লাল শাড়িতে প্রেয়সী পর্ব ২৬
Fatima Fariyal
রাত যত গভীর হচ্ছে নিস্তব্ধতা ততই ভারী হয়ে নেমে আসছে শহরের বুকে। রাস্তায় ল্যাম্পপোস্টের হলুদ আভা কেবল ধোঁয়াটে আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে। চারদিকে নীরব, কিন্তু সেই নীরবতা হঠাৎই চিরে ফেললো তানভীরের চিৎকার,
“রিদি! রিদি কী হয়েছে তোর? চোখ খোল, চোখ খোল রিদি, রিদিইই!”
তানভীরের হাক ডাক চেঁচামেচিতে বাসা থেকে সবাই দৌড়ে বেড়িয়ে আসে। আর এসেই এই ভ’য়ংক’র দৃশ্য চোখে পড়ে, সবাই একসাথে জমে গেলো জায়গায়। রিদি রাস্তায় পরে ছটফট করছে, চোখ উল্টে যাচ্ছে, মুখ থেকে গুগানির মত আওয়াজ বেরোচ্ছে আর ফেনার মত থু থু বেড়িয়ে আসছে। একেকটা নিঃশ্বাস যেন মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে। ইব্রাহিম দৌড়ে এসে বোনের পাশে বসলো, তার মুখে হাত রাখতেই শরীরটা ঝাটকা মারলো, কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো,
“রিদি! রিদি আমার দিকে তাকা! কিছু হয়নি তোর, শান্ত হ, শান্ত হ, রিদি!”
ঈশানীর পা থেমে যায়। বুকের ভিতর আছড়ে পড়লো অজানা আতঙ্ক। ধীরেধীরে গিয়ে বসে রিদির মাথার কাছে। রিদির নিঃশ্বাস তখন ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছে। চোখের কোণে ঘন অশ্রু জমে আছে, মুখ কাঁপছে অদ্ভুতভাবে। ঈশানী হাত বাড়িয়ে বোনের মাথায় হাত রাখলো, এই তো ঘন্টা-খানেক আগেও সে বোনের মৃ’ত্যু চেয়েছে। যদিও ইচ্ছাকৃত ভাবে বলেনি, অথচ এখন তার বোন তার সামনে মৃ’ত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছে। ঈশানীর সামনে ছটফট করতে করতে একসময় নিস্তেজ হয়ে গেলো তার বোনের দেহটা।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
ঈশানী ঢোক গিলতে পারছে না, মনে হচ্ছে কেউ তার গলা টিপে ধরেছে। এমন দৃশ্য এই নিয়ে তৃতীয় বার তার চোখের সামনে ঘটছে। সে সব কিছু জেনে বুঝে কি করে পারলো বোনকে এমন কঠিন কথাটা বলতে। নিজের উপর খুব রাগ হলো, নিয়ন্ত্রণ হাড়িয়ে হু হু করে কেঁদে উঠল। ইতি মধ্যে সাইরেনের আওয়াজ ভেসে এলো। লাল আলো ঝলমল করে উঠলো রাস্তায়, এম্বুলেন্স চলে এসেছে। ইব্রাহিম দৃঢ় হাতে নিজের বোনকে তুলে নেয়। চারদিকে হাহা কার। ফরিদা বেগম উতলা হয়ে গেলেন, অঝরে কাঁদতে লাগলেন মেয়ের এই করুন অবস্থা দেখে। সুমন আর রিদির মামা মিলে সবাইকে সামলানোর চেষ্টা করছে। রিদির মামা নিজের ছেলের দিকে তাকিয়ে ধমকে উঠলেন,
“তানভীর, কী করেছিস ওর সাথে? ও কী দেখে ভ’য় পেয়েছে?”
তানভীরের চোখ ঝাপসা হয়ে এলো, তার চোখ এমন করুন দৃশ্য নিতে পারলো না। কয়েক ফোটা অশ্রুও গড়িয়ে পড়লো, রিদির উপাধি দেয়া শান্তশিষ্ট লেজ বিশিষ্ট তানভীরের। একটা ঢোক গলাধঃকরণ করে গলা কাঁপিয়ে বললো,
“আ.. আমি কিছু করিনি। আ.. আমি বুঝতে পারিনি এমন, এমন কিছু ঘটবে।”
“তুই কিছু না করলে ওর এই দশা কী করে হলো?”
“আমি সত্যিই কিছু করিনি। আমরা তো একটু হাটতে বেড়িয়েছিলাম শুধু, কিন্তু হঠাৎ করে ও পরে গিয়ে এমন..”
