শাহজাহান তন্ময় পর্ব ২৯+৩০

শাহজাহান তন্ময় পর্ব ২৯+৩০
Nabila Ishq

জানালাটা পরিপূর্ণ ভাবে খোলা। শুভ্র রঙের পর্দা গুলো উদাসীন উড়ছে, ভিজছে। ইলশাগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে রাত থেকে। ঝিরঝিরে, গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টিধারার সঙ্গে রয়েছে হিমশীতল আবহাওয়া। বৃষ্টির ফোঁটা হাওয়ায় ভেসে জানালা পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করছে। ফোঁটা গুলো যেন মার্বেলের ফ্লোরে পড়ে ‘টিপটপ’ শব্দ তুলছে! দেয়াল ঘড়িতে ঘন্টার কাঁটা ঘুরছে সকাল আটটা আর মিনিটের কাঁটা ঠিক দশে। বাইরেটা এখনো আঁধারে নিমজ্জিত। মনে হচ্ছে, সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নামবে বলে।

তন্ময়ের তন্দ্রার গভীরতা বেশ পাতলা। বৃষ্টির ক্ষীণ ধ্বনিতে সে আধোঘুমে রয়েছে। মস্তিষ্ক পইপই শুনছে বর্ষণের অস্পষ্ট নৃত্য। শরীরের প্রচাত্যেকটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অলসতার চাদরে লেপ্টে। শান্ত, স্থির এবং উদাসীন নয়নযুগল একবার চাইল জানালার দিকটায়। জানালায় ঝুলে আছে তিনটে ফুলের টব, অলকানন্দা, স্পাইডার লিলি আর বকুল। সবে ফুল ফুটতে ধরেছে। সেসব সতেজ হয়ে আছে বৃষ্টির ছোঁয়াতে। চকচক করছে সবুজরঙা পাতা গুলো। ফুলটুলের প্রতি তন্ময় অযথাই নির্লিপ্ত। ওদের যত্নে রাখা, সময় করে পানি দেওয়ার আগ্রহ কোথায় তার? এগুলো সচরাচর অরুই করে থাকে। ওর ফুলের প্রতি রয়েছে ভীষণ উত্তেজনা, অত্যধিক প্রবণতা। তাদের বাগানের ফুল গুলোর সেবাযত্ন ওই করে থাকে। সকাল-বিকেল প্রায়শই ওকে দেখা যায় বাগানে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

অনেক প্রকারের ফুলের মাঝে ওকেও দেখতে লাগে একটি জীবন্ত ফুল। যেই ফুলটি তার আশেপাশে সর্বদা ঝকঝক করে বেড়ায়, মৌমাছিদের মত। কোনো একটা স্পেসিফিক ফুলের সঙ্গে ওর তুলনা করা যায় না। একেক রজনীতে ও একেকরকম ফুলের মত দেখতে।
ধ্বনিশূন্যতা বজায় রেখে কক্ষের দরজাটা খোলা হলো। জবেদা বেগম ঢুকলেন নীরবে। অত্যন্ত ধীরেসুস্থে চরণ পড়ছে ফ্লোরের বুকে ; যদি শব্দে ঘুম না ভাঙে ছেলেটার। তবে বিছানায় চাইতেই দেখলেন, তন্ময়কে চোখ মেলে তারই পানে চেয়ে থাকতে। মুহূর্তে আঁটসাঁটো হলো বদন। পরপর চমকিত তিনি উচ্চকণ্ঠে হেসে শুধালেন,
‘ঘুম ভেঙেছে তাহলে আমার রাজপুত্রের?’

জবেদা বেগম বিছানার কাছাকাছি আসতেই, তন্ময় হাত বাড়িয়ে মায়ের নরম হাতটা টেনে ধরল। বিছানায় অবলীলায় বসিয়ে নিজের অগোছালো উগ্র চুলের মাথাটা কোলে রাখল অযত্নে। স্নেহরূপে হেসে মমতাময়ী হাতটা ছেলের চুলে রাখলেন জবেদা বেগম। ডান হাতের আঙুল গুলো ব্যস্ত হলো, ছেলের ছোটো চুলগুলো আদুরে শক্তিতে টেনে দিতে। আনমনে বললেন,
‘তোর বাবা এখনো সকালের নাস্তা করেনি। লিভিংরুমে বসে আছে ছেলের সঙ্গে নাস্তা করবে বলে। অবশ্য মুখে বলেনি। এসব কী আর তার বলতে হয়? তার মুখ দেখেই বলতে পারি আমি।’
ক্ষণিকের জন্য চোখ বুঝেছিল তন্ময়। মায়ের উক্তি শুনে চোখ মেলে মায়ের মুখপানে চায়। চেয়ে থেকে অন্যমনস্ক কণ্ঠে শুধোয়,

