শাহজাহান তন্ময় পর্ব ৪৩+৪৪

শাহজাহান তন্ময় পর্ব ৪৩+৪৪
Nabila Ishq

অরু মৃদু স্বরে গোঙাল। তীব্র প্রচেষ্টা করে চলেছে এই অসহ্যকর অনুভূতি হতে লুকোতে। তবে লুকোনো কী সম্ভব? আবেদনময়ী এই রাতের নির্জন আঁধারে ঘটিত অঘটন থামাতেই বুঝি ঘর আলোকিত হয়ে উঠল! বিদ্যুৎ যেমন আচমকা গিয়েছে–তেমন হঠাৎ করেই ফিরেছে। বিদ্যুতের সঙ্গে ফেরে তন্ময়ের ভাবনাচিন্তার বোধটুকু। সচল হয় মস্তিষ্ক। তার আবরণশূন্য পেশিবহুল শরীরের নিচে চাপা পড়ে থাকা; ফর্সা আধঢাকা দেহ খানা বিদ্যুতের সাদা আলোতে এবার সু’স্পষ্ট। অরুর মেদহীন কোমরে তার একটি বলিষ্ঠ হাত এখনো রয়েছে। অন্যটি অরুর হাত দুটো শক্ত করে ধরে আছে। ওকে সম্পূর্ণ ভাবে, দৃঢ়ভাবে নিজের কাছে বন্দি রেখেছে। বিড়ালছানার মতন অসহায় অরু বিদ্যুতের আলোতে এবার– লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছে। কান ধরে গলা রক্তিম হয়ে এসেছে।

মুহূর্তেই তন্ময়ের উত্তেজনায় জর্জরিত শরীর আসাড় হয়ে আসে। এক ঝটকায় জাপ্টে বন্ধ করে নেয় দু’চোখের পাতা। ব্যাকুলভাবে অনুভব করে অরুর কম্পমান অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। বাইরে তখনো বর্ষিত হচ্ছে অদরকারি বর্ষণ। তন্ময় ততক্ষণাৎ ওঠে দাঁড়ায়। একমুহূর্তের জন্যও দাঁড়ায় না। অশালীন ভাবে; দ্বিতীয়বার না চেয়ে–চোয়াল শক্ত করে চোখমুখ বুঁজে, কয়েক কদমে ঢুকে পড়ে নিজ কক্ষে।
শব্দ করে দরজাটা বন্ধ করে। দরজায় সুঠাম পিঠ লেপ্টে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রয়। হৃদপিন্ড তিরতির করে কাঁপছে তখনক। বুকের ওঠানামার গতি অস্বাভাবিক দ্রুত। ঘনঘন শ্বাসপ্রশ্বাস ফেলে নিজেকে ধাতস্থ করে নেবার অসীম চেষ্টা।
এতটা অসহায় বোধহয় এই প্রথম লাগছে তার।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

এমন একটি বিশ্রীরকমের কাজ করে সে পালিয়ে এসেছে? তার অরু নিশ্চয়ই কষ্ট পেয়েছে? ওকে ওভাবে ফেলে এসেছে ভাবতেই রাগে শরীরের সবটুকু উত্তেজনা হারিয়ে ফেলল। আজ যদি তার অধিকার থাকতো তাহলে কী অপরাধবোধ কাজ করতো? এতটা দ্বিধায় আক্রান্ত হতে হতো হৃদয়কে? বাবাকে দেয়া প্রতিশ্রুতিও সে রাখতে পারেনি। বিদ্যুৎ না ফিরলে সে কী করে বসতো? ভাবতেই শিরশির করে ওঠে মেরুদণ্ড। এতবড় একটি ধাপে সে চলে এসেছে। এই ধাপে পা রেখেও কীভাবে নির্লিপ্ত থাকবে? কীভাবে নিশ্চুপ রইবে? নিজেকে দমিয়ে রাখার রাস্তা তো আর নেই। তার পক্ষে আর নির্লিপ্ত থাকা সম্ভব নয়! পরিবারের সম্মতির পরোয়া করাও তার দ্বারা আর হবে না। যা হবে এবার তার ইচ্ছেতে- তার মতে।

