লাল শাড়িতে প্রেয়সী পর্ব ২৮
Fatima Fariyal
তারেক রায়ান একজন প্রখর ইসলামিক মনস্তাত্ত্বিকের মানুষ। তার জীবন, চিন্তাধারা সবই কঠোর নিয়ম-কানুনে আবদ্ধ। এসব গান বাজনা, উস্রীংখল কাণ্ড কারখানা তার মোটেও পছন্দ না। তাই সে নিজের মেয়ের বিয়েটা ঘরোয়া, শান্তিপূর্ণ ও ইসলামিক নিয়ম কানুন মেনে দিতে চেয়েছেন। তাই তেমন বড় কোন ঘটা করে আয়োজন করেননি। কিন্তু এই মুহূর্তে, আহাদ রাজার চরম উগ্র আচরণ তার সমস্ত ধৈর্যকে চ্যালেঞ্জ করছে। একবার স্পষ্টভাবে নিষেধ করার পরও আহাদ রাজা কোনো ভাবেই থামেনি। তারেক রায়ান ভালো করেই বুঝতে পারলেন, আহাদ ইচ্ছাকৃতভাবে এমন করছে হয়তো তাকে উত্তেজিত করার জন্য। গম্ভীর কণ্ঠে তিনি পুনরায় সতর্ক করলেন,
“এসব বন্ধ করুন, যা করার এখন থেকে দূরে গিয়ে করুন।”
কিন্তু গানের তীব্র শব্দে আহাদ রাজার কানে সে কথা পৌঁছালো না। রিদির দিকে তাকিয়ে সে এক চোখ টিপে দিয়ে সেই মিউজিকের তালে দুলতে লাগলো। তারেক রায়ান এবার মেয়ের দিকে কঠোর নজর রাখলেন। রিদি, বাবার কঠোর দৃষ্টি লক্ষ্য করে, স্বাভাবিকভাবে চিবুক নামিয়ে নেয়। তিনি নিজের মেয়ের হাত ধরে টেনে ঘুড়ে এক পা বাড়াতেই আচমকা থেমে গেলেন। কপাল ভাঁজ করে পিছনে ফিরে দেখে তার মেয়ের অন্য হাত আহাদ রাজা ধরে রেখেছে। ধরে রেখেছে বললে ভুল হবে, সরাসরি স্পর্শ না করে সে নিজের ওড়নার এক অংশ রিদির হাতে পেঁচিয়ে ধরে রেখেছিল। গানের তীব্র শব্দ থেমে যেতেই মুহূর্তের জন্য নীরবতা নেমে এল। সবাই অবচেতনভাবে তাকিয়ে আছে, যেন প্রত্যেকের মনে প্রশ্ন এবার কি ঘটবে? তারেক রায়ান এবার একটু বেশিই রেগে গেলেন। তবে নিজেকে সংযত রাখার চেষ্টা করছেন, এমন ক্ষমতাশীল মানুষের সাথে তো আর রেগে দু চারটা কথা বলে সমাধান করতে পারবেন না। তাই কণ্ঠে দৃঢ়তা রেখেই বললেন,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
“দেখুন মিস্টার, আমি কোন ঝামেলা চাই না। আমার মেয়ের হাত ছাড়ুন।”
আহাদ হেসে ঠোঁট কামড়ে ধরলো, অতঃপর এক কদম এগিয়ে এসে বললো,
“যদি ছাড়রই হতো, তাহলে ধরলাম কেনো?”
তারেক রায়ান কপাল ভাঁজ করে প্রশ্ন করলেন,
“কী চাইছেন আপনি?”
“আপনার মেয়েকে! দিয়ে দিন।”
একদম সরাসরি নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে উত্তর দিলো আহাদ।
তারেক রায়ান এটারই ভ’য়ে ছিলেন। এর আগেও তিনি আন্দাজ করেছিলেন, কিন্তু এবার সরাসরি আহাদ রাজার বলা কথাটা তার ভ’য়কে আরও তীব্র করে দিল। তবুও কাউকে বুঝতে না দিয়ে নিজের মনে শক্ত থাকার চেষ্টা করে বললেন,
“রাস্তায় দাঁড়িয়ে তামাশা করছেন, মিস্টার?”
“তাহলে চলুন বাসায় যাই।”
এই বলে সে রিদির হাতে পেচানো ওড়নার অংশটা টেনে কয়েককদম এগিয়ে গেলো। কিন্তু বাকি সবাই সেখানেই কেমন থ মেরে দাঁড়িয়ে আছে। আহাদ এবার থেমে ঘুরে তাকালো, এমন সময় সেখানে আরো পাঁচ ছয়টা গাড়ি এসে থামে। ততক্ষণে আহাদের বাবা, মা, চাচা গাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসে। তারেক রায়ানকে দেখে আফরোজা শেখ সামন্য লজ্জিত হলেন। কিন্তু আমজাদ মীর চোখের ইশারায় ভরশা দেন, তিনি সামলে নেবেন। রিদির মামা নূরুল আমিন আমজাদ মীরের কাছে গিয়ে উৎকণ্ঠিত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
“এসব কী, ভাই? আপনার বড় ছেলে কোথায়? আর আপনার ছেলে এসব কী উস্রীংখল করছে?”
আমজাদ হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে একটু ভঙ্গি করে বললেন,
“এখানে দাঁড়িয়ে সব শুনবেন? নাকি বাসায় যাওয়ার অনুমতি হারিয়ে ফেলেছি?”
“ছি! ছি! কী বলছেন। অবশ্যই বাসায় যাবেন, চলুন।”
নূরুল আমিন হাতের ইশারা করে সামনে এগিয়ে গেলেন।
আমজাদ মীর ছেলের দিকে তাকিয়ে চোখে ইঙ্গিত করে বুঝালেন, রিদির হাত ছেড়ে দিতে। কিন্তু আহাদ গায় মাখলো না। আমজাদ মীর এবার ছেলের কানে ফিসফিস করে বললেন,
“আহাদ! বেশি ঝামেলা করবি তো এখানে রেখেই চলে যাবো। তখন দেখবো কিভাবে বিয়ে হয় তোর।”
আহাদ এবার রিদির হাত থেকে নিজের ওড়নাটা সরিয়ে নিয়ে, বাবার কানে ফিসফিস করে বলল,
“আমার বিয়ে না হলে, বাসায় ফিরে তোমার ডিভোর্স করিয়ে দিবো। কথাটা মাথায় থাকে যেনো।”
“লজ্জা করে না তোমার? নিজের বাবাকে হুমকি দিচ্ছো!”
আহাদ মুখ ঢেকে হালকা লজ্জা দেখানোর ভঙ্গি করলেন,
“হে হে, লজ্জা পেয়েছি! হয়েছে?
আমজাদ মীর ছেলের দিকে কটমট করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। অতঃপর সবাই একসাথে উপরে চলে যায়। নিচে গাড়ির পাশে তাদের গার্ডরা সার দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
বাহিরে দিনের আলো অনেকটাই ক্ষীন হয়ে এসেছে। তবে
ড্রইংরুমের সাজ-সজ্জার ছোট ছোট লাইটের ঝলকানি চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে। যেনো এক অদ্ভুত থমথমে আবহ তৈরি করেছে। রিদি নিজের রুমে বিছানায় বসে আছে, ভিতরে ভিতরে অস্থিরতায় ছটছফ করছে। পাশের আনিকাও তার সঙ্গে একই অস্থিরতায় কেঁপে উঠছে। উপরে আসার পর সবাই নীরব হয়ে বসে আছে। কেমন থমথমে এক নীরবতা, যেনো এখন কী ঘটতে চলেছে সেটার অপেক্ষাই করছে। ঠিক সেই সময় আফরোজা শেখ স্বরে কিছুটা অপরাধী ভাব নিয়ে বললেন,
“ভাইজান, আমি কি বলবো জানি না… এতক্ষণে হয়তো সব বুঝে গেছেন। আসলে আমি…”
তার কথা আটকে গেলো তারেক রায়ানের নড়েচড়ে। তারেক রায়ান মেরুদণ্ড সোজা করে পেষি টান টান করে বসলেন। মুখে কেমন একটা রুঢ় ছাঁপ, যেনো এখন সামনে বসা সবার কথা শুনতে অনাগ্রহী। তখনই আমজাদ মীর গলা পরিষ্কার করে বললেন,
“দেখুন ভাইজান, আমার স্ত্রী জানতো না যে তার আধ-পাগল ছেলে আর আপনার আধ-পাগল মেয়ে দু’জন একে অপরকে ভালোবাসে। তাহলে সে কখনই আদনানের সঙ্গে এই বিয়ে ঠিক করতো না।”
তারেক রায়ান তখনও স্থির বসে আছে। আফরোজা শেখ স্বর নরম করে বললেন,
“এখন যা হওয়ার তা হয়ে গেছে, ভাইজান। আর কিছু বলার মুখও নেই আমার। তবুও ছোট মুখে একটা বড় আবদার করছি, আপনার মেয়েটাকে আমার হাতে তুলে দেন। আদনানের জন্য হোক, আর আহাদের জন্য রিদিতাকে আমি একইভাবে আগলে রাখবো।”
তারেক রায়ান হঠাৎ দাঁড়িয়ে পরলেন। এতে উপস্থিত সবাই হকচকিয়ে তাকালো। চোখে একধরনের দৃঢ়তা, আহাদের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে বললেন,
“আমি আপনাদের বড় ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক করেছিলাম। এখন যেহেতু সেটা হচ্ছে না, আপনারা দয়া করে আসতে পারেন।”
এই বলে তিনি দু’হাত জড়ো করলেন, শান্ত কিন্তু দৃঢ় ভঙ্গিতে। তার কথা শুনে সাথে সাথে আহাদ তেড়ে আসতে চাইল, কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে আসফাক মীর তাকে টেনে ধরে রাখলো। আমজাদ মীরও উঠে দাঁড়িয়ে তারেক রায়ানের কাছাকাছি এসে দাঁড়ান। এবার তার মুখের ভঙ্গি বদলে গেলো, ঠোঁটে একরকম রহস্যময় হাসি, ভীতিকর, কিন্তু শান্ত কণ্ঠে বললেন,
“আমার ছেলের সম্পর্কে তো মোটামুটি ধারনা আছে আপনার। আমার ছেলে চাইলেই আপনার সামনে থেকে আপনার মেয়েকে তুলে নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু আমরা তাকে সে রকম কিছু করা থেকে ধমিয়ে রেখেছি। এখন আপনি যদি সম্মতি না দেন, তাহলে আর আমার কিছু করার থাকবে না ভাই জা ন।”
তারেক রায়ান ঠোঁটে হালকা হাসি রেখে উত্তর দিলেন,
“আমি আপনাদের সম্মান করি। তাই সম্মানের সঙ্গে বলছি, আমি আমার মেয়েকে কিছুতেই আপনার উগ্র ছেলের হাতে তুলে দিতে পারব না। ক্ষমা করবেন।”
তার কথা শেষ হতে না হতেই পাশ থেকে আছড়ে পরলো আহাদের উন্মত্ত, উগ্র স্বর,
“এই উগ্র আহাদ রাজাকেই আপনার মেয়ে ভালোবাসে, শশুরমশাই!”
তারেক রায়ানের চোখে তখন কঠোরতা ছড়িয়ে গেল। তিনি গভীরভাবে নিশ্বাস নিয়ে বললেন,
“ঠিক আছে। আমি আমার মেয়েকে জিজ্ঞেস করব। যদি সত্যিই তাই হয়, তখন ভেবে দেখবো।”
এই বলে তিনি ইব্রাহিমকে ইশারা করে রিদির রুমের দিকে গেলেন। রিদি এতক্ষণ আড়ি পেতে সবই শুনেছে, এখন বাবাকে আসতে দেখে একপ্রকার শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। হাতের তালু ঘামে ভিজছে, ঠোঁট শুকিয়ে এসেছে। বুকে অজানা চাপ, হৃদস্পন্দন দ্রুত বেড়ে চলছে। তারেক রায়ান মেয়ের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ালেন, চোখে একদম অদম্য দৃঢ়তা, যদিও সে এতক্ষণে সব বুঝতে পেরেছেন। তবুও নিজের মেয়ের মুখ থেকে শুনতে চাইলেন,
“আমি যা জিজ্ঞেস করব, সরাসরি উত্তর দেবে।”
এক সেকেন্ড নীরবতার পর জিজ্ঞেস করলেন,
“তুমি কী আহাদ রাজাকে ভালোবাসো?”
রিদি চিবুক তুলে এক ঝলক তাকালো বাবার দিকে। বোঝার চেষ্টা করলো তার বাবার চোখের গভীরে কি অনুভূতি লুকানো আছে। অতঃপর দৃষ্টি সরালো দরজার ফাঁকা দিয়ে ড্রইংরুমে দাঁড়িয়ে থাকা আহাদের দিকে। আহাদ তখন চাতক পাখিরে মত তার দিকে তাকিয়ে আছে। বুকে অজনা উত্তেজনা, আর তার প্রেয়সীর উওরের অপেক্ষা। রিদি সেই গভীর দৃষ্টি থেকে দ্রুত নজর সরালো, বুকে হালকা ধুপধুপ শব্দ, হৃদস্পন্দনের তীব্রতা শোনা যাচ্ছে। গলা আটকে আসছে, কোন শব্দ বের করতে পারলো না। শুধু উপর নিচ মাথা নাড়ালো, তারেক রায়ান সেটা দেখে আবার কর্কশ কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
“মুখে বলো, তুমি আহাদ রাজাকে ভালোবাসো?”
রিদি আবারও উপর নিচ মাথা ঝুলিয়ে বললো,
“ব…বাসি।”
তার কথা ড্রইংরুম থেকে শোনা না গেলেও, তার মাথা হালকা উপর নিচ করার ভঙ্গি দেখে আহাদ উওর পেয়ে গেলো। সে মাথা উঁচু করে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে একটা স্বস্তির নিশ্বাষ ফেললো। চোখ বন্ধ করে নিলো পরম আবেশে। তার চোখের কোনে ঝমে থাকা এক বিন্দু উজ্জল অশ্রু টাল সামলাতে না পেরে গড়িয়ে পরলো। আহাদ সেটা বৃদ্ধা আঙুল দিয়ে মুছে নিলো। পাশ থেকে তার কাঁধে হাত রাখলো শাহীন। আহাদ চমকে সেদিকে তাকিয়ে ঠোঁট চওড়া করে একটা হাসি ফোটালো।
এদিকে তারেক রায়ান মেয়ের উত্তরে যেনো এক দম স্থির হয়ে আছেন। ইব্রাহিম অবিশ্বাসের সঙ্গে রিদির দিকে তাকিয়ে রইলেন। এখন ভালো করে বুঝতে পারলো, তার বোনের এতোদিন কিসের টানাপোড়ন ছিলো। রিদির মামা এগিয়ে এসে তারেক রায়ানের কাঁধে হাত রাখলেন, দৃঢ় স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন,
“কি ভাবছো, তারেক! তোমার মনে কি চলছে?”
তারেক রায়ান ধীরে পিছনে থাকা বেতের চেয়ারে বসে পড়লেন। তার মুখে কোন শব্দ নেই, কোন রঙ নেই, দৃষ্টি স্থির হয়েছে সামনের দেয়ালে। হঠাৎ ঈশানী এসে তার পায়ের কাছে বসে পরলো, গলা কাঁপিয়ে বললো,
“আব্বু! মেনে নাও না! অত্যন্ত রিদির খুশির কথা ভেবে মেনে নাও। আমি তো তোমার কাছে কখনো কিছু চাইনি, এবার আমার এই চাওয়াটা রাখো।”
এক সেকেন্ড চুপ থেকো আবারও বললো,
“আমি আমার অতীত ভুলে গেছি আব্বু, বিশ্বাস করো! কিন্তু রিদি পারবে না, ও আমার মতো শক্ত মনের না। দেখলে তো ওই দিন কী হয়েছিল। প্লিজ, আব্বু, মেনে নাও।”
ইব্রাহিমও এবার বোনের সাথে সহমত দিলো,
“আব্বু, ঈশানী ঠিকই বলেছে। জানি তুমি রিদির ভালোই চাইছ। এখন তোমার সিদ্ধান্ত নির্ভর করছে রিদির ভালো থাকার ওপর। ও সব দিক থেকে দূর্বল আব্বু, তুমি যদি…”
ইব্রাহিমের কথার মাঝেই তারেক রায়হান হালকা হেসে ফেললেন। কিন্তু সেই হাসিতে কোন খুশির আভা ছিল না। ছিল একটা বিদ্রুপ মাখা হাসি, ইব্রাহিমের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“তোমরা দুই ভাই-বোন এমন বলছো, যেন আমি ওর সৎ বাবা! আমি ওর ভালো চাই না!”
ইব্রাহিম মাথা নিচু করে বললো,
“আমরা সেভাবে বলিনি আব্বু! আমরা শুধু বলতে চেয়েছি…”
তারেক রায়ান এক হাত উঁচু করে থামিয়ে দিয়ে বললেন,
“থাক! আর কৈফিয়ত দিতে হবে না।”
রিদির দিকে তাকিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। রিদি বাবার দিকে তাকিয়ে দ্রুত মাথা নামিয়ে নিলো। তারেক রায়ান এগিয়ে এসে গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
“তুমি জানো, আমি রাজনীতি পছন্দ করি না। তাই তোমাকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে চেয়েছিলাম। তবুও তোমার মা আর মামার কথায় আদনানের সাথে বিয়ে ঠিক করেছি। কিন্তু আমি কখনো চাইনি তুমি এমন একটা পরিবারে যাও। তোমার সুখের কথা ভেবে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কিন্তু তুমি যখন ওই আহাদ রাজার সাথেই তোমার সুখ খুঁজে নিয়েছো, তখন আমারও এ বিয়েতে কোনো আপত্তি নেই।”
রিদি হকচকিয়ে মাথা তুলে বাবার দিকে তাকালো। চোখে অবিশ্বাস, তার বাবা এত সহজেই মেনে নিলেন! ভাবতেই তার চোখের কোনে অশ্রুবিন্দু জমে এলো। মুখে হালকা হাসির রেখা, তারেক রায়ান মেয়ের মাথায় হাত রেখে দোয়া দিলেন, কিছু একটা পড়ে নিয়ে ফু দিয়ে শান্ত স্বরে বললেন,
“সুখী হও। তোমার বাবার দোয়া সবসময় তোমার সঙ্গে থাকবে।”
রিদি এক রকম ডুকরে কেঁদে উঠলো, মূহুর্তেই বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পরলো। তারেক রায়ানও মেয়েকে জড়িয়ে কেঁদে ফেললেন। রুমে থাকা সকলের মুখে হাসি ফুটলেও বাবা মেয়ের আবেগি দৃশ্য দেখে চোখের পানি আর ধরে রাখতে পারলেন না।
প্রায় অনেকক্ষণ পর রিদি রুম থেকে বেরিয়ে এলো। তাকে রুম থেকে বেরিয়ে আসতে দেখে ড্রয়িংরুমে উপস্থিত সবাই নড়েচড়ে উঠলো। আহাদ দ্রুত এগিয়ে আসে তার দিকে, তার বুকের ভিতরটা অস্থিরতায় ভরে আছে। রিদির দিকে তাকিয়ে চোখের ইঙ্গিতে প্রশ্ন করে। রিদি ফোঁস করে নাক টেনে হাতের পিঠে মুছে নিয়ে হালকা হেসে, কেঁপে ওঠা স্বরে বললো,
“আব্বু.. আ আব্বু রাজি!”
আহাদ এক মূহুর্ত হতভম্ব হয়ে স্থির দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর হঠাৎই অদ্ভুত এক উল্লাসে ফেটে পড়লো,
“রাজি? রাজিইই? শাহীইইইনন! কাজী কই, কাজী!”
তার এমন আচরনে সবাই হো হো করে হেসে উঠলো। কিন্তু রিদি একটু আহাদের কাছে এসে আবেশময় ভঙ্গিতে কণ্ঠ নিচু করে ফিসফিস করে বললো,
“আব্বু রাজি, কিন্তু আমি রাজি না।”
কথাটা শোনার সাথে সাথে আহাদের মুখটা ফুটা বেলুনের মত চুপসে গেলো। নিজের প্রেয়সীর দিকে তাকিয়ে রইলো অসহায়ের মত। রিদি স্থির হয়ে হাত দুটো বুকে ভাঁজ করে কণ্ঠে কঠোরতা মিশিয়ে বললো,
“আপনি আমাকে হার্ট করেছেন। আমি আপনাকে বিয়ে করবো না!”
আহাদ ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ছাড়লো, চোখে হতাশা আর অবিশ্বাস। হঠাৎই আবার ঠোঁটের কোণগুলোতে রহস্যময় একটি হাসি ফুটে উঠলো। সে খানিকটা ঝুঁকে কণ্ঠ নিম্ন করে বললো,
“আমার কিন্তু তুলে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা আছে! দেখতে চাও সেই ক্ষমতা?”
চোখ বড় বড় হয়ে যায় রিদির,
“নাহ! ক…করবো তো! বিয়ে করবো। তবে একটা শর্ত আছে।”
আহাদ কপাল গুছিয়ে ভ্রু তুলে প্রশ্ন করল,
“কি শর্ত?”
রিদি আঙুলের কোর গুণে কিছুক্ষণ হিসেব কষলো, অতঃপর নিশ্চয়তা ভরা দৃষ্টিতে আহাদের দিকে তাকিয়ে বললো,
“বাহাত্তর ঘন্টা! তার মানে বাহাত্তর বার কান ধরে উঠ-বস করতে হবে!”
আহাদের মুখে এক ঝলক বিস্ময়, কন্ঠ হালকা উঁচু করলো,
“হোয়াট! বাহাত্তর বার! আর কান ধরবো আমি? এই আহাদ রাজা?”
“ঠিক আছে, আপনার ইচ্ছা।”
রিদি তার রুমের দিকে পা বাড়ালো, হালকা তৃপ্তি ও লজ্জা মিশে মনের মধ্যে খুশির স্ফূরণ। ঠিক তখনই আহাদের কন্ঠ আবার তাকে থামিয়ে দিলো,
“ওকে, ওকে! আই’ম ডুইং ইট।”
আহাদ কান ধরার প্রস্তুতি নিতেই, রিদি মুখ টিপে একটু হাসল। চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে দ্রুত তাকে থামিয়ে দিলো। কণ্ঠ সামান্য নিচু করে বললো,
“থাক! এখন ধরতে হবে না। আমারও তো একটা মান-সম্মান আছে, নাকি? তবে শাস্তি বকেয়া রইলো।”
একটু হেসে রিদি দ্রুত নিজের রুমে চলে যায়। তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আহাদও ঘাড়ে হাত রেখে হেসে ফেললো।
আজকে মে মাসের চব্বিশ তারিখ। এই দিনটা আহাদ আর রিদিতার জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবে আজীবন। আজকের এই মুহূর্তটি তাদের অনুভূতি, তাদের না বলা ভালোবাসার পূর্ণতা পেতে চলেছে। রিদিতাকে আবারও সুন্দর করে বউ সাজিয়ে এনে বসানো হয় কনের আসনে। তার ওপর প্রান্তে বসে আছে আহাদ। তবে তার মুখের ঘোমটা আর সামনের ফুলের পর্দার জন্য আহাদের চেহারা অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
রিদির এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে আনিকা অন্য পাশে ঈশানী। আর আহাদের পাশে তার এয়ী শাহীন নাদিম আর শাওন, অন্য পাশে তার চাচ। ড্রইংরুম ভরে আছে এক উজ্জল উওেজনায়। তানভীর কাজীর সাথে মিলে সব ঠিকঠাক করে দিলো। বড়রা সব পাশেই বসে আছে, কনের পাশে মহিলারা আর বরের পাশে সব পুরুষেরা। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হল। কাজী সঠিক নিয়মে দোয়া পড়ে, সমস্ত বিধি-বিধান সম্পন্ন করে বরের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“বাবা দেনমোহর?”
আহাদের ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেলো, পাল্টা জবাব দিলো,
“মোহর দেবো মানে! এই যুগে আমি মোহর পাব কোথায়? মোহর তো ছিল সেই মোগল আমলে। আমি কোন মোহর টোহর আনি নাই। আপনি বিয়ে পাড়ান।”
তার কথায় মধ্যবয়স্ক কাজী কেঁশে উঠলেন, ওপর প্রান্তে বসে থাকা রিদি আর বাকি সবার মুখেও হাসি চলে আসলো তার উদ্ভট কথায়। এমন সময় শাহীন কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বললো,
“ভাই! মোহর মানে দেনমোহর, মোহরানা। কাজী সাহেব আপনাকে জিজ্ঞেস করছেন, দেনমোহর কত ধার্য করবেন।”
এক সেকেন্ড ভাবার পর আহাদ বুঝলো, কোন দেনমোহরের কথা বলা হচ্ছে। বিয়ের উত্তেজনার মধ্যে সে বেফাঁস ভুলেই গেছে। কাজীর দিকে তাকিয়ে সে একটু রাগী স্বরে বললো,
“সেটা বলবে তো! তা না করে ভিক্ষুকের মতো বলছে, বাবা দেন মোহর!”
আসফাক মীর একটু ধমকের সুরে বললেন,
“চুপ থাক! নিজের বুঝতে ভুল হয়েছে সেটা স্বীকার না করে ত্যাড়ামী করেছিস। বেশি কথা না বলে, এখন বল দেনমোহর কত লিখবে।”
আহাদ এবার ধীরেধীরে ফুলের পর্দার ওপাশে বসে থাকা তার প্রেয়সীর দিকে তাকালো। মুহূর্তের মধ্যে তার মুখের রঙ বদলে গেল, মায়াবি এক আভা ঘিরে ধরলো তাকে।
সে পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে কাজীর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
“এখানে আমার সকল হালাল উপার্জন আছে। আমি আমার হালাল সম্পর্কের দেনমোহরও হালাল উপার্জনের মাধ্যমে আদায় করতে চাই।”
কাজী সাহেব নম্র ভাবে পরিমান জানতে চাইলে, আহাদ কার্ডের টাকার পরিমানের হিসাব জানাল। কাজী আহাদের কথা মত কাবিন নামায় সেই পরিমান লিখে নিলেন। এরপর কাজী উঠে রিদিতার সামনে গিয়ে বসলেন। তার কাছে তার মতামত চেয়ে বললেন,
“আপনি কি এই বিয়েতে রাজি আছেন? রাজি থাকলে বলুন, আলহামদুলিল্লাহ, কবুল।”
রিদি চোখে অদ্ভুত আলোড়ন, হৃদয়ে আনন্দ আর কণ্ঠে শিহরণ মিশিয়ে কেঁপে উঠলো। তবে কবুল বলতে বেশি সময় নিলো না। গলা কাঁপিয়ে বলে ফেললো,
“আলহামদুলিল্লাহ… ক, কবুল!”
কাজী নম্র স্বরে বললেন,
“আরো দুবার বলতে হবে, মা। বলুন, কবুল।”
রিদির কাঁধে ঈশানীর হাত স্পর্শ করলো, হালকা সমর্থন। আরেকবার কণ্ঠ কাঁপিয়ে বললো রিদি,
“কবুল! কবুল!”
তার বলা সেই শব্দ ঘরে গুঞ্জরিত হলো। আহাদ পরম আবেশে চোখ বন্ধ করে সেই মুহূর্ত উপভোগ করল। কাজী এবার উঠে আহাদের কাছে এসে তাকে কবুল বলতে বললেই, আহাদ সঙ্গে সঙ্গে উৎসাহ আর আনন্দের সঙ্গে ফট ফট করে বললো,
“কবুল! কবুল! কবুল!”
ড্রইংরুমে উপস্তিত সাবই এক সাথে হাসিতে ফেটে পড়লো। আলহামদুলিল্লাহ বলে তারাও বিয়ে কবুল করলো। এরপর কনে ও বরের স্বাক্ষর নিয়ে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রে নাম লিখলো। মোনাজাতের মাধ্যমে বিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পূর্ণ করা হলো। আনুষ্ঠানিকতা শেষে আহাদ তার সদ্য বিয়ে করা প্রেয়সীকে সরাসরি দেখতে চাইলো। ফুলের পর্দার দিকে হাত বাড়াতেই রিদির সামনে এসে দাঁড়াল আনিকা, রাইসা আর তানভীর। তারা যেন এক প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে রিদিকে আড়াল করে দিল। আহাদ দ্রুত ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
“কী সমস্যা?”
রাইসা হেসে উঠে বললো,
“নতুন বউয়ের মুখ দেখতে হলে টাকা লাগবে, দুলা ভাই!”
“আজব! আমার বউ আমি দেখবো! টাকা কেনো দিবো?”
তানভীর এক গাল হেসে বললো,
“টাকা না দিলে বউয়ের মুখ দেখতে পারবেনা, দুলাভাই।”
পাশ থেকে শাহীন তীক্ষ্ণ গলায় বললো,
“ভাই, এরা তো রীতিমত চাঁদাবাজি করছে!”
আনিকা এক আঙুল শাহীনের দিকে তুলে বললো,
“এই একদম চাঁদাবাজি বলবেন না। এটা আমাদের প্রাপ্য, আমরা আমাদের পাওনা চাইছি।”
“এ্যাহহহ, প্রাপ্য! কোন কালের বংশধর আপনি? ভাইয়ের থেকে প্রাপ্য চাচ্ছেন?”
“একদম বংশধর নিয়ে কথা বলবেন না!”
“একশবার বলবো, হাজার বলবো।”
আনিকা ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বললো,
“তাহলে কিন্তু বউ দিবো না বলে দিলাম!”
আহাদ চট করে বলে উঠে,
“এই একদম না! তোমাদের টাকা চাইতো? ঠিক আছে, দিবো। তবে তার আগে আমার বউয়ের মুখ দেখতে হবে। এবার সরো সামনে থেকে, কুইক।”
আহাদের কথা অনুযায়ী তারা একপাশে সরে দাঁড়ায়। আহাদ ধীরে ধীরে তাকালো তার সামনে বসা সদ্য বিয়ে করা বউয়ের দিকে। লম্বা ঘোমটা টেনে রাখা সেই রূপকূপময় মুখে, আহাদ তার কম্পিত হাত দুটো বাড়িয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে সেই ঘোমটা তুলে দিতেই তার প্রেয়সীর লাজুক মুখে দৃষ্টি আটকে গেলো। চিবুক নিচে নামানো, লজ্জায় গাল দুটো লাল চেরির মত হয়ে আছে। আহাদ ধীরে তার চিবুক তুলে নিয়ে বললো,
“মাশাআল্লাহহহহ!”
শাওনের দিকে হাত বাড়াতেই শাওন তার হাতে টাকার বান্ডিল তুলে দিলো। আহাদ সেই টাকার বান্ডিল রিদির মুখের সামনে কয়েকবার ঘুড়ালো, এমন যেনো নজড় না লাগে। এরপর রিদি মাথার উপর টাকা ছুঁড়তেই উড়ে চারদিকে ছড়িয়ে গেলো। তানভীর আর রাইসা সেগুলা কুড়াতে ব্যাস্ত হয়ে পরলো। আর এই ব্যাস্ততার মাঝেই আহাদ হঠাৎ এক ঝটকায় রিদিকে কোলে তুলে নিলো। রিদি একরকম হকচকিয়ে গেলো, চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখে সবাই তাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। লজ্জায় আড়ষ্ট হলো তার শরীর, ফিসফিস করে বললো,
“কী করছেন, নামান আমাকে!”
আহাদের সেই কন্ঠস্বর কান পর্যন্ত পৌঁছাল না। সে তার প্রেয়সীকে কোলো নিয়ে সোজা বাসা থেকে বেড়িয়ে গেলো। তার এই কর্মকাণ্ডে কেউ একটুও বিচলিত হলো না। কারন সবার ধারনা আছে আহাদ কি করতে পারে। তবে আফরোজা শেখ আবারও লজ্জিত অনূভব করলেন। সবার সাথে হাসি হাসি মুখে কথা বললেও ভিতরে ভিতরে তার ছেলের আচরনে সে খুবই তিক্ত!
লাল শাড়িতে প্রেয়সী পর্ব ২৭
বাধ্য হয়ে এবার তারাও আহাদের পিছুপিছু বেরিয়ে যায়। রিদির মামা আর ইব্রাহিম অনেক অনুরোধ করেছেন রাতের খাবারটা অত্যন্ত যেনো খেয়ে যায়। কিন্তু সেই ছোট্ট অনুরোধটা তারা রাখতে পারলো না তাদের এই অবাধ্য ছেলের কারনে। শেষমেশ নিচে এসে রিদিকে সবাই বিদায় দিলো, রিদি একে একে তার মা, বাবা, মামা সহ সবার কাছথেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে বসতেই, সারি দিয়ে দাঁড়ানো গাড়িগুলো ধীরে ধীরে গলির শেষ প্রান্ত পেরিয়ে রাস্তায় উঠলো। রিদি জানালার বাইরে তাকিয়ে রইলো, পিছনে ফেলে আসা পরিবারের দিকে।