শাহজাহান তন্ময় পর্ব ৩৭+৩৮
Nabila Ishq
অস্থিরতা, চঞ্চলতা– ব্যাকুলতা এবং আকুলতা যেসব প্রভৃতির ভাব তন্ময়ের শক্তপোক্ত হৃদয়ে ছিল; এই পর্যায়ে সেসব পোঁটলাপুটলি বেঁধে হাওয়ায় ভেসে গেল। হৃদয় তীব্র বিদ্রো হী হয়ে ওঠল। আন্দো লন ঘোষণা করল যেন। যার জন্য করল চু রি, দিনশেষ সেই বলল চো র। বন্ধুবান্ধব ফেলে তড়িঘড়ি করে ছুটে এলো যার জন্য; সেই রাণী ভিক্টোরিয়া তো দিব্যি ঘুরতে বেরিয়ে গিয়েছে। তন্ময়ের অপেক্ষাতে চুপচাপ বসে নেই। অভিমানে তন্ময়ের স্বভাবসুলভ গম্ভীরমুখটা, দ্বিগুণ এবং গাঢ়তম ভাবে গম্ভীর হয়ে এলো। জবেদা বেগম চিন্তিত কণ্ঠে শুধালেন,
‘আমার বাবার মুখটা এমন দেখাচ্ছে কেন? কী হয়েছে?’
তন্ময় নির্বিকার হাবভাবে বলল, ‘কিছু না। একটা কফি করে দাও, মা!’
জবেদা বেগমের গলাতে একদলা আগ্রহ গেঁথে আছে, ‘সে নাহয় করে দিলাম। আগে এটা বল, ভালোয় ভালোয় এলি, যেই শুনলি অরু বেরিয়েছে মুখটা ভোঁতা করে ফেললি! ব্যাপার কী? আমাকেও বল। আমিও শুনে মুখ ভাড় করি।’
তন্ময় অস্বস্তিতে পড়ল। লজ্জা পেলো ইষৎ।
গম্ভীরমুখে অদেখা সংকোচ! দৃষ্টি ঘুরিয়ে অস্বস্তিটুকু নিপুণভাবে এড়িয়ে গেলো,
‘কীসব বলছ! কফি করে দিবে না; তা সরাসরি বলে দাও।’
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
জবেদা বেগম ঠোঁট টিপে হাসলেন, ‘বাহ্ বাহ্, কথা ঘোরানো হচ্ছে! বোস। এনে দিচ্ছি।’
তন্ময় লিভিংরুমের সোফাতে গিয়ে বসল। সম্পূর্ণ বাড়ি জুড়ে নিস্তব্ধতা। মুফতি বেগম আর জবেদা বেগম ছাড়া কেউই নেই এই মুহূর্তে। মোস্তফা সাহেব সবাইকে নিয়ে বেরিয়েছেন। তন্ময় সংবাদপত্র হাতে তুলে নিলো। মনোযোগী হওয়ার প্রয়াস। হেডলাইন কোনোরকম পড়তেই চোখ বুঁজে নিলো। সংবাদপত্র ভাঁজ করে পুনরায় টি-টেবিলে রেখে দিলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছাড়ল টেলিভিশন। আর-টিভিতে একটি বাংলা নাটক চলছে। সেটাতে ক্ষীণ মস্তিষ্ক নেওয়ার প্রচেষ্টা।
কিছুক্ষণ বাদে জবেদা বেগম এলেন কফি হাতে।
নিজের জন্যও চা নিয়ে এসেছেন। ছেলের পাশে বসে কফিটা এগিয়ে ধরেন। তন্ময় নিয়ে পুনরায় টিভির পর্দায় দৃষ্টি ফেলল। একটি ঝগড়ার দৃশ্য চলছে। দুজন গ্রামীণ মহিলা আঁচল বেঁধে ঝগড়া করছে। ভাষা এবং চেঁচামেচি শুনে তন্ময় স্তব্দ, বিমুঢ়। সে চ্যানেল পরিবর্তন করতে চাইলে, জবেদা বেগম বাঁধ সাধেন। আগ্রহী চোখে চেয়ে বলেন,
‘দেখ কীভাবে ঝগড়া করছে! ঝগড়ার একেকটা কথা পয়েন্টে পয়েন্টে।’
তন্ময় বাকরুদ্ধ না হয়ে পারল না, ‘আশ্চর্য! এই ঝগড়ার কথা পয়েন্টে পয়েন্টে হলেও আমি দেখে কী করব?’
জবেদা বেগম বিরক্তমুখে বোঝালেন, ‘ঝগড়া করাও একটা আর্ট! শিখে রাখা ভালো। কাজে দেবে ভবিষ্যতে।’
তন্ময় বিরসভাব নিয়ে উঠে দাঁড়াতে চাইল। জবেদা বেগম নিজের থেকে দ্বিগুণ উচ্চতার ছেলেকে টেনে বসিয়ে দিলেন। উৎসাহ নিয়ে বললেন, ‘দেখ না একটু।’
তন্ময় অগ্যত উদাস নয়নে ফের দৃষ্টি ফেলল টিভির পর্দায়। কফিতে ঠোঁট বসাতে-বসাতে মস্তিষ্ক অন্য ভাবনায় বিভোর। এযাত্রায় মুফতি বেগম আসলেন। তিনি এসেই ভীষণ আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
‘কী হয়েছে!’
ওম্নেই জবেদা বেগম তাকে টেনে পাশে বসিয়ে দিলেন। টেলিভিশনের পর্দায় চলতে থাকা ঝগড়া দেখাতে ব্যস্ত হলেন। মুফতি বেগমও অতিমাত্রায় আগ্রহভরা নয়নে দেখতে বসেন। দেখে-দেখে মন্তব্যও করেন। সে সুযোগের সৎব্যবহার করল তন্ময়। আলগোছে উঠে পড়ল। ত্বরান্বিত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এলো। নিজ রুমে ফিরল ঝটপট। আগামীকালের গুরুত্বপূর্ণ অফিস কাগজপত্র সহ ল্যাপটপ হাতে তুলে নিয়ে এগুল বারান্দার দিক। বারান্দায় বসল আরামদায়ক ভঙ্গিতে। ঊরুতে ল্যাপটপ রেখে, কফি খেতে-খেতে ব্যস্ত হলো কাজে। কাজকর্মে মননিবেশ হতেই ভুলে বসল রাণী ভিক্টোরিয়া অরুকে। যিনি ধেইধেই করে ঘুরতে বেরিয়েছে। ঘড়ির কাঁটা এখন এগারোটা বিশে। আসমানের এসময় গুরুতর দুর্দশা। কালো মেঘে আচ্ছন্ন পরিপূর্ণ আকাশ। ঢাকঢোল পিটিয়ে মেঘেরা গর্জন করছে। চাঁদের কোনো হদিশ নেই। উদাসীন বৃষ্টি এই নামবে নামবে হাবভাব। গাড়ির ধ্বনি কর্ণগোচর হলো। ফিরেছে হয়তো সকলে। তন্ময় উঠল না। নাক ফুলালো। ধ্যানমগ্নতায় কাজে ডুবল পুনরায়। মিনিট চারেকের মাথায় দরজায় করাঘাত পড়ল। পরপর ঢুকল অরুর মাথাটা।
তন্ময় মাথা তুলল না ল্যাপটপ স্ক্রিন হতে। না সে ফিরে চাইল। অরু ছোটো করে, ‘আসলাম’ বিড়বিড়িয়ে জানাল। এতেও তন্ময় বিন্দুমাত্র প্রতিক্রিয়া দেখাল না। নিজের মতোন কাজ করেই গেলো। অরু ছোটোছোটো পদচারণে বারান্দায় এলো। মাথা ঝুকিয়ে দেখল কর্মরত তন্ময়কে। চঞ্চল চাহনি দ্বারা চেয়ে রইল। বেচারি বেজায় চিন্তিত তন্ময়ের গম্ভীর, আগ্রহহীন হাবভাবে। অরু মিনিটখানেক চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে শুধাল,
‘তন্ময় ভাই, কী করেন?’
তন্ময় নিরুদ্বেগ, নির্লিপ্ত। ইষৎ ধ্বনি তুলে ল্যাপটপের কীবোর্ড টিপে চলল। প্রয়োজন অনুভব করল না দৃষ্টি তুলে তাকানোর। অরু আশ্চর্যের সপ্তমে পৌঁছাল। চোখমুখ ভোঁতা হলো। অভিমানে সিক্ত হবার জোগাড় তার আঁখিদুটি,
‘কথা বলছেন না কেন!’
দিনশেষে তন্ময় দুর্বল অরুর প্রতি। ওর সামনে সে অসহায়। চেয়েও দীর্ঘক্ষণ এড়াতে পারে না, এই মেয়েকে! বিধাতা তাকে এতটা শক্ত হৃদয় দেননি। এযাত্রায় ল্যাপটপের স্ক্রিনে দৃষ্টি রেখেই গম্ভীরকণ্ঠে বলে, ‘দেখছিস না কী করছি?’
অরুর বুকের ভেতরটা দুরুদুরু কাঁপল। তিরতির কাঁপছে ওষ্ঠদ্বয়। যেন কিছু বলতে চায়ম অভিমানে হৃদয় উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। একচিত্তে চেয়ে থাকে তন্ময়ের মুখপানে। ঝুমঝুমিয়ে বর্ষণ নামে তক্ষুনি। অরু অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বাইরে তাকায়। বৃষ্টিতে দৃষ্টি পড়তে ভেতরটা ধক করে ওঠে। ছাঁদে ঘটিত একেকটি দৃশ্য ফিল্মের মতো দু’চোখের পাতায় ভাসে। ক্ষণিকের অভিমান অদৃশ্য হয়ে যায়। দৃষ্টি ফিরিয়ে আড়চোখে তন্ময়ের পানে চাইতেই, দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলে। তন্ময় গুনেগুনে মিনিট খানেক ধরে দেখেছে অরুর লাজুক মুখশ্রী।
বৃষ্টির পানে চেয়ে রক্তিম হয়ে আসা; ওর গালজোড়া সে নির্নিমেষ উপভোগ করেছে। দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলতেই তন্ময়ের শরীর জুড়ে উত্তাপ। দৃষ্টি নিবিড়। নীরবতা ভেঙে বলে,
‘ঘুরতে গিয়েছিলি?’
অরু ধীরেসুস্থে দুবার মাথা দুলিয়ে বোঝায়, হুঁ গিয়েছিল। তন্ময় নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল,
‘ঘুরাফেরা হয়েছে, এখন গিয়ে শুয়ে পড়।’
অরু চুপচাপ দাঁড়িয়ে। মুখটা চুপসানো। সে ইতস্তত ভঙ্গিতে প্রশ্ন করল, ‘আপনি কী আমার ওপর রেগে!’
তন্ময়ের কাঠখোট্টা জবাব, ‘না।’
অরু যেন পাকাপোক্ত ভাবে স্বীকৃতি পেলো। বিড়বিড়িয়ে বলল, ‘আমি কি করলাম! আমার ওপর রাগার কারণ কী! রাগা তো আমার উচিত!’
তন্ময় শুনেও শুনল না। কাগজপত্র, ল্যাপটপ হাতে উঠে দাঁড়াল। বড়ো বড়ো পায়ে বেডরুমে চলে এলো। আশানুরূপ তার পিছু-পিছু আবছায়া অনুভব করতে না পেরে, আড়চোখে পেছনে চেয়ে দেখল অরু বারান্দাতেই দাঁড়িয়ে। একচিত্তে বৃষ্টি দেখছে। তন্ময় সে দৃশ্যে থমকাল। হৃদয় অশান্ত, দৃষ্টি নরম হলো। ঢোক গিলে অনুভব করল ভেতরটা স্রোতের ন্যায়! তার ছোট্টোখাট্টো একচিলতে অভিমান রইল না। পাজোড়া নিজ মোতাবেক কাজ করে বসল। ধীরেসুস্থে এগুতে থাকল বারান্দার দিক। থামল ঠিক অরুর পেছনে। অরু গ্রিলের ফাঁকফোকর দ্বারা হাত বাইরে দিয়ে রেখেছে। বৃষ্টির জল ছুঁয়ে দিচ্ছে ওর কোমল, ফর্সা চিকন হাত। সেই দৃশ্যও দেখতে বেশ লাগছে তন্ময়ের। আনমনেই নিজ হাতটাও বাড়াল। ঠিক অরুর হাতের নিচে। আড়চোখে দেখল এহেন কাণ্ডে অরু হাসছে। মিটিমিটি হাসিটুকু ওর ভালোলাগা কী সুন্দর ভাবে জাহির করছে! অরুকে দেখতে নিয়ে অনুভব করল তার হাতে আরেকটি হাতের স্পর্শের। ত্বরিত সেদিকে দৃষ্টি ফেলে দেখল অরুর ছোটো হাতটা, তার বৃহৎ হাতের মুঠোতে যত্নসহকারে পড়ে আছে। মুহূর্তে ইষৎ হাসি খেলা করল তার ওষ্ঠদ্বয় জুড়ে। অরু একচিত্তে বৃষ্টি দেখলেও; তার দৃষ্টি বৃষ্টি উপভোগ করা প্রেয়সীতেই নিবদ্ধ হয়ে রইল।
বর্ষাকাল পেরুল; পেরুল ভাদ্র-আশ্বিন। চলছে অগ্রহায়ণ মাস। ঋতুর হেমন্তকাল। আজ বুধবার। গত দু’মাস ধরে তন্ময় কাজসূত্রে ব্যস্ত। সকাল সাতটায় বেরিয়ে ফিরে রাতের এগারোটায়। এমনকি মাঝেমধ্যে বারোটা ছোঁয়। আজকাল শুক্রবার ব্যতিত বাসায় থাকা হয় না। কাল আবার কাজসূত্রে বেরুতে হবে চট্রগ্রামের উদ্দেশ্যে। দুদিন থাকা লাগবে সেখানে। আজই তার ম্যানেজার হোটেল বুকিং দিয়ে রেখেছে। কাল সকাল-সকাল রওনা হবে। সেইসূত্র ধরে আজ অফিস হতে তাড়াতাড়ি বেরুনো হয়েছে। তখন ঘড়ির কাঁটা ঘুরছে সাতটা। গাড়িটা সবেমাত্র তাদের এলাকায় ঢুকেছিল, ওসময় কর্ণে প্রবেশ করল ছোট্টখাট্টো ডাক। গলার স্বর পরিচিত। অয়নের কণ্ঠ চিনতে অসুবিধে হলো না তন্ময়ের। জানালার কাঁচটা খোলা ছিলো কিঞ্চিৎ। এতেই দেখতে পেলো অয়নের অবয়ব। সবেমাত্র দু’গাল জুড়ে দাড়িগোঁফ ওঠা শুরু করেছে। বাচ্চা বাচ্চা ভাবটা এখন আর নেই। অয়ন ঝুঁকে হাসিমুখে আবদার ধরে,
‘ভাইয়া, এককাপ চা খাওয়ার সময় হবে?’