তানভীর সত্যিটা লুকিয়ে গেলো। রিদির যে আহাদ রাজার সঙ্গে দেখা করতে এসে এই ভ’য়ং’ক’র পরিণতি হলো, তানভীর চেয়েও বলতে পারলো না। নূরুল আমিন রাগে থরথর করে কাঁপতে লাগলেন, নিজের ছেলের দিকে তাকিয়ে আবারও ধমকে উঠলেন,
“এতো রাতে হাটতে বেড়নোর কী দরকার ছিলো! এখন দেখ মেয়েটার কী দশা হয়েছে, দেখ!?”
“ওর মন খারাপ ছিলো, তাই ভাবলাম..”
এমন সময় ইব্রাহিম ডাক দিলেন এম্বুলেন্সের ভিতর থেকে। তানভীর দৌড়ে গেলো সেদিকে। সাইরেনের শব্দ আবার বেজে উঠলো। এম্বুলেন্সটা লাল আলো ছড়িয়ে ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেলো রাতের অন্ধকারে।
হাসপাতালে ১০২ নাম্বার কবিনের সামনে অস্হির সময় পার করছেন রিদির পুরো পরিবার। ভিতরে রিদির মুখে অক্সিজেন আর হাতে সেলাইন। তার বুক ধীরে ধীরে উঠছে নামছে, যেন মৃত্যুর সাথে নিঃশব্দ যুদ্ধ চলছে। এমন সময় কেবিনের দরজা ঠেলে হাতের গ্লবস খুলতে খুলতে বেড়িয়ে আসে আদনান। আদনান গ্লাভস খুলে পাশের ট্রেতে রাখলো, একটা গভীর নিশ্বাস নিয়ে দেয়ালের সাথে হেলান দিলো। তার গলার শিরাগুলো টান টান হয়ে উঠেছে, মুখে ঘাম জমেছে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে একটা ভাড়ী নিশ্বাষ ফেললো। অবশেষে তারেক রায়ান আর ইব্রাহিমের দিকে তাকিয়ে নিচু কণ্ঠে বলল,
“এর আগেও কী এমন হয়েছিলো?”
তারেক রায়ান মাথা নেড়ে দৃঢ় স্বরে বললেন,
“হ্যাঁ, দু’বার হয়েছে। প্রথমবার হয়েছে ওর যখন নয় বছর বয়স তখন, এরপর অনেকদিন কিছু হয়নি। শুধু মাঝেমাঝে অচেতন হয়ে যেতো! পাঁচ-দশ মিনিট, কখনো আধঘণ্টা, এরপর ঠিক হয়ে যেতো। শেষ তিন বছর আগে এমন হয় আর আজকে নিয়ে তৃতীয়বার।”
আদনান ঠোঁট কামড়ে ধরলো, তার চোখে যেন অপরাধবোধের ছাঁয়া ঘন হয়ে উঠেছে। সে মাথা নিচু করে, একবার নিজের ভেতর খুইয়ে গেলো। সে ভালো করেই জানে, এটাকে এপিলেপসি বলে, এমন তখনই হয় যখন কোন কারনে ভ’য় পায় কিংবা মস্তিষ্কে অনেক বেশি চাপ সৃষ্টি হয়। অথবা অক্সিজেনের ঘাটতি বা মানসিক ধাক্কা, বা ট্রমা থেকেও এমন হতে পারে। আবার র’ক্তে শর্করার অস্বাভাবিকতার কারনও হতে পারে। সে চোখ তুলে ভ্রু গুছিয়ে ইব্রাহিমের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,
“প্রথম যখন হয়েছে, তখন কী অস্বাভাবিক কিছু ঘটেছিলো?”
“হ্যাঁ,ওর চোখের সামনে একটা মারামারি হয়েছিলো… একজনকে র’ক্তা’ক্ত অবস্থায় দেখেছিলো, আর তারপরই হঠাৎ এমন খিঁচুনি উঠে। তখন খুব ভ’য় পেয়েছিলাম।”
“ডাক্তার দেখাননি তখন?”
