শাহজাহান তন্ময় পর্ব ৪১+৪২
Nabila Ishq
নীল আকাশ জুড়ে শুভ্র মেঘের ছড়াছড়ি। সূর্যের সোনালি দীপ্তি অরুর ঘুমন্ত মুখ জুড়ে। মাথাটা হেলেদুলে চলেছে চলন্ত গাড়ির তালে-তালে। তন্ময় ভালোভাবেই অবগত ছিলো; অরু বেশিক্ষণ সজাগ থাকতে পারবে না। শিগগিরই গভীরতম ঘুমের দেশে পাড়ি জমাবে। হলোও তাই। স্বাভাবিকভাবে গতকাল রাতে দ্রুত ঘুমুতে যায়নি। সকালে আবার ভোর করে উঠেছে। ঘুমে তলিয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক নয় কী! তন্ময় একপল ওর মুখপানে আড়চোখে চেয়ে কাঁচটা তুলে দিল। দুটো কাঁচ তুলে দিতেই ভেতরটা আঁধারে এবং গুমোট পরিবেশে আবদ্ধ হলো। জাঁকজমক, ঝঞ্ঝট পৃথিবী হতে বহুদূর, ছোটোখাটো নিজেদের একটি পৃথিবীতে আছে যেন!
এযাত্রায় তন্ময় অবাঞ্ছিত একটি কাজ করে বসল। চলন্ত গাড়িটির গতি কামিয়ে ব্যস্ত হলো– মাথার ওপরে হাতের বাম-পাশের আয়নাটির নিদর্শন পরিবর্তন করতে। এবারে অরুর মুখটুকু আয়নাতে পরিষ্কার দেখাচ্ছে। তন্ময় অবলীলায় একপল চোখ তুললেই মুখদর্শন হচ্ছে। ব্যাপারটা যেমন তৃপ্তিজনক তেমনই অশান্তিজনক বটে। তৃপ্তি দু’চোখ হচ্ছে আর অশান্তি হৃদয়! অদ্ভুতভাবে লম্বা একটি সময় অতি নীরবে চলে গেল। অরুর চোখমুখ বন্ধ থাকলে সবকিছু নির্জীব ভারী। এইযে এখনের সময়টাতেই প্রমাণ পাওয়া গেল। ওর চঞ্চলতা, বাচালতা ছাড়া তন্ময়ের দুনিয়া ভয়াবহ রকমের শান্ত, স্তব্ধতায় মোড়ানো।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
ঘড়ির কাঁটা ঘুরছে দশটা ত্রিশে। জানালার বন্ধ কাঁচেতেই এতক্ষণ যাবত অরুর মাথাটা লেপ্টে ছিল। তন্ময় ভুলবশত চেয়েও এগিয়ে মাথাটা নিজের কাঁধে নিচ্ছে না। যদি ওর ঘুমটা ভেঙে যায় সেই ভয়ে। ভেবেছিক একচিত্তে একইভাবে কতক্ষণই বা ঘুমাবে? নিজেই ফিরবে তার দিকে। তবে তা আর হলো কোথায়? অগ্যত এযাত্রায় ওর মাথাটা নিজ কাঁধে সযত্নে নিয়ে এলো। অরুর ঘুমটা সামান্য কেঁটে গেল বোধহয়। মিটমিট করে আধবোজা চোখে চাইল। তন্ময়ের কাঁধে মাথা রেখেছে বুঝে– আরও নিবিড়ভাবে মাথাটা এগিয়ে নিলো। ঘুম জড়ানো–আকুতি মেশানো কণ্ঠে বিড়বিড়িয়ে বলল,
‘কাঁচটা নামিয়ে দিন না।’
ঘুমঘুম কণ্ঠটি ঠিক তীর হয়ে বিঁধল তন্ময়ের অন্তরে! অন্তরের ভেতরে কিছু একটা ধপাস করে ভাঙল যেন। ঘুমঘুম কণ্ঠও যে এতটা প্রভাব ফেলতে পারে এই প্রথম উপলদ্ধি করল সে। আবার দেখ, ঘুমের মধ্যেও গাড়ির কাঁচ খোলা চাই! অগ্যত তন্ময় সরু সড়কপথে বিচক্ষণ দৃষ্টি রেখেই, গাড়ির কাঁচ দুটো নামিয়ে ফেলল। দুধারে গিয়েছে দুটো রাস্তা। তন্ময় বাম-পাশের বাঁকা রাস্তাটির দিক ছুঁটে। রাস্তার দুধারে রয়েছে বড়ো-বড়ো হরেকরকমের গাছ। বিশেষ করে নারিকেল গাছ। জমিন জুড়ে ছোটোছোটো সবুজ ঘাস। এদিকটায় পাখিদের কিচিরমিচিরও বড্ড বেশি। রোঁদটাও তেমন তীক্ষ্ণ নয়। আরাম বোধ হচ্ছে বেশ। বাতাস হামলে এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে তাদের। গাড়ির গতি বাতাসের স্পর্শের মাত্রা দ্বিগুণ করে ফেলেছে।
অরুর শান্ত-স্থির চুলগুলো এবার অশান্ত হয়েছে। ড্রাইভার তন্ময়কে মহাবিরক্ত করছে। তার মুখ-বুক সবাখানে চুলের ছড়াছড়ি। সুড়সুড় লাগছে মুখে। এতে ড্রাইভিংয়ে কনসেন্ট্রেশনে বাঁধা সৃষ্টি করছে। এ-তো মস্তবড় অন্যায়। অথচ অন্যায় কারী ব্যক্তিটি বেশ আরাম-আয়েশিতেই আছে। বাতাসের স্পর্শে, শক্তপোক্ত কাঁধে মাথা রেখে– তিনি গভীর ঘুমে তলিয়ে গিয়েছে পুনরায়। তন্ময় ঠোঁটে ঠোঁট চেপে সুড়সুড়ি সহ্য করেই ড্রাইভ করে গেল। ড্রাইভার তন্ময়ের কনসেন্ট্রেশন ভাঙার মতন অবস্থার বুঝি শেষ নেই!
