শাহজাহান তন্ময় পর্ব ৬৫+৬৬

শাহজাহান তন্ময় পর্ব ৬৫+৬৬
Nabila Ishq

বাতাসে যেভাবে গাছের পাতা নাচে, ঠিক সেভাবেই
মাহিন কাঁধ নাচাল চমৎকার ভঙ্গিমায়। মুখ চালাল বদমাইশি ইশারায়,
‘আমরা বললেই কালা। তুমি করলেই ভালা।’
তন্ময় দাঁতে দাঁত পিষে বলে ওঠে, ‘স্কাউন্ড্রেল-এর মতন একই ব্যাপার নিয়ে পড়ে আছিস কেন? থাম এবার।’
মাহিন হোঁচট খেলো যেন গুরুতর, ‘আমি স্কাউন্ড্রেল?’
তন্ময় নাক সিটকাল। নির্বিকার গলায় প্রত্যুত্তর করল,
‘না। তবে মুখ চলতে থাকলে হতেই পারিস।’
মাহিন দানবের মতন শব্দ করে হাসল। এগিয়ে এসে তন্ময়ের উসকোখুসকো চুলগুলো এলোমেলো করে জানাল, ‘আই ডোন্ট কেয়ার।’

তন্ময় মাথা ঘামাল না। দু’হাতে চুলগুলো পরিপাটি করে ফেলল দু’ধাঁপে। রিয়ান এইমুহূর্তে অতিমাত্রায় অস্বাভাবিক শান্ত। চেয়ারে বসে গুনগুন করছে নিজমনে। তন্ময় নির্বিকার চোখে একবার দেখল আপাদমস্তক। আশ্চর্যও হলো বটে। আগ বাড়িয়ে ঝামেলা পাকাতে চাইছে না। এই তো দারুণ ইম্প্রুভমেন্ট। তন্ময় ভাবল প্রশংসা করবে। মুখ খোলার পূর্বেই আচমকা কণ্ঠ দমিয়ে রিয়ান শুধাল,
‘দোস্ত, দিন-দুনিয়া আজ একটু বেশি চমকাল লাগছে না তোর? মনে হচ্ছে না স্বর্গে আছিস? যেখানে রংবেরঙ এর ফুল উড়ছে। মৌমাছি মধু খাচ্ছে। মাধবীলতা…. ’
তন্ময় গিলে নিলো প্রশংসাটুকু। চোখ রাঙাল কঠিনভাবে। বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল। ওদের ফেলে ভেতরে রওনা হলো। এদের সামনে থাকা আর ধৈর্যের পরিক্ষা দেয়া একই ব্যাপার। মাহিন গান ধরল,
‘ও বন্ধু তুমি কই, কই রে…
এই প্রাণো বুঝি যায় রে…
ও তুমি ছাড়া বাঁচি না…..’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মৃদুল হাওয়ায় হেলেদুলে চলেছে কৃষ্ণচূড়া গাছের লতাপাতা। মগডালে বসা পাখি জোড়াও; তালে তাল মিলিয়ে দুলছে আদুরে ভঙ্গিতে। ঝরে পড়ছে কৃষ্ণচূড়া ফুলগুলো। কয়েকটি ফুল হাওয়াতে ভেসে এসে ছুঁয়েছে বারান্দার জমিন। গাছের পেছনেই সূর্য বসেছে। গাছের ফাঁকফোকর দিয়েই দীপ্তি ছড়াচ্ছে প্রাঙ্গণে। বারান্দায় একটি সেকেলে কাঠের চেয়ার পাতা। সেটির কয়েকটি যায়গা ঘুণে খেয়েছে। অরু সেই চেয়ারটিতেই বসেছে —দু’পা বুকে জড়িয়ে। মাথাটা হাঁটুতেই এলিয়ে রেখেছে খুব আনমনা ভঙ্গিমায়। চাপাস্বরে গুনগুন সুরে গান গাইছে। একটি সেকেলে বাংলা গান। গানটার নাম তন্ময় জানে না। তবে পূর্বে শুনেছে বোধহয়। গাঢ়ভাবে কান পাততেই দুটো সংলাপ শুনল,
‘একটুস খানি দেখো, একখান কথা রাখো…
ভালোবাইসা একবার তুমি বউ কইয়া ডাকো….’

গোধূলির সময় তখন। নিভৃতে, নিভতে বসা সূর্যের সোনালি রশ্মি অরুর শরীর ছুঁয়েছে। কালো চুলের বাহার পিঠ জুড়েছে। মুখের একটিপাশ চুলে ঢাকা। চোখজোড়া বন্ধ। ওর গায়েতে তখনো তন্ময়ের সুডৌল দেহের কালো শার্ট-টি। ঢোলা একটি সাদা প্যান্ট পরনে। প্যান্টের ভেতরে হারিয়েছে পায়ের পাতা জোড়া। মিনিটখানেক হবে তন্ময় এসে দাঁড়িয়েছে কৃষ্ণচূড়া গাছটার সামনে। সুস্পষ্ট শুনেছে অরুর হাস্যোজ্জ্বল কণ্ঠের সুর। এবেলায় কয়েক’পা এগুতেই, পুরুষোত্তম পা’তলে শুকনো পাতার স্পর্শতেই; খসখসে শব্দ হলো। নীরবতা ভাঙল। অরু তক্ষণ –তড়িৎ মাথা তুলে চাইল। তন্ময়কে দেখতে পেয়েই মুখ ভরে হাসল।

