লাল শাড়িতে প্রেয়সী পর্ব ৩৪
Fatima Fariyal
সন্ধা ঘনিয়ে এসেছে অসীম আকাশে। দিগন্তের ওপারে সূর্য অস্ত গেছে অনেকক্ষণ আগে, শুধু মেঘের কিনারায় রয়ে গেছে হালকা লালচে আভা। পাশের মসজিদ থেকে ভেসে আসছে মাগরিবের আজান, কোমল, অথচ গভীর এক ডাক যা ঘরের ভেতর ছড়িয়ে দিচ্ছে একধরনের প্রশান্তি। হালিমা বেগম আহিয়াকে নিয়ে ততক্ষণে উপরে উঠে আসলেন। আহিয়ার পায়ের গোড়ালিতে একটা হালকা নীলচে দাগ ফুটে উঠেছে। রুমে এসে হালিমা বেগম খুব যত্নে তাকে বিছানায় বসালেন। ধীরে ধীরে তার পা তুলে সোজা করে দিয়ে তার পিঠে একটা নরম কুশন ঠেকিয়ে দিয়ে বললেন,
“এইভাবে একটু থাক। আর বেশি নড়াচড়া করিস না।”
অতঃপর টেবিল থেকে পানির বোতলটা তুলে আহিয়ার হাতে দিলেন,
“নে, একটু পানি খা। আমি মাগরিবের নামাজটা পড়ে আসি। কিছু লাগলে আমাকে বা রিতুকে ডাকিস, কেমন?”
“আচ্ছা।”
দরজা পর্যন্ত গিয়ে হালিমা বেগম আবার ঘুড়ে আসলেন। দৃঢ় স্বরে বললেন,
“ওহ শোন। আগামিকাল তোকো নিয়ে একটু বসুন্ধরা যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এখন তো পায়ে ব্যাথা পেয়ে বসে আছিস।”
আহিয়া চোখ তুলে জিজ্ঞেস করল, “কেন, কী কাজ?”
“রিদির জন্য কিছু গয়না বানাতে দিয়েছিলাম না? সেগুলো আনতে যাবো। আর কিছু কেনাকাটাও করবো। হুটহাট সব হয়ে গেলো, রিদির জন্য তেমন কিছুই কেনা হয়নি।”
“আচ্ছা যাবো। আগে পা টা ভালো হোক।”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
“আদনান তো বলল, ঠিক হয়ে যাবে। দেখি, কালকের মধ্যে যদি ঠিক হয় তাহলে কিন্তু যাবো।”
আহিয়া মৃদু মাথা দোলালো। হালিমা বেগম ব্যাস্ত পায়ে বেড়িয়ে গেলেন ঘর থেকে। তিনি যেতে না যেতেই আদিবা এসে ঢুকল রুমে। আহিয়াকে একটা চকলেট ধড়িয়ে দিয়ে বলল,
“আহি আপু। আদনান ভাই বলছে তুমি নাকি পরে গেছো?”
“হুম, তুই কোথায় ছিলি?”
“আমি তো কানে হেডফোন লাগিয়ে গেম খেলছিলাম।”
“আমি মরে গেলেও আমার মাথার পাশে বসে তুই গেম খেলবি! অ’স’ভ্য।”
আদিবা মুখ বৃকিতি করে বলল,
“উহ, একটু ব্যাথা পেয়ে একদম বাড়ি মাথায় তুলে ফেলেছে। আর পা ভাঙলে কি করত আল্লাহ মাবুদ জানে। যতসব ঢং।”
এই বলে আদিবা মুখ বাঁকিয়ে সেখান থেকে চলে গেলো। পিছন থেকে আহিয়া চেঁচিয়ে উঠল,
“আদিবা তোরে কিন্তু আমি ফ্রোজেন ড্রইংবুকটা কিনে দিবো না বলে দিচ্ছি!”