‘বাহ! আমার মুখখানা ভালোভাবে দেখ। দেখে বলোত আমি কী ভাবছি!’
তন্ময় উত্তর আশা করেনি। এভাবেই বলল। তবে তাকে অবাকের চূড়ান্তে ফেলে জবেদা বেগম না ভেবেই চটপটে জবাব দিলেন,
‘নিশ্চয়ই অরুর কথা।’
এমন উত্তর তন্ময় আশা করেনি। স্বপ্নেও নয়। অপ্রত্যাশিত জবাব কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই, দু-দফায় কেশে ওঠে সে। কাশিটুকু যেন মাথায় চড়ে বসেছে। জাবেদা বেগম হতভম্ব হোন। চটজলদি ডান হাত বাড়ান ছেলের পিঠের দিকটায়। ছোটো-ছোটো চড় বসাতে লাগলেন। অতি সাবধানতাজনিত কণ্ঠে শুধিয়ে বসেন,

‘কীরে বাবা! আমি কি আন্দাজি সঠিক গাছে ঢিল ছুঁড়লাম?’
তন্ময় কিংকর্তব্যবিমূঢ়! আঁখি যুগল ছেড়ে মণি দুটো বেড়িয়ে আসবার উপক্রম হয়েছে প্রায়! গলাটা শব্দকরে পরিষ্কার করল। উঠে বসল অতিদ্রুত। চোরের ন্যায় দৃষ্টি এদিক-ওদিক ফেলল। মায়ের সঙ্গে চোখাচোখি না করেই জানাল,
‘তেমন কিছু না।’
‘আমার তো তেমন কিছুই মনে হচ্ছে আব্বা!’
তন্ময় মায়ের সঙ্গে তর্কে পারবে না আর নাইবা পারবে যুক্তিতে। তবুও অস্বীকার করতে যাচ্ছিল ; পূর্বেই খোলা দরজা দ্বারা অরু ঢুকতে-ঢুকতে প্রফুল্লহৃদয়ে, উচ্চকণ্ঠে বলল,
‘কী মনে হচ্ছে বড়োমা!’
তন্ময় আর একমিনিট ওখানে থাকল না। তড়িঘড়ি করে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। চপ্পল জোড়ায় পা গলিয়ে, বাথরুম ঢুকল কলকলে চরণে। অরু বড়ো বড়ো চোখে দেখল তন্ময়ের পালানো সুঠাম দেহখানা। নজর ফিরিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ল জবেদা বেগমের পানে,

‘কী হয়েছিল এখানে বড়োমা? আমি কি কিছু মিস করে গেলাম?’
‘হ্যাঁ, মিস করেছিস।’
অরুর কণ্ঠে উতলতা,
‘কী মিস করেছি? আমাকে ঝটপট বলো।’
‘শোন তাহলে!’
‘শুনছি, শুনছি। বলো তুমি!’
‘তুই ব্রেকফাস্ট মিস করেছিস। তাড়াতাড়ি নিচে আয় খেতে।’
জবেদা বেগম বেরিয়ে এলেন। দরজা পেরুতে-পেরুতে নিঃশব্দে হাসলেন আঁচলে ঠোঁট চেপে।
অরু বোকার মত দাঁড়িয়ে রইল বেশ কিছুক্ষণ। তার সাথে এভাবে মজা নিলো বড়োমা? পারল সে এমনটা করতে? এক্সপেক্টেশন কতটা উঁচুতলায় উঠেছিল তা তো বড়োমা জানত না। জানলে এভাবে মজা কখনওই করত না। অরু দেখল বিছানাটা অগোছালো। চঞ্চল পায়ে সে নিজ ইচ্ছেতে গোছাতে শুরু করল। গোছানো শেষে ফুলের টব দুটো দেখতে বসল সময় নিয়ে। তখনি তন্ময় বেরোলো পরিপাটি পোশাকে। গলায় তোয়ালে ঝুলে। অরুর মুখশ্রীর একপাশটায় চেয়ে প্রশ্ন করল,

‘খেয়েছিস?’
‘বাহ-রে। কেউই তো খায়নি। আমি কীভাবে একাএকা খেতে বসি? বড়ো চাচ্চু না খেয়ে বসে আছেন, তাকে রেখে কেউ কি খাবার মুখে তুলবে? আর এভাবেও আজ ছুটির দিন। সাথে বাইরে বৃষ্টি। বড়ো মা খিচুড়ি পাকিয়েছে উইদ গরুর গোশত। একসাথে সবাই মিলেমিশে খেলে বেশি আনন্দ হবে।’
‘আচ্ছা। চল!’
তোয়ালে চেয়ারে ছুঁড়ে রুম ছাড়ল তন্ময়। অরু তার পাশে। সমানতালে হাঁটছে। ইতিমধ্যে লিভিংরুমে কমবেশ সবাই উপস্থিত। জয়তুন বেগম গল্পের আসর বসিয়েছেন। তার ছোটো ছোটো গল্পগুলো সব জবেদা বেগমকে ঘিরে। মেয়ে তার কেমন চঞ্চল ছিল, কতটুকু দুষ্টুমিতে মেতে থাকত সেসবই। তন্ময় বাবার পাশেই বসল। মোস্তফা সাহেব আড়চোখে চাইলেন ছেলের দিক। শুধালেন,

‘আজ বেরোবে?’
‘বলতে পারছি না।’
‘সুফিয়ানের পঞ্চান্নতম জন্মদিন সেলিব্রেট করা হবে। ইনভাইটেশন পাঠাল। যাওয়া উচিৎ। সাথে চলো।’
জবেদা বেগমের ডাক পড়াতে, বাবা-ছেলের আলোচনাটুকু ডাইনিংয়ে চলে এলো। খাওয়া-দাওয়ার ফাঁকেফাঁকে তাদের কথাবার্তা চলল। মাঝেমধ্যে আনোয়ার-ওহী সাহেবেও দু’চারটে মতামত তুলে ধরেন। খাওয়া শেষে টিস্যু হাতে তন্ময় বাবার সাথে উঠে পড়ে। পাশাপাশি হেঁটে অগ্রসর হয় সদরদরজার দিকটায়। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি এখন ঝুম বৃষ্টিতে পরিণত হয়েছে। সবুজবর্ণ বাগানে অপূর্বতা ছেয়ে। আনোয়ার সাহেব বড়ো ভাইয়ের পাশে এসে দাঁড়ালেন। বললেন,

‘ভাইয়া, অরু ড্রাইভিং শিখতে চাচ্ছিল।’
মোস্তফা সাহেবের কপালের চামড়ায় চার-পাঁচ দৃশ্যগত ভাঁজ পড়ল।
‘শেখা অবশ্যই ভালো। আরেকটু বড়ো হোক না। তাড়া কীসের? এতটুকু মেয়ে ও। অনার্সটা শেষ করুক। ভর্তি করে দেব নে তখন। আশরাফুলের ছেলের ড্রাইভিং ইন্সটিউট আছে। বললেই হবে। আর এভাবে টুকটাক শিখতে চাইলে তন্ময়, আকাশ ওরা আছে তো। শিখবে ওদের থেকে। ধারণা আসবে ভালো।’
আনোয়ার সাহেব হঠাৎ হাসেন। বলেন,
‘মেয়ে আমার বড়ো হয়ে গিয়েছে।’
‘বড়ো? কোন দিক দিয়ে? এতটুকু মেয়ে আমাদের। এখনো বাড়ির এদিক-ওদিক কেঁদে বেড়ায়।’
শব্দ করে হাসে আনোয়ার সাহেব,

‘ভাইয়া, আপনার আলমের কথা মনে আছে? ওর ছেলে মেঘ এবার অনার্স ফোর্থ ইয়ারে। পড়াশোনার পাশাপাশি আলমের বিজনেসও সামলাচ্ছে। ওর জন্য আলম সেদিন অরুকে চাইল।’
পাশে দাঁড়ানো ছেলের মুখপানে মোস্তফা সাহেব আলগোছে চেয়ে নিলেন একটিবার। মুখশ্রীর রঙ বদলেছে। বদলেছে দাঁড়ানোর ভঙ্গিমা। চেহারায় লেপ্টানো হাসিটুকুর ছোঁয়া এখন আর নেই। মোস্তফা সাহেবের কণ্ঠে থাকা বাক্য ‘আমার কাছে মেয়ের হাত চাইতে এমন আলম নিত্যদিন আসে।’ টুকু গিলে ফেললেন। কথা ঘুরানোর ছুঁতোয় বললেন,
‘ওর আগে শাবিহা-রুবি আছে। ওদের বিয়েশাদির সম্পর্কেই এখনো কোনো আলাপ ওঠেনি।’
‘চিন্তা হয় ভাইয়া। মেয়েটাকে আদরে বাদর বানিয়ে রেখেছি। সারাজীবন যদি নিজের পাশে রাখা যেত, তাহলেই শান্তি পেতাম।’

