লাল শাড়িতে প্রেয়সী পর্ব ২৭
Fatima Fariyal
আহাদ উপরে যেতেই পুরো হলঘরে ক্ষণিকের জন্য নিস্তব্ধতা ভর করে। আফরোজা শেখ ভারি নিঃশ্বাস ফেলে বসলেন নিজের চেয়ারে। তার কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ, চোখের কোণে রাগ আর অসহায়তার মিশ্র ছাঁপ। একরকম দোটানায় পড়লেন। এক হাতে কপাল চেপে ধরলেন, যেনো নিজের ধৈর্যটাকে সামলা দেয়ার চেষ্টা করছে। আমজাদ মীর ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে তার পাশে বসলেন। স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। অতঃপর মৃদু কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
“কী ভাবছো আফরোজা? তোমার মুখটা এমন দেখাচ্ছে কেনো?”
আফরোজা শেখ স্বামির কথায় মাথা তুলে তাকায় তার দিকে। চিকন ফ্রেমের চশমটা দু আঙুল দিয়ে ঠেলে ঠিক করে নিয়ে বললেন,
“ভাবছি… এখন রিদিতার বাবাকে কী জবাব দেবো।”
আমজাদ মীর হালকা হাসলেন, যেন কিছুই ঘটেনি। এমন ভঙ্গিতে বললেন,
“এটা নিয়ে এত ভাবাভাবির কী আছে, আফরোজা? যা হওয়ার কথা ছিল, সেটাই হচ্ছে।”
কথাটা শুনেই আফরোজা শেখের ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেল। ঠোঁটে ক্ষীণ রাগের রেখা ফুটে উঠল। কণ্ঠে গাম্ভীর্য আর অভিমান মেশানো স্বর,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
“সব চিন্তা ভাবনা তো আমারই, তাই না? আমি রিদিতার বাবাকে ডেকেছি, বিয়ের কথাবার্তা আমি বলেছি। এখন প্রতারণাও আমিই করছি! আর এই সবকিছু হয়েছে আপনার জন্য, মন্ত্রী মশাই!”
আমজাদ মীর একটু হকচকিয়ে বললেন,
“যাক বাবা! আমি আবার কী করলাম? ছেলের যত দোষ সব আমার ঘাড়ে চাপাচ্ছো?”
আফরোজা শেখ এবার স্বর উঁচু করলেন,
“আপনি সব জানতেন! আপনি যদি আমাকে আগেই বলতেন, তাহলে পানি এতদূর গড়াত না! এখন আমি রিদিতার বাবাকে মুখ দেখাব কীভাবে? তারা কী ভাববে আমার সম্পর্কে, একজন আইনজীবী হয়েও আমি প্রতারণা করেছি তাদের সাথে!”
আমজাদ মীর নিরুপায় কণ্ঠে বললেন,
“তোমার ছেলে আমাকে হুমকি দিয়ে মুখ বন্ধ করে রেখেছিল আফরোজা। কী করে বলতাম! আর প্রতারণা কেনো বলছো? বিয়ে তো হচ্ছেই।”
“হচ্ছে, কিন্তু যেভাবে হচ্ছে তা প্রতারণা ছাড়া কিছু না! এক ছেলেকে দেখিয়ে অন্য ছেলের সঙ্গে বিয়ে! ভাবতেই পারছি না আমি… কী যে হবে, আল্লাহই জানে।”
আহিয়া তখন পাশে বসে কথা শুনছিলো, মায়ের এ কথা শুনে হালকা হেসে বললো,
“কি আর হবে! দুই আধ পাগল মিলে এখন পুরা পাগল হবে!”
