শাহজাহান তন্ময় পর্ব ১১+১২

শাহজাহান তন্ময় পর্ব ১১+১২
Nabila Ishq

জানালায় পর্দা লাগানো হয়নি। ফলস্বরূপ স্কাই-ব্লু থাই-গ্লাস ভেদ করে সূর্যের স্পর্শ পড়েছে তন্ময়ের মুখমণ্ডল জুড়ে। ঘর জুড়ে সূর্যের প্রতিফলন। আড়মোড়া ঘুম ভাঙে। তার পায়ের ওপর লম্বা পা-জোড়া ফেলে রেখেছে সৈয়দ। পিঠের ওপর মাহিনের মাথা। চোখের সামনে ইব্রাহিম নাক ডেকে যাচ্ছে। এদের একেকজনের ঘুমের ভঙ্গিমা ভীষণ রকমের বিশ্রী। তন্ময় সবগুলোকে ঠেলেঠুলে উঠে বসে। জানালার সামনে এসে দাঁড়ায়। বাইরে নজর ফেলতেই ভাবনায় আসে, রুমে পর্দা লাগানো প্রয়োজন।

এতো আলো ঘরে থাকাটা তার মোটেও পছন্দ নয়৷ নিভু-নিভু রুম তার স্বাচ্ছন্দ্যের। সেদিকে অরু আবার ভিন্ন। মেয়েটা জানালা কখনো লাগায় না, না লাগায় সে পর্দা। ঘর-দুয়ার আলোয় আলোয় রাঙিয়ে রাখে। দুদন্ড আঁধার মেনে নিতে পারে না। সবকিছু উজ্জ্বল এবং রঙবেরঙের হতে হবে ওর। তন্ময় যদি এই মেয়ে নিজের রুমে তোলে, জীবন যৌবনের সব চাওয়া-পাওয়া ছেড়ে দিতে হবে। অবশ্য সে ছাড়তেও রাজি৷ ভাবতেই ঠোঁট জুড়ে বিচিত্র হাসি ছুটে এলো। সেলফোন হাতে নিল। অরুর ম্যাসেজ এসেছে ভোর পাঁচটায়। মেয়েটা ঘুমোয়নি। জেগেই ছিল সারারাত! তরতর করে ম্যাসেজ দিয়েই চলেছে ছ’টা পর্যন্ত। একে এখন আর লাই দিয়ে মাথায় চড়ানো যাবে না। একটু-আধটু ধমকে রাখতে হবে। নাহলে যেই বয়সে ও পড়েছে! সবকিছু ভস্ম করার পূর্বে তন্ময়কেই জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ভস্ম করে ফেলবে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ব্রেকফাস্ট খেতে বসে হৈ-হুল্লোড়ের ঠ্যালায় তন্ময়ের মাথা ব্যথা শুরু হলো। তার বন্ধুবান্ধব থাকবে আর মাথা ব্যথা হবে না, তা আদোও সম্ভব? চুপচাপ খেতে থাকা তন্ময়কে খোঁচানোর একটুকরো সময় ব্যয় করছে না মাহিন। পরিমাণ মতো তেলে ভাজা রুটির সঙ্গে আলুভাজি খেতে খেতে বলে,
‘কোন কোন কোম্পানিতে এপ্লাই করলি?’
তন্ময় সাবলীল গলায় জবাব দিল। কোম্পানির নাম গুলো বলল। পরমুহূর্তেই রিহানের মুখ খুলল। এতক্ষণ মুখে কুলুপ এঁটে বসে ছিল। জবেদা বেগম ছিলেন কি-না! যেই না তিনি রান্নাঘরে গেলেন, ওমনি বুলেটের গতিতে বলে উঠল,