ছেলেটার কণ্ঠেও অগাধ পরিবর্তন এসেছে। তন্ময় একচিত্তে কিছুক্ষণ অয়নের মুখমণ্ডল দেখে। সেমুহূর্তে তার দু’চোখের পাতায় ভেসে ওঠে বোনের কান্নারত মুখশ্রী। ছোটো বোনের কান্নার কারণ তো তার সামনে উপস্থিত এই ছেলেটাই! এরজন্যই তো দিনরাত কেঁদেকেটে বেড়ায়। যন্ত্রণায় প্রায়শই ছটফট করে। যা হুটহাট তার তীক্ষ্ণ নজরে দেখা দেয়। ভাবনাচিন্তার অদেখা হিসেব-নিকেশ কষে, অবশেষে তন্ময় ঠোঁটে ঠোঁট টিপে থমথমে মুখে মাথা দোলায়। গাড়িটা একপাশে রেখে বেরিয়ে আসে। চা-পানের দোকানটা অদূরেই। দুজন ধীরেসুস্থে হেঁটে সেখানে পৌঁছিয়ে পাশাপাশি বসে। অয়ন একফাঁকে উঠে দাঁড়ায় দুটো চায়ের অর্ডার দিতে। দেবার একফাঁকে শুধায়,
‘ভাইয়া, সুগার কেমন?’
তন্ময়ে শর্টকাট জবাব, ‘উইদাউট সুগার।’
চায়ের অর্ডার দিয়ে এসে, মাঝে সামান্য দূরত্ব রেখে; পুনরায় তন্ময়ের পাশে বসে অয়ন। দুহাতের তালু ক্রমান্বয়ে প্যান্টে ডলতে থাকে। ছোটো-ছোটো ঢোক গিলে। এই কাজকর্ম গুলো নার্ভাসন্যাসের লক্ষণ। তন্ময়ের বুঝতে আর বাকি রয় না, এই ছেলে ঠিক কী নিয়ে কথা বলবে! তবে মুখে সে কুঁলুপ এঁটে থাকে। গম্ভীরমুখটা দ্বিগুণ রূপে ভারী করে রাখে। সে দেখতে চায় ওর সাহস কত! বুকের পাটা কতবড় আজ তার পরিক্ষা নেবে সে! কোন জাদুমন্ত্র ছুঁড়ে পাগল করল তার আদরের বোনকে, তা তো তাকে যেকোনো মূল্যে জানতে হবে। অয়ন এদিক-ওদিক চেয়ে নিজেকে ধাতস্থ করল। খানিকক্ষণ চুপ থেকে, নীরবতা ভাঙতে অপ্রস্তুত গলায় শুধাল–
‘ভাইয়া, আপনার দিনকাল কেমন যাচ্ছে!’
তন্ময় নির্বিকার, ‘আলহামদুলিল্লাহ্। তোমার বলো! পড়াশোনা কেমন চলছে?’
অয়ন জোরপূর্বক সামান্য হাসার প্রচেষ্টা চালাল, ‘ভালো। সামনেই ফাইনাল। মন দিয়ে পড়াশোনা করতে চাচ্ছি কিন্তু পারছি না।’
তন্ময় উদাস কণ্ঠে, ‘ওহ্’ উচ্চারণ করল। আগ বাড়িয়ে আর জিজ্ঞেস করল না, কেন পারছিস না বা আশায়বিশায়! অয়নকে সুযোগের ‘গ’ পর্যন্ত দিলো না। অপরদিক অয়ন বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ল। হাঁসফাঁস করে বেচারা চুপসে গেল। সেসময় দু’কাপ চা দিয়ে গেল এক বালক। অয়ন একটি কাপ নিয়ে অপরটি তন্ময়ের দিক এগিয়ে ধরল। তন্ময় বিনাবাক্যে চায়ের কাপ নিয়ে তাতে চুমুক বসাল। তবে অয়ন চায়ের কাপ হাতে বসে থাকল। নীরবতায় কথাদের সাজাতে ব্যস্ত যেন! তন্ময় আড়চোখে নিশ্চুপ ভাবে ওর মুখভঙ্গি অনুসরণ করল সঙ্গে চায়ে ধীরেসুস্থে চুমুক বসাতে থাকল। দু’মিনিট নীরবতায় কেটে গেল। চায়ের কাপ ফাঁকা হলো। তবে অয়নের বুলি ফুটল না। তন্ময় আশাহত! এই ছেলেকে দিয়ে