লাল শাড়িতে প্রেয়সী পর্ব ২৫

লাল শাড়িতে প্রেয়সী পর্ব ২৫
Fatima Fariyal

ড্রইংরুমে যেন নিস্তব্ধতার এক অদ্ভুত আস্তরণ পড়েছে। ঘড়ির টিকটিক শব্দটা যেন এই নীরবতার বুক চিরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। উপর তলা থেকে ধীরে ধীরে নামছে আদনান আর রিদিতা। দু’জনের মুখেই যেন কিছু অনুচ্চারিত অনুভবের ছাঁয়া। রিদি নেমেই গিয়ে বসলো আহিয়া আর হালিমা বেগমের মাঝখানে। আর আদনান গিয়ে বসল সোফার অপর প্রান্তে। আহাদ উপরের করিডোরে গ্রিলের ওপরে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখ যেন ছুরির মতো বিদ্ধ হয়ে আছে সোজা রিদির উপর। রিদি তখন কথা বলছে হালিমা বেগমের সাথে, কিন্তু হঠাৎই তার দৃষ্টি গিয়ে থামলো আহাদের সেই গাঢ় বাদামী চোখের চাহনিতে। রিদির বুক কেঁপে উঠলো অজানা অনুভবে, অস্বস্তি চেপে রেখে সামান্য নড়েচড়ে বসল। কিন্তু আহাদের চোখ সড়লো না। সে তাকিয়েই রইলো নিবিষ্ট, তীব্র, এবং ভেতর থেকে জ্বলন্ত অগ্নিদাহ নিয়ে।

এই অদ্ভুত চোখাচোখি এড়ালো না বিচক্ষণ আফরোজা শেখের দৃষ্টি। তার কপালে গভীর ভাঁজ পড়লো। নিজের ছেলের পাগলামো আর এই মূহুর্তে রিদির দিকে তাকিয়ে থাকা চোখের ভাষা পড়তে বেশিক্ষণ সময় লাগলো না। তার ছেলের সেই চোখের ভাষা তাকে ভীত করলো। মনের মধ্যে এক অদ্ভুত অস্থিরতা বয়ে গেল। একটা প্রশ্ন যেন বুকের ভেতর কেঁপে উঠলো নিঃশব্দে।
“তবে কি সে কোন ভুল করছে?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ঠিক সেই সময়েই, মূল দরজা খুলে প্রবেশ করলেন আমজাদ মীর। তার আগমনে ঘরের বাতাসে যেন এক ভারী স্রোত বয়ে গেল। সবার দৃষ্টি ঘুরে গেল তার দিকে। গম্ভীর, সুউচ্চ, কিন্তু মুখে অল্প ক্লান্তির ছাঁপ। দরজার কাছে দাঁড়িয়েই তিনি এক মুহূর্ত থেমে গেলেন। তার চোখে বিস্ময়, তর্জনী আঙুল দিয়ে কপাল চুলকে ভাবতে লাগলো, তাকে বলা হয়েছিল সে যেন আজ একটু আগেই আসে। কাজের চাপে সে কথা ভুলে গিয়েছিলেন। এখন এসে দেখছেন, ঘটনার গতি তার অনুপস্থিতিতেও থেমে নেই। তিনি ধীরে ধীরে এগিয়ে এলেন হলঘরের মাঝখানে। তারেক রায়ান তাকে দেখেই শ্রদ্ধাভরে উঠে দাঁড়ালেন। আমজাদ মীর এগিয়ে গিয়ে কুশল বিনিময় করলেন, অতঃপর মুখে হালকা হাসি এনে বললেন,
“আরে বসুন, বসুন! এখন তো কেবল সম্পর্কের শুরু, দুজন মিলে গল্পগুজব করবো জমিয়ে আড্ডা দিবো। সে সব তো এখনো বাকি আছে !”