দরজটা পুরোপুরি বন্ধ হওয়ার আগেই দরজা ঠেলে ভিতরে ঢোকে আদনান। দরজার পাশে হেলে দাঁড়িয়ে আছে। বুকের সামনে হাত ভাঁজ করা। সোজা তাকিয়ে আছে আহিয়ার দিকে। দৃষ্টিটা এত গভীর, এত স্থির যে আহিয়ার বুক কেঁপে উঠল। কিছু একটা বলার ইচ্ছে হচ্ছিল, কিন্তু কথা আটকে গেল গলায়। সে পানির বোতলটা বেডসাইড টেবিলে রাখল। গলা পরিষ্কার করে নিচু গলায় বলল,
“কিছু বলবেন, আদনান ভাই?”
কোন উত্তর নেই। শুধু সেই গভীর দৃষ্টি, যা আহিয়ার ভেতরটা অস্থির করে তুলছে। বুঝতে পারলো না, সে কি কোন ভুল করেছে? তা না হলে এভাবে তাকিয়ে থাকার মানে কী? আড় চোখে আবারও তাকালো আদনানের দিকে। আদনান তখনও একইভাবে তাকিয়ে আছে। আহিয়া নজর সড়িয়ে নিল। অস্বিতে একটু নড়েচড়ে বসল। অবশেষে সে ধীরে এগিয়ে এসে পকেট থেকে একটা ছোট ওষুধের পাতা বের করে আহিয়ার হাতে রাখল। গলা নিচু করে বলল,
“এটা খেয়ে নে। আশা করি তোর ব্যাথা সেরে যাবে।”
আহিয়া এক মুহূর্তও দ্বিধা করল না। পানির বোতল হাতে তুলে ওষুধটা খেয়ে নিল। আদনান এবার বিছানার এক কোনে এসে তার পায়ের কাছে বসল। আহিয়া নিশ্চুপ। কিছুক্ষণ নীরবতার পর আদনান গলার স্বর খানিকটা ভারী করে বলল,
“একটা কথা বলব, আহি?”
আহিয়া একটু বিচলিত হয়ে জানতে চাইল, “কী কথা?”
আদনান কিছুক্ষণ নীরব থেকে জানালার দিকে তাকাল।
সন্ধ্যার আলো এখন প্রায় নিভে এসেছে, চারদিকে ঘন অন্ধকার। শুধু ঘরের কোণে টেবিলল্যাম্পের নরম হলদে আলো ছড়িয়ে আছে। সে ধীরে ধীরে বলল,
“যদি কখনো এমন দিন আসে, যে আমি আর থাকলাম না। তাহলে কী তুই আমার জন্য কাঁদবি? সামান্য একটু! কাঁদবি আমার জন্য?”
আহিয়ার ভিতরটা কেমন কেঁপে উঠল আদনানের সেই কথায়। থাকবে না মানে? বরং সে প্রশ্ন না করে পারলো না। কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল,
“থাকবেন না মানে? আপনি কী বড় আব্বু বড় আম্মুর কাছে আবার জার্মান চলে যাবেন?”
আদনান মৃদু হেসে মাথা নাড়ল, “উহুম।”
“তাহলে যে বললেন..”
মূহুর্তেই আহিয়ার বোধগম্য হলো আদনানের বলা কথার মানেটা, তার গলার স্বর হঠাৎ ভারী হয়ে গেল। চোখ ছলছল করে উঠল। সাথে সাথেই টুপ করে এক বিন্দু শীতল অশ্রু গড়িয়ে পরল তার গাল বেয়ে। আদনান তাকিয়ে রইল সেই দৃশ্যের দিকে। একটা ক্ষীণ হাসি ফুটে উঠল তার ঠোঁটে। ধীরে ধীরে সামনে ঝুঁকে নরম স্বরে বলল,
“আমি তো বলেছিলাম, আমি যখন থাকব না, তখন আমার জন্য সামান্য হলেও কাঁদিস। কিন্তু তুই তো এখনই কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছিস। তাহলে কি আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করব, আহি?”
আহিয়া ঠোঁট চেপে নিজের কান্না সংযত করল। তার গলার স্বর ভাষ্পে ঢাকা,
“আপনি হঠাৎ এমনটা কেন বললেন, আদনান ভাই?
এমন অযৌক্তিক কথার মানে কী?”
হালকা হাসল আদনান, বলল,
“তোর ভাইয়ের মতো তুইও ভাবিস আমি যুক্তিহীন কথা বলি। আমার সব কথাই কি অযৌক্তিক, আহি?”
আহিয়া মাথা নাড়ল,
“সব কথা না হলেও এখন যেটা বললেন… সেটা একেবারে নিরর্থক। এমন কথা বলার কোনো মানে হয় না। আপনি জানেন, বড় আব্বু আর বড় আম্মু শুনলে কতটা কষ্ট পাবে?”
“শুধুই কি আব্বু আম্মু? তুই পাবি না? তাহলে কাঁদলি কেন?”
আহিয়া তাকিয়ে রইল তার চোখে। কিছুক্ষণ পরে খুব নিচু গলায় বলল,
“আপনি কী আমাকেই কষ্ট দেয়ার জন্যই কথাটা বলছেন? তাহলে শুনুন, আমি কষ্ট পাবো। খুব কষ্ট পাবো। আর এতে কি আপনি শান্তি পাবেন? বলুন না, আদনান ভাই.. আপনি খুশি হবেন?”
আদনান কোন উত্তর দিল না। বরং অদ্ভুত কোমল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আহিয়ার দিকে। চোখে একরাশ শান্তি, ভেতরে ভেতরে সত্যিই খুশি হয়েছিল আদনান। আহিয়া তাকে হারিয়ে কষ্ট পাবে বলেছে, এর থেকে সুখের আর কী হতে পারে? আজ সে নিজেই স্বীকার করছে তাকে হারানোর ভয়! এই এতটুকু স্বীকারোক্তিই যথেষ্ট ছিল আদনানের জন্য। তার বুকের ভেতর যেন হালকা আগুনের শিখা জ্বলে উঠল, নরম, উষ্ণ, কিন্তু গভীর। আহিয়া বরাবরই ভীতু! সে কী পারবে রুখে দাঁড়াতে? পারবে তার জন্য তারা বাবা আর ভাইয়ের মুখোমুখি হতে? পারবে না নিশ্চয়ই! এই ভাবনার মাঝেই হঠাৎ একটা তীব্র চিৎকারে ভেঙে গেলো সেই নীরব মুহূর্ত,
“ইয়েস!!”
সেই চিৎকারে উভয়েই ঘুড়ে তাকাল দরজার দিকে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আদিল, ল্যাপটপ হাতে। মুখে ঝলমলে উচ্ছ্বাস। আদিল ভেতরে ঢুকে এল, হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
“ভাই! তোমার করা প্রজেক্টটা ওদের দারুণ লেগেছে, দেখো!”
আদনান নজড় রাখল ল্যাপটপের দিকে। তার মুখে কোন রঙ নেই। গম্ভীর কন্ঠে বলল,
“এবার আমি সাহায্য করেছি, কিন্তু এরপর থেকে আর করব না। বাঁদরামি বন্ধ কর, নিজের ওপর নির্ভর করতে শিখ। ফোকাস কর পড়াশোনায়। আমি ডাক্তারি নিয়ে পড়েও তোর সফটওয়ার প্রজেক্ট করছি, লজ্জা হওয়া উচিত তোর।”
“আচ্ছা এরপর থেকে লজ্জা পাবো।”
“ননসেন্স।”
আদনানের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। এক নজড় আহিয়ার দিকে তাকিয়ে গটগট করে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো। দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দটা ঘরের মধ্যে প্রতিধ্বনিত হলো। আদিল তখনও দাঁড়িয়ে আছে। আহিয়া এবার রাগে গজগজ করে উঠল,
“তুই দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? যা বেরো আমার রুম থেকে!”
আদিল মুখ বাঁকিয়ে ব্যাঙ্গ করে বলল,
“বেরো আমার রুম থেকে। তোর রুমে কি আমি থাকতে এসেছি নাকি? শাঁকচুন্নি।”
“তাহলে খাম্বার মত দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? যা!”
“যাব না, আমার ইচ্ছা।”
“আদিল্লার বাচ্চা.!”