“দেখিয়েছি! ডাক্তার বলল, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ধীরেধীরে ঠিক হয়ে যাবে। শুধু সাবধানে থাকতে হবে।”
আদনান চোখ বন্ধ করলো। একটা তীব্র নিঃশ্বাস বুকের গভীর থেকে বেরিয়ে এলো। তার মনে হলো, ঘাড়ের পেছনে কেউ পাথর বেঁধে দিয়েছে। নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে। সব কিছু জেনে শুনে এমন সিদ্ধান্ত নেয়া তার মোটেও উচিৎ হয়নি। সে ধীর কন্ঠ ধীর করল,
“আমি কিছু ওষুধ দিয়ে দিয়েছি, চিন্তায় কারন নেই। রিদি এখন অনেকটাই সুস্থ। সকাল পর্যন্ত সব ঠিক হয়ে যাবে, ইনশাআল্লাহ।”
“ইনশাআল্লাহ।”
সবাই একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। কিন্তু আদনান সেই স্বস্তির অংশ হতে পারলো না। তার চোখে যেন এক অব্যক্ত জ্বালা, ভিতরটা জ্বলছে দাউদাউ করে। আজকে শুধু মাত্র তার জন্য রিদির এই অবস্থা। আহাদের সাথে বাজি আর নিজের ভালোবাসা হাসিল করার লোভে এতোবড় সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাদের দুই ভাইয়ের লড়াই মেয়েটার উপর কেমন প্রভাব পরতে পারে, সেটা একবারও চিন্তা করেনি। এতোটা নির্দয় সে কবে হলো? ভাবতে ভাবতে হাসপাতাল থেকে দ্রুত বেড়িয়ে আসে আদনান। তখন রাতের শেষ প্রহর চলছে, পার্ক করা গাড়ির সাথে হেলে বিষণ্ণ আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ জোড়া ভিজে উঠেছে অজান্তেই, বুকে একটা তীব্র ব্যাথা অনুভব করলো। সে তো এমনইতেও রিদিকে বিয়ে করতো না! শুধু আহাদকে জব্দ করে আহিয়াকে চেয়ে নিতো। কিন্তু এখন সব কিছু ওলট-পালট হয়ে গেলো। তার করা একটা ভুল সিদ্ধান্তের জন্য কতগুলো জীবন কষ্ট পাচ্ছে। এখন রিদি সুস্থ হলে সে কী করে রিদির সামনে গিয়ে দাঁড়াবে! কী করে ক্ষমা চাইবে। সব থেকে বড় কথা রিদির বাবাকে এখন কী জবাব দিবে? কী বলবে, যে আমি আপনার মেয়েকে বিয়ে করবো না?
আদনাদ প্রচণ্ড মাথা যন্ত্রণায় কপাল চেপে ধরলো, শার্টের কলার টেনে একটু স্বস্তির নিশ্বাষ নেয়ার চেষ্টা করলো। তবে পারলো না, একটা নিশ্বাষ বুকে এসে আটকে গেলো তার। সে এখন কী করবে? একদিকে নিজের এতো বছরের ভালোবাসা না পাওয়ার যন্ত্রণা! অন্যদিকে অপরাধ বোধ। সব মিলিয়ে যেনো ধংসাত্বের কাঠগরায় দাঁড়িয়ে আছে। আর সহ্য করতে না পেরে পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে কাঁপা কাঁপা হাতে জ্বালিয়ে নিলো। প্রথম ধোঁয়ার কুণ্ডলী ছাড়তেই মনে হলো, ভিতরের যন্ত্রণা যেন আরো গভীর হয়ে উঠেছে। মাথা উঁচু করে তাকিয়ে রইলো আকাশের দিকে।সেখানে অসীম অন্ধকার, একটাও তারা নেই। শুধু ফ্যাকাশে চাঁদ ধূসর আলো ছড়িয়ে রেখেছে বিষণ্ণ জগতের বুকে।