মোস্তফা সাহেব ঠোঁটে ঠোঁট টিপলেন,
‘ঘরজামাই আনব। ঠিক বললাম তো তন্ময়?’
তন্ময় গম্ভীর গলায় বলে ওঠে,
‘আমার কাজ আছে। গেলাম।’
তন্ময় বাড়ির ভেতর চলে গেল। আনোয়ার সাহেব কিচ্ছুটি আঁচ করতে পারলেন না। তিনি তখনো ভাইয়ের সাথে নিজের মনের কথাগুলো বলে চলেছেন নির্নিমেষ।

অরু ছাঁদের এককোণেতে দুটো চেয়ার পেতেছে। ঠিক ছাউনির নিচে সে এক চেয়ারে বসে অন্য চেয়ারে পা’জোড়া তুলে। হাতে বাদামের কাঁচের বৌঊল। ডান হাতে বাদাম তুলে হাওয়ায় ছুঁড়ে মুখ ‘হা’ করে পুরে ভেতরে নিচ্ছে। বৃষ্টি উপভোগ করছে বাদাম চিবুনির তালে-তালে। তন্ময় সিঁড়ির মাথাতে দাঁড়িয়ে ওর এই অমানবিক কাণ্ডকারখানা অনিমেষ দেখছে। অজান্তে বুকের মধ্যিখানে জমেছে ক্ষোভ। ইচ্ছে করছে আচ্ছা করে ওকে বকতে। নাকে-চোখে কাঁদলে হয়ত তার বিরক্তিকর ক্ষোভ নিভে আসবে।
অরু হাওয়ায় তোলা বাদামটি মুখে পুরতে পারল না। কারো উপস্থিতি অনুমান করে চাইল। ওমনি উঠে দাঁড়াল ঝটপট। তন্ময়ের কণ্ঠে মেঘ ঘনিয়ে বজ্রপাত নেমেছে যেন,
‘চাচ্চু বললেন, তুই নাকি ড্রাইভিং শিখতে চাচ্ছিস?’
অরু ভেঙাল,

‘চাইব না? আমার চাওয়া দোষ? এইযে, আমি বৃষ্টিতে ঘুরতে যেতে চাচ্ছি। কই কেউতো নেই আমাকে ঘুরতে নেওয়ার। আমি ড্রাইভিং শিখলে নিজেই যেতে পারব যখন ইচ্ছে।’
তন্ময়ের কণ্ঠ নিজ অজান্তে নরম হয়ে এলো,
‘আমাকে বলেছিস তুই?’
‘বললেই কী? আপনি মনে হয় বসে আছেন, নেওয়ার জন্য!’
‘তোর কোন ইচ্ছে আমি অপূর্ণ রেখেছি, হু?’
অরুর চোখমুখে আঁধার নামল। মিনমিনে গলায় বলল,
‘মেইন ইচ্ছেটাই অপূর্ণ।’
‘কোন মেইন ইচ্ছে?’
তন্ময় জেনেও অজানার ভাণ ধরল ভালোভাবে। অরু ঘাবড়াল তবুও অটল রইল,

‘আপনি জানেন।’
‘জানি না।’
অরুর গলার স্বর নেমে আসলো,
‘ওটা করতে পারে আর জানে না।’
ওটা বলতে অরু ‘চুমু’ বোঝিয়েছে সেটুকু বুঝেও অবুঝ সাজল তন্ময়। ওকে জব্দ করার তালে শুধাল,
‘বড়ো ভাইয়ের সাথে এভাবে কথা বলিস?’
অরু দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
‘বড়ো ভাই বুঝি ওসব করে?’

অতটুকু বলে হঠাৎ অরু মিষ্টি হাসে। হাসিতে যেন পদ্ম ফুটেছে। তন্ময়ের বুকটা আতঙ্কে মুচড়ে ওঠে। সন্দেহ হয় কিছু একটার। সন্দেহকে সত্য প্রমাণ করে অরুর হাসিটুকু স্নিগ্ধ, সতেজ হয়ে ওঠে। কণ্ঠে শ্রদ্ধাশীলতা ঢলে পড়ছে,
‘বড়ো ভাইয়া, আপনি একদম ঠিক বলেছেন। বড়ো ভাইদের সাথে ওভাবে কথা বলা আমার উচিৎ হয়নি। ভাইয়া আমার বিরাট ভুল হয়েছে, মাফ করে দিন।’
তন্ময়ের মনে হলো, তার হৃদয় ছিঁড়ে গরম, তাজা র ক্ত টলটলে বেরোচ্ছে। অরু সেই র ক্ত হেসেহেসে পান করছে স্বতঃস্ফূর্ততায়। তন্ময় ঢোক গিলল। জব্দ করতে গিয়ে যে সে নিজেই হবে, ভাবেনি। এভাবেই এই ‘ভাই’ তার গলায় আটকে থাকা বিরাট বড়ো কাঁটা। আর এখন এই কাঁটা যদি প্রতিনিয়ত কর্ণকুহরে প্রবেশ করে, সে তো বেশিক্ষণ বাঁ চবে না। সে হাসার প্রচেষ্টা করল সামান্য,

