শাহজাহান তন্ময় পর্ব ৭+৮

শাহজাহান তন্ময় পর্ব ৭+৮
Nabila Ishq

তন্ময় ল্যাপটপে টাইপিং করছে৷ পাশেই অরু-দীপ্ত বসে পড়ছে। পড়ছে বললে ভুল হয় অরুর ক্ষেত্রে। সে বইয়ের ফাঁকে-ফাঁকে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে৷ নয়ন জোড়া তার শান্ত নেই। তন্ময় দেখেও দেখছে না। নজরআন্দাজ করছে ব্যাপারটা। খুব গাম্ভীর্যের সহিত কাজ করছে। মুখ খুলে শুধু দীপ্তর সাবজেক্ট গুলো বুঝিয়ে দিচ্ছে। দীপ্তর হোম-ওয়ার্ক শেষ হলো। বইপত্র গুঁছিয়ে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে দাঁড়াল। আঁড়চোখে অরুকে দেখে বলল,

‘চোখ এক জায়গায় থাকলে পড়া শেষ কীভাবে হবে?’
অরু চোখ পাকিয়ে তাকাতেই ছেলেটা ছুটে পালালো। তন্ময় এবারও অগ্রাহ্য ভাবে রয়েছে। বিষয়টা আসলে অগ্রাহ্য সে মোটেও করছে না। সবই খেয়াল করছে। দেখছে! না চাইতেই চোখ চলে যাচ্ছে। এইযে অরু কানের পেছনে চুল গুঁজে আদুরে চোখে তাকাচ্ছে। ছটফটিয়ে উঠছে, বসছে। কিছু একটা বলবে হয়ত! তন্ময় বুঝেও জিজ্ঞেস করছে না আজ! অগ্যত অরু কিছুক্ষন অপেক্ষা করে মুখ খুলল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘উহুম! তন্ময় ভাই!’
‘হু।’
‘আপনি সায়মা আপুকে চেনেন?’
‘না।’
‘চেনেন না? ওইযে পাশের বিল্ডিংয়ের আপুটা।’
তন্ময় মাথা ঘুরিয়ে স্বাভাবিক চোখে তাকায়। অরু আমতাআমতা করে বলে,
‘ওই আপুটাকে আপনার কেমন লাগে?’
মুখশ্রী স্বাভাবিক রাখা কিছুটা কষ্টের হয়ে পড়ল তন্ময়ের জন্য। সে ভুরু উঁচিয়ে প্রশ্ন করে,
‘কি বলতে চাচ্ছিস? পয়েন্ট কী?’
অরু মুখ গোমড়া করে,

‘আপুটা ভালো না। কেমন যেন! আপনার দিক বাজে চোখে তাকায়। দেখলেন না বিকেলে কেমন করছিল? আর আজ ত আমায় ডেকে বলে, আপনার নাম্বার দিতে। কত বড়ো সাহস!’
‘তুই দিয়েছিস?’
‘না। আমি কেন দিব। একদমই দিব না।’ বিড়বিড় করেই কথাটুকু শেষ করল।
তন্ময় সাবলীলভাবে বলে,
‘গুড।’

এবং দৃষ্টি ফেরায়। আড়ালে সামান্য হাসে৷ অরু পুনরায় হাসফাস করছে। ঘড়ির কাঁটা দশটায় যেতেই তন্ময় উঠে৷ ল্যাপটপ গুঁছিয়ে ফেলে। সেগুলো টেবিলে রেখে পিছু ফিরে। অরু এখনো বসে। যেন এখানেই থাকবে। তন্ময় ভুরু জোড়া উঁচু করতেই, অরু নিঃশব্দে মুখ বাকায়। হেলাফেলা ভঙ্গিতে উঠে। ব্যাগ বইখাতা বুকে জড়িয়ে যাওয়ার জন্য রওনা হয়৷ তবে যায় তো যায় না। দরজার কাছটায় গিয়ে ফিরে তাকায়। বিড়বিড় করে বলে,
‘তন্ময় ভাই! আপনার কেমন মেয়ে পছন্দ?’
তন্ময় মুখশ্রী বহু প্রচেষ্টায় দ্বিগুণ গম্ভীর করে। সেই গম্ভীর মুখশ্রী দেখে অরু ভয় পায়। দ্রুত পায়ে ছুটে পালায়। তন্ময়ের অধর জুড়ে হাসির বিচরণ। বেশ খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে সে বোকার মতো মুচকি হাসে। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতেই ঠান্ডা বাতাসের প্রলয় ছুঁয়ে দেয়। সে-মূহুর্তে একটা সিগারেট ধরায়।

