বসল। খালি গা স্যাঁতস্যাঁতে ভেজা দেখে আরও বিরক্ত হলো। এই গরমের জন্য তার ঘুমটা ভেঙেছে। রিদ বিরক্ত চোখে রুমের এসির দিকে তাকাতে দেখল সেটা অফ। রিদের রুমের এসি সচরাচর কখনো বন্ধ থাকে না। তাহলে এখন এসি বন্ধের কারণটা খুঁজতে গিয়ে রিদের মনে পড়ল শেষ রাতে গোসলের পর মায়ার শরীরের তীব্র কম্পন ধরে ছিল ঠান্ডায় যার কারণে রিদ নিজেই এসি অফ করে দিয়েছিল। মায়ার কথা স্মরণে আসতে রিদ খানিকটা চিন্তিত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল। শেষ রাতে মায়াকে বেশ দুর্বল আর অসুস্থ দেখাচ্ছিল এখন কেমন আছে সেটা জানতে চেয়ে রিদ ঘর ছেড়ে বাহিরে যেতে চেয়েও গেল না।

এখন বের হলে সে আর রুমে ফেরার সময় পাবে না ব্যস্ততায়। তাই রিদ সময় নিয়ে ফ্রেশ হয়ে গায়ে সাদা পাঞ্জাবি জড়াল। সে চট্টগ্রামে থাকাকালীন এসব সাদা পাঞ্জাবি পরে রাজনৈতিক স্বচ্ছলতা বজায় রাখে কিন্তু ঢাকা ফিরে সে এসব পরে না। রিদ গায়ে পাঞ্জাবি জড়িয়ে আয়নার সম্মুখে দাঁড়িয়ে নিজেকে পরিপাটি করতে চোখে পড়ল গলার কিছু অবাঞ্ছিত দাগ। এসব দাগ তার শরীরেও আছে। কিন্তু রিদের শরীর কাপড় ঢাকা হলেও গলা উন্মুক্ত। রিদ ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার খুলে ফার্স্ট এইড বক্স নিল। সেখান হতে ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ গলার দুই-তিন জায়গায় লাগিয়ে কভার করতে চোখে পড়ল গালের ডানপাশের একটা দাগ। এসব বিষয়ে যদিও রিদের লজ্জা-শরম কম। কিন্তু রাজনৈতিক সমাবেশে ছোট থেকে ছোট বিষয় গুলোও মিডিয়া বড় বড় করে দেখাবে বলে রিদ মুখেও ওয়ান টাইম মাস্ক পরার সিদ্ধান্ত নিল। এর মাঝে রিদ নিজের ফোনের সঙ্গে মায়ার ফোনটাও ওপেন করতে দরজার ধরে দাঁড়াল কেউ। রিদ আয়নায় দিয়ে মায়াকে দরজার সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল….

‘এদিকে এসো।
রিদের ডাকে নত মস্তিস্কের মায়া ছোট ছোট পা ফেলে এগিয়ে গেল সেদিকে। মায়াকে ছোট ছোট পা ফেলে হাঁটতে দেখে রিদ সেদিকে তাকাল। মায়া কাছাকাছি আসতে রিদ মায়ার বাহু টেনে নিজের মুখোমুখি করে তীক্ষ্ণ গলায় প্রশ্ন করে বলল…
‘হাঁটতে সমস্যা হচ্ছে? ব্যথা পাচ্ছো?
নিশ্চুপ মায়ার নত মস্তিস্ক আরও নত করে নিতে রিদ পুনরায় একই ভাবে বলল….
‘বাহিরে যাওয়ার দরকার নেই। রুমে রেস্ট নাও। সার্ভেন্ট তোমার খাবার ঘরে দিয়ে যাবে। বুঝেছ?
মায়া মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিতে রিদ মায়ার লালচে মুখটার দিকে তাকাল। রিদ চোখ বুলিয়ে মায়াকে অবলোকন করতে দেখতে পেল মায়ার শরীরে কালো একটা সুতির থ্রি-পিস জড়িয়ে ওড়নাটা মাথায় গোল করে বেঁধে শরীরে জড়িয়ে। রিদ বুঝতে পারছে মায়ার অসময়ে ওড়নাটা হিজাব করার কারণ। রিদের নিজেরও পছন্দ না তাঁর ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের সাক্ষী অন্যকাউকে করতে। সে এসব বিষয়ে খুব সেনসিটিভ। উচ্ছৃঙ্খল কোনো কিছুই তার পছন্দ না। রিদ হাত বাড়িয়ে মায়ার কাটা ঠোঁটে আলতো আঙুল চেপে বলল….

