শাহজাহান তন্ময় পর্ব ৫৯+৬০
Nabila Ishq
পুষ্পবৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির রিমঝিম ধ্বনিতে মুখরিত ঘর। বিছানার সামনেই জানালাটি। সেটি খোলা; অরুর দৃঢ় আবদারে। শীতল হাওয়া এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ।
অরু নিবিড় তন্দ্রায় আবিষ্ট। অক্টোপাসের মতন হাত-পা দ্বারা তন্ময়কে জাপটে ধরে আছে। মাথাটা শক্তপোক্ত মজবুত বক্ষঃস্থলের ওপরে। পা দুটো তন্ময়ের পুরুষালি ঊরুতে। হাত দুটো পেটের কাছটায় আদুরে ভঙ্গিতে রাখা। অন্ধকারাচ্ছন্ন কামরায় তন্ময় সজাগ। ঘুমের ‘ঘ’টুকুও যেন চোখদুটোর ভেতরে নেই। ছোটোখাটো নরম তুলতুলে শরীরের সংস্পর্শে ঘুম না আসাটাই বরঞ্চ স্বাভাবিক। তন্ময়ের চোখদুটি আঁধারে তলানো অরুর ঘুমন্ত মুখটা দেখতে উদগ্রীব। বাতি বন্ধ করা সঠিক হয়নি। ওঠে জ্বালানোর সুযোগটুকু নেই। তন্ময় অতি তুচ্ছরূপে নড়লেই অরু গুঙিয়ে আরও আষ্টেপৃষ্ঠে জাপটে ধরে। এসময় অনুচ্চস্বরে তর্কবিতর্ক সমতুল্য কথোপকথন হচ্ছে দরজার ওপারে। ফিসফিসানি সুরের কথোপকথনরত মৃদু সেই আওয়াজ কর্ণগোচর হয় তন্ময়ের। ভ্রুদ্বয়ের মধ্যিখানে ততক্ষণ ভাঁজ পড়ে পাঁচটি।
‘আরেহ ব্যাটা, ঠ্যালাঠ্যালি করিস না।’ বলতে-বলতে দ্বারে কান পাতল মাহিন। ভেতরকার অঘটিত কার্যকলাপ শুনতে উৎকণ্ঠিত। প্রগাঢ়, নিগূঢ় মনোনিবেশকারী তাকে ঠেলেঠুলে রিয়ান পাশে এসে দাঁড়াল,
‘সাইডে চাপ। শুনতে দে।’
রিয়ান কণ্ঠ খাদে নামিয়েছে। অবলীলাক্রমে কান পেতে দিয়েছে দরজায়। শ্বাসপর্ব থমকিয়ে রাখে ক্ষণিকের জন্যে। যেন নিজ শ্বাসপ্রশ্বাসের আওয়াজটুকু ভেতরের শব্দ শুনতে ব্যাঘত সৃষ্টি করবে! পেছনেই শুহানি দাঁড়িয়ে। মুখাবয়ব অনুরাগশূন্য। ছোটো-ছোটো চোখে চেয়ে চাপাস্বরে শুধায়,
‘এভাবেই থাকবি তোরা? তন্ময় বুঝতে পারলে রেগে যাবে।’
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
রুস্তম ঐকমত্য। তন্ময় ঠান্ডা মস্তকের হলেও– একাবার রাগ হলে আর দিকনির্দেশনা নেই। সাংঘাতিক অত্যন্ত বেগতিক ব্যাপারস্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। রুস্তম মাথাটা দু’পাশে দোলায়। তবে মুখে অমত করে না। ছোঁকছোঁক করে আছে দৃষ্টি। শ্রবণেন্দ্রিয় প্রগাঢ়। সৈয়দ আর ইব্রাহিম অবশ্য চুপচাপ অদূরেই দাঁড়িয়ে। হাতে কাচের প্লাওয়ার প্রিন্টেড প্লেট। সেথায় ড্রাগন ফল ছোটোছোটো করে কাটা। কাঁটাচামচ দিয়ে দুজন আমোদে ফল খাচ্ছে। প্রবণতা নিয়ে দেখছে এবং শুনছে ঠিকই। তবে কর্তব্যভার নিতে অপারগ। মাহিন ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে,
‘কিছু শোনা যাচ্ছে না কেন?’
রিয়ান কৌতুক সুরে বলে, ‘জনাব আপনি কী শুনতে চাচ্ছেন? আহ, উহ?’
জিহ্বা কামড়ে মাহিন মাথা নাড়ায়, ‘নিজের ডার্টি মিন্ডেড চিন্তা আমা ওপর চাপাস না।’
রিয়ান ভেঙায়, ‘তাহলে কান পেতে কী শুনতে চাচ্ছিস? মাহফিলের বক্তব্য?’
মাহিন আশ্চর্যের সপ্তমে, ‘আরোপ দিচ্ছিস কেন! আমি আমার বন্ধুর খবরাখবর জানতে আগ্রহী হতে পারি না?’