বুঝি কিছুই হবে না। যেই ছেলে প্রেমিকার বড়ো ভাইয়ের সম্মুখে বুক ফুলিয়ে ভালোবাসার জাহির করতে পারে না, সে কতটুকু সাহসী হবে? কতটুকুই বা পুরুষত্বের পরিচয় দেবে? এভাবেই তার বোন বয়সে বড়ো। অয়ন ছোটো। বয়সের সঙ্গে যদি ওর চিন্তাভাবনা- সাহসিকতাও কম হয় তাহলে তো হবে না। বয়স কম হলেও চিন্তাভাবনা, ব্যক্তিত্ব এবং পুরুষত্ব থাকতে হবে অধিক। যারতার হাতে তো আর আদরের বোন সে তুলে দেবে না। ফাঁকা চায়ের কাপ হাতে উঠে দাঁড়াল তন্ময়। দুটো চায়ের বিল অয়নের পূর্বে মিটিয়ে দিলো। অয়নের উদ্দেশ্যে বলল,
‘থাক তাহলে। পড়ে দেখা হবে।’
তন্ময় কয়েক কদম হেঁটে চলে গিয়েছে। অয়ন দৌড়ে গিয়ে তন্ময়ের সামনে দাঁড়াল। তাদের আশপাশটা আঁধারে এবং নির্জন। মানুষের আনাগোনা কম। অয়ন ঘনঘন শ্বাস নিলো। চোখমুখ শক্ত করে সময় নিয়ে দৃঢ়ভাবে জানাল,
‘ভাইয়া, আমি– আমি শাবিহাকে ভালোবাসি। যতটা ভালোবাসলে নিজের অস্তিত্ব ভুলে যাওয়া সম্ভব ততটা।’
তন্ময়ের নিরুদ্বেগ মুখশ্রী দেখে অয়নের মুখমণ্ডলের হাবভাব পরিবর্তন হয়। কিঞ্চিৎ বিস্ময় খেলা করে ওর চোখজোড়া জুড়ে। তন্ময় সে চোখে চেয়ে তর্জনী তুলে বলে,
‘বলে নয় করে দেখা। চোখে আঙুল তুলে বোঝা বয়স কিছুই নয়। বিশ্বাস করা, ইউ ক্যান হ্যান্ডেল হার। ইউ ক্যান টেক কেয়ার ওভ হার। আমরা ওকে রাজকুমারীর মতো বড়ো করেছি। এবার তার হাতে তুলে দেব যে রানির মতো বাদবাকি জীবন রাখতে পারবে।’
অয়ন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। ক্রমাগত মাথা দোলাল। উচ্ছ্বাস খেলা করল ওর চোখমুখ জুড়ে। অটল–বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলল,
‘আমি নিজেকে প্রমাণ করেই আসব ওর হাত চাইতে। ভাইয়া, আপনি শুধু আমায় একটি সাহায্যের নামে ওয়াদা করুন। তাহলে আমার সামনে এগুতে কোনো সমস্যা হবে না।’
তন্ময় আগ্রহী গলায় শুধাল, ‘কী?’
অয়ন এযাত্রায় বিধ্বস্ত হলো, ‘কয়েকদিন পরপর শুনছি ওকে দেখতে আসছে। বিয়েশাদির কথাবার্তা চলছে। এসব আমাকে মানসিক ভাবে শান্তি দেয় না। আমি পড়াশোনায় মন বসাতে পারি না। প্লিজ, ভাইয়া! আমাকে দুটো বছর দিন। এরমধ্যে ওর বিয়েশাদি আটকে রাখুন। আমি কথা দিচ্ছি, আমি সেই অয়ন তৈরি হব; যেই অয়নের হাতে আপনি নির্দ্বিধায় শাবিহার হাত তুলে দিতে পারবেন।’
তন্ময়ের থমথমে মুখের পরিবর্তন ঘটে। ভ্রুদ্বয় শিথিল হয়ে আসে। ডান হাত উঠিয়ে অয়নের প্রশস্ত কাঁধে রাখে, ‘বেস্ট ওভ লাক।’
অয়ন হেসে বলে, ‘থ্যাংকিউ। বাই দা ওয়ে ভাইয়, আপনি তো বুঝবেন আমার ভালোবাসা শাবিহার জন্য কতটা গাঢ়!’
তন্ময় আশ্চর্য হয়। চওড়া কণ্ঠে শুধায়, ‘কীভাবে বুঝব?’
অয়ন লাজুক ভঙ্গিতে জানায়, ‘এক সত্যিকারের প্রেমিক চেনে আরেক সত্যিকারের প্রেমিককে!’
এবার তন্ময় আশ্চর্যের সপ্তমে পৌঁছায়। ওষ্ঠদ্বয়ের মধ্যে কিঞ্চিৎ ফাঁক হয়। সে ভাষা হারিয়ে বসে ক্ষণিকের জন্যে। নিজেকে স্বাভাবিক করে কোনোরকমে প্রশ্ন ছুঁড়ে, ‘কে সত্যিকারের প্রেমিক?’
অয়ন মিটিমিটি হেসে ফেলে, ‘আপনি! ভাইয়া, আমি তো জানি আপনি অরুকে ভালোবাসেন। আধপাগলও এক দেখাতেই বলে দিতে পারবে। আপনার চোখমুখ তীব্র ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়।’
তন্ময় নিশ্চল; নিস্পন্দ! চোখেমুখে লেপ্টে অবিশ্বাস্যতা। তন্ময়ে স্তব্ধীভূত অবস্থার ফায়দা তুলে; অয়ন এই ফাঁকে এক দৌড়ে পালাল। মিনিটের মধ্যে ওকে আর দূরদূরান্তে দেখা যাচ্ছে না। তন্ময় একপর্যায় ডেকেও ওর সাঁড়া পেলো না। অগ্যত চিন্তায় পড়ল ভীষণ! তার গম্ভীরমুখে কী লেখা সে অরুকে ভালোবাসে? নাহলে এক দেখাতে মানুষ কীভাবে বুঝবে? অয়নই বা কীভাবে বুঝতে পারল? জটিল সমস্যা!
শাহ্জাহান বাড়ির দোরগোড়া পেরিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকতে-ঢুকতে ঘড়ির কাঁটা ঘুরছে আটটাতে। তন্ময় গাড়িটা পার্কিং করে বেরুতেই সর্বপ্রথম খেয়াল করল অরুকে। দোতালায় দাঁড়িয়ে রয়েছে মুখ ভোঁতা করে। অর্ধখণ্ডিত ধবধবে সাদা চাঁদ সহ সহস্র নক্ষত্র ঠিক ওর মাথার ওপরে। সেই চমৎকার আসমান অবলীলায় দেখছে। নয়নযুগল জুড়ে নিত্যকারের মুগ্ধতা নেই। উদাস, হতাশ ওর হাবভাব। যেন পৃথিবীতে ও পরিপূর্ণ ভাবে একাই আছে; ওর কেউ নেই। তন্ময়ের ক্লান্ত মুখপানে ইষৎ আবিরের ছটা পড়ল এযাত্রায়। সে স্বেচ্ছায় গাড়ির দরজাটা বিকট ধ্বনি তুলে লাগাল। এতে কাজ হলো বটে! অরু তড়িৎ দৃষ্টি নিচে ফেলল। তন্ময়কে ফিরতে দেখে বাকরুদ্ধ হলো। ক্ষণিক চোখ বড়ো বড়ো করে চেয়ে রইল। দৃশ্যমান রূপে তার ভোঁতা মুখটুকু উচ্ছ্বাসে রূপান্তরিত হয়ে এলো। পরমুহুর্তেই সহাস্যমুখে হাত উঠিয়ে ব্যাকুল গলায় চেঁচিয়ে ডাকল,
‘তন্ময় ভাই! এইযে আমি ওপরে।’