আহিয়া দাঁত কিড়মিড় করে একটা কুশন তুলে ছুড়ে মারল তার দিকে। আদিল জ্বিব বের করে একটা ভেঙচি কেটে দৌঁড়ে বেড়িয়ে গেলো। আহিয়া তখন বিছানায় বসে রইল নিস্পন্দ, তার রুমটায় আবার নিস্তব্ধতা ভর করল। মাথার ভেতর যেন আদনানের কথাগুলো প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। বুকের ভেতর হঠাৎ করে কেমন চিনচিনে ব্যথা ছড়িয়ে পড়ল। সে পানির বোতলটা তুলে নিয়ে ঢক ঢক করে কয়েক ঢোক খেলো, কিন্তু তৃষ্ণা মেটেনি বরং গলায় আরও শুষ্কতা নেমে এলো। মনে হলো যেন কোনো অদৃশ্য আগুন ভেতরটা জ্বালিয়ে দিচ্ছে। এমন অদ্ভুত অস্বস্তি কেন লাগছে তার? তবে কী সত্যিই সে আদনানকে ঘিরে কোনো অনুভূতি বহন করছে? ভাবতেই বুকের ব্যথাটা আরো তীব্র হয়ে উঠল। বিছানার পেছনে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করল আহিয়া। বুকের ওপর হাত রাখল, যেন হৃদস্পন্দনটাকে থামাতে চায়। কিন্তু সেই স্পন্দন যেন আরও জোরে বাজতে শুরু করেছে।
রিদিতা ভোরের নীরবতায় উঠে কটেজের বারান্দায় গিয়ে সেই ছোট্ট দোলনায় চড়ে দুই পা তুলে বসল। দোলনাটা হালকাভাবে দুলছে আর তাঁর দৃষ্টি আটকে গেছে আকাশের দিকে ছুটে চলা তুলোর মতো সাদা মেঘের উপরে। মেঘেরা কোনো নিয়ম ছাড়াই ছুটে বেড়াচ্ছে; একটুখানি মিলেমিশে আবার ভিন্ন রূপ নেয়। নির্বাসিত আকাশে তাদের খেলা দেখে রিদিতার মনও অচেতনভাবে ঝলমলে হয়ে ওঠে। কোনো বাঁধা নেই; কোনো দ্বিধাও নেই, শুধু মুক্ত বাতাস আর মেঘের ভেলা। সেই অনাবিল মুক্তির মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেললো রিদিতা। মাঝে মাঝে শীতল হাওয়া বয়ে এসে তার গালে মৃদু-কম্পন জাগায়; উরুতে হাত রেখে চিবুক ঠেকিয়ে অস্থির চোখে তাকিয়ে আছে ভাবনার বাইরে, নিখুঁতভাবে অনমনা। গতকাল তারা নীলগিরির আশেপাশে কয়েকটি ছোটছোট জায়গায় ঘুরেছে। বাকি সময়টা তারা কটেজেই একান্তভাবে কাটিয়েছে।
আজকে সকাল সকাল রিদির ঘুম ভেঙে যায়। আহাদ তখনো গভীর নিদ্রায় ডুবে আছে। কয়েকদিনের ক্লান্তি তার চোখের পাতায় ভার করে বসেছে। তাই রিদি তাকে আর জাগায়নি। নিজে ফজরের নামাজ শেষ করে নিঃশব্দে বারান্দায় বসে বসে সময় কাটাচ্ছিল, পাহাড় আর নীল আকাশের মৃদু নীরবতায় নিজেকে মিশিয়ে ধরে। মনে যেন কোনো অচেনা শান্তি। আহাদ এবার একটু পাশ ফিরতেই টের পেলে বিছানায় রিদি নেই। ঘুম ঘুম চোখে কয়েকবার হাতিয়ে যখন বুঝল সত্যিই রিদি পাশে নেই, ধড়ফড় করে উঠে বসল। মাথা ঝাঁকিয়ে চোখ টেনেটুনে খুলল কোনরকম। কিন্তু রুমের কোথাও নিজের প্রেয়সীকে না দেখে গলা উঁচিয়ে ডাকল,
“রিদি! রিদিইই! জানু!”