রুস্তম ফিক করে হেসে ওঠে। রিয়ানের চোখমুখ জুড়ে বিদ্রূপাত্মক, ‘বন্ধুর খবরাখবর বুঝি মাঝরাতে বন্ধুর দরজায় কান পেতে নেয়? এমন বন্ধু আমি গু লি করে মে রে ফেলতাম।’
‘তাহলে নিজেকে মা র। তুই কান পেতে আছিস স্টিল।’
মাহিন অনড়ভাবে প্রত্যুত্তর করে। রিয়ান তর্কে জড়াতে প্রস্তুত। আজ একটা দুর্বোধ্য মীমাংসা হোক। আজ এই মাহিনের একদিন কিংবা তার! রিয়ান তেড়ে এগুতেই কাঠের দরজাটা শিথিলভাবে খুলে গেল। দুয়ারে গম্ভীরমুখে তন্ময় এসে দাঁড়িয়েছে। গায়ে এখনো সাঁঝের পোশাক বিদ্যমান। মানে কী কিছুই হয়নি? কিচ্ছুটি নয়? ভেবেই মাহিন হতাশের শীর্ষতে। এই তন্ময়কে দিয়ে কিছু হবে না। এত সুন্দর সুযোগ খানা হাওয়াতে উড়িয়ে দিল? তন্ময় হাত দুটো বক্ষঃস্থলের ওপর ভাঁজ করে রেখেছে। চাহনি সুচের মতন শানিত। তার মৌনতাই যেন প্রশ্ন করছে। রুস্তম হাত তুলে নিজেকে নিরপেক্ষদলে রাখতে আলুথালু গলায় বলে,
‘দোস্ত আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। ওরা দুজন জোরপূর্বক তুলে এনে বলল দাঁড়াতে। ফ্রিতে এক্সক্লুসিভ রোমান্টিক অডিও রোমান্স নাকি শোনাবে। সাবস্ক্রিপশন ছাড়া।’
সৈয়দ মাথা দোলায়। সে কঠিনভাবে সহমত। তারা একনিষ্ঠ দর্শক বৈ কিছু না। মাহিন ভ্যাবলার মতন হাসছে। বাম চোখটা ক্ষণে ক্ষণে টিপে দিচ্ছে। তন্ময় দেখেও দেখছে না। কয়েক’পা সামনে এসে দরজা লাগাল,
‘সমস্যা কী তোদের?’
কিয়ৎক্ষণের নীরবতা ভেঙে রিয়ান নির্লজ্জ মতন হেসে প্রশ্ন করে, ‘দোস্ত, অরু কই?’
তন্ময় ভ্রু তুলে, ‘কেন?’
‘মেয়েটা কেমন আছে জানতে এসেছিলাম। কিছুর প্রয়োজন পড়ে কিনা। আমার কাছে কিন্তু সওওঅঅব আছে। কোন জিনিস লাগবে একবার বল শুধু। এক্ষণ এনে দিচ্ছি।’
তন্ময় চোখ রাঙিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
‘ওর হাজবেন্ড আছে।’
রিয়ান দুষ্টু হেসে বলে বসে, ‘আরেহ ছোটো বেইবি তো। তাই আরকি!’ কথাটুকু শেষ করে শেয়ালের মতন ছুটে পালাল। তন্ময়কে উত্তম অবসরটুকু দিলো না— ওকে ধরে উত্তমমধ্যম দেবার। রুস্তম, ইব্রাহিমও আর থাকল না। ত্বরান্বিত পদচারণে চলে যাচ্ছে। অবশিষ্ট থাকা মাহিনের মুখটা তেঁতো হয়ে এলো। সে একাই দাঁড়িয়ে। তন্ময় রাগিত গলায় কিছু বলবে পূর্বেই ঘরের ভেতর থেকে অরুর ঘুমঘুম কণ্ঠ শোনা গেল,
‘তন্ময় ভাই! কী হয়েছে?’
দরজাটা লাগানো। তন্ময় বেরিয়েই লাগিয়েছিল শিথিলভাবে। অরু হয়তোবা ওঠে গিয়েছে। কীভাবে ওঠল? নিদারুণ নিঃশব্দে বেড়িয়েও, কীভাবে! বেশ চতুরতার সাথে মাহিন বন্ধুর কাঁধ চাপড়ে দিল,
‘যাহ, তোর পিচ্চি বউ ডাকে।’
তন্ময় শাসাতে ভুলে না, ‘আরেকবার তোদের এই কাণ্ডকারখানা দেখতে পেলে পুকুরে চুবাব।’
মাহিন জিহ্বা কামড়ে দ্রুততম পদচারণে চলে এলো। আড়াল হয়ে করিডরে সবাই দাঁড়িয়ে। মুখ টিপে হাসছে। মাহিন গিয়েই রিয়ানের পেটে দুটো ঘুসি বসাল,
‘শা লা! নিজেরা মুরগির মত পালালি আমাকে রেখে।’
ঘুসি দুটো বলপ্রয়োগহীন। ব্যথা হওয়ার মত নয়। তবুও রিয়ান নীরব, স্থির থাকার মত পাত্র নয়। সেও লেগে পড়ে মা রতে। শুহানি নিজের ঘরে চলে গেল। বাকিরাও চলে যাচ্ছে নিজেদের ঘরে। করিডরে ধস্তাধস্তি করছে মাহিন আর রিয়ান। রুস্তম অবশ্য কিছু সময় আনন্দের সহিত দেখছিল। অতঃপর সেও নিজের ঘরের দিক পা বাড়াল।
শেয়াল গুলোকে পালাতে দেখে, এযাত্রায় তন্ময় দরজা খুলে ঘরে প্রবেশ করে। বাতি জ্বালানো। সাদা দীপ্তি ছড়িয়ে ঘরে। অরু দাঁড়িয়ে জানালার পাশে। বাইরেটা দেখছে। বজ্রপাত পড়ছে ঘনঘন। দরজা আটকানোর আওয়াজ শুনতে পেয়ে মাথা ফিরিয়ে চায় অরু। চোখদুটো ফোলা। ঘুমন্ত মুখটায় যেন চন্দ্রিমা এসে বসেছে। তন্ময়কে দেখে এগুতে শুরু করে,
‘কী হয়েছে? ভাইয়ারা ডেকেছিলেন?’