তন্ময় এমন এক ভাব ধরল; যেন অরুকে সে মাত্রই খেয়াল করল। কিছুক্ষণ আগে ভ্যাবলার মতোন ওকে দেখা ব্যক্তিটি সে নয়! প্রেয়সীর এটেনশন্ পেতে শব্দ তোলা ব্যক্তিটি একদমই সে নয়! প্রিয়তমার মুখ দেখে ইষৎ হাসা ব্যক্তিটিও সে নয়। এযাত্রায় তন্ময় দৃষ্টি তুলে গম্ভীরমুখে মাথা দোলাল। আড়চোখে আরো দু’বার চাইল। ত্বরিত পদচারণে ভেতরে ঢুকল। দৈনন্দিনের ন্যায় আজ আর লিভিংরুমে একমুহূর্তের জন্য দাঁড়াল না। সোজাসাপটা সিঁড়ি বেয়ে দোতলাতে উঠে এলো। অরু দাঁড়িয়ে হাস্যজ্জ্বল মায়াবী মুখখানা নিয়ে। পরনে মসলিনের কামিজ। ওড়নাটা কী সুন্দর ওর চারিপাশে ছড়িয়ে। ওর এই হাস্যজ্জ্বল, মায়াবী মুখমণ্ডল জাদুর মতো কাজ করল। টনিকের ন্যায় দূর করল তার সারাদিনের ক্লান্তি– রাগান্বিত অনুভূতি। হাওয়ায় ভেসে গেল সবরকমের কাজকর্মের চিন্তাভাবনা। একদলা আবেগ, অপরিসীম ভালোবাসা ব্যতিত কিছুই অবশিষ্ট রইল না হৃদয়ে। অদৃশ্যভাবে নরম হয়ে এলো ভঙ্গিমাযুক্ত তার গম্ভীরমুখ। অরু উরণচণ্ডী রূপে, ছটফটে গলায় শুধাল,
‘আজ থেকে বুঝি আটটায় ফিরবেন? ঠিক আগের মতো?’
অরুর মুখশ্রী জুড়ে প্রত্যাশা। জ্বলজ্বল করছে আঁখিদুটি। ওই প্রত্যাশা ভর্তি মুখমণ্ডল হতে তন্ময় দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। ইচ্ছে করছে না প্রত্যাশা ভেঙে সত্যিটা জানাতে। দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগা তন্ময়ের পূর্বেই বাচ্চা-বাচ্চা কণ্ঠটি অদূর হতে বলে ওঠে,
‘তন্ময় ভাইয়া, কাল চট্রগ্রাম যাবে। এরজন্যই তো আজ তাড়াতাড়ি ফিরেছে। অরুপি, তুমি দেখি কিচ্ছু জানো না।’
দীপ্ত দৌড়ে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে এসেছে। কোঁকড়া চুলগুলো ওর হাঁটার তালে তাল মিলিয়ে দুলছে। স্বাস্থ্যসম্মত মুখটা হাসির পরশে গোল আলুর ন্যায় হয়ে আছে। অরুর সেদিকে ধ্যান নেই। সে অবাকের চূড়ান্তে। কণ্ঠে বিস্ময়,
‘কী!’
শাহজাহান তন্ময় পর্ব ৩৫+৩৬
তন্ময় আলগোছে নিজের কক্ষের দিক হাঁটা ধরে। রেগেমেগে অস্থির অরু তার পিছু-পিছু আসছে আর প্রশ্ন করে যাচ্ছে,
‘আপনি কাল সত্যি চট্রগ্রাম যাচ্ছেন? কদিনের জন্য যাচ্ছেন? কেন যাচ্ছেন?’
তন্ময় চোখ তুলে দীপ্তর পানে চাইতেই দীপ্ত কী বুঝল কে জানে! সে হেসে দৌড়ে চলে গেল। আগ্রহ চোখে তাকে আর ফিরে তাকাতে দেখা গেল না। অরুর অবশ্য সেদিকে গভীর অভিনিবেশ নেই। সে তখনো একাধারে প্রশ্ন করায় ব্যস্ত। তন্ময় ধৈর্যসহকারে অনিমেষ শুনতে ব্যস্ত!
