শাহজাহান তন্ময় পর্ব ১৫+১৬

শাহজাহান তন্ময় পর্ব ১৫+১৬
Nabila Ishq

অরুর চোখমুখে লালাচে আভা। শ্বাসপ্রশ্বাস এবং বুকের ওঠানামার গতি অস্বাভাবিক। কাছাকাছি এসেই ঠোঁটের হাসির রেখা দীর্ঘ হয় ওর। চাঁদের মতো জ্বলজ্বল করছে চোখজোড়া। এই চোখে চেয়ে তন্ময়ের বুকের চাপা যন্ত্রণাটুকু, নিদারুণ সুখময় অনুভূতিতে রুপান্তরিত হলো। অশান্ত, অস্থির তোলপাড় চলিত বক্ষে ঝিরিঝিরি শান্তির বর্ষন নামল যেন। পৃথিবীর শুদ্ধতম প্রাণস্পন্দন হাসির রেখা ধরে রাখা ঠোঁট জোড়ার দিকে তাকিয়ে বলল,

‘বোকার মতো এতো হাসার কি হলো!’
ওড়নার কোণ মোড়াতে থাকা অরু লাজুক হাসে। আঁকাবাঁকা ভঙ্গিতে তাকিয়ে , ফকফকে পরিস্কার দাঁত দেখিয়ে বলে,
‘আমি অনেক খুশী।’
তন্ময় দৃষ্টি ফিরিয়ে আনে। অস্পষ্ট স্বরে শুধায়,
‘কেন?’
অরু হেলেদুলে পা-জড়া নাড়াচড়া করে। নুপুর জোড়া প্রতিধ্বনি তুলে ঝনঝন শব্দে। হেসে হেসে বোকার মতো বলে,
‘এম্নেই।’
পাশ দিয়ে রিক্সা যাচ্ছে। হুটহাট গাড়ি দেখা দিচ্ছে। তন্ময় অরুর মাথায় ডান হাত চেপে সাইডে নিয়ে আসে। সে নিজে দেয়ালের মতো ওর সামনে দাঁড়ায়। প্যান্টের পেছন পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করতে করতে প্রশ্ন করে,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘পড়াশোনা ঠিকভাবে হচ্ছে?’
‘না।’
‘কেন না?’
অরু চুপ মেরে আছে। তন্ময় দোকানের টাকা মিটিয়ে ফিরে তাকায়। ধমকের সুরে বলে,
‘না কেন?’
অরুকে মিনমিন গলায় বলতে শোনা যায়,
‘আমায় পড়াবেন না!’
তন্ময়ের মুখমণ্ডলের পরিবর্তন হলো না। গলার স্বর ও রুক্ষ রয়ে গেল। অথচ ভেতরে প্রশান্তি। সে তো এটাই চাচ্ছিল। অরু আসুক প্রতিদিন। চোখের সামনে থাকুক। সারাদিন পর একটিবার দেখতে পারলে ক্লান্তির নিস্তার ঘটবে, ভালো ঘুম হবে। খুব সাবলীল গলায় হুকুম করে,

‘চলে আসবি কাল সন্ধ্যা ছ’টায়। আমি চাচ্চুকে বলে রাখব।’
অরু লাফিয়ে উঠলো। খুশিতে চকচক করছে সম্পূর্ণ ও নিজে। তড়িঘড়ি গলায় বলল,
‘আচ্ছা। আমি তার আগেই চলে আসব। খুব মন দিয়ে পড়াশোনা করব। একদম ফাঁকিবাজি করব না। একটুও জ্বালাব না।’
তন্ময় অদেখা হাসে। আনমনে আওড়ায়, ‘যতখুশি জ্বালা, যতখুশি ফাঁকিবাজি কর। আমি আছি তো সহ্য করার জন্য, তোকে আগলে রাখার জন্য।’