অরুর গভীর ঘুম ভাঙল ঠিক ঘন্টাখানেক পর। তখন প্রায় এগারোটা ত্রিশ। দ্বিতীয় দফায় তন্দ্রা ভাঙতেই আধবোজা চোখে চেয়ে শুধাল,
‘কয়টা বাজে, তন্ময় ভাই!’
তন্ময় একপল হাত ঘড়িতে চাইল। ফের চোখ তুলে আয়নাতে দৃষ্টি ফেলল। আয়নায় প্রতিচ্ছবি হওয়া মুখটুকু দেখে জানাল,
‘এগারোটা পঁয়ত্রিশ।’
জবাবে অরু নাকমুখে ‘হুম’ ধ্বনি তুলল। আড়মোড়া ভঙ্গিতে সোজা হয়ে বসল। মাথা সহ কাঁধটা ব্যথা হয়ে গিয়েছে তার। কাঁধে মস্তবড় বস্তা ছিল যেন। সমানে মাথাটা এদিক-ওদিক ঘুরিয়েফিরিয়ে ব্যথা দূর করবার প্রচেষ্টা। তন্ময় জিজ্ঞেস করল,
‘বেশি ব্যথা করছে?’
প্রশ্নটি বোধহয় অরুর ভালো লাগল। ঠোঁটে মৃদু হাসি নিয়ে–সে ত্বরিত প্রশ্নের জবাবে প্রশ্ন ছুঁড়ল, ‘হ্যাঁ বললে কি মালিশ করে দেবেন?’
তন্ময় আশ্চর্য অথবা হতভম্ব হলো না। বরঞ্চ প্রশ্নটির জবাব সে কণ্ঠ খাদে নামিয়ে ভ্রু তুলে দিলো, ‘করতে দিবি?’
অরু বুঝি আসমান হতে জমিনে পড়ল? অবিশ্বাস্য হৃদয়ে আর বিস্ফোরিত চোখে চাইল তন্ময়ের মুখে। নির্বাক চোখে কয়েক মুহূর্ত দেখল একচিত্তে। অদেখা হিসেব-নিকেশ কষল যেন। তারপর ভদ্রভাবে দৃষ্টি ঘুরিয়ে ফেলল নিজের দিকের জানালার বাইরে। তন্ময় না চেয়েও সবটাই দেখল। গাল ভরে হাসল শব্দহীন ভাবে। হাসিটুকু মুখে লেগে থাকল দীর্ঘসময়। মেইন রোড পেরিয়ে গাড়িটা নির্জন রাস্তা ধরতেই; অরু এযাত্রায় মুখ খুলে বলল,
‘খিদে পেয়েছে। গাড়িটা থামান। খেয়ে নিই আগে।’
তন্ময় সহমত হলো। তা মাথা দুলিয়ে বোঝাল। নিরিবিলি জায়গা দেখে গাড়ি থামাল। চোখের সম্মুখে দীর্ঘ জায়গা জুড়ে চাষের জমি। দুজন নেমে হাতমুখ ধুয়ে নিয়ে পুনরায় গাড়িতে উঠে বসল। প্যাকড করা বক্স থেকে একেএকে সবগুলো বাটি বের করল অরু। ঢাকনা খুলতেই ঘ্রাণে ম-ম করল চতুর্দিক। ঘ্রাণ টেনে নিয়ে খেতে শুরু করল চটপট। ওর পছন্দের খাবারের বাটিগুলো রেখে অন্যসবে হাত বাড়াল তন্ময়। যেসব মহারানির পছন্দ নয়– সেসবই তার পেটে গেল। তৃপ্তি নিয়ে খাওয়া-দাওয়া শেষ করল। গাড়িটা পুনরায় স্টার্ট করবে এসময় অরু বলল,
‘কফি খেয়ে নেন আগে!’