সারারাত তন্ময় দুচোখের পাতা এক করেনি। সজাগ হয়ে চেয়ে রয় বাইরে। বৃষ্টি পোঁটলাপুটলি বেঁধে চলে যায়। কালো মেঘ সাদা হয়। চাঁদ ডুবে সূর্যোদয় হয়। সবটাই ঘটে তার চোখের সামনে। এযাত্রায় ঘড়ির কাঁটা সাতটায় থামে। তন্ময় ফোন হাতে তুলে নেয়। কল করে সুমনকে। সুমন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন তখন। ঘুম কী বসের চেয়ে বড়ো? না, একদমই নয়। সে তরিৎ উঠে বসে। কল রিসিভ করে ফোন কানে তুলে। মুখ খুলে ‘গুডমর্নিং’ টুকু শেষ করতে পারে না। তন্ময় অধৈর্য কণ্ঠে শুধায়,
‘আশেপাশে কাজি অফিস আছে?’
চমকে ওঠে সুমন। বিস্ফোরিত চোখে শূন্যে চেয়ে জিজ্ঞাসু সুরে বলে,
‘কেন, স্যার?’

তন্ময় থমথমে শক্ত গলায় বিস্ফোরণ ঘটানো কথাটি নির্বিকার ভঙ্গিতে বলে বসে,
‘আমি এইমুহূর্তে বিয়ে করব। যা যা ব্যবস্থা নেবার নিতে হবে। কী কী প্রয়োজন বিয়ে করতে–তার খোঁজ লাগান! কাজি অফিসের লোকেশন ট্র‍্যাক করুন সর্বপ্রথম। কাছাকাছি হলে ভালো হয়। যত দ্রুত সম্ভব তত ভালো। আপনি আমার কথাগুলো বুঝেছেন?’
সুমন কিংকর্তব্যবিমূঢ়। হওয়ার কথা কী নয়? এরথেকে আশ্চর্যের বিষয় দুটো হয় না। মিটিং করতে এসে বস বিয়ে করতে চাচ্ছে! ও মাই গড।

সুমন চিন্তিত, বাকরুদ্ধ। এসব যদি পরে তার বড়ো বস জানে? সুমন সবচেয়ে বেশি ভয় পায় মোস্তফা সাহেবকে! এই কাণ্ডে যদি সে হাত লাগায়া, তার হাতই কেঁটে দেবে। কেঁটে দিলেই বা কী? ছোটো বসের কথাও যে অমান্য করা সম্ভব নয়। সুমন গলায় তলোয়ার নিয়েই কোনোমতে শুধাতে চাইল,
‘হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত কেন, স্যার? কিছু কি হয়ে…’
তন্ময় অধৈর্যের সপ্তমে। ধৈর্য ফুরিয়ে গিয়েছে। অল্পও অবশিষ্ট নেই। সে তাড়াহুড়ো গলায় বলল,
‘কোনো প্রশ্ন না। বিয়ের আগে এই কথা যেন লিক না হয়। যা বললাম তাড়াতাড়ি করুন, সুমন সাহেব। আম সিরিয়াস এবাউট দিস!’

সুমন ফোনের ওপাশে মাথা দোলায়। দ্বিতীয় প্রশ্ন করার সাহস করে না। কিন্তু মনে একটি প্রশ্ন রয়েই যায়। পাত্রী কে? মনে একজনের চেহরা ভেসে উঠেছে। সেই কী? ধড়ফড়িয়ে ওঠা বুক চেপে বলে,
‘স্যার, মাত্র আধঘন্টা দিন। সবকিছু এরেঞ্জ করে ফেলব।’
তন্ময় ফোন কান থেকে নামিয়ে বিছানায় ফেলে। গোসলে ঢোকে। গোসল সেরে বেরোয় বাথরোব পরে। ভেজা চুলে দাঁড়ায় গ্লাসের সামনে। বাইরেটা উজ্জ্বল। খণ্ড খণ্ড শুভ্র মেঘ নীল আকাশ জুড়ে।
স্বচ্ছ পানির সুইমিংপুল দেখা যাচ্ছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে তৈরি হয়ে নেয়। তৈরি হয়েই ফোন হাতে তুলে নেয়। পুনরায় কল করে সুমনকে। সুমন এক রিং হতেই রিসিভ করে। তন্ময় চটপট শুধায়,
‘কতদূর?’