‘আমি জানি আমি কী হই তোর। বারবার বলার প্রয়োজন নেই তো।’
‘কী যে বলেন না বড়ো ভাইয়া! এসব শ্রদ্ধা, শ্রদ্ধা। আমি রেডি হই গিয়ে। বেরোবো তো তাই না?’
অরু হেলেদুলে বেরিয়ে গেল। তন্ময় কপালে আঙুল চাপল। সে খেয়াল করেছে, অরু তাকে আগের মত ভয় পায় না। এই পরিবর্তন ঘটেছে ওই চুমুর পর থেকে। সাহস বেড়েছে সঙ্গে স্পর্ধাও।

তন্ময়ের অঙ্গপ্রত্যঙ্গে জড়ানো কালচে পেলো শার্ট। বুকের দিকের কিছু বোতাম পরিপূর্ণ লাগানো হয়নি। হাত ঘড়ি পরতে নিয়ে রুম ছাড়ল ত্বরান্বিত। অ্যাশ রঙের গাড়িটা বের করল গ্যারেজ হতে। সদরদরজার বাইরে গাড়ি পার্ক করল অনেকক্ষণ। এঁচড়ে পাকা মেয়েটা এখনো নামেনি। তৈরি হতে এতটা সময়ের প্রয়োজন পড়ে নাকি? অবশ্য মেয়েমানুষ মানেই সাধ্যসাধনা মূলক সময়ব্যায়। গুণে-গুণে বিশ মিনিট পর নেমেছে। তাও সাদা পাজামা সেট পরে। বৃষ্টির দিন ওর সাদা কাপড়চোপর পরা নিয়ে যেই নিষেধাজ্ঞা সে দিয়েছিল, তা কী ভুলে বসেছে? ভুলেছে বলেই তো সাহস করেছে। যদি ভুলবশত ভিজে তাহলে পরিস্থিতি কেমন দাঁড়াবে? অরু দরজা খুলে তন্ময়ের পাশে বসল। হেসেহেসে বলতে নিচ্ছিল,

‘বড়ো ভাইয়া… ‘
‘চুপ।’
তন্ময় গম্ভীর কণ্ঠে ধমকে ওঠে। ‘বড়ো ভাইয়া’ ডেকে-ডেকে বিষাদ করে তুলেছে তার রুহ।
ওদিকে ধমকটুকু অরুর অন্তরাত্মা নিতে পারল না। অভিমানে ঝলসে গেল বুকের ভেতরটা। গাল ফুলিয়ে অন্যপাশে মুখ পেতে থাকল। জানালার কাচটা নামাল পরপর। আসমানে একগুচ্ছ কালো মেঘ। সকালবেলার বাইরেটা সন্ধ্যার ন্যায় আঁধারে ভাব। ঝুমঝুমিয়ে নামছে বর্ষা। মুহূর্তে একঝাঁক বর্ষণ পোটলাপুটলি বেঁধে অরুর কোলে এসে বসল। হাওয়ায় বৃষ্টির একেকটি ফোঁটা মিলেমিশে, তোরজোড়িয়ে ভিজিয়ে দিল তাকে দৃশ্যমান রূপে।

বজ্রপাতের তুমুল শব্দ হলো! আশেপাশেই কোথাও হয়ত বজ্রপাত পড়েছে। সুরেলা আওয়াজে স্থিরচিত্তে বর্ষণ হয়ে যাচ্ছে। থামা-থামির নামধাম নেই বললেই চলছে। তন্ময়ের নয়নযুগল বেহায়ার মত অরুতে চলে গেল। ফোঁটা জলে ভেজা গোলাপি ওষ্ঠদ্বয় দেখতেই বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। ডান হাতে হুইল ধরে, বা-হাতে চটপট অরুর পাশের কাচটা উঠিয়ে দিল বিনাবাক্যে। গাড়ির ভেতরে এখন নিস্তব্ধতা শোভমান। বৃষ্টির শব্দ আর কর্ণকুহরে প্রবেশ করছে না। গাড়ির সামনের গ্লাসে ব্যস্ত হয়ে আছে রেইন উইপার্স, ক্ষণে-ক্ষণে সেটি বৃষ্টি মুছছে। তন্ময় আড়চোখে চাইল অরুর দিক। মুখখানা ভাড় করে চেয়ে আছে কাচের পানে। কাচ তুলে দেওয়াটা পছন্দ হয়নি হয়ত। না হোক, সবকিছু কী ওর মর্জি মোতাবেক চলবে নাকি?

তবে, পরমুহুর্তেই মনটা খচখচ করে উঠল। ধমকটুকু দেয়া তার ঠিক হয়নি। ইচ্ছে করছে কাচটা নামিয়ে দিয়ে, ওকে নিজ ইচ্ছেমত ভিজতে দিতে। আবার ভিজলে ওর সর্দি লাগবে, জ্বর হওয়ার সম্ভাবনাও থাকছে। দোটনায় পড়া হৃদয়টা লুকিয়ে তন্ময় সাধারণ গলায় শুধাল,
‘কোথায় যেতে ইচ্ছে হচ্ছে?’
‘লণ্ডন।’
অরুর ত্যাড়ামো জবাবেও তন্ময়ের কণ্ঠের স্বর সমুদ্রের শান্ত স্রোতের ন্যায় শোনাল,
‘এই সপ্তাহে কিংবা মাসে তো সম্ভব না। পড়ে ভেবে দেখব। এর আগে শুনলাম হাতিরঝিল যেতে চাচ্ছিলি। সেদিকে যাচ্ছি তাহলে। হু?’
অরু মুখ ভেঙাল, ‘ঠিকাছে, বড়ো ভাইয়া।’

তন্ময় চুপসে গেল। মেঘ জমল মুখশ্রীতে। চেয়েও ঠিকঠাক ‘বড়ো ভাইয়া’ সম্বোধনটি তার হজম হলো না। হজম না হওয়ার কারণ অবশ্যই রয়েছে। ও কখনো ঠিকঠাক ‘তন্ময় ভাই’ টুকুও বলত না। আপনি- আপনি বলেই ডেকে যেত। আর এখন উঠতে-বসতে ‘বড়ো ভাইয়া’ সম্বোধন সে কীভাবে পেটের ভেতর চালান করবে? মাটন খেয়ে কেউ কী আর চিকেন পছন্দ করবে? তন্ময়ের চেহারায় দৃশ্যগত হয়েছে ‘অপছন্দ’ নামক শব্দটি। অরু নিশ্চয়ই বুঝে নিয়েছে নাহলে বারংবার কেন বলে যাবে? সেয়ানা মেয়েটা তাকে বিরক্তির চরম পর্যায়ে নিতে চাচ্ছে। কিছুক্ষণ খামোশ থেকে তন্ময় অনড় কণ্ঠে বলে,

‘নর্মালি কথা বল।’
‘নর্মালি কথা বলছি, বড়ো ভাইয়া। এর থেকে নর্মাল কথাবার্তা হয় বলে আমার জানা নেই।’
তন্ময়ের কণ্ঠ নেমে আসলো, ‘শেখাব?’
অরুর হৃদয় তড়িৎকৌশলে স্তব্দ হয়। দৃষ্টি হয় ছন্নছাড়া, এলোমেলো। আঁখিপাতায় ভেসে এলো মাওয়াঘাটে ঘটে যাওয়া দৃশ্যটুকু। ওই ওষ্ঠদ্বয় তার ওষ্ঠ ছোঁয়ার পূর্বে বলেছিল ‘ভয় সারাব?’

বুকের ওঠানামার গতি বেগতিক হলো অরুর। ঘুরে গেল জানালার দিক। তন্ময় হাসে শব্দহীনতা বজায় রেখে। ঠোঁটের নিচ অংশটুকু দাঁতে চেপে কোণচোখে চায়। অরু ভুলবশতও তার দিকে তাকাচ্ছে না। বেশ কাবু হয়েছে! নির্লজ্জের মত তার ওমন কথাটা বলা উচিৎ হয়নি। মুখ কী আর উচিত-অনুচিত ভেবে চলে? যা হৃদয়ে আসে তাই মুখে! ওভারব্রিজের রাস্তাটা ধরতেই গাড়ির গতি কমাল তন্ময়। কাচটা নামিয়ে দিল দুপাশ থেকেই। আসুক বৃষ্টি, ভিজিয়ে দিক সর্বশ। অরু এবার নড়েচড়ে ওঠে। ওষ্ঠে ঘেঁষেছে স্মিত হাসি। উপভোগ করছে হিমশীতল বাতাস, বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ। হাতটা বের করে ঠাণ্ডা বৃষ্টির জল হাতের মুঠোতে জমাচ্ছে। তন্ময়ের চোখে হাস্যজ্বল অরুকে পড়ন্ত বিকেলর একচিলতে রোদ লাগে,