‘খেয়াল রাখিস। চারপাশে নজর দিস। কখন না কখন আবার রমনীগণদের বুকে টোকা মেরে দিবি! ওমনি পিছু পড়ে যাবে তোর। ভূলবসত আবার কোম্পানির এমডির কচি মেয়ের হৃদয় নিয়ে ফেলিস না। কেস খাবি বলে দিলাম।’
হেসে উঠল সৈয়দ। কিছু একটা মনে পড়েছে এমন ভঙ্গিতে বলে ওঠে,
‘রাইসার কথা মনে আছে? রিসাবের বোনটা! মেয়েটা কি পাগল ছিল তন্ময়ের! কতকিছুই না করেছে। এখনো আমায় পেলে জিজ্ঞেস করে, তন্ময় কেমন আছে!’
‘বিয়ে হয়ে গিয়েছে শুনেছিলাম।’
‘এখন বাচ্চাও আছে একটা।’
তন্ময়ের খাওয়ার ভঙ্গিমার মোটেও পরিবর্তন এলো না। সে নিজের মতোই খেয়ে চলেছে। বন্ধুদের কথায় একটু-আধটু মুখ তুলছে। সে যেমন নিজের বন্ধুদের হাড়গোড় সহ চেনে, তেমনি তার বন্ধুরা তার হাড়গোড় সহ চেনে। তাই তাদের এসব অদ্ভুত কথাবার্তার সমাপ্তি ঘটবে না, যতক্ষণ না তন্ময় বলবে, ‘আহ, থামবি তোরা!’

বড়ো বড়ো কোম্পানির বড়সড় পদ গুলোতেই সিভি ড্রপ করেছিল তন্ময়। দুটো থেকে ডাক পড়েছে পরদিনই। ডাক পড়ারই কথা। তাদের নিজেদের কোম্পানি বড়ো বড়ো কোম্পানির সাথেই যুক্ত। শাহজাহান লিমিটেড গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির প্রেসিডেন্ট পদে সে ছিল কিছুদিন। সাতটা ফ্লোর তার আন্ডারে ছিল। ছ’মাস সময় নিয়েছে তাদের যাবতীয় কাজের সূত্রপাত শুরু থেকে বুঝে নিতে। গতমাস থেকেই সে তাদের বেশ কিছু ব্যবসা বুঝে নিয়েছিল। নিজেই দেখত। সেগুলোর দায়ভার তার ওপর ছিল। তার সিগনেচার ছাড়া কোনো কিছু নড়চড় হতোনা। এতসব প্রাপ্তি নিয়ে একটা ভালো মানের চাকরি পাওয়া, তারজন্য কঠিন বিষয় অবশ্যই নয়। কিন্তু সে চাচ্ছিল না মোস্তফা সাহেবের নাম কামিয়ে চাকরি করতে। আবার তাছাড়া উপায় ও দেখা যাচ্ছে না। জবেদা বেগম আছেন সঙ্গে। তার দায়িত্ব তন্ময়ের। সেই দায়িত্ব পালন করার বড়ো রাস্তা টাকাপয়সা। তাই এক্ষুনি চাকরি দরকার। বাবার ওপর জেদ ধরে বসে থাকা সম্ভব নয়।

তন্ময়ের সেলফোন লিভিংরুমে। সেটি কখন থেকে বেজে চলেছে। জবেদা বেগম রান্নাঘর থেকে ছুটে এলেন। ফোন হাতে নিয়ে ছেলের রুমে প্রবেশ করেন। তন্ময় গোসলঘরে। তিনি শব্দ করে ডাকেন,
‘অ্যাই তন্ময়! ফোন বাজছে।’
তন্ময় ‘আসছি’ বলে ছোট জবাব দেয়। মিনিট খানিকের মধ্যেই বেরিয়ে আসে। জবেদা বেগম ততক্ষণে ফোন রেখে চলে গিয়েছেন। তন্ময় ফোন হাতে নিলো। কল এসেছে তার চাচ্চু, ওহী সাহেবের৷ পুনরায় আসতেই রিসিভ করে তন্ময়। ওপাশে ওহী সাহেব গলা খাঁকারি দিয়ে ওঠেন। রক্ষ গলা কোমল করার ভঙ্গিতে ডাকেন,

‘তন্ময়!’
‘জি চাচ্চু।’
‘কি অবস্থা তোমাদের?’
‘এইতো ভালো।’
‘এভাবে পড় করে ফেললে চাচ্চুকে?’
তন্ময় নিঃশব্দে হাসে। সে সত্যিকারের অর্থে একজন শাহজাহান। বাপচাচারা যেমন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কথা বলতে জানে না, তেমন সেও জানে না। এইযে ওহী সাহেব কথা খুঁজতে চাচ্ছেন কিন্তু পাচ্ছেন না ব্যাপারটা তারজন্য হাস্যকর বটে৷ সে খুব সাধারণ ভাবেই জবাব দেয়,

‘ইম্পসিবল। আপনারাই তো সব।’
‘আমিতো তাই জানি। তাহলে বলছিলাম যেটা! আমরাই সব! আমরাই সব বলতে অবশ্যই আমি আর আনোয়ার তো, তাই না? বড়ো ভাইজানের সাথে রেগেছ সেটা ভাইয়ার ওপরে। আমাদের ওপরে ত রাগ নেই! আমিতো এরমধ্যে একদমই নেই। আর জানোই, আমি একটু অসুস্থ। সেই চট্রগ্রাম গিয়ে ব্যবসার দেখাশোনা করতে পারছি না। আব্বা, তুমি যদি একটু…’
তন্ময় মাঝপথেই ডেকে ওঠে,
‘চাচ্চুউ! শাহজাহান ব্যবসায় আমি আর থাকব না। আমি অন্য কোম্পানিতে এপ্লাই করছি। দোয়া করবেন যেন জব-টা হয়ে যায়। আর শাহজাহান মোস্তফা সাহেবকে বলে দেবেন, আমি শাহজাহান তন্ময় তার টাকাপয়সা ছাড়া বেশ চলতে পারব।’

ওহী সাহেবের ফোন স্পিকারে দেওয়া ছিল। তন্ময়ের কথাগুলো উপস্থিত সকলে শুনতে পেলো স্পষ্ট। লিভিংরুমে বসে থাকা মোস্তফা সাহেবের মুখশ্রী কালো হয়ে গেল। ওহী সাহেব আলগোছে স্পিকার সরিয়ে ফেলেন। থতমত খাওয়া বললেন,
‘বলছিলাম যে… ‘
সে-মুহুর্তে মোস্তফা সাহেব শব্দ করে বলেন,
‘ওকে বলে দে ওহী, আমি শাহজাহান মোস্তফা ওর হাত-পা ধরে কোম্পানিতে আনতে যাব না। ও না আসলে না আসবে। আমি আমার সম্পত্তি গোল্লায় ফেলব। জলে ঢালব, বিলিয়ে দিব। তাও ওকে ধরেবেঁধে আনতে যাব না। যাক… ও নিজের রাস্তায়। বাবার আর দরকার কী! বড়ো হয়েছে এখন যা ইচ্ছে করবে! আমি মরে যাচ্ছি না… ওদের ঘরে তোলার জন্য… ‘

তন্ময়ের এবার সামান্য হাসিই পেলো। সঙ্গে এই এক্ষুনি বাবাকে দেখার বড়ো পিপাসা জন্মাল। মানুষটা নিশ্চয়ই প্রেসার বাড়িয়ে ফেলেছে। গলার স্বর ও অচেনা লাগছে। ভেঙে ফেলেছে কন্ঠ। ওই কন্ঠস্বর শোনার মতো শক্ত মন তন্ময়ের আপাতত নেই। সে বাবার কথা মাঝপথে থামিয়ে বলে,
‘এসব বলে লাভ নেই। আমি শাহজাহান তন্ময় ফিরছি না। ফিরব না। রাখলাম।’
মোস্তফা সাহেব চোখ রাঙালেন ওহী সাহেবের ফোনের ওপর। তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফোনের ওপাড়ে থাকা তন্ময়ের ওপর যেন!

বিকেলে তন্ময় বেরোচ্ছিল! তখনই দেখতে পেলো একজন ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে। মোটাসোটা ধাঁচের খাটো ফর্সা মহিলা। তাদের ফ্ল্যাটেই এসছেন যেন! ওর আগাগোড়া দেখে আরেকদফায় হাসলেন। অপ্রস্তুত তন্ময় সালাম জানালো। মহিলা এবার আরও উদ্বিগ্ন চোখে তন্ময়কে দেখতে থাকলেন। হেসে বললেন,
‘আমি তোমার বাড়িওয়ালা আন্টি বাবা। ওপরের ফ্ল্যাটে থাকি। ব্যস্ত থাকার কারণে আসতে পারিনি। তোমার আম্মু আছে বাসায়?’
‘জি। ভেতরে।’

