রূপবানের শ্যামবতী পর্ব ২৬

রূপবানের শ্যামবতী পর্ব ২৬
এম এ নিশী

বাইরে থেকে আসা শব্দ কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই সতর্ক হয়ে যায় আয়মান।
–হক সাহেব, আপনি গিয়ে দেখে আসুন কিসের শব্দ হলো। আমি আপাতত আড়ালে রইলাম। পরিস্থিতি বুঝেই বেরোবো।
হক সাহেব বলে সম্বোধন করা ব্যক্তি যাকে অরুনিকা নিজের বাবা ভেবেছিলো তিনি আয়মানের কথায় সম্মতি জানিয়ে দ্রুত পায়ে দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন। আশেপাশে তন্নতন্ন করে খুঁজেও কাউকে পেলেন না।

তাই তিনি ভেতরে গেলেন আয়মানকে ডাকতে। এদিকে পাশেই থাকা গাছপালার ঝোপের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিল অরুনিকা। মুখে হাত চেপে শ্বাস আটকে রেখেছিলো এতোক্ষণ। লোকটা চলে যেতেই আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো সে। যেভাবেই হোক তাকে এখন এখান থেকে পালাতে হবে। কিন্তু সামনে দিয়ে পালানো যাবেনা। পেছনে দিক দিয়েই পালাতে হবে। বাড়িটার পেছন দিকে আসতেই হতাশ হতে হলো অরুকে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা চারপাশ। কিভাবে বেরোবে সে? হুট করে দেওয়ালের সাথে লেগে থাকা বিশাল এক গাছের দিকে নজর আসে তার। খুশি হয়ে যায় সে। এই গাছ বেয়ে উঠলেই দেয়ালটা টপকাতে পারবে। গ্রামের মেয়ে হওয়ার দরুন গাছে ওঠা তার কাছে কোনো কঠিন ব্যাপার নয়। নিজেকে ভালোভাবে প্রস্তুত করে আর এক মুহুর্ত দেরি করলো না অরু। তরতর করে গাছ বেয়ে উঠতে লাগলো। কিন্তু ওপরে উঠতেই বাঁধলো বিপত্তি। যখনই দেয়ালের ওপর পা রাখতে যাবে তখনই সে আটকে গেলো।

পিছু ফিরে দেখে একটা ডালের সাথে তার ওড়নাটা বাজেভাবে ফেঁসে গেছে। যত চেষ্টা করছে খুলতে তত বেশি যেন আটকে যাচ্ছে। পায়ের শব্দ শুনতেই পিলে চমকে ওঠে অরুনিকার। নিশ্চয়ই এবার দুজনেই বেরিয়েছে। যেকোনো মুহুর্তে এদিকটায় চলে আসতে পারে। অরুনিকা প্রাণপণ চেষ্টা করছে ওড়ানাটা ছুটিয়ে আনার। সফল হচ্ছে না কিছুতেই। পায়ের শব্দ এগিয়ে আসছে। তার মানে ওরা চলে এসেছে। আর কোনো কিছু না ভেবেই ওড়নাটা হেঁচকা টান দিতেই চলে এলো সেটা। তবে কিছু অংশ ছিঁড়ে আটকে রইলো সেই ডালটার মাথায়। অরুনিকা এক লাফে দেয়ালটার ওপর উঠে গেলো। সেখানে বসে নিচের দিকে তাকিয়ে লাফিয়ে পড়লো সে। পায়ে ব্যথা পেলেও সেটাকে গুরুত্ব না দিয়ে ছুটতে থাকলো কেবল।

আয়মান আর হক সাহেব ওদিকটায় এসে খুঁজতে লাগলেন। কিন্তু কারো কোনো অস্তিত্ব না পেয়ে হক সাহেব বলে ওঠেন,
–আমরা বোধহয় ভুল ভাবছি কোনো বিড়াল টিড়াল ছিলো বোধহয়।
আয়মান কোনো জবাব দেয়না। এখনো সে জহুরি নজর চালিয়ে তল্লাশি করছে। তবে কিছুই ধরতে পারলোনা সে। হক সাহেবের কথাই ঠিক ভেবে ফিরে আসতে যাবে তখনই তার চোখ যায় দেয়ালের সাথে লেগে থাকা গাছটির দিকে। সেদিকে এগিয়ে এসে এক হাত গাছে রেখে কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করলো। ঝট করে ওপরের দিকে তাকাতেই ঠোঁটের কোণে দেখা দেয় বক্র হাসি। সরে এসে দাঁড়ায় সে। হক সাহেব প্রশ্ন করলেন,

–কি হয়েছে?
কন্ঠে বিদ্রুপ মিশিয়ে জবাব দিলো আয়মান,
–কাঁচা খেলোয়াড়। হাহ!
হক সাহেব বুঝতে না পেরে পুনরায় প্রশ্ন করেন,
–মানে?

–মানেটা হলো যা বোঝার আমি বুঝে গিয়েছি। সময় হয়ে গিয়েছে পরবর্তী চাল চালার।
বলতে বলতে পকেট হাতড়ে নিজের ফোনটা বের করে আয়মান। আসিফের নাম্বারে ডায়াল করে। রিসিভ হতেই আসিফকে কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই শক্ত কন্ঠে বলে ওঠে,
–পরবর্তী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার সময় এসে গেছে। প্রস্তুত হ।
নিজের কথাটুকু শেষ করেই ফোন কেটে দেয় সে। নজর তার তখনও সেই গাছের ডালে আটকে থাকা অরুনিকার ওড়নার অংশবিশেষের দিকে।

ছুটতে ছুটতে নিজের কোচিং সেন্টারের গেটের কাছে এসে দাঁড়ায় অরুনিকা। হাঁটুতে দুহাত রেখে ঝুঁকে জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে সে। কিছুটা ধাতস্থ হতেই সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আশেপাশে চোখ বুলায়। নাহ। আহরার এখনো আসেনি। সাথে সাথে গেট দিয়ে স্টুডেন্টদের বের হতে দেখে বুঝতে পারে কোচিং শেষ। তখনই আহরারের গাড়িটা আসতে দেখে তাড়াহুড়ো করে স্টুডেন্টদের সাথে মিশে গেলো অরু। যেন মনে হয় সেও কোচিং শেষ করে বেরোচ্ছে।

গেটের কাছে গাড়ি থামিয়ে নেমে আসে আহরার। অরুনিকাকে বেরোতে দেখে প্রশস্ত হেসে এগিয়ে আসে সে। অরুনিকাও পাল্টা হাসি দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু বুঝতে পারে তার হাসি আসছে না। একটা ভয় কাজ করছে তার। আহরার যদি বুঝতে পেরে যায় সে আজ কোচিং ফাঁকি দিয়েছে। তবে কি তাকে ভুল বুঝবে। মনে মনে ভাবলো, আজ আহরারকে বলে দেবে সব। এমনকি আজকের ঘটনাটাও। স্বীকার করে নেবে সে। অন্যের কাছ থেকে জানার আগে অরু নিজেই জানিয়ে দিতে চায়। ভাবনার জগতে এতোটাই হারিয়ে গিয়েছে অরু যে আহরারের ডাকও তার কান পর্যন্ত পৌঁছালো না। আহরার দু বাহু ধরে ঝাঁকাতেই চমকে ওঠে বলে,

–হ..হ্যা.. কি হয়েছে?
–কোথায় হারিয়ে গেলো। এতো করে ডাকছি সাড়া দিচ্ছো না।
–ওহহ। না মানে খেয়াল করিনি।
–বেশ। চলো তাহলে যাওয়া যাক।
–হুম। চলুন।
আহরার অরুনিকাকে নিয়ে চললো। বাড়ির পথে না গিয়ে অন্য পথে যাওয়ায় অরুনিকা অবাক হয়ে প্রশ্ন করে,

–এটা তো বাড়ির রাস্তা নয়। তবে কোথায় যাচ্ছেন এদিকে?
অরুনিকার প্রশ্ন শুনে দ্বিগুণ অবাক হয় আহরার।
–মানে সিরিয়াসলি অরু। এরিই মধ্যে ভুলে গেলে তুমি। আজ কি কথা ছিলো।
অরু মনে করার চেষ্টা করে। আর মনে পড়তেই দাঁত দিয়ে জিভ কাটে সে। মাথা থেকে একেবারেই বেরিয়ে গিয়েছিলো। আজ যে আহরার তাকে তার পছন্দের জায়গায় ঘুরতে নিয়ে যাবে বলেছিলো।
–আমি খুবই দুঃখিত। কিভাবে যেন ভুলে গেলো।
–আরে ইটস ওকে অরু। কোনো ব্যাপার না।

গাড়ি এসে থামে দীঘির পাড়ে। আহরার নেমে এসে অরুনিকার দরজা খুলে তাকে নামায়। অরুর এক হাত শক্ত করে ধরে তাকে নিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে চলে দিঘীর দিকে। নিরিবিলি জায়গা দেখে সেখানে বসে পড়ে দুজনে। এই দিঘীরপাড় অরুনিকার সবচেয়ে পছন্দের জায়গা। যেদিন আহরার তাকে প্রথম এখানে নিয়ে আসে সেদিন ঘন্টার পর ঘন্টা নির্বাক হয়ে স্থির দৃষ্টিতে দীঘির জলের দিকে তাকিয়ে কাটিয়ে দিয়েছে। সেদিন অরু বলেছিল এই জায়গায় এসে সে নিজেকে হারিয়ে ফেলে। সেই সাথে হারিয়ে ফেলে নিজের সমস্ত দুঃখ, কষ্ট, চিন্তা ও মানসিক চাপ। নিজেকে নতুন ভাবে খুঁজে পায় সে। নিজেকে ও নিজের জীবনকে নিয়ে সব ভালো কিছু ভাবতে ইচ্ছে করে তার। তাই আজও আহরার তার মন ভালো করার জন্যই তাকে এখানে নিয়ে এলো।

ভেসে আসছে শীতল দখিনা হাওয়া। সেই হাওয়ায় মজে দীঘির শান্ত জলে মনোনিবেশ করে রেখেছে অরুনিকা। কেমন অন্যমনষ্ক ভাব তার। সেই ভালো লাগার অনুভূতির রেশ তার চোখে মুখে দেখা যাচ্ছে না। আহরার শান্ত চোখে দেখছে অরুনিকাকে। বেশ কিছু লটা সময় নীরবতা পালন করে হুট করে আহরার বলে ওঠে,
–তোমার ওড়নাটা ছিঁড়লো কিভাবে অরু?

চমকে উঠে অরু। আহরারের দিকে দৃষ্টি ফেরায় সে। অত্যন্ত স্বাভাবিক মুখভঙ্গিমা আহরারের। তার কথায় অরুর মনে হয় এবার সবটা বলে দেওয়া উচিত। পরক্ষণেই তার মাথায় অন্য এক প্রশ্ন আসায় কৌতুহল দমাতে না পেরে বলেই বসলো,
–আচ্ছা, আপনার বড় ভাইয়ের বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার কারণ কী ছিল?
ভ্রুঁ কুঁচকে তাকায় আহরার। অরুর প্রশ্নের জবাবে সেও পাল্টা প্রশ্ন করে,

–হঠাৎ এই প্রশ্ন?
অরুনিকা চোখ সরিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে জবাব দেয়,
–আপনার ভাইয়ের ব্যাপারে আমি কিছুই জানিনা। কখনো কাউকে প্রশ্ন করার সাহস দেখাতে পারিনি। তাই আজ আপনার কাছ থেকে জানতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে।

নীল আকাশে পেজা তুলোর মত সাদা মেঘের দল ভেসে বেড়াচ্ছে। তার ছায়া দীঘির জলে পড়েছে। তাই জলের রংও স্বচ্ছ নীল দেখাচ্ছে। পড়ন্ত বিকেলে হেলে পড়া সূর্যটার তাপ তখনো কমেনি।অরুনিকা খুট খুট করে ঘাস ছিঁড়ছে। কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে তপ্ত শ্বাস ফেলে আহরার বলা শুরু করল,

–আয়মান আর আমার বয়সের পার্থক্য গুনে গুনে ৮ মাসের। যার দরুন সে আমার বড় ভাই হওয়া সত্ত্বেও আমরা দুজন বন্ধুর মতো ছিলাম। এমনকি আমি তাকে ভাই বলে না ডেকে নাম ধরেই ডাকি। আমাদের দুজনের জীবনে এমন কোন সিক্রেট নেই যা আমরা জানিনা। ছোটবেলা থেকেই দুষ্টুমি, খুনসুটি করে করে বড় হওয়া আমরা দুজন দুজনের জানের দোস্ত ছিলাম। একে অপরের সাথে সবকিছু শেয়ার করা থেকে শুরু করে একে অপরের দুঃখ কষ্ট ভাগাভাগি করে নেওয়া সবটাই ছিল আমাদের মধ্যে। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার কি জানো অরু?

আমরা জামা কাপড়ও পড়তাম একইরকম। জামা- কাপড়, জুতা, ঘড়ি, এমনকি সানগ্লাসটাও আমাদের ম্যাচিং ম্যাচিং থাকতো। কেউ যদি আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করত তবে আয়মান তার বারোটা বাজিয়ে দিত। আর আয়মানের সাথে কেউ দুর্ব্যবহার করলে আমিও তাকে ছেড়ে দিতাম না। একটা ঘটনা বলি, আমরা তখন সদ্য ভার্সিটিতে উঠেছি। আমাদের ভার্সিটি একই ছিল। আমরা একই ক্লাসে পড়তাম। নাদিম মানে ফারনাজের বর আমাদের সাথেই পড়তো।

সে বেশ ভালো মানের ছাত্র ছিল। আমিও প্রথম সারিরই ছাত্র ছিলাম। নাদিমকে টপকে স্কুল কলেজে কেউ কখনো ফার্স্ট হতে পারেনি। কিন্তু ভার্সিটিতে এসে আমি হলাম ফার্স্ট আর ও হয়ে গেল সেকেন্ড। তাই তার কিছু পুরোনো বন্ধু তাকে সব সময় ক্ষেপাতো এই বিষয়টা নিয়ে। যার কারণে ওর পুরো রাগ এসে পড়ে আমার উপর। একদিন আমি অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে যাচ্ছিলাম প্রফেসরের সাথে দেখা করতে। বাইকে করে যাচ্ছিলাম। হুট করে কোথা থেকে নাদিমও বাইক নিয়ে এসে আমার বাইকে ধাক্কা দিতেই আমি ছিটকে পড়ে গেলাম।

বেশ ব্যথা পেয়েছিলাম। উঠতে পারছিলাম না। তখন নাদিম এসে আমার দীর্ঘদিন ধরে কষ্ট করে তৈরি করা অ্যাসাইনমেন্টে আগুন জ্বালিয়ে দিলো। দ্রুত ছুটে এসে আমি আগুন নিভানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু বেশিরভাগ পুড়ে গেছে। হাত দিয়ে আগুন নেভাতে যাওয়ার কারণে আমার হাতেও ফোসকা পড়ে গিয়েছিল। আর এসব কিছু যখনই আয়মান জানতে পেরেছে সাথে সাথে ২-৪ জন ছেলে নিয়ে গিয়ে কৌশলে নাদিমকে বাড়ি থেকে বাইরে এনে বেধরম পিটিয়েছে।

এক মাস সে বিছানা থেকে উঠতে পারেনি। এর জন্য ভার্সিটি থেকে আয়মানকে সাসপেন্ড করে দিচ্ছিল। কিন্তু বড় আব্বুর অনুরোধে তাকে প্রথম ও শেষবারের জন্য ছেড়ে দেওয়া হলো। এরপর নাদিম আর ভার্সিটিতে আসেনি। কারণ ও এই ভার্সিটি বদলে অন্য ভার্সিটিতে চলে যায়। বহুদিন পর তার এক বন্ধুর কাছ থেকে তার এই ক্ষোভের কারণ জানতে পেরেছিলাম। জানার পর তার প্রতি আর কোন রাগ ছিল না। আমি মাফ করে দিয়েছিলাম। যাই হোক এই ঘটনা শুনেই। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো আয়মান আর আমার সম্পর্ক কেমন ছিলো। কিন্তু এই সুন্দর সম্পর্কটাই একদিন নিমিষেই ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়।

আহরারের চোখের কোণে অশ্রুরা ভিড় করতে শুরু করেছে। অরুনিকা উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে মনোযোগ দিয়ে এতোক্ষণ সবটা শুনছিলো। আহরার থেমে যাওয়ায় তার মনোযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আহরারের চোখের কোণে জমা অশ্রু নজরে আসতেই অরু দুহাতে আহরারের মুখটা ধরে নিজের দিকে ফেরায়। উৎকন্ঠা হয়ে প্রশ্ন করে,
–কি হয়েছে খান সাহেব? আপনি কাঁদছেন? কেন কাঁদছেন?
বলতে বলতে আহরারের মাথা টেনে এনে নিজের বুকে চেপে ধরে অরু। সযত্নে হাত বুলিয়ে শান্তনা দিতে থাকে নিজের স্বামীকে।

কলেজ থেকে ফিরে কোনোরকমে হাতমুখ ধুয়ে ছুটে ঘরের ভেতর ঢুকে দরজা আটকে দেয় আদ্রিকা। পুরোটা বিষয় সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করেন সেলিনা। ব্যাপারটা এবার সন্দেহের মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে। নাহ। তার এখন জানতেই হবে আদ্রিকা করছেটা কি?

ফোনটা হাতে নিতেই জানে পানি আসে আদ্রিকার। আজ কলেজে ফোন নিয়ে যেতে ভুলে গিয়েছে সে। পুরোটা সময় কতোটা অস্থিরতায় কাটিয়েছে যেন জানটা হাতে নিয়ে রেখেছে। এখন বাড়ি এসে ফোনটা জায়গামতো দেখেই স্বস্তি মিললো তার। ঝটপট ফোন চালু করতেই সেই অপরিচিতের ম্যাসেজ দেখে আরো এক দফা শান্তির ঢেউ খেলে গেলো মনে। বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে ম্যাসেজিং এ ডুবে গেলো সে।

“রূপসীর মায়াভরা, অপরূপ সৌন্দর্য্যমন্ডিত, স্নিগ্ধ মুখখানি দেখার বড্ড পিপাসা পাচ্ছে যে।”
ম্যাসেজটা পড়ে ঠোঁটে লাজুক হাসি দেখা গেলো আদ্রিকার। দ্রুত আঙুল চালিয়ে টাইপ করে উত্তর পাঠালো সে,
“আচ্ছা, আপনি কি কখনো আমাকে দেখেছেন।”
ওপাশে বেশ কিছু সময় নিশ্চুপ থেকে অতঃপর ফিরতি উত্তর,

“হুমমম! দেখেছি তো। যেদিন প্রথম দেখেছি তোমায় সেদিন সোজা বুকে এসে লেগেছিলো। এমন অসম্ভব রূপবতী আমি আমার জীবদ্দশায় কখনো দেখার সৌভাগ্য অর্জন করিনি।”
লজ্জায় লাজুকলতার ন্যায় নুইয়ে পড়ছে আদ্রিকা।
“ইশশ! লোকটা কিভাবে কথা বলে। কত্তো লজ্জা দেয়। কি আশ্চর্য! এই লজ্জার মধ্যেও এক অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করছে। এগো ভালো লাগছে কেন সবকিছু।”

ম্যাসেজের আওয়াজে পুনরায় ফোনের দিকে নজর দেয় আদ্রিকা,
“রূপসী বোধহয় লাজরাঙা হয়ে মুখ লুকোচ্ছে। ওমন লজ্জামাখা মুখটা দেখার জন্য বড্ড মন আনচান করছে। কবে দেখবো সেই মুখ?”

আদ্রিকা আর ফোনটা হাতে রাখার সাহস পেলো না। বিছানার এক কোণে ফোন ছুঁড়ে মেরে উঠে গিয়ে জানালার সামনে দাঁড়ায়। মুখে লাজ, ঠোঁটে হাসি। জানালা বরাবর থাকা ফুল গাছটার গা ছুঁইয়ে দেয় সে। আর ফিসফিস করে বলতে থাকে,
“কিরে, তাকিয়ে দেখছিস কি আমার দিকে। এ্যাই, বল না তোরা আমার আনন্দ হচ্ছে কেন? কেন এতো ভালো লাগছে সবকিছু। চারিদিকে যা-ই দেখছি সবকিছু কত্তো সুন্দর লাগছে। মনে হচ্ছে এই পৃথিবীতে দুঃখ বলতে কিচ্ছু নেই। সবখানে শুধু সুখ আর সুখ।”

নিজমনেই কথাগুলো বলেই খিলখিল করে হেসে ওঠে সে। তবে সেই হাসির স্থায়িত্ব বেশিক্ষণ থাকেনা। দরজায় জোরে জোরে কড়া নাড়ার আওয়াজে ধুম করে হাসি থেমে যায় তার। একটু একটু ভয় লাগতে শুরু করে। একটু আগে তার বলা কথা আর হাসি কেউ শুনে নেয়নি তো। তবে ভয়টা জেঁকে বসার আগেই দূর হয়ে গেলো। যখন ওপাশ থেকে সেলিনার আওয়াজ ভেসে আসে,

–হ্যা রে আদ্রি, কলেজ থেকে ফিরেই দরজা আটকে কি করছিস? রুমকি এসেছে। ডাকছে তোকে। বেরো।
রুমকির কথা শুনে খুশি হয়ে গেলো আদ্রিকা। তার প্রিয় বান্ধবী। যাকে সে সবকিছু খুলে বলে। একটু আগেই সেই অপরিচিতের সাথে হওয়া কথাগুলো তো ওকে জানাতে হবে। এই ভেবে ছুটে এসে দরজা খোলে সে। জোরেশোরে দৌড় লাগায় প্রাণপ্রিয় বান্ধবীর উদ্দেশ্যে।

দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থেকে আদ্রিকার ছুটে যাওয়া দেখলেন সেলিনা। তারপর ধীর পায়ে তার ঘরে এসে ঢুকলেন। এদিক ওদিক তাকিয়ে বিছানার ওপর পড়ে থাকা ফোনটা দেখতেই এগিয়ে গিয়ে সেটা হাতে তুলে নিলেন। ফোনটা চালু করতেই ওপরে জ্বলজ্বল করছে কিছু ম্যাসেজ। ম্যাট্রিক অবধি পড়াশোনা করা সেলিনা ম্যাসেজটুকু ভালোভাবেই পড়তে পারলেন। ফোন চালানোও শিখেছেন কিছুটা। তাই ইনবক্সে ঢুকে একে একে সবকটা ম্যাসেজ পড়তে লাগলেন তিনি।

আকাশজুড়ে রক্তিম আভা। সন্ধ্যা নেমে আসছে প্রায়। নরম ঘাসের ওপরে বসে এখনো দীঘির জল দেখতে ব্যস্ত আহরার অরুনিকা। তিক্ত স্মৃতিচারণের কারণে কিছুটা দূর্বল হয়ে পড়েছিলো আহরার। যার ফলাফল চোখে পানি আসা। অরুনিকার ভালোবাসা মাখা শান্তনায় নিজেকে সামলে নিয়েছে সে। দুজনেই চুপচাপ। থেকে থেকে কেবল বুকচিঁড়ে আসা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছে আহরার। নিরবতা ভেঙে অরুনিকাই বলে উঠলো,

রূপবানের শ্যামবতী পর্ব ২৫

–আপনাদের সম্পর্কটা ভেঙ্গে যাওয়ার কারণ কি ছিলো?
দূরে দৃষ্টি মেলে তাকায় আহরার। চোখ বুজে বুক ভরে শ্বাস নিয়ে সন্তর্পণে ছেড়ে দেয় তা। পুনরায় দৃষ্টি মেলে ব্যথিত মন নিয়ে শীতলকন্ঠে জবাব দেয়,
–কারণটা ছিলো আয়মানের স্ত্রী – তানিশা…

রূপবানের শ্যামবতী পর্ব ২৭