অরু দুটো ফ্লাস্ক বের করল। একটাতে তারজন্য চা আরেকটায় গরম পানি। এই ফ্লাস্কে বারো ঘন্টা পানি-চা গরম থাকে। যখন গরম পানি ঢালল মগে-তখন রীতিমত টগবগ করে ধোঁয়া উঠছিল।
ওয়ান টাইম কফির প্যাকেট ছিঁড়ে মগে ঢেলে দিলো। চামচ দিয়ে নেড়েচেড়ে এগিয়ে ধরল।
তন্ময় স্থির চোখে এই ব্যস্ত অরুকেই দেখছিল।
এগিয়ে ধরা মগটা এযাত্রায় নিলো। অরু পিনপতন নীরবতায় নিজের চা-টা নিয়ে খেতে ব্যস্ত। সে দিব্যি চা পান করতে নিয়ে মন্তব্য ছুঁড়ল,
‘প্রকৃতির জাদু দেখতে-দেখতে চা খাওয়ার মজাই আলাদা।’
তন্ময় দ্বিমত করল না। কফিটা সে বেশ সময় নিয়ে খেলো। কফি এতটা অনুভব করে সে কখনো খেয়েছে বলে মনে হলো না।
চট্রগ্রাম পৌঁছাতে-পৌঁছাতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল।
শান্তস্থির বিকেলবেলার আসমান জুড়ে তখন পাখিদের আসা-যাওয়া চলছে। এদিক-ওদিক নদীজলের দর্শন মিলছে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাস্তা ধরেছে তাদের গাড়ি। এতক্ষণ যাবত বন্ধ করে রাখা ফোনটা তন্ময় এযাত্রায় খুলল। খুলতেই একের পর এক মিসডকলের উচ্চধ্বনিতে মুখরিত গাড়ির ভেতরটা। লাস্ট মিসডকল এসেছে ম্যানেজার সুমন থেকে। তন্ময় তাকেই কল ব্যাক করল সর্বপ্রথম। ব্লুটুথ কানে গুঁজল। ফোনটা হুইলের পাশে রেখে সড়কপথে দৃষ্টি ফেলল। ‘রেডিসন ব্লু’ হোটেলটি অদূরেই। তারা প্রায় পৌঁছে গিয়েছে। ম্যানেজার সুমন এক রিংটোনেই কল রিসিভ করেছে। তন্ময় জানাল তারা পৌঁছেছে। সে কোথায়? সুমন প্রত্যুত্তরে জানাল সে হোটেলেই। পার্কিং এড়িয়াতে এক্ষুনি আসছে। গাড়িটা মডার্ন রাজকীয় রেডিসন ব্লু-য়ের দোরগোড়া হয়ে সদর দরজা পেরিয়ে ঢুকল। পার্কিং এড়িয়াতে আসতে মিনিট খানেক লাগল। দেখা গেল সুমনকে। যে ইতোমধ্যে দাঁড়িয়ে। গায়ে সাদা রোব্ পরে আছে। পায়ে সাদা স্লিপার্স। অরু এভাবে তাকে দেখে হেসে ফেলল। হাসিতে দুলছে তার শরীর। গাড়ির ভেতরে বসেই হাসতে-হাসতে শুধাল,
‘আঙ্কেল, এভাবে চলে এসেছেন যে!’
সুমন বেশ লজ্জা পেয়েছে। লজ্জায় হাঁসফাঁস করছে। মাঝবয়সী তার এহেন পোশাক মানায় নাকি! সে তো ভেবেছে স্যার আসবে রাতে। সারাদিন অপেক্ষা করে যখন দেখল আসছে না, তাই কেবলই গোসল নিতে গিয়েছিল। ভেবে রেখেছিল গোসল সেরে নরম বিছানায় টানটান হয়ে একটি গাঢ় ঘুম দেবে। কে জানতো তার গোসল নেবার সময়টাতেই চলে আসবে? দীর্ঘশ্বাস ফেলে লজ্জাসংকোচ সরিয়ে এগুল সে। ল্যাগেজ বের করল। তন্ময় গাড়িটা পার্ক করে বেরুল। চাবিটা সুমনের হাতে ধরিয়ে দিলো। অরু নিজেও বেরিয়েছে এসময়। সুমনকে দেখে মিটিমিটি হাসছে।
‘ভালো আছেন, আঙ্কেল? আপনাকে কিছুদিন না দেখে মনে হচ্ছে আরও ইয়ং হয়ে গিয়েছেন।’
সুমন আড়চোখে তন্ময়ের মুখ দেখে ভদ্রসভ্য গলায় রয়েসয়ে বলল, ‘ভালো আছি, আলহামদুলিল্লাহ্। ধন্যবাদ, মামণি। তুমি কেমন আছো?’