আহাদের ডাকে অবেচেতন ঘোর ভাঙে রিদির। তাড়াহুড়ো করে বারান্দা থেকে ভিতরে আসে। আহাদ তখনও বিছানায় বসা। রিদিকে দেখে যেন সমস্ত অস্থিরতা মুছে গেল; কোনো কথা না বলে সে ধপ করে আবারও শুয়ে পড়ল। চোখ বন্ধ করে নিঃশ্বাস গভীর করে নিল। রিদি কিছুটা এগিয়ে এসে তার মাথার পাশে দাঁড়িয়ে রইল। খেয়াল করছিল, আহাদ কি সত্যি ঘুমিয়েছে নাকি কেবল চোখ বোঁধা রেখেছে। আহাদের চোখে কোনো কম্পন নেই, নিশ্বাস ভারী অর্থাৎ সত্যিই সে ঘুমিয়ে পরেছে। নিশ্চিত হয়ে রিদি সেই নিদ্রাবিষ্ট মুখটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তার কোমল হাত তাৎক্ষণিকভাবে গালের দাঁড়িতে ছুঁয়ে দিল। এক চুমোর তীব্র লোভ জাগল। যেহেতু সে ঘুমিয়ে আছে, তাই রিদি সুযোগ নিল। আরো কিছুটা ঝুঁকে সেই খসখসে গালে নরম একটা চুমু খেল। সাথে সাথে আহাদ এক ঝটকায় রিদিকে নিজের দিকে টেনে এনে বিছানায় ফেলল। এক পা তাঁর ওপর তুলে দিয়ে কোলবালিশের মত আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখল। রিদি কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঘটনাটি ঘটল। যখন বোধগম্য হলো, চোখ বড় বড় করে হতভম্ব হয়ে আহাদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“আপনি ঘুমাননি?”
আহাদ চোখ বন্ধ রেখেই ঘুমঘুমে কণ্ঠে উত্তর দিল,
“হুম, ঘুমিয়েছিলাম। কিন্তু কেউ একজন আমার ঘুমের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। এখন তাকে কী শাস্তি দেয়া উচিত বলো তো?”
তার কথাগুলো ইদানিং একঅর্থে দুষ্টুমির মতো হলেও কানে ভাসে আদরের আধুটি। রিদি লাজুক স্বরে সাফাই দেয়ার চেষ্টা করে,
“আমি কিছু করিনি, সত্যি বলছি।”
“আচ্ছা?”
“হুম।”
“ঠিক আছে। তুমি যখন কিছু করনি.. আমি করছি।”
আহাদের কণ্ঠে এক অদ্ভুত দুষ্টু গাম্ভীর্য মিশে ছিল। রিদিতা চমকে উঠে জিজ্ঞেস করল,
“কি?”
আহাদ সামান্য নড়ে চড়ে ওর শরীরের ভারটা আরও কাছে টেনে আনল। উষ্ণ নিশ্বাস মিশে গেল রিদির গালে। দুষ্ট মুচকি হাসি নিয়ে আহাদ বলল,
“ডট ডট ডট!”
রিদি প্রায় লাফিয়ে উঠল, চোখ বড় বড় করে বলল,
“না! প্লিজ!”
“হ্যাঁ, প্লিজ!”
আহাদের সেই আহ্লাদী স্বরে রিদি এবার লাজুকলতার ন্যায় নেতিয়ে গেল তার বুকে। আহাদও গভীর আলিঙ্গনে জড়িয়ে নিল তাকে। এমন সময় বেড সাইডের টেবিলে রাখা আহাদের ফোনটা হঠাৎ কেঁপে উঠল। রিদি চমকে তাকালো, কিন্তু আহাদ চোখ বন্ধ করে একইভাবে স্থির রইল। রিদি তাকিয়ে দেখল আহাদের কোন হেলদোল নেই। একটা মোচড় দিয়ে নিজেকে ছাড়ানোর ব্যার্থ চেষ্টা করে বলল,
“আপনার ফোন বাজছে তো।”
আহাদ অলস ভঙ্গিতে উত্তর দিল, “আই ডোন্ট কেয়ার।”
“কোনো গুরুত্বপূর্ণ কল হতে পারে, ধরুন না?”
“তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছি। ডিস্টার্ব করো না।”
কিন্তু এবার পরপর কয়েকবার ফোন বাজতে দেখে বেশখানিকটা বিরক্ত হলো আহাদ। অনিচ্ছাভরে সে রিদিকে ছেড়ে আধ-শোয়া হয়ে বসল। ফোন হাতে নিয়ে দেখে তুহিনের কল, মুখ বিকৃত করে নিল। রিসিভ করতেই ওর গলা ভারী আর বিরক্ত শোনাল,
“কোন বা’লে’র হানিমুন করতে আসছি আমি, হে? বারবার ফোন দিয়ে ডিস্টার্ব করতেছিস কেন?”
ওপাশ থেকে তুহিনের গলা ভেসে এলো,
“আরে ভাই, তোরে কি আর আমি মজা করার জন্য ফোন দিছি নাকি? সেই সকাল সাতটা থেকে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি তোদের জন্য। অথচ তোদের আসার নামগন্ধ নাই।”
আহাদ বিরক্ত মুখে বলল,
“তোরে দাঁড়িয়ে থাকতে কে বলছে?”
“তুই বলছিস, তুই! শালা বউয়ের নেশায় এমন ডুবে গেছিস যে সবই ভুলে গেছিস! উঠে চোখে মুখে পানি দে, নেশা কাটা আর মনে কর, তুইই তো বলছিলি আজ থানচি যাবি। আমি আর রিয়াদ চট্টগ্রাম থেকে চলে আসছি, আর তোরা এখনো পাহাড়ের চূড়ায় বসে বসে প্রেম করতেছিস!”
মূহুর্তেই আহাদের বোধগম্য হলো, তাই তো? আজ তো তাদের থানচি যাওয়ার কথা, নাফাখুম ঝর্না দেখতে। সে তো বেফাঁস ভুলেই গিয়েছিল। আড় চোখে তাকাল রিদির দিকে, রিদি তখন লাগেজের কাপড় গুজগাছ করছে। সে একটা ভঙ্গি করে মাথা চুলকে হালকা গম্ভীর গলায় বলল,
“তোরা আধঘণ্টা অপেক্ষা কর। আমরা এক ঘন্টার মধ্যে আসতেছি।”
“আর কখন আসবি ভাই? ওখানে যেতে যেতেই তো রাত হয়ে যাবে। তাহলে ফিরব কখন?”
আহাদ একটু বিরক্তি নিয়ে বলল,
“সে চিন্তা তোর করতে হবে না। ফোন রাখ।”
বলেই আহাদ ফোন কেটে দিল। রিদিতা এতক্ষণ চুপচাপ সব কথাই শুনেছে। এবার ধীরপায়ে এসে দাঁড়াল আহাদের সামনে। মুখ গম্ভীর করে মিনমিন করে বলল,
“আমি কোথাও যাব না। আপনি তুহিন ভাইয়াদের জানিয়ে দিন না।”
আহাদ কিছুটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কেন?”
রিদি এক লাফে এসে আহাদের সামনে বসে পড়ল। একটানে জামার কলার সরিয়ে দিল। গলার পাশে লালচে দাগগুলোর দিকে ইশারা করে ক্ষীপ্ত হয়ে বলল,
“দেখুন কী করেছেন! এগুলো নিয়ে আমি বাইরে যাব কীভাবে?”
আহাদ এক সেকেন্ড রিদির দিকে তাকিয়ে থাকল।অতঃপর নির্বিকারভাবে বলল,
“তাহলে ড্রয়ারে রেখে যাও।”
রিদি রাগে ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
“আপনি মজা করছেন? আমার জ্বলে যাচ্ছে!”
“ভালো হলে ঠিক হয়ে যাবে।”
“এটা কেমন কথা?”
“এটা আহাদ রাজার কথা।”
রিদিতা ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
“বিয়ের আগে তো আমার একটু হাত কেটে গেছিলো বলে কত কেয়ার করেছেন। বাসা ভর্তি প্রোটিন খাবার পাঠিয়েছেন। আর এখন এগুলো আপনার চোখে পরছে না?”
“প্রোটিন লাগবে? এগুলোর প্রোটিন কিন্তু আলাদা। তুমি চাইলে আমি এখনই দিতে পারি। দিবো?”
রিদি চোখ বড় করে চেঁচিয়ে উঠল,
“বজ্জাত বেডা!”