‘কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিবে তাহলে ভালো লাগবে কেমন?
মায়া আবারও মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিতে রিদ মায়াকে ছেড়ে ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার খুলে পরপর দুটো বক্স বের করে রাখল। প্রথম বক্সটি খুলে তাতে ডায়মন্ড রিং বের করে মায়ার বামহাতের আঙুলে পড়াতে পড়াতে বলল…
‘বউকে দেনমোহর দিতে হয়। যদিও তোমার দেনমোহর পরিশোধ করা আছে তারপরও আবার দিলাম। এটা তোমার জন্য অনেক আগেই কিনে ছিলাম। মুরাদপুরের ফ্ল্যাটে তোমাকে একটা চাবির রিং দিয়েছিলাম মনে আছে? এই রিংটা তখন তোমার জন্য কিনেছিলাম আর আজ দিলাম।
রিদের কথায় মায়া চোখ তুলে তাকাল রিদের দিকে। দীর্ঘ নীরবতা ভেঙে কৌতূহল নিয়ে মিহি স্বরে বলল….
‘সেদিন মুরাদপুর ফ্ল্যাটে আমাদের বিয়েটা কি আসল ছিল?

‘ হ্যাঁ।
‘ তাহলে আপনি আমাকে বললেননি কেন?
‘আমি বললে তুমি বিশ্বাস করতে? গ্রহণ করতে আমায় স্বামী হিসাবে?
রিদের কথায় মায়া চুপ হয়ে যায়। সেদিন রিদ বললে হয়তো মায়া বিশ্বাস করত না রিদ মায়ার স্বামী সেটা। বরং মায়ার মনে হতো রিদ মায়ার অচেনা মায়ার সম্পর্কে জেনে এখন রিদ মায়ার সুযোগ নিয়ে নিজেই মায়ার অচেনা স্বামী বলে নিজেকে দাবি করছে। তখন ব্যাপারটা মায়া বিশ্বাস না করলেও রিদ অন্তত একবার মায়াকে জানাতে পারত রিদ মায়ার স্বামী হয় সেটা। মায়া মিনমিন করে বলল…
‘ তারপরও আপনার দায়িত্ব ছিল আমাকে অন্তত একবার জানানোর।
মায়ার কথায় রিদের পাল্টা প্রশ্ন আসল তক্ষুনি। বলল…
‘সে রাতে তুমি আমাকে বলে পালিয়েছিলে যে আমি দায়িত্ব পালন করব তোমাকে জানিয়ে?
‘ আমি জানাইনি বলে আপনিও জানাবেন না?
‘ না।

মায়া গাল ফুলিয়ে দাঁড়াল। রিদ অপর বক্স হতে মায়াকে গলায় ডায়মন্ডের লকেট গলায় পড়িয়ে দিতে দিতে বলল…
‘ বক্সে আরও কিছু জুয়েলারি আছে ভালো লাগলে পড়ে নিও। আর নয়তো রেখে দিও।
মায়া হাতে পায়ে গলায় সুফিয়া খানের দেওয়া গোল্ড জড়ানো। রিদ-মায়ার মনোমালিন্যতার সময়ে সুফিয়া খান মায়াকে এসব কিনে দিয়েছিল। মায়া ভেবেছিল সবসময় পড়ে রাখবে কিন্তু আজ রিদের দেওয়া প্রথম উপহার গ্রহণ করতে মায়া সুফিয়া খানের দেওয়া সোনার বালা দুটো খুলে শূন্য হাত দুটো রিদের দিকে বাড়িয়ে দিতে দিতে বলল…
‘এগুলো আপনি পড়িয়ে দিন।
রিদ যত্ন সহকারে মায়ার দুহাতে দুটো ডায়মন্ডের চুড়ি পড়িয়ে দিতে দিতে বলল…
‘বেড সাইডের ড্রয়ারে তোমার জন্য মেডিসিন রাখা আছে সেটা খেয়ে নিবে বুঝেছ?
মায়া মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিতে দিতে চোখ তুলে রিদের দিকে তাকিয়ে বলল…
‘আপনি দুপুরে খেতে আসবেন না?
‘না।
‘তাহলে কখন আসবেন?