ভোরের আলো তখন পুরোপুরি ছড়িয়ে পড়েছে। মীর হাউজের হলঘরে নরম সোনালি আলো ঢুকছে জানালার পর্দার ফাঁক দিয়ে। হালিমা বেগম সকালে উঠে তড়িঘড়ি করে রুম থেকে বেরিয়ে আসতেই তার পা থমকে যায়। হলঘরের দৃশ্য দেখে তার চোখ কপালে উঠে গেলো। হলঘরের অবস্থা একেবারে যুদ্ধক্ষেত্রের মতো। সোফার কুশন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, সেন্টার টেবিলে বই আর কাগজ পত্র ছড়ানো। আর সব থেকে বিস্ময়কর হলো, সোফার উপর বুঁদ হয়ে পরে আছে আহাদ। তার চুল এলোমেলো, মুখে ক্লান্তির ছাঁপ, এক হাত নিচে ঝুলে মেঝেতে এসে ঠেকেছে। হাতের কাছে একটা অ্যা’ল’কো’হ’লে’র শেষ হওয়া বোতল। হালিমা বেগমের বুকটা কেঁপে উঠলো। আহাদের এই অবস্থা তার জন্য নতুন নয়, তবে আজকে একটু বেশিই ছন্নছাড়া লাগছে। হালিমা বেগম দ্রুত দৌড়ে আসে, এক হাত রেখে কাঁদ ঝাঁকিয়ে ডাকলেন,
“আহাদ! আহাদ বাবা, উঠ।”
কোনো সাড়া নেই। হালিমা বেগম এবার কিছুটা জোরে কাঁধ ঝাঁকালেন। আহাদ এবার একটু নড়েচড়ে উঠলো, চোখ আধখোলা, মাথা ভারী, হালকা হাত উঁচু করে ঘুম আর নেশায় ভরা কন্ঠ,
“উহুমম।”
একটা অস্পষ্ট শব্দ করে আবার ভাড়ী নিঃশ্বাস ফেলল সে।হালিমা এবার একটু কড়া গলায় বললেন,
“এ কী হাল করেছিস নিজের? আপা দেখলে রেগে যাবে তো! উঠ না, অনেক দেরি হয়ে গেছে।”
কিন্তু তার কোন নড়চড় নেই, এমন সময় আসফাক মীরও পাঞ্জাবির হাতা গুটাতে গুটাতে বেড়িয়ে আসে। আহাদকে এমন অবস্থায় দেখে তার মুখের রঙ পাল্টে গেল। সামনে থাকা অ্যা’ল’কো’হ’লে’র বোতল টা পা দিয়ে সরাতেই গরগর শব্দ করে গড়িয়ে দূরে সরে গেলো। আহাদের দিকে ঝুঁকে বিদ্রুপ মাখা গলায় ডেকে উঠল,
“এই যে ভবিষ্যৎ মন্ত্রী মশাই! পরে পরে ঘুমাবেন নাকি দেশে আর দেশের জনগন নিয়েও একটু চিন্তা ভাবনা করবেন।”
তার কণ্ঠের প্রতিটি শব্দে ছিল তীব্র ব্যঙ্গ। আহাদ এবার মাথা কাত করে এক চোখ খুলে তাকালো চাচার দিকে। চোখে লালচে রেখা, মুখে বিরক্তিকর ছাঁয়া। কিন্তু চাচার কথায় প্রতিবাদ করার ইচ্ছা বা শক্তি কোনটাই নেই তার। আসফাক মীর তখন আবার খেঁকিয়ে উঠল,
“দেবদাস হয়ে পরে থাকবি নাকি যাবি। ভাইজান অলরেডি কয়েকবার কল দিছে। এমন একটা দিনেও তুই নে’শা করে বসে আছিস!”
আহাদ এবার তড়াক করে উঠে বসলো। মাথা ঝাঁকিয়ে নিয়ে চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিজের অবস্থান বোঝার চেষ্টা করল। তখনই মনে পড়লো, গতকাল রাতের ঘটনা। রিদির সাথে দেখা হওয়ার পর নিজেকে সামলতে না পেরে একরকম পালিয়ে এসেছে। তার প্রেয়সীর সেই ভঙ্গুর মুখ দেখে নিজের বুকে একটা চাপা যন্ত্রণা হচ্ছিল, তাই সে যন্ত্রণা কমাতে অ্যা’ল’কো’হ’লে’র বোতলে একের পর এক চুমুক দেয়। বাসায় ফিরেও নিজেকে থামাতে পারেনি, মাত্রা হারিয়ে সব কিছু এলোমেলো করে দিয়েছে। তার প্রভাবে এখনও তার মাথাটা ঝিমঝিম করছে। আসাফাক মীর তাড়া দিতেই আহাদ কোন রকম নিজেকে সামলে উপরে চলে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই তৈরি হয়ে আবার নিচে নেমে আসে। এরপর আসফাক মীরের সাথে দ্রুত বেড়িয়ে যায়।
হালিমা বেগম রিতুকে ডেকে হলঘর ঠিক করতে বললেন। তার মনটা ভাড়ী হয়ে আছে, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালেন। এমন সময় বাহিরে থেকে আদনানকে আসতে দেখে একটু অবাক হয়ে যান। আদনান ধীরেধীরে উপরের দিকে যাচ্ছিল। তখনই তিনি বিস্মিত স্বরে পিছু ডাকলেন,
“আদনান! কোথায় গেছিলে তুমি?”
আদনানের পা থেমে যায়, ধীরে ঘুরে তাকায় হালিমা বেগমের দিকে। তার চোখে একরাশ অনুশোচনা, মুখে ক্লান্ত বিষণ্ণতা। হালিমা তাকে চুপ থাকতে দেখে আবারও প্রশ্ন করলেন,
“আদনান, তোমাকে এমন লাগছে কেনো? কী হয়েছে, কোথায় ছিলে তুমি?”
একটা ভারী নিশ্বাষ ছাড়লো আদনান। অতঃপর এক কদম এগিয়ে এসে নিচু স্বরে বললো,
“হাসপাতালে, রিদি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো।”
হালিমা বেগম এই কথা শুনে চমকে গেলেন। উদ্বকন্ঠা গলায় জানতে চাইলেন,
“হাসপাতালে? কী হয়েছে রিদির?”
“এপিলেপসি অ্যাটাক হয়েছিলো, তবে চিন্তার কারন নেই। এখন ঠিক আছে, বাসায় আছে।”
কথা শেষ করে দ্রুত উপরে উঠে গেলো। হালিমা বেগম যতটা উতলা হয়েছিলো, রিদি ঠিক আছে শুনে একটু স্বস্তি পেলো। তবে আদনানের চোখের ভাষা বুঝতে পারলেন না।
শুধু তাকিয়ে রইলেন তার পেছনে।
রিদিতা বসে আছে নিজের রুমে, জানলার গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে। এক হাতে গালে ভর, অন্য হাতটা ঢিলেঢালা ভঙ্গিতে নিচে ঝুলে আছে। চোখের দৃষ্টি স্থির, অথচ শূন্য।
গোটা জগতটা তার কাছে বিষাদময় লাগছে। আশেপাশের কাউকেই সহ্য হচ্ছে না তার। রাইসা কয়েকবার এসে ডেকে গেছে কিন্তু রিদির যেনো চোখের পলকও পড়লো না। চেতনা ফেরার পর থেকে ঈশানীর সাথে একটা কথাও বলল না। সবার কথার জবাব হু হা তে দিলেও ঈশানীর কোন কথার জবাব দিলো না। ঈশানীর প্রতিবার ব্যার্থ হয়েছে, শেষবার তো তার মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। এখন আবার দরজায় কড়া পরতেই রিদি বিরক্ত হয় খানিকটা। চোখ কুঁচকে তাকালো দরজার দিকে। মনে মনে ভাবল, নিশ্চয়ই ঈশানী আবার এসেছে। তাই থ মেরে বসে রইলে, কিন্তু আবারও জোরে করাঘাত পরতেই রিদি রেগে গিয়ে দরজা খুলতে খুলতে ঝাঁজ মেশানো গলায় খেঁকিয়ে উঠল,
“কি সমস্যা? আমি তো বলেছি ভালো লাগছে ন..”
কথা সম্পুর্ন করার আগেই থেমে গেল। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে ইব্রাহিম। তাকে দেখে রিদির মুখের অভিব্যক্তি বদলে গেল তৎক্ষণাৎ, ধীরে গিয়ে বিছানার কোনায় বসলো। দুই হাত জড়ো করে রাখল কোলের মধ্যে। ইব্রাহিম এক মূহুর্ত তাকিয়ে থেকে এসে বোনের পাশে বসল। এভাবে নীরবে কেটে গেলে কয়েক সেকেন্ড। এবার ইব্রাহিম বোনের দিকে তাকিয়ে স্নেহময় কন্ঠে বললো,
“আজকে উপলব্ধি করতে পারলাম, আমার ছোট্ট বোনটা সত্যিই বড় হয়ে গেছে। কথা লুকাতে শিখে গেছে, আবদার করা ভুলে গেছে।”
রিদি কোন কথা বলল না, চোখের দৃষ্টি তখনও নিচের দিকে, কিন্তু চোখের কোণে অজানা এক ঝিলিক। শুধুু চুপচাপ শুনতে লাগলো। তার কণ্ঠটা ধীরে ধীরে ভারী হয়ে এল, একটু নিরব থেকো জিজ্ঞেস করলো,
“রিদি! আমি জানিনা না তোর কি হয়েছে! কেনো তোকে আবারও সেই যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে! আমি শুধু এটুকু বলতে চাই, তোর কিছু বলার থাকলে, চাওয়ার থাকলে, নির্দিধায় বল। আমি ভাইয়া সবটুকো দিয়ে চেষ্টা করবো তোর ইচ্ছা পূরুন করার। ঠিক আগের মত।”
রিদির শরীর হালকা কম্পিত হলো, একচিলতে দ্বীধা নিয়ে ওষ্ঠজোড়া চেপে রাখলো। যেন ভেতরের কান্নাটা আটকে রাখতে চায়। মনে মনে বিড়বিড় করলো,
“আমি কী আবাদার করবো, আবদার করে কাকে চাইবো!যাকে চাইবে সেই তো আমাকে ফেলে চলে গেছে। সে তো আমাকে চায়না!”
ইব্রাহিম বুঝতে পারল বোনের ভেতরের টানাপোড়েন। সে ধীরে রিদির কাঁধে হাত রাখল, মৃদু কণ্ঠে জানতে চাইলো,
“কী হলো? শরীর খারাপ লাগছে?”
রিদি হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখ মুছে মাথা নাড়লো,
“না। কিছু না, আমি ঠিক আছি ভাইয়া। আমাকে নিয়ে শুধু শুধু চিন্তা করার দরকার নেই।”
“ঠিক আছে, তুই রেস্ট কর। কিছু লাগলে বলিস।”
চোখের ইশারা করতেই ইব্রাহিম রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। রিদি বুকের ভেতর আবারও সেই অস্বস্তিকর ব্যাথা জেগে উঠল। রিদি বিছানা থেকে নেমে মেঝেতে বসে পড়ল, চিবুক ঠেকায় বেডের কর্নারের সাথে। সামনে থাকা ফোনটা হাতে নিয়ে আহাদের একটা ছবি বের করে স্থির নয়নে তাকিয়ে রইলো। এই মানুষটার জন্য এতো এতো ভালোবাসা তার বুকে কখন, কবে বাসা বাঁধলো? এই প্রশ্নের উওর সে নিজেও দিতে পারলো না। ধীরে ধীরে আঙুল বাড়িয়ে দিলো স্ক্রিনের দিকে। আহাদের মুখের উপর আঙুল রেখে স্পর্শ করল হালকা করে। স্ক্রিনের ঠান্ডা আলোয় আঙুলের ডগা কেঁপে উঠল। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বিড়বিড় করলো,
“আপনি যদি আমার না হোন,
তাহলে সুখের অসুখ হোক আপনার নিত্য সঙ্গী।
জ্বলতে জ্বলতে বুঝুন ভালোবাসা কাকে বলে!
না পাওয়ার আগুনে পুড়ুক আপনার নিঃশ্বাস,
যেভাবে আমি পুড়ছি আপনার নিঃস্পৃহ নির্বাস।”
এই কথা গুলো বলতে গিয়ে ঠোঁট কাঁপলো রিদির, চোখ থেকে শীতল অশ্রু গড়িয়ে পরলো। জানলার পর্দার ফাঁকা দিয়ে বিকেলের এক ফালি কমলা রোদ এসে পরলো তার মুখে। হাত বাড়িয়ে সেই আলোটাকে ছুঁয়ে দিতে চাইলো, কিন্তু স্পর্স করতে পারলো না। অবচেতনভাবেই ঠোঁটের কোনে একটা শুকনো হাসি ফুটালো।
রাত তখন প্রায় দশটা। মীর হাউজে একরকম থমথমে নীরবতা, সময়ও যেন দাঁড়িয়ে গেছে। ঝাড়বাতির নিচে এক অজানা উত্তাপ ছড়িয়ে আছে চওড়া মার্বেলের মেঝেতে। আফরোজা শেখ থ মেরে বসে আছেন নিজের নির্দিষ্ট চেয়ারে। চোখেমুখে ক্ষোভের আগুন। তার পাশে হালিমা বেগম দাঁড়িয়ে আছে অজানা আশঙ্কা নিয়ে। আদনান সামনের সোফায় বসে আছে শিঁড়দাড়া সোজা করে, তার ঠোঁটে অনড় সিদ্ধান্ত। সে রিদিকে বিয়ে করবে না। আর এ কথাটা আফরোজা শেখের উপর বাজের মত প্রভাব ফেলেছে। ক্রোধে সমস্ত শরীর শক্ত হয়ে গেছে, দাঁত চেপে গর্জে উঠলেন,
“এসব কী ধরনের কথা বলছো আদনান? আগামিকাল বিয়ে আর আজ বলছো তুমি বিয়ে করবে না! এটা কী পুতুল খেলা পেয়েছো?”