তারেক রায়ান বিনীতভাবে হাসলেন, আবার বসলেন নিজের নির্দিষ্ট জায়গায়। আমজাদ মীরও বসে পড়লেন আফরোজা শেখের পাশে। এক গ্লাস পানি হাতে নিয়ে চুমুক দিলেন, আর ঠিক সেই মুহূর্তেই চোখ গিয়ে থামলো সামনে হাত জড়ো করে বসে থাকা রিদিতার উপর। রিদিকে দেখেই তার গলায় চুমুকের পানি হঠাৎ বিদ্ব হলো। খক খক করে কেঁশে উঠলেন। এবার তার দৃষ্টি ঘুরে গেলো উপর তলার দিকে। সেখানে আহাদ এখোনো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাদের দিকেই, তার সেই তীক্ষ্ণ চাহনিতে আরও কয়েক বার কেশে উঠলেন আমজাদ মীর। আফরোজা শেখ এগিয়ে এসে একটু অস্থির গলায় জানতে চাইলেন,
“কী হয়েছে আপনার? শরীর খারাপ লাগছে?”
আমজাদ মীর কাশির ভেতরেই চোখ তুলে তাকালেন নিজের স্ত্রীর দিকে। অতঃপর আরো দু’বার কেঁশ নিয়ে গলা পরিষ্কার করে বললেন,

“না, কিছু হয়নি, আমি ঠিক আছি। ঠাণ্ডা পানি মুখে নিয়েছি, তাই হয়তো গলায় বসে গেছে।”
আফরোজা শেখ এবার একটু শান্ত হয়ে বসলেন। আমজাদ মীর কোন রকম নিজেকে আর পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করলেন। সামান্য বিরতি চেয়ে, মৃদু হেসে আসফাক মীরের দিকে তাকালেন। একটা নীরব ইঙ্গিত করলেন চোখের ইশারায়। অতঃপর নিজের রুমের দিকে হেটে গেলেন। আসফাক বুঝে মাথা নেড়ে তার পিছু নিলো। দরজা বন্ধ হতেই আমজাদ মীরের কণ্ঠ গর্জে উঠলো,

“এসব কী হচ্ছে, আসফাক? আদনানের সঙ্গে ওই মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে? আর তোর ভাতিজা শান্তশিষ্ট হয়ে সেটা দেখছে?”
আসফাক মীর বিদ্রূপে ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে উঠলো,
“তোমার ছেলে আর শান্তশিষ্ট? হাসালে ভাইজান। বাড়িতে এসেই যে তুলকালাম করেছে, সেটা দেখলে নিশ্চিত হ্যার্ট অ্যাটাক করতে।”
আমজাদ মীররে ভ্রু গাঢ় হলো, চোখ ছোট করে গভীর চিন্তা করে বললেন,
“তাহলে এখন হঠাৎ শান্ত হলো কেনো?”
“নিশ্চয়ই কোন ফন্দি আঁটছে বজ্জাতটা। তোমার ছেলে তো! এতো সহজে কী আর হার মানবে?”
আমজাদ মীর বিরক্ত হয়ে গলা ভারি করলেন,

“এতো তামাশা করার কী আছে? সবাইকে গিয়ে সত্যিটা বলে দিলেই তো ঝামেলা মিটে যায়। শুধু শুধু এতো হরতাল করার মানে কী?
একটু থেমে আবার দৃঢ় স্বরে বললেন,
“আমি এখনই গিয়ে বিষয়টা ক্লিয়ার করে দিচ্ছি। এভাবে লুকোচুরি খেলে কোনো লাভ নেই।”
তিনি পা বাড়াতেই আসফাক তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললো,
“ভাইজান! এই ভুল কোরো না। তোমার কী মনে হয়, আহাদ চুপ চাপ কী এমনই এমনই আছে?”
আমজাদ মীর থেমে ঘুরে তাকালেন,
“মানে?”
আসফাক এগিয়ে এসে গম্ভীর গলায় বললো,

“তুমি ভুলে যাচ্ছো, কয়েকদিন আগের খবরটা। তোমার ছেলের জন্য রিদিতা মেয়েটা মাঝখান থেকে আহত হয়েছিল। আহাদের ভ’য়, এখন যদি তাদের সম্পর্কে নিয়ে কোন নিউজ সামনে আসে। তাহলে নির্বাচনের আগে শত্রুরা রিদিকে টার্গেট করবে আহাদকে জব্দ করতে। তাই ও চায় নির্বাচন অব্ধি যেভাবে চলছে চলুক।”
আমজাদ মীর এক নিঃশ্বাস ফেলে, বিরক্তিকর ভঙ্গিতে বললেন,
“নির্বাচন শেষ হলেই কী আমাদের শত্রুর সংখ্যা কমে যাবে আসফাক? রাজনীতির জগতে সারাজীবন শত্রুদের আনাগোনা থাকবে। তাই বলে কী নিজেদের গুটিয়ে নিতে হবে। এতো ভ’য় নিয়ে রাজনীতি করা যায় না আসফাক! তোর ভাতিজাকে বুঝিয়ে দিস।”