হেমন্তের বিকেলের গোধূলির মতন দেখতে সেই হাসি। যা দেখেই শান্তিবোধ করে তার মনপ্রাণ। জুড়িয়ে আসে নয়নযুগল। ধুকপুক করে অন্তর। ঘাসের ওপরে অবলীলায় পড়ে থাকা পাতা গুলো পিষে সামনে এগোয় তন্ময়। আশেপাশে বসে কোলাহল তোলা পাখি গুলো, এযাত্রায় আতঙ্কে ছটফটিয়ে উড়ে পালাল। বসল অদূরের নারকেল গাছটার সুউচ্চ মগডালে। বারান্দার কাছাকাছি এসে কাঠের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ায় তন্ময়। চাইলেই সে লাফিয়ে উঠে যেতে পারে বারান্দায়। অরুর একেবারে কাছে, ঠিক পাশে। তবে তা সে করল না। সেভাবেই দাঁড়িয়ে দেখল দু’হাত দূরে বসা অরুকে। হাসছে ওর চোখজোড়া। চোখের মণিতে ভাসছে নক্ষত্র। নক্ষত্রে ভাসছে তন্ময়ের মুখ। অরু উঠে না। একইভাবে হাঁটু জড়িয়ে রেখেই উল্লাসিত গলায় শুধায়,

‘ভাইয়ারা বেরিয়ে পড়েছেন?’
‘হুঁ।’ তন্ময়ের সাবলীল জবাবটুকুর পরপরই অরু ফের উৎফুল্ল স্বরে শুধায়, ‘কোথায় যাবেন তারা? চা-বাগান?’
আজ তন্ময়দের বেরুনোর কথা ছিল সকাল-সকাল। যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল চা-বাগানে। অরু যাওয়ার জন্য তীব্র উদগ্রীব ছিল। বলা চলে, ওর দু’চোখ ভরতি উচ্ছ্বাস দেখা দিয়েছে। তবে গত রাতের ঘটনার পর আজ আর বেরুনোর প্রশ্নই ওঠে না। কোনোভাবেই সে আজ অরুকে বেরুতে দেয়নি। নিজেও কোথাও যায়নি। আজ অরুর দিনব্যাপী বিশ্রাম নিতে হবে। তন্ময় পাশে থেকে সঙ্গ দেবে।

‘হুঁ। আশেপাশেই। কেন? তোর যেতে ইচ্ছে হচ্ছে?’
অরু মাথা নাড়াল। দৃষ্টি অদূর কৃষ্ণচূড়া গাছে। আদুরে, ভ্রম গলায় বলল, ‘উহুঁ। যেতে ইচ্ছে করছে না।’
তন্ময় ভ্রু তুলল। আগ্রহী হলো। শান্ত-স্থির কন্ঠে জিজ্ঞাসাবাদ চালাল ‘আমি ভুল না হয়ে থাকলে, তুই খুব এক্সাইটেড ছিলি চা-বাগান যাবি বলে। তাহলে এখন কেন ইচ্ছে করছে না?’
অরুর ছন্নছাড়া দৃষ্টি এদিক-ওদিক ছুটতে ব্যস্ত। দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলনে অপারগ। দ্বিধান্বিত মিনমিনে স্বরের প্রত্যুত্তর শোনা গেল সময় নিয়ে,
‘আমি সেসব জায়গাতে যেতে এক্সাইটেড যেখানে আপনি আছেন। যেহেতু আপনি এখানে সেহেতু আমি এখানে থাকতেই এক্সাইটেড।’

ধুকপুক, ধুকপুক, ধুকপুক! তন্ময়ের হৃদয়ের এই অশান্ত ধুকপুক শব্দ কি অরু শুনতে পারছে? বুঝতে কি পারছে ওর এই সাধারণ-সাবলীল কথাটুকুর প্রভাব কতটা গাঢ়ভাবে ছুঁয়েছে তাকে? কীভাবে কাঁপছে তার পিঞ্জর— জানতে কি পারছে? নিপুণভাবে চোখজোড়া শক্ত করে বুজে নিলো এইমুহূর্তে। হৃৎপিণ্ডটা লাফাচ্ছে। ধড়ফড়িয়ে উঠছে থেমেথেমে। বুক ভরে লম্বা শ্বাস টানল তন্ময়। চোখ মেলে চাইল। ততক্ষণাৎ তার গভীর দৃষ্টিতে অরুর উৎসুক দৃষ্টির মিলন ঘটল। আশেপাশে কোথাও বজ্রপাত হলো নাকি তার অন্তরে? অরুর নাজুক মুখটা লাজুকলতায় মিইয়ে এলো। তন্ময় এবেলায় মুখ ভরে হাসল। তার গম্ভীরমুখে হাসির ঝলক দেখা আর আকাশের চাঁদ দেখা বুঝি একই বিষয়! নাহলে অরু এত আশ্চর্য হবে কেন? ভ্যাবলার মতন চেয়েই বা রবে কেন? তন্ময় লাফিয়ে বারান্দায় উঠে পড়ে। অরু সটানদেহে বসেছে এবারে। তন্ময় ওর সামনাসামনি এসে দাঁড়িয়েছে। মাথা ঝুঁকিয়ে চোখে চোখ রেখে– দারুণ নির্বিকার গলায় বলে ওঠে,