‘আলহামদুলিল্লাহ্।’
তন্ময় ল্যাগেজ একটা ডান হাতে টেনে নিয়ে–বামহাতে অরুর হাত ধরল। নিজের সাথে তালে-তাল মিলিয়ে নিতে-নিতে সে সুমনের সঙ্গে কথায় ব্যস্ত। রিসিপশনে এসে অনলাইন বুকিং দেখাতে হলো। চাবি হাতে তাদের সঙ্গে একজন লেডিস এলো। তৃতীয় তলায় তাদের স্যুট। সেখানে পৌঁছে দিয়ে গেল। চাবি হাতে ঢুকল তারা বিলাসবহুল স্যুটের ভেতরে। যেখানে ফ্লোর হতে সিলিঙ ধরে উইন্ডোস।
‘লাক্সারিয়াস স্যুট’ এই নামেই সম্বোধন করা হয় ‘রেডিসন ব্লু-য়ের’ এই রাজকীয় ঘরটিকে। দুটো বেডরুম সঙ্গে এটাচড বাথরুম। সাথে বিভিন্ন সুযোগসুবিধাও রয়েছে। চারপাশের একেকটি উইন্ডোজ জমিন হতে সিলিঙ পর্যন্ত হওয়ায়– শহুরে ব্যস্ত পথঘাটের দেখা মিলছে অবলীলায়। পশ্চিমের জানালার সামনে দাঁড়ালে; চোখে এসে ধরা দিচ্ছে পরিষ্কার চকচকে নীল পানির সুইমিংপুল। তন্ময় একা এলে সাধারণ ভাবেই দুটো রুম বুকড করে। একটিতে সে এবং অন্যটিতে তার ম্যানেজার সুমন থাকে। তবে অরু যেহেতু সঙ্গে এসেছে, স্যুট নেয়াটা বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ও একা একটি রুমে থাকতে পারবে না– ভয় পাবে। আবার সে ওকে একা একটি রুমে দিয়েও শান্তি পাবে না–মন আনচান করবে। নিশ্চিন্তে ঘুমুতে পারবে কী-না সন্দেহের বিষয়। আবার একই স্যুটে থাকাটা আতঙ্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এভাবেই সে অত্যন্ত অধৈর্য হয়ে গিয়েছে।
আজকাল নিজের ওপর তার বিন্দুমাত্র আস্থা নেই। ভীষণভাবে সে অরুকে ভয় পায়। ভয় পায় ওর একেকটি ভাবভঙ্গিকে। ওর শরীরের একেকটি অঙ্গ অনিচ্ছুক ভাবেই তাকে জানিয়ে দেয় ওর মতামত–ও ঠিক কী চাচ্ছে, ও ঠিক কী ভাবছে! এতে বরাবরের মতন; একশো এক ডিগ্রিতে উঠে আসে তন্ময়ের শরীরের তাপমাত্রা। এযাত্রায় তার মনে হচ্ছে, মোস্তফা সাহেবের দুশ্চিন্তা অযথার্থ নয়। ভদ্রলোক সঠিক পথেই সন্দেহের বাণ ছুঁড়েছেন। তন্ময় অনুতপ্ত বড়ো। তার উচিৎ হয়নি অরুর মুখ দেখে গলে যাওয়া। গলে গিয়ে ওর কথা শোনা। আরও উচিৎ হয়নি আগুনকে আপ্যায়নের সঙ্গে ঘরে তোলা।
ফোরকাস্ট জানাচ্ছে, রাত সাতটা ধরে বৃষ্টি হবে। সম্ভাবনা এইট্টি নাইন পার্সেন্ট। তীব্র! আকাশ ইতোমধ্যে ঢাকঢোল পিটিয়ে জানাচ্ছে, সে দৃঢ়ভাবে দুঃখী। যেকোনো সময় অঝোরে কেঁদে ভাসাবে নগরীয়। বাইরে বাতাস ছুটেছে প্রবলবেগে। উড়নচণ্ডী হয়ে তাণ্ডব শুরু করেছে গাছেদের দলবল। খণ্ডে খণ্ডে বিভক্ত কালো মেঘ
আঁধারে আসমান জুড়ে। ভাগ্যক্রমে তারা ভোরের দিকে রওনা হয়েছিল! তাইতো সন্ধ্যার আগেই হোটেলে উঠতে পেরেছে। নাহলে আজ বৃষ্টির মধ্যেই আটকে পড়তে হতো।
অশালীন- অপ্রস্তুত কাপড়ে আবৃত সুমনকে দেখে অরু মিটিমিটি হাসছে। হেসেহেসে সে এটা-ওটা নিয়ে নানান প্রশ্ন করে যাচ্ছে। তন্ময় সেই হাসিমুখটুকু খেয়াল করে- ভ্রু তুলে তাকাল সুমনের দিকে। অসন্তুষ্টি তার মুখ জুড়ে লেপ্টে। ভদ্রলোককে মাথা থেকে পা-পর্যন্ত দেখে ভ্রুদ্বয় কুঁচকে বসল। নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল,
‘ল্যাগেজ রাখুন। আপনি গিয়ে আগে কাপড়চোপড় চেঞ্জ করে ফেলুন।’
সুমন যেন এতক্ষণ যাবত এই আদেশের আশাতেই ছিল। প্রাণপাখি হাতে পেয়েছে এমন ভঙ্গিতে, ‘জি’ উচ্চারণ করেই ছুটে বেরিয়ে গেল। অরু তার যাওয়ার ভঙ্গিমা দেখে এবার উচ্চস্বরে হেসে উঠল। এত প্রাণবন্ত হাসির মানে কী? এমন ছোটো বিষয়ে এত হাসার কী আছে? তন্ময় বুঝে পেলো না ওর অষ্টাদশী মস্তিষ্ক। ওর প্রফুল্লতাকে এড়িয়ে সে শুধাল,
‘কোন বেডরুম চাই?’
