লাল শাড়িতে প্রেয়সী পর্ব ৩০

লাল শাড়িতে প্রেয়সী পর্ব ৩০
Fatima Fariyal

আহাদের সজ্জিত রুমটায় তখন পিনপতন নিরবতায় ভরপুর। চারপাশে মোমবাতির হলুদ আলোয় সাদা লালের মিলেমিশে তৈরি হওয়া একটা অদ্ভুত রোমান্টিক আবেশ।
কিন্তু রিদিতার মন যেনো ঠিক তার বিপরীত, উদ্বিগ্ন, লজ্জায় কুঁকড়ে থাকা, ভয়ে বুক ধড়ফড় করছে। সে চুপচাপ বসে, হাত দু’টো কোলের মধ্যে জড়ো করে রেখেছে। বারবার পিটপিট করে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে প্রতিটা কোন। এমন সময় দরজা খোলার শব্দে চমকে তাকায় সেদিকে, আহাদ রুমে ঢুকেছে হাতে একটা হাড়ি! রিদি চট করে দাঁড়িয়ে পরলো, চোখ কপালে উঠে গেলো আহাদের কান্ডে। মুখ প্রসারিত হয়ে গেলো, আবার লজ্জার রেখাও ফুঁটে উঠলো। সে খিদে পেয়েছে বলেছিলো বলে, এই লোকটা হাড়ি সহ নিয়ে আসবে? সে কি এখন বসে বসে হাড়ি সামনে নিয়ে খাবার খাবে নাকি? আহাদ এগিয়ে এসে বাচ্চাদের মতো সরলভাবে জিজ্ঞেস করলো,

“এটা কোথায় রাখবো?”
রিদির মাথা আরো বেশি গুলিয়ে গেলো। সে কী করে বলবে কোথায় রাখবে? আহাদ নিজেই চারদিকে একবার তাকিয়ে কার্পেটের এক কোনায় রাখলো হাড়িটা। এবার আর চুপ থাকতে না পেরে রিদি বিস্ময়ের স্বরে বলে উঠলো,
“কী করছেন আপনি?!”
“দেখছো না? খাবার নিয়ে এলাম। তুমিই তো বললে তোমার খিদে পেয়েছে।”
রিদি কুণ্ঠিত গলায় বললো,
“হ্যাঁ, তাই বলে হাড়ি সহ নিয়ে আসবেন?”
আহাদ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো,
“তোমার কতটুকু প্রয়োজন সেটা তো জানি না। তাই নিয়ে এলাম। আর তাছাড়া…”
“তাছাড়া…?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আহাদ এবার ধীরে রিদির একদম কাছে এসে দাঁড়াল। ধীরে হাত তুলে তার কানের পাশে নেমে আসা চুলের গোছা আলতো করে গুঁজে দিয়ে গভীর নেশাময় কন্ঠে বললো,
“তাছাড়া পরেরবার যেনো কাছে এলে বলতে না পারো, আমার খিদে পেয়েছে।”
একটা অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেলো রিদির শিরায়। আহাদ এবার হাঁটু মুড়ে বসে প্লেটে খাবার তুলে নিলো। অতঃপর
রিদিকে বিছানায় বসিয়ে নিজে বসলো তার মুখমোখি হয়ে।
রিদির এমন অনুভূতি হলো, যেনো তার বুকের ভেতর ছোট্ট কোনো ঢেউ উঠছে বারবার। চোখ নামিয়ে রাখলো খাবারের প্লেটের দিকে। আহাদ সেই দৃষ্টি লক্ষ্য করে নরম গলায় জিজ্ঞেস করলো,
“বেশি খিদে পেয়েছে?”
রিদি তাকাতেই দেখলো আহাদ ঠিক ওর ভিতরটা ভেদ করে তাকিয়ে আছে। তার গলা শুকিয়ে এলো, কন্ঠ থেকে শব্দ বের হলো না। শুধু ছোট করে বললো,