এই প্রশ্নের জবাব তন্ময় দেবে না। মৌনতা বজায় রেখে ঠাঁই থাকল। অরু কাছাকাছি এসে আবার শুধাতেই তন্ময় বলল,
‘ঘুম ভাঙল কীভাবে?’
অরুর কাছে যেন এই প্রশ্নের প্রত্যুত্তর প্রস্তুত, ‘আপনি নেই যে। বিছানা ফাঁকা। আমার হাতও ফাঁকা।’
ঠোঁটে ধেয়ে জমতে চাওয়া হাসিটুকু দানবের মতন গিলে ফেলে তন্ময়, ‘ফাঁকা তাতে কী? আশেপাশে হব। তুই না ঘুমিয়ে মাঝরাতে ওঠবি কেন?’
অরুর চোখ দুটো ছোটো ছোটো হয়ে এলো। নাক ফুলিয়ে মুখটা কাছাকাছি এনে নিগূঢ় দৃষ্টি তাঁক করল, ‘সিগারেট খেতে গিয়েছিলেন?’ বলেই সুগভীরভাবে শুঁকল।
তন্ময় ঢোক গিলল। জটিল হলো দৃষ্টি। তার পুরুষালি হাতদুটো ইতোমধ্যে অরুর পাতলা কোমর বুঝে নিয়েছে। এক টানে নিজের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিবিড় গলায় বলল,
‘টেস্ট করে দেখ। জানতে ইজি হবে।’
অরু যেন নিজের শ্রবণেন্দ্রিয়কে বিশ্বাস করতে পারছে না। বড়ো চোখেতে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে। এবেলায় অদৃশ্যভাবে লজ্জায় আড়ষ্ট হয়। চোখ তুলে চাওয়া যেন দুঃসাহসসম্পন্ন। তন্ময় ডান হাতের আঙুলের সাহায্যে অরুর থুতনি ধরে মুখ তুলে। অরু চোখদুটো খিঁচে বন্ধ করে আছে। তন্ময় মাথা ঝুকোয়। অরুর কানের কাছে মুখ নিয়ে মন্থর স্বরে আদেশ ছুঁড়ে,
‘তাকা।’
অরু বাধ্যভাবেই চোখ মেলে চায়। দৃষ্টিতে দৃষ্টির মিলন ঘটে। পরমুহূর্তেই তন্ময় চেয়ে থেকে দ্রুতবেগে অরুর ঠোঁট দুটোতে চুমু বসায়। চুমু বসিয়ে ক্ষান্ত হয় না। গভীর, নিবিড় চুম্বনে লিপ্ত হয়। অরুর হাঁসফাঁস করা দেহটিকে নিজের মধ্যিখানে জাপটে রাখে। নড়েচড়ে ওঠার সুবিধা থেকেও বঞ্চিত করে। চুমুটুকু শেষ করে ফের চায় অরুর মুখপানে। অরু পুনরায় চোখজোড়া বুজে আছে। ভেজা রক্তিম ঠোঁটদুটো স্থিরভাবে কাঁপছে। সে দৃশ্যে নিজের ভেজা ঠোঁটজোড়া জিহ্বা দিয়ে ভিজিয়ে নেয় তন্ময়। দুষ্টুমি গলায় প্রশ্ন করে,
‘জবাব পেয়েছিস?’
অরু তো এভাবেই শুধিয়েছিল। এতকিছু ভেবে কী প্রশ্ন করেছিল? অথচ তার সাধারণ প্রশ্নটিকে কোথায় নিয়ে পৌঁছেছে। লাজে সে সুবিস্তৃত শক্তপোক্ত বাহু থেকে মুক্তি পেতে মরিয়া হয়ে ওঠে। তন্ময় আরও ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে একগুঁয়ে গলায় ফের শুধায়,
‘হুম? জবাব পেয়েছিস? নাকি আরেকবার টেস্ট করে দেখবি?’
অরু ত্বরিত মুরগির মত মাথা দু’পাশে নাড়ায়। অর্থাৎ না। সে জবাব পেয়েছে। তন্ময় নিঃশব্দে হাসে। ওকে ছাড়ে। শুধায়, ‘ক্ষুদা লেগেছে? কিছু খাবি?’