‘আমার সব ব্যথার, অসুখের এক চমৎকার মেডিসিন আছে।’
সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটা বড়ো করে ফেলে চোখজোড়া। আশ্চর্য! সব ব্যথার এক মেডিসিন হয় নাকি? মেডিসিন নাম জানতে অরু ব্যাকুল হয়ে পড়ে, ‘ও মাই গড! সব অসুখের এক মেডিসিন হয় নাকি? কী নাম?’
‘অরু মেডিসিন। আমার আরাধনা।’
তন্ময় কাছ থেকে নিবিড়ভাবে দেখে অরুর লজ্জাশীল মুখ। মুখচোরার মতন ছটফট করে চলেছে। দৃষ্টি রেখেছে জমিনে। যেন চাহনি তার দিক ফেললেই ওর ফাঁ সির রায় হবে। হেসে তন্ময় পায়ের পাতায় ভার ফেলে হাঁটু উঁচিয়ে বসে। আলতোভাবে ছোঁয় অরুর ডান’পা। মুহূর্তেই নড়েচড়ে ওঠে অরু। সীৎকার করে চাপাস্বরে,

‘তন্ময় ভাই….’
প্যান্টের শেষ অংশ ভাঁজ করতে নিয়েই তন্ময় চোখ তুলে ভ্রু নাচিয়ে শুধায়,
‘হুমমম?’
অরু নির্বাক চোখে চেয়ে রয় শুধু। পলক ফেলতেও দ্বিধান্বিত যেন। দু’পায়ের প্যান্ট ভাঁজ করে উঠে দাঁড়ায় তন্ময়। হাত বাড়িয়ে দেয়। অরু হাতে হাত রাখে। দাঁড়াতে নিতেই তন্ময় পাঁজাকোলে তুলে ফেলে ওর ছোট্টোখাটো দেহ খানা। ঠোঁট নামিয়ে কপালে ত্বরিত চুমু বসাল। সূর্য তখন অর্ধেক ডুবেছে। ক্ষণিকের মধ্যেই পরিপূর্ণ রূপে ডুববে বলেই।

রুপার থালার মতন গোল একটি চাঁদ ভেসেছে আকাশে। গাছগাছালির মাথার ওপর ওইতো দেখা দিচ্ছে। আবছায়াতে গাঁথা নিস্তব্ধতা ভেঙে ঝিঁঝিঁপোকাদের কোলাহল কর্ণগোচর হচ্ছে। কৃষ্ণচূড়া ফুলের ঘ্রাণ ভেসে আসছে। তন্ময় জানালা দিয়ে একটিবার দেখে নিলো দৃশ্যটুকু। ফের চাহনি রাখল অরুতে। স্যুপ খাচ্ছে বিছানায় বসে। সামনে ল্যাপটপ খোলা। বলিউড মুভি দেখছে। মুভির সারসংক্ষেপ বলছে একটু পরপর। নায়ক-নায়িকার সৌন্দর্যের বিবরণ এই নিয়ে গুণে-গুণে তিনবার দিয়েছে। এইমুহূর্তে অরুর ফোন বেজে ওঠে। তন্ময় ভুল না হলে, মারজির কল এসেছে। সাধারণত এমন অসময়ে মারজি কল করে থাকে। আজও ব্যতিক্রম হওয়ার কথা নয়। অরু স্ক্রিনে নজর ফেলেই আনন্দিত হলো। চটপট কল রিসিভ করে কানে চাপল। তন্ময় চেয়ার ছেড়ে উঠল। কথা বলার সামান্য প্রাইভেসি দিতে বেরিয়ে এলো রুম থেকে। বাবু মিঁয়া করিডোর জুড়ে ঘুরপাক খাচ্ছেন অসময়ে। ভদ্রলোক মহা চিন্তায় দরবেশ বনেছেন যেন। তন্ময়কে দেখেই চিন্তিত স্বরে জানালেন,

‘বাবা, সাহেব তো অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। রুস্তম বাবার কালই ঢাকা ফিরতে হবে।’
তন্ময়ের ভ্রুদ্বয় কুঁচকে আসে মুহূর্তেই,
‘খুব সিরিয়াস কিছু?’
‘না। তবে জ্বর, ঠান্ডা, সর্দি ভালোভাবেই শরীরে বিঁধেছে।’
‘রুস্তমকে জানিয়েছেন?’

বাবু মিঁয়া ইতস্তত করেন, ‘না। ভাবছিলাম বাবা ফিরুক। তারপর নাহয় জানাব। রাস্তাঘাট তো ভালো না।’
তন্ময় এক্ষেত্রে একমত। ওরা সহিসালামত ফিরুক সবাই। প্রয়োজনে আগামীকাল একত্রে ঢাকা রওনা দেয়া যাবে। এভাবেও তন্ময়ের একাধিক কাজ পেন্ডিং জমেছে। ঢাকা ফিরে লম্বা সময় ব্যস্ত থাকা লাগবে। তখন অরুর কী হবে? ও তো ব্যস্ততা বুঝতেই চায় না। অভিমান করে, কাঁদে। এখন শুনলেই হয়েছে আগামীকাল ফিরে যাবে; ততক্ষণাৎ মুখ বেজার করে রাখবে দীর্ঘক্ষণ। আর তন্ময় সইতেই পারে না অরুর অভিমান, কান্নারত মুখশ্রী। আলগোছে বেরিয়ে আসে প্রাঙ্গণে। হাত ঘড়িতে আটটা ত্রিশ তখন। পকেটে দু’হাত ভরে চায় আকাশে। অনুভব করে পেছনে কারো উপস্থিতি। কিয়ৎক্ষণের মধ্যেই তার সুডৌল পুরুষোচিত কোমরে— একজোড়া শীর্ণ হাতের অস্তিত্ব মিলে। বিস্তৃত পিঠ ছোঁয় মসৃণ গাল। সুমধুর কণ্ঠস্বর অভিমানে জর্জরিত,