সেদিন ছিল প্রলয়ঙ্কর বর্ষণ প্রকৃতির বুকে। তন্ময় দুদিনের ট্যুর দিয়ে ফিরেছে। সামান্য ড্রিংক ও করেছিল। তবে নেশায় ধরেনি তাকে। ভীষণ রাত হয় বাড়িতে ঢুকতে। একদম ভিজে জবজবে অবস্থা। বাড়ির সকলে ঘুরে ব্যস্ত। কেউ জেগে নেই। তাই সে সোজা নিজের রুমের সামনে এসে দাঁড়ায়। তবে ভেতরে ঢুকে না। দাঁড়িয়ে রয় রোবটের ন্যায়। হুট করে বা দিকে হাঁটা ধরে। অরুর দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। দরজায় হাত ছোঁয়ায়। দরজা খোলা। ধাক্কা দিলেই খুলে যাবে। মেয়েটা দরজা লাগায় না কেন? কেন? কেন?

তন্ময় রাগ হবে নাকি সুযোগের সৎ ব্যবহার করবে জানে না! ধাক্কা দিতে নেয় দু’বার। কিন্তু শেষমেশ দিচ্ছে না। ইচ্ছে ভেতরে যাবার। অরুকে একটু দেখার। কিন্তু শেষমুহুর্তে নিজেকে আটকায়। মাথা দরজায় ছুঁয়ে সেভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে৷ পায়ের শব্দ পেতেই চমকে ফিরে তাকায়। মোস্তফা সাহেব দাঁড়িয়ে। চোখমুখ শান্ত। মোটেও আশ্চর্যের ছোঁয়া নেই। তন্ময় নিজেকে প্রস্তুত করে বাবার প্রশ্নের সম্মুখীন হতে। কিন্তু সেটা হলো না। মোস্তফা সাহেব ভীষণ শান্ত গলায় বললেন,
‘ঘরে যাও।’

তন্ময় থমকে রয়। ধীর পায়ে করিডর ভিজিয়ে নিজের রুমে ঢুকে যায়। মোস্তফা সাহেব ছেলের রুমের দিক বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন। ভাবনায় বিভোর তিনি। এক-পর্যায়ে হতাশার নিশ্বাস ফেলে চলে যান। তন্ময় মোটেও নিজের ঘরে ঢুকে না। বাবা যেতেই সে দরজা খুলে বেরোয়। এবার আর দাঁড়ায় না। সোজা অরুর রুমের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে। মেয়েটা আজও জানাল খোলা রেখেছে। বাতাসে পর্দা উড়ছে। বৃষ্টির ছিঁটেফোঁটা প্রবেশ করছে। তন্ময় ভেতরে পা বাড়ায়। বিছানার পাশের স্ট্যান্ড লাইট জ্বালানো। সেই হলদেটে আলোয় অরুর মুখমণ্ডল স্পষ্ট। মেয়েটা বেঘোরে ঘুমচ্ছে। তন্ময় দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে থাকে। অরুর ঘুমন্ত মুখশ্রী দেখে নির্নিমেষ ভাবে। হঠাৎ চোখ যায় পাশে। মুহূর্তে তন্ময়ের ভাবভঙ্গি পরিবর্তন হয়৷ হাত বাড়ায়। অরুর সাথে একটি সাদা শার্ট। তন্ময়ের শার্ট। শার্ট ধরে পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকে নির্বিকার ভঙ্গিতে। অনুভব করে শরীরের সর্বাঙ্গ জ্বলছে। অদ্ভুত উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছে বুক। অরুর দিক দ্বিতীয়বার তাকানোর সাহস দেখায় না। শার্ট টা বিছানায় রেখে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে যায়। যাওয়ার পূর্বে দরজা ভালোভাবে লাগিয়ে দেয়।