‘না। ঘুমাব। আসুন ঘুমুতে।’
অরুর সরল প্রত্যুত্তর কর্ণগোচর হতেই তন্ময় এবারো থমকায়। আশ্চর্য হয়। তেমনি আপ্লুত। মাঝেমধ্যে অরুটা তাকে বিস্ময়ের চূড়ান্তে পৌঁছে দেয়। অথচ মুখটা সরল প্রতিমার মতন। অরু ইতোমধ্যে বিছানায় শুয়েছে। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে তন্ময়ের অপেক্ষায়। যেন তন্ময় এলেই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ঘুমোবে আমোদে।
তন্ময় বাধ্যভাবেই বাতি নিভিয়ে বিছানায় আসে। অঝোরে বৃষ্টি তখনো নামছে। গুমোট আবহাওয়ায় রাতের প্রহরটুকু ভিন্ন। অরু বরাবরই বৃষ্টি পছন্দ করে। উপভোগ করে। আজও ব্যতিক্রম নয়। তন্ময়ের বুকপকেটে মাথা রেখে জানালার পানে চেয়ে। সুন্দর বৃষ্টি দেখছে। অরু আনমনেই বলে বসে,
‘আগামীকালও বৃষ্টি হলে ভালোভাবে। সিলেট দেখতে দারুণ লাগবে।’
তন্ময় অসন্তোষ কণ্ঠে ফোড়ন কাটে, ‘বৃষ্টি হলে ঘুরবি কীভাবে?’
‘ভিজে ভিজে।’ অরুর অকপটে জবাব।
তন্ময় নির্বিকার গলায় জানাল, ‘তাহলে ঘরেই থাকবি। বেরোনোর প্রয়োজন নেই।’
অরু ত্বরিত নিজের বলা কথা ঘুরিয়ে ফেলে, ‘তাহলে বৃষ্টি না আসুক। আমি চাচ্ছি না।’
এহেন কৈফিয়তে তন্ময় তৃপ্ত। আলগোছে অরুকে বক্ষঃস্থলে বুঝে নিয়েছে। অরুও শান্ত-স্থির বিড়াল। আরাম করেই তন্দ্রাচ্ছন্নতায় ডুবে যেতে প্রস্তুত।
রাতভর ঝরঝরে বৃষ্টি হলো। স্নিগ্ধ; শান্ত বাতাস বইল। প্রাকৃতিক পরিমন্ডল শীতল থাকল। ভোরের দিকে বৃষ্টি থামলেও, আজ সূর্য ওঠেনি। খণ্ডখণ্ড কালো মেঘ আকাশ গুমোট করে রেখেছে। দেয়াল ঘড়িতে সকাল সাতটা নয়। অথচ বাইরের প্রকৃতির দুর্দশায় ধরে নিতে হচ্ছে, মাগরিবের আজান পড়েছে যেন। তন্ময়ের ঘুম ভেঙেছে কিছুক্ষণ হবে। স্বভাবসুলভ আজ আর আড়মোড়া ভাবভঙ্গিতে ঘুম ভাঙেনি। একজনের গুঁতোগুঁতিতে ভেঙেছে। অরুর ঘুমের মাত্রাতিরিক্ত শোচনীয় অবস্থা। এই করুণ দুর্দশার বিষয়ে প্রায়শই আলাপে মশগুল হতো শাবিহা, রুবি। তন্ময় মাঝেমধ্যে চুপচাপ শুনতো। অরু তখন হাঁসফাঁস করে অস্বীকার করতো। চাপাস্বরে প্রতিবাদী গলায় জানাতো,
‘আমার নামে মিথ্যে অভিযোগ মানব না। বাবা বলেছেন আমার মতন সুন্দরভাবে কেউ ঘুমোতে জানে না।’
তখন সকলের অট্টহাসির ধ্বনিতে লিভিংরুম পর্যন্ত কাঁপতো যেন। পরিবারের সবার কমবেশ অরুর শোচনীয় ঘুমের ভাবভঙ্গি সম্পর্কে জানা। অজ্ঞেয় বিষয় নয়। অজ্ঞাতসারে তন্ময় নিজেও না হেসে পারতো না। অরুকে একপলক চোখের দেখাটুকু দেখতে— মাঝেমধ্যেই অরুর রুমে নিশীথে প্রবেশ করতো। সেইসূত্রে পূর্বেই অরুর ঘুমের এই দুর্দশা সম্পর্কে সে সচেতন। তবে দেখে আসা আর উপভোগ করার মধ্যে এক সুবিস্তৃত দূরত্ব রয়েছে। এইযে আপাতত অরুর ঘুমের করুণ দুর্দশার একঝলক দেখা যাচ্ছে। মাথাটা তন্ময়ের বুকের ওপর। পাজোড়া বিছানার বাইরে ঝুলছে। মধ্যরাতে অবশ্য তন্ময়ের পেটের ওপর ছিল।
ভাগ্যক্রমে হাত দুটোর অবস্থান ঠিকঠাক জায়গাতে। তন্ময় নিঃশব্দে হেসে ওঠে। দু’হাতে অরুকে টেনে সঠিকভাবে নিজের পাশে শুইয়ে দেয়। ওর মাথাটা ডান হাতের বাহুতে রেখে, বাম হাতে কোমর জড়িয়ে ধরে। অপলক চেয়ে রয় ঘুমন্ত মুখপানে। অরুর ঘুমের ভাবভঙ্গি শোচনীয় হলেও, ঘুমন্ত মুখের দৃশ্যটুকু দারুণ লোভনীয়। বাচ্চাবাচ্চা ঘুমন্ত মুখমণ্ডল দেখতে সুন্দর। মুখের কাটাকাটা একেকটি স্থান তন্ময় নিগূঢ়ভাবে দেখল। নাকটা সামান্য বোঁচা। এরজন্যে বুঝি মুখের ভঙ্গিমায় সরল ভাব। অবশ্য বাস্তব জীবনেও অরু ভীষণ সরলসহজ। তবে শান্ত না। এই শব্দটুকু ওর ক্ষেত্রে বেমানান বড্ড। তন্ময়ের বাম হাতটা ওর নরম কোমর ছেড়ে মুখের সামনে এসে থেমেছে। ছোট্টখাট্টো নাকটা টেনে ধরতেই অরু নড়েচড়ে ওঠল। আরেকটু গভীরভাবে ঢুকল তন্ময়ের আলিঙ্গনে। বুকে মুখ গুঁজে তন্দ্রাচ্ছন্ন ঘোরে ডাকল,
‘তন্ময় ভাই!’
এই গভীর, দৃঢ়তম আলিঙ্গনের সুন্দর মুহূর্তটি, ঘুমকাতুরে কন্ঠটি– তন্ময় চমৎকার ভাবে উপভোগ করল, ‘হুউম?’
অরুর আর প্রত্যুত্তর এলো না। পুনরায় গভীর ঘুমে ডুবেছে সে। তন্ময় নিজেও চোখবুজে রাখল। দ্বিতীয়দফায় ঘুমানোর ইচ্ছা। দীর্ঘক্ষণ পেরুলেও ঘুমের ‘ঘ’ টুকুও ধরা দিতে অপারগ। অন্যদিকে দরজায় ইতোমধ্যে গুণেগুণে নয়বার করাঘাত পড়েছে। ঘড়িতে এখন আটটা নয়। বিছানা ছেড়ে ওঠা আবশ্যক। নাস্তাপানি সেরে তাদের বেরোতেও হবে। বন্ধুবান্ধবদের সুউচ্চ বিশাল প্ল্যানিং করা। অরু নিজেও উত্তেজিত ছিল ঘুরাফেরা নিয়ে। ঘুরতে-ফিরতে ভালোবাসে। বিশেষ করে সঙ্গি তন্ময় হলে। এই ছোটো বিষয়টিও তন্ময়কে আনন্দ দেয়। উদগ্রীব হয়ে ওঠে বক্ষপিঞ্জর।
অরু এযাত্রায় নড়েচড়ে ওঠছে ক্ষণেক্ষণে। চোখ দুটোর পাপড়িযুগল কাঁপছে। ঘুম ভাঙার পূর্বলক্ষণ। তন্ময়ের মস্তিষ্কে দুষ্টু বুদ্ধি চাপল। ঝটপট নিজের চোখদুটো বন্ধ করে নিলো। স্বাভাবিকভাবে ঘুমের ভাণ ধরে থাকল। পাপড়িযুগল সামান্যও কাঁপল অবদি না। অথচ চোখজোড়া বুজেও রেখেও অনুধাবন করতে পারছে। অরু ঘুমন্ত ফোলা চোখে চেয়ে। নিবিড়, নিগূঢ় অপলক দৃষ্টিতে চেয়েই রয় দীর্ঘসময়। এত কী দেখে মেয়েটা? তন্ময়ের চোখ মেলে চাইতে ইচ্ছে হলো। চোখে চোখ রেখে ওকে চমকে দিতে মন উতলা। এইমুহূর্তের জন্য নিজের উচ্ছ্বাসিত হৃদয়কে কঠিন শাসনে দমন করে রাখল। ইচ্ছেটুকুকে ক্ষণিকের জন্য আশকারা দিলো না। অরুর পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য সে অধীর আগ্রহে অপেক্ষায়। কিছুক্ষণ পর নরম আঙুলের স্পর্শ পেলো মুখ জুড়ে। ধীরেসুস্থে অবিরামভাবে মুখজুড়ে আঙুলগুলো ঘুরেফিরে চলল। আদুরে ভঙ্গিতে একে-একে মুখের প্রত্যেকটি স্থানে আঙুল বুলাল। ছোটো দেহটি তার পুরুষালি আলিঙ্গনে গভীরভাবে মিশতে ব্যাকুল। তন্ময় সহায়তা করল বড়ো কৌশলে।
নিপুণভাবে গাঢ় হয়ে ছোঁয়া শরীরকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। অরুর শরীর কিছুক্ষণের জন্য থমকাল। কাঠের মতন কাটকাট সোজা হয়ে এলো। যখন বুঝল তন্ময় ঘুমিয়ে আছে, জেগে ওঠেনি —ফের শান্ত হলো। ছেড়ে দিলো শরীর। তন্ময় সবই উপলব্ধি করল। এযাত্রায় ভাবল চোখজোড়া খুলে চমকে দেবে। পূর্বেই তাকে চমকে দিলো অরু। আকস্মিক নরম ঠোঁটের স্পর্শে কেঁপে ওঠল তন্ময়ের পাপড়িজোড়া। ঠোঁটদুটো আদুরে স্পর্শে ছুঁয়ে চলেছে তার মুখজুড়ে। তন্ময়ের হৃদয় দিশেহারা হয়।