আহাদ হালকা শব্দ করে হেসে উঠলো। একরাশ আনন্দ মেশানো হাসি। এতে রিদিতা প্রচণ্ড আকাঁড়ে খেপে গেলো। আহাদের এই গা ছাড়া ভঙ্গি দেখে তার ভেতরে আগুন জ্বলে উঠল। দাঁত কিড়মিড় করতে করতে হঠাৎই সে এক অপ্রত্যাশিত কাণ্ড করে বসল। আহাদের ঘাড়ে একেবারে জোরে একটা কামড় বসিয়ে দিল!
“আউচ!”
আহাদ হালকা আর্তনাদ করল। চোখ কুঁচকে রিদির দিকে তাকাতেই দেখল, সে ইতিমধ্যে দৌড়ে ওয়াশরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে! আহাদ উঠে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। দেখল ঘাড়ে বেশ গাঢ়ো দাগ পড়েছে কামড়ের। আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবির দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল,
“কি পেস্ট ব্যবহার করে রে! দাঁতে এমন জোর পায় কোথা থেকে!”
আয়নায় নিজের সেই দাগের দিকে তাকিয়ে তার ঠোঁটের কোণে আবার এক চোরামি হাসি ফুটে উঠল।
সময় তখন সকাল দশটার কাছাকাছি। পাহাড়ের বুকের ফাঁক গলে সূর্য ঠিকরে বেরোচ্ছে উজ্জ্বল আলো নিয়ে। দূর পাহাড়ের চূড়াগুলোয় এখনো কুয়াশার টুকরো লুকিয়ে আছে। কিন্তু নিচের দিকে নামার সাথে সাথে গরম বাতাস আর আলোটা যেন তীব্র হয়ে উঠছে। কটেজ থেকে নামতে নামতে রিদিতা আর আহাদ দু’জনেই চারপাশের সৌন্দর্যে ডুবে আছে। একদিকে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে বয়ে যাওয়া মেঘের ছায়া, অন্যদিকে ঝকঝকে রোদে চকচক করা পাথর। নিচে গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় আছে তুহিন আর রিয়াদ। দূর থেকে যখন দু’জনকে নামতে দেখে, তুহিন হাত নাড়ল। মুখে চওড়া হাসি টেনে মজা করে বলল,
“এই যে রাজা-রানী অবশেষে নামল পাহাড় থেকে!”
আহাদ এগিয়ে আসতেই তুহিন গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল। বন্ধুত্বের সেই পুরোনো চেনা উষ্ণতা আবার ফিরে এলো। কিন্তু পরের মুহূর্তেই তুহিনের দৃষ্টি আটকে গেল আহাদের ঘাড়ে। সেখানে ছোট্ট একটা ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ। আহাদ ব্যাক্তিগত মূহুর্তগুলো গোপন রাখতে ব্যান্ডেজের সাহায্যে ঢেকে নিয়েছে দাগটা। কিন্তু তুহিনের চোখে পড়াতে কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
“তোর এখানে কী হয়েছে ভাই? ব্যান্ডেজ কেন?”
আহাদ এক হাত পকেটে পুরে রেখে আড়চোখে রিদির দিকে তাকাল। অতঃপর খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল,
“একটা ব্যাঙ কামড়ে দিয়েছিল।”
তুহিন চোখ কুঁচকে অবাক হয়ে বলল,
“বলিস কী! এখানে আবার ব্যাঙ আসল কোথা থেকে? দেখি?”
কথা শেষ না হতেই সে আহাদের ঘাড়ের ব্যান্ডেজটা আলতো করে একটু তুলল। আর দেখেই হেসে খেই হারিয়ে ফেলল। মুখের হাসি চেপে রাখতে না পেরে কাশির ভান করে বলল,
“হুম, কামড় দেখে মনে হচ্ছে ব্যাঙটা দয়ালু ছিল। না মানে ওতটাও জোরে সোরে পরেনি।”
রিদিতা তখন চিবুক নামিয়ে ফেলেছে, তার গাল লালচে হয়ে উঠেছে। ওড়নার ভেতর মুখটা অর্ধেক লুকিয়ে ফেলল। মনে মনে আফসোস করতে লাগল,
“কেন যে ওই কামড়টা দিতে গেলাম!”