একচিলতে আদর।
মানুষজন বিহীন হাতিরঝিল এখন শান্ন্ত, স্থিরচিত্তে মজে। বৃষ্টির স্পর্শে আশপাশ ভেজাটে, নতুন রূপে। তন্ময় ব্রিজের একপাশে থামাল গাড়িটা। ব্রিজের নিচে নদী ছুটেছে। মাথা ঘুরিয়ে তাকাল অরুর পানে। অরু তখনো বাইরে তাকিয়ে দেখছে, অদূরে দুজন কপোত-কপোতীর বৃষ্টি বিলাস। অন্যদের এত দেখার কী আছে?
‘কী দেখছিস?’
অরু ফিরে তাকাল। একপল চেয়ে বলল,
‘বাইরে বৃষ্টি।’
‘হু। ওয়েদার ঠাণ্ডা। বাতাসও ছেড়েছে। বৃষ্টির একেকটা ফোঁটা ঠাণ্ডা। ভেজার দরকার নেই। ঠাণ্ডা লাগবে আর জ্বর তো মাস্ট!’

‘উম…..আচ্ছা। ভিজব না। তবে ঘুরব, ঠিকাছে?’
অরুর এখুনি ঠাণ্ডা অনুভব হচ্ছে। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে। ভিজলে কেঁপে-কেঁপে অস্থির হবে সর্বাঙ্গ। না ভেজাই উত্তম হবে বলে মনে করল।
তন্ময় বেশিক্ষণ সেখানে গাড়ি থামিয়ে রাখল না। কিছুক্ষণ থেকেই পুনরায় গাড়ি চলতে শুরু করল। উল্টোপথ ধরে এগুচ্ছে এবার।

পরদিন রাতে, জয়তুন বেগম রাতের খাবার সেরে, সবাইকে লিভিংরুমে উপস্থিত হতে বলেন। তিনি চাচ্ছেন মেয়ে-মেয়েজামাই, নাতিপুতিদের নিজের সঙ্গে সিলেট নিতে। একটু ঘুরেফিরে নাহয় আসবে সবাই। সেই কত বছর পূর্বে একবার গিয়েছিল। শাশুড়ি মায়ের আবদার ফেলতে পারছিলেন না মোস্তফা সাহেব। আবার সে পুরোপুরিভাবে ব্যস্তও আছেন। তাও তিনি ভাবার সময় নিলেন। আড়ালে-আবডালে বাড়ির অন্য সদস্যদের সাথে আলাপ-আলোচনা করতে এলেন। অরু, দীপ্ত, শাবিহা, রুবি ওরা একপায়ে রাজি। যাবেই যাবে! পারছে না এক্ষুনি ব্যাগপত্র গুছিয়ে বেরিয়ে পড়তে। মোস্তফা সাহেব ছেলের মতামত চাইলেন। তন্ময় তখন অরুর খুশিতে উজ্জ্বল মুখখানা দেখছে। ঘুরাফেরার সম্পর্কে মেয়েটা সদাই মঁই হাতে দাঁড়িয়ে! গলায় থাকা শ্বাসটুকু ফেলে, শেষমেশ বলে,
‘যাওয়া যায়।’

পরদিন মোস্তফা সাহেব সিদ্ধান্ত নিলেন, তারা সবাই সিলেট যাবেন। কিছুদিন ঘুরে আসবেন পরিবার নিয়ে। মস্তিষ্ক সতেজ হবে। তারপরদিনই গোছগাছ শুরু হয়। সন্ধ্যার পরপর রওনা দেবেন। তন্ময় অফিসে ছিল সেদিন। কাজকর্ম যতটুকু পেরেছে গুছিয়ে ফিরেছে। ইতমধ্যে সকলে তৈরি হয়ে, নিজস্ব ল্যাগেজ হাতে লিভিংরুমে দাঁড়িয়ে। তারজন্যই যত অপেক্ষা সবার। তন্ময় দ্রুত ফ্রেশান-আপ হতে ওপরে ওঠে। নিজের রুমে ফিরতে-ফিরতে শার্টের হাতার বোতাম খুলতে ধরেছে। দু’হাতার বোতাম খুলে হাত বাড়ায়, বুকের দিকের সবগুলো বোতাম খুলতে। ঘরে ঢুকতে-ঢুকতে অঙ্গপ্রত্যঙ্গে লেপ্টানো শার্ট পরিপূর্ণ ভাবে খুলে নিয়েছে।