“উমম।”
আহাদ হেসে ফেললো, নড়েচড়ে আরেকোটু কাছে গিয়ে বসলো। চামচ ভর্তি খাবার তার দিকে এগিয়ে দিলো
চোখের ভাষায় বললো,
“খেয়ে নাও।”
রিদি একটু ইতস্তত করলেও ভিতরে ভিতরে এক অনাবিল আনন্দ ছড়িয়ে পরলো। যাকে পাবে না বলে, এতোদিন তার ভিতরে জ্বলেছে আজ সে তার সামনে বসে তাকে নিজের হাতে খাইয়ে দিচ্ছে। এর থেকে বড় পাওয়া আর কী হতে পারে? চামচটা মুখে নিতেই, রিদির চোখের কোনে বিন্দু অশ্রুকনা জমা হলো। মুখে খাবার থাকা স্বত্বেও ঠোঁট জোড়া কেমেন ফুলে উঠেছে অভিমানে। আহাদ তৎক্ষণাৎ প্লেট নামিয়ে তার মুখের দিকে তাকালো, স্পষ্ট বুঝতে পারলো তার প্রেয়সীর মনে অভিমান ঝমেছে। সে আলতো করে তার গালে হাত রাখলো। বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে অশ্রুকণা মুছলো, গালে হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

“কী হলো, হুম? খারাপ লাগছে?”
হালকা নাক টানার শব্দ করে না সূচক মাথা নাড়ালো রিদি। আহাদ আবারও কোমল স্বরে বললো,
“তাহলে?”
রিদি প্যাচপ্যাচ করে নাক টেনে হাতের পিঠ দ্বারা নাকটা মুছে নিয়ে বললো,
“আপনি যখন আমাকে আপনার করেই নিবেন, তাহলে আমাকে এতো কষ্ট দিলেন কেনো? কেনো সেদিনই সবাইকে বলেননি? কেনো সেদিনই আব্বুর কাছ থেকে আমায় চাইলেন না?”
কথাগুলো তীরের মতো বিঁধলো আহাদের হৃদয়ে। সে গভীর নিশ্বাস টেনে আহত গলায় বললো,
“ইচ্ছে করে কষ্ট দিতে চাইনি রিদি! আমি শুধু চেয়েছিলাম তোমাকে নিরাপদে রাখতে। ভাবিনি তোমার সাথে এমন ভয়ংকর কিছু ঘটতে পারে। আর তাছাড়া, আমি যদি সেদিনই এসব বলতাম, তোমার হিটলার বাপ কখনোই মেনে নিতো না।”

“কেনো মেনে নিতো না? এই যে দেখুন, আমি আপনার সামনে বসে আছি।
হালকা হাসলো আহাদ, রিদি উল্টে প্রশ্ন করলো,
“হাসছেন কেনো? বলুন না।”
আহাদ তার স্বভাব শুলভ ভঙ্গিতে বা হাতের উল্টোপিঠ দ্বারা নাকটা ঘষে নিয়ে বললো,
“আমি তোমাকে পেয়ছি কারন আমি চেয়েছি। তোমার আব্বু বাধ্য হয়ে রাজি হয়েছে, আর তাকে বাধ্য আমিই করেছি।”
“মানে?”
আহাদ এবার আরকটু ঝুঁকে বসল রিদির দিকে, চোখে চোখ রেখে বললো,

“সেদিন যদি আমি কিছু বলতাম, তাহলে তোমার আব্বু আদনানের সাথে বিয়ে ভেঙ্গে দিতো ঠিকই সাথে তোমাকেও হয়তো গ্রামে নিয়ে যেতো। তাই আমি ইচ্ছে করেই এই বিয়ে হতে দিয়েছি, কারন বিয়ের দিন বর পাল্টে গেলেও তোমার আব্বুর কিছু করার থাকবে না। সম্মানের প্রতি বড্ড লোভ তোমার আব্বুর, অতন্ত সেদিক বিবেচনা করে যে রাজি হবে তা শতভাগ নিশ্চিত ছিলাম।”
একট বিরতির পর, নিচু গলায় যোগ করলো,
“তবুও যদি রাজি না হতো, তাহলে অন্য ব্যবস্থা করতাম।”
আহাদের কথায় আর চোখের দুষ্টু ঝিলিক দেখে রিদি ভুরু কুঁচকে ঠোঁট উল্টে তাকিয়ে রইলো। ওর সেই বাচ্চামি দেখে আহাদও হেসে ফেললো। তর্জনী আঙুল দিয়ে আলতো করে তার নাকে টোকা দিয়ে বললো,