‘কাল ফিরে যাচ্ছি?’
কোমরে থাকা কোমল হাত দুটো নিজ বাম হাতের মুঠোয় ভরে তন্ময় ঘুরে। ওর ডান হাত তার প্রশস্ত বুকে চেপে ধরে। মাথা নুইয়ে দাঁড়ানো অরুকে একচিত্তে দেখে। ডান হাতে অরুর থুতনি ধরে মাথা উঠিয়ে; চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন ছুঁড়ে,
‘হুঁ। কেন, যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না?’
‘ফিরেই তো কাজে ব্যস্ত হয়ে যাবেন।’
তন্ময় হেসে ফেলে। অরুর চুল বুলিয়ে আওড়ায়, ‘তা তো হবোই। বউ পালতে হলে, টাকা তো কামাতে হবে।’

রূপালি থালার মতন গোল উজ্জ্বল চাঁদটা আর নেই। মেঘেদের আড়ালে ডুবেছে। ঝিঁঝিঁপোকাদের কোলাহল সুস্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। স্বচ্ছ আকাশপথে এবেলায় কালো মেঘেদের আনাগোনা চলছে। মৃদু হাওয়ার বেগে বৃষ্টি-বৃষ্টি ঘ্রাণ লেপ্টেছে। মনে হচ্ছে, শীঘ্রই বৃষ্টি নামবে। অবশ্য এভাবেও সিলেটে ঘনঘন বৃষ্টি হয় বলে শোনা যায়। এখানে অসময়ে বৃষ্টি নামাটাই বরং স্বাভাবিক। অরু আলতোভাবে মাথাটা রাখল তন্ময়ের সুবিস্তৃত, শক্তপোক্ত পুরুষোচিত বুকের মধ্যিখানে। তার নিভু কণ্ঠে আকাশ সম অভিলাষ,
‘আগামীকাল তো ফিরে যাচ্ছি। আজ একটু ঘুরে আসি?’ কথাটুকু শেষ করে লম্বা শ্বাস টেনে নেয় অভ্যন্তরে। ফের চকিতে বলে, ‘প্লিইইইজ? আমরা তো বেরোলামই না।’

তন্ময় সিলেট এসেছিল ওকে নিয়ে ঘুরতে। গতকাল রাতের কার্যাবলী না করে থাকলে অনায়াসেই ঘুরেফিরে বেড়ানো যেতো। অরুর শরীর এমনিতেই নাজুক, শীর্ণ। এই শরীর নিয়ে ও ঘুরতে-ফিরতে পারবে না বলেই তো এতো নিষেধাজ্ঞা তার। অথচ মেয়েটা বুঝতেই চাইছে না। সবকিছু কি ওকে মুখে– ভেঙেচুরে বলে বোঝাতে হবে? তারপর তো নিজেই লজ্জায় মুখ লুকোতে ব্যস্ত হবে। ঘণ্টাখানেক চোখে চোখও রাখবে না। বুকে মিশে থাকা মাথাটায় রুক্ষ হাত বুলিয়ে তন্ময় গভীর গলায় শুধাল,
‘একটুও খারাপ লাগছে না?’
অরুর মুখটা শক্তপোক্ত বুকে ঢুকে গেল যেন। সেভাবেই মাথা দু’পাশে দৃঢ়ভাবে নাড়াল। এক পর্যায়ে মাথা তুলে চাইল। ওর লাজুক গাল দুটো তখন বৃষ্টির স্পর্শ পাওয়া সবুজ পাতার মতন সতেজ,
‘লাগছে না।’

প্রেয়সীর আবদারের সমীপে তন্ময় দুর্বল সৈনিক। বাধ্য পুরুষের ন্যায় মাথা দোলাল। গাল ছুঁয়ে বলল,
‘গেট রেডি। আমি গাড়ির বের করছি।’
অরু সাদা ফকফকে দাঁত দেখিয়ে হাসল। হাসিতে মুক্ত ঝরেঝরে পড়ছে যেন,
‘গাড়ি লাগবে না। হেঁটে বেরোব। রিকশা চড়ব।’
‘বেরোনার কোনো প্রয়োজন নেই তবে।’
‘হে হে, আমি মজা করছি।’ বলেই অরু ছুটল ভেতরে। ঘুরেবেড়ানোর বিষয়ে ও সর্বপ্রথম এগোবে। উচ্ছ্বাসে ওর গলা রোধ হয়ে আসছেই বলে। তন্ময় নিজেও এগোল অন্দর পানে। বাবু মিঁয়াকে পেলো গেস্টরুমে। বসে লুডু খেলছেন দারোয়ানের সাথে। তন্ময় প্রশ্ন ছুঁড়ল,
‘গাড়ির চাবি আছে আপনার কাছে, চাচা?’
‘বেরোইবা বাবা?’
‘জি। এই একটু আশেপাশেই যাব।’
বাবু মিঁয়া উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলতে থাকলেন, ‘আছে সাদাটার। তয় তেল কম বোধহয়।’
‘ব্যাপার না। ভরে নেব প্রয়োজনে।’

বাবু মিঁয়া এনে দিলেন সাদা গাড়ির চাবি। তন্ময় চাবি হাতে বেরোল ফের। পার্কিং এরিয়াতে এসে ঢাকা সাদা গাড়িটার কালো কাপড় টেনে সরাল। দরজা খুলে ড্রাইভিং-য়ে বসল। গাড়ি বের করে বেরোল। দারোয়ান দরজা খুলে দাঁড়িয়েছে। এরমধ্যেই হাতের উল্টোপিঠে এসে বসল একফোঁটা জল। পরপর বড়ো বড়ো বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করল। অরু বেরোল এযাত্রায়। মেরুন রঙের কামিজ পরেছে। তন্ময় দরজা খুলে ধরেছে। অরু বসতেই দরজা লাগাল। ওপরপ্রান্তে এসে ড্রাইভিং-য়ে বসল। গাড়ি স্টার্ট করে বেরোল বাগানবাড়ি ছেড়ে। ততক্ষণে ঝুম বৃষ্টি নেমে গেছে। ঝুম বৃষ্টির সিলেট চমৎকার সুন্দর। সবকিছুই অপূরক। চোখ জুড়িয়ে যায়। বৃষ্টির মধ্যেই ঘুরল চতুর্দিক। ঘুরেফিরে ফিরতে-ফিরতে রাতের একটা দশ তখন। অরুর আরক্তিম চোখজোড়া দেখে আশ্চর্যরকমভাবেই থমকে গেল তন্ময়ের হৃৎপিণ্ড। কিয়ৎক্ষণের জন্য স্তম্ভিত হয়ে রইল দৃষ্টি। হঠাৎ কাঁদার কারণ পেলো না। চিন্তিত সে সিটবেল্ট খুলে ঝুঁকতেই, অরু দৃষ্টি নামিয়ে ধীর গলায় বলল,

‘আপু আর ভাইয়ারা চমৎকার মানুষ। আমি তাদের খুব মিস করব। ভুলতেই পারব না।’
তন্ময় হেসে ফেলে। অরুর এই কথা শুনলে তার বন্ধুবান্ধব আকাশে উড়বে। সানন্দে মাথায় চড়ে নাচবে। যা সে একদমই চাচ্ছে না। অরুর মাথা ছুঁয়ে চোখে চোখ রেখে বলে, ‘ভবিষ্যতে অনেক দেখা হবে। মন খারাপ করে না। হুঁ?’
‘হুঁ।’

শুরুটা পৌষ মাসের। যখন শীতের আগমন অপ্রতিরোধ্য। শহর জুড়ে ইতোমধ্যে ঠাণ্ডাবোধ অস্তিত্বশীল। শীতের দুর্বল স্পর্শ শরীর উপভোগ করছে। গতমাসের শেষ সময় থেকেই দেখা মিলেছে অল্পস্বল্প নভোরজ-ময় প্রকৃতির। এই মাসে তা পর্যায়ক্রমে দ্বিগুণ ধাপে বেড়েছে। এখন ভোরের বেলায় কিচ্ছুটি দেখা যায় না;কুয়াশা ব্যতীত। কুয়াশার তীব্রতা এতটাই দুর্দমনীয়
যে—প্রায়শই বেলা নয়টা পর্যন্ত শহুরে সড়কপথ এই অতিমাত্রার কুহেলিকায় আবৃত থাকে। টানা কয়েকদিন সূর্যের দর্শন পাওয়া দুঃসাধ্যকর। শাহজাহানদের ডুপ্লেক্স বাড়িটির ছাঁদ থেকে কুয়াশা দেখার আহ্লাদ কয়েকগুণে বেড়ে যায়। মনে হয় চতুর্দিক জুড়ে শুভ্র রঙা মেঘ আনাগোনা করছে। অনুভব হয় তারা গা স্পর্শ করছে।

হাত বাড়ালেই তাদের ছুঁয়ে দেয়া যাচ্ছে। এই কনকনে শীতেও, তন্ময় রোজ ভোর করে ছাঁদে ওঠে। ব্যায়াম করতে। টাইমার দিয়ে গুণে-গুণে পঁয়ত্রিশ মিনিট তার ব্যায়াম করা অপরিহার্য। আজও ব্যতিক্রম নয়। ছয়টা পনেরোতে রুমের নীরবতা ভেঙেছে এলার্ম ধ্বনি। পুরুষালি ডান হাতটা অন্ধের মতন–বেশ অবহেলায় বন্ধ করল এলার্ম ক্লক। উষ্ণ ধবল কম্ফর্টার সরিয়ে উঠে বসল তন্ময়। উদোম দেহে ঘুমানো তার অন্যতম বদভ্যাস। কনকনে শীতও এই বাজে অভ্যাসটুকু ঘুচাতে ব্যর্থ। রক্তবর্ণ চোখজোড়া জানান দিচ্ছে, পর্যাপ্ত ঘুম হয়নি। গতকাল রাতের একটা একান্নতে ঘুমুতে পেরেছে সে। একটা পঞ্চাশে অরু তার রুম ছেড়ে বেরিয়েছে।

হরর ফিল্ম দেখেছে দু’ঘন্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিট ধরে। এই সময় জুড়ে সমীপেই লেপ্টেছিল। ওর নাকি একা দেখতে ভয় লাগে। আপাতত তন্ময়ের মাথার ভেতরটা টনটন করছে পীড়ায়। রুম টেম্প্রেচার উষ্ণ বলেই সামান্য রক্ষা তার। সময় নিয়ে বিছানা ছাড়ল। পর্দা সরিয়ে, জানালার কাচ স্লাইড করতেই মোস্তফা সাহেবকে দেখা গেল। ভদ্রলোক বাগানের উত্তরদিকে দাঁড়িয়ে আছেন। গায়ে কালো-সাদার সংমিশ্রণের চাদর জড়ানো। চাদরটা দু’বছর পূর্বে ইতালি থেকে এনেছিল তন্ময়। একান্ত মোস্তফা সাহেবের জন্য। শীতকাল এলেই এখন ভদ্রলোক এই একটাই চাদর ঘুরিয়েফিরিয়ে পরবে। আরও কতশত চাদর তো আছে। সেসব ওয়ারড্রবে তুলে রাখার মানে কী?