তার কথা শেষ হতে না হতেই, দরজার পাশে গম্ভীর গলায় শোনা গেল,
“আহাদ রাজা আল্লাহর দুনিয়ায় ভূত আর আল্লাহর বান্দিরে হারোনর ভ’য় ছাড়া, অন্য কিছুকে ভ’য় পায় না!”
দুজন একসাথে চমকে তাকালেন দরজার দিকে। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে আহাদ, দুই হাত পকেটে, চোখে একরাশ চ্যালেঞ্জ। আমজাদ মীর দ্রুত এগিয়ে এলেন,
“তাহলে কী এখন তুমি বসে বসে এসব তামাশা দেখবে? অত্যন্ত সবাইকে জানিয়ে রাখলে বিষয়টা এখানেই মিটমাট হয়ে যাবে।”
আহাদ সাথে সাথে জবাব দিলো,
“এতো সহজে সব কিছু মিটে যায় না বাবা। যদি তাই হতো, আহাদ রাজা বসে বসে তার প্রেয়সীর বিয়ে দেখতো না!”
আমজাদ মীরের চোখে রাগ জ্বলে উঠলো,

“তাহলে চাইছো কী তুমি?”
আহাদ বাবার দিকে তাকিয়ে একটা রহস্যময় হাসি দিলো। অতঃপর ঝুঁকে এসো কৌতুকী গলায় বললো,
“আগে আগে দেখো, হোতাহে ক্যায়া!”
এরপর ঘুরে দরজা ঠেলে বেরিয়ে গেল সে। দুই ভাই শুধু নির্বাক দৃষ্টিতে একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারা বেশ ভালো করেই বুঝতে পারলো, আহাদ তার খেলা শুরু করে দিয়েছে।
ড্রইংরুমে একটা চাপা গুঞ্জন বইছে, যেন আনন্দের আড়ালে লুকিয়ে থাকা কোনো অচেনা আশঙ্কা। সবার মুখে হাসির রেখা, মাত্রই আদনান আর রিদির বিয়ের তারিখ নির্ধারিত হয়েছে। পরিবারের সবাইকে অবাক করে আদনান নিজেই বিয়ের তারিখ রেখেছে। আজ থেকে ঠিক তিন দিন পর। তারেক রায়ান ও দ্বীমত করেনি, কারন তাদেরও তো গ্রামে ফিরে যেতে হবে। তাই এমন তাড়াহুড়োতেই যেন একপ্রকার স্বস্তি খুঁজে পেলেন। তবে আফরোজা শেখ প্রথমে রাজি হননি। নির্বাচন আর মাত্র দু’দিন পর, বাড়ির পুরুষেরা ঠিকঠাক সময় দিতে পারবে না। এতো ধকলের পর আবার বিয়ের অনুষ্ঠান?

কিন্তু আদনান জানিয়েছে, তার নাকি এই সপ্তাহের শেষেই জার্মানি যেতে হবে। আর তার বাবা মা বলেছে, বিয়ে করে বউ নিয়ে তবেই যেনো যায়। এই কথাগুলোর পর আর কিছু বলার ছিল না। তাই আফরোজা শেখও বাধ্য হয়ে পরবর্তীতে মত দেন। যদিও সে নিজেই চেয়েছে আদনান আর রিদিতার বিয়েটা হোক, কিন্তু আজ যখন তার কথাই বাস্তবে পরিণত হচ্ছে। তখন তাঁর মনটা কেমন খচখচ করছে। বারবার মনে হচ্ছে, সে নিজের অজান্তেই কিছু একটা ভুল করছে, অনেক বড় ভুল!