“আর কিছু জানার আছে, রিদি রানী?”
রিদি উপর নিচ মাথা ঝাঁকালো, আহাদ জিজ্ঞেস করল,
“আবার কী? বলে ফেলেন।”
রিদি নিচু গলায় মিনমিনিয়ে বললো,
“আমি যে আপনার অনুৃমতি ছাড়াই লাল শাড়ি পরেছি।আপনি কিছু বললেন না যে?”
আহাদ ঠোঁটের কোণে ধীরে ধীরে হাসি টেনে আনলো। ধীরে ঝুঁকে পরলো খুব কাছে, এত কাছে যে তার নিঃশ্বাসও অনুভূত হচ্ছে রিদির গালে। হিসহিসিয়ে বললো,
“কারন আমি জানি, আপনি আমার জন্যই পরেছেন।”
রিদির চোখ ছলছল করে উঠলো, কোনো উত্তর বের হলো না মুখ থেকে। আহাদ এবার প্লেট হাতে নিয়ে বললো,
“হয়েছে, এখন আর প্রশ্ন না। আজকে অনেক বেশি প্রশ্ন করেছেন। এবার চুপচাপ খেয়ে নিন।”
রিদিও আর কোন কথা না বলে চুপচাপ খেয়ে নিলো।
খাওয়ার শেষে আহাদ বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে তার ঠোঁটের কোনে লেগে থাকা দানাগুলো মুছে দিলো। পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে কোমল গলায় বললো,

“আমি এগুলো রেখে আসছি, তুমি ততক্ষণে ফ্রেশ হয়ে নিও। কেমন?”
রিদি শুধু মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো। আহাদ রুম থেকে বের হওয়া মাত্রই তার বুক আবার তীব্র ধুকপুক শুরু করে দিলো। আয়নার সামনে গিয়ে সে কিছু গয়না খুলে নিজেকে হালকা করলো। অতঃপর ওয়াশরুমে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে আসে। হঠাৎই আবার পায়ের শব্দ হলো, রিদি বুঝতে পারলো আহাদ আসছে। তার বুকটা কেমন করে উঠলো, সেই সময় তো খিদের অজুহাত দিয়েছে। এবার কী করবে? চারদিকে তাকিয়ে কোন উপায় না পেয়ে দ্রুত পাশের আলমারির দরজা খুলে, ভেতরের কাপড় এক পাশে ঠেলে নিজেকে গুটিয়ে বসে পড়লো। আহাদ রুমে ঢুকেই তার প্রেয়সীকে খুঁজে পেলো না। ভ্রু কুঁচকে গেলো তৎক্ষণাৎ। গলার স্বর খানিকটা উঁচু করে ডাকলো,

“রিদি,রিদিইই।”
তবে কোন আওয়াজ এলো না, রিদি নিজের নিশ্বাষটা অব্ধি রোধ করে রেখেছে। আহাদ রিদিকে না পেয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো, ভাবলো আহিয়ার কাছে গেছে হয়তো। কিন্তু রুম থেকে বের হতেই সামনে পরলো আদনান, দু ভাই আবারও মুখমোখি হলো। আদনানকে দেখেই আহাদের চোখের দৃষ্টি মুহূর্তেই কঠিন হয়ে গেলো। আদনান পেষি টানটান করে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলো। ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসি রেখে গলা ভারী করে বললো,
“এতো রাতে শখের বউ রেখে বাহিরে বাহিরে ঘুরে বেড়াচ্ছিস! ভাবার বিষয়।”
আহাদ কৃত্তিম হাসি টেনে বললো,

“ভাবাভাবির কিছু নাই, শখের বউ লুকোচুরি খেলছে আমার সাথে। ওকেই খুঁজছি।”
বলেই আদনানের কাঁধ ঘেঁষে সোজা আহিয়ার রুমের দিকে চলে গেলো। আদনান তার চলে যাওয়া পিঠের দিকে তাকিয়ে পরাজয়ের দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললো, মাথা নাড়িয়ে বিড়বিড় করে বললো,
“আহি ঠিকই বলেছে, দুইটাই আধ পাগল।”

এদিকে আহাদের সারা শব্দ না পেয়ে রিদি ধীরে আলামারি থেকে বেরিয়ে আসে। বিছানার কোনে বসে পা দুটো তুলে পিছনে হালকা হেলে বসলো। ক্লান্ত দেহ বিছানা পেয়ে চোখের পাতা ভারী হয়ে এলো। কিছুক্ষণ পর আহাদ রিদিকে সারা বাড়ি খু্ঁজে না পেয়ে আবার রুমে ফিরে আসলো। আর এসে দেখে রিদি বিছানায় অর্ধশোয়া অবস্থায়, চোখ বন্ধ, নিশ্বাস ভাড়ী বোঝাই যাচ্ছে ঘুমে আছন্ন হয়ে পরেছে। আহাদ ধীরে এগিয়ে যায় কাছে, নিশ্বব্দে পাশে বসে। কয়েকমূহুর্ত তাকিয়ে থাকে সেই ঘুমন্ত কোমল মুখটার দিকে। এক হাত মাথার পাশে, চোখ বন্ধ, ঠোঁট একটু ফাঁক, প্রতিটা নিঃশ্বাস, প্রতিটা নড়াচড়া সব তার মনে আগুন ধরাচ্ছে। হঠাৎ রিদি একটু কেঁপে উঠলো, হয়তো ঠান্ডা লাগছে রিদির। আহাদ ভ্রু কুচঁকে তাকালো এসির দিকে, দ্রুত এসির তাপ মাত্রা বাড়িয়ে দিলো। অতঃপর তার মাথার নিচের বালিশটা ঠিক করে দিয়ে, মুখের উপরের চুলগুলো সরিয়ে দিলো আলতো হাতে।

তখন রাতের শেষ প্রহর চলছে, চাঁদের আলো ঢুকছে পর্দার ফাঁক দিয়ে। আহাদ আরো কিছুক্ষণ প্রেয়সীকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছিলো। তার ভেতরে তখন হাজারো ঝড়, হৃদয়ে অনিয়ন্ত্রিত দহন, মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো অবাধ্য অনূভতির দল। কোন রকম নিজেকে সামলে চলে গেলো বারান্দার দিকে। রাতের মৃদু হাওয়া এসে ছুঁয়ে গেলো তার এলোমেলো ধূসর চুলগুলো। একটা সিগারেট জ্বালিয়ে নিয়ে ছোট ছোট নিশ্বাষে টানতে লাগলো, যেনো এই মূহুর্তে তার ভিতরের অজানা দাহটাকে নিভানোর ক্ষুদ্র চেষ্টা করছে। মাঝে মাঝে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় বিছানায় ঘুমিয়ে থাকা তার প্রেয়সীর দিকে। আবার অজান্তেই ঠোঁটের কোনে হাসির রেখা ফুটে উঠে, কারণ এখন তার পৃথিবী
এই মেয়েটাই।

মীর হাউজে সকাল থেকেই হালকা খুশির আমেজ লেগে আছে আহাদ আর রিদিকে ঘিরে। আজকে রিদির পরিবারের সবাই এ বাড়িতে আসবে, রিদিকে নিয়ে যেতে। আর তা ছাড়া নতুন বউ দেখতেও অনেকের আসার কথা, সব মিলিয়ে বাড়ির প্রতিটি কোণেই যেনো ব্যস্ততার ছোঁয়া। আর এর মধ্যেই সেই সকাল থেকে তানভীর আহিয়ার পিছু ঘুরঘুর করছে। মাঝে মাঝে এটা সেটা বলে খোঁচাচ্ছে, তবে আহিয়া তাকে বিন্দুমাত্র পাত্তা দিচ্ছিল না। সে এবার বিরক্ত হয়ে উঠে সোজা নিচে চলে এলো। তানভীরও তার পিছু যেতে যেতে আহিয়াকে উদ্দেশ্য করে গেয়ে উঠলো,
“এই যে বেয়াইন সাব, ভাব নিয়েন না, একটা মাত্র বেয়াই আপনার, দেইখাও দেখেন না!”
ঠিক শেষ সিঁড়িতে পা রাখতেই পিছন থেকে কারো শক্তপোক্ত একটা হাত পরলো তার কাঁধে। সে চমকে ঘুরে দেখে আদনান আরেক ধাপ সিঁড়ির উপর দাঁড়িয়ে আছে। তানভীরের দিকে তাকিয়ে জোর পূর্বক একটা হাসি ফুঁটিয়ে বললো,
“বেয়াইন না দেখলে কী হবে, তোমার বেয়াই তো আছে।

চল, ঝাঁকানাকা ব্রেকফাস্ট করাবো, খুব খেয়াল রাখবো তোমার!”
তার কথা শুনে তানভীরের মুখের হাসিটা মিলিয়ে গেলো, আনিকা আর রাইসা তখন টেবিলে বসে নাস্তা করছিলো। তানভীরের সেই চুপসে যাওয়া বেলুনের মতো চেহারা মুখ চেপে হেসে উঠলো। আদনান এক প্রকার জোর করেই তাকে এনে নিজের পাশের চেয়ারে বসালো। তানভীরের আরেক পাশে রাইসা বসা, সে একটু কাত হয়ে রাইসার কানে ঝুঁকে ফিসফিস করলো,
“রাইসা, জোর বাঁচা বেঁচে গেছিস! ভালোই হয়েছে তোর দুলাভাই এই ধলা ডাক্তার হয় নাই। না হাসে, না কাঁধে, মনে হচ্ছে কেউ ওর মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে রেখেছে। সারাক্ষণ মিলিটারিদের মতো গম্ভীর হয়ে থাকে।”
রাইসাও ফিসফিস করে বললো,
“চুপ থাক, তা না হলে বন্দুক ঘুড়ে তোর কপালে এসে ঠেকতে পারে।”
“আহাদ রাজাই বেস্ট!”

“হুম, এক বান্দর আরেক বান্দরের সুনাম তো গাইবেই।”
রাইসা কথাটা কটাক্ষ করে বললেও, সে সব গায় মাখলো না তানভীর। বরং আরো শিড়দারা সোজা করে ভাব নিয়ে বসলো, যেনো রাইসা তাদের খুব প্রশংসা করেছে। রাইসা এটা দেখে হালকা বিরক্ত হলো, রাইসার বোনর জন্য আদনানকে পছন্দ হয়েছিলো। কারন আদনান ডাক্তার আবার দেখতেও সুন্দর, কিন্তু তার মন খারাপ হলো আহাদের সাথে রিদির বিয়ে হওয়াতে। তবে কি আর করার, তারা একে অপরকে ভালোবাসে।

ঠিক তখনই সিঁড়ি বেয়ে ধীরে ধীরে নেমে এলো রিদি। লাল শাড়ির পাড়ে হালকা রূপালি কাজ, মুখে একচিলতে হাসি আর মায়াবী ক্লান্তি। পাশেই আদিবা। সকাল থেকে আদিবা রিদির সাথেই আছে, কারন আহাদ বেড়োনোর সময় কড়া ভাবে তাকে আদেশ করে গেছে, সে না আসা পর্যন্ত যেনো রিদির সাথেই থাকে। এক সেকেন্ডর জন্য যেনো না সরে। আহাদের আজকে বাধ্য হয়ে বের হতে হয়েছে। আজকে সংসদে তার শপথ পাঠ হবে, তার আরো একটা নতুন যাত্রার শুরু। আজকে দুপুর দুটোয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আসনে তার নাম ঘোষনা করা হবে। তাই তার বাবার সাথে বেড়িয়ে গেছিলো তাড়াহুড়ো করে। রিদি নিচে নামতেই চোখ পরে আদনানের দিকে, তবে আদনান চোখ নামিয়ে রেখেছে। তবুও আদনানকে দেখে কেমন অস্বস্তি হলো তার, আবার কেনো জানি রাগও হলো। রিদিকে দেখেই ছুটে আসে আহিয়া, আনিকাও খাবার শেষ করে উঠে তাদের সাথে যোগ দেয়। তিন বান্ধবি মিলে হলঘরের সোফায় গিয়ে বসে, হালকা হাসি ঠাট্টা, গল্প জমে উঠে তিন জনের মধ্যে। তার মাঝেই আহিয়া উঠে রিদির হাত টেনে বললো,
“ওহ, তুই তো নাস্তা করিস নাই? ভাইয়া তো সকাল সকাল চলে গেলো বললো, তুই ঘুমাচ্ছিস যেনো না ডাকি। এখন চল নাস্তা করবি, আমিও করি নাই।”

রিদি অনিচ্ছায় মাথা নেড়ে বললো,
“খিদে নেই। ইচ্ছে করছে না।”
হালিমা বেগম তখন পাশেই টুকটাক কাজ করছিলো। রিদির কথা শুনে মুখ টিপে হাসি সংযত রেখে বললেন,
“আহিয়া, কি যে বলিস না! এক হাড়ি বিরিয়ানি খেলে কী আর কারোর খিদে লাগে?”
কথাটা শুনে চোখ বড় বড় হয়ে গেলো রিদির, চমকে তাকালো হালিমা বেগমের দিকে। তিনি এবার হাসি চেপে রাখতে পারলে না, রিদির লজ্জায় কান গরম হয়ে গেলো। মনে মনে বললো,
“ছি! ছি! কী এক কান্ড। এখন হাড়ির কথা কী সবাই জেনে যাবে? কী দরকার ছিলো খিদের কথা বলার। না আমি বলতাম আর না উনি হাড়ি সহ নিয়ে যেতো। ইশশশ্!।”

আহিয়া আর আনিকা অবাক হয়ে একসাথে তাকালো রিদির দিকে। সে চোখ বন্ধ করে রেখেছে, মুখ দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, সত্যিই এমন কিছু ঘটেছে। আহিয়া আর আনিকা একে অপরের দিকে তাকিয়ে একসাথে বলে উঠলো,
“এক হাড়ি বিরিয়ানি?!”
মূহুর্তেই হাসিতে ফেটে পরলো। রিদি এতে আরো লজ্জিত হলো বান্ধবিদের কাছে। কপাল চুলকোনোর ভান করে নিজের মুখটা ঢাকতে চাইলো। তবে আহিয়া আর আনিকা গড়াগড়ি করে হেসেই চলছে।

সারাদিন ধরে রিদি যেন এক অদ্ভুত যুদ্ধ লড়েছে। একেরপর এক মেহমান আসছে, তাদের সামনে শাড়ি পরে কাঠের পুতুলের মতো বসে থাকা এ কোন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে কম নয়। তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে সবাই, যেন সে কোনো মূল্যবান শিল্পকর্ম, যার প্রতিটি খুঁটিনাটি পরখ করে দেখার দায়িত্ব সবাই কাঁধে নিয়েছে। কিন্তু কেউই খালি হাতে দেখছে না। সবাই প্রশংসা করে কিছু না কিছু পরিয়ে দিয়েছে। অবশেষে সন্ধে নেমে আসতেই লোকজনের ভিড় কিছুটা কমলো। আর সেই সুযোগে রিদি আস্তে আস্তে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এলো। আহাদের রুমে ঢুকতেই বুকের ভেতরে কেমন দপদপ করে উঠলো, এখন তো এটা তারও রুম!

ভাবতেই গালের দুপাশে লাজুক রঙ ছড়িয়ে পড়লো। নিজের হাতেই যেন নিজের লাজ ধরা পড়ে গেলো, মাথা নিচু করে পাশের সোফায় বসল। ভারী শাড়ির আঁচল ঠিক করে নিলো, ক্লান্তিতে মাথাটা এলিয়ে দিলো পিছনে। আহাদ সেই সকালে বেড়িয়েছে, আর এখন প্রায় সাতটা বাজতে চললো। যদিও এর মধ্যে একবার ফোন আর দুবার মেসেজ করেছে। তবুও তার ভিতরটা কেমন হাহাকার করে উঠলো। এত এত মানুষ তার চারপাশে, তবুও কেন যেন ভীষণ একা লাগছিলো। এমন সময় দরজা খোলার শব্দে রিদি কাত হয়ে তাকাতেই হৃদস্পন্দন যেন এক মুহূর্তের জন্য থেমে গেলো। আহাদ ভেতরে ঢুকছে, সাদা পাঞ্জাবির হাতা কনুই পর্যন্ত মুড়ানো। চুলগুলো হালকা এলোমেলো, মুখে একরাশ ক্লান্তির ছাঁপ। তাকে দেখেই রিদি ধড়ফর করে দাঁড়িয়ে পরলো। আহাদ একটু এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো,

“ভয় পেয়েছো?”
তার ক্লান্ত কণ্ঠেও এক অদ্ভুত কোমলতা। রিদি মাথা নিচু করে উওর দিলো,
“উহুম।”
আহাদ পকেট থেকে ফোন ওয়ালেট বের করে বেড সাইডের টেবিলে রাখলো। ধীরে রিদির সামনে গিয়ে দাঁড়ল। আহাদের ডান হাতের পিঠ আলতো করে ছুঁয়ে গেলো তার গাল। সেই স্পর্শে রিদির শ্বাস আটকে এলো, চোখ দুটো বন্ধ হয়ে গেলো অজান্তেই। রিদির কোমল গালে হাত বুলিয়ে নিচু গলায় বললো,
“আমি একটু ফ্রেশ হয়ে আসছি। তুমি এখানেই বস।”
এই বলে ঘুড়ে যেতে নিলেই পিছন থেকে রিদির কণ্ঠ কেঁপে উঠলো,
“মন্ত্রী মশাই!”

আহাদের পা থেমে যায় সেই ডাকে। আহাদের থমকে দাঁড়ানোই যথেষ্ট বোঝানোর জন্য, যে এ শব্দ তার ভেতর কতটা আলোড়ন তুলেছে। সারাদিনে সবার মুখ থেকে পাওয়া ‘মন্ত্রী সাহেব’ এর সম্বোধন তার কানে এমন মধুর লাগেনি, যতটা এই মূহুর্তে তার প্রেয়সীর মুখে শুনে লাগছে। সে তৃষ্ণা ভরা চোখে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। রিদির বড্ড লোভ জাগলো মনের কোনে, এই এলোমেলো আহাদ রাজাকে একটু জড়িয়ে ধরার। সেই লোভটা আর ধামাচাপা দিয়ে রাখতে পারলো না। মুখ ফস্কে বলেই ফেললো,
“আমাকে একবার জড়িয়ে ধরবেন মন্ত্রী মশাই? আপনাকে জড়িয়ে ধরার বড্ড শখ আমার!”