সুমন ত্বরিত জবাবে বলে, ‘সব রেডি। ইভেন এই সাতসকালে কাজিকে ধরেবেঁধে এনে কাজিঅফিস খুলিয়েছি। আমি এখন হোটেলের সামনে। আসছি।’
কয়েয় মিনিট পরপরই বাজল ডোরবেল। তন্ময় সেমুহূর্তে বেরোল। ঢোক গিলল। আড়চোখে চাইতেই দেখল অরু সোফায় বসে আছে। পিটপিট চোখে লজ্জিত মুখে বারংবার চাইছে। অস্বস্তি ওর একেকটা হাবভাব। তন্ময় দরজার দিক যেতে-যেতে আদেশ ছুঁড়ল,
‘রেডি হ। আমরা এক্ষুনি বেরোব।’

‘কোথায় যাচ্ছি’ এই প্রশ্ন মস্তিষ্কে নিয়েই অরু মাথা দোলাল। মনের কুঠুরিতে থাকা প্রশ্নটি করার স্পর্ধা পেলো না বোধহয়। চুপচাপ তৈরি হয়ে এলো কিছু মিনিটের মাঝেই। সুমন তৈরি হয়ে বেরুনো অরুকে দেখে আরও নিশ্চিত হলো। তার ধারণা বুঝি সঠিক হতে চলেছে? তবে দেখেশুনে যতটুকু বুঝল অরু কিছুই জানে না। নির্বোধের মতন চুপচাপ বসে আছে। নিত্যদিনের মতো চঞ্চলও আজ নেই। কিছু কী হয়েছে দুজনের মধ্যে? হলেও বা তার কী? সুমন নিজের ভাবনাচিন্তা তালাবদ্ধ করল। একচিত্তে গাড়ি চালাতে থাকল। পেছনে বসেছে তন্ময়-অরু। দুজনই চুপচাপ ভদ্রসভ্য ভাবে বসে। আজ কাঁচও তোলা। অরু বায়না ধরেনি কাঁচ নামানোর জন্য। আড়ষ্ট ভাবে বসে আড়চোখে চেয়ে যাচ্ছে শুধু। তন্ময় সবটাই না দেখেও অনুভব করল। কিছুক্ষণ পরে যেই কাহিনী ঘটবে সেটি কীভাবে মেনে নেবে অরু? ও কি ভয় পাবে?

কাজি অফিসের সম্মুখে এসে থামল গাড়িটা। তন্ময় বেরোল প্রথমে। ওপর পাশে এসে দরজা খুলে ধরল অরুর জন্য। অরু বড়ো বড়ো চোখে কাজি অফিসের সাইনবোর্ড দেখছে। আশ্চর্য হয়েই বেরোল সে। জিজ্ঞাসু চোখে চাইল তন্ময়ের দিক। সেই দৃষ্টি পরিপূর্ণ ভাবে অগ্রাহ্য করল তন্ময়। অরুর হাত ধরে স্থিরচিত্তে হাঁটা ধরল ভেতরে। কাজি অফিসের ভেতরে দুজন ঢুকল আনম্যারিড রূপে। বেরোল ম্যারিড রূপে। অরুর গলায় সুন্দর গোলাপ ফুলের মালা। তন্ময়ের গলাতেও সেটি। নিজ হাতেই দুজন দুজনকে পরিয়েছে। সুমন এবং সুমনের বড়ো ভাই সহ চেনাপরিচিত কিছু মানুষও বেরিয়ে এসেছে পিছুপিছু। তারাই ছিল পরিবার হিসেবে। বিবাহিত অরু তখনো তাজ্জব। তন্ময় তাজ্জব অরুকে গাড়িতে বসিয়ে সুমন সহ বাকিদের উদ্দেশ্যে বলল,
‘আজকের জন্য ধন্যবাদ। আনুষ্ঠানিক ভাবে বিয়েটা হলে নিশ্চয়ই দাওয়াত পাবেন।’
সুমনের বড়ো ভাই রসিকতা সুরে বলল, ‘মিষ্টি খেয়েছি তাতেই হবে।’
তন্ময় মাথা দোলায়। সালাম জানিয়ে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে বসে। বিয়েটা বেশিক্ষণ প্রাইভেট রাখা গেল না। হাওয়ার গতিতে সেখবর শাহজাহান বাড়ি পৌঁছে গিয়েছে। এবং সবকিছু নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছে ঠিক অরুর মতন। তন্ময় গাড়ি চালাতে-চালাতে প্রশ্ন করল,