সদরদরজার সামনে আসতেই দারোয়ানের সাথে দেখা। টুকটাক কথা বলে বেরোতেই তার চোখ গেল মোড়ে। গোলাপি ফুলের গাছটার নিচে সাইকেল হাতে অরু দাঁড়িয়ে। এদিক-ওদিক সমানে তাকাচ্ছে। একে-ওকে ডেকে কিছু একটা জিজ্ঞেস করছে৷ সাদা ফ্রোক পড়েছে। লম্বা চুলে বিনুনি। দুদিন না দেখেই তন্ময়ের মনে হলো, মেয়েটাকে সে বছর ধরে দেখেনি। বেবিপাওডারের গন্ধটাও যুগ যুগ ধরে শুঁকেনি। দু-পাশে মাথা দুলিয়ে এগোল সামনে। তাকে দেখতে পেয়েই অরুর চোখজোড়া বড়ো হয়ে গেল। পরমুহূর্তেই কান্নারত মুখশ্রী জলে ভিজে ওঠে। সাইকেল খানা হাত ফসকে পড়ে। তন্ময় চটজলদি সেটা এক হাতে ধরে।

ওমনি অরু ছুটে এসে তার বুকের মধ্যে পড়ে। যে কাজটা তন্ময় করতে পারতো না, কিন্তু তার আকাঙ্খায় ছিল, সে কাজটা অরু করে বক্ষে একরাশ শান্তি দিয়ে ফেলল। সমানে নাক টানার শব্দ আসছে। বুকের অংশের শার্ট নিশ্চিত চোখের জলে, নাকের জলে ভিজিয়ে ফেলেছে। তন্ময় মাথা তুলে তাকাতেই দেখল, আশেপাশে মানুষ তাকিয়ে। অরু তখনো কাঁদছে শব্দ করে। পাশে দিয়ে যেতে থাকা ছোকরা গুলো বিড়বিড় করছে। বিড়বিড় করে কি বলল, তা স্পষ্ট শুনল তন্ময়,
‘আমার গার্লফ্রেন্ড এমন করলে বুকের মধ্যে এতক্ষণে ঢুকিয়ে ফেলতাম ভাই! এই লোক কেম্নে এভাবে দাঁড়িয়ে কাঠের মতো!’

এইযে তন্ময় কাঠকাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে। হাত জোড়া ঠিক কোথায় রাখবে ভেবে পাচ্ছে না। মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে আছে। অরু হচ্ছে আগুনের দ্বিতীয় রূপ। যাকে ছুঁয়ে দিলেই ধ্বংস নিশ্চিত।
এসেছে অবদি মেয়েটা জাপ্টে ধরে আছে তাকে। ওরকম নরম তুলতুলে শরীর লেপ্টে রাখার কোনো মানে হয়? ও কি ছোটো আছে? নির্ঘাত সে ধৈর্যবান পুরুষ। তার জায়গায় অন্যকেউ হলে মাথায় আগুন লাগিয়ে ঝলসে যেতো! পৃথিবী ত্যাগ করে বসত! ইচ্ছে তো করছে বড়ো এক রামধমক দিতে। তবে শেষমেশ অরুর মায়াবী-করুণ মুখমণ্ডল দেখে, ধমক দেওয়ার ইচ্ছেটা পূর্নতা আর পেলো না।

চুপচাপ রয়েসয়ে রইল তন্ময়। কিন্তু সেটুকুও থাকতে পারলো না। অরুর শরীর আরেকটু নিবিড়ভাবে লেপ্টে আসতেই মগজ জ্বলে ওঠে! দ্রুত অরুর কপালে আঙুল ছুঁয়ে সরিয়ে দেয়। নাকমুখ লাল করে ফেলেছে কেঁদেকেটে। ফুলে টমাটো হয়েছে গাল দুটো। চোখের জল নাকের জল লেপ্টে এলাহি কান্ড। তন্ময় নিজের বুকের দিক তাকাল। ভিজিয়ে ফেলেছে। শার্ট পরিবর্তন করা প্রয়োজন।
প্যান্টের পেছন পকেট হাতড়ে রুমাল বের করে।
অরুর হাতে ধরিয়ে বলে,

‘অরু! একদম চুপ! এতো কাঁদার কি আছে? এখনো বেঁচে আছি।’
‘আ..আপনি এভাবে কথা বলতে পারছেন আমার সাথে? একটুও মিস করেন নাই আমাকে!’
রুমালটায় সর্দি মুছে মুহুর্তে নষ্ট করে ফেলে অরু। তারপর ওটাকে তন্ময়ের সামনে এগিয়ে ধরে, জেনেও যে তন্ময় ওটা আর নিবে না। তন্ময় তখন সরু চোখে তাকিয়ে অরুর পানে। এভাবে তাকানো দেখে অরু ভড়কায়,
‘একটুই ত ময়লা হয়েছে! আমি ধুয়ে দিব।’

তন্ময় জবাব দেয় না। পাগলের সাথে আগ বাড়িয়ে কথাবার্তা বাড়ানোর কোনো মানে নেই।
আপাতত বন্ধুদের একটা কল দেওয়া প্রয়োজন। সে মূলত বেরিয়েছিল ওদের কাছে যাওয়ার জন্য। এখন অরুকে ফেলে যাওয়া অসম্ভব ব্যাপার স্যাপার। মাহিনকে কল করে জানালো, সে যেতে পারবে না। কাল সন্ধ্যায় দেখা করবে। সেলফোন প্যান্টের পকেটে ভরে, সাইকেলটা শক্তপোক্ত ভাবে ধরে। সাইকেলের সামনের ঝুলিতে একটি ফুলগাছ। খুব সুন্দর স্যাট করা। ডেকোরেশন করে রেখেছে পুরো সাইকেল জুড়ে। মেয়েটা ডেকোরেশনে এক্সপার্ট, মানতেই হয়। অরু তন্ময়ের নজর খেয়াল করে গাল ফুলিয়ে হাসে। আগ বাড়িয়ে বলে,

‘সুন্দর না? ফুল এতটাই সুন্দর যে এটা যেখানে থাকে সেটাও সুন্দর হয়ে ওঠে! দাঁড়ান, আপনার পকেটে একটা ফুল গুঁজে দেই।’
‘না।’
‘আরে একটাই তো…’
অরু হুড়মুড়িয়ে একটা ফুল ছিঁড়ে নেয়। তন্ময়ের সামনে দাঁড়িয়ে শার্টের পকেটে ফুলটা গুঁজে দেয়। মুগ্ধ নয়নে দেখতে লাগে। কি সুন্দর ফুটে উঠেছে ফুলটি তন্ময়ের স্কাই রঙের শার্টের সঙ্গে! তন্ময় দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে। সাইকেল হাতে চালিয়ে সামনে অগ্রসর হয়। সেই পর্যন্ত অরুর মুখ এক-সেকেন্ড থেমে নেই,

‘কোনটা বিল্ডিং? ওইযে গাছের সাথেরটা? সুন্দর। চলুন তাড়াতাড়ি যাই। বড়ো মা কেমন আছে? কি করছে সে? নিশ্চয়ই আমার জন্য কেঁদেছে? আমি জানি তো। আপনি মিস না করলেও, বড়ো মা আমায় ভীষণ মিস করেছে….’
এবং অরুর কথার শেষ নেই। চলতেই থাকে। তন্ময় সামনে তাকিয়ে। যেমন পাশের মেয়েটি কি বলছে তার গ্রাহ্য নেই! অথচ কানে প্রত্যেকটা শব্দ ভেসে আসছে। এবং একজন বিচক্ষণ শ্রোতা হয়ে শুনছে। সদরদরজায় দাঁড়ানো দারোয়ান চাচা হাসে। তন্ময়কে প্রশ্ন করে,
‘কি হয় তোমার!’

তন্ময়ের জবাব দিতে হয় না। অরু হুড়মুড়িয়ে এগিয়ে সামনে যায়। গলার স্বর নামিয়ে বলে,
‘আমরা খুব আপন। কেমন আপন ভবিষ্যতে বলব!’
দু-চোখে ডান হাতের আঙুল চেপে নিঃশব্দে, অগোচরে হেসে ফেলে তন্ময়। এবং অরুর মাথা ফেরার পূর্বেই হাসিটুকু মিলিয়ে নেয়। ওদিকে বোকার মতো তাকিয়ে থাকে দারোয়ান চাচা। তন্ময় আর তাকে বিশ্লেষণ করে না। সাইকেল ডাউন ফ্লোরে রেখে, অরুকে নিয়ে লিফটে চড়ে। মেয়েটা একমুহূর্ত শান্ত থাকে না। এইযে পাশে গুইসাপের মতো নড়েচড়ে যাচ্ছে। আড়চোখে সমানে তাকাচ্ছে। একবার ওপরে, একবার নিচে। যেন সে তন্ময়ের আগাগোড়া মুখস্থ করছে। অরু পিটপিট করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে মুখ খোলে,

‘কোথাও যাচ্ছিলেন তন্ময় ভাই?’
‘হু।’
‘কোথায় যাচ্ছিলেন?’
তন্ময় পলক নিচু করে তাকায়। অরু তার তুলনায় ছোটো। দেখতেও ছোটো, লম্বায় ও ছোটো। এই কারণ বসত উঁচু জুতো পরে থাকে ইদানীং। বিষয়টি লক্ষ্য করেছিল সে। আড়ালে আবডালে হেসেছিলও। তবে আজ স্নিকার পরে এসেছে। তাই ঠিক তার বুকের মাঝের উচ্চতায় স্থান পেয়েছে। পলক নিচু করলেই ওর আগাগোড়া মাপা যায়। ঠিক তার এক হাতে সম্পূর্ণ অরু এঁটে যাবে। নজর সরিয়ে নিয়ে বলে,

‘ধানমন্ডি লেক।’
‘আপনার বন্ধুদের কাছে? ওইযে লম্বা ভাইয়াটা?’
‘কোন লম্বা?’
‘ওইযে ইব্রাহিম নামের।’
‘হু।’
‘আমি ওই ভাইয়াটার একটা সিক্রেট জানি।’
‘কি সিক্রেট?’
‘বলব না।’

লিফটের দরজা খুলেছে। ওমনি অরু দৌড়ে চলে গেল। ফ্ল্যাট চিনতেই সেখানে লাগাতার বেল বাজাতে শুরু করে। ভেতরে জবেদা বেগম একপ্রকার আতঙ্কিত হয়ে ছুটে আসেন। স্পটে অরুকে দেখে চটজলদি দরজা মেলে দেন। অরু ঝাপিয়ে পড়ে জবেদা বেগমের বুকে। কাঁদতে থাকে দিনদুনিয়া ভুলে। এইযে একটু আগে তন্ময়ের সামনে কে হাসছিল? এই মেয়েটার মুড পরিবর্তন হতে মিনিটের প্রয়োজন পড়ে না। তন্ময় আঁড়চোখে তাদের দেখে ভেতরে ঢুকে। জুতো রেখে লিভিং-রুমে আসতেই থমকে যায়। বাড়িওয়ালা আন্টি এখনো আছেন। সোফায় বসে। তন্ময়কে দেখেই মিষ্টি করে হাসেন। তন্ময় পুনরায় সালাম দেয়। এবং আলগোছে নিজের রুমে চলে যায়, কথাবার্তা বাড়ানোর সুযোগ না দিয়ে।

রাহনুমা বেগম চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে প্রশ্ন করেন,
‘কি হয় আপনার?’
জবেদা বেগম অরুর চুলের মধ্যে আঙুল চালাতে চালাতে হেসে বলেন,
‘আমার আরেক মেয়ে।’
রাহনুমা বেগম হাতের ইশারায় অরুকে কাছে ডাকেন। অরু নেচেকুঁদে এগোয়। পাশে বসে। ওমনি রাহনুমা বেগম জিজ্ঞেস করেন,
‘কি নাম গো তোমার?’
‘আরাবী।’
‘বাহ! সুন্দর নাম। কে রেখেছে?’
‘আমার চাচ্চু। চাচ্চু বলেছেন এই নাম আমার জন্য তৈরি। আবার তন্ময় ভাই-র নাম ও তারজন্যই তৈরি, এটাও বলেছেন।’

‘তন্ময় বুঝি তোমার খুব পছন্দের ভাইয়া?’
অরু কী খানিক লজ্জা পেলো? হয়তো! মেয়েটা হুড়মুড়িয়ে উঠে জবেদা বেগমের পেছনে চলে এলো। হাসলেন রাহনুমা বেগম এবং জবেদা বেগম দুজনেই। তন্ময় তখন দুয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে। বোতলটা নিতে এসেছিল। এমন কান্ড দেখে স্মিথ হাসি ঘেঁষে আসে ঠোঁট জুড়ে। নিজের রুমে ঢুকে পুনরায়। চেয়ারে বসে সে কমবেশ সবকিছুই শুনছে।
জবেদা বেগম অরু গাল টিপে শুধালেন,
‘কান্নাকাটি ত অনেক করলি। এখন বল, কি খাবি?’
‘আবহাওয়া সুন্দর। খিচুড়ি করে দিবে বড়ো মা? গরুর মাংস সাথে!’