হালিমা বেগম গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন পাশে বসে থাকা রিদিতাকে। কেমন মন মরা হয়ে বসে মেয়েটা। দেখে মনে হচ্ছে, এসব কিছুর প্রতি অনিহা তার। এমন সময় হঠাৎ সে খেয়াল করলেন, রিদি বারবার চোখ পিটপিট করে ড্রইংরুমের কর্নারের দিকে তাকাচ্ছে। সেই দৃষ্টির অনুসরণ করতেই দেখলেন আহাদ টেবিলে পা তুলে বসে আছে। হাতে থাকা লাল বলটা এক হাত থেকে অন্য হাতে নিয়ে একরকম খেলছে ঠিকই তবে তার দৃষ্টিও বিদ্ধ হয়ে আছে রিদিতার দিকে। হালিমা বেগম এবার একটু আহিয়ার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললেন,
“এই আহিয়া, আহাদ আর রিদিতার মধ্যে কী চলছে? সত্যি সত্যি বলবি।”
আহিয়া এক ঝলক তাকিয়ে দুজনকে দেখে নেয়। একটা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে নিচু গলায় বললো,
“চাচি আম্মু! আমি তো নিজেই বুঝতে পারছি না। তোমাকে কি বলবো।”

হালিমা বেগম কিছু না বলে চুপ করে গেলেন। তাঁর মনে কিন্তু গোপন উদ্বেগের ঢেউ উঠল। ঠিক তখনই রিদির মাথায় টোকা পড়ল। চমকে ঘুরে তাকাতেই দেখল তানভীর দাঁড়িয়ে। রিদির মাথাটা আদনানের দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে, মুখে দুষ্টুমি মাখা হাসি এনে বললো,
“দুলাভাই এইদিকে, তুই ওদিকে তাকিয়ে আছিস কেনো?”
রিদি দাঁত চেপে নিজেকে সংযত করে বললো,
“তানভীর! আরেকবার আজেবাজে বললে কিন্তু থাপ্পড় খাবি!”
এবার আহিয়াও ঘুড়ে তাকায় তানভীরের দিকে, তানভীর আহিয়ার দিকে তাকিয়ে ঠোঁটে হাসি এনে হাত নাড়িয়ে বললো,

“হ্যালো বেয়াইনসাব, আপনার ভাবিকে সামলান। যখন তখন আমার মতো শান্তশিষ্ট ছেলেটাকে মারে।”
রিদি এবার চোখ কুঁচকে বললো,
“শান্তশিষ্ট না, লেজবিশিষ্ট আস্ত একটা বান্দর!”
এই কথা শুনে আহিয়া মুখ টিপে হেসে ফেলল, তানভীর মুখ গম্ভীর করে আদনানের পাশে গিয়ে বসে পড়ল। আদনানও বিরক্ত মুখে আড়চোখে তাকায় তার দিকে।একটু নড়েচড়ে সরে বসে। এমন সময় হালিমা বেগম আহিয়াকে বললেন,
“আহিয়া, আমার রুম থেকে ফোনটা একটু এনে দে না মা।”
আহিয়া উঠে পড়তেই তানভীর চট করে বললো,
“চলেন বেয়াইন, আমি সাহায্য করি!”
কিন্তু তানভীর দাঁড়ানোর আগেই আদনান তার কাঁধ চেপে ধরে বসিয়ে দেয়। তানভীর অবাক হয়ে, ভ্রু কুচঁকে প্রশ্ন করলো,

“কি হয়েছে দুলাভাই।”
আদনান চোয়াল শক্ত করে একটা কৃত্রিম হাসি টেনে বললো,
“কোথায় যাচ্ছো শা লা বা বু!”
“বেয়াইনকে একটু সাহায্য করে আসি!”
আদনান তার কাঁধে শক্ত হাত রেখে আহিয়ার দিকে তাকালো। চোখে শীতল আগুন নিয়ে বললো,
“তোমার বেয়াইন ফোন আনতে যাচ্ছে, চালের বস্তা না। চুপচাপ এখানেই বসে থাকো।”
তানভীর আদনানের কথা শুনে অসহায়ের মতো বসে রইল। শুধু এমনই বসে আছে বললে ভুল হবে, আদনান একরকম জোড় করে তাকে বসিয়ে রেখেছে। রিদিতাও ওদের দিকে তাকিয়ে বিরক্ত হয়ে সেখান থেকে উঠে আহিয়ার পিছু যায়। আহিয়া যখন ফোন নিয়ে ফিরছিল, তখন রিদি তার সামনে এসে দাঁড়াল। আহিয়া অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,