আদনান ফু্ঁস করে নিশ্বাষ ছেড়ে বললো,
“সরি ছোট আম্মা! কিন্তু আমি এ বিয়েটা করতে পারবো না।”
আফরোজা শেখ চেয়ার থেকে সামান্য ঝুঁকে পড়লেন,
“কেন? কেন করতে পারবে না! কারণ জানতে চাই আমি। ভনিতা না করে সরাসরি উওর দাও।”
আদনান এক মূহুর্ত দ্বীধায় পরে, শার্টের কলার ঠিক করে একটু নড়েচড়ে বসলো। এক ঝলক আহিয়ার দিকে তাকিয়ে আবার দৃষ্টি সরাল আফরোজা শেখের মুখে। জ্বিব দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে কিছু একটা বলতে উদ্যত হয়। তবে তার আগেই ঝড়ের বেগে আহাদ এসে আদনানকে ছো মেড়ে বসা থেকে টেনে তোলে। কোন অগ্রিম বার্তা ছাড়াই আদনানের মুখে একের পর এক ঘু’ষি বসিয়ে দেয়। তার মুখে তখন আগুন জ্বলছে, চোখে হিং’স্র উন্মাদনা। আজকের নির্বাচনে জয় পেয়েছে তাদের দল। বিজয়ী হওয়ার পর সংসদ থেকে বের হতেই শাহীন খবর দিলো রিদির ব্যাপারে। সাথে সাথে আহাদের শরীরে ক্রোধ ঝলকানি দিয়ে উঠলো। সবকিছু পেছনে ফেলে দিয়ে ছুটে আসে, আর এসেই এই বিস্ফোরণ। আদনানের উপর ঝাঁপিয়ে পরে মূহুর্তে, আহাদের হঠাৎ এমন কান্ডে উপস্তিত সবাই হত্ববিল হয়ে যায়। আহাদ এবার সিংহের মতো গর্জন করে উঠল,
“তোর সাহস হলো কী করে, হ্যাঁহ! সাহস হলো কী করে আহাদ রাজার থেকে তার প্রেয়সীকে ছিনিয়ে নেওয়ার!”
এই বলে আরো একটা ঘুষি বসিয়ে দেয়। আদনান টাল খেয়ে মেঝেতে পড়তে পড়তে নিজেকে সামলালো। প্রচণ্ড রাগে বুক উঠা নামা করছে তার, আবার আদনানের কলার টেনে ধরলো। দঁতে দাঁত চেপে গর্জে উঠল,
“তোর জন্য, শুধুু মাত্র তোর জন্য আজকে রিদির এই অবস্থা। মেরে ফেলবো তোকে আমি!”
আফরোজা শেখ এগিয়ে ছাড়ানোর চেষ্টা করেন। তবে ব্যার্থ হয়ে একরকম ধমকে উঠলেন,
“আহাদ, ছাড়ো ওকে। কী করছো? ছাড়ো বলছি!”
আহাদ জলন্ত চোখে তাকায় মায়ের দিকে, কপালের শিরাগুলো নীলচে বর্ন ধারন করেছে। চোয়াল শক্ত, দাঁত কিড়মিড় করছে, কিন্তু আদনানকে ছাড়লো না। এমন সময় বাহির থেকে দৌড়ে আসে আমজাদ মীর আর আসফাক মীর। আদনান এবার ঝটকা মেরে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে শার্ট ঠিক করতে করতে বললো,
“আমি জানতাম না রিদির এমন কিছু হতে পারে।
জানলে আমি কখনোই রাজি হতাম না।”
আহাদ আবার তেড়ে যায় তার দিকে, তবে মাঝখানে বাধ সেজে দাঁড়ায় আসফাক মীর। এতে আহাদ চাচার উপর ফুঁসে উঠলো,
“চাচুউউউ! সরে যাও সামনে থেকে। আমি ওকে মেরে চালের ড্রামে ঢুকায়া রাখবো বলে দিলাম।”
“চুপ থাক! আসছে, চালের ড্রামে ঢুকায়া রাখতে!”
আসফাক মীর হালকা ধমকের সুরে বললেন কথাটা। কিন্তু এতে আহাদের কোন হেল দেল নেই। সে সজোরে একটা লাথি মারলো ডান পাশের সোফায়। সোফাটা হালকা কাত হয়ে পড়লো, হালিমা বেগম আর আহিয়া ভ’য় পেয়ে একটু পিছিয়ে গেলো। আফরোজা শেখ এবার গর্জে উঠলেন,
“তুমি কী পাগল হয়ে গেছো? এইভাবে হিংস্র পশুর মতো আচরন করছো কেনো?”