তন্ময় অবশ্যই গম্ভীর স্বভাবের। কথাবার্তা কম বলে৷ তবে কখনো তার বন্ধুদের অযথা ‘না’ বলতে পারে না। তার মুখ থেকে সর্বত্র বেরোয়,
‘হ্যাঁ। ঠিকাছে। যেভাবে ভালো হয়।’
কিংবা,
‘আচ্ছা যেভাবে তোরা চাস।’
শুধু একটা বিষয়ে তার মুখে না শোনা যায়। সেটা অরুর বিষয়। মাহিন যখন মুখশ্রীতে আদূরে ভাব এনে বলে,
‘তন্ময়! প্লিজ, একদিন অরুকে আন? মেয়েটার সাথে পরিচয় করিয়ে দে?’
তন্ময়ের মস্তিষ্ক কাজ করার পূর্বে মুখ কাজ করে। সেই গম্ভীর গলায় বলে ওঠে,
‘না।’

এই নিয়ে মাহিনের আফসোসের শেষ নেই। আজও আড্ডায় বসে মাহিন হতাশার নিশ্বাস ফেলে বারবার বলছে,
‘বন্ধুদের কথার এখন আর কোনো দাম নেই!’
তার কথার প্রভাব তন্ময়ের ওপর আদতে পড়ছে নাকি, দ্বিধার বিষয়। তন্ময় অন্যমনস্ক রূপে বসে। এসেছে অবদি এমন হয়ে আছে। বেশ গম্ভীর এবং অন্যমনস্ক। বিষয়টা ধরল রিহান। ড্রিংকের গ্লাস টেবিলে রেখে উঠে দাঁড়ায়। তন্ময়ের পেছনে দাঁড়িয়ে তার কাঁধে হাত রাখে। প্রশ্ন করে রয়েসয়ে,
‘কী হয়েছে? অরু বুঝি বেশি পেইন দেয়?’
তন্ময় মাথা তুলে একবার তাকায়। আবার নজর ফিরিয়ে রাখে হাতের গ্লাসের ওপর। লাল ড্রিংক গুলো নাড়িয়ে তুলছে। মাহিন সিরিয়াস হয়। গমগমে গলায় বলে,

‘কিছু হয়েছে?’
বন্ধুদের মধ্যে বিচলিত ভাব চলে এলো। সকলেই আপাত নিরবতা পালন করছে। তন্ময়কে ডিপ্রেশড দেখাচ্ছে। এভাবে মন-খারাপ তন্ময়কে সচরাচর দেখা যায় না। মাহিনের প্রচন্ড খারাপ লাগছে। হাতের ড্রিংকটাও বিষাদ লাগছে। সে উঠে দাঁড়ায়। তন্ময়ের কাঁধ চেপে তাকে দাঁড় করায়। নিয়ে চলে রেস্টুরেন্টের ছাঁদের দিক। যাবার পূর্বে বলে, ‘থাক তোরা।’

রিহান থাকে না। মানিব্যাগ পকেটে ভরতে ভরতে দুজনের পিছু ছুটে যায়। এই রেস্টুরেন্টের ছাঁদ আকর্ষণীয়। মানুষজনের ভীড় কম। যেহেতু এখানে চেয়ার-টেবিলের উদগ্রীব নেই৷ এক কোণায় দাঁড়ায় তিনজন। তন্ময় দুই বন্ধুর মধ্যে। একটা সিগারেট ধরায় সে। দেখাদেখি মাহিন আর রিহান ও সিগারেট ফুঁকতে নেয়। এবার আর প্রশ্ন করে না। শুধু তাকিয়ে থাকে জাঁকজমক রাস্তায়।
তন্ময় একসময় নিজেই মুখ খুলে,
‘আমি কি অধৈর্য্য হয়ে গেলাম?’
রিহান ক্ষীণ স্বরে বলে,
‘আমার দেখা সবথেকে ধৈর্যবান মানুষ তুই।’

তন্ময় দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে। হাতের সিগারেট ফেলে দেয়। ছটফট ভঙ্গিতে বলে,
‘আজকাল বাসায় যেতে ভয় হয়। আবার বাসায় তাড়াতাড়ি না পৌঁছালে অশান্তি অনুভব করি। নিজেকে ভীষণভাবে অপদার্থ মনে হচ্ছে।’
‘হঠাