শাহজাহান তন্ময় পর্ব ৬১+৬২
Nabila Ishq
কাঠের বারান্দাটা সেকেলে। আপাতত ভেজাটে। ভোরের বৃষ্টির সংস্পর্শে এখনো পিচ্ছিল ভাব। বুঝেশুনে পদচারণ না ফেললে —মুখ থুবড়ে পড়ে যাবার সম্ভবনা দারুণ। স্থির, শীতল বাতাস বইছে। বৃষ্টির সুমধুর ঘ্রাণ যেন এখনো বাতাসে বাতাসে লেপ্টে। আনোয়ার সাহেব কল করেছেন। অরু চতুরভাবে নগ্ন পায়ে হেঁটে-হেঁটে কথা বলছে। তার উচ্ছ্বাসিত বদন এবং উচ্চধ্বনির হাস্যোজ্জ্বল কণ্ঠস্বর তন্ময় ঘরে বসে শুনতে পারছে। সে কিছুক্ষণ আগেই গোসল নিয়ে বেরিয়েছে। পাশেই বের করে রাখা শার্ট-টা পরার সময় হয়ে উঠেনি। গুরুত্বপূর্ণ কল এসেছে। এক জরুরি ইমেইল এপ্রুভড করতে হবে। ল্যাপটপ কোলে নিয়ে চেয়ারে বসল। ইমেইল-টা পড়তে নিতেই তার ম্যানেজারের কল এলো। ডান কানে কাঁধের সাহায্যে ফোন চেপে ধরে—চার-পাঁচ বাক্যে কথা শেষ করে ফোন সরাল। অরু বাবার সঙ্গে কথা শেষ করে এসেছে। তন্ময়ও গুরুত্বপূর্ণ কাজটা শেষ করে ল্যাপটপ সরিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। পাশে রাখা শার্ট তুলে নিয়েছে। শার্ট-টা অরু পছন্দসই বের করেছে তার ল্যাগেজ হাতড়ে। বোধহয় আজ ম্যাচিং করে জামাকাপড় পরতে চাচ্ছে। এতটুকু বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না।
‘আমরা কোথায় যাব?’
অরুর নিভু কণ্ঠের প্রশ্নের সামনে তন্ময় নির্লিপ্ত থাকল। চোখ তুলে তাকাল না। হাতের আঙুল গুলো তখন ব্যস্ত কালো শার্টের সোনালি রঙের বোতামগুলো লাগাতে। সুবিস্তৃত; শক্তপোক্ত, সুঠোম বুকের দিকটা পরিষ্কার। ফরসা বুকে কালো শার্ট-টা অপূর্বভাবে মানিয়েছে। ঠিক বামদিকের জানালাটা আপাতত খোলা। পর্দা গুলো দু’পাশে ছড়িয়ে দেয়া। সূর্যের সোনালি দ্যুতি এসে মেঝেতে পড়েছে শীর্ণ পথ ধরে। এখান থেকে কৃষ্ণচূড়া গাছটা দেখা যাচ্ছে। গাছটি সূর্যের রশ্মির মোহে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। শ্যাওলায় আধঢাকা প্রাচীরের ওপর কোয়েল পাখির জোড়া বসে। মিহি সুরে ডাকছে। যেই ডাক কানে ভাসতেই বুকভরে আলোড়ন হয়।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
এবেলাতে অরু প্রশ্নের জবাব না পেয়ে আরেকটু কাছে এসে দাঁড়াল। পায়ের গোড়ালিতে সম্পূর্ণ ভারটুকু ছেড়ে কাধটা ছুঁইছুঁই করল। মুখ বাড়িয়ে চোখ দাবিয়ে আবারো যেন একই প্রশ্নটি করছে। উতলা ওর কর্মকাণ্ড তন্ময় দেখেও দেখল না। এই একই প্রশ্নের জবাবটি সে দু’বার ইতোমধ্যে দিয়েছে। তৃতীয়বারের জবাবটুকু দিতে বাধ্য হলে সে সভ্যভাবে আর বাক্যে দেবে না। অভদ্রোচিত শক্ত এক চুমুতে দেবে। অসন্তুষ্ট অরু এযাত্রায় তন্ময়ের পাশে থেকে একদম সামনে এসে দাঁড়াল। লম্বাচওড়া তন্ময়ের সামনে সে অতিষ্ঠ ভাবভঙ্গি নিয়ে বলল,
‘এতক্ষণ লাগে বোতাম লাগাতে? দেখি…দেখি আমাকে দেন। এক মিনিটেই সবগুলো লাগিয়ে দিচ্ছি।’
বলতে-বলতে তাড়াহুড়ো হাত দুটো বাড়াল। তন্ময় শান্তভাবেই নিজের হাত দুটো সরিয়ে নিলো। আরামকরে সটানদেহে দাঁড়াল। নত দৃষ্টি অরুর মুখে নিবিষ্ট। বড়ো চোখের কালো পাপড়িজোড়া কাঁপছে। বেশ ঘনঘন পলক ফেলছে। হাত দুটো দু’তিন চেষ্টায় একটি বোতাম লাগতে মিনিটখানেক সময় নিচ্ছে। আঙুলগুলোর মাথা ছুঁয়ে দিচ্ছে বুকের অংশটুকু। অরু নিজেও হয়তোবা বুঝতে পারল বিষয়টা। বোকার মতন মৃদু হাসার চেষ্টায় জানাতে উদগ্রীব হলো,
‘আপনি লম্বা দেখে দেরি হচ্ছে। খাটো হলে সেকেন্ডে হয়ে যেতো।’
তন্ময় সাবলীলভাবেই উদার কণ্ঠে বলল, ‘তাহলে কি মাথাটা কে টে পেটে লাগাব? খাটো দেখাবে। তোর বোতাম লাগাতে মাত্র সেকেন্ডে লাগবে।’
অরু স্তম্ভিত হয়। দৃষ্টি তুলে চায়। থমথমে গম্ভীরমুখ থেকে এইকথা বেরুবে তা ভাবতেও পারেনি হয়তোবা। এমন মুখ নিয়ে কৌতুককর কথাবার্তাটুকু হাস্যকর না লাগাটাই বরং স্বাভাবিক। অসহ্যকর জোকস-টা তার হজম হলো না। ক্ষুব্ধ চোখ রাঙিয়ে চাইল। হাত দুটো নিরালায় সরিয়ে আনতে উদগ্রীব। নিঠুরভাবে সরে যেতে উতলা হতেই তন্ময় মুখ বাড়িয়ে ঝুঁকে। শীতল স্বরে আদেশ ছুঁড়ে,
‘সবগুলো বোতাম লাগাতে হবে। ইট’স এন অর্ডার।’
অরু মুখ ভেঙাল। বিড়বিড় করল। তবে বাধ্য মেয়ের মত পুনরায় হাত বাড়াল। লাগাতে ধরল বোতাম গুলো। দৃষ্টি তন্ময়ের সুঠোম বুকের কাছটায়। ভুলবশতও চোখ তুলে দৃষ্টিতে দৃষ্টি মেলাল না। বোতাম লাগাতে নিয়েই মিনমিনে গলায় বলল,
‘তাহলে কথা শোনাচ্ছেন কেন? একটু দেরি হলে কী এমন হয়েছে?’
তন্ময় অপলক চোখে দেখতে পেলো অরুর ঠোঁটের একেকটি ভাঁজ। গোলাপি ঠোঁটের ভাঁজগুলো যেন তার ঠোঁটের ভাঁজগুলোকে ইশারায় ডাকছে। সেই ডাকে ঠোঁটদুটো সাড়া দিতে মরিয়া হলেও তন্ময় দিলো না। একইভাবে অনড়ভাবে ঝুঁকে থাকল। শুধুই দেখে গেল একগুঁয়ে দৃষ্টিতে। অরু যেন সেই দৃঢ়তম দৃষ্টির সংকেত অনুভব করছে। মৃদু মৃদু কাঁপছে হাত দুটো। অরুর নাস্তানাবুদ মলিন মুখ দেখে তন্ময় নিঃশব্দে হাসল। সটানদেহে দাঁড়িয়ে বাদবাকি বুকের দিকের দুটো বোতাম নিজেই লাগাল— দুটো স্টেপে। এক পলকে, অতিদ্রুত। এই দৃশ্যে অরুর দ্বিধান্বিত চোখজোড়া লাজুক হলো। দাঁড়িয়ে রইল ভাবসূচক অভিনিবেশে।
করুণ কণ্ঠে নিজের সাফাই গাইতে বলল,
‘আপনি তো বছরের তিনশো পঁয়ষট্টি দিন শার্ট পরেন। এতে বোতাম লাগানোর স্পিড আমার থেকে একটু ভালো থাকাটাই স্বাভাবিক। তাই নয় কি?’
তন্ময় ভ্রু তুলল, ‘হ্যাঁ। সেক্ষেত্রে এক কাজ করতে পারিস।’
‘কী কাজ?’ অরুর স্বরে উত্তেজনা। দৃষ্টি নিবিড়। জানার আগ্রহবোধ অসীম। তন্ময় স্বাভাবিকভাবে বলল,
‘নিয়মিত শার্টের ঘ্রাণ না শুঁকে–প্রত্যেক রাতে পরতে পারিস। পরতে পরতে বোতাম লাগানোর স্পিড বেড়ে যাবে।’
অরুর ছোটোছোটো চোখজোড়া বড়ো হয়ে এলো। থতমত খাওয়া মুখটা দেখে তন্ময় ঠোঁট টিপে হাসল। অরুর সময় লাগল বাক্য গুলো বুঝতে। বুঝে সে আশ্চর্য হলো। অবিশ্বাস্য চোখে চেয়ে রইল কিছু সেকেন্ড। ঠোঁট দুটো নাড়াল কিছু বলতে। কয়েকবার চেষ্টা করে, ‘আপ…আপনি… ’ ছাড়া আর কিছুই বলতে পারল না। লজ্জায় স্তম্ভিত সে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় ওকে আড়চোখে দেখে —তন্ময় কথা ঘুরিয়ে বসল,
‘কী বলেছিলাম তখন?’
অরুর চোখমুখ লজ্জায় নুইয়ে আছে তখনো। তবুও প্রত্যুত্তর করে কিঞ্চিৎ সন্দেহজনিত জিজ্ঞাসাবাদে, ‘কী বলেছেন?’
ডান হাতা ভাঁজে-ভাঁজে কনুইতে তুলতে নিয়েই তন্ময় বলল, ‘তৈরি হতে। নাকি বেরুনোর ইচ্ছে নেই?’
‘যাচ্ছি’ আওড়ে অরু দ্রুত সরে গেল। তন্ময় সুস্পষ্ট দেখল ওর ব্যস্ত দেহ। ল্যাগেজ হাতড়ে কালো কামিজ বের করেছে। সেটি স্কার্ফের নিচে ঢেকে বাথরুম ঢুকেছে তড়িঘড়ি করে। তন্ময় এবারে শব্দ করেই হাসল। বাম হাতা কনুইতে তুলে হাত ঘড়ি পরল। এগুল অরুর খোলা ল্যাগেজের দিক।
পায়ের পাতায় ভার রেখে ল্যাগেজ ছুঁতেই, অরুর পার্সোনাল ডায়েরিতে নজর আটকাল। ওপরের এককোণেতে পড়ে আছে। হাত বাড়িয়ে ছুঁতে নিয়েও ছুঁলো না শেষমেশ। ল্যাগেজের চেইন লাগাল। অরু বেরুলো পাঁচ মিনিটের মাথায়। কালো চুড়িদার পরেছে। কালোতে ওকে সর্বদাই চমৎকার দেখায়। অবশ্য তন্ময়ের কাছে সবভাবেই, সব পোশাকেই —ওকে চমৎকার লাগে। আড়চোখে দু’বার চেয়ে নিজের দৃষ্টি সংযত করল। সাবলীলভাবে বসল চেয়ারে। ছন্নছাড়া দৃষ্টির সামনে রাখল ফোন। স্ক্রিনে এটেনশন দেবার তীব্র প্রচেষ্টা। সে চাইলেই বেরিয়ে যেতে পারে। মাহিন একের পর এক মেসেজ দিচ্ছে। সবগুলো বন্ধু প্রাঙ্গণে বসে। অথচ তার যেতে ইচ্ছে করছে না। মন যেতে চাইছে না। হৃদয় বলছে,
‘বাইরে আছেটা কী? অরুর সাজসজ্জা দেখার চেয়ে আপাতত ইম্পরট্যান্ট কিছু নেই তোর। চুপচাপ বসে বসে দেখ।’
অরু ছুটে-ছুটে তৈরি হচ্ছে। তাড়াহুড়ো হাতে দুল পরছে। টিপ পরছে। ঘড়ি পরছে। সাইড ব্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছে। দৃশ্য গুলো ভীষণভাবে উপভোগ করছে সে।
রৌদ্রজ্জ্বল আকাশপানে চেয়ে মাহিন ভাবুক কণ্ঠে বলে,
‘আবহাওয়া অধিদপ্তর ভুয়া গবেষণা করেন। আকাশ দেখলেই বোঝা যায় আজ কোনো বৃষ্টি-টৃষ্টি হবে না। আমার কথা মিলিয়ে নে। দেখ কী চমৎকার রোদ্দুর! রোদ পারছে না জাস্ট নাচতে।’
রিয়ান ফোন বের করল পকেট থেকে। নিশ্চিত হতে পুনরায় ওয়েদার অ্যাপ-এ ঢুকল। বৃষ্টি হওয়ার সম্ভবনা দুটো পঁয়তাল্লিশ থেকে। একটা ত্রিশ থেকে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হবে দেখাচ্ছে। রিয়ান ভ্রু তুলে জানাতেই মাহিন বিরক্ত হলো,
‘শোন এসব ওয়েদার ফয়েদার বাদ। তুই আমার কথা শোন। আমিই হচ্ছি উন্নতমানের আবহাওয়া অধিদপ্তর।’
শুহানি হেসে শুধাল, ‘তা আপনি কি চার্জ করেন, স্যার?’
মাহিন উদারতার বহিঃপ্রকাশ করল, ‘জি। খুব কম। মাত্র পাঁচশো। পার সেন্টেন্সে।’
সৈয়দ আশ্চর্য গলায় বলে বসল, ‘তোর একেকটি বাক্য কী স্বর্ণে বাঁধাই করা?’
মাহিন সাদা ফকফকে দাঁতগুলো দেখিয়ে জানাল,
‘দাঁত মাজি নাই সকালে। দাঁত না মাজা মুখ হলো স্বর্ণখনি। তাই এই মুখ দিয়ে আসা একেকটি বাক্য দামি। চার্জ বাড়িয়ে দিলাম। এখন প্রত্যেকটি বাক্যে হাজার টাকা।’
ইব্রাহিম অবিশ্বাস্য ভঙ্গিতে মাথা দুলিয়ে বলল, ‘মামা, তুই ডেট এক্সপায়ার গাঁজা দিন-দুপুরে আর খাইস না।’
মাহিন শব্দ করে হাসল, ‘একা একা খেয়ে মজা নাই। আয় মিলেমিশে খাই। খুউউব টেস্ট।’
বন্ধুদের তর্কবিতর্কের মাঝেই অরুকে নিয়ে বেরিয়ে এসেছে তন্ময়। অরু খুব মনোযোগ সহ সামনে চেয়ে। তার বন্ধুদের তর্কবিতর্ক শোনার প্রবণতা প্রখর।
প্রাঙ্গণে ইতোমধ্যে সবাই আসন পেতেছে। গতকাল রাতেই আলোচনা করা হয়েছে কোথায় যাবে। তারা মাইক্রো করে লেকের পাড়ে যাবে। আধঘণ্টার পথ। সিলেটের ওই প্রাকৃতিক লেকপাড় জুড়ে কয়েকটি টং আছে। দলবদ্ধভাবে চেয়ার পাতা থাকে। বৃষ্টির দিনে ছাউনির নিচে চা খেয়ে আড্ডা দেবার মতন সু-ব্যবস্থা করা। আজ যেহেতু বৃষ্টির দিন। কাছাকাছিই থাকবে। আগামীকাল ভ্রমণে বেরুবে। এইমুহূর্তে প্রত্যেকের দৃষ্টি তন্ময় এবং অরুর ওপর। তন্ময় গলা পরিষ্কারের ছুঁতোতে বন্ধুদের দিকে চেয়ে শুধায়,
‘তাহলে বেরুনো যাক? সবাই রেডি?’
মাহিন মুখ টিপে হাসে। অগোচরে ডান চোখ টিপে বলে, ‘আমরা ভালোভাবেই রেডি। তোর রেডি হতে এত গুলো ঘন্টা লাগল। উফ!’
অরু ঘাবড়াল। তন্ময়ের হয়ে সাফাই দিতে উতলা হলো, ‘ভাইয়া, আমি রেডি হতে সময় নিয়েছি। তন্ময় ভাই তো সেই কখন রেডি হয়েছেন।’
অরুর সহজসরল প্রত্যুত্তরে সবাই ফিক করে হেসে উঠল। অরু ঠিক বুঝল না কেন হাসাহাসি হচ্ছে। তবে বেশ লজ্জা পেলো। চুপসে গেল মুখটা। শুহানি মাহিনের কাঁধে দুটো চড় বসিয়ে –ধমকাল। এগিয়ে গিয়ে অরুকে টেনে নিজের পাশে এনে হেসে আশ্বস্ত করল, ‘ও মজা করছে।’
অরু এযাত্রায় বুঝতে পারল। অস্বস্তিতে পড়ল। শুহানি অরুর গাল ছুঁয়ে প্রশংসায় ভাসাল, ‘কী মিষ্টি লাগছে! আমাদের তন্ময় কী আর শুধু শুধু পাগল হয়েছে, হুঁ? এমন মিষ্টি দেখতে মেয়েটার জন্য পাগল হওয়াটাই স্বাভাবিক। আমারই তো তোমাকে আদর করতে ইচ্ছে করছে।’
অরু লাজুক ভঙ্গিতে চায়। বড়ো বড়ো চোখে হাসে। ভদ্রসভ্য ভাবে, ‘ধন্যবাদ’টুকু।’ বলে সেও প্রশংসায় মাতোয়ারা হয় শুহানির। তন্ময় পার্কিং এর দিক এলো। মাইক্রোর পেছনে এসে বনেট তুলল। ব্যস্ত হাতে কিছু ছোটোখাটো কার্যক্রম সেরে বনেট বন্ধ করল। সামনে এসে দরজা খুলে স্টিয়ারিং-এ বসল। চাবি ঘুরিয়ে গাড়ি স্টার্ট করে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। অরুকে আলগোছে তন্ময়ের পাশে চড়িয়ে দরজা লাগিয়ে দিল। সে গিয়ে উঠে বসল পেছনে। সবাই বসতেই তন্ময় গাড়ি স্টার্ট করল। তরতর করে চলতে শুরু করল গড়িটি। বেরিয়ে গেল বাগানবাড়ি ছেড়ে। লেকপাড়ের উদ্দেশ্যে।
সিলেটে ঘনঘন বৃষ্টি হয়। জনমুখে শোনা যায়, সিলেট বৃষ্টিতেই সুন্দর। অরুও তাই মানে। এভাবেই ও বৃষ্টি বলতে অজ্ঞান। তবে তন্ময়ের বিষয় ভিন্ন। সে বৃষ্টি পছন্দই করতো না। বলা চলে অপছন্দের ছিল। ইদানীংকালে অরুর জন্য একটু-একটু মেনে নিচ্ছে। তবে ঘুরতে গিয়েও বৃষ্টি মেনে নিতে তীব্র নারাজ সে।
এইযে ঘন্টাখানেকের মধ্যেই রোদ হারিয়ে গেল। সূর্য ডুবল! কালো কালো মেঘ আকাশ জুড়ে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। আশেপাশে উচ্চধ্বনিতে বজ্রপাত পড়ছে। এখনো ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়নি। তবে ফোঁটা ফোঁটা পড়ে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। শীঘ্রই ঝমঝমিয়ে নামবে বলে। ইতোমধ্যে তাদের গাড়ি লেকপাড়ে পৌঁছেছে। মানুষজন কম। নিরিবিলি বেশ। হৈ-হৈ করে বেরুলো সকলে। জনমানবশূন্য জায়গাটি মুহূর্তেই প্রাণোচ্ছল হয়ে উঠল। কাছের গোলাকৃতি দশ-বারো জনের টেবিলজুড়ে বসল রাজাদের মতন। গাড়ি-টা রাস্তার পাশে রেখে বেরিয়েছে তন্ময়। অরুকে নিয়ে এগুচ্ছে বন্ধুদের দিক। অরু মুখ তুলে চেয়ে ধীর কণ্ঠে আবদার সুরে বলল,
‘বসব না এখন। একটু লেকের কাছাকাছি যাব।’
তন্ময় আবদার মানল। বন্ধুদের ইশারা করে অরুকে নিয়ে চলল পাথরের লেকের দিকটায়। যেতে যেতে অরুর নরম হাতটা মুঠোভরতি করে নিলো। অরু এতে ক্যাটফুড পাওয়া সন্তুষ্ট বিড়ালে রূপান্তরিত যেন। মুখ টিপে মুচকি মুচকি হেসে চলল। তন্ময় নরম কণ্ঠে সতর্ক করল,
‘বৃষ্টি হবে। দু’মিনিটের বেশি না।’
জবাবে অরু মাথা দোলাল। তারা এলো লেকের কাছাকাছি। লেকের পানি স্বচ্ছ। নীলচে। গভীরটা দেখা যাচ্ছে। রঙবেরঙের ছোটো ছোটো পাথর আছে। অরু নিচে নেমে পানি ছুঁতেও প্রস্তুত। তন্ময় ওর হাবভাবের সঙ্গে পূর্বপরিচিত। আলতোভাবে হাত টেনে রাখল। এরমধ্যে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি হঠাৎ করেই ঝুম বৃষ্টিতে রূপান্তরিত হলো। তন্ময় অরুকে টেনে ছুটল বন্ধুদের দিক। বেশি দূরে যায়নি বলে পৌঁছাতে মিনিট খানেক লাগল। চুলগুলো ব্যতীত তেমন ভিজেনি দুজন। অরুকে ফাঁকা চেয়ারে বসিয়ে পাশে নিজেও বসল।
ইতোমধ্যে কফি এবং চা এসেছে। যার যেটা পছন্দ সে মোতাবেক অর্ডার দেয়া হয়েছিল। অরু চা নিলো চটপট। তন্ময় কফি। বৃষ্টির উচ্চধ্বনির রিমঝিম শব্দে মুখরিত চারপাশ। শুহানি চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলল,
‘আজ রাতে বারবিকিউ পার্টি করলে কেমন হয়?’
ঐশী চেঁচিয়ে বলে, ‘চমৎকার।’
রিয়ান তাকায় রুস্তমের দিকে। রুস্তম ভ্রু তুলে, ‘তাকানোর কী আছে? চাইলে করব। আমি বাবু চাচাকে কল করে জানাচ্ছি। সব বন্দোবস্ত করে রাখবে।’
ইব্রাহিম আঙুল নাড়িয়ে জানায়, ‘একটা নতুন টুন তুলেছি গিটারে। আজ তোদের শোনাব।’
এতে যেন উত্তেজনা বাড়ল। অরুও উজ্জ্বল চোখে তন্ময়ের দিকে তাকাল। তন্ময় ওর চোখে যেন আকাশের তারা দেখতে পেলো। কী সুন্দর পরিষ্কার উজ্জ্বল চোখদুটো! এই চোখদুটোর উজ্জ্বলতা দেখতে সে সব করতে পারবে। সব। তন্ময় রুস্তমকে বলল,
‘দে বাবু চাচার নাম্বার। আমি কথা বলছি। টাকাপয়সা চাচার কাছে আছে? রেখে এসেছিস কিছু?’
‘দিয়ে এসেছি। যা আছে হয়ে যাবে।’
বৃষ্টির মাত্রা বাড়ছে। বাতাসে বসে বৃষ্টি দুলে এসে শরীর ছুঁয়ে যাচ্ছে। তন্ময় দাঁড়িয়ে ফোনে আলাপ সারল। অন্যপাশে মাহিন, রিয়ান, ইব্রাহিম এবং সৈয়দ চাপাস্বরে কানে-কানে ফুসুরফাসুর করছে। চারজনের মাথা একত্রিত। তন্ময় আড়চোখে সে দৃশ্যে বিচলিত হয়।
সে নিজের বন্ধুদের ভালোভাবে চেনে। কিছু একটা নিশ্চয়ই পাকাচ্ছে! কী করতে চাচ্ছে ওরা? তন্ময়কে বসতে দেখে চারজনই আগের মত পিঠ এলিয়ে বসেছে চেয়ারে। যেন তার আড়ালে ফুসুরফাসুর করা ছেলেপেলে ওরা নয়। তন্ময়ও আর মাথা ঘামাল না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঠান্ডা কফিটা ফের হাতে নিলো। এলিজা শুহানি এবং ঐশীর উদ্দেশ্যে বলল,
‘আজ রাতে শাড়ি পরলে কেমন হয়? ভাবছি কিছু ছবি তুলব সবাই মিলে। আমি দুটো শাড়ি এনেছি।’
শুহানি খুশিতে আত্মহারা, ‘সাদা শাড়ি এনেছি আমি। দারুণ হবে।’ কথাটুকু শেষ করে শুহানি মাথা ঘুরিয়ে অরুকে শুধাল, ‘শাড়ি এনেছ, অরু?’
অরু মাথা দু’পাশে নাড়াল। সে তো জানতো না এতকিছু। জানলে নিশ্চয়ই সাথে আনতো। টপস, কামিজ এবং চুড়িদার ব্যতীত কিচ্ছুটি আনেনি সে। তন্ময় এরমধ্যে দ্রুত গলায় বাঁধ সাধল, ‘তোরা পর। ওকে এসবে জড়াস না।’ অরু শাড়িটাড়ি পরলে শুভকর হবে না বিষয়টা। এই অমঙ্গল সে হতেই দেবে না। মাহিন দুষ্টু ভঙ্গিতে হাসছে। ভ্রু নাচাচ্ছে। এযাত্রায় গুনগুন সুরে গান ধরল,
‘কিছু কিছু মানুষের জীবনে,
মধুচন্দ্রিমা না চাওয়াটাই ভুল।
সারাটিজীবন কাছে পেতে হলে…
করতে হবে এই একটিমাত্র ভুউউউল…..’
আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ। কোমল উষ্ণতাহীন বাতাস শরীর ছুঁয়ে যাচ্ছে। ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি নামছে। সবেমাত্র মাগরিবের আজান পড়েছে। লেকপাড়টা আঁধারে অদেখিত কাব্যিকে রূপান্তরিত হয়েছে। নিবিড়ভাবে নীরব চারদিক। আলোছায়াতে জড়ানো লেকপাড়টা মনোমুগ্ধকর। নৈকট্যে দুজন কপোত-কপোতীর আদল বোঝা যাচ্ছে। পাশাপাশি বসে নিঃশব্দে ভিজছে বৃষ্টির ছোঁয়ায়। তিমিরাচ্ছন্নতায় ডুবে থাকা লেকের পানি দেখছে অনন্যচিত্তে। অদূর হতেই সেই দৃশ্য অরু মুগ্ধ চোখে দেখছে। ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে তন্ময়ও একপলক তাকায়। ভ্রুদ্বয়ের মধ্যিখানে চারটে ভাঁজ পড়ে সঙ্গে সঙ্গে। অসন্তোষ হয় বড়ো। অনিন্দ্যসুন্দর কিছু তো নয়। এমনভাবে দেখার কী আছে? তন্ময় মাথা ঝুঁকিয়ে চাপাস্বরে শুধায়,
‘কী দেখছিস এত?’
অরু দৃষ্টি ফিরিয়ে আনে। সরল ডাগরডোগর চোখদুটোতে সুস্পষ্ট মুগ্ধতা। রিনরিনে কণ্ঠে বলে, ‘দেখেন তাদের কী দারুণ লাগছে দেখতে!’
তন্ময় বাধ্য হয়ে পুনরায় দৃষ্টি ফেলে অদূরে। অজানা মানব দেহ দুটোর অবয়ব দেখে। প্রিয়তমার মুখের ‘দারুণ’ শব্দের যথার্থ কোনো অনুভূতি তার অনুভব হয় না। তবুও নাকমুখে ‘হুম’ ধ্বনি তুলে ঐক্যমত্যতা প্রকাশ করে। এতে অরু উৎসাহিত হয়। আপ্লুত বদনে ফের চাইতে নিতেই— তন্ময় হাত বাড়িয়ে থুতনি ধরে আলতোভাবে। নিজের দিকে ওর মাথাটা ফিরিয়ে বলে,
‘অন্যদের দিকে চেয়ে থাকাকে অভদ্রতা বলে।’
অরু ঠোঁটে ঠোঁট টিপে। মাথা দুলিয়ে জানায়, ‘আর তাকাব না।’
তন্ময় সন্তুষ্ট হয়। থুতনি ছাড়ে। ডান হাতে ওর চুল বুলিয়ে আওড়ায়, ‘গুড গার্ল।’ পরপর সটানদেহে সামনে দৃষ্টি ফেলতেই আঁতকে ওঠে। রুস্তম, সৈয়দ, রিয়ান এবং মাহিন নির্নিমেষ নেত্রে চেয়ে। ওদের ঠোঁট দুটোর মাঝে সুবিস্তৃত ফাঁক। একই অবস্থা ঐশী এবং এলিজার। অন্যদিকে ইব্রাহিম, শুহানি শান্ত। নিঃশব্দে সকলের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। তন্ময় সামান্য কাশে। উঠে দাঁড়ায়। অপ্রস্তুত গলায় বলে,
‘চল ওঠ সবাই।’
মাহিন বত্রিশ দাঁত দেখাল এযাত্রায়। এক ঝটকায় দাঁড়াল। দ্রুতপায়ে তন্ময়ের কাছাকাছি এসে বামহাতে গলা পেঁচিয়ে ধরল। গাঢ়ভাবে দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে নিম্নস্বরে বলল,
‘মামা, তুই তো পুরাই গেছস। নিজেরে আয়নায় আজকাল দেখস? নাকি শুধু অরুকেই? মহা সৈকতের কত গভীরে আছস— জানস? ঠাঁই পাচ্ছস তো? তুই বোধহয় ডুবে ম র বি বলতেছি আমি।’
তন্ময় নির্বিকার ভঙ্গিতে হাত সরায়। পিছু ফিরে চায়। অরু শুহানির পাশে। ওদের সঙ্গে ধীরেসুস্থে হাঁটছে।
এখনো ঝিরঝিরে বৃষ্টি নামছে। সেই বৃষ্টি মাথায় নিয়েই মাইক্রোর দিকে এগুচ্ছে সবাই। হাঁটতে হাঁটতে তন্ময় অনাগ্রহী কণ্ঠে বলে,
‘ডুবেও শান্তি।’
মাহিনের মুখটা দৃশ্যকর ভঙ্গিতে হা হয়ে আসে। নিজেকে চটপট সামলে দানবের মতন অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। গেয়ে ওঠে উচ্চকণ্ঠে,
‘গভীর জলের ফিশ রে তুই,
গভীর জলের ফিশ।
আমরা তাই নাম দিয়েছি…
তন্ময় একটা চিইজ।’
মাহিন গেয়েও থামে না। নিরাশ গলায় ব্যক্ত করতে থাকে, ‘কথায় আছে ‘ডু নট জাজ আ বুক বায় ইট’স কভার।’ এই বাক্যটি তোর ক্ষেত্রে শতভাগ মিলতেছে।’
রিয়ান ভেজা গলায় সুরে সুর মেলায়, ‘ইব্রাহিম দোস্ত আমার! আমারে মাফ করে দিস রে। আগে যখন তুই আমাদের তন্ময়ের কীর্তিকলাপ সম্পর্কে বলতি—তখন আমরা হেসে উড়িয়ে দিতাম। আজ তার কারণে অনেকগুলো সরি।’
ঐশী তন্ময়ের দিকে একপলক চায়। পরপর দৃষ্টি সামনে রেখে বলে, ‘ভার্সিটিতে দেখতে চার্মিং বয় হলেও তন্ময়ের পার্সোনালিটি ছিল গম্ভীর। চুপচাপ। এখনো গম্ভীর এবং স্বল্পভাষী। তবে কে জানতো ও এমন রোমান্টিক! এতো ভালোবাসতে জানে! স্বচক্ষে না দেখলে বিশ্বাস করার মতন না।’
রুস্তম হেসে মাথা দোলায়, ‘আমরা আগে থেকেই জানতাম। তবে ওর প্রেমিক সত্তা সামনাসামনি দেখা এই প্রথম। তাই রীতিমত ধাক্কা খাচ্ছি।’
মাহিন আফসোস সুরে বলে ওঠে, ‘কী ভাগ্য মানুষের! চাচাতো বোনকে কোলেপিঠে বড়ো করে এখন বউ বানিয়ে নিয়েছে। এমন সুযোগ যদি আমাদেরও হতো…’ বাকি কথাটুকু আর মাহিন শেষ করতে পারল না। তন্ময় কঠিনভাবে চোখ রাঙাল। দাঁতে দাঁত পিষে বলল,
‘শাট-আপ, মাহিন।’
রিয়ান শব্দ করে হাসে। সৈয়দ বলে, ‘এই তোদের মনে আছে সেদিনের কথা? তখন অরু দশম শ্রেণিতে। ফুল দিয়ে অরুকে প্রপোজ করায় বাচ্চা ছেলেটাকে কী বেধড়ক মা ই রই না দিয়েছিল।’
তন্ময় আড়চোখে পিঁছু চেয়ে চাপাস্বরে ধমকাল, ‘থামবি তোরা?’ কথাটুকু বলে তন্ময় স্টিয়ারিং-এ উঠে বসল। এযাত্রায় তার পাশে এসে বসল রিয়ান। উচ্চকণ্ঠে গাড়ির সবার উদ্দেশ্যে জানাল,
‘আজ থেকে মেয়েরা এক সাথে থাকবে, সাথে অরুও। আমরা ছেলেরা একসাথে থাকব, সাথে তন্ময়ও।’
কিংকর্তব্যবিমূঢ় তন্ময় গাড়ি স্টার্ট করতে ভুলে যায়। ভ্রু তুলে শুধায়, ‘কী বললি?’
‘শুনিস নাই? আবার বলতেছি, শোন ভালো করে।’
তন্ময় আশ্চর্য না হয়ে পারল না। গতকাল থেকে সবগুলো তাকে জোরপূর্বক পারছিল না মধুচন্দ্রিমায় ডুবাতে। আর আজ সুর পরিবর্তন করে ফেলল? তন্ময়ের মুখ মুহূর্তে থমথমে হয়ে এলো। গম্ভীর হলো ভ্রুদ্বয়ে ছ’খানেক ভাঁজ। আড়চোখে সাইড মিরোরে দৃষ্টি ফেলল। অরু খোশমেজাজ নিয়ে গল্পগুজবে বিভোর। ও কি শুনেনি?
বাগানবাড়ির দরজা খুলে দিয়েছেন দারোয়ান ইয়াসিন মোল্লা। কেয়ার টেকার বাবু মিঁয়া তখন বাগানে দাপাদাপি করছেন। সবকিছু পরিপাট্য ভাবে বন্দোবস্ত করা শেষ। বড়ো ছাতার ছাউনি লাগিয়েছেন। গুণে-গুণে চেয়ার পেতেছেন। গোরুর গোশত, মুরগি, মাছ ম্যারিনেট করে রেখেছেন। সাউন্ড বক্সের ব্যবস্থা করেছেন। চারটে সাদা বাল্ব লাগিয়েছেন। অল্প সময়ের মধ্যে চমৎকার সব আয়োজন করে ফেলেছেন ভদ্রলোক। মাইক্রো পার্ক করতেই হুড়মুড়িয়ে বেরুলো সবাই। শুহানি অরুর হাত ধরে রাখল। বাধ্য করল নিজের সাথে বেরুতে। তন্ময় এই দৃশ্যে কুণ্ঠিত হলো। গাড়ি থেকে বেরিয়ে চাইল বন্ধুদের দিক। অথচ কেউই তার দৃষ্টিতে দৃষ্টি রাখল না। মুখ খোলার পূর্বেই শুহানি অরুকে টানতে টানতে বলল,
‘অরু, চলো ফ্রেশ হয়ে একটু রেস্ট নেবে। এরপর পার্টি হবে আজ।’
তন্ময় ভ্রু কুঁচকে দেখল। অরুর বদন ঘরের ভেতর হারিয়ে যেতেই বন্ধুদের দিকে তাকাল, ‘এসবের মানে কী?’
রিয়ান যেন কিচ্ছুটি বুঝছে না, ‘কীসের কথা বলছিস?’ কথা শেষ করে সেও ঘরের ভেতর ঢুকে গেল। একে-একে বাকিরাও। রুস্তম তন্ময়ের কাঁধ চেপে বলল, ‘দোস্ত, শুধু অরু অরু করলে হইব? আমাদের একলা সময় লাগব না? আজকে মাল আনছি। ইতালিয়ান বিউটি। এত্তো জোস ভাই। ১৯৭৫ এর মাল। টেস্টিইই…’
তন্ময় গম্ভীরমুখে বাঁধ সাধল সোজাসুজিভাবে, ‘আমি এসব খাচ্ছি না।’
সৈয়দ পেছন থেকে গুঁতো মারল, ‘তুই খাবি তোর বন্ধুগোষ্ঠীও খাবে।’
তন্ময় বাধ্যভাবেই ওদের সাথে রুমে এলো। বিছানায় মাহিন শুয়ে আছে। ইব্রাহিম চেয়ারে পায়ের ওপর পা তুলে বসে। রিয়ান জমিনে হাত-পা ছড়িয়ে– উদোম শরীরে শুয়ে; আপাতত সেলফোন টিপছে। তন্ময় ভালোভাবে ওদের মুখাবয়বে দৃষ্টি বিচরণ চালাল। তার মন খুঁতখুঁত করছে। কুঁ ডাকছে। কিন্তু কেন? এরমধ্যে বাবু মিঁয়া তন্ময়ের ল্যাগেজ হাতে দুয়ারে এসে দাঁড়ায়। তন্ময় বিস্ময়ে হকচকিয়ে ওঠে। বাবু মিঁয়া হেসে বলে,
‘বাবা, ল্যাগেজ নিয়ে আসছি। এইযে…’
রুস্তম আদেশ ছুঁড়ে, ‘ভেতরে রাখো, চাচা। অরুর ল্যাগেজ দিয়ে এসেছ না?’
‘হো। দিয়াই আইলাম মাত্র।’
রুস্তম মাথা দোলায় সন্তুষ্ট ভঙ্গিতে, ‘ঠিকাছে। আগুন ধরাও। আমরা আসতেছি।’
‘আইচ্ছা।’
বাবু মিঁয়া যেতেই তন্ময় রাগান্বিত চোখে বন্ধুদের দিকে চাইল। দাঁতে দাঁত পিষে গম্ভীরমুখে শুধাল, ‘হচ্ছেটা কী?’
মাহিনের সহজসরল জবাব, ‘কী হবে? ড্রিংক-ফ্রিংক করে তো আর অরুর কাছে যেতে পারবি না। তাই আজ আমাদের সাথেই থাকবি।’
‘আমি কখন বলেছি ড্রিংক করব?’ তন্ময়ের কণ্ঠে বিরক্তিপ্রকাশ ঝর্নার ন্যায় ঝরছে। তা বুঝেও যেন বুঝল না কেউ। প্রত্যুত্তরও করল না। নিজেদের মতন ব্যস্ত। তন্ময় হতাশায় মাথা নাড়ায়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মেয়েটা কি করছে কে জানে! ওরা ডাকল আর সাথে-সাথে ধেইধেই করে চলে গেল। কই তন্ময়কে তো জিজ্ঞেস করল না! ফিরে একটিবার তাকাল অবদি না। কী আশ্চর্য! কী নিষ্ঠুর ব্যাপারস্যাপার। সবাই আজ এমন তার বিপক্ষীয় দলে নাম লেখাল কেন?
সাউন্ড বক্স দুটো ছেড়েছে মাহিন। একটি ইংরেজি গান চলছে। রিয়ান ম্যারিনেট করা মুরগির পিসেস পুড়তে দিয়েছে। বাবু মিঁয়া উনুনের কার্যক্রমের দায়িত্বে অব্যাহত। সৈয়দ আধবসে দু’পায়ের পাতায় ভার ছেড়ে—মুরগির পিসেস গুলোতে তেল লেপ্টে দিচ্ছে। তন্ময় পায়ের ওপর পা তুলে গম্ভীরমুখে বসে। হাত ঘড়িতে নয়টা বিশ। আড়চোখে ঘনঘন চাইছে দুয়ার পানে। বাগানে আসবার পূর্বে অবশ্য একবার মেয়েদের রুমের সামনে গিয়েছিল সে। অরুকে সঙ্গে আনতে। দরজা লাগানো অবস্থাতেই শুহানি পরিষ্কার গলায় জানাল, অরু ব্যস্ত! আশ্চর্য রকমের কথাবার্তা! তন্ময়ের জন্য অরু কীভাবে ব্যস্ত হয়? অসম্ভব! অবিশ্বাস্য। সে বিশ্বাস করতে অপারগ। আর অরুটা কি করছে কী, হুঁ? তন্ময়ের গলার স্বর কী ও চেনে না?
ডাকার পরও কোনো প্রত্যুত্তর করল না! পুরুষভাবাপন্ন এক সুগভীর অভিমান তন্ময়ের গলা রোধ করে বসল। পুরুষালি হাতটা ব্যস্ত হলো একটা সিগারেট ধরাতে। সে সিগারেট খাওয়া বন্ধ রাখবে কেন? কার জন্য? আগেপাছে ঘুরে বেরানো, চব্বিশঘণ্টা ভ্যাবলার মতন চেয়ে থাকা প্রিয়তমার এইরূপ তার ঠিকঠাক হজম হলো না। সিগারেটে দুটো অবহেলিত টান মেরে ফের চাইল। সেসময় ঐশীকে দেখতে পেলো বেরোতে। কালো জামদানি শাড়ি পরেছে। পরপর এলিজাকেও দেখা গেল। দুজনের শাড়ি একইরকম প্রায়। তন্ময় ডান হাতটা নিচু করল। সিগারেট লুকাল। দৃষ্টি দুয়ারপানে নিবিড় হলো। অথচ মিনিটখানেক পরও অরুকে দেখা গেল না। এলিজা এসেই অশান্ত তন্ময়কে দেখে মুখ টিপে হাসল। তন্ময় বিরক্ত গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ল,
‘অরু কোথায়?’
ঐশী ভেংচি কাটল, ‘কোথায় আবার? রুমে!’
‘ওকে আনিস নাই কেন?’
এলিজা দাঁত দেখিয়ে হাসল, ‘গল্প করছে শুহানির সাথে। শুহানি আর রিয়ানের প্রেম কাহিনী শুনছে।’
এই কথা শুনে রিয়ান পিলে চমকে ওঠে। চোখমুখ কালো করে ফেলে। বিড়বিড়িয়ে বলে, ‘ওর প্রেম কাহিনী বলা মানে একই ব্যাপার বলা। আমি প্লে বয় ছিলাম। অনেক মেয়ের সাথে প্রেম করেছি এটসেট্রা!’
তন্ময় যেন এই সুযোগটুকুর অপেক্ষাতেই ছিল। মুহূর্তেই লুফে নিলো, ‘ছিলিই তো? কতশত মেয়ের সাথে তরঙ্গলিলা করছিস তা গুণে শেষ করা সম্ভব না। আমি মিথ্যে বললেও শুহানি তো আর মিথ্যে বলবে না। ও আসুক। জিজ্ঞেস করব। সরাসরি প্রমাণ হবে।’
রিয়ান আশ্চর্য হলো, ‘খবরদার দোস্ত! এই ব্যাপারটা তুলিস না। ও শুরু হলে আর থামবে না। জানিস না তো কিছুই। গতমাসে আমার সাথে চারদিন যোগাযোগ রাখেনি। আমি ম রতে ম রতে বেঁচে ফিরছি। এই আলাপ শুনলে আবার কথা বলা বন্ধ করবে।’
তন্ময়ের সাবলীল স্বীকারোক্তি, ‘আমি তাই চাচ্ছি।’
হেসে উঠল উপস্থিত সকলে। তন্ময় ফের সিগারেট ঠোঁটে ছোঁয়াল। বাম হাতে ফোন বের করল। অরুকে ইতোমধ্যে দুটো মেসেজ পাঠিয়েছে। জবাব আসেনি। এবারে কল করল। রিং হচ্ছে, তবে রিসিভ হলো না। প্রেম কাহিনীতে কি এমন আছে যে ও তাকেও মনে রাখেনি। আসুক একবার। খবর আছে ওর। ধপধপ করে বুকের মধ্যিখানে জ্বলতে থাকা আগুন যেন বেড়েই চলেছে ক্রমান্বয়ে। নেভার নাম মাত্র নেই। মাহিন সহ বাকিরা মিটিমিটি হাসছে। এযাত্রায় চেয়ারে শব্দ করে বসল মাহিন। চিন্তিত গলায় শুধাল,
‘কীরে আমাদের বেইবি কই?’
রাগে তন্ময়ের কপালের শিরা ফুটে উঠল। অতিমাত্রা বিরক্ত দৃষ্টি কঠিনভাবে তাঁক করল। মুখ খুলে কিছু ভাষণ ছাড়বে পূর্বেই এলিজার গলা শোনা গেল,
‘এইতো চলে এসেছে শুহানি, অরু!’
তন্ময়ের ভ্রুদ্বয় শিথিল হলো। অশান্ত হৃদয় শান্ত হওয়ার পথে। ততক্ষণাৎ ঘাড় ফেরাতে নিয়েও ফেরাল না। একটু সময় নেয়ার চেষ্টা করল। লাভের লাভ কিচ্ছুটি হলো না। মন লাভলোকসান মানল না। দ্রুত গতিতে তাকাতে বাধ্যই হলো। ক্ষণিকের জন্য স্তম্ভিত হয় হৃদয়। দৃষ্টি নিষ্ঠুরভাবে থমকে পড়ে। গভীর হতে থাকে দৃষ্টির মানে। হাতের জ্বলন্ত সিগারেটটা পড়ে গেছে। সেলফোনটা পড়ার ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। তন্ময় আচমকা দাঁড়াতেই চেয়ার উলটে যায়। উচ্চধ্বনিতে হেসে ওঠে বন্ধুরা। এতেও তন্ময়ের হেলদোল হয় না। অদূরেই হাসতে থাকা শুভ্র রঙের জর্জেটের শাড়ি পরিহিত অরু ছাড়া যেন পৃথিবীতে কিচ্ছুটি নেই। কোনো শব্দ নেই। মাহিন চেঁচিয়ে উঠল,
‘শুহানি, ইউ ডিড আ গ্রেট জব, ম্যান!’
শুহানি শব্দ করে হাসল। অরুর হাতটা তখনো ধরে থাকল। ছাড়ল না। তন্ময়ের কাছাকাছি যেতেও দিলো না। অরু তখন লজ্জায় নেতিয়ে আছে গোলাপ ফুলের ন্যায়। চোখ তুলে তাকাতেও পারছে না। তন্ময় যেন সম্মোহন হলো। কিছুই আর চোখে লাগল না। এযাত্রায় আর বাঁধসাধ, চোক্ষুলজ্জাও মানল না। সবার সম্মুখেই অরুর সামনে চলে এলো। হাতটা ধরল প্রথমে আলতোভাবে। অতঃপর গাঢ়ভাবে, শক্ত করে। টেনে নিজের দিকে আনতেই পুনরায় শোরগোল শুরু হলো। সিটি বাজার আওয়াজ শোনা গেল। হাততালির, হাসাহাসির উচ্চ শব্দ। তন্ময় যেন ওসব কানেও তুলল না। অন্যদিকে অরুর আজ নাজুক অবস্থা। সে হাত আলগোছে ছাড়াতে চাইল। ফিসফিস করে বলল,
‘তন্ময় ভাই, সবাই হাসছে।’
তন্ময় হাত ছাড়ল না। উলটো দ্বিগুণ শক্ত করে ধরল। অন্যরকম হয়ে এলো তার কন্ঠের সুর, ‘তাতে কী?’
অরু হকচকাল। মাথা তুলে চাইল। ফের দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। তন্ময় ওকে নিয়ে পাশাপাশি চেয়ারে বসল। সৈয়দ গিটার এনে রেখেছে চেয়ারে। ইতোমধ্যে বারবিকিউ রেডিই। টেবিলে পরিবেশন করা হয়েছে।
সাউন্ড বক্স বন্ধ। সৈয়দ গিটারে সুর তুলছে। মুখে গুনগুন করছে। এরমধ্যে দু’চার ফোঁটা করে পুনরায় বৃষ্টি নামতে শুরু করেছে। মুশলধারা বৃষ্টি নামল এক মুহূর্তেই। চোখের পলকে! সৈয়দও উচ্চকণ্ঠে গাইতে শুরু করল। তন্ময়ের দৃষ্টি সামনে তবে ওদিকে মনোনিবেশ নেই। তার সকল ধ্যানধারণা কাছে –বড্ড পাশে বসা রমণীতে। অরু চুপচাপ কুণ্ঠিত হয়ে বসে। দৃষ্টি সামনে। সৈয়দের গান শুনছে একচিত্তে। গানটা হয়তোবা ওর পছন্দ হয়েছে। অপ্রস্তুত, লজ্জা ভাবটা কাটিয়ে উঠেছে। শুহানির দেখাদেখি নিজেও গুনগুন করছে। তন্ময় এক সেকেন্ড চোখ বন্ধ করল। ভেসে উঠল সাদা শাড়ি পরিহিত অরু। চোখের পর্দায় ভাসল সাদা শাড়িতে লেপ্টানো ফরসা পেট, পাতলা কোমর। পরমুহূর্তেই চোখ খুলে পাশে তাকাল। তার দৃষ্টি অনুভব করে অরু মিইয়ে গেল দৃশ্যমান রূপে। লাল হয়ে উঠল কানের লতি। তন্ময় রক্তিম কান ছুঁয়ে দেয়। বুকের ভেতর জ্বলতে থাকা আগুন যেন কণ্ঠে এসে ভীড় জমিয়েছে,
‘শাড়ি পরেছিস কেন?’
অরু নড়েচড়ে ওঠে। হাঁসফাঁস করে জানায়, ‘আপু বললেন পরতে।’
‘পরতে বললেই পরতে হবে? তাও এমনভাবে!’
অরু চোখ তুলে তাকায়। কেমন ভাবে? ওর প্রশ্নাত্মক চাহনিতে দৃষ্টি রেখে তন্ময় সরাসরি অরুর পেটের কাছটায় চায়। অরুও দৃষ্টি অনুসরণ করে চাইল। কাছাকাছিভাবে পরিষ্কার পেট দেখা যাচ্ছে। মুহূর্তেই মেয়েটা লজ্জায় আড়ষ্ট হয়। দ্রুত আঁচল জড়ো করে পেটের দিকে। চিন্তিত গলায় বলে,
‘আমি খেয়াল করিনি। আপু নিজের মতন পরিয়ে দিলেন।’
তন্ময় দেখল নিগূঢ়ভাবে কিয়ৎক্ষণ। অরুর পেছনে —ঠিক চেয়ারের ওপর থাকা তার হাতটা উশখুশ করছে। কয়েকবার ইচ্ছেটুকুকে ক বর দিতে চেয়েও পেরে উঠল না। আকস্মিক সে পেছন থেকেই অরুর শাড়ির ভাঁজ ভেদ করে কোমর ছুঁয়ে দিল। থরথর করে কাঁপল স্পর্শিত দেহটি। অরু ভয়ার্ত চোখে চাইল একপলক। সরে যাবার সামান্য প্রচেষ্টা। তন্ময় গ্রাহ্য করল না। শুধুমাত্র ছুঁয়েও থামল না। পুরুষালি রুক্ষ, শক্ত হাতে চেপে ধরল তুলতুলে পাতলা কোমর। পেটের কাছটা ছুঁতেই অরু নড়েচড়ে ওঠে। তন্ময় সেভাবেই শুধাল দাম্ভিক ভাবে,
‘ফোন কোথায়? কল ধরিস নাই কেন?’
শাহজাহান তন্ময় পর্ব ৫৯+৬০
অরু তোতলাল। পরিপূর্ণ প্রত্যুত্তর করতে পারল না। তন্ময় ঘনঘন শ্বাস ফেলল, ‘তুই কি চাচ্ছিস আমি ম রে যাই? ওরা চাচ্ছে আমাকে মা রতে, আর তুইও রেডি, হুঁ?’
অরুর নরম হাত দুটোও পেটে কাছটায়। বারংবার বৃথা, দুর্বল চেষ্টা শক্তসমর্থ পুরুষালি হাতটা সরানোর। তন্ময়ে আরেকটু গভীর হয়ে বসল। কণ্ঠ আকাশের মতন বিস্তৃত তবে সমুদ্রের ন্যায় গভীর,
‘তোকে দেখে একশো তিন ডিগ্রী জ্বর উঠে গেছে শরীরে।’