তুহিন হেসে তাকাল রিদির দিকে। সে আজ পরেছে শ্যাওলা রঙের চুড়িদার, সবসময়ের মত মাথায় ওড়না ভালো করে টানা। মুখে মাস্ক, কিন্তু চোখদুটি তেমনিই দীপ্ত। তুহিন ভদ্র ভঙ্গিতে সালাম দিল,
“আসসালামু আলাইকুম, ভাবি। ভালো আছেন?”
রিদি একটু লজুক স্বরে নিচু গলায় উত্তর দিল,
“জী, আলহামদুলিল্লাহ।”
তুহিন রিয়াদের দিকে ইঙ্গিত করে বলল,
“এই যে, এটা আমার কাজিন শালা, রিয়াদ।”
“কাজিন শালা?”
রিদির ভ্রু জোড়া কুচঁকে গেল। তুহিন হেসে উঠে বলল,
“একদিক থেকে কাজিন একদিক থেকে শালা, তাই শর্টকাটে কাজিন শালা।”
“ওহ।”
মৃদু হাসলো রিদি। এবার রিয়াদও হাসিমুখে সালাম দিল,
“আসসালামু আলাইকুম, ভাবি।”
রিদিও সৌজন্যমূলকভাবে জবাব দিল,
“ওয়ালাইকুমুসসালাম।”
এরপর একটু কৌতূহলভরে তুহিনকে জিজ্ঞেস করল,
“আপনি বিয়ে করেছেন?”
তুহিন কিছু বলার আগেই পাশ থেকে আহাদ নির্লিপ্ত কন্ঠে বলে উঠল,
“দুইটা আন্ডাকান্ডাও আছে।”
রিদি মুহূর্তে তার দিকে তাকাল। মুখে হাসি টেনে বলল,
“তাহলে ভাবিকেও নিয়ে আসতেন!”
আহাদ এবারো আর তুহিনকে কিছু বলার সুযোগ দিল না। সংকোচহীন গলায় বলল,
“কি করে আনবে, ওর বউরে ‘উমে’ বসায়া রেখে আসছে। কিছুদিনের মধ্যেই আরেকটা আন্ডাকান্ডা ফুটবে।”
রিদিতা ততক্ষণে চোখ নামিয়ে ফেলেছে, গালদুটো লাল হয়ে উঠেছে। আহাদের এমন লাগামহীন কথায় সে লজ্জায় অস্থির। সাথে তুহিনও লজ্জা পেল। রিয়াদ পরিস্থিতি সামাল দিতে দ্রুত কথার মোড় ঘুরিয়ে বলল,
“ভাই, এখন চলেন। তা না হলে সত্যিই রাত হয়ে যাবে ফিরতে ফিরতে।”
আহাদ বাঁকা হেসে বলল, “ফিরবো তোকে কে বলেছে?”
“মানে?”
তুহিন ভ্রু কুঁচকে তাকাল,
“কোথাও তুই আবার ক্যাম্পিংয়ের কথা ভাবছিস না তো?”
আহাদ কিছু না বলে দু’ভ্রু উঁচু করে একটা রহস্যময় ভঙ্গি করল। তাতেই তুহিন উত্তর পেয়ে গেলো। হেসে মাথা নাড়ল,
“বুঝে গেছি, রাজা সাহেব ফুল রোমান্স মোডে আছেন।”
লাল শাড়িতে প্রেয়সী পর্ব ৩৩
অতঃপর সবাই গাড়িতে উঠে বসল। তুহিন চালকের আসনে, তার পাশেই রিয়াদ। পেছনের সিটে পাশাপাশি বসেছে আহাদ আর রিদিতা। গাড়িটা পাহাড়ের আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে ধীরে ধীরে এগোতে শুরু করল। রিদি চুপচাপ বাইরে তাকিয়ে আছে, কিন্তু পাশে বসা আহাদের স্থির দৃষ্টি যেন প্রতিনিয়ত তাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ির গতি যতই বাড়ছে, তাদের মাঝের নিঃশব্দ বোঝাপড়াটাও যেন ঠিক ততটাই গভীর হয়ে উঠছে। মৃদু, নীরব, অথচ ভেতরে জ্বলা এক অব্যক্ত প্রেমের মতো।