এহেন প্রশ্নের সম্মুখীন হতেই, অরু থমকাল। বিমুঢ় হলো। যেন এই প্রশ্ন আশা করেনি। তাহলে কী আশা করেছিল? তারা একই রুমে শোবে? তন্ময় নিজের লম্বা নাক অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে ছুঁলো। নিজের অশালীন ভাবনাচিন্তাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে–অন্যদিক দৃষ্টি ফেলে পুনরায় একই প্রশ্ন করল। অরু ঠোঁটে ঠোঁট টিপল। বোধহয় কিছু অদেখা হিসেব-নিকেশ কষছে। কষাকষি শেষ করে ছুটল বেডরুম দুটো দেখতে। বিচক্ষণ নজরে ঘুরেফিরে রুম দুটো দেখে সে বারান্দা যুক্ত বেডরুম বেছে নিলো। তন্ময় বোঝবার ন্যায় মাথা দোলাল। হাতের সামনে পাওয়া ল্যাগেজটি টেনে নিয়ে পরিত্যক্ত বেডরুমে ঢুকল। দরজা লাগাল ত্বরিত। লম্বাটে শ্বাস ফেলল। নীরবতায় অশান্ত মস্তিষ্ক শান্ত হলো। গিয়ে দাঁড়াল নীল কাঁচের জানালার সম্মুখে। বাইরেটা কিছুক্ষণ নিশ্চুপ দেখল। ঘড়ির কাঁটা ঘুরছে পাঁচটা ত্রিশে। গোসল নেয়া প্রয়োজন একটি। এতে আরামবোধ হবে বেশ। ভেবেই –ল্যাগেজটি গোছানো শুভ্র রঙের বিছানায় তুলল। এবং মুহূর্তে খেয়াল করল এটি তার ল্যাগেজ নয়। মহারানি ভিক্টোরিয়ার ল্যাগেজ। এমন জাঁকজমকপূর্ণ ল্যাগেজ তার হয় কীভাবে? চোখ কোন দেশে রেখে এটাকে নিজের ভেবে এনেছে? চোখবুজে তপ্ত শ্বাস ফেলল আরেকদফায়। ল্যাগেজ নিয়ে বেরুল রুম ছেড়ে।
অরুর রুমের দরজা আধখোলা।
ও কোনোকালেই নিজের রুমের দরজা লাগায় না। ও লাগায় না বিধায় তাকে সর্বদাই সতর্কতার সহিত দরজায় সিটকানি তুলে রাখতে হয়েছে।
এযাত্রায় তন্ময় কেবলই হাত উঠিয়েছে দরজায় করাঘাত করবে বলে– সেমুহূর্তে অবিশ্বাস্য একটি দৃশ্য দেখে হাতটি স্তম্ভিত হলো। আশ্চর্য বনে গেলো সে। মুখটা তার পরমুহুর্তেই নীল হয়ে এলো। অরু ইতোমধ্যে তার ল্যাগেজ খুলে ফেলেছে। হাতে ওর কালো বক্সার্স। অন্যভাবে বলতে গেলে তার আন্ডারওয়ের। সেটিকে চোখের সামনে তুলে ঘুরিয়েফিরিয়ে দেখছে। আশ্চর্য! এটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নিখুঁত চোখে দেখার কী আছে? তন্ময় ভাষাহীন হয়ে পড়ল। বিনাবাক্যে ততক্ষণাৎ দরজা ঠেলে ঢুকল। অরু আতঙ্কিত হলো। ওর হাত ফসকে মহামূল্যবান বস্ত্রটি ফ্লোরে পড়ে গেল। চমকেছে ভালোভাবেই। কেমন হাঁসফাঁস করছে। সেদিকে বেশিক্ষণ নজর রাখল না তন্ময়।