হঠাৎ করেই চোখ মেলে চেয়ে বসে। অরুর চোখজোড়া বন্ধ। ওর ঠোঁট দুটো তখনো তার শক্তপোক্ত লম্বা নাকের ডগা ছুঁয়ে। ক্রমান্বয়ে সেই ভঙ্গিতে ঠোঁটে চুমু খেতে গিয়ে চোখ মেলে চায় একপল। এবং এতেই বরফের মতন জমে যায়। দৃষ্টিতে দৃষ্টির মিলন ঘটে। সেকেন্ডের মধ্যে অরু চাপাস্বরে শীৎকার দিয়ে ওঠে। ধড়ফড়িয়ে সরে আসতে চাইলে তন্ময় নিগূঢ়ভাবে জাপটে নেয় নিজের মধ্যে। আচমকিত আক্রমণাত্মক চুমুতে ভরিয়ে দেয় অরু সর্বমুখ। কুঁকড়ে আসা শরীরকে আলতো, তবে দৃঢ় বন্ধনে আলিঙ্গন করে রাখে। গোলাপি ঠোঁটে একটা গাঢ় চুমু বসিয়ে থামে তন্ময়। অরুর আতঙ্কিত মুখ দেহে হেসে ফেলে। দুষ্টুমি গলায় শুধায়,
‘কী দেখছিলি?’
অরু লজ্জায় হাঁসফাঁস করে। পলক ফেলে ক্রমান্বয়ে। দৃষ্টিতে দৃষ্টি রাখতে অনিচ্ছুক। তন্ময় আলতোভাবে চেপে ধরে ওর থুতনি। অরু তুষ্ট, অসন্তোষ হয়। কণ্ঠে জাহির করে সেটুকু,
‘নাটক করছিলেন ঘুমের?’
তন্ময় গভীর স্বরে শব্দ করেই হেসে ওঠে। পুনরায় লাজুক মুখটার বাম গালে চুমু খায়। মুখটা অরুর মুখের সাথে ছুঁইছুঁই করে আদুরে গলায় বলে,
‘উঁহু। লুকোচুরি খেলছিলাম। না খেললে তো চুমুগুলো মিস করতাম। আরেকটু অপেক্ষা করলে ঠোঁটেও পেতাম। মিস করে গেলাম।’
অরু ভাষাহারা। ঠোঁটে ঠোঁট টিপে বাঁকাচোখেতে চাইল। দৃষ্টি সরিয়ে আমতাআমতা করল। এবেলায় আকস্মাৎ তীব্র করাঘাতের ধ্বনি শোনা গেল। মাহিনের অধৈর্য কণ্ঠ,
‘ব্যাটা ওঠ। রাত আর নাই। এখন সকাল। মা-খালারা বলেন, নতুন দম্পতিদের দিন-দুপুরে দরজা আটকে রাখতে নেই। মানুষ কানাঘুষা করে। বেরিয়ে আয় তাড়াতাড়ি। নাহলে কিন্তু মাইকিং করব।’
অরু ভয় পেয়ে গেল। চটপট তন্ময়ের ওপর থেকে ধড়ফড়িয়ে ওঠে বসল। দরজার দিকে একবার চেয়ে তন্ময়ের পানে চাইল। গাল দুটো লজ্জায় তিরতির কাঁপছে। তন্ময় কিয়ৎক্ষণ উপভোগ করল সে দৃশ্য। হাত বাড়িয়ে অরুর মাথাটা বুলিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
‘খিদে পেয়েছে নিশ্চয়ই। নাস্তাপানি খেতে হবে। ঘুরতে বেরোবি না?’
অরু ত্বরিত মাথা দোলাল। ঘুরতে যাওয়ার জন্য সে উদগ্রীব হয়ে আছে। তন্ময় হেসে বিছানা ছাড়ল। দরজার দিকটায় যেতে-যেতে বলল,
‘ফ্রেশ হয়ে নে। আমি আসছি।’
অরু ততক্ষণাৎ বলল, ‘আপনি ফ্রেশ হয়ে বেরোন।’
তন্ময়ের পদচারণ থামল। ফিরে চাইল সে। অরু তটস্থ হয়ে চেয়ে আছে। তন্ময় বাধ্যভাবেই ফিরে এলো। অরুর সমানতালে মাথা ঝুকাল। অদ্ভুতভাবে ভ্রু দুটো নাচাল। কাঁধ ঝাঁকিয়ে আদুরে ভাবে বলল,
‘বউ যা বলে তাই সই।’
অরু এবারেও আশ্চর্য হয়। লজ্জায় নেতিয়ে যায় পাপড়িযুগল। কম্পমান ঠোঁটজোড়া টিপে ল্যাগেজ দুটোর দিক ছোটে। থেমে থেমে বলে,
‘টুথব্রাশ, টুথপেস্ট দিচ্ছি।’
তন্ময় হাসিমুখে সহমতি প্রকাশ করে আদুরে আশকারার ভঙ্গিতে, ‘ওকে।’
সুউচ্চ প্রাচীর ঘেঁষে দাঁড়ানো কৃষ্ণচূড়া গাছের ডালপালা বৃষ্টির জলে ভিজে। টপটপ করে জল পড়ছে পাতা থেকে। সবুজরংয়ের ঘাসজলের ওপর পড়েছে কৃষ্ণচূড়ার প্রাণপূর্ণ ফুলগুলো। সেখানটায় গুণে-গুণে পুরাতন দশটি কাঠের চেয়ার পেতে দিয়েছেন বাবু মিঁয়া। একটি গোলগাল টেবিলও সামনেই রেখেছেন। এই ভেজা, মেঘলা আবহাওয়াতে সবাই বাগানে নাস্তা করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে বলে মনে করলেন। ভদ্রলোক স্বভাবসুলভ আজানের সু-মধুর আহ্বানে ওঠেছেন। ওঠে নামাজ আদায় করে নিয়েছেন। সকালের নাস্তায় কী-কী থাকবে তা নিয়েও, দারোয়ান ইয়াসিন মোল্লার সাথে একচোট বোঝাপড়া সেরে নিয়েছেন। তারপর প্রতীক্ষায় সময় কাটিয়েছেন অতিথিদের ওঠবার। অবশেষে সাতটার পরপর একে একে সবাই ওঠেছে। ফ্রেশ হয়েই বেরিয়ে এসেছে প্রাঙ্গণে। এসে বসেছে পেতে রাখা চেয়ারগুলোতে। কৃষ্ণচূড়া এবং বৃষ্টির এক অদেখিত ঘ্রাণে চতুর্দিক মোহে আচ্ছন্ন। মেঘলা দিনটা আজ আর মন্দ লাগছে না। বেশ স্বতঃস্ফূর্তরা বিরাজ করছে মন আঙিনায়। মাহিন নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বেরিয়ে আসছে ভেতর থেকে। অদূর হতেই তাকে দেখে রিয়ান প্রশ্ন ছুঁড়ল,
‘ওঠেছে তন্ময়? ওর মধুচন্দ্রিমা শেষ হয় নাই নাকি?’
মাহিন উত্তরদিকের ফাঁকা চেয়ারটিতে অবলীলায় গা এলিয়ে বসল। পায়ে পা ওঠিয়ে নাচাল। ভোঁতামুখে জবাবে বলল,
‘তন্ময় বেঁচে যাচ্ছে। ওর বউ পিচ্চি দেখে। পুতুলের মতন ভোলাভালা, সরল এক বাচ্চা মেয়ের সামনে তো আর এডাল্ট কথাবার্তা বলা যায় না। নিজের কাছেই অপমানজনক। নাহলে আজ ওর খবর ছিল। দরজা ধাক্কিয়ে থামতাম না। আরও অনেক কিছুই বলতাম।’
রিয়ান অতিষ্ঠ ভঙ্গিমা ‘চ’ শব্দ তুলল। সে কঠোরভাবে সহমত। এবং অতিরিক্ত বিরক্ত। মেয়েটা বাচ্চা এই তো কম ছিল না। তার ওপর আবার তন্ময়ের চাচাতো ছোটো বোন। বেশ কম্পলিকেটেড ব্যাপারস্যাপার। সবদিক দিয়ে তারা ফেঁসেছে। আঁটকেও আছে। আর অরুটা এমন মিষ্টিভাবে— ‘ভাইয়া, ভাইয়া’ ডাকে, তার সামনে আর যাহোক বন্ধুকে বিকৃত ভঙ্গিতে খোঁচানো মুশকিল। সৈয়দ মিটবল খাচ্ছে। দারুণ সুস্বাদু হয়েছে।
দুটো খেয়ে তিনটার সময় মুখ খুলল,
‘ভুলেও উল্টাপাল্টা বলতে যাস না। তন্ময় চিবিয়ে চিবিয়ে খাবে তোকে।’
তন্ময় দুয়ারে এসে দাঁড়িয়েছিল সবেমাত্র। শুনতে শুনতেই পা বাড়িয়ে এগুতে থাকল। তন্ময়কে দেখে মুখে কুলুপ এঁটে রাখল সৈয়দ। তবে মাহিন চুপ রইল না। অরুকে পেছনে না দেখে মুখ চালাল রকেটের গতিতে,
‘দোস্ত, ভার্জিনিটি হারাইছিস তো? মানসম্মান আর হারাতে দিস না। এখনো যদি বিবাহিত ব্যাচেলর থেকে যাস— মানুষ বলবে তোর যন্ত্রপাতি কাজ করছে না। মানুষের কথা নাহয় বাদ দিলাম। অরু কী ভাববে বল? মুখে না বলুক, বেচারি মনে মনে হয়তোবা তোকে ডাক্তার দেখাতে প্রস্তুত। ভাববে ওর তন্ময় ভাই একটা গে। কোনো কাজের না।’
ফিক করে হাসতে গিয়েও হাসিটুকু গিলে নিলো রিয়ান। শোচনীয় সংলাপ। হাসাহাসি না করাই উত্তম। সৈয়দ তন্ময়ের বাম পাশের ফাঁকা চেয়ারে বসেছিল। অন্যদিকে মুখটা ফেরানো। কাঁধ কাঁপছে তার দৃশ্যমান রূপে। তন্ময় এতে নির্লিপ্ত। জবাব একটি শব্দ বলল না। তবে ডান পায়ে লাথি মার তে ভুলল না সৈয়দকে। সৈয়দ লাথি খেয়ে শব্দ করেই হাসল। রিয়ানও আর নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারল না। এবেলায় শুহানির সঙ্গে অরু বেরিয়ে এলো। শুভ্র রঙের কামিজ পরেছে।
মেঘলা দিনের মতন আবছায়াটে লাগছে দেখতে। তন্ময় হাত ওঠিয়ে নিজের দিকে ডাকল। তার ডান পাশের চেয়ারটা ফাঁকা। সেখানেই অরু বসল। ইতোমধ্যে নাস্তা পরিবেশনের কাজে ব্যস্ত বাবু মিঁয়া। খাওয়ার ফাঁকফোকরে পুনর্বার আলোচনায় মশগুল হলো। আজ কোথায় বেরুবে সেটাই মূল আলোচনার বিষয়বস্তু। যেহেতু মেঘলাদিন। দূরে না যাওয়াটাই ভালো হবে। কাছাকাছিভাবে গাড়ি করে ঘুরে আসা যেতে পারে। অধিদপ্তর থেকে অবশ্য আগামীকালের সংকেত দেয়া
কাল টগবগে সূর্য ওঠবে। রাত ব্যতীত সারাদিনব্যাপি বৃষ্টির সম্ভবনা নেই। আজ সারাদিনব্যাপি বৃষ্টি হওয়ার সম্ভবনা নব্বই শতাংশ। সেক্ষেত্রে আবহাওয়া দেখেশুনে সিদ্ধান্তে আসা হলো।
আহারের কার্যক্রম শেষে অরু ভেতরে চলে গিয়েছে। আরেকটু সুনিপুণ হয়ে নেবে বেরুনোর তাগিদে। অন্যদিকে তন্ময় বন্ধুবান্ধবদের সাথে প্রাঙ্গণে সিগারেট ফুঁকেছে। না ফুঁকে কোথায় পালাবে? একেকটা ইত রের চাচাতো ভাই। জোরপূর্বক তাকে খাইয়ে ছেড়েছে। তন্ময় গতরাতে নিজমনে প্রতিজ্ঞা নিয়েছিল সিগারেট ধরবে না। তবে তা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। সিগারেটের গন্ধ পেলেই অরু নাকমুখ কুঁচকে রাখে। অসন্তোষ দৃষ্টিতে চায়। কবে যেন মুখের ওপর বলে বসে,
‘সিগারেট খেয়ে আমায় চুমু খেতে পারবেন না।’
এই বাক্য পূর্বের অরু বলবার সাহস পেতো না। তবে এখানকার অরুর এই সাহস আছে। মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাওয়া ওর জন্য এতটুকু সাধারণ। এযাত্রায় নিজেও বন্ধুদের রেখে ওঠে এসেছে। ভেতরে ঢুকেছে। নিজেদের রুমের দরজা ঠেলে ঢুকতেই দেখল অরু খুব অভিনিবেশ হয়ে ডায়রিতে কলম চালাচ্ছে। এই দৃশ্যটুকু দেখতে-দেখতে পা চালাতে নিয়েই শুধাল,
‘কী লিখছিস?’
অরু মাথা তুলল না। একাহাতের সাহায্যে ঢেকে রাখল শুধু। জবাবে ছোটো করে বলল, ‘ডায়রি।’
তন্ময় পাশেই বসল চেয়ার টেনে। চোখ ওঠিয়ে দেখার প্রচেষ্টা। ‘কী সম্পর্কে লিখছিস?’
‘এবাউট আওর জার্নি।’
তন্ময় আশ্চর্য কণ্ঠে বলে, ‘ঢাকতে হচ্ছে কেন? আমি দেখলে সমস্যা কী?’
শাহজাহান তন্ময় পর্ব ৫৭+৫৮
অরু নাক ফুলাল, ‘সমস্যা বলেই তো দেখাচ্ছি না। চুপ করুন, তন্ময় ভাই। আরেকটু বাকি। শেষ করতে দিন।’
তন্ময় কথাটুকু শুনল। নিঃশব্দে বসে রইল। একচিত্তে শুধু চেয়ে রইল। অরু বেশ মনোযোগী। কর্মরত, ব্যস্ত তাকে অসাধারণ দেখতে লাগছে। তন্ময়ের মনে হলো সে দীর্ঘসময় এভাবেই চেয়ে থাকতে পারবে। হয়তো সারাজীবনভরও….