আহাদের কাছে তার প্রেয়সীর সেই শখটা বড়ই মায়াবি লাগলো। সে এক মূহুর্ত তাকিয়ে থাকলো সেই মায়াবি মুখ খানার দিকে। অতঃপর ধীরে হাত বাড়িয়ে টেনে আনলো নিজের বক্ষস্থলে। পরম আবেশের সাথ জড়িয়ে ধরলো তার প্রেয়সীকে। রিদি মাথাটা গুঁজে দিলো আহাদের বুকের ঠিক নিচে। অনুভব করলো তার হৃদস্পন্দন, জোরে, খুব জোরে ধুকপুক করছে। পিছন থেকে দু হাতে আঁকড়ে ধরে রাখলো আহাদকে। মনে হলো বহু প্রতীক্ষিতর পর সে এই আশ্রয়টা পেয়েছে, অজান্তেই তার কান্না চলে এলো। ফুঁপিয়ে ফঁপিয়ে কেঁদে উঠলো আহাদের বুকে মাথা রেখেই। আহাদ স্পষ্ট বুঝতে পারলো, তবে কোন কিছু বলে শান্তনা দেয়ার আর শক্তি ছিলো না। কারন তার নিজেরও চোখের কোনে অশ্রুকনা জমেছে, কন্ঠ ভাড়ী হয়ে এসেছে। রিদি প্যাচপ্যাচ করে নাক টেনে আহাদের পাঞ্জাবির বুকের অংশ ভিজিয়ে ফেলেছে। হঠাৎ অনূভব করলো, আহাদের হাতের বাঁধন শক্ত হয়ে আসছে। রিদি নড়েচড়ে উঠে ভেজা কন্ঠে বললো,

“এতো শক্ত করে কেউ জড়িয়ে ধরে? মেরে ফেলবেন নাকি?”
আহাদও নেশালো গলায় বললো,
“হুম, ফেলবো তো। একদম আমার বুকের সাথে পিষে মেরে ফেলবো।”
হালকা হাসলো রিদি, নাক টেনে বললো,
“মৃত্যুর প্রক্রিয়া যদি এতো সুন্দর হয়, তবে আমি আমৃত্যু মনে করে গ্রহণ করবো।”

আহাদও কিন্চিৎ হাসলো সেই কথায়, নিজের বুক থেকে রিদির মাথা তুলে আলতো করে তার কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালো। কপালে কপাল ঠেকিয়ে গভীর ভাবে নিশ্বাষ নিলো। সেই নিশ্বাষ আছড়ে পরলো রিদির মুখে, বিদুৎয়ের মতো ঝটকা মারলো তার শরীর। আহাদ আবারও তাকে বুকে চেপে ধরলো। এমন সময় ঠকঠক করে দরজায় কড়া পরলো, এতে খানিকটা বিরক্ত হলো আহাদ। রিদি নিজেকে সরিয়ে নিলো আহাদের থেকে, আহাদ গিয়ে দরজা খুলে দেখলো রিতু দাঁড়িয়ে আছে। ঝাঁঝালো কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

“কী হয়েছে? ডিস্টার্ব করছিস কেনো?”
রিতু দ্রুত নজর নামিয়ে নিলো, নিচু কন্ঠে বললো,
“নতুন ভাবির বাড়ি থেকে মেহমান আইছে, খালাম্মা আপনাদের নিচে ডাকে।”
আহাদ আড়চোখে তাকালো রিদির দিকে, রিদি আবার সেই লাজে ঠোঁট কামড়ে নিজেকে সামলাতে ব্যাস্ত। আহাদ গম্ভীর কন্ঠে বললো,

লাল শাড়িতে প্রেয়সী পর্ব ২৯

“ঠিক আছে, তুই যা। আমি ফ্রেস হয়ে আসছি।”
রিতু দ্রুত চলে গেলো সেখান থেকে। আহাদ আবার ধাপ করে দরজাটা বন্ধ করে দিলো। দরজা বন্ধ হতেই খানিক নীরবতা। কিন্তু সেই নীরবতার ভেতরে মিশে রইলো অগণিত অপ্রকাশিত কথা।

লাল শাড়িতে প্রেয়সী পর্ব ৩১

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here