“কিরে, কী হয়েছে তোর? কিছু লাগবে?”
“হুমমম।”
ছোট করে উওর দিলো রিদি। আহিয়া একটু কাছে এসে উদ্বেগ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কী লাগবে বল, আমি এনে দিচ্ছি।”
রিদি গলা কাঁপিয়ে মৃদু স্বরে বললো,
“তোর ভাইকে লাগবে, এনে দে।”
এক মুহূর্তের জন্য সময় থমকে গেল। আহিয়া রিদির দিকে তাকিয়ে রইল অবিশ্বাসে। এতো সহজভাবে যে রিদি এই কথা বলবে সে ভাবেনি। হঠাৎ চোখ গেলো দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা আহাদের দিকে, তাকে দেখেই রিদির শরীরে কম্পনের সৃষ্টি হয়। মনে মনে ভাবতে লাগলো, আহিয়াকে বলা কথাটা কী আহাদ শুনে ফেলেছে? দ্বীধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়লো সে। এটা দেখে আহিয়ার মুখে এক চিলতে দুষ্ট হাসি ফুঁটে উঠলো। সে দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে, ভাইকে উদ্দেশ্য করে ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো,

“তোমাকে ডাকছে রিদি! আমি চাচি আম্মার ফোনটা দিয়ে আসি।”
এই বলে আহিয়া দ্রুত সেখান থেকে বেড়িয়ে যায়। রিদি ঠোঁট কামড়ে দাঁড়িয়ে রইলো, পা বাড়ানোর শক্তি যেনো হারিয়ে ফেলেছে। এদিকে আহাদ ধীরেধীরে এগিয়ে আসতে লাগলো তার দিকে। প্রতিটি পায়ের শব্দ যেন রিদির বুকের ভেতর ধাক্কা দিচ্ছে। ভেতরটা কেমন ধড়ফড় করছে। রিদি জ্বিব দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিলো, এখনই বুঝি আহাদ তাকে কিছু বলবে। আহাদ কাছাকাছি আসতেই রিদি চোখ জোড়া শক্ত করে বন্ধ করে নিলো। আহাদ সেদিকে তাকিয়ে থেকে ঠোঁট বাঁকিয়ে একটা হাসি দিয়ে, তার পাশ কাটিয়ে সামনে গেলো। কেবল বাতাস কেটে যাওয়ার মত শব্দ হলো। রিদি ধীরে এক চোখ খুলে দেখে আহাদ সামনে নেই। এরপর তড়াক করে ঘুরে দেখে আহাদ টেবিল থেকে ল্যাপটপ হাতে নিয়ে দরজার দিকে এগোচ্ছে। রিদি কোন কিছু না ভেবেই ডেকে উঠল,

“শুনুন না!”
আহাদের পা দরজার সামনে আটকে যায়। ধীরে পেছন ফিরল। একটা ভারী ঢোক গিলে মনে মনে ভাবলো, এই আল্লাহর বান্দি কি তাকে এভাবে ডেকে দুর্বল করার চেষ্টা করছে! দাঁত কিড়মিড় করে ঠোঁটে বিদ্রূপমাখা হাসি এনে বললো,
“আমাকে বলছেন, ভাবিজি?”
রিদির মুখ রক্তবর্ণ হয়ে গেল। আহাদের সামনে গিয়ে ফুঁসতে ফুঁসতে বললো,
“আমাকে ভাবি কেনো ডাকছেন?”
আহাদ একটু ভঙ্গিমা করে ঠান্ডা স্বরে বললো,
“যাক বাবা! আমার গুণধর ভাইকে নাচতে নাচতে বিয়ে করতে এসেছেন, ভাবি ডাকবো নাতো কি ডাকবো..”
একটু ঝুঁকে রিদির কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,
“জানু?”

শেষ শব্দটা কানের কাছে ঝরে পড়তেই রিদির বুকের ভেতর কাঁপুনি ধরল। কিছু বলার শক্তি নেই, শুধু ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলো আহাদের দিকে। আহাদও নীরব হয়ে তার প্রেয়সীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো কয়েক সেকেন্ড। অতঃপর আবারও ফিসফিস করে বললো,
“আমার থেকে দূরে থাকবেন, ভাবিজি। আপনার দেবর কিন্তু মোটেও ভালো লোক না।”
রিদি এবার চোখ বড় বড় করে তাকাল, ঠোঁট শক্ত হয়ে উঠল। রাগে নাক ফুলে গেছে, দাঁত কিড়মিড় করে বললো,
“বজ্জাত বেটা!”
অতঃপর গটগট করে আহাদকে রেখেই রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো। আহাদ স্থির দাঁড়িয়ে রইল দরজার পাশে। তার প্রেয়সীর চলে যাওয়া পিঠের দিকে তাকিয়ে একাই বিড়বিড় করে বললো,
“অবশ্যই! বজ্জাত তো বটেই। তা না হলে তোমার বাপের চেয়েও এক ডিগ্রি ওপরে উঠতে পারতাম, জানু!”