অদূর হতে মনে হচ্ছে, কুয়াশায় মোস্তফা সাহেবের দেহখানা মেঘে ভাসছে। ভদ্রলোক কোমর ঝুঁকিয়ে স্মার্টফোন দিয়ে ফুলের ছবি তুলছেন নিরালায়। তন্ময়ের ভ্রুদ্বয় কুঁচকে এলো। এমন বিশ্রী শীতের ভোরসকালে বাগানে দাঁড়িয়ে ফুলের ছবি তুলতে হবে কেন? এই কেমন ইচ্ছে-চেতনা? আশ্চর্য! তন্ময় গলা তুলে চ্যাঁচাবে পূর্বেই— তার ফোনের মেসেজ টুন কর্ণগোচর হলো। ফোনটা ল্যাম্পশেডের সামনে। বিছানার সাইড টেবিলের দিক। এগিয়ে গিয়ে ফোনটা হাতে তুলে নিলো। হোয়াটসঅ্যাপ-এ মেসেজ পাঠিয়েছেন মোস্তফা সাহেব। নাম সেভ করা ‘M.r Shahjahan.’ দিয়ে। তন্ময় হোয়াটসঅ্যাপ ঢুকল। ক্যামেলিয়া আর চন্দ্রমল্লিকা ফুলের ছবি পাঠিয়েছে। এই ফুল দুটোর গাছ শুঁকিয়ে এসেছে কেমন! ছবির নিচেই মোস্তফা সাহেব পরিষ্কার বাংলায় লিখেছেন,

‘এই চমৎকার ফুল দুটো অরুর প্রিয়। ম রে যাচ্ছে দেখলে কষ্ট পাবে। ভাবছি প্লাস্টিকের এনে সাজিয়ে রাখব। ম রবেও না— মেয়েটা আমার কষ্টও পাবে না। অবশ্য ভবিষ্যতে এভাবেও মেয়েটা সারাজীবন কষ্টই পাবে। কোথায় সারাদেশ খুঁজে একটা রাজকুমার আনতাম, খানদানি পরিবারে ধুমধাম করে ওর বিয়েশাদি দিতে পারতাম—তা-না! কপাল দেখ মেয়েটার, আহারে….’
কে বলবে এই ভদ্রলোক তার পিতা মহাশয়? মনে হচ্ছে দূরসম্পর্কের শ্বশুর! সাতসকাল বেলাতে তন্ময়ের মুখের ভেতরটা তেঁতো লাগল। বিবর্ণ মুখের–সরু নাক কুঁচকে এলো। শীর্ণ ঠোঁটে ঠোঁট টিপে, বিরক্তিভাব লুকিয়ে —মেসেজটার জবাবটুকু ভয়েজ রেকর্ড করে দিলো,
‘বাবা হিসেবে ইমতিয়াজ চাচ্চুও খারাপ ছিল না। চমৎকার মানাতো মায়ের সাথে। ভদ্রলোক সেদিনও মায়ের কথা জিজ্ঞেস করছিলেন;আফসোস করছিলেন। আহারে….’

মিনিটখানেকের মধ্যে আর কোনো প্রত্যুত্তর এলো না। এতেই তন্ময় নিঃশব্দে হাসল। জানালার সামনে এসে ফের দাঁড়াল। মোস্তফা সাহেব বাগানে পায়চারি চালাচ্ছেন রগরগে মেজাজে। ফুঁসছেন বোধহয় তীব্রভাবেই। তীক্ষ্ণ চোখে ফোন স্ক্রিনে চাইছেন ক্ষণেক্ষণে। বিড়বিড়িয়ে হয়তো বকছেনও ছেলেকে। তন্ময় শেষবার চেয়ে –ফোন বিছানায় ছুঁড়ে; ওয়াশরুম ঢুকল। ঢুকেই দ্বিতীয়দফায় এই সাতসকালে স্তম্ভিত হলো। আয়নায় হলদে চিরকুট সেঁটে দেয়া। এই হলদে রঙের চিরকুট ডায়েরি অরুর। হাতের লেখাও জানান দিচ্ছে, এটি এই মহামান্যর কাজ। তাছাড়া আর কার স্পর্ধা আছে? চিরকুটে বড়ো বড়ো উদাসীন অক্ষরে লেখা,