‘বাসায় কী বলবি?’
অরু বোকার মতো শুধাল, ‘কী বলব?’
তন্ময় ধীর গলা শিখিয়েপড়িয়ে নেবার ভঙ্গিতে জানাল,
‘বলবি এই বিয়ে তুই স্বেচ্ছায় করেছিস। তোর ইচ্ছেতে সব হয়েছে।’
অরু পুনরাবৃত্তি করল, ‘স্বেচ্ছায় করেছি? আমার ইচ্ছেতে হয়েছে?’
তন্ময় ভ্রু তুলে বলল, ‘স্বেচ্ছায় নয় বুঝি? তুই কী আমাকে বিয়ে করতে চাস নি? আমাকে বিয়ে করার ইচ্ছে নেই?’
অরু ঘাবড়ে গেল। ভড়কে তোতলানো সুরে কোনোরকমে বলল, ‘তা কেন হবে! তা নয়। আ-আমি – আমি চা-চচ্ছিলাম।’

তন্ময় সন্তুষ্টা হলো খানিক। আদেশ দেবার মতন নির্দেশ দিলো, ‘এখনকার মতো থেমে থেমে নয়। ফ্রেশ কণ্ঠে ঝরঝর ভঙ্গিতে বলবি। তোতলানো চলবে না। বুঝেছিস?’
অরু না বুঝেও বুঝেছে বোঝাতে মাথা ঝাকাল।
তন্ময় দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তাকে আজ শাহজাহান মোস্তফা চিবিয়ে চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে নির্ঘাত! চাচ্চু কীভাবে বিষয়টা নেবে তা নিয়েও শঙ্কিত সে! ভালোয় ভালোয় সকলে মেনে নিলেই হয়।

বাড়ির ছেলেমেয়ে বিয়ে করে নিয়েছে। নিজেদের মতন; পরিবার ছাড়া। এই বিয়ে কী হয়েছে, হয় নি! মোস্তফা সাহেব মানবেন না এই বিয়ে। কখনো না। আজ এই বাড়িতে তার ছেলে থাকবে নাহলে সে থাকবে। আপাদমস্তক একটা ফয়সালা হবে এবার। তিনি বৈঠক বসাবেন। মানুষ ডাকাবেন। ছেলেকে বহিষ্কার করবেন। এই মেয়েধরা ছেলের একটা শিক্ষা হওয়া দরকার।

ফোনের ওপাশে সুমন কাঁপছে। ঠকঠক করছে পাজোড়া। প্যান্ট-টা তার একটু ভেজা-ভেজা লাগছে। অতি ভয়ে ভিজে গেল নাকি? হওয়ার সম্ভাবনা একশো এক পার্সেন্ট। প্রচণ্ড ভয়ে তার গোপন এক চাপে। মাঝেমধ্যে দুইয়ো। দুই-টা সচরাচর আসে না। তবে একটা অনায়াসেই হয়ে যায়। যেমন এখন হচ্ছে, মানে হবে-হবে ভাব। কপালেও বিন্দু-বিন্দু ঘামের চিহ্ন। শার্ট ঘামে ভিজে গায়ে লেপ্টেছে। ওপর পাশে দানবীয় কণ্ঠে তার মালিক এখনো চ্যাঁচিয়ে যাচ্ছেন। একেকটা ধমকে কেঁপে উঠছে সুমন এবং তার হৃদয়।
‘তোমাকে চাকরি থেকে আউট করব। গু লি করব। বন্দুকে বুলেট ভরে তোমার বুক ঝাঁজরা করব, স্টুপিড! মতিভ্রম হয়েছে? মনে নেই কী বলেছিলাম? আমার খেয়ে-আমার পরে আমাকেই লাথি? আমার সামনে আর আসবে না। খবরদার!’

সুমনের বুক ধড়ফড় করছে। কণ্ঠ খাদে নেমে এসেছে। মিনমিনে গলায় কোনোরকমে বলে,
‘ছ-ছোটো – ছোটো স্যার বলতে না ক…’
বাক্যটি পূর্ণতা পেলো না। কঠিনমুখে মোস্তফা সাহেব আরেকদফায় শাসাতে শুরু করেছেন,
‘স্টপ ইওর ননসেন্স। তোমাকে আমি পুলিশে দেব, সুমন। আমার খেয়ে; আমার পরে- আমাকেই ধোঁকা দেবার জন্য জেলখানাতে ঢোকাব। রিমান্ডে নেব। যতরকম মামলা দেয়া যায়– দেব। ইউ ওয়েট অ্যান্ড ওয়াচ।’
সুমনের আফসোস হচ্ছে। তার মোটেও উচিৎ হয়নি তন্ময়ের সঙ্গ নেয়া। তার কথায় ওঠবস করা। বড়ো স্যারকে জানিয়ে দিলেই ভালো হতো। একূল-ওকূল, দুকূলই সে হারিয়ে বসল। তার এখন কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু পারছে না। চোখে জল আসছে না। বুকে ছোটো-ছোটো চড় মেরে হাহাকার করল। সেমুহূর্তে ফোনে ম্যাসেজ টুন বেজে ওঠল। ফোনটা ঝাপসা চোখের সামনে তুলল। একাউন্টে পঞ্চাশ হাজার টাকা এসেছে।