জবেদা বেগম হেসে মাথা দোলান। পা বাড়িয়ে রান্নাঘরে ছোটেন। তন্ময় ঠিক জানে অরু এখন ছটফটিয়ে তার রুমে ঢুকবে। হলোও তাই! এসেই মাতব্বরি শুরু করেছে। নিজে নিজে এটা-ওটা ধরে ধরে দেখছে। তন্ময়ের রুমে এভাবে ঢুকে সবকিছু হাতানোর সাহস বাড়িতে কারোর নেই। কেউই করে না মূলত। অথচ এই মেয়েটা তার রুমের সবকিছু উলটপালট করে দেখবে। তন্ময় একটা সাধারণ ধমক ছাড়া কিছুই বলতে পারে না। এইযে এখন সে তন্ময়কে ডিঙিয়ে টেবিলের সব ধরছে। শব্দ করে প্রশ্ন করছে, এটা কি, ওটা কি!
তন্ময় একপর্যায়ে গম্ভীর স্বরে ডাকে,

‘অরু!’
‘একটু দেখছিলাম মাত্র।’
এতটুকু বলে চুপচাপ বিছানার কোণে গিয়ে বসে পড়ে। তন্ময় সেদিকে একবার তাকিয়ে পুনরায় নজর ল্যাপটপে ফেলে। তন্ময়ের অ্যাটেনশন না পেয়ে অরু ধীরেসুস্থে বেরিয়ে যায়। সে মুহূর্তে কল আসে আনোয়ার সাহেবের। তন্ময় রিসিভ করে। ওপাশে চিন্তিত গলার স্বর,
‘তন্ময়! অরু গিয়েছে?’
‘জি চাচ্চু। এখানেই।’
‘ওহ আচ্ছা। কখন বেরিয়ে গেল কেউই জানি না। বাইরের অবস্থা ভালো না। ঝড়বৃষ্টি হবে মনে হয়। এগুলো না থামা অবদি অরুকে ছেড়ো না। অবশ্য আজ ফিরতে চাইবে না। জোরপূর্বক পাঠানোর প্রয়োজন নেই। একটাদিন থাকুক। বড়ো বড়ো মা করে পাগল হয়ে গেছে মেয়েটা।”

‘জি আচ্ছা। ঠিকাছে চাচ্চু।’
কল কেটে দরজার দিক তাকায় তন্ময়। অরুর কন্ঠের স্বর ভেসে আসছে রান্নাঘর থেকে। জবেদা বেগমের সাথে হৈ-হুল্লোড় করছে। পকেটে ফুলটা এখনো রয়েছে। সেটি হাতে নেয়৷ ছোটো ফুল। খুব আলগোছে ফুলটা ডায়েরির ভেতর রাখে৷ তারপর শার্ট খুলে ওয়াশরুম ঢুকে, দরজা লাগায়। এবং সে নিশ্চিত ভাবে বলতে পারে, অরু পুনরায় তার রুমে ঢুকেছে। এখন হয়তো ওয়াশরুমের দরজার সামনে কান পেতে দাঁড়িয়ে।

শাহজাহান তন্ময় পর্ব ৯+১০

তন্ময় মাঝেমধ্যে ভাবে, সে যদি নিজের মনমাফিক কাজ করে, তাহলে কী হবে? কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তার আর অরুর সম্পর্ক? নিজেকে আটকে না রাখলে কী খুব বেশি ক্ষতি হবে? এইযে সে এখন অর্ধ-উলঙ্গ। শরীরে কিছু নেই, শুধু প্যান্ট ছাড়া। সম্পূর্ণ ভিজে আছে। এই মুহুর্তে যদি সে দরজাটা খুলে অরুকে টেনে ভেতরে নেয়, ব্যাপারটা কেমন হবে? অরু এরপর নিশ্চয়ই আর এমন ভাবে কান পেতে থাকার সাহস পাবে না। বরং ভীষণ ভয় পাবে।
তন্ময় দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে। চোখ বুঝে দেয়ালে মাথা ঠেলে দাঁড়ায়। শাওয়ার ঝর্ণা থেকে হুড়মুড়িয়ে পানি পড়ছে। বেয়ে চলেছে তা তার সর্বাঙ্গ জুড়ে….

শাহজাহান তন্ময় পর্ব ১৩+১৪

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here