‘তন্ময় ভাই, আমাকে আপনি ভোর বেলায় ডেকে দেবেন। আমি কুয়াশা দেখব। মনে করে ডাকবেন কিন্তু!
আপনার ডাকে আমি হয়তো উঠতে চাইব না। এতে হাল ছেড়ে দেবেন না। আমি উঠতে না চাইলেও জোরপূর্বক তুলে দেবেন। প্রয়োজনে একটা চড় আপনি মা রতেই পারেন। আমি মাইন্ড করব না। বুঝেছেন?’
অন্দর হতে বেশ অবলীলায় বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। চাচা-ভাইজি, একই নদীর –একই নৌকার দু’মাঝি। এত এত চমৎকার মিল যা অস্বীকার করবার নয়। আশ্চর্যরকমের মিলিত দুজনের প্রিয় খাবার নিশ্চয়ই তন্ময়ের মাথা, কলিজা এবং ফুসফুস। যা নিয়মিত ভেজে না খেলে তারা শান্তি পায় না। চিরকুটের ভাবনা মস্তক হতে সরিয়ে— তন্ময় দাঁত ব্রাশ করল। মুখ ধুয়ে বেরোল। একটা টি-শার্ট দেহে পরে নিলো চটপট। পা মোজা পরে, ক্যাডস বাঁধল। ডাম্বেল দুটো তুলে নিয়ে বেরোল ছাঁদের উদ্দেশ্যে। ক্ষণিকের জন্য থামল অরুর রুমের সামনে।

ও প্রতিনিয়ত রাত করে ঘুমোয়। এত ভোরে উঠতে পারবে না যেহেতু, কষ্ট করে শুধুমাত্র কুয়াশা দেখতে ওঠার কী প্রয়োজন? এত অদ্ভুতুড়ে সখ-আহ্লাদ কেন থাকবে? তন্ময় চাচ্ছিল না ওর ঘুম ভাঙাতে। কিন্ত…কয়েক কদম গিয়ে পুনরায় ঘুরে এসে দাঁড়াল দরজার সামনে। আলগাভাবে লাগানো দরজাটা আলতোভাবে খুলে ঢুকল অবশেষে। আঁধারছন্নতায় ঘেরা রুমের বাতি জ্বালাল। অরুর বিশেষ ধাঁচের ঘুমের ভঙ্গিমা দেখল উদাস চোখে। ইতোমধ্যে এলার্ম বেজে চলেছে ক্রমান্বয়ে। অসহ্যকর শব্দতে তন্ময়ের মাথা ব্যথা করছে। বন্ধ করতে এগুবে, এরমধ্যেই কম্ফোর্টার এর ভেতর হতে অরুর ডান হাতটা বেরিয়ে এলো জানাশোনা ভাবে। অভ্যস্ত ভঙ্গিতে অন্ধের মত এক থাবড়ে বন্ধ করল এলার্ম। ফের হাতটা চলে গেল উষ্ণতায়।

তন্ময় এবেলায় হাসল মৃদু। ডাম্বেল দুটো ফ্লোরে রাখল। এগুলো বিছানার দিক। কম্ফোর্টার সহ ঘুমন্ত অরুকে কোলে তুলে নিলো মুহূর্তেই। রওনা হলো ছাঁদের উদ্দেশ্যে। ফাঁকা করিডর। আশেপাশে, অদূরে কোথাও কেউ নেই। সিলেট থেকে ফেরার পর হতেই, অরু তার সাথে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। একই রুমে তারা কবে থেকে থাকতে পারবে, তা নিয়েও ওর একশত প্রশ্নবাণ। তন্ময় বিষয়টা এতদিন ধরে এড়িয়ে-এড়িয়ে বেরাচ্ছে। গতকালও তার রুমে থাকার জন্য অনেক সময় ব্যয় করেছে মেয়েটা। শেষপর্যন্ত ওকে নিজের রুমে যেতে বাধ্যই করেছে তন্ময়। বাধ্য না করেই বা উপায় কী? অরু তাকে জড়িয়ে ধরে আমোদেই ঘুমুতে পারে। কিন্তু তন্ময় তো পারে না। মনে হয় দেহের সাথে আগুন লেপ্টেছে। শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ উত্তেজনায় বিদ্রোহি হয়ে ওঠে। এসব ওই বাচ্চা মেয়েকে কে বোঝাবে? অরুর নরম, তপ্ত শরীর মৃদু কেঁপে-কেঁপে উঠছে। তন্ময় ওর নাজুক দেহখানা ঘনিষ্ঠভাবে– আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখল বুকের কাছটায়। দেখল ঘুমন্ত মুখটা। ডাকল গাঢ় তবে ধীর স্বরে,

‘অরু?’
মুহূর্তেই অরুর প্রত্যুত্তর আসে না। তবে হাত দুটো
জানাশোনা, অভ্যস্ত ভঙ্গিতে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে তন্ময়ের ঘাড়। মুখটা ঘাড়ে গুঁজে অরু বিড়বিড়িয়ে ওঠে,
‘হু।’
ছাঁদের দরজা পেরোতেই দমকা ঠান্ডা হাওয়া ছুঁয়ে গেল। দাঁড়িয়ে উঠল অঙ্গপ্রত্যঙ্গের একেকটি পশম। অরু গোঙাল। শীতের তীব্রতায় কাঁপল পেলব ওষ্ঠজোড়া। পাতলা কম্ফোর্টার এই কনকনে শীতের মোকাবেলা করতে অক্ষম। দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছে অরুর। কাঁচা ঘুম ভাঙনের ফলস্বরূপ রক্তবর্ণ চোখজোড়ার দুর্দশা। চেয়েই ভ্যাবলার মত ভালোভাবে, সময় নিয়ে তন্ময়কে দেখল। তারপর চতুর্দিক। কুয়াশা তাদের ঘিরে আছে। মুখ খুলে শ্বাস নিলেই ধোঁয়া বেরুচ্ছে। তন্ময়ের লম্বা নাকটা লাল। দেখতে বেশ লাগছে। অরু হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিলো উঁচু নাকের ডগা। আঁধভাঙা গলায় বলল,

‘আপনার নাক লাল হয়ে গেছে, তন্ময় ভাই।’
তন্ময় ডান ভ্রু নাচাল, ‘নিজেকে দেখছিস? সম্পূর্ণ মুখটাই লাল। দেখা হয়েছে? শেষ?’
‘কী বলেন! ভালোভাবে দেখলামই না। নামান আমাকে!’
তন্ময় নামাল না। নির্বিকার ভাবে বলল, ‘জুতো আনিনি।’

‘লাগবে না। কিছুক্ষণের জন্যেই তো।’ অরুর সাহসী জবাব। তন্ময় পরপরই নামিয়ে দিলো বরফের মত তীব্র ঠান্ডা ফ্লোরে। পায়ের তলা ফ্লোর ছুঁতেই অরুর মুখের রঙ বদলাল দারুণ ভাবে। ইতস্তত চোখে চাইল তন্ময়ের দিক। তন্ময় সাবলীল চোখেই চেয়ে আছে। অরুর থমথমে মুখটা —বোকার মত হাসার সামান্য চেষ্টা করে। তন্ময় ওর দুর্বল হাসিটুকু দেখে ক্যাডস খুলে দেয় পায়ের, ‘পরে নে।’
অরু দ্রুত মাথা নাড়াল। পরবে না। মুখে বলে ফটাফট, ‘লাগবে না।’ তন্ময় সুগভীর চোখে তখনো চেয়ে। অরু আলগোছে বড়ো জুতোজোড়া পরে নেয়। তার ছোটোখাটো পা দুটো সমুদ্রে ডুবল যেন। দেখাসাক্ষাৎ নেই। জুতো পরে ভালোভাবে দেখল একপলক। পরপর হারাল কুয়াশা নামক মেঘরাজ্যে।

বাগানে ল্যাপটপ নিয়ে বসেছে তন্ময়। ঘড়ির কাঁটা তখন সাতটা ত্রিশে। রোদ ওঠেনি। কুয়াশায় ভেজা ভূমির দূর্বাঘাস। মোস্তফা সাহেব ওপর পাশের চেয়ারে বসে। চা খাচ্ছেন। তিনি বর্তমান জেনারেশন-এর ছেলেমেয়েদের নিয়ে চিন্তিত বড়ো। গতকাল কী ভয়াবহ এক দৃশ্য দেখলেন! সেই দৃশ্যটুকুর বর্ণনা ছেলেকেও জানাতে তিনি ব্যাকুল হলেন,
‘গতকাল কী দেখলাম শুনো! পনেরো বছরের দুটো ছেলেমেয়ে হবে। স্কুল ড্রেস পরনে। দুজন দুজনকে জড়িয়ে আছে। জড়িয়ে কী করছিল তা তো আর মুখে নেয়া যাচ্ছে না! তুমিই বলো, এই বাচ্চা দুটো কী আর বুঝে?’
তন্ময় গরম কফিতে নির্বিকারভাবে দুটো চুমুক বসাল। আড়চোখে দেখল বাবার গম্ভীর মুখটা। দৃষ্টি ফিরিয়ে মেঘাচ্ছন্ন আকাশের মতন উদাস কণ্ঠে বলল,

‘তোমার ভাতিজি যখন আমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিল, ওর বয়স তখন সবে ষোলো। দশ মিনিটের রাস্তায় ছ’বার উষ্ঠা খেয়ে পড়ত। তখনো চাচি তিনবেলা মুখে তুলে খাইয়ে দিতেন।’
মুহূর্তেই দৃশ্যমান রূপে মোস্তফা সাহেবের মুখটা ভোঁতা হয়ে এলো। তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন। রেগেমেগে অস্থির তিনি চোখ রাঙালেন,

‘তু–তুমি..একটা যাচ্ছেতাই। অরু তখন ছোটো, অবুঝ নাবালিকা মাত্র। তুমি ফিটফাট হয়ে ওর সামনে ঘুরেবেড়াতে। এসব কী আমি বুঝিনি ভেবেছ? তুমিই ওর মাথাটা খেয়েছ।’
‘মাথা যদি প্লেটে সার্ভ করা হয় আমার জন্য, খাব না? তাও যদি হয় আমার প্রিয় মাথা।’
মোস্তফা সাহেব চায়ের কাপ হাতে উঠে দাঁড়ালেন। অসভ্য ছেলের সঙ্গে কোনো তর্কে সে যাবে না। তন্ময় নরম হলো ততক্ষণে। গলা পরিষ্কার করে আদুরে ভঙ্গিতে দ্রুত বলল,

শাহজাহান তন্ময় পর্ব ৬৩+৬৪

‘বাবা, বাবা…বসো। মজা করছি। ইম্পরট্যান্ট কথা বলব। বসো.. বসো….’
মোস্তফা সাহেব তিরিক্ষি মেজাজে চোখ রাঙালেন ঠিকই, তবে ছেলের কথা শুনলেন। ফের বসলেন এসে। যতই হোক, ছেলের সাথে বসে নিভৃতে একটু সময় কাটানো তার অন্যতম পছন্দের বিষয়।

শাহজাহান তন্ময় পর্ব ৬৭+৬৮

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here