কীভাবে এলো? কে দিলো? বড়ো-বড়ো চোখে ম্যাসেজটি কয়েকবার পড়ল। সেসময় একটি ম্যাসেজ এলো; এয়ারটেল নাম্বার থেকে। তার জানামতে এটি তন্ময়ের প্রাইভেট নাম্বার। ছোটো ম্যাসেজটি হচ্ছে,
‘এঞ্জয় ইওর ফ্রি টাইমস, সুমন সাহেব। বাবার সামনে কিছুদিন না গেলেই আপনার মঙ্গল।’
মেঘে ঢাকা মুখেতে এবার অলৌকিক সূর্যের দ্যুতি ছড়াল। চ্যাপ্টানো ঠোঁটে মৃদু হাসির দর্শন মিলল। ছোটো স্যারের নৌকায় চড়ে দূকুল হারিয়ে বসেনি। যাক! মিটিমিটি হেসে সে ঝটপট ম্যাসেজ করল,
‘ধন্যবাদ, স্যার।’
তারপর স্ত্রীকে কল করল। হাস্যজ্জ্বল কণ্ঠে জানাল,
‘আসতেছি আমি। আমার জন্যে ঝাল-ঝাল গোরুর মাংস ভুনা আর সাদা পোলাও রান্না বসাও।’

মোস্তফা সাহেবের চোয়াল শক্ত। তার চোখমুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। গেলেও ভয়ে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠবে নিশ্চিত। তিনি গম্ভীরমুখে; গলগল পায়ে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছেন। লিভিংরুমের নরম সোফায় বসেছেন বিচারকের মতো। ইতোমধ্যে শাহজাহান বাড়ির সবার নিকটে হাওয়ার গতিতে বিয়ের খবরটি পৌঁছে গিয়েছে।
সকলেই জানে, তন্ময় আর অরু তিন কবুল বলে বিয়ে করে ফেলেছে। এহেন সংবাদ শোনার পরে, পরিবারের একেকটি সদস্যের একেকরকম ভাবভঙ্গি–আকারইঙ্গিত। যেমন জবেদা বেগমের কথাই বলা যাক। ভদ্রমহিলা ট্রে সাজাচ্ছেন। ট্রে-তে দিয়েছেন, মিষ্টি; দু’রকমের শরবত। কেকের একপিস টুকরো। দুটো টিস্যু। ছেলেমেয়েকে পরিবারের পরম্পরাগতভাবে আপ্যায়ন করার জন্য একেবারে প্রস্তুত তিনি।

অন্যদিকে মুফতি বেগম, লিভিংরুম থেকে কাঁচের সবকিছু সরিয়ে নিচ্ছেন। তার মতে আজ ভালোরকমের ঝামেলা বাঁধবে। তর্কবিতর্ক-ঝগড়াঝাঁটি হবে। তর্কে উইনার কে হবে মুফতি বেগম জানেন। কে উইনার হবে না তাও তিনি জানেন। যে উইনার হবে না, সে লিভিংরুমের সব ভেঙে ফেলবে–এটিও জানেন। এরজন্য আগেভাগে সব সরিয়ে রাখছেন। মোস্তফা সাহেব কঠিন চোখে আপাদমস্তক ছোটো ভাইয়ের বউকে দেখে নিলেন। শিরশির করে উঠল মুফতি বেগমের শরীর। মারাত্মক ভয় পেলেন। তবুও সরানোর অভিযান বন্ধ করলেন না। দুরুদুরু কম্পমান বুকে কাঁচের ফুলদানি চেপে আলগোছে চলে এলেন।
রান্নাঘরে ফিরেই আটকে রাখা শ্বাস ফেললেন। বড়ো বাঁচা বেঁচেছেন। আড়চোখে দেখলেন ব্যস্ত জবেদা বেগমকে। নিচু গলায় সাবধান করলেন,