সে ঝড়ের গতিতে তুলে নিলো বস্ত্রটি। সেটিকে ল্যাগেজে ভরল। ল্যাগেজের চেইন লাগিয়ে, ল্যাগেজ টেনে বেরিয়ে এলো। নিজের বেডরুমে ফিরে দরজা লকড করে ফেলল। কপালে আঙুল ঘষে সে বিভ্রান্তিতে পড়ল। পুনরায় কঠিন ভাবে অনুতপ্ত অনুভব করল। আজকের রাতটা চোখের পলকে কেটে গেলে কেমন হয়? এখুনি রাতটা কেটে যাক। যাক, যাক– যাক।
কলিংবেল বেজে উঠেছে। তখন তন্ময় সবেমাত্র গোসল নিয়ে বেরিয়েছে। পরনে ট্রাউজার আর টি-শার্ট। ভেজাটে চুলগুলো মুছতে নিয়েই, তোয়ালে হাতে বেরিয়ে এসেছে রুম ছেড়ে। অরু দাঁড়িয়ে আছে অপ্রস্তুত হাবভাবে। তখনকার জন্য লজ্জিত বোধহয়। চোখে চোখ রাখছে না। ইতস্তত কণ্ঠে মিনমিনে সুরে বলল,
‘সুমন আঙ্কেল এসেছেন হয়তো।’
তন্ময়ের হাসি পেলো। ঠোঁটে ঠোঁট পিষে হাসিটুকু গিলে নিলো সযত্নে। একপল ওই লজ্জিত মুখটুকু দেখে এগুল দরজার দিকে। দরজা খোলার পূর্বে দেখে নিলো কে এসেছে! বাইরে ম্যানেজার সুমন। এবার ভদ্রলোক পরিপাটি পোশাকে তৈরি হয়ে এসেছে। তন্ময় দরজা খুলে দিলো। সুমন প্রফুল্ল গলায় শুধাল,
‘স্যার, খেতে নামবেন নাকি রুম সার্ভিস ডাকব?’
তন্ময় মাথা ঘুরিয়ে অরুর মুখপানে চেয়ে, ভ্রু তুলে ইশারায় জানতে চাইল ওর মতামত। অরু ইঙ্গিত বুঝে ভেবেচিন্তে নিজের মতামত জানাল,
‘নিচে গিয়ে খেয়ে আসি? হোটেলটা ঘুরেফিরে দেখা হয়ে যাবে।’
সুমন এতে খুশিই হলো। একসাথে খাওয়া যাবে। এভাবেই সে ভীষণ রকমের ক্ষুধার্ত। খুশি জাহির করতে উচ্চকণ্ঠে বলে উঠল, ‘চলো মামণি। তুমি তৈরি?’
অরু আঙুল দেখিয়ে পাঁচ মিনিট বুঝিয়ে ছুটল নিজের রুমে। তন্ময় ক্ষণিক সময় ধরে চেয়ে থাকল সুমনের মুখপানে। এতে সুমন ভড়কাল;থমকাল। সে আবার কী করল? বস এভাবে চেয়ে আছে কেন? অদ্ভুত! অরুর গুনেগুনে ছয়’মিনিট লাগল। ওর হতেই তিনজন বেরুল স্যুট ছেড়ে। সিঁড়ি বেয়ে পৌঁছাল খাবার পরিবেশনকারী জায়গায়। লম্বা করে একেকটি খাবার সাজিয়ে রাখা। অরু ঝটপট প্লেট হাতে তুলে নিলো। মন মতন যা ইচ্ছে একে-একে তুলে নিচ্ছে প্লেটে। সুমন সে দৃশ্য দেখে ঢোক গিলল। খিদেটা বাড়ল বলে! অন্যদিকে তন্ময় মেরুদণ্ড সোজা করে একচিত্তে দাঁড়িয়ে। খিদেটিদে কী তার লাগছে না? বস নড়ছে না, প্লেট তুলে খাবার নিচ্ছে না–বসকে ফেলে সুমন তো পারছে না এগুতে। পারলে আগে-আগে খাবার বেড়ে খেতে শুরু করত। যতই হোক টাকাগুলো তার বসের পকেট থেকে যাবে। লোভ সামলে দাঁড়িয়ে রইল।
তন্ময় দেখছিল চঞ্চল অরুকে। সুমনকে খেয়াল করল মিনিটখানেক পর। গলা পরিষ্কার করে বলল,
‘খেয়ে নিন।’
সুমন ক্ষুধার্ত পেট নিয়ে ধৈর্যশীলতার পরিচয় দিলো, ‘স্যার, আপনি?’