হলঘরের এক কোণে বুকশেলফে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল আদনান। আহিয়ার কথায় তার ঠোঁটের কোণে হালকা এক তির্যক হাসি ফুটে উঠল। আসফাক মীর এতক্ষণ চুপচাপ বসে ছিলো। এবার আফরোজা শেখ কে শান্তনার আশ্বাস দিয়ে গম্ভীরভাবে বললো,
“তুমি এটা নিয়ে শুধু শুধু চিন্তা করো না তো ভাবি! যা হওয়ার হবে, সেটা সময় হলে দেখা যাবে।”
“আসফাক ঠিকই বলেছে, তুমি চিন্তা করো না। ভরশা রাখো আমার উপর।”
এই বলে তিনি স্ত্রীর হাতে আশ্বাসের হাত রাখলেন। আফরোজা শেখ আর কিছু বললেন না। চোখ বন্ধ করে পিছনে চেয়ারে একটু হেলে বসলেন। যেন ভেতরের অস্থিরতাকে সামলে নিচ্ছেন। আসফাক মীর এবার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা হালিমা বেগমের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে নিজের রুমে চলে গেলেন। দুই মিনিটও যায়নি, ঘর থেকে চিৎকার ভেসে এল,
“হালিমা! হালিমা! একটু আসো তো!”
হালিমা বেগম তখন গ্লাসে পানি ঢালছিলেন। আহিয়ার হাতে গ্লাসটা দিয়ে তাড়াহুড়ো করে এক প্রকার দৌড়ে গেলেন। রুমে ঢুকেই থমকে গেলেম, পুরো ঘর এলোমেলো করে কাপড় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছে। হালিমার চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেলো,
“এ কী হাল করেছো ঘরের!”
আসফাক মীর আলমারির সামনে দাঁড়িয়ে বিরক্ত মুখে ঘুরে তাকালেন,
“আমার ক্রিম কালারের পাঞ্জাবি কই? পাচ্ছি না কেনো?”
হালিমা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে মেঝেতে পড়ে থাকা কাপড় তুলতে তুলতে বললেন,
“বানি আপার ছেলেকে দিয়ে দিছি।”
সাথে সাথে আসফাক মীর চেঁচিয়ে উঠলো,
“কীহ! আমি একদিনও পড়লাম না। আর তুৃমি সেটা দিয়ে দিলা!”
“পড়ো না বলেই তো দিয়ে দিছি! অযথা পরে আছে।”
“অযথা! আমি এখন কী পরে যাব তোমার গুণধর ভাতিজার বিয়েতে, হেহ?”
হালিমা কপাল ভাঁজ করে বললেন,
“কেনো, তোমার কাপড়ের অভাব? তাহলে আমার একটা শাড়ি যাও।”
আসফাক মীর স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে হালিমার দিকে। হালিমা কাপড় গুছাতে ব্যস্ত থাকার ভান করলেও বুঝতে পারছিলেন স্বামীর দৃষ্টি তার ওপর স্থির হয়ে আছে। শেষে বিরক্ত হয়ে হাতের কাপড় গুলো আলমারিতে রেখে ঘুরে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,
“এই ভাবে তাকিয়ে আছো কেনো? চোখ দিয়ে গিলে খাবা নাকি?”
“এভাবে বলতে পারলে আমাকে? আমার পছন্দের পাঞ্জাবি ছিল সেটা!”
“আচ্ছা! গত সপ্তাহে কে বলেছিল, এই পাঞ্জাবিটা ভালো না? আর আজ বলছো পছন্দের ছিল! এত তাড়াতাড়ি মুড়ে যাও কী করে? দুই দিন পর তো বলবে, আমাকেও ভালো লাগছে না!”
আসফাক মীর দু’পা এগিয়ে এসে নিচু গলায় বললেন,
“যদি তাই হতো, তা হলে এতগুলো বছর আছো কী করে আমার সাথে!”
“আছি তো তোমার ছেলে মেয়ের জন্য। তা না হলে তোমার মত লোকের সাথে কে থাকতো!”
আসফাক মীর ভ্রু কুচঁকে স্ত্রীর দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিল,
“তুমি বলতে চাইছো আমি খারাপ?”
“বলতে চাইছি না। বলছি!”
আসফাক মাথা নেড়ে এক নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
“শুনেছি ভালোবেসে বিয়ে করলে নাকি অনেক সুযোগ সুবিধা আছে? বিবিজান নাকি ভালো-মন্দের খেয়াল রাখে।
কিন্তু আমার বিবিজান বাড়ির কুকুরগুলোর খেয়াল রাখে, মাগার আমার খেয়াল রাখে না! আফসোস!”
হালিমা একদম থেমে গিয়ে তাকালেন। অতঃপর ঠোঁটের কোণে হালকা কটাক্ষের হাসি টেনে বললেন,
“বেশি আফসোস হচ্ছে? তাহলে কচুগাছের সাথে গলায় দড়ি দাও গিয়ে। যতসব, সরো তো!”
এই বলে হালিমা বেগম তার বুকে হাত রেখে ঠেলে সরিয়ে দিলেন আর রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। আসফাক মীর থেমে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন দরজার দিকে।
অতঃপর ধীরে ধীরে বিছানায় বসে পড়লেন, মুখে অদ্ভুত হালকা হাসি ফুটে উঠলো,
“রাগে বউটা যেমন ভ’য়ঙ্ক’র, তেমনি সুন্দর হয়ে যায়। আহা রে, আগের মতো শুধুু আলিঙ্গনটা করতে পারলাম না!”
বেলা তখন অনেকটাই গড়িয়ে গেছে। সূর্যটা আকাশের মাঝ বরাবর। আজকে সূর্যের তাপটা একটু কম, কিন্তু উজ্জলতা যেনো আগের দিনের তুলনায় তীব্র। জানালা দিয়ে আসা সেই আলো ঘরের ধুলোবালির সাথে মিশে একধরনের হলদেটে আভা তৈরি করেছে। কিন্তু সেই উষ্ণতার ভেতরেও কোথাও একটা অস্বস্তি জমে আছে। রিদিতা বিছানায় শক্ত হয়ে বসে আছে হাঁটু জড়িয়ে। তার চুলগুলো এলোমেলো হয়ে পরে আছে পিঠ জুড়ে। তার মুখে কোনো রঙ নেই, শুধু ক্লান্তির এক ধূসর ছাঁয়া। ঠোঁটে অনড় সিদ্ধান্ত, সে কিছুতেই হলুদ মাখবে না।
ফরিদা বেগম সেই সকাল থেকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু কোন কিছুতেই কাজ হলো না। আর ঈশানীর সাথে তো কথাই বলছে না। তাই শেষেমেশ বোঝানোর দায়িত্ব পড়লো আনিকার উপর। ঈশানীর সাথে কথা বলে না বলে, ঈশানী আনিকাকে খবর পাঠিয়েছে। তাছাড়া আনিকা যেহেতু রিদির বন্ধু তো তার বিয়েতে থাকবেই। নীলাকেও বলা হয়েছে, তবে নীলা এলো না। আনিকা রিদির সামনে বসে আছে। অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করছে বোঝাতে,
“রিদি! সময় নাই আর। এবার তো একটু আন্টির কথাটা শোন!”
রিদি চুপ করে বসেছিল এতক্ষণ, কিন্তু এবার মুখ তুলে তাকাল। চোখে যেন র’ক্ত উঠে এসেছে। ঠোঁট শক্ত হয়ে আছে, কণ্ঠটা কেঁপে উঠলো,
“আনিকা! আমার সামনে থেকে যা বলতেছি। তোদের কাউকে আমার সহ্য হচ্ছে না। তোরা সবাই একরকম। সার্থপর কোথাকার!”
আনিকা হতবম্ভ হয়ে বললো,
“আরেহ! আমি কী করলাম!”
“সব কিছু জেনে বুঝে এখনও বলছিস, আমাকে আদনানের জন্য হলুদ লাগাতে!”
আনিকা কিছু একটা বলতে যাবে, এমন সময় আবার ফরিদা বেগম একটা বাটিতে করে হলুদ নিয়ে রুমে ঢুকলেন। আঙুল দিয়ে একটু হলুদ তুলে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,
“আচ্ছা ঠিক আছে, তোর শাড়ি টাড়ি পরে রেডি হওয়া লাগবে না। শুধু গালে একটু ছোঁয়া দেই, তাতেই হবে।”
রিদি এবার বিরক্ত হয়ে চোখ মুখ গুছিয়ে নিলো। সকাল থেকে এই একই কথা একটানা, বারবার শুনতে শুনতে কান পচে গেছে। মাথার ভেতর যেন কেউ হাতুড়ি মারছে। রাগে ঠোঁট চেপে চেঁচিয়ে উঠল,
“কতবার বলেছি, আমি হলুদ লাগাবো না। আর হলুদ লাগানো কী ফরজ? নিশ্চয়ই না! তাহলে বারবার একই কথা কেনো বলতেছো?”
“তবুও একটা রীতি-নীতি তো আছে না কী?”
তিনি আবারও হাত বাড়ালেন, রিদি এবার রেগে ধড়ফড় করে বিছানা থেকে নেমে গেলো। ধপধপ পা ফেলে ড্রইংরুমের দিকে যেতে যেতে বললো,
“বল্লাম তো আমি এসব লাগাবো না। আজব!”
তখনই চোখে পড়লো ড্রইংরুমে তার বাবা দাঁড়িয়ে আছে। রিদিকে দেখে তিনি এগিয়ে এসে মেয়ে’র মাথায় হাত রাখলেন। শান্ত কণ্ঠে বললেন,
“ও যখন চাইছে না, কেনো জোর করছো ফরিদা? ইসলামে কোথাও বলা হয়নি যে হলুদ না মাখলে বিয়ে হয় না। ও না চাইলে থাকুক।”
ফরিদা বেগম বাবা মেয়ের দিকে রাগি রাগি চোখে এক ঝলক তাকিয়ে, নিঃশব্দে টেবিলের উপর হলুদের বাটিটা রেখে রান্না ঘড়ের দিকে চলে গেলো। রিদি সেদিকে তাকিয়ে এক কদম রাড়াতেই হোচট খেয়ে পরে যেতে নেয়। পাশে থাকা চেয়ার আকড়ে ধরে নিজের ভারসাম্য রক্ষা করে। এরপর চোখ বুলায় চারপাশে, ড্রইংরুমের সোফা টেবিল এক পাশে সড়িয়ে বিয়ের আসনের জন্য জায়গায় করা হয়েছে। মাঝখানে সাদা ফুলের দেয়াল আর মেঝেতে রঙিন কুশন। একপাশে কনের আসন, অন্যপাশে বরের। চারপাশে লাল গোলাপ আর সাদা ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। এটা দেখে রিদির বুকের ভেতর অদ্ভুতভাবে কেঁপে উঠলো। মনে হলো এই সাজসজ্জার মাঝেই সে বন্দি হয়ে গেছে। কেমন অস্থিরতা লাগছে তার, ঠোঁট কেমন শুকিয়ে আসছে। চোখ জোড়া মূহুর্তেই পানি ছলছল করছে। কোন রকম ধড়ফড় করে দৌড়ে এসে ঢুকে পরলো ওয়াশরুমে। দরজটা কট করে বন্ধ হতেই আনিকা হতভম্ব হয়ে দরজার সামনে গিয়ে কড়া নাড়ল,
“রিদি! রিদি, কী হয়েছে ঠিক আছিস?“
ভিতর থেকে নাক টানার আওয়াজ এলো। আনিকা বুঝতে পারলো রিদি কাঁদছে। তাই আর ডাকলো না, ভাবলো কাঁদলে হয়তো ওর বুকটা একটু হালকা লাগবে। সে আবার এসে বিছানায় বসে পরলো। তার কী করা উচিৎ, কী বলে শান্তনা দেয়া উচিৎ জানেনা। শুধু বসে বসে এক হাত দিয়ে অন্য হাতের তালু ঘষতে লাগল আর অপেক্ষা করতে লাগলো।
প্রায় অনেকক্ষণ পর রিদি ওয়াশরুমে দরজা খুলে বেরিয়ে আসে। চুলে তাওয়ালে পেচানো, মুখে হালকা পানির ছিটা, তাই একটু ফ্রেশ লাগলেও চোখ দুটো লাল হয়ে ফুলে আছে। রিদি দরজার চৌকাঠে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। এমন সময় ঈশানী এসে কয়েকটা শাড়ি বিছানার উপর ছড়িয়ে রাখলো। রাইসাও তখন পিছু পিছু আসে, মুখে হালকা মেকআপ, চোখে কৌতূহল নিয়ে এসে বসলো বিছানায়। ঈশানী আনিকাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“এগুলো সব ওর বিয়ের শাড়ি। এখান থেকে যেকোনো একটা পছন্দ করে পরিয়ে, সাজিয়ে দিও।“
“ঠিক আছে, আপু।“
আনিকা এক এক করে শাড়িগুলো দেখতে লাগলো।
তার চোখ পড়লো একটা লাল রঙের শাড়ির উপর ঝলমলে র’ক্ত’লাল রেশমের উপর গোল্ডেন সূতার ঘন কাজ, যেন আগুনের ভেতর সূর্যের ঝিকিমিকি। আনিকা সেটা তুলে নিয়ে রিদির গায়ে কেমন লাগবে ভাবছে, ঠিক তখন রাইসা একটা অফ-হোয়াইট আর গোল্ডেনের ভিতর ছোট ছোট পাথর জোড়া শাড়িটা তুলে ধরলো,
“আনিকা আপু, এটা পরাও না! এটা খুব সুন্দর! একদম রিদি আপুর মতো।”
আনিকা মাথা নেরে বললো,
“রাইসাআআ, বিয়েতে সবাই লাল শাড়িই পরে। লাল শাড়িতেই কনে বেশি সুন্দর লাগে।”
রাইসা ঠোঁট উল্টে বললো,
“আজকাল আর কেউ লাল শাড়ি পরে না আপু! সব সেলিব্রিটিরা এখন অফ-হোয়াইট, প্যাস্টেল, অ্যাস্থেটিক কালার পরে। এই লালটা পুরনো হয়ে গেছে।”
আনিকা আর যুক্তি খুঁজে পেলো না। আসলেই আজ কাল বিয়েতে সাদা, ক্রিম, হালকা গোলাপি এসব রঙই বেশি চলে। ঐতিহ্যিক লালটা তেমন দেখা যায় না। তাই রাইসার দেয়া শাড়িটা তুলে নেয়। তখনই হঠাৎ রিদি আনিকার বাছাই করা লাল ঝলমল শাড়িটা তুলে গলা কাঁপিয়ে বললো,
“এটা পড়িয়ে দে!“
রাইসা আর আনিকা দুজনেই হতবাক হয়ে একে অপরের দিকে তাকালো। যে মেয়েটা হলুদ মাখবে না, বিয়ে করবে না বলে থ মেরে বসে ছিলো। সে এখন নিজেই লাল শাড়ি পরে বউ সাজতে চাইছে? আনিকার মনে সন্দেহ হলো। তাদের এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে রিদি এবার একটু ধমকের শুড়ে বললো,
“এভাবে তাকিয়ে আছিস কেনো? বললাম তো এটা পরিয়ে দিতে।“
আনিকা শাড়িটা হাতে নিয়ে উঠে পরে। এরপর রাইসা আর আনিকা দীর্ঘ সময় নিয়ে রিদিকে সাজাতে শুরু করল,
চুলগুলো আলতো করে খুলে দিলো, গলায় পাতলা সোনার হার, কপালে ছোট টিকলি, ঠোঁটে হালকা রঙ। মুখটা অদ্ভুত শান্ত, কিন্তু সেই শান্তির নিচে এক অচেনা ঝড় বইছে।
ঈশানী আর ফরিদা বেগম মাঝেমধ্যে উঁকি দিয়ে দেখে যাচ্ছেন। সাজানো শেষে রিদিতাকে ধরে আয়নার সামনে এসে দাড় করালো আনিকা। হালকা আলোয় ভেসে উঠলো লাল শাড়িতে এক কনে। রিদি নিজের প্রতিফলনের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। বুকটা কাঁপছে, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। আয়নার ভেতর যেন অন্য একজনকে দেখছে, একজন অপরিচিতা নারী, যে লাল শাড়ি পরে আছে, অথচ ভেতরে ভেতরে মৃ’ত। এমন সময় ঈশানীর ডাকে রাইসা আর আনিকা রুম থেকে বেরিয়ে যায়। রিদি তখন আরো এক পা এগিয়ে যায় আয়নার দিকে। বুকে অদ্ভুত কম্পনের ঢেউ উঠছে, ওষ্ঠজোড়া কাঁপছে তিরতির করে। চোখ জোড়া মূহুর্তেই ভিজে উঠলো, মনে পরলো আহাদের সেই ভ’য়ং’ক’র কথাটা,
“আমার অনুমতি ছাড়া যদি আর কখনো লাল শাড়ি পরেছিস! তাহলে তোর ওই লাল শাড়ি আমি সাদা কা’ফ’নের কাপড়ে পরিনত করবো!“
রিদির আয়নায় নিজের প্রতিভীম্বের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলো,
“কই দেখুন! আমি তো লাল শাড়ি পরেছি। আপনার অনুৃমতি ছাড়াই পরেছি। তাহলে আপনি কেনো আসছেন না! কেনো আসছেন না আমার এই লাল শাড়ি কা’ফ’নের কাপড়ে পরিনত করতে। আমার অস্বস্তি হচ্ছে, এই লাল রঙটা আমার গায়ে আগুনের মতো জ্বলছে। বিশ্বাস করুন, স্বস্তি পাচ্ছি না আমি! সত্যি বলছি তো! বড্ড অস্বস্তি লাগছে! এতটা অস্বস্তি হয়তো সাদা কা’ফ’নের কাপর জড়ালেও হতো না। তখন অত্যন্ত শান্তিতে… শান্তিতে শুয়ে থাকতে পারতাম…“
রিদি গলা ভাষ্পে ডেকে গেলো, আর কিছু বলতে পারছে না। ধীরে ধীরে পিছিয়ে এসে বিছানার পাশে মেঝেতে বসে পড়লো। হাঁটু জড়িয়ে বুকে টেনে রাখলো, শরীরটা কাঁপছে অনবরত। নাক টেনে টেনে বারবার হাতের পিঠে মুছে নিচ্ছে। ঠিক তখনই আবারও দরজাটা হালকা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো আনিকা। রিদিকে মেঝেতে বসে থাকতে দেখে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। দৌড়ে এসে পাশে বসলো তার, দুই হাত দিয়ে চিবুক তুলে বললো,
“কী হাল করেছিস নিজের? কত কষ্ট করে সাজিয়ে দিলাম। একটু আগেই কত সুন্দর লাগছিল তোকে… এরই মধ্যে এলোমেলো করে ফেলেছিস?“
কান্নার ভিতরে হালকা শব্দে করে পাগলের মত হেসে ফেললো রিদি। কন্ঠ খাদে নামিয়ে বললো,
“আমার ভেতরটা যে এলোমেলো হয়ে আছে, সেটা তো দেখলি না! শুধু সাজটাই দেখলি?”
আনিকা তখন রিদির মাথার ওড়নাটা ঠিক করছিলো। এই কথা শুনে তার হাত থেমে গেলো। রিদির দিকে তাকিয়ে তার ভীষন কষ্ট হলো। সে বুঝতে পারছে রিদির ভিতরে কেমন টানাপোড়ন চলছে, কিন্তু কিছু করতে পারলো না। নিজকে অপরাধী মনে হলো, নিচু কন্ঠে বললো,
“আমি জানি রিদি, তুই কতটা কষ্ট পাচ্ছিস! এটাও জানি তুই আহাদ রাজাকে কতটা ভালোবাসিস। তবে এটা বুঝতে পারছি না, তুই বিয়েতে রাজি হলি কেনো? তোর আব্বুকে তো সবটা বলতে পারতি!“
“কি বলতাম! আহাদ রাজাকে ভালোবাসি?“
এক সেকেন্ড চুপ থেকে বিদ্রুপ মাখা হাসি দিয়ে বললো,
“যাকে ভালোবাসি সেই তো আমায় ভালোবাসে না! তাহলে কার উপর ভরশা করে বলতাম!“
আনিকা বুঝতে পারলো রিদি কী বোঝাতে চাইছে। কিন্তু রিদি যতই বলুক। আনিকা শতভাগ নিশ্চিত যে, আহাদ রাজা রিদিকে ভালোবাসে। তার চোখে রিদিকে পাবার তীব্র আকাঙ্ক্ষা দেখেছে। কিন্তু এটা বুঝতে পারছে না আহাদ রাজার কেনো চুপ করে আছেন। আনিকা ধীরে প্রশ্ন করলো,
“তাহলে এখন কি করবি? বিয়ে করে নিবি আদনানকে।“
রিদি হঠাৎ হেসে উঠলো একটা অদ্ভুত, ভাঙা, ব্যথা মেশানো হাসি,
“মাথা খারাপ! আমি মরে যাবো আনিকা। মরে যাবো, তবুও এই বিয়ে করবো না।”
আনিকার ঠোঁট কেঁপে উঠলো। কিছু বলার ভাষা নেই। শুধু চুলের একগোছা সরিয়ে দিয়ে রিদির মাথার ওড়নাটা টেনে ঠিক করে ক্লিপ দিয়ে আটকে দিলো। নিজের কান্না লুকাতে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। রিদি তখনো মেঝেতে বসে আছে হলুদ আলোয় ঝলমল করছে তার লাল শাড়ি, কিন্তু চোখে শুধুই শূন্যতা।
এই নিস্তব্ধতার মাঝেই হঠাৎ করে নিচ থেকে ভেসে এলো ঢোল ডাকের শব্দ সাথে বাশির সুরেলা আওয়াজও ভেসে আসছে। ক্রমে সেটা এত জোরালো হয়ে উঠলো, যেন পুরো গলিটাই কেঁপে যাচ্ছে সেই তালে তালে। আনিকা হকচকিয়ে দৌড়ে যায় বারান্দার দিকে। তার পিছুপিছু রাইসা আর ঈশানীও ছুটে যায়। মাহি তো এক রকম ঢোলের সাথে সাথে হাত পা ছড়িয়ে নাচতে শুরু করলো। রিদি তখনও যেনো কিছু শুনছে না, স্থির হয়ে বসে আছে। যেনো পৃথিবীর সব শব্দ থেকে সে নিজেকে আলাদা করে রেখেছে। এমন সময় আনিকা বারান্দা থেকে দৌড়ে এসে কৌতুহল গলায় চেঁচিয়ে উঠলো,
“রিদি! রিদি তোর আহাদ রাজা আসছে!”
রিদির বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠলো। চিবুক তুলে তাকালো আনিকার দিকে। তার ঠোঁট হালকা কাঁপছে, চোখে একরকম অবিশ্বাস। আনিকা এবার চোখ বড় বড় করে বললো,
“শুনছিস না? তোর আহাদ রাজা নিচে আসছে! আমি জানতাম আহাদ রাজা তোর বিয়…”
কথা আর সম্পুর্ন করতে পারলো না আনিকা, তার আগেই রিদি ধড়ফড় করে উঠে দৌড়ে গেল বারান্দার দিকে। দৃষ্টি নিচে রাখতেই দেখে, রাস্তার পাশে ফুলে সাজানো কালো গাড়িগুলো সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সবচেয়ে সামনে, নিজের গাড়ির বোনেটের উপর বসে আছে আহাদ রাজা। হালকা অফ-হোয়াইট পাঞ্জাবি আর পায়জামা, চোখে কালো চশমা, চধূসর চুলগুলো হালকা বাতাসে উড়ছে। ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত একটা আত্মবিশ্বাসী হাসি। তার ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে শাহীন, নাদিম, আর শাওন। সাদা পাঞ্জাবির উপর কালো কটি, সবাই একই পোষাকে যেন এক উৎসবের বাহিনী।
রাস্তাজুড়ে মানুষ জড়ো হতে লাগলো, জানালার ফাঁক দিয়ে মানুষ উঁকি দিচ্ছে, নীরব গলিটা মূহুর্তেই কেমন রমরমা হয়ে উঠলো। উপরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে রিদি একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে।এতোদিনের শুকিয়ে যাওয়া ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো। তার বুকে অদ্ভুত অনুভূতি ঝেঁকে বসেছে, সেই অনুভূতির টাল সামলাতে না পেরে এক দৌড়ে বেরিয়ে যায় বাসা থেকে। তার পিছু নেয় আনিকা আর রাইসাও। তাদের এভাবে ছুটতে দেখে ড্রয়িংরুমে উপস্থিতি সবাই একটু বিচলিত হলেন।
তবে ততক্ষণে রিদি ছুটে বেড়িয়ে গেছে। সিঁড়ির প্রতিটা ধাপেধাপে তার অনুভতি রঙ আরো গাঢ়ো হচ্ছে। শেষমেশ হাঁপাতে হাঁপাতে গেটের সামনে এসে দাঁড়ায়। তার পিছনে রাইসা আর আনিকাও এসে দাঁড়ায়। তার বুক দ্রুত উঠা নামা করছে, ঠোঁটে একটা হাসি লেগে আছে। তাকে দেখেই আহাদ রাজা এক লাফে গাড়ি থেকে নেমে পরে। নাদিমের দিকে তাকিয়ে ইশারা করতেই নাদিম মিউজিক চালিয়ে দেয়। সাথে সাথে আহাদ হাত দুলিয়ে অদ্ভুত ভঙিতে নাচতে শুরু করে, শাহীন, নাদিম, শাওনও যোগ দিলো তার সঙ্গে। গানটা যেনো এই মূহুর্তের সাথে একদম মানিয়ে গেছে,
“তেরে ঘর আয়া, মেঁ আয়া তুঝকো লেনে
দিল কে বদলে মেঁ দিল কা নজরানা দেনে
তেরে ঘর আয়া, মেঁ আয়া তুঝকো লেনে
দিল কে বদলে মেঁ দিল কা নজরানা দেনে
মেরি হার ধড়কান
ক্যা বোলে হ্যায় সুন সুন সুন সুন
সাজন জি ঘর আয়ে, সাজন জি ঘর আয়ে
দুলহন কিউঁ শর্মায়ে, সাজন জি ঘর আয়ে
ঐ দিল চলেগা অভ না কোনো বাহানা
গোরি কো হোগা অভ সাজন কে ঘর জানা
মাথে কি বিন্দিয়া
ক্যা বোলে হ্যায় সুন, সুন, সুন, সুন
সাজন জি ঘর আয়ে সাজন জি ঘর আয়ে
দুলহন কিউ শর্মায়েঁ? সাজন জি ঘর আয়ে”
লাল শাড়িতে প্রেয়সী পর্ব ২৬
রিদি এক রকম ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে উঠলো, অথচ মুখে আবার হাসিও লেগে আছে। এ যেন কান্না আর আনন্দের মাঝামাঝি কোনো অনুভূতি। ততক্ষণে উপর থেকে সবাই চলে এসেছে, আর এসেই দেখে আহাদ রাজার এই অদ্ভুত কাণ্ড কারখানা। তারেক রায়ান এসব দেখেই কর্কশ গলায় গর্জন করে উঠলো,
“এসব কী তামাশা লাগিয়ে রেখেছো! বন্ধ করো এসব।”
তার গর্জনে হঠাৎ কেঁপে উঠলো রিদির শরীর। ভ’য়ে নিজেকে একটু গুটিয়ে নিলো। তবে আহাদ রাজা তখনও একই ভাবে লাফিয়ে চলছে। ঠোঁটে সেই দুষ্টুমি ভরা হাসি। গানের সুর তখন তুঙ্গে।