হঠাত পদচারণ স্তব্ধ হয়। দৃষ্টি ঠেকে অরুতে। অরু দাঁড়িয়ে তার কাবার্ডের সামনে। হাতে সাদাটে রঙের শার্ট। ভাঁজ করে ল্যাগেজ গোছাচ্ছিল। ও নিজে পরিপাটি ভাবে তৈরি। সাজগোছ করেছে সামান্য। চুলগুলো আধখোলা বিনুনিতে বেঁধে, এককাঁধে ফেলে রেখেছে। আপাতত ওর দৃষ্টি তন্ময়ের ওপর পড়ল। ওষ্ঠদ্বয়ের মাঝে সামান্য ফাঁক হয়ে গেল মুহূর্তে। আঁখিদুটি বড়সড় আকারে রূপান্তরিত হলো। দৃষ্টি তন্ময়ের উন্মুক্ত বুকে নিবদ্ধ। তন্ময় সেসময় এক’ভ্রু উঁচু করে চায়। লজ্জাজড়িত অরু নজর ফিরিয়ে নেয়। অপ্রস্তুত সে হৈচৈ ফেলে দ্রুত পদক্ষেপ ফেলে বেরিয়ে গেল। তন্ময় ওর যাওয়ার পথটা দেখে নিঃশব্দে হাসে। শার্ট বিছানায় ছুঁড়ে ল্যাগেজের দিক এগোয়। সবকিছুই পরিপাটি করে গোছানো।

তাদের এই সিলেট ভ্রমণপথ ছিল অতুলনীয় আনন্দের, বিশেষ কিছু মুহূর্তের। তন্ময় চব্বিশঘন্টাই অরুকে পাশে পেয়েছে, দেখেছে। তাদের আলাদাভাবে, একান্তভাবে ; এক অনুভব প্রকাশের রীতিনীতি চলছিল যেন! সব ঠিকঠাক ছিল, একদম যেন মেঘের দেশে স্বপ্নের বাড়ি। তারপর হঠাৎ করে অরু ভীষণ জ্বরে আক্রান্ত হলো। জ্বর ছুঁতেই ওর আঁখিদুটিতে ভর করে অন্যরকম চাউনি। যেই চাউনিতে তন্ময় পরিচিত নয়। সে কখনো এই অন্যরকম অরুকে দেখেনি, জানেনি। বিষণ্ণতা ওর মুখশ্রীতে লেপ্টে। মনে হচ্ছে ওর ভেতরে বসবাস করা আদুরে আত্মাটা আর নেই। ডাকলে শুনে না, কথাবার্তা বলে না। তন্ময় ওর এইরূপে চিন্তিত হয়, ব্যথিত হয়। হৃদয় জ্বলেপুড়ে ছারখার হতে শুরু করে। অসহ্যরকমের যন্ত্রণা তার সর্বাঙ্গ জুড়ে। তারপর..তারপর হুট করে, কাউকে কিচ্ছুটি না জানিয়ে ঢাকা ফিরে গেল। একশো পাঁচ ডিগ্রি জ্বর নিয়ে। কেন এমন করল? কী কারণ! তন্ময় কী অজান্তে ওকে কষ্ট দিয়েছে, নিরাশ করেছে? নাহলে তার অরু এমন করার মেয়ে নয়। তন্ময় তখন দিশেহারা পথভ্রম! মোস্তফা সাহেব ছেলের এমতাবস্থা দেখে অস্থির হোন। কাঁধ ছুঁয়ে শুধান,

শাহজাহান তন্ময় পর্ব ২৭+২৮

‘কী হয়েছে আব্বা? এমন করতেছ কেন?’
‘অরুর কী হয়েছে বাবা? ও….
‘চিন্তা হচ্ছে খুব? চলো আজই রওনা দেই। আমি গাড়ি রেডি করতে বলি। চিন্তা করে না।’
অত্যন্ত চিন্তিত মোস্তফা সাহেব বেরিয়ে পড়েন। আজই ঢাকা ফিরবেন সিদ্ধান্ত নেন। তন্ময় মাথা নুইয়ে বসে রইল। চক্ষু দুটো লালচে। হাতে সেলফোন। পঁয়তাল্লিশটি কল ইতোমধ্যে দিয়েছে। বিশের অধিক ম্যাসেজ। একটা কলও রিসিভ হয়নি। ম্যাসেজের কোনো জবাব আসেনি। উলটো ফোন বন্ধ করে ফেলেছে। তন্ময়ের চোয়াল শক্ত হয়। হাতের ফোনটা আছড়ে ফেলে ফ্লোরে। ভেঙেচুরে লণ্ডভণ্ড হয় ফোনটি। দাঁতে দাঁত পিষিয়ে বিড়বিড়িয়ে ওঠে,
‘এই কাহিনীর উপযুক্ত কারণ তুই দেখাতে না পারলে, তোকে আমি খেয়ে ফেলব। জাস্ট খেয়ে ফেলব।’

শাহজাহান তন্ময় পর্ব ৩১+৩২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here