লোভ শেষ পর্ব 

লোভ শেষ পর্ব 
সুমাইয়া আফরিন ঐশী

ক্যাফেতে মুখোমুখি বসে আছে ওরা দু’জন। সিদরার মুখাবয়ব আনন্দঘন, ঠোঁটের কোণে লেগে আছে অদ্ভুত এক তৃপ্তির ছাপ। সে আরাম করে বসে কোল্ড ড্রিংকে ছোট্ট ছোট্ট চুমুক দিচ্ছে, অথচ চোখ দু’টো তার বেপরোয়া—একদম সোজা ইরফান ভাইয়ের দিকে স্থির।
ইরফান যেন অন্য জগতে বন্দি। সেদিকে তার হেলদোল নেই। তার দৃষ্টি আটকে আছে ফোনের স্ক্রিনে। মাঝে মাঝে ভ্রু কুঁচকে কী যেন পড়ে, আবার কখনো অস্থিরভাবে আঙুল চালিয়ে স্ক্রল করতে থাকে। সিদরা চুপচাপ তাকিয়ে থাকে, একটুও বিরক্তি নেই চোখে, বরং সুখ-সুখ হাসি লুকিয়ে আছে তার দৃষ্টিতে।
“পাশে বসা সুন্দরী নারীকে উপেক্ষা করে, আপনি ফোনে কী দেখছেন এত মনোযোগ দিয়ে? মাঝেমধ্যে তো একটু তার দিকেও তাকাতে পারেন, ইরফান ভাই!”

কোল্ড ড্রিংকসের গ্লাস হাতে নিয়ে চনমনে কণ্ঠে বলল সিদরা। কথার ভেতর লুকিয়ে ছিল দুষ্টুমির ছোঁয়া, চোখেও একরাশ শ’য়তানি হাসি। গ্লাসের রিমে আলতো কামড় দিয়ে সে অপেক্ষা করল, দেখার জন্য ইরফান ভাই এবার কী বলে।
মেয়েটার অপেক্ষা আর দীর্ঘ হলো না। ইরফান একবারও ওর দিকে না তাকিয়ে, হাতের ফোনটা প্যান্টের পকেটে ভরতে ভরতে আচমকা ধমকে উঠলো,
“তোর বাপ কি আমায় ড্রাইভার পেয়েছে? আমাকে দেখে কি ড্রাইভার মনেহয়?”
সিদরা আজ আর ইরফান ভাইয়ের ধমকে খুব একটা পাত্তা দিলো না। বরং মেয়েটা অনেক সাহস জুগিয়ে ফট করে বলেই ফেললো,
“আপনাকে দেখে ড্রাইভার কম বরং জামাই মেটেরিয়ালই বেশি মনে হয়!”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ইরফান অমনি সামনে বসা মেয়েটার দিকে অ গ্নি চোখে তাকালো। বিরশ কণ্ঠে আবারও ধমকে উঠলো,
“তুই আমার সাথে ফাজলামো করছিস, সিদরা? আমি তোর ভাই হই।”
সিদরা নাক সিটিয়ে উঠলো, “ইয়াক! আমি আপনাকে ওসব ভাই-ফাইয়ের চোখে দেখি না, লেফটেন্যান্ট সাহেব।”
“তাহলে কেমন চোখে দেখিস?”
ইরফান খানিকটা কৌতূহল নিয়েই প্রায় সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন ছুঁড়লো। সিদরা মেয়েটা আজ আর ধমলো না। নিজের এতোদিনের চাপিয়ে রাখা তীব্র অনুভূতিকে এক ঝটকায় উগরে দিলো, চোখে চোখ রেখেই বললো,
“জামাই-জামাই চোখে। জানেন, আপনি ছাড়া পৃথিবীর সব ছেলেরাই আমার ভাই! একদম মায়ের পেটের আপন ভাই! আমি সবাইকে সেরকম চোখেই দেখি, সত্যি বলছি।”

মেয়েটার স্নিগ্ধ, সরল, বোকা-বোকা স্বীকারোক্তি শুনে, ইরফান মনেমনে একটু হাসলো যেন। কিন্তু, তার সেই হাসি প্রকাশ পেলো না মুখাবয়বের গম্ভীরতার বেড়াজালে। হয়তো ছেলেটা ইচ্ছে করেই প্রকাশ করলো না! সবসময়ের মতো ধমকা-ধমকি আর নিজের ক্রোধের তোপের মুখেই পড়তে হলো সিদরা মেয়েটাকে।
ইরফান ভাইয়ের আ’গুন ঝড়া দৃষ্টিপাতের সামনে বেশিক্ষণ টিকতে পারলো না, সিদরা। এতক্ষণ কথার খেই হারিয়ে ফেলা মেয়েটা হঠাৎ সামনের পুরুষটিকে ভয় পেতে শুরু করলো। শুকনো ঢোক গিললো বারকয়েক। আর কোনো ভণিতা না করে সামনের মানুষটাকে মানিয়ে নেওয়ার মতো করে বললো,
“সরি! সরি! আমি মজা করছিলাম, ইরফান ভাই!”
ইরফান আর বসলো না। এ বিষয়টি নিয়ে আর ঘাঁটাঘাঁটি করলো না কেন জানি। হঠাৎ, টানটান সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সিদরাকে গম্ভীর কণ্ঠে যেন আদেশ করলো,
“বাইকে গিয়ে বোস। তোকে বাসা অবধি পৌঁছে দিবো।”
সিদরা আর কথা বাড়ালো না। চুপচাপ গিয়ে বাইকের কাছটাতে দাঁড়ালো। কিছুক্ষণ ইরফান ভাইয়ের কাছাকাছি, পাশাপাশি থাকা হবে, এতটুকুতে ভেবেই মেয়েটা দারুণ খুশী!

মেইন রোড দিয়ে ইরফানের বাইকটি চলছে। তার কাঁধের কাছটাতেই এক হাত দিয়ে পিঠ খামচে ধরে বসে আছে, সিদরা। ওরা দু’জনই চুপচাপ। ইরফানের চোখ দুটি বাইকের মিররের দিকে স্থির, যেন সে নীরবে সেখানে কিছু খুঁজছে। গোপনে, মিররের আয়নায় সে এক শ্যামময়ীকে গভীর দৃষ্টিতে দেখছে কি? কে জানে….
হঠাৎ করে মাঝরাস্তায় তার ফোনটা শব্দ করে বেজে উঠলো। ইরফান ফোনটা ব্লুটুথে কানেক্ট করে ড্রাইভিং করতে করতেই রিসিভ করলো। আচমকা, ওপাশ থেকে আদনান বেসুরো গলায় গেয়ে উঠলো,
“প্রেমে পড়লে মানুষ বন্ধু চিনে না রে দয়াল, প্রেমে পড়লে মানুষ বন্ধু চিনেনাআআআআ”
বন্ধুর অদ্ভুত গানের সুর কানে আসতেই, ইরফান আচমকা বাইকের ব্রেক টেনে ধরলো। নাক-মুখ কুঁচকে, তীব্র বি’রক্তি নিয়ে মৃদু চেঁচিয়ে উঠলো,

“ইয়াক, কী বি’শ্রী!”
অথচ ওপাশ থেকে এবার ফোনটা বোধহয় জয় নিলো। পুনরায় তার কণ্ঠে সেই একই সুরে বেজে উঠলো,
“সত্যি কথা মানুষের হজম হয় না রে দয়াল, সত্যি কথা মানুষের হজম হয় না।”
ইরফান তখন আর নিজেকে সামলাতে পারলো না, এক টান শ্বাস টেনে হতাশার সুরে বললো,
“জয়, তুইও?”
এদিকে সিদরা, ইরফান ভাইয়ের আচমকা রিয়াকশনের কারণ-টারণ কিছু বুঝতে না পেরে বেশ কিছুক্ষণ বোকার মতো তাকিয়ে রইলো। তারপর একটু কুঁকড়ে গিয়ে, প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো,
“কি হলো, ইরফান ভাই? হঠাৎ এভাবে বাইক থামালেন কেনো?”
মেয়েটার চোখে-মুখে খেয়ে গেলো মিশ্র প্রতিক্রিয়া—কৌতূহল আর অবাক বিস্ময়ের মিশেল। কিন্তু, ইরফানের মধ্যে সেরকম কিছুই দেখা গেলো না। ছেলেটা বন্ধুদের লাস্ট হু’মকি-ধ’মকি দিয়ে ফোনটা কাটলো। আবারও বাইক স্টার্ট দিলো। বাইক চলছে। কিছুটা দূরে যেতেই সিদরা আবারও কথা শুরু করলো। ঠোঁটের কোণায় হাসি ঝুলিয়ে ডাকলো,
“ইরফান ভাই?”

মিররের দিকে তাকিয়ে ইরফান ছোট্ট করে সাড়া দিলো,
“হু।”
সিদরার ঠোঁটের কোণের হাসিটা এবার আর-ও স্পষ্ট হয়। কাঁধের হাতটা আরো একটু চেপে একবার ইরফানের দিকে তাকায়, গভীর, চঞ্চল দৃষ্টিতে।
“আপনাকে একটা গল্প শোনাতে চাই।”
“গল্প?” ইরফানের কপালে ভাঁজ পড়ে।
“হ্যাঁ,” সিদরা ততক্ষণাৎ হেসে বলে, “একজন ব্যস্ত মানুষের গল্প, যে কাজের মধ্যে এত ডুবে থাকে যে, পাশে বসে থাকা কাউকে ঠিকমতো দেখতে পর্যন্ত পায় না।”
ইরফান হাসে। “এটা কি তুই আমায় বললি?”
সিদরা মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, “আপনি নিজেই বলুন না-হয়!”
ইরফান হেলমেটের ভেতর থেকে ঠোঁট এলিয়ে হাসলো। নিজের সঙ্গে আওড়াল,
“আমার দৃষ্টিতে সারাক্ষণই তুই!”

পুরুষটির এ-কথা পেছনের মেয়েটা আর শুনলো না। সে কেমন, চাতকের ন্যায় জবাবের আশায় কান পেতে ছিলো! কিন্তু, তাদের আর কথোপকথন এগুলো না। বাকিটা পথ ছিলো ইরফান নিরব। সিদরা বা আর কি বলবে? একা একা কি কথা বলা যায়? মানুষটা এমন কেন? একটু বেশি কথা বললে কি হয়?
সিদরার অদ্ভুত ভাবনার মাঝেই বাইক এসে থামলো তালুকদার বাড়ির গেইটের কাছটাতে। ইরফান সঙ্গে সঙ্গে তাড়া দিলো,
“নাম।”
সিদরার মন খারাপ হলো। এতো তাড়াতাড়ি চলে আসা লাগে? পথটা এতো ছোট! আরেকটু দীর্ঘ জার্নি হলে কার কি ক্ষতি হতো?
সিদরাকে মন খারাপ করেই বাধ্য হয়ে নামতে হলো। ও নামতেই ইরফান উল্টো পথে আবারও বাইক ঘুরালো। যা দেখে সিদরা মৃদু কণ্ঠে শুধালো,
“ভেতরে যাবেন না, ইরফান ভাই?”

“এই বিকেলটা ছিল পুরোপুরি তোর নামে, এখান থেকে এক সেকেন্ডও অন্য কারও জন্য নয়…”
রসকষহীন ভাবে, কথাখানি বলে’ই ইরফান হাওয়ায় উড়ে গেলো যেন। আচমকা, ইরফান ভাইয়ের কথাখানা ওর কাছে কেমন কেমন শোনালো! কি বললো মানুষটা? সিরিয়াসলি? ইরফান ভাইয়ের কাছে সে এতো স্পেশাল?
ভাবতেই, অষ্টাদশী প্রেমিক মনটা ভেতর থেকে আবারও ঢাকঢোল পি’টিয়ে নেচে নেচে উঠলো। অপর মানুষটার একটু আহ্লাদে, ওর ভেতরের সত্তাটা আরো আশকারা পেলো। মেয়েটা কেমন মায়াভরা দৃষ্টিতে ইরফান ভাইয়ের যাওয়ার পথটা দেখলো। আচমকা, সে পথের দিকে তাকিয়েই সিদরা বলে উঠলো,
“আপনাকে পাওয়ার লোভ কিন্তু আমি ছাড়ছি না, ইরফান ভাই।
লোভ যে খারাপ, সে কথাই তো শুনে এসেছি সারাজীবন। কিন্তু যদি সে লোভ হয় আপনাকে পাওয়ার? যদি সে লোভ হয় আপনার হাতটা ছুঁয়ে রাখার, আপনার পাশে দাঁড়ানোর, আপনার হাসির কারণ হওয়ার?

