শাহজাহান তন্ময় পর্ব ১৩+১৪

শাহজাহান তন্ময় পর্ব ১৩+১৪
Nabila Ishq

হোয়াটসঅ্যাপে একটা গ্রুপ-চ্যাট খোলা আছে তন্ময়দের। নাম ‘উই আর রকস’। এখানে সবগুলো বন্ধু অ্যাড। দিনরাত টুকটাক টাইপিং চলতে থাকে। আজও তাই। তন্ময় দুবার গিয়েছে। রিপ্লাই দিয়ে এসেছে। তাও হচ্ছে না ওদের। একের পর এক কল করছে। কলে জয়েন করেছে মাহিন আর রিহান। তন্ময় বাধ্যতামূলক রিসিভ করে। স্পিকারে দিয়ে ফোন টেবিলে রাখে। হাতের ফাইলে মনোযোগ দেয়। মাহিন আর রিহান কিছু একটা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করছে। একসময় তর্ক থামিয়ে মাহিন উচ্চস্বরে বলে,

‘অ্যাই তন্ময়!’
‘হু।’
‘শুনলাম তোর ভবিষ্যৎ পিচ্চি বউ এসেছে।’
‘…..’
‘কই তোর বাচ্চা প্রেয়সী? আশেপাশে? কান্না করেছে? বেচারি! নিশ্চয়ই কান্নাকাটি করছে। কান্না করতে মানা কর। আমি আছি ওর জন্য। অনেক যত্ন করে বড়ো করব। তোর থেকে ভালো রাখব।’
‘……….’
তন্ময়ের জবাব না পেয়ে মুখ টিপে হাসে মাহিন। রিহান হেসে হেসে বলে,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘বাচ্চা প্রেয়সী কই আর থাকবে? তন্ময়ের কোলে বসে ফিডার খায়।’
‘এরজন্য ডিরেক্ট কোলে বসে?’
তন্ময় ধীরেসুস্থে স্পিকার সরিয়ে ফেলে। অরু একটু পরপর উঁকিঝুঁকি দিতেই থাকে। এসব শুনে ফেলতে পারে। সে কানে ফোন গুঁজে গলা নামিয়ে বলে,
‘কোলে বসিয়ে ফিডার খাওয়াব নাকি চুমু সেটা তো তোদের বলব না।’
মুহুর্তে হৈচৈ শুরু করে মাহিন। রিহান চিৎকার চেঁচামেচি করছে। কান থেকে ফোন সরাতে হলো তন্ময়ের। এতো শব্দ করে ছেলেগুলো!

অরু অনেকক্ষণ যাবত বিড়বিড় করছিল, বৃষ্টি কেন আসছে না! তন্ময় আড়চোখে তাকিয়ে শুনছে শুধু। ক্ষনে ক্ষনে মেয়েটা জানালার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বাইরেটা দেখছে। বৃষ্টি শুরু হলে তারপরই নাকি, সে খেতে বসবে গরম-গরম খিচুড়ি। এটাই তার বাহানা। বাহানা খানা জবেদা বেগম মেনে নিলেও, তন্ময় মানেনি। ধমক দিয়েছে। সেই ধমকে কাজ হয়নি। উল্টো মুখ গোমড়া করে চুপসে আছে।
কিছুক্ষনের মধ্যেই আকস্মিক একঝাঁক বৃষ্টি নামল। প্রবল বৃষ্টির শব্দ ভেসে আসছে। বাতাসের প্রলয়ের সঙ্গে লেপটেছে সেই বৃষ্টির জল। ছুটে আসছে জানালা দিয়ে। অরু সেদিকে ছুটে গিয়ে দাঁড়াতেই ফোঁটা ফোঁটা জল স্পর্শ করছে তাকে। মুখশ্রীতে এসে পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি। বাইরে তখন আঁধার। গুমোট আবহাওয়া আঁধারের পরিমাণ বাড়িয়ে তুলেছে।

রাস্তার হলদেটে বাতির আলো বৃষ্টির সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলল কয়েক গুণে! তন্ময় বই বন্ধ করে উঠে দাঁড়িয়েছে। দৃষ্টি এদিক-ওদিক দুলিয়ে সেই অরু-তে গিয়ে ঠেকাল। অরুর ওড়নাটা দুলছে। কেন? এতো সিনেম্যাটিক হওয়ার কারণ কী? আবার.. আবার চুলগুলোও তো হেলেদুলে চলেছে। অবাধ্য চুল।
তন্ময়ের ইচ্ছে করল, অবাধ্য চুলগুলো হাত বাড়িয়ে কানের পেছনে গুঁজে দিতে। সে হিপনোটিজ হয়েছে যেন, এমন ভঙ্গিতে এক-পা, দু-পা এগিয়ে গেল। অরুর পেছনে দাঁড়ালো। কিন্তু হাত বাড়ানোর সাহস করল না। লম্বাটে সে দৃষ্টি নিচু করে অরুর মুগ্ধ দৃষ্টি দেখতে পারছে। আচমকা পেছনে ফিরে অরু। আঙুল তুলে বাইরেটা দেখিয়ে বলে,
‘তন্ময় ভাই। দেখুন দেখুন। ওইযে! একটা আপু আর একটা ভাইয়া। হাত ধরে হাঁটতে-হাঁটতে গোসল করছে।’
তন্ময়ের ভুরু জোড়া কুঁচকে এলো। সরু চোখে অরুকে দেখে নেয়। ঠোঁটে কিছুক্ষণ ঠোঁট চেপে বলে,

‘বৃষ্টিবিলাস।’
‘অ্যাহ?’
‘তারা বৃষ্টিবিলাস করছে। বৃষ্টি উপভোগ করছে।’
‘বৃষ্টিতে ভিজলে বৃষ্টিবিলাস বলে?’
তন্ময়ের দৃষ্টি বাহিরে। কপোত-কপোতী হাঁটছে ধীরেসুস্থে। দূর থেকে ভীষণ সিনেম্যাটিক লাগছে। কোনো মুভির ক্লিপ যেন! সে সেদিকে তাকিয়েই বলে,
‘উপভোগ করার নেশায় ভিজলে তা বৃষ্টিবিলাস।’
অরু পুনরায় মাথা ঘোরাতে চাইলে, তন্ময় দেয় না। মাথা ধরে আঁটকে রাখে। মেয়েটা পেছনে ফিরতে নিলেই মুখটা তার বুকে এসে ঠেকে। এতো নড়চড় কেন করে! শান্তমূর্তি বনে একটু দাঁড়াবে তা না! অরু সেভাবেই ছটফট মুখে বলতে থাকে,

‘বৃষ্টিবিলাস? তাহলে তো আমারও বৃষ্টিবিলাস করতে ভালো লাগে। আমিতো বৃষ্টি হলেই ভিজি। ওদের দারুণ লাগছে। চলুন তন্ময় ভাই আমরা বৃষ্টি…’
তন্ময় বাকিটা আর শোনার সাহস করে না। ওর মাথা ছেড়ে দেয়। গম্ভীর স্বরে বলে, ‘খেতে আয়।’
এবং তৎক্ষণাৎ হুড়মুড়িয়ে বেড়িয়ে যায়। দ্বিতীয় বার ফিরে একটুখানি দেখার সাহস করে না। এই একটুখানি মেয়েটা! কিছুই বুঝে না। অথচ কথাবার্তা এমন বলে যে, তন্ময়ের মস্তিষ্ক জ্বলে ওঠে। রক্ত ঠান্ডা হয়।
হাতমুখ ধুয়ে তন্ময় ডাইনিংয়ে আসে। চেয়ার টেনে বসে। জবেদা বেগম খাবার সার্ভ করছিলেন। প্লেট এগিয়ে দিতে নিয়ে বলেন,

‘রানার দরকার কিছু। ডাইনিংটা রানার ছাড়া ভালো দেখায়?’
‘আমি নিয়ে আসব নাকি সাথে যেতে চাচ্ছ?’
‘অনেক কিছু দরকার। দরজা – জানালার পর্দা, কিছু সুন্দর বিছানার চাদর। বারান্দা দুটো খালি। সেখানটা সাজাতে বেশকিছু সরঞ্জাম ও লাগে।
তুই তো কাল ইন্টারভিউ দিতে যাবি। জব হয়ে গেলেই ব্যস্ত! আমাকে কীভাবে নিবি? সময় আছে?’
‘কীভাবে শিয়র হচ্ছ জব হয়ে যাবে? নাও হতে পারে।’
জবেদা বেগম পাশেই ছিলেন। খিচুড়ি বেড়ে দিচ্ছিলেন। তন্ময়ের প্রশ্ন শুনে, চটপট ছেলের মাথার ওপর অর্থাৎ চুলের মধ্যখানে একটা চুমু দিয়ে বসেন। হেসে – হেসে বলেন,
‘আমার ছেলে সবদিক দিয়েই পারফেক্ট। জব না হয়ে উপায় আছে?’
‘মা। এসব জব পারফেক্টন্যাস দিয়ে হয়না৷ তুমি নিশ্চয়ই জানো!’

‘বললেই হলো? যেকোনো কিছু হাসিল করতে পারফেকশনিস্ট হতে হয়। আর তুই তাই!’
গরম গরম খিচুড়ি থেকে ধোঁয়া উড়ছে। ঘ্রাণে ম-ম করছে চারিপাশ। তন্ময় লম্বা ঘ্রাণ নিলো। মায়ের হাতের সব রান্না অমৃত। বিশেষ করে গরুর গোস্তো। আলাদাই রসালো। দমবন্ধ অনুভূতি হয় খেলেই। তাদের বাড়ির সবথেকে খাবার প্রিয় মানুষ অরু। খাওয়া – দাওয়া খুব উপভোগ করে। আর দারুণ প্রশংসা করতে জানে। অরুর কথা মস্তিষ্কে আসতেই মাথা তুলে তাকায়। মেয়েটা এখনো জানালার সামনে দাঁড়িয়ে?

জবেদা বেগম আরেকটি প্লেটে অরুর খাবার বাড়ছিলেন। এরমধ্যে চেঁচিয়ে ডাকেন। কোনো জবাব আসেনা। খাবার বেড়ে নিজেই এগিয়ে যেতে নেন। পূর্বেই অরু এক দৌড়ে আসে। হুড়মুড়িয়ে তন্ময়ের সম্মুখীন চেয়ারে এসে বসে। পিটপিট করে বেশ কয়েকবার ইতোমধ্যে তাকিয়েছে তন্ময়ের পানে। তন্ময় দেখেও দেখল না। খেতে ব্যস্ত মনোযোগ সহ। অরু খেতে-খেতে পা দোলায়। দু-বার ওর পা গিয়ে ঠেকল তন্ময়ের লম্বা পায়ে। দুবারই বিড়বিড় করে, ‘স্যরি’ বলেছে সে। অথচ তৃতীয় বারও একই কাণ্ড ঘটাল। এবং পুনরায় বিড়বিড় করে স্যরি জানাল। তন্ময় এবার চোখ তুলে তাকায়। সঙ্গে সঙ্গে অরুর পা নাচানাচি থামে। সে চুপচাপ খেতে থাকে। টুকটাক কথাবার্তা বললেও পা জোড়া আর নাড়াচাড়া করে না।

সকাল নয়টা পঁয়ত্রিশে তন্ময়ের জব ইন্টারভিউ। খুব বড়ো লিমিটেড কোম্পানি। আর সে ইন্টারভিউ দিচ্ছেও খুব ভালো পদে। বিশেষ প্রস্তুতি দরকার। এবং সে নিচ্ছেও মনোযোগ সহ।
শুধু মাঝেমধ্যে অরু চলে আসে মস্তিষ্কে। আশেপাশে আছে বলে একটু বেশিই আসছে।

বৃষ্টি থেমেছে গভীর রাতে। ঠান্ডা আবহাওয়া। জানালা খোলা। বাতাস আসছে। এলার্ম-ঘড়ি-টা বেজে ওঠে। ছ’টায় দেওয়া ছিল। তন্ময় বা-হাতে ঘড়িটা বন্ধ করে। বিছানার হেডবোর্ডে পিঠ ঠেকিয়ে উঠে বসে। কপাল ধরে মাসাজ করতে থাকে। পরপর সেলফোন বেজে ওঠে। কল করছে মোস্তফা সাহেবের ম্যানেজার। তন্ময় ধরে না। পরপর আবার সেক্রেটারি কল করে। দুজনেই একসাথে কল করছে। তন্ময় জানে কীজন্য করছে। এরজন্যই রিসিভ করেনি। করলেই প্যানপ্যান করবে। অন্য কোম্পানিতে জব করবে সে ব্যাপারটা তার বাবা-চাচারা মেনে নিতে পারছে না। শাহজাহান তন্ময় জব ইন্টারভিউ দিবে ভেবেই হয়তো তার বাবার চারশো চার ডিগ্রি জ্বর গায়ে। উঁচু নাক নিচু হয়ে যাচ্ছে যেন! নিজের বাবাকে সম্পূর্ণভাবে চেনে সে।

উঠে ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বেরোয়। জবেদা বেগম উঠে পড়েছে। তিনি খুব ভোরে ওঠেন। আজও তাই। তন্ময়কে দেখেই অশান্ত হলেন,
‘এতো রাত করে জেগেছিলি। আবার এতো তাড়াতাড়ি উঠে পড়লি। শরীর খারাপ করবে না?’
‘আমি ঠিকাছি মা।’
‘আব্বা! কি খাবি ব্রেকফাস্টে? পরোটা করব?’
তন্ময় পরোটা খায় না। ব্রেড খায়। জেল দিয়ে। ফ্রিজে আছেও। কিন্তু পরোটা খায় অরু। পরোটা দিয়ে আলুভাজি পছন্দ ওর! তন্ময় বলে,
‘আচ্ছা। অরু উঠেছে?’
জবেদা বেগম হাসতে লাগলেন,
‘না। উঠেনি। তবে সকাল সকাল তুলে দিতে বলেছে।’
‘উঠিও না। ঘুমাক।’

জবেদা বেগম রান্নাঘরে গিয়েছেন। তন্ময় ওয়ার্ক-আউট করে। তারপর গোসল নেয়। সাধারণত নিজেদের ছাঁদেই ওয়ার্ক-আউট করত! খোলামেলা হাওয়ায়। আসমানের নিচে। তবে এখনের বিষয়টা আলাদা। আর এখানের বারান্দা ছোটো। তাই ভাবল ছাঁদে যাবে। ছাঁদটাও দেখা হবে। এই বাড়ির ছাঁদ দেখা হয়নি এখন পর্যন্ত৷ গতকাল রাতে তীব্র বর্ষণ হয়েছে। আবহাওয়া সুন্দর। তন্ময় দরজা খুলতেই অরুর গলার স্বর শুনতে পায়। উঠে গিয়েছে মহারানী। আনমনে হেসে সে একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যায়। তবে তাড়াতাড়ি বেরিয়েও লাভ হয়না। অরু তাকে দেখে ফেলে। চেঁচিয়ে বলে,

‘তন্ময় ভাই! দাঁড়ান, দাঁড়ান। আমিও যাব। আমিও যাব।’
তন্ময়ের পিছু পিছু অরু ছুটছে। কোনোরকম মুখ ধুয়ে এসছে। ঘুম-ভাঙা চোখ। চুলগুলো এলোমেলো। কয়েকবার সিঁড়ি ভেঙে উঠতে গিয়ে পড়তে নেয়। রেলিঙ ধরে নিজেকে ধাতস্থ করে। তন্ময় পদচারণ স্লো করে। অরুকে আগে যেতে দেয়। সে পিছু পিছু ওঠে। তবুও ফিরে যেতে বলে না। আগেকার মতো তো আর এই ঘুমন্ত মুখ সচরাচর দেখতে পাবে না। এইযে অরু চুলগুলো দু-হাতে বাঁধার চেষ্টা করছে। দৃশ্যটি কতটা প্রিটি তা কি অরু জানে? কতটা আবেদনময়ী দেখায় বুঝে? কখনো কী জানতে পারবে, তন্ময়ের হৃদয়ে হিমশীতল বাতাস বয়ে যায়!

জবেদা বেগম অরুর চুল বেঁধে দিতে চেয়েছেন। কিন্তু মেয়েটা বাঁধবে না। মহিষীর মতো ঝড়ের বেগে ছুটে গিয়েছে। এখন অগোছালো চুলের বাহার। লম্বা চুলগুলো এলেমেলো। হাতে হেয়ারব্যান্ড আছে। তন্ময় সিঁড়ির মাথায় থমকে দাঁড়ায়। তার দেখাদেখি অরুও থেমে যায়। তন্ময়ের হাতের ইশারা দেখে কিছুটা কাছে এগিয়ে প্রশ্ন করে,
‘কি হয়েছে? ছাঁদে যাবেন না? ব্যায়াম করবেন না?’
‘এদিকে আয়। হেয়ার ব্যান্ড দে।’

অরু হেয়ারব্যান্ডটি খুলে দেয়। চেনাপরিচিত ভঙ্গিতে পিঠ তন্ময়ের দিক তাঁক করে দাঁড়িয়ে পড়ে। যেন সে জানে কি করতে চায় তন্ময়। আচার-আচরণে সবটাই স্পষ্ট। তন্ময় বাম হাতে হেয়ার ব্যান্ড নিয়ে ওর চুলগুলো দু’হাতে পেঁচিয়ে নেয়। উঁচু করে ঝুটি করে দিতেই অগোছালো চুলগুলো কিছুটা বাধ্যগত হয়! অরু তখন লাজুক ভঙ্গিতে ছটফটে আচরণ করছে। গাল দুটো কেমন ফুলে উঠছে। পাপড়ি কাঁপছে। পলক ফেলছে অস্বাভাবিক রকম। তন্ময়ের গাঢ় চোখে অরুর কার্যকলাপ ঘুরছে। একসময় টেনেহিঁচড়ে নজর ফিরিয়ে নেয়। সাবলীল ভঙ্গিতে সামনে পা বাড়ায়। অথচ ভেতরে এক অদ্ভুত ব্যাকুলতা। ছুঁয়ে দেবার প্রকট ইচ্ছেটা গোপনে দমন করা।
সুন্দর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ছাঁদ। হরেকরকমের রঙবেরঙের ফুল গাছের টব সাজানো। জমিনের চারিপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে ফুলের পাপড়ি। বাতাসে সেগুলো এদিকসেদিক নড়ছে। সিলভার রঙের একটি বড়সড় দোলনাও মধ্যে বসানো।

আজকের আবহাওয়া দারুণ। আশপাশ শান্ত। নীলাভ-সাদা আকাশের এক কোণে রক্তিম আভা ফুটে উঠছে, ধীরে ধীরে। সূর্যমামা মাথা উঁকিঝুঁকি মেরে দেখা দিচ্ছে যেন! গুন গুন বাতাস বইছে চারিপাশে। মিষ্টি সুগন্ধ প্রকৃতি ছড়িয়েছে। মোহনীয় এই সৌন্দর্যের অন্ত ঘটাতে দৈত্য অরু হুড়মুড়িয়ে ছাঁদে ওঠে। জুতো জমিনে ঘষে প্রকট শব্দ তুলে। তন্ময়ের পেছনে থাকা সে সামনে চলে আসে। তড়িঘড়ি ভঙ্গিতে ছুটে চলে দোলনায় বসবে বলে। তখনই উপলব্ধি করে আরও দুজন মানুষের অস্তিত্ব। তাদের দেখতে পেতেই শান্ত হয়ে পড়ে। ধীরেসুস্থে তন্ময়ের পাশে এসে দাঁড়ায়। তন্ময় যে পাশে যায়, সেও ও পাশেই গিয়ে দাঁড়ায়। আগ্রহী চোখে ফিরে তাকাচ্ছে বারংবার অজানা দুজনকে দেখার আশায়।

তন্ময় আড়চোখে অরুকে দেখে। ডান হাত তুলে, দু আঙুলের সাহায্যে ওর কপালে টোকা দেয় শক্ত করে। মুহুর্তে দৃষ্টি ফিরিয়ে আনে মেয়েটা। আর্তনাদ করে কপাল ঘষতে শুরু করে। ছলছল নয়নে মাথা উঁচিয়ে দৃষ্টি তাঁক করে। ফোলা ফোলা ঘুমন্ত নয়ন জোড়ায় দৃষ্টি মিলিয়ে তন্ময় সাবলীল গলায় বলে,
‘ওখানে কী দেখিস? অচেনা কারো দিক এভাবে তাকাতে হয় না। অভদ্রতার পরিচয় বহন করে।’
‘কিন্তু.. কিন্তু তারা ত আমাদের দিক তখন থেকে তাকিয়ে। বড়ো বড়ো চোখে দেখছে। ওইতো ওই আপুটা এখনো তাকাচ্ছে।’

‘সেটা তাদের বিষয়। তবে তুই তাকাবি না।’
‘আমিতো লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছি।’
‘সেভাবেও দেখবি না।’
‘তাহলে কি আপনি লুকিয়ে তাকাবেন?’
‘আমি কেন তাকাব?’
‘দেখার জন্য।’
‘দেখার মতো ওখানে কিছু আছে?’
‘নেই?’
তন্ময় দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে, ‘চুপ।’

অরুর মুখ বন্ধ হয়। ভুলবশত ও আর ফিরে তাকানোর সাহস করে না। বরং সামনে তাকায়। দৃষ্টি গিয়ে ঠেকে অদূরের গাছটায়। একজোড়া পাখি বসে। একদম পাশাপাশি, লেপ্টে। শুব্দ তুলছে তারা। অরু মুগ্ধ নয়নে দেখতে থাকে। একসময় আঙুল তুলে তন্ময়কেও দেখায়। তন্ময় নির্নিমেষ চোখে দেখে অনেকটা সময় ধরে। দৃষ্টি ফিরিয়ে মুগ্ধ অরুতে ফেলে। তার ইচ্ছে করল অরুর একটা ছবি তোলার। তুলবে কি? ভাবতে ভাবতেই পকেটে হাত ঢোকায়। চটজলদি সেলফোন বের করে। খুব অগোচরেই একটা ছবি তুলে নেয়। এলোমেলো অরুর একটি স্নিগ্ধ শান্ত ছবি। ছবিটি তুলে সে জুম করে দেখে নেয় একবার।
অরু প্রশ্ন করে আগ্রহী গলায়,

‘ব্যায়াম করবেন না?’
‘আমার ব্যায়াম করা নিয়ে তোর এতো
কানশার্ন কেন?’
‘আপনি না বললেন ব্যায়াম করবেন!’
‘কখন বললাম!’
‘মানে.. আপনি তো করেন।’
‘হু.. তো?’
‘এম্নেই, কিছুনা।’
অরু হাসফাস করে চুপসে যায়। অন্যদিকে ফিরে। ছাঁদে থাকা তরুণ তরুণী ইতিমধ্যে চলে গিয়েছে। তন্ময় আরও কিছুক্ষণ থাকে। অরুকে দোল খাওয়ার সময় দিয়ে, হাত ঘড়িতে সময় দেখতে থাকে। পাক্কা পনেরো মিনিট পর, অরুকে নিয়ে নিচে নেমে আসে। তার কাজ আছে। অরুকে বাসার মোড়ে পৌঁছে সে নিজ গন্তব্যে যাবে।

তন্ময়ের জবটা হয়। মিসিং পোস্ট ছিল বলে পরদিনই জয়েনিং করেছে। এবং কাজের সূত্রে দীর্ঘদিন ব্যস্ত থাকে। বারোজন নতুন কর্মচারীদের জুনিয়র ডিরেক্টর সে৷ তার আন্ডারে কাজ করে। দায়িত্ব সম্পূর্ণ তার ওপর। অর্থাৎ কাজের প্রেসার খুব। কোনো ওফ ডে পায়নি সে।
কাল শুক্রবার। ওফ ডে। তাই আজ পাঁচটায় অফিস থেকে বেরিয়েছে। বেরোতেই কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গিয়েছে। পিঠের শার্ট ভিজতে শুরু করেছে। শরীর জ্বলছে। কিছুক্ষণের মধ্যে গরমে ঝলসে যাবে যেন! সারাবছর এসিতে থাকায় এই বেহাল দশা তার। শুধু যে তার তা নয়। জবেদা বেগমেরও খারাপ অবস্থা! মা তার কিচ্ছুটি মুখে বলে না। তবে তন্ময় বোঝে।

চোখ গেল অদূরে। একটি গাড়ি দাঁড়িয়ে গাছের আড়ালে। তন্ময় চিনে নিয়েছে গাড়িটা। শাহজাহান মোস্তফা সাহেবের গাড়ি চিনতে ভুল হবার কথা নয় তার। অগোচরে হেসে নজর ফেরায়। প্রায় দু-একদিন পরপরই সে বাবার গাড়িটা দেখে। ভেতরের মানুষটাকে না দেখেও বুঝতে পারে, তার হাহাকার। আহ, কতদিন কথা হয় না, দেখা হয় না। একসাথে বসে চা-কফি খাওয়া হয় না। শোনা হয়না, তার নামের ডাক খানা। দীর্ঘনিশ্বাস বেরিয়ে আসে ভেতর থেকে। কিছুটা হেঁটে গিয়ে রিকশা দাঁড় করায়। উঠে পড়ে ব্যস্ত পায়ে। আরেকবার আড়চোখে দেখে নেয় আড়ালে থাকা গাড়িটা। সেসময় ফোন বাজে। পকেট থেকে বের করে চোখ বুলায় স্ক্রিনে। মাহিনের কল। সে রিসিভ করে শান্ত গলায় বলে, ‘আসছি।’

রিকশাটা যেতেই গাড়িটা আড়াল হতে বেরোয়। রাস্তায় নামে। ড্রাইভিংয়ে বসা ড্রাইভার রফিক মিঁয়া প্রশ্ন করেন,
‘স্যার! তন্ময় বাবাকে ফলো করব?’
মোস্তফা সাহেব গম্ভীরমুখে বন্ধ জানালার পানে চেয়ে। নিশ্চুপ হয়ে আছেন। রফিক মিঁয়া লুকিয়ে লুকিং গ্লাস দিয়ে স্পষ্ট মোস্তফা সাহেবের লাল চোখ জোড়া দেখতে পারছেন। ঘামে ভেজা কপাল খানাও দৃষ্টির মধ্যে। ঠোঁট ভিজিয়ে তিনি ছোটো স্বরে ডাকেন,
‘স্যার, এসিটা ওন করে দেই? ঘেমে যাচ্ছেন।’
‘না।’
‘জি। আচ্ছা।’

গাড়ির মধ্যে নিস্তব্ধতা বয়ে চলেছে। মোস্তফা সাহেব কথা বললেন না দীর্ঘসময়। রফিক মিঁয়া ও আগ বাড়িয়ে কথা বলার সাহস পেলেন না। চুপচাপ বসে। গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ। আড়চোখে লুকিং গ্লাসে তাকাচ্ছেন বারবার। একপর্যায়ে শুনতে পেলেন মোস্তফা সাহেবের গলা। অভিমান উপচে পড়ছে,
‘খুব শুকনো লাগছে না দেখতে? শুকিয়ে গেছে।
গায়ের রঙ চেপেছে। গরম একটুও সহ্য করতে পারে না। সচরাচর গাড়ি ছাড়া চলাচল করে না। অথচ এখন কীভাবে চলছে! গাড়ি পাঠালাম এক্সেপ্ট করল ন। ফেরত পাঠাল। কার্ড গুলো নিলো না। কার সাথে এতো জেদ ওদের? জেদ কী ওদের একার আছে? আমার নেই?’

রফিক মিঁয়ার মায়া হলো। বাবা-ছেলের দারুণ বন্ডিং চোখের সামনে নদীর জলে ভেসে যাচ্ছে। দুজন দুদিক দিয়েই কষ্ট পাচ্ছে একটি সাধারণ বিষয় নিয়ে। তিনি সাবধানত গলায় বড্ড ভেবেচিন্তে বলেন,
‘স্যার। তন্ময় বাবার ইচ্ছেটা পূর্ণ করে দিলেই তো সব ঠিকঠাক হয়।’
‘তুমি জানো ওর ইচ্ছেটা কী?’
‘না স্যার।’
‘তাহলে মুখ বন্ধ করে গাড়ি চালাও। বাসায় যাব।’
চুপসে যায় রফিক মিঁয়া। জিজ্ঞেস করার আর সাহস হয়না মনের গহীন থাকা প্রশ্নটি।
‘ কি এমন ইচ্ছে যে পূর্ণ করা যাচ্ছে না?’

রক্তিম আভা আকাশ জুড়ে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসছে। উত্তরার আগে পঞ্চবতীর পাশে গিয়েছে নদীর স্রোত। নদী ঘিরে রয়েছে অহরহ জাহাজ, নৌকা। পাশেই কফি-চায়ের স্টল। ফুচকা চটপটির খোলামেলা দোকান। হিমশীতল বাতাস বইছে সেখানে। ঢাকাশহরের বিদঘুটে গাড়িঘোড়ার গন্ধ, জ্যাম ঠেলে এখানে এসে প্রাণ ভরে শ্বাসপ্রশ্বাস নেওয়া স্বপ্নের মতো। এইতো মাহিনের বাইক এসে থামল কফি-চায়ের স্টলের সামনে। লাল সাদা হরেকরকমের চেয়ার পাতা রয়েছে। কিছু কাপল বসে আছে অদূরে। মাহিনের পেছনেই তন্ময় ছিল। সে হেলমেট খুলে নেমে আসে। এখনো তার গায়ে লেপ্টে সকালের ফর্মাল স্যুট। অফিস থেকে সোজা এসেছে!

পরপর আরও দু-তিনটা বাইক তন্ময়ের সামনে এসে থামে। বাইক গুলো পারছেনা তাকে ধাক্কা মেরে উড়িয়ে ফেলতে। বিশেষ করে রিহানের বাইকটা রীতিমতো তন্ময়ের পায়ে এসে ছুঁয়েছে। তন্ময় সরে দাঁড়ায়। প্যান্ট ঝাড়া দেয়। শান্তশিষ্ট জায়গা খানা মুহুর্তেই তাদের হৈচৈ-য়ের শব্দে অশান্ত হয়ে ওঠে। মাহিন চেঁচিয়ে সাত কাপ কফির অর্ডার দিয়ে আসে। গোলাকার ভঙ্গিতে সবাই বসেছে। নদী ঘেঁষে তন্ময়ের চেয়ার। বাতাসের তোড়ে কপালের ঘাম মুছে গিয়েছে। ঠান্ডা বাতাসে শরীর শীতল। চোখ বন্ধ করে লম্বা শ্বাস নেয়। তার পাশে শুহানি বসেছে। ফ্রেন্ডদের মধ্যে শুহানি চুপচাপ। মেয়ে মানুষ তাই হয়তো। বাকিগুলো কথাবার্তার নামে হৈচৈ করছে সমানে। খুব ছোটো গলায় শুহানি প্রশ্ন করে,

‘কেমন কাজের চাপ?’
‘মোটামুটি।’
‘আঙ্কেল এখনো কিছু বলেনি?’
তন্ময় হাসে, ‘কি বলবে?’
‘এইযে অরু শুধু তোর। এবং তোর হাতেই ওকে তুলে দিবে।’
তন্ময় হাসে। মুখে কিছু বলে না। পকেটে ফোনটা টুন টুন শব্দ তুলছে। তন্ময় সেলফোন বের করে চোখের সামনে ধরে। অরুর ম্যাসেজ, একটি পায়ের ছবি পাঠিয়েছে। নুপুর পরেছে। সাদা পায়ে রুপার নুপুর। রিনঝিন শব্দ তুলে নিশ্চয়ই? এই নুপুর পরে তন্ময়ের চারিপাশে না হাঁটলে, পরার কোনো স্বার্থকতা আছে? নেই, একদমই নেই।
গুনে গুনে পনেরো দিন ধরে, অরুকে দেখা হয়না। চোখের তৃষ্ণা মেটাতে, বক্ষের অশান্তি দূর করতে অরুকে দেখা দরকার। একবার কী রাস্তার মোড়ে পৌঁছে অরুকে বেরোতে বলবে? গম্ভীরমুখে খুব শক্ত চোখে দেখে নিবে প্রাণ ভরে। তারপর একটা ধমক দিয়ে বলবে, ‘বাসায় যা এক্ষুনি।’ ব্যস! অরু নিশ্চয়ই কিছু বুঝতে পারবে না। ওই মেয়েটা তো গাধা। গাধার মতো শুধু লুটুরপুটুর চোখে তাকায়। তবে তন্ময়ের মন বুঝে না। দৃষ্টি চিনে না। অরু একটা অবুঝ বালিকা।

ঘড়ির কাটা ঘুরছে রাত এগারোটা দশে। গরম গরম দু-কাপ চা শেষ করেও তন্ময় সিদ্ধান্ত নিতে পারল না। অরুকে কী বেরোতে বলবে একটু? নাকি বলবে না? দোটানায় সে অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে। ব্যস্ত পায়ে পায়চারিও করছে। চুলগুলো দু-হাতে কপালের ওপরে উঠিয়ে নেয়। দেখতে পায় একজন আগন্তুক আসছে তার দিকে। কাছাকাছি আসতেই চিনতে পারে। অয়ন! ছেলেটা তাদের পাশের বাড়ির। খুব ভালো সম্পর্ক তাদের দু-পরিবারের মধ্যে। অয়নের সাথে মাঝেমধ্যেই কথাবার্তা হয় চা খেতে খেতে। তন্ময়কে দেখেই সালাম দেয় অয়ন। বাড়ন্ত বয়সী ছেলেটা গভীর শ্রদ্ধাশীল গলায় ডাকে,

‘তন্ময় ভাই। এখানে দাঁড়িয়ে যে?’
‘এইতো এভাবেই।’
‘চা নেই দুটো?’
‘আচ্ছ।’
দুজন দু কাপ চা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খায় আর আশেপাশে নজর দেয়। টুকটাক কথাবার্তা বলে এটাসেটা নিয়ে। এর মধ্যে তন্ময় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। অরুকে ম্যাসেজ করে বলে এক্ষুনি বেরোতে। কাজ আছে।
চা শেষ হতেই তন্ময় অয়নকে বলে,
‘রাত হয়েছে। গো। ইউ শুড স্লিপ আর্লি।’
‘জি ভাই। গেলাম তাহলে।’
‘উম।’

শাহজাহান তন্ময় পর্ব ১১+১২

অয়ন চলে গিয়েছে। তন্ময় তাকিয়ে সেদিকটাতেই। অরু কি ম্যাসেজটা দেখেছে? যদি না দেখতে পায়? হয়তো ঘুমিয়েও পড়েছে! সে কি কল করবে একটা? ফোন হাতে ব্যাকুল নয়নে পথের পানে চেয়ে। এসময় অদূরে আঁধারের মধ্যে ছোটো একটি শরীরের দেখা মিলল। এদিকেই আসছে দৌড়ে। বাতাসে উড়ছে লম্বা চুল, আর সাদা ওড়না। অরুর চোখমুখে আলো পড়তেই, তন্ময়ের ভেতরটা কেঁপে উঠল। গলাটা শুকিয়ে গেল। পনেরো দিনের মধ্যে কী মেয়েটা পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে?

শাহজাহান তন্ময় পর্ব ১৫+১৬

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here