‘এসব রেডি করতেছেন কী বকাঝকা খেতে, ভাবি? ভাইয়া মারাত্মক রেগে আছে। এই সাজানো গোছানো ট্রে দেখলে তার হাই প্রেসার আরও হাই হবে।’
জবেদা বেগম চিন্তিত মুখে ফিরে চাইলেন। অনর্গল বলে গেলেন,
‘এরজন্য কি নিয়মকানুন মানব না? বিয়ে তো হয়েছে। তাই না? এই বিষয় তো অস্বীকার করার মতন না। আর আমার ছেলেটা অকারণে নিশ্চয়ই এমন করেনি। কারণ আছে। ও আসলেই জানতে পারব।’
মাত্রই রান্নাঘরে ঢোকা শাবিহা মায়ের কথাবার্তা শুনে মাথা দোলাল। সে তার মায়ের সাথে সহমত। তারও তাই মনে হয়। সে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানাল,

‘আজ বাদে কাল বিয়ে তো হতো? কালকের বদলে আজ হলেই বা কী? আর অরুও ভাইয়াকে পছন্দ করে। বিড়ালছানার মতো ভাইয়ার চারিপাশে ঘুরেফিরে বেরিয়েছে। আকারইঙ্গিতে সবসময় বুঝিয়েছে ও ভাইয়াকে পছন্দ করে। দুজন দুজনকে পছন্দ করে যেহেতু বিয়ে হলে আরও ভালো না?’
মুফতি বেগম সাবধান করলেন,

‘ধীরেসুস্থে বল। বড়ো ভাইয়া শুনে নিলে তোর খবর আছে। বাড়িঘর ভেঙে ফেললেও ফেলতে পারেন।’
সাবধান খানা কাজে লাগল। শাবিহা মৃদু ভয় পেলো। কণ্ঠ নামাল। ফুসুরফাসুর করে আরও কিছু মন্তব্য ছুড়ল। তবে কথা শেষ করে গেল না, রান্নাঘর থেকে গেল। মায়ের সাথে ট্রে সাজাতে হাত বাড়াল। সেসময় রুবির উপস্থিতি ঘটল। মেয়েটা দৌড়ে এসেছে। কপালে তার বিন্দু-বিন্দু ঘাম। এসিতে থেকেও সে ঘেমেনেয়ে একাকার।

গরম-গরম আশ্চর্যজনক-অবিশ্বাস্য খবরাখবর শুনেই বোধহয় এসেছে। প্রথমে সে বিশ্বাস করতে পারেনি। তবে বাসার হালচাল দেখে এবার বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছে। আজ সাংঘাতিক কিছু ঘটবে বলে আশংকাও করছে! অন্যদিক সুমিতা বেগম দিশেহারা। অভদ্রমহিলার মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে যেন! সে সিঁড়িপথে খাপটি মেরে দাঁড়িয়ে। নড়চড় নেই। জবেদা বেগম দুবার ডেকেও সাড়া পেলেন না। বড় মাপের শক পেয়েছে। পাবার কথাই। জবেদা বেগম যতটুকু জানেন, সুমিতা বেগম চাচ্ছিল তার ভাইয়ের ছেলের সাথে অরুর বিয়ে দিতে। তা কি আর সম্ভব? ওই লম্পটের কাছে তাদের মেয়ে দেবে? ইহজন্মে নয়!

আনোয়ার সাহেব অবুঝ বাচ্চাদের মতন চুপচাপ লিভিংরুমে এলেন। তার পেছনেই ওহী সাহেব। দু’ভাই মুখে কুঁলুপ এঁটে রেখেছেন। বড়ো ভাইয়ের হাবভাব দেখে; মুখে কিচ্ছুটি জিজ্ঞেস করবার সাহস পেলেন না। নার্সারির বাচ্চাদের মতো ভাইয়ের পাশে এসে বসলেন। চোখ তুলে দুজন চাওয়াচাওয়ি করে নিলেন। হাবভাব বোঝার মিথ্যে প্রচেষ্টা আরকি! সবার চোখ অগচোরে সদরদরজার দিকে রয়েছে। দরজা দিয়ে এই বুঝি তন্ময়-অরু ফিরবে। কান দুটো সকলের খাঁড়া। এই বোধহয় গাড়ির আওয়াজ কর্ণগোচর হবে।

গুনে-গুনে ঘন্টাখানেক সকলেই একইরকম ভাবে মূর্তি বনে রইল। টু’শব্দও নেই কোথাও। নীরবতা ভাঙল গাড়ির ধ্বনিতে। সেই ধ্বনিতে ধড়ফড়িয়ে ওঠে জবেদা বেগমের বুক। শান্তস্থির নেই শাবিহাও। মা-মেয়ে একবার চোখাচোখি করে নিলো। সুমিতা বেগম নীরব দর্শক মাত্র। তার মস্তিষ্ক শূন্য। জবেদা বেগম ট্রে হাতে বেরোলেন সেসময়। সজ্জিত ট্রে খানা স্ত্রীর হাতে দেখেই ফুঁলেফেপে উঠলেন মোস্তফা সাহেব। যেন কেউ তার কাঁটা গায়ে নুনেরছিটে মেরেছে। উচ্চকণ্ঠে ধমকে সুরে প্রশ্ন ছুঁড়লেন,

‘এসব কী? এগুলো দিয়ে কী হবে?’
জবেদা বেগম আমতাআমতা করলেন। জবাবে বলার মতো ভাষা খুঁজে পেলেন না। এগুনোর সাহসও সঞ্চয় করতে ব্যর্থ তিনি। জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। আড়চোখে দরজা দিকে তাকাতেই দেখলেন তন্ময় ঢুকছে। ঢুকতে ঢুকতে তন্ময় বলল,
‘ওসব রাখো, মা। পরে হবে।’

তন্ময়কে নির্বিকার দেখাল। হাবভাব সাধারণ। পায়ের গতি অত্যন্ত ধীর। অঙ্গপ্রত্যঙ্গ জুড়ে নিত্যকার তেজ। চোখমুখ শীতল সমুদ্রের মতো স্থির। বলার উপায় নেই, এই ছেলে সাংঘাতিক কাণ্ড ঘটিয়ে এসেছে। ছেলের হাবভাবে মোস্তফা সাহেবের প্রেসার দ্বিগুণ ভাবে বাড়ল যেন। আঙুল তুলে কিছু বলতে গিয়েও পারছেন না। আশেপাশে কিছু পেলেনও না ফ্লোরে ছুঁড়ে মারার জন্য। বুকটা চেপে ধরলেন।
তন্ময় লিভিংরুমে পৌঁছে সোফায় বসল আরামদায়ক ভাবে। আড়চোখে একপল অরুকে দেখে নিলো। মেয়েটা ইতস্ততভাবে এগিয়ে আসছে। চোখমুখ লজ্জায় নত। ওকে এমন বিশ্রীরকম পরিস্থিতিতে সে ফেলতে চায়নি। বাধ্য হয়ে করেছে। তার হাতপা বাঁধা পড়েছিল। দীর্ঘনিশ্বাস টেনে নিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করল বাবা-চাচাদের সামনাসামনি হওয়ার। হলোও তাই। বসতে না বসতেই মোস্তফা সাহেব শুধালেন,
‘কী শুনছি আমি?’

তন্ময় মাথা তুলল। বাবার চোখে চোখ রাখল। না বোঝার ভাণ ধরল। বিচিত্র ভঙ্গিতে ভ্রু দুলিয়ে বলল,
‘কীভাবে বলব তুমি কি শুনেছ? আমি তো পাশে ছিলাম না। দেখি বলো–শুনি।’
মোস্তফা সাহেব নিজেকে যথাসম্ভব শান্তশিষ্ট রাখার প্রচেষ্টা চালালেন। দাঁতে দাঁত পিষে বললেন,
‘ফাজলামো করতেছিস? তুই নাকি বিয়ে করছিস অরুকে?’
তন্ময় সাবলীল গলায়– দিনদুপুরে চোখমুখ খোলা রেখে মিথ্যেটা জানাল,
‘জি। ও আমাকে ভালোবাসে। বিয়ে করতে চেয়েছে। তাই আমি করেছি। আমারও মনে হয়েছে, আমার থেকে ভালো লাইফপার্টনার ওর জন্য অন্যকেউ হতে পারে না। ঠিক তো, অরু?’

আনোয়ার সাহেব সামান্য ভেবে একমত হলেন। তারও তাই মনে হয়। তন্ময়ের থেকে ভালো মেয়েজামাই হতেই পারে না। তিনি মেয়ের সম্মতি জানতে চোখ তুলে তাকালেন। অরু তন্ময়ের দৃষ্টি পেয়ে লজ্জায় আড়ষ্ট হলো। কোনোমতে মাথা দোলাল ক্রমান্বয়। ব্যস, মুহূর্তেই আনোয়ার সাহেব চিন্তামুক্ত হলেন। হেসে উঠলেন প্রফুল্ল গলায়। তবে হাসিটুকু বেশিক্ষণ স্থির থাকতে পারেনি। মোস্তফা সাহেব গম্ভীরকণ্ঠে ধমকে ওঠেন। বড়ো ভাইয়ের ধমক খেয়ে চুপ করে গেলেন আনোয়ার সাহেব। মোস্তফা সাহেব তন্ময়কে শক্ত চোখে দেখলেন। তারপর অরুর দিকে তাকিয়ে শুধালেন,

‘অরু, তুমি সত্যিটা বলবে। ওর শিখিয়েপড়িয়ে দেয়া কথা তোতাপাখির মতো বলবে না। আমি আছি তোমার পাশে। ও কিচ্ছু করতে পারবে না। বলো ও তোমাকে জোর করেছে?’
অরু কেঁদে দেবে-দেবে ভাব। ছোটোখাটো শরীরটা কাঁপছে। জবেদা বেগম এসে জড়িয়ে ধরলেন ওকে। মোস্তফা সাহেব পুনরায় গম্ভীরমুখে শুধাতেই, অরু ঠিকঠাক স্পষ্ট গলায় জবাব দিলো,
‘আমি স্বেচ্ছায় করেছি।’
তন্ময় মুগ্ধ হলো। তিরতির করে কাঁপল তার হৃদয়। প্রফুল্লতায় ভরে গেল ভেতরটা। মাথা উঁচিয়ে তাকাল বাবার দিকে। মুখটা কালো হয়ে আছে মোস্তফা সাহেবের। অরুর কথা তিনি কানে তুললেন না। উলটো আঙুল তুলে ছেলের উদ্দেশ্যে বললেন,

‘আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যা। তোর মতো অপদার্থ-র এখানে স্থান নেই।’
তন্ময় সহজসরল ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল। গম্ভীরমুখে গলা উঁচিয়ে বলল,
‘অরু, চল।’
মোস্তফা সাহেবের চোখজোড়া বড়ো বড়ো হয়ে এলো। চোখের মণি বেরিয়ে আসবে যেন! তিনি আতঙ্কিত গলায় প্রশ্ন ছুঁড়লেন,
‘ও কোথায় যাবে?’
তন্ময় অসভ্যের চূড়ান্তে গেল, ‘আমার বউ আমার সাথে যাবে না?’

উপস্থিত সকলেই হতভম্ব হলো। কিংকর্তব্যবিমূঢ় মোস্তফা সাহেব! শাবিহা-রুবিও মিটিমিটি হাসছে। আনোয়ার সাহেব মুগ্ধ হলেন। উঠে ভবিষ্যৎ মেয়েজামাইকে বুকে জড়িয়ে নিতে চাইলেন। তবে তা বড়ো ভাইয়ের ভয়ে পারলেন না। হাসিমুখে শুধু চেয়ে থাকলেন। ইতোমধ্যে মোস্তফা সাহেব দাঁড়িয়ে গিয়েছেন। আঙুল তুলে মুখ খুলেও কিছুই বলতে পারলেন না। তন্ময় সুযোগে গা ভাসিয়ে আলগোছে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে এলো। নিজের ঘরে ফিরে এসে আনমনে হাসল। আজ আর দরজাটা লাগাল না।

শাহজাহান তন্ময় পর্ব ৪১+৪২

আধভেজানো রেখেই কিছু একটা খোঁজাখুঁজি শুরু করল। শেল্ফের পেছনে পেলো; মাঝাকৃত একটি ছবির ফ্রেম। অরু আর তার এই ছবিটা পুরাতন। তখন অরু দশম শ্রেণিতে পড়ত। ছবিটা তোলা হয়েছে তাদের ছাঁদে। অরু তার পাশে দাঁড়িয়ে তার পানে কেমন মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে! তন্ময়ও মৃদু হাসছিল তখন। এমন সময় তোলা হয়েছে। তুলেছিল শাবিহা। ছবিটা এতটাই মনে ধরেছিল তন্ময়ের যে; সে সময় নষ্ট না করে– বন্ধুকে দিয়ে ততক্ষণাৎ বের করিয়ে রেখেছিল। এতদিন লুকিয়ে রাখতে হয়েছিল। এখন আর লুকোতে হবে না। এটা এবার খুব শীগ্রই তার রুমজুড়ে থাকবে। দেয়ালে রাজত্ব করতে পারবে। ছবিতে থাকা বোকা মুখটা ছুঁয়ে তন্ময় বিড়বিড়িয়ে ওঠে,
‘বাবার ভয়-শঙ্কা কখনো সত্য হবে না। আমি হতে দেব না। আমরা সারাজীবন ভালো থেকে, সুখে থেকে দেখিয়ে দেব–কেমন?’

শাহজাহান তন্ময় পর্ব ৪৫+৪৬

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here