এই লোভ ত্যাগ করা যায় না, জানেন?
বরং দিন দিন বাড়ে, আরও গভীরে গেঁথে যায় মনজুড়ে।
আপনি যখন চোখের সামনে দিয়ে চলে যান, তখন মনে হয়—এই মুহূর্তেই ছুঁয়ে দিই আপনাকে।
আপনি যখন চুপ করে থাকেন, মনে হয়—আপনার মনের সব শব্দ শুনে নিই আলগোছে।
আপনি যখন হাসেন, মনে হয়—এই হাসিটা আমার একার করে নেই।
আপনাকে পাওয়ার লোভটা যদি অপরাধ হয়, তবে আমি আজীবন অপরাধী হয়ে থাকতে রাজি।
কারণ এই লোভের বিচার শুধু আমার হৃদয়ই করতে পারে, আর সে তো আপনার দিকেই ঝুঁকে আছে…
আপনি কি আমাকে এই লোভের অতল সাগর অব্ধি ডুবে যেতে দেবেন, ইরফান ভাই?”

কারো বক্ষ জুড়ে রঙিন বসন্তের আনাগোনা, আর কারো বক্ষ জুড়ে তীব্র ক্ষরা। চার দেয়ালের অন্ধকার ঘরটার মাঝেই আজকাল নিজেকে বন্দি করে রেখেছে অধরা। দিন-রাত কেটে যাচ্ছে হতাশায়, অথচ মুক্তির কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছে না সে। বাবা-মায়ের সম্পর্কটাও দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে, কিন্তু তার যেন তাতে কোনো হেলদোল নেই। কারণ, সে-তো নিজের ভেতরেই এক ভয়ংকর ঝ ড় বয়ে চলেছে—সেদিনের নিজের করা পাপ তাকে প্রতিনিয়ত দ গ্ধ করে চলেছে। বুকের ভেতর সেই ভুলকে লালন করেই কোনোমতে শ্বাস নিচ্ছে মেয়েটা, কিন্তু ভালো থাকা আর হয়ে উঠছে না।
জীবনে কিছু ভুল থাকে না, যা মানুষকে সারাজীবন কাঁদিয়ে যায়—তাদের আর কখনো সত্যিকারের শান্তি মেলে না। অধরার ক্ষেত্রেও যেন তাই হচ্ছে। প্রতিদিনের মতো আজও সে নিজের সমস্ত ভুলগুলোর হিসেব কষছিল, অথচ সেগুলোর ভার বইবার শক্তি আর অবশিষ্ট নেই তার মধ্যে।
সে ভাবছে, “লোভ করে কী হলো? সর্বহা’রা ছাড়া কিছু পেলাম কি?”

সব পেতে পেতেও যেন তার কিছুই পাওয়া হলো না। এক মুহূর্তের লোভ, এক মুহূর্তের ভুল সিদ্ধান্ত—তার পুরো জীবনকে তছনছ করে দিয়েছে, শেষ করে দিয়েছে সব, সব। অতীতের স্মৃতিগুলো একের পর এক চোখের সামনে ভেসে উঠছে কেমন! প্রতিটি মুহূর্ত তাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে তার নিজের করা পাপের কথা।
বুকের ভেতর শূন্যতা আর অপরাধবোধের এক দ’হনে ক্ষণে ক্ষণে পু’ড়ছে অধরা। একসময় যা চেয়েছিল সে, যা পাওয়ার জন্য সবকিছু ত্যাগ করেছিল, আজ তা-ই তার কাছে অর্থহীন মনে হচ্ছে। এখন কেবল তার অবশিষ্ট রইলো দীর্ঘ এক শূন্যতা, আর আকাশ সমান আফসোস।

“লোভ করে সে কি পেল? কিছুই তো নয়—শুধু হাহাকার, শুধু হারানোর যন্ত্রণা।”
মেয়েটা প্রতিদিনের মতো আজ-ও ফুপিয়ে উঠলো আচমকা। ঝড় ঝড় করে কাঁদলো কতক্ষণ… হঠাৎ, মুখে ওড়না চেপে হতাশ কণ্ঠে আওড়াল,
“তীব্র লোভ করে আমি কেবল তোমাকেই পেতে চেয়েছিলাম, অথচ দেখো—দিনশেষে আমি কিছুই পেলাম না! না তোমাকে, না নিজেকে।”

লোভ পর্ব ৮

ওট কণ্ঠে ছিলো এক ধরনের নিষ্প্রাণতা। কান্না থামানো সম্ভব হচ্ছে না, বুকের ভেতরের যন্ত্রণা থেকে-থেকে আরও তীব্র হয়ে উঠলো। হৃদয়ের গভীর থেকে বের হয়ে আসলো আরো কিছু শব্দ।
“জানো, এখন শুধু জীবন আমাকে বারবার উপলব্ধি করাচ্ছে, ‘সততা যেখানে, শান্তি সেখানে; লোভ যেখানে, অশান্তি সেখানে।”

সমাপ্ত