অরু ছটফট করছে। আড়ে আড়ে তাকাচ্ছে। সবসময় এভাবে তাকায়। এইযে, এভাবে যে তাকায় ও কী বোঝে তন্ময় সব দেখে, আগাগোড়া জানে? এমন হাবভাবে কতটা অশান্ত করে তাকে বোঝে? অশান্ত, অবিন্যস্ত ও যে সর্বনাশের পুনরাবৃত্তি। এতক্ষণ শুধু একপলক দেখতে চেয়েছিল! অথচ এখন.. এখন তো ইচ্ছেগুলো ক্রমশ বেড়ে চলেছে।
রাত হচ্ছে। অরুর ফিরে যাওয়া দরকার। কিন্তু তন্ময় বলতেই পারছে না, চলে যেতে। এই রাস্তার আলোয়, চাঁদের রূপে সবকিছু যেন এক মোহ। এই মোহ থেকে দূরে যেতেই ইচ্ছে হয় না। কিন্তু সবসময় ইচ্ছেরা পূর্নতা পায় না। তন্ময় হাত ঘড়িটা দেখে বলে,
‘খাওয়া দাওয়া করছিস না কেন? কি সমস্যা? আমি যেন আর না শুনি এসব। ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করবি। এখন যা বাসায়।’
অরু ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল। তন্ময় তাড়া দিল না। তাকিয়ে থাকল। একসময় নিজেই পা ঘুরিয়ে হাঁটা ধরল মেয়েটা। যাওয়ার পথে কয়েকবার ফিরে তাকাল। দরজার ভেতরে ঢুকতেই দৃষ্টি ফিরিয়ে আনে তন্ময়। মাথার ওপরে তখন চাঁদটা জ্বলজ্বল করছে।

তন্ময়ের ডিপার্ট্মেন্টের মেয়েগুলো উগ্র স্বভাবের। সারাদিন গসিপ করে বেড়ায়। আচার-আচরণেও সভ্যতা নেই। তন্ময়কে সবখানে ফলো করে। ইরাবতী নামের মেয়েটা তো সেদিন ইনিয়েবিনিয়ে প্রপোজ ও করে বসল। ফেইসবুকে রিকোয়েস্ট দেওয়া, নাম্বারে কল দিয়ে বিরক্ত করা তো আছেই! প্রত্যেকদিন লাঞ্চ টাইমে টিফিনবাক্স নিয়ে সামনে আসবে। আজও তাই! তন্ময় ফাইলস গোছগাছ করছিল। ওসময় ইরাবতী আসে। হাতে নিত্যদিনের মতো টিফিনবাক্স। পাত্তা না পেয়ে একটু কেশে নিজের আসার বার্তা বোঝায়। মিষ্টি গলায় শুধায়,

‘ডিরেক্টর! লাঞ্চ টাইম এখন। ক্যান্টিন যাবেন না?’
‘না। একটু বেরোব।’
‘কারো সাথে দেখা করতে?’
‘জি।’
‘কে জানতে পারি?’
তন্ময়ের ফাইলস গোছানো শেষ। সেলফোন বেজে ওঠে সেসময়। কল রিসিভ করে যেতে যেতে বলে যায়,
‘বোন।’

অফিস বিল্ডিংয়ের পাশেই একটা কফি-শপ। সেখানেই এসেছে শাবিহা। থমথমে মুখে বসে। তন্ময় দরজা ঠেলে প্রবেশ করেই, বোনের শক্তপোক্ত মুখখানা দেখে নিল। তার আর মায়ের ওপর শাবিহা ভীষণ রেগে। রেগেমেগে কথাবার্তা বন্ধ রেখেছিল। কল দিলেও ধরছিল না। অবশ্য ওর রাগার উপযুক্ত কারণ আছে। তন্ময় গিয়ে পাশের চেয়ারে বসে। শাবিহার নাক ফুসছে। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে। এই কেঁদে ফেলবে ফেলবে ভাব। তন্ময় হতাশ মুখে হাত বাড়ায়। তৎক্ষণাৎ ঝাপিয়ে পড়ে ভাইয়ের বুকে। মাথা রেখে, শাবিহার সে কী কান্না! কান্নার তোড়ে মেয়েটা শ্বাস নিতে পারছে না। মুখমণ্ডল চোখের জলে ভিজে একাকার। এতো কাঁদার কি হলো? কখন থেকে একনাগাড়ে কেঁদে যাচ্ছে। তন্ময় মাথায় হাত রাখে। চুলের ওপর হাত বুলিয়ে দিয়ে নরম গলায় বলে,

‘হয়েছে তো। আর কাঁদে না। দেখি…মুখ তো লাল করে ফেলছিস। পানি খা… ধর!’
তন্ময় পানির বোতলের ঢাকনা খুলে শাবিহার হাতে ধরিয়ে দেয়। দু চুমুক পানি খেয়ে বোতল টেবিলে রাখে শাবিহা। বড়ো বড়ো নিশ্বাস নিচ্ছে আর ফেলছে। তন্ময় দুটো কফির অর্ডার করে। তার জন্য সাধারণ কফি আর শাবিহার জন্য কোল্ড ওয়ান। শাবিহা নিজেকে শান্ত করে। টিস্যু দিয়ে চোখমুখ মুছে নেয়। নাক টেনে ভাইয়ের দিক তাকায়। অভিমানী গলায় বলে,
‘আমিতো তোমার কেউ না। মায়ের ও কেউ না। আমি কারো কেউ না।’
তন্ময় হাসে। শাবিহার লাল নাকে টোকা মেরে বলে,
‘রাগলে তোকে মায়ের মতো দেখায়।’
‘আর হাসলে তোমায় বাবার মতো দেখায়।’

বলেই ফিক করে হাসে শাবিহা। হাসতে হাসতে দুলে পড়ে ভাইয়ের ওপর। নিজের ফোন বের করে। একটি ছবি দেখিয়ে বলে, ‘দেখ দেখ। এই ছবিটায় তোমার আর বাবার মুখমণ্ডল একদম এক লাগছে।’
ছবিটি তাদের বাগানের। তন্ময় আর মোস্তফা সাহেব পাশাপাশি চেয়ারে বসে। পেছনে হরেকরকম ফুলের সমাহার। নীলসাগরের আসমান মাথার ওপর। চারিপাশে সবুজ গাছপালা। হাতে দুজনের চায়ের কাপ। দুজনের দৃষ্টিই অদূরে। ছবিটি সাইডে থেকে তোলা। তুলেছে শাবিহা। আদুরে চোখে তন্ময় ছবিটি দেখল। অন্যমনস্ক গলায় প্রশ্ন করে,
‘বাবা কেমন আছে?’

‘ভালো না। মনমরা হয়ে থাকে। খুব কষ্ট পাচ্ছেন। আমি জানি তুমি আর মাও পাচ্ছ। আর আমাকে তোমরা সবাই মিলে কষ্ট দিচ্ছ। আমার এসব ভালো লাগছে না ভাই। সব ঠিক করে দাও না।’
এরমধ্যে কফি চলে এসেছে। কফি খেতে-খেতে দু ভাইবোনের মধ্যে অনেককিছু নিয়েই কথাবার্তা হলো৷ আলাপ-আলোচনার শেষ নেই। শাবিহা সবকিছু নিয়ে একের পর এক টপিক তুলছে। কথার ফুলঝুরি নিয়ে বসেছে।

সামনেই পবিত্র ঈদুল ফিতর। রমজান মাসের শুরু হবে কাল বাদে পরশু থেকেই। জবেদা বেগমের মন খারাপ। ভীষণ ভাবে খারাপ। বাড়ি ছেড়ে এই প্রথম ঈদ তার আর তন্ময়ের। কেঁদেকেটে চোখমুখ ফুলিয়ে ফেলেছেন। রাতভর তন্ময় মায়ের পাশেই থাকল। বারবার করে বলল,
‘আমি দিয়ে আসি। বাসায় ফিরে যাও৷ তুমি ছাড়া ঈদের মজা আছে?’
জবেদা বেগমের কান্নাকাটি সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে গেল। তিনি কড়াকড়ি গলায় বললেন,
‘আমি গেলে তোর কী হবে? আমার ছেলেকে আমি একা ফেলে যাব? অসম্ভব!’
‘অসুস্থ হয়ে পড়বে মা।’

‘হব না। আচ্ছা শোন না, বাবা! ভাবছিলাম ইফতারি তো আমি নিজের হাতে প্রত্যেকবার করি। ওরাও আমার হাতের খাবারেই অভ্যস্ত। তাই ভাবছিলাম রমজানের ইফতারি এখান থেকে বানিয়ে পাঠালে কেমন হয়?’
‘ভালো হয়। লিস্ট করে দাও, বাজার করে নিয়ে আসি।’
‘হ্যাঁ, ভালো বলেছিস। এখনই করে রাখব। আর শোন.. আমি চাচ্ছিলাম শাবিহা, অরু, দীপ্ত আকাশ ওরা সবাই একদিন না-হয় এখানেই ইফতারি করুক। এখন প্রথম রোজায় আনা তো ঠিক হবে না ওদের। প্রথম রোজার ইফতারি এখানে করলে, ওই বাড়িটা খালিখালি লাগবে। বরংচ দ্বিতীয় রোজায় ওরা এখানে ইফতারি করবে, তোর চাচ্চুকে বলে রাখিস। প্রথম রোজায় বরং তোর বন্ধুদের দাওয়াত কর। ছেলেমেয়ে গুলো এতো আদুরের। ওরা বাসায় আসলেই বাড়িঘর জ্বলজ্বল করে।’
তন্ময় মাথা দোলায়। বন্ধুবান্ধবদের আগের থেকেই জানিয়ে রাখে। তারাও রাজি। জবান দিয়েছে সন্ধ্যার আগেই হাজির হবে।

পরদিন বিকেলের ঘটনা। তন্ময় অফিস ছেড়ে দ্রুত ফেরে বাজার করবে বলে! বাড়ির কাছাকাছি আসতেই দেখে ছোটোখাটো একটা ট্রাক দাঁড়িয়ে। ট্রাকে ভর্তি সরঞ্জাম। রান্নাবান্নার কী নেই সেখানে? চাল-ডাল-তেল-আটা থেকে ধরে সবকিছু। সেগুলো ওঠানো হচ্ছে পাঁচতলায়। জবেদা বেগমকে দেখা গেল বেকুব বনে দাঁড়িয়ে থাকতে। তন্ময়কে দেখেই তিনি ছুটে আসলেন। তন্ময়কে আর জিজ্ঞেস করতে হলো না, কী হচ্ছে। সে নিজেই বুঝে নিয়েছে। তার বাপ-চাচাদের ছাড়া আর কার কাজ এগুলো? এরমধ্যেই কল এলো আনোয়ার সাহেবের। তিনি প্রাণ খুলে হাসছেন,
‘হ্যাঁ, শোনো আব্বু! সবকিছু পাঠিয়ে দিয়েছি। সাহায্যের জন্য রূপালী আপাকেও পাঠাব। ভাবীর রান্নাবান্না ছাড়া কী রমজান মাস উপভোগ করতে পারব? আর ভাই বা কীভাবে রোজা রাখবে ভাবীর হাতের খাবার ছাড়া?’
এই সূত্রপাত ধরে রাতেই রূপালী আন্টি হাজির। কোমরে ওড়না বেঁধে তিনি সঙ্গে সঙ্গে কাজে নেমে পড়েছেন। একদিক দিয়ে ভালোই হলো। একাএকা
জবেদা বেগমের পক্ষে এতো কাজ করা অসম্ভব ছিল।

প্রথম রোজার দিন অফিস ছুটি। রাতে সেহরি খেয়ে নামান পড়ে শুয়েছিল তন্ময়। তাই বেলা করে এখনো শুয়ে। আধোঘুমে সে সজাগ আবার ঘুমের ঘোরে। এরমধ্যে আবছা মেয়েলী চিকন গলার স্বর শুনতে পেলো। অরু এসেছে। নুপুরের শব্দও তো কানে এসে ঠেকছে। কখন এলো? মাত্রই বুঝি। ভাবনার মধ্যেই দরজা ঠেলে কারো প্রবেশের শব্দ! শব্দহীন ভঙ্গিতে হাঁটছে। তন্ময়ের ঘুম পুরোপুরি কেঁটে গেল। তবে উঠল না। ঠাঁই সেভাবেই শুয়ে রইল যেন গভীর ঘুমে। চোখের পাপড়ি অবধি নড়ছে না। অনুভব করল অরু বিছানার কোণে এসে বসেছে। খুব ধীরেসুস্থে যেমন ভীষণ ভয়ে আছে। মাথাটা ঘুমন্ত তন্ময়ের দিকেই ঝুঁকানো। বিড়বিড়িয়ে কীসব বলছে! এরমধ্যে তন্ময় একটি বাক্য শুনে নিল, ‘ঘুমন্ত তন্ময় ভাই বেশি সুন্দর নাকি সজাগ তন্ময় ভাই?’

এই বাক্যের মাথামুণ্ডু তন্ময় বুঝল না। তার বোঝার আগেই অরুর হাত এলো তার গালে। নরম হাতের স্পর্শ তার দাঁড়ির ওপর পড়ল। এবং পরপরই চলে গেল। ছুঁয়েই মেয়েটা হন্তদন্ত ভঙ্গিতে ছুটে পালিয়েছে। পালানোর পূর্বে দুয়ারে হোঁচট ও খেয়েছে।
অনেকক্ষণ পর তন্ময় চোখ মেলে তাকায়। গাল ছুঁয়ে গাঢ় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দরজার দিক। বুকটা ধড়ফড় করছে। অরু তাকে যেভাবে জ্বালায়, সেভাবে অরুকে জ্বালালে কেমন হয়?

খুব সভ্য ভদ্র একদল লম্বাচওড়া পুরুষদের উপস্থিতি ঘটল ইফতারির আগ-মুহুর্তে। তাদের মধ্যে থাকা একমাত্র শুহানি নামের নারীকে দেখাল জেরির মতো। ছোটোখাটো পুচকে। অথচ শুহানি লম্বায় পাঁচফুট ছয়! হাত তাদের একেকজনের ফাঁকা, কিচ্ছুটি নেই। খালি হাতে একেকজন নিঃশব্দে প্রবেশ করছে। এর অবশ্য কারণ রয়েছে বড়সড়। সেবার একগাদা জিনিসপত্র নিয়ে এসেছিল! এবারও যদি তা করে, শান্তশিষ্ট তন্ময় যুদ্ধের ঘোষণা দেবে। সেই যুদ্ধে জ্বলেপুড়ে ছারখার হওয়া ছাড়া করার কিছু থাকবে না। তন্ময় তাদের শান্তশিষ্ট বন্ধু হলেও, ভীষণ ভয়ানক যখন সে সত্যিকার অর্থে রাগে। এতবছরের বন্ধুত্বের ফজিলত হচ্ছে, ছেলেটাকে আগাগোড়া জেনে নেয়া।

দুয়ারের সামনে থেকে সবাই ভদ্রতা বজায় রেখে, স্পষ্ট শব্দে সালাম ছুড়ল রান্নাঘরের কাজে ব্যস্ত থাকা জবেদা বেগমের পানে। এরপররপরই আসল চেহারা বেরোলো ভদ্রসভ্য পুরুষ গুলোর।বুড়ো বয়সে এরা জুতোজোড়া আগেফাগে খুলে, চটজলদি বাড়িতে ঢোকার একরকম যুদ্ধ করছে। ঠিক অনেকটা ভার্সিটির অডিটোরিয়ামে সর্বপ্রথম উপস্তিত হবার প্রতিযোগিতার মতো। শুহানি মেয়ে মানুষ বিধায় রক্ষা পেল। আরামসে জুতোজোড়া খুলে প্রথমেই বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে। অলস মুখে ফিরে চেয়ে দেখে এই দামড়া ছেলেদের, অদারুণ দৃশ্যটি।
রুপালী সহ শাহজাহান বাড়ির গার্ডেন কেয়ারটেকার করা ফজিলাতুন্নেছা এবং ড্রাইভার রফিক মিঁয়া উপস্থিত আছেন ফ্ল্যাটের লিভিংরুমে।

তারা তিনজন ভীষণ ব্যস্ত খাবার ভর্তি বড়ো বড়ো বোউল ট্রান্সফার করতে। জবেদা বেগমের হাতের তৈরি ইফতারি সহ হরেকরকমের রান্নাবান্না একেএকে বিল্ডিংয়ের পার্কিং এরিয়ায় রাখা গাড়িতে তোলা হচ্ছে। ঘ্রাণে লিভিং রুমের চারদিকে ম-ম করছে। টিকতে না পেরে মাহিন সহ বাকিগুলো হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়েছে তন্ময়ের রুমে। সেখানেও রক্ষা নেই এই ঘ্রাণ থেকে। পেটের ভেতর থেকে ডাক শোনা গেল। মাহিন হাউমাউ করে উঠল। ক্ষুধা লাগছে এই বিষয়টা মস্তিষ্কে আসতে না দেবার যুদ্ধ নিজের সঙ্গে চালাচ্ছে।

হাত ঘড়িতে নজর দেয়া শেষ শতবার। রিয়ান বিছানায় শুয়ে আছে মুখে বালিশ গুঁজে। সৈয়দ ভালো ছেলের মতো বসে। মুখজুড়ে অসহায়ত্ব লেপ্টে। ইব্রাহিম ফোন টিপছে মনোযোগ সরাতে। তন্ময় সেসময় বেরোলো বাথরুম থেকে। অফিস থেকে সে এসেছে আধঘন্টা আগে। এসেই টুকটাক কেনাকাটা করতে নিচে নেমেছিল। সেগুলো মায়ের হাতে ধরিয়ে গোসল নিয়ে বেরোলো সবেমাত্র। বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে, দৃষ্টি ফেলল দেয়াল ঘড়িতে। পাঁচটা ত্রিশ মাত্র। আজ ইফতারির সময় ছ’টা বারোতে। আধঘন্টার মতো সময় আছে। মাথা মুছে তন্ময় রুম থেকে বেরোয়। খাবারদাবার নেয়া কমপ্লিট। ইতোমধ্যে জবেদা বেগম ডাইনিং সাজাচ্ছেন। তন্ময়কে দেখতে পেতেই তিনি শুধালেন,
‘শোন না বাবা! তিন রকমের শরবত করেছি। লেমন, ম্যাঙ্গো আর অরেঞ্জ। আর কিছু করা লাগবে? ওদের কার কোন ফ্লেভারের শরবত পছন্দ জিজ্ঞেস করতেই ত ভুলে গিয়েছিলাম!’

তন্ময়ের জবাব দিতে হলো না। রুম থেকে বেরিয়ে আসা মাহিন দাঁত দেখিয়ে বলল,
‘আন্টি আপনার হাতের সাধারণ পানিও অমৃত। তাই এসব চিন্তাভাবনা বাদ! যা দিবেন তাই পেটে ঢুকে যাবে। আর এভাবেও আমার লজ্জাশরম কম। সবই খাব।
জবেদা বেগম হাসলেন। বিড়বিড়িয়ে বললেন, ‘পাগল ছেলে!’

আজান দিতে তখনও দশমিনিট বাকি। ইতোমধ্যে চেয়ার জুড়ে সবাই বসে। আজানের অপেক্ষায়। টেবিলে সবরকম ফলফলাদি সাজানো। ঠান্ডা ঠান্ডা তিনরকমের শরবত। ইফতারি মাখাতে শুরু করেছে তন্ময়।
দেখা গেল খাবার খাওয়ার পূর্বে পানি খেয়েই পেট ফুলিয়ে ফেলেছে একেকজন। পর্যাপ্ত খেয়ে, একটু রেস্ট নিয়ে তন্ময় বন্ধুবান্ধব নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। মসজিদে নামাজ পড়ে, ওরা হাইওয়েতে গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছে। গাড়িটা থেমেছে হাইওয়ের শেষের চায়ের স্টলের সামনে। সবগুলো একসঙ্গে বেরিয়েছে। চা-য়ের সঙ্গে সিগারেট। তন্ময় চা-টা শেষ করে একটা সিগারেট ধরিয়েছে। জ্বলন্ত সিগারেটে কয়েক টান দিতেই সেলফোন বেজে ওঠে। অরুর মুখশ্রী স্ক্রিনে। কল দিচ্ছে! এই অবুঝ মেয়ে অকারণে কল দেওয়ার সাহস করে না। তন্ময় হুটহাট ধমক দেয় বিধায় হয়তো!

কোনো কারণে দিয়েছে বোধহয়। তন্ময় রিসিভ করছে না। চোখের সামনেই উচ্চগলায় মাহিন আর রিহান এইটিন প্লাস ভাষায় তর্কাতর্কি করছে। মাহিন তর্কের মাঝেও তন্ময়ের রিংটোন শুনেছে। সঙ্গে সঙ্গে হ্যাংলামি শুরু করে,
‘অরু নাকি? কল ধর, ধর না। বন্ধুবান্ধবদের ওপর একটুও বিশ্বাস নেই তোর। এমন অল্পবিশ্বাসে আমরা ভবিষ্যৎ পাড়ি দিব কীভাবে, হ্যাঁ? জানিস কতদূর যাওয়ার আছে আমাদের? ধর কলটা। একদম চুপ থাকব। বিশ্বাস রাখ!’
তন্ময় ফোন বের করল পকেট থেকে। মাহিনের চোখজোড়া জ্বলজ্বল করে ওঠে। পরমুহূর্তেই ওর চোখের সামনে তন্ময় ফোন খানা সাইলেন্ট করে পুনরায় পকেটে ঢুকিয়ে ফেলল। মাহিনের উজ্জ্বল চোখের চাহনি নিভে গেল। নাক কুঁচকে বিড়বিড় করল, ‘বিশ্বাস ছাড়া বন্ধুত্বের দাম আছে? আজকাল সত্যিকারের বন্ধুত্বের বড়োই অভাব!’
বাড়ির নিচে এসে তন্ময় কল ব্যাক করল। অরু যেন ফোন নিয়েই বসেছে। এক রিংটোন হতেই কল রিসিভ করেছে, ‘হ্যালো।’

তন্ময় কাঁধে চেপে ফোন কানে গুঁজে দু’হাতে সিগারেট জ্বালায়। বাসায় ফিরে আর খাওয়া সম্ভব না। সে সচরাচর পরিবারের সামনে সিগারেট খায়না। তাও দিনে দু-একটা। সিগারেটে প্রথম টান মেরে অস্পষ্ট স্বরে শুধায়, ‘হু?’
অরুর গলার স্বর ছোটো। অনেকটা ফিসফিসিয়ে বলা! যেন লুকিয়ে-চুরিয়ে কথা বলছে, ‘আজ আসতে পারিনি পড়তে।’
আনোয়ার সাহেব সন্ধ্যার আগেই কল করে বলেছিলেন বিষয়টা। তখন অরুর চাপা কন্ঠ ও সে শুনেছে। বারবার বলছিল, ‘না আমি যাব পড়তে! কেন না করছ!’
পরপরই মোস্তফা সাহেবের গম্ভীর কন্ঠে চুপ করেছিল মেয়েট। সেসব মনে করেই তন্ময় নিঃশব্দে হাসে। মুখে বলে, ‘আচ্ছা।’

‘আমি কিন্তু আসতে চেয়েছিলাম।’
‘হুম..কেন আসিসনি তাহলে?’
‘চাচ্চু বলল আজ থাক। তারপর কিছু কী আর বলা যায়? আমিতো বড়দের খুব শ্রদ্ধা করি। তাদের মুখের ওপর একটা কথাও বলিনা।’
তন্ময়ের ঠোঁটের হাসি দীর্ঘ হয়। চোখে একরাশ স্নেহ, ‘হ্যাঁ।’
‘জানেন আজ কী হয়েছে তন্ময় ভাই?’
‘কি!’

‘রোহান স্যারের ইংলিশ ক্লাসের টেস্ট এক্সামে আমার হাইস্কর। স্যার আমাকে একটা পেন দিয়েছেন। আ বিউটিফুল পেন। সাথে অ্যাও বলেছেন আমি খুব লক্ষি মেয়ে। সব পারি কি-না! আমাকে যে বিয়ে করবে সে খুব ভাগ্যবান হবে।’
তন্ময় সিগারেট মুখে কেশে ওঠে। কালো ধোঁয়া উড়িয়ে আহ্লাদী ভঙ্গিতে মাথা দোলায়। দুষ্টুমি মাথায় চাপতেই সে গম্ভীর স্বরে বলে, ‘ভুল বলেনি। ঠিকই বলেছে। আমাদের বাড়ির মেয়ে তো আমরা যারতার হাতে তুলে দিব না। ভাগ্যবান কারো হাতেই তুলে দিব।’

অরু কিছুক্ষণ হাসফাস করে কল কেটে দিল। তন্ময় এবার শব্দ করে হেসে ওঠে। ম্যাসেজ রিংটোন বাজতেই স্ক্রিনে তাকায়। অরুর ম্যাসেজ, ‘আমি যাকেতাকে বিয়ে করব না। মোটেও না। আমি কাউকেই বিয়ে করব না।’
তন্ময় ধীরেসুস্থে সিগারেট টানে। অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে সামনের রংবেরঙের গাছটার পানে তাকিয়ে রয়। অবুঝ প্রেয়সী,
‘দিনরাত বুকের ভেতরটা ক্ষতবিক্ষত করে, আলগোছে মলম লাগায়, অথচ দিনশেষে কিছুই বোঝানা, কিছুই জানেনা।’

পরদিন সন্ধ্যার খুব আগেই বাচ্চারা সব হাজির। অরু, দীপ্ত, আকাশ এবং রুবি ঢুকতেই শান্তশিষ্ট ফ্ল্যাট উজ্জ্বল হয়ে উঠল। চেঁচামেচি করে মাথায় তুলেছে সব। তাদের পাশের বাড়ির অয়নকেও বাচ্চাদের পেছনে দাঁড়ানো দেখা গেল। ছেলেটাকে জবেদা বেগম দাওয়াত করে নিয়ে এসেছেন। আজ সকালে বাজারে হাঁটাহাঁটি করার সময় দেখা হয় দুজনের। ভদ্র সভ্য ছেলেটা বাজারের ব্যাগ বয়ে নিয়ে এসেছে অনেকটা রাস্তা। তাই সে দাওয়াত দিয়ে এসেছে আজ আসবার। জবেদা বেগম ব্যস্ত নয়নে দুয়ারের পানে তাকিয়ে। শাবিহা কী আসেনি? মেয়েটাকে দেখার জন্য নয়ন জোড়া প্রত্যাশায়। তিনি ভাবলেন হয়তো আসেনি। সে-মুহুর্তেই শাবিহাকে গোমড়া মুখে ঢুকতে দেখা গেল। জবেদা বেগম চেষ্টা করলেন চোখের জল লুকোনোর। অথচ মেয়ের চোখের সঙ্গে চোখ মিলতেই কেঁদে ফেললেন। শান্ত নেই শাবিহাও। মায়ের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে কেঁদে ওঠে। তাদের কান্নাকাটি দেখার ফুরসত আসলে অরু আর দীপ্তর নেই। দুজন ঘ্রাণ শুঁকতে শুঁকতে রান্নাঘরে ঢুকেছে।

মায়ের কথামতো তন্ময় ফোন করে চাচ্চুকে জানালো, আজ সবাই এখানেই থাকবে। আনোয়ার সাহেব সম্মতি দিয়েছেন। অবশ্য সে তার বাবার গম্ভীর স্বরে বলা, ‘সব বাচ্চারা ওখানে থাকলে ঘরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগবে না!’ শুনেছে। মানুষটা তাদের কতটা মিস করছে তা তার হাবভাবেই স্পষ্ট। কথাবার্তা শেষ করে লিভিংরুমের সোফায় বসে। অয়ন আর আকাশ পাশেই। তিনজন তারা ক্রিকেট দেখছে। দীপ্ত বসেছে তন্ময়ের কোলে। হাতে তার তন্ময়ের ফোন। সাবওয়েসার্ফ খেলছে সে। তার ঝাকড়া চুলগুলো তন্ময়ের থুতনিতে ঠেকে। মুখ বন্ধ নেই। বাড়িতে ঘটে যাওয়া সবকিছুই বলছে। একপর্যায়ে বলা শুরু করল অরুকে নিয়ে,

‘আপু তো সেই সকাল থেকে পাগলের মতো সারাবাড়ি ঘুরছিল। ঢাকঢোল পিটিয়ে তাড়া দিয়েছে আমাদের। তারজন্যই বিকেল বিকেল চলে এসেছি। আসার কথা ছিল তো সন্ধ্যায়। অরু আপু আমার মাথার ঝুটি-টাও করতে দিল না। জুতো পড়তে নিয়েছিলাম, বলে সেগুলো পড়লে লেট হয়ে যাবে স্যান্ডেল পরতে। বইগুলোও আনতে দেয়নি। হোমওয়ার্ক ও করা হয়নি। ভাগ্যিস কাল ওফ ডে!’

টেলিভিশনে চোখ থাকলেও কান দীপ্তর প্যাচাল শুনতে ব্যস্ত। তন্ময় মন দিয়ে সবটাই শুনল। এবং আরেকটা জিনিস খেয়াল করল। অয়নের দৃষ্টি। উম… বারবার ও শাবিহার দিক তাকাচ্ছে না? বিষয়টা সে ঠিকঠাক বুঝতে পারল, ইফতারির সময়। ছেলেটা অগোচরে লুকিয়ে শাবিহার মুখের দিক তাকায়, আবার চোখ ফেরায়। পবিত্র দৃষ্টি। ছেলেমানুষের পছন্দের সীমানা আকাশ ছোঁয়া। তাদের মনে কখন কে ঢুকে পড়ে বোঝা মুশকিল। অয়নকে সে ছোটো থেকে চেনে। ভীষণ ভদ্র ছেলে। কোনো খারাপ রেকর্ড নেই। তাই আর সে তেমন মাথা ঘামাল না।

শাহজাহান তন্ময় পর্ব ১৩+১৪

অনেকদিন পর সবাই একসাথে হয়েছে। তাই একসঙ্গে অনেক সময় কাটাবে এটাই শাবিহার উক্তি। আড্ডা দিবে, মজা করবে। সেই সুত্র ধরে আটটার পর একজোট হয়েছে সকলে। লিভিং রুমের কার্পেটে গোল হয়ে বসেছে। তাদের মধ্যে একটি পানি ভর্তি ওয়াটার বোতল। এই বোতলটা ঘোরানো হবে। যার দিক বোতল ইশারা করবে তাকে দুটো ওপশন দেওয়া হবে। ট্রুথ নাকি ডেয়ার? ট্রুথ নিলে যা প্রশ্ন করা হবে তার সত্য জবাব দিতে হবে। আর ডেয়ার নিলে সাহসের পরিচয় দিতে হবে। অর্থাৎ যা বলা হবে করতে হবে।

শাহজাহান তন্ময় পর্ব ১৭+১৮

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here