তন্ময় বিরসমুখে বলল, ‘আপনি খেতে শুরু করুন।’
সুমন আর ভদ্রতা দেখাল না। প্লেট হাতে ছুটল খাবার নিতে। অরু ইতোমধ্যে পছন্দের সব খাবার প্লেটে তুলে নিয়েছে। খাবারে ভর্তি প্লেটটা এগিয়ে এসে তন্ময়ের হাতে ধরিয়ে দিলো। আরেকটি প্লেট নিয়ে এগুল নিজের জন্য নিতে।
ঘুরেফিরে, রাতের খাবার খেয়ে স্যুটে ফিরতে-ফিরতে ঘড়ির কাঁটা ঘুরছে এগারোটা ত্রিশে। বাইরে তখন ঝোড়ো–তীব্র বর্ষণ। অরু প্রধান ফটকে ঠিক বড়ো কাঁচের দেয়ালের সম্মুখে দাঁড়িয়ে–বাইরের উথালপাতাল বৃষ্টি দেখছে মুগ্ধনয়নে। বৃষ্টির প্রতি ওর অত্যধিক প্রেম। বাজেরকম ভাবে ভালোবাসে বৃষ্টিকে। ওর চোখ কথা বলে বৃষ্টি দেখলেই। এইযে কেমন চিকচিক করছে কালো মণিযুগল। তন্ময় নির্নিমেষ চোখে অনেকটা সময় ধরে দেখল সেই দৃশ্য। সম্মোহন হবার মতন গুড়িগুড়ি পদচারণে এগুতে থাকল অরুর দিকে। কিছু কদম গিয়েই থমকাল হঠাৎ। মস্তিষ্ক নড়বড়ে হলো যেন। সজাগ হলো দৃষ্টি। ত্বরান্বিত পিছু ফিরে এলো। অরু মুগ্ধ গলায় বলল,
‘তন্ময় ভাই, দেখুন এখান থেকে কী সুন্দর দেখতে লাগছে সবকিছু! বৃষ্টি ভিন্নরূপ নিয়েছে আজ।’
তন্ময়ের কপালের নীল রগ ফুঁলেফেপে উঠছে। বুকের ভেতরটা কেমন যেন করছে। শিরা-উপশিরা বেয়ে ঘাম ছুটছে। সে আলগোছে, বিনাবাক্যে নিজের বেডরুমের দিক পা বাড়াল। অরু মাথা ঘুরিয়ে পুনরায় ডাকল,
‘তন্ময় ভাই?’
তন্ময় ঢোক গিলল। কণ্ঠ গম্ভীর করে ধমকের সুরে বলল, ‘কয়টা বাজে? নিজের রুমে যা! এক্ষুনি গিয়ে ঘুমোবি।’
অরু কিংকর্তব্যবিমূঢ়! শান্তশিষ্ট মানুষটা হঠাৎ করে চটে গেল কেন? আশ্চর্য! অরুর অভিমান হলো। ধমক খেয়ে বৃষ্টি আর ভালো লাগল না। মুখ বেঁকিয়ে হুড়মুড়িয়ে নিজের রুমে চলে গেল। ওর যাওয়া দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলল তন্ময়। ওর এতক্ষণ ধরে দাঁড়ানোর জায়গাটিতে সে এসে দাঁড়াল। দৃষ্টিপট গিয়ে ঠেকল রিমঝিম বর্ষণমুখর নগরীয়তে। দীর্ঘসময় একচিত্তে অন্যমনস্ক হয়ে দেখল একইভাবে। পেছনে কারও অস্তিত্ব অনুভব করল। মাথা একপাশে ফিরিয়ে চাইল। অরু ভ্রুদ্বয় কুঁচকে, দুগাল ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তন্ময় যেন ওর অভিমান দেখেনি; পূর্বের চেয়েও কঠিন গলায় ধমকে উঠল,
‘বললাম না রুমে যেতে? রুম থেকে একপা বেরুলে পা ভেঙে ফেলব। যা ভেতরে!’
অরুর চোখজোড়া মুহূর্তে টলমল করে উঠল। রক্তিম হয়ে এলো। ফুঁলেফেপে উঠল নাকের পাটা। তন্ময়ের চোখে চোখ রেখে, সমান তালে চোখ রাঙিয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
‘যাব না।’
তন্ময় অসহায় ওর সামনে। দিশেহারা সে চোখবুজে শ্বাস টেনে নিলো। শ্বাসরুদ্ধকর হৃদয়ের বেগতিক অবস্থা অনুভব করল। অরুর দিকে না চেয়ে সোজা নিজের বেডরুমে ফিরে এলো। দরজা লাগাল। বিছানায় বসল দু’পা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। মাথাটা দু’হাতে ঢেকে বসে থাকল। নিজেকে সমুদ্রের ন্যায় শান্ত করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা। সে-মুহূর্তে হঠাৎ করেই উজ্জ্বল রুম আঁধারে ঢেকে গেল। এটাই বুঝি হওয়া বাকি ছিল? তার সঙ্গে কী মশকরা হচ্ছে? রাগে তন্ময়ের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। তার সবথেকে বড়ো ভুল হয়েছে, চট্রগ্রামে আসা। হৃদয় আতঙ্কে– উত্তেজনায় দুমড়েমুচড়ে উঠছে। নিজেকে যে আটকে রাখবে তার উপায়ও যে নেই! অরুটা অন্ধকার ভয় পায়। তন্ময় দ্রুত উঠে দাঁড়াল। অন্ধকারেই দরজা খুলে বেরুল। অরুর ডাক ভেসে আসছে। ভয়ার্ত গলায় ডাকছে। তন্ময় ধীর স্বরে আশ্বস্ত করতে জানাল,
‘এইযে আমি। ভয় লাগছে?’
অরু যেন নিজের প্রাণপাখি হাতে ফিরে পেয়েছে। স্বস্তির শ্বাস ফেলে বলে, ‘হুঁ। ফোনের ফ্লাশলাইট ওন করেন না।’
তন্ময় ট্রাউজারের পকেট ছুঁয়ে অনুভব করে সেলফোন নেই। হয়তো রুমে আছে। সে অরুর আবছায়া দেখে বলে, ‘দাঁড়া, নিয়ে আসছি।’
অরু চিৎকার করে ওঠে, ‘না– একদম যাবেন না। আমি সঙ্গে যাব।’
তন্ময় অনুভব করে তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পাথর বনে গিয়েছে। সচল মস্তিষ্ক এযাত্রায় অসচল হয়ে এসেছে। ধড়ফড় করছে অন্তর। কাছ থেকে উপলদ্ধি করছে অরুর নিশ্বাস, ওর শরীরের মিষ্টি গন্ধটা। কোন ফুলের ঘ্রাণ এটা? এত মাদকতাপূর্ণ সেই ঘ্রাণ! নেশার মতন কাজ করছে। তাকে আকৃষ্ট করছে। তীব্রভাবে টেনে নিতে চাচ্ছে। তাকে নেশার সমুদ্রের গভীরে নিতে, অরু এগিয়ে এলো কাছাকাছি। একদম পাশে। গা ছুঁইছুঁই দুজনের। অরু আকুতি ভর্তি গলায় বলল,
‘চলুন।’
তন্ময় যেন সেই কণ্ঠটি শোনেনি। একইভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। অরু সন্দেহজনক গলায় ডাকে, ‘তন্ময় ভাই?’
আঁধারে আবছায়ায় চোখে চোখ পড়ে দুজনের। তন্ময় গভীর চোখে অদেখায় দেখে অরুর থমকানো মুখ। অপ্রস্তুত বদন। হেলেদুলে কয়েকপা পিছু চলে যাওয়া। সেই মুহূর্তে তন্ময়ের মণি জোড়াতে শুধু প্রিয়তমার প্রতিচ্ছবি। প্রেয়সীর নেয়া একেকটি ভাবভঙ্গি। অবলীলায় কাজ করে বসল তার পাজোড়া। যা ইতোমধ্যে এগিয়ে যাচ্ছে নিজ গতিতে। যতক্ষণ না দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে অরু থেমেছে– ততক্ষণ সে এগিয়ে গিয়েছে। নিজের পেটানো শরীর দ্বারা ঢেকে ফেলেছে অরুর ছোটোখাটো দেহ। পেশিবহুল হাত দুটো ঠিক ওর মাথার দুপাশে। আঁধারে আবছায়া মুখটা অনুভব করতে হাত বাড়াল তন্ময়। ছুঁয়ে দিলো ওর মুখ। শীতল হাতের স্পর্শে অরু কেঁপে উঠল। দেয়ালের সঙ্গে পরিপূর্ণ ভাবে লেপ্টে গেল। ঢোক গিলল ছোটো করে। মুখ খুলল, কিছু বলার জন্য। ততক্ষণাৎ তন্ময়ের আঙুল এসে ঠেকল তার ঠোঁটে। বড়সড় হয়ে এলো অরুর চোখজোড়া। তন্ময় বৃদ্ধা আঙুল দিয়ে তার ঠোঁট চেপে ধরল। মাথাটা নুইয়ে নিলো সমানতালে। আঁধারে ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা প্রেয়সীর মুখ দেখবার। ঘোর লাগানো কণ্ঠে সে বিড়বিড়িয়ে বলল,
‘তোর ঠোঁট ছুঁয়ে আমি মর তেও রাজি।’
শাহজাহান তন্ময় পর্ব ৩৯+৪০
অরু সেই অচেনা-অজানা কণ্ঠে তিরতির করে কেঁপে ওঠে। সংকীর্ণ হয় হৃদয়। পরমুহুর্তেই একজোড়া শীতল ঠোঁট চূর্ণবিচূর্ণ করে তোলে তার পৃথিবী। ঝোড়ো বর্ষণের সমানতালে ঘনিষ্ঠ হতে থাকে ওষ্ঠেদ্বয়ের ছোঁয়া। নিবিড় স্পর্শের ঘোরে সবকিছু কল্পনাজল্পনায় আচ্ছন্ন যেন। সেই কল্পনার জগত ভেঙে একজোড়া পুরুষালি হাত তাকে নিবিড়ভাবে জাপ্টে ধরে। কানের কাছটায় ঠোঁট আনে। তার দেহের নড়চড় থামাতে গভীর কণ্ঠে বলে ওঠে,
‘জান! নড়ে না— প্লিজ।’