‘ দিনে আসা হবে না তবে রাতে অবশ্যই আসব।
রিদের কথায় মায়া লজ্জা পেতে মুহূর্তে নত মস্তিস্কের হয়ে দাঁড়াল। রিদ মায়ার নাক টেনে কপালে শব্দ করে চুমু খেয়ে বেরিয়ে যেতে মায়া সেদিকে তাকাল। রিদের বলে যাওয়ার পরও মায়াকে মেডিসিন খেতে দেখা গেল না। বরং অবহেলায় ফেলে রাখল সেগুলো। এর মাঝে জুইকে দেখা গেল মায়ার খোঁজে রিদের রুম অবধি পৌঁছাতে। মায়াকে আয়নার সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জুই বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসতে বসতে বলল….
‘তোর আরিফ ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ নেই রিতু?
মায়া আয়নার সম্মুখে বসে রিদের দেওয়া জুয়েলারি বক্স খুলে রাখা বাকি গহনা গুলো তুলে রাখতে রাখতে মায়া বলল…

‘সপ্তাহ খানিক আগে ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে মুরাদপুরে যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু রাফার জন্য শেষ পর্যন্ত দেখা হয়নি।
‘ রাফার জন্য দেখা হয়নি মানে? রাফা কী করেছে?
মায়া সেদিনকার ঘটনা সম্পূর্ণটা বলল জুইকে। সবটা শুনে জুই খানিকটা উত্তেজিত ভঙ্গিতে বলল…
‘ রাফা কি এখনো নাদিম ভাইকে স্বামী হিসাবে মানে রিতু? কিন্তু এই বিয়ে তো হবে না। একজনের বিয়েতে অন্যজন কবুল বললে সেটা গ্রহণযোগ্য না।
মায়া আগের ন্যায় বলল….
‘রাফা জানে সেটা।
‘জেনে-বুঝেও নাদিম ভাইকে স্বামী হিসাবে গ্রহণ করে কিভাবে? ওহ কি পাগল?
‘ ব্যাপারটা এখন রাফার মনজনিত। সামান্য কবুল বলাকে ঘিরে রাফার মনে নাদিম ভাইকে নিয়ে ভালোবাসা তৈরি হয়েছে জুই।
মায়ার কথায় জুই তৎক্ষণাৎ আপত্তি জানিয়ে বলল…

‘ কিন্তু রাফা কি আসিফ ভাইকে পছন্দ করতো না? আসিফ ভাইয়ের বিষয়টা কি হবে তাহলে?
‘ আসিফ ভাই পছন্দটা রাফার জন্য একতরফা ছিল জুই। রাফা চঞ্চলতায় আসিফ ভাইয়ের ভালোবাসার গভীরতা বুঝতে পারেনি। আর নয়তো আসিফ ভাইয়ের ঘাটতি ছিল রাফাকে নিজের ভালোবাসা প্রকাশ করতে। যার জন্য রাফা আসিফ ভাইয়ের জায়গায় নাদিম ভাইকে স্বামী হিসাবে চাচ্ছে।
মায়ার কথায় জুই ফের আপত্তি জানিয়ে অসন্তুষ্টি গলায় বলল…
‘ আসিফ ভাই রাফাকে পছন্দ করে সেটা আমরা সবাই জানতাম। রাফা নিজেও জানে আসিফ ভাই ওকে পছন্দ করে সেখানে ঘটা করে আবার আসিফ ভাইয়ের মুখে বলার প্রয়োজন কি আছে বুঝলাম না আমি।
মায়া বেশ তীক্ষ্ণ গলায় জুইকে বুঝিয়ে বলল…

রিদ মায়ার প্রেমগাঁথা পর্ব ৭০

‘ প্রয়োজন আছে জুই। ভালোবাসি বললে ভালোবাসা তোমার হয়ে যায় না জুই। ভালোবাসার চেয়ে ভালোবাসা আগলে রাখাটা কঠিন। যত্নে মায়া বাড়ে। অযত্নে পচন ধরে কথাটা তো তুই শুনেছিস তাই না? মানুষের মন পরিবর্তনশীল। মনের খোঁজ না নিলে মন কিন্তু তার ঠিকানা ঠিকই খোঁজে নিবে অন্য কারও মাঝে। আসিফ ভাই রাফাকে ভালোবেসেছিল কিন্তু যত্ন করতে পারেনি বলে আজ রাফা মনের শূন্যস্থানে নাদিম ভাইকে বসাতে চাচ্ছে ওহ।

রিদ মায়ার প্রেমগাঁথা পর্ব ৭২