আমজাদ মীর ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে উঠলেন,
“হাহ! নিজের ছেলের না হওয়া বউকে ভাসুরের ছেলের হাতে দিতে চাও, আর ভাবছো তোমার ছেলে ভেজা বেড়াল হয়ে সেটা দেখবে?”
স্বামির এই কথায় বিচলিত হলেন না। বরং একটুখানি সোজা হয়ে বসলেন, মুখে কঠোরতা এনে বললেন,
“তাহলে আমি যেটা সন্দেহ করেছিলাম, সেটাই ঠিক।”
বরং তার এই কথায় সবাই চমকে তাকায় তার দিকে। আমজাদ মীর ভ্রু কুচঁকে জিজ্ঞেস করলেন,
“মানে! তুমি জানতে?”
হালকা হাসলো আফরোজা শেখ,
“এমনি এমনি তো আর নাম করা ল’য়ার এর অ্যাওয়ার্ড পায়নি। সন্দেহ আমার সেদিনই হয়েছে। আজ নিশ্চিত হলাম।”
মায়ের কথা শুনে আহাদের রাগ চরম পর্যায় এবার পৌঁছে গেলো। হাতের কাছে থাকা ফুলদানি তুলে ছুড়ে মারলো আদনানের দিকে। আদনান নিচু হয়ে নিজেকে আত্মরক্ষা করলেও ফুলদানি ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হলো দেয়ালে। সবাই বুঝতে পাড়লো মায়ের রাগ আদনানের উপর ঝারছে। কিন্তু আদনান কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না, কারন সে জানত এমনই কিছু ঘটবে। তাছাড়া তার বলার ভাষা নেই। আহাদ তো ঠিকই বলেছে সব তার জন্যই হয়েছে। আমজাদ মীর এবার দৃঢ় কন্ঠে বললেন,
“এবার যখন নিশ্চিত হয়েছো? তখন এই বিয়ের গুটি ঘুড়িয়ে দাও আফরোজা। তা না হলে আবার আমার বিয়ের গুটি ঘুড়ে যাবে।”
“মানে.!”
ভ্রু কুচঁকে জানতে চাইলো আফরোজা শেখ। আমজাদ মীর ছেলের দিকে তাকালেন, দু’বার গলা খাঁকরি দিয়ে বললেন,
“কিছু না, তুমি রিদির বাবাকে ফোন করে বলে দাও। এই বিয়ে হবে না।”
“বিয়ে হবে, আর কালই হবে।”
আহাদের কর্কশ কন্ঠে বজ্রপাতের মত চমকে যায়। আহাদ দু দিকে ঘাড়টা ঘুড়িয়ে নিয়ে আড়াম নেয়ার চেষ্টা করে। অতঃপর ধীরে সোফায় গিয়ে বসল, পা তুলে, দুই হাত ছড়িয়ে। আসফাক মীর কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো,
“কাল বিয়ে হবে মানে? তুই চাইছিস টা কী বল তো!”
আহাদ এক ঝলক সবার দিকে তাকালো, চোখে এক অদ্ভুত দীপ্তি। একটা রহস্যময় হাসি দিয়ে বললো,
“বউ চাই চাচুউউউ! কিন্তু আমার না হওয়া বউয়ের এক মাত্র বাপটা আমার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে কিছুতেই আমার আর রিদির বিয়ে মেনে নেবে না।”
আহিয়া বিস্মিত হয়ে ভাইয়ের পাশে বসলো। উৎকণ্ঠা স্বরে জানতে চাইলো,
“তুমি কী করে বুঝলে ভাইয়া?”
আহাদ একটা বাঁকা হাসি দিয়ে বললো,
“সেদিনই বুঝে গেছি, যখন শ্বশুরমশাই আমাকে তার মেয়ের কাছ থেকে দূরে থাকতে বলেছিলেন। তার চোখে আমার প্রতি এমন একরাশ বিরক্তি দেখেছি।”
আসফাক মীর এবার কাছে এসে বললো,
লাল শাড়িতে প্রেয়সী পর্ব ২৫
“তাহলে এবার কী করবি?”
“বেশি কিছু না চাচু। জাস্ট ছোট্ট একটা ডেমো দেখাবো শশুড়মশাইকে।”
বলেই একটা বাঁকা রহস্যময় হাসি দিলো আহাদ। অতঃপর উঠে একরকম হাত পা ছুড়ে একরকম নাচতে নাচতে উপরে চলে গেলো। মুখে একটা গুনগুনি শোনা যাচ্ছে। পেছনে সবাই হতভম্ব মুখে তার চলে যাওয়া ভঙ্গিমার দিকে তাকিয়ে রইল।