এই নিস্তব্ধতার ভিতর দিয়েই কেটে যায় টানা দু’দিন। আদনান আর রিদিতার বিয়ে নিয়ে দু পরিবারেই হুলুস্তুল পরেছে। আজকে সকালেই রিদির ভাই ইব্রাহিম আর মামা নূরুল আমিন এসে হাজির হয়েছে। আর এক দিন বাকি বিয়ের অথচ রিদি যেনো প্রতিটা মুহূর্তে চেষ্টা করছে। এই বিয়েটা থেকে পালানোর পথ খুঁজছে। তার চোখে আতঙ্ক, মনে একটা অদ্ভুত স্থবিরতা। সে কোন ভাবেই এই বিয়ে করবে না, আর এটা শুধু ঘুরে ঘুরে বলছে ঈশানীকে। কারন আর কাউকে বলার সাহস তার নেই। যেখানে তার বাবা আহাদ রাজাকে পছন্দই করে না, সেখানে তার সাথে বিয়ের কথা বলা মানে তৃতীয় বিশ্ব যুদ্বের আগমনী বার্তা। একটু আগেই সবাই বিয়ের শপিং করে ফিরেছে কিন্তু রিদি যায়নি। অনেক বলার পরও সে নাকোচ করে দিয়েছে, শরীর খারাপ বলায় কেউ আর জোরও করেনি। এই মূহুর্তে ঈশানী বিয়ের শপিং গুছগাছ করছে, কার কোনটা সব ঠিক করছে। কিন্তু সেই কাজের ভেতরেই বারবার শুনছে রিদির গলা, একই কথা, একই কান্না, একই অনুনয়। ঈশানী এবার রেগে যায়, এক প্রকার ধমকে উঠলো,

“কি সমস্যা তোর? আমি আগেই বলেছি আমি এসবের মধ্যে নাই। তাহলে আমার কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করছিস কেনো? যা বলার ভাইয়াকে বা আব্বুকে বল।”
রিদির বুকটা কেমন ফেটে যাচ্ছে, চোখে পানি ছলছল করছে। এখনই টপকে পরবে এমন অবস্থা। সে ফুুঁপিয়ে উঠে বললো,
“আমি কি তোমার বোন না? আমার জন্য এতোটুকু করতে পারবে না?”
ঈশানী এক মূহুর্ত তাকিয়ে থাকে বোনের ভঙ্গুর মুখের দিকে। বুকের ভেতরটা কেমন হালকা ব্যথায় মোচড় দিয়ে ওঠে। দুই দিনেই তার বোনর নাজেহাল অবস্থা, চোখ মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। সে দ্রুত নজড় সরিয়ে চোখ মুছে গলা কাঁপিয়ে জবাব দিলো,
“না, আমি কিছু পারবো না।”
রিদি গাল বেয়ে টপটপ করে গরম অশ্রু গড়িয়ে পরলো। ঠোঁট চেপে কান্না সংযত করার চেষ্টা করলো, থেমে থেমে বললো,
“আমি আবারও বলছি বুবু! একটু সহোযগিতা করো প্লিজ। শুধু কোন ভাবে বিয়েটা বন্ধ করো, আর কিছু করতে হবে না।”

ঈশানী চোখের পানি মুছে বোনের দিকে তাকায়, তার কন্ঠে কঠোরতা,
“আমি বললেই এই বিয়ে বন্ধ হয়ে যাবে? কি বলে বিয়ে বন্ধ করবো? তুই আহাদ রাজাকে ভালোবাসিস, এটা বলে? আহাদ রাজার তো এতো ক্ষমতাবান, কই সে তো কিছু করছে না! এটার মানে সে তোকে ভালোবাসে না রিদি! তাহলে আমি কোন ভরশায় বিয়ে বন্ধ করবো। আর ওইদিন যখন বিয়ে ঠিক হয়েছে, তখন তোর মুখে ঠুলি পরেছে? তখন বলতে পারিসনি? এখন আমাকে কেনো এসব বলছিস? আমি কিছু করতে পারবো না। যা, এখান থেকে।”
কথাগুলো যেন ছুরির মতো গিয়ে বিঁধলো রিদির মনে।
তার ঠোঁট কাঁপছে, চোখ থেকে অনবরত অশ্রু গড়িয়ে পরছে। হঠাৎ নিচু হয়ে ঈশানীর পায়ের কাছে বসে প্যাচপ্যাচ করে নাক টেনে বললো,

“মরে যাবো আমি!”
ঈশানী ফোঁস করে হালকা হেসে বললো,
“এটা আমিও বলেছিলাম একসময়। কিন্তু দেখ, এখনো দিব্যি বেঁচে আছি, সংসার করছি মন দিয়ে।”
রিদি ঠোঁট ফুলিয়ে ফিসফিস করে বললো,
“আমি সত্যি সত্যি মরে যাবো, বুবু..”
“তাহলে মরে যা!”

এই তিনটা শব্দ যেন ঘরের সব নিস্তব্ধতা ছিঁড়ে দিল। ঈশানীর নিজেরও বিশ্বাস হয় না কথাটা তার মুখ ফস্কে বেরিয়েছে। সাথে সাথে মুখে হাত দিয়ে চেপে ধরে, চোখ বড় বড় করে তাকায় রিদির দিকে। রিদি স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে, চোখে বিস্ময় আর গভীর যন্ত্রণার ছোঁয়া। ভেতরে হাজারটা ভাঙা অনুভূতি। ঈশানীর সামনে থেকে ধীরেধীরে উঠে দাঁড়িয়ে পরে রিদি। শরীরটা কেমন ভার ছেড়ে দিয়েছে, আজ নিজেক অসহায় মনে হচ্ছে বড্ড অসহায়! ঈশানীর বুক কেঁপে ওঠে। অনুশোচনায় ভরে যায় পুরো মন। দ্রুত এগিয়ে গিয়ে বোনের হাত ধরতে চায়, কণ্ঠ কেঁপে যায়,

“রিদি, বোন দেখ। আমি এ এভাবে বলতে চাইনি, রাগের মাথায় কি বলেছি..”
রিদি ঝটকা মেরে তার হাত সড়িয়ে দেয়। চোখের পানি মুছে নেয় হাতের পেছন দিয়ে। একটা ভারী নিঃশ্বাস ফেলে দরজার দিকে এগিয়ে যায়। পা টেনে টেনে নিঃশব্দে রুম থেকে বেড়িয়ে আসে। যেন পৃথিবীর সব আলো পেছনে ফেলে চলে যাচ্ছে।

রাত তখন অনেকটাই গভীর, ঘড়ির কাঁটা একটারও বেশি পেরিয়ে গেছে। রাতের আকাশটাও আজ কেমন বিষন্ন, চারদিকে সব নিস্তেজ লাগছে। রিদিতা বারান্দার গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে বসে তাকিয়ে আছে সেই অসীম আকাশে। ঠাণ্ডা মৃদু হাওয়ায় তার চুলগুলো উড়ে এসে গাল ছুঁয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তার ভেতরের দাহটাকে নেভাতে পারলো না। সন্ধার পর কয়েকবার আহাদ রাজাকে সে কল করেছে। সেও তার কল রিসিভ করলনা। তবে কি সত্যিই আহাদ রাজা তাকে ভালোবাসে না? যদি তাই হয় তাহলে তার ওই গাঢ়ো বাদামি ঘন পাপড়িযুক্ত চোখে, সে কেনো একটুকরো প্রশান্তি খুঁজে পায়!

সে স্বীকার না করলেও, তার চোখের ভাষা তো অস্বীকার করা যায় না। তাহলে কেনো সে চুপ করে আছে? কেনো সবাইকে সব বলছে না? কেনো আমার মতো করে বলছে না, যে আমার রিদিকেই লাগবে? ভাবতে ভাবতে তার চোখের শীতল অশ্রু গড়িয়ে পরলো গাল বেয়ে। সে আর পারছে না ভাবতে, তার ভিতরটা জ্বলে যাচ্ছে। যন্ত্রণা হচ্ছে তার ভীষন যন্ত্রণা হচ্ছে!

অবেচেতন ভাবে তার চোখ গেলো নিচের দিকে। এক মূহুর্তের জন্য তার নিশ্বাস রোধ হয়ে আসে, সে কি ঠিক দেখছে? চোখ কচলে আবার তাকালো, আবছা আলোয় সেই অবয়ব চিনতে তার ভুল হলো না। আহাদ রাজা এসেছে, সত্যিই? রিদির নিস্তেজ মুখে হঠাৎ প্রাণ ফিরে এলো। তার শুকনো ঠোঁটে এক চিলতে হাসির রেখা ফুঁটে উঠলো। নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে এক দৌড়ে বাসা থেকে বেড়িয়ে গেলো। নিচে আসতেই দেখে আহাদ গাড়ির সাথে হেলে দাঁড়িয়ে আছে। রিদিকে দেখে সোজা হয়ে দাঁড়ায়, রিদি কেমন শুকিয়ে গেছে। মাএ দুই দিনেই এই অবস্থা? আহাদ তার প্রেয়সীর সেই ভঙ্গুর মুখের দিকে আর তাকিয়ে থাকতে পারলো না, নজড় সরিয়ে নিলো। রিদি ছোট ছোট পা ফেলে কাছে আসতেই, আহাদ দ্রুত ঘুড়ে গেলো। রিদি তার ভঙ্গুর কন্ঠে পিছু ডাকলো,
“যদি চলেই যাবেন, তাহলে এলেন কেনো?”

আহাদের বুকে সেই কন্ঠস্বর তীরের মতো বিঁধল। একটা ঢোক গলধঃকরণ করতে নিয়েও পারলো না। আটকে গেলো গলায়। বহু কষ্টে একটা শব্দ বের করলো,
“এমনই।”
রিদি আরেকটু কাছে গিয়ে আহাদের পিঠের দিকে তাকিয়ে ভাঙা ভাঙা শব্দে বললো,
“আল্লাহর দু নি য়ায় এমনই বলতে কিছু হয় না। কেনো এসেছেন? বলুন না?”
আহাদ বুকে ব্যাথা নিয়েও হেসে ফেলল, একটা করুণ, ভাঙা হাসি। তবে মূহুর্তেই হাসি মিলিয়ে গেলো। ছোট করে বললো,
“বললাম তো! এমনই।”

হঠাৎ পেছন থেকে নাক টেনে টেনে কান্নার আওয়াজ আসলো। আহাদ আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না, দ্রুত গাড়িতে উঠে মূহুর্তেই মিলিয়ে গেলো রাতের আলো আধারিতে। একবারও ফিরে তাকালো না রিদির দিকে, রিদি তখনও সেখানে পাথরের মূর্তির মতো দাড়িয়ে আছে। হঠাৎ পিছন থেকে ভেশে এলো একটা বিস্ময়কর কন্ঠ স্বর,
“রিদি!!”

রিদি ধীরেধীরে ঘুরে তাকালো, তানভীর দাঁড়িয়ে আছে মাএ কয়েক ফুট দূরে। রিদি যখন তড়িঘড়ি করে বেড়িয়ে আসে বাসা থেকে, তখন ড্রইংরুমে বসে বসে ফোন স্ক্রল করছিলো তানভীর। রিদিকে এভাবে এতো রাতে বাসা থেকে ছুটে বের হতে দেখে পিছু নেয়। আর এসে এমন কিছু দেখবে আশা করেনি। রিদির দিকে একটু এগিয়ে যায় তানভীর, রিদি তখনও একই ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। সব কিছু ঝিম দিয়ে আসছে। চোখের সামনে সব ঝাপসা। নিশ্বাষ নিতে কষ্ট হচ্ছে তার। বুকে চাপড়া মেরে জোড়ে জোড়ে কয়েকবার নিশ্বাষ নেয়ার চেষ্টা করলো। তানভীর কাছে এসে ধমকে উঠলো,

লাল শাড়িতে প্রেয়সী পর্ব ২৪

“এসব কী রিদি! তুই এতো রাতে বাইরে এসে…”
কথা শেষ হওয়ার আগেই ধপ করে রাস্তায় পরে যায় রিদি। কাটা মুরগির মত ছটফট করতে লাগলো। মুখ দিয়ে সাদা সাদা ফেনার মত কিছু একটা বের হয়ে আসছে। চোখ বড় বড় হয়ে গেছে, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। তানভীর এক মূহুর্তের জন্য থমকে যায়, রিদির এই ভ’য়ংক’র পরিনতি দেখে তার সমস্ত শরীর কেঁপে উঠলো।

লাল শাড়িতে প্রেয়সী পর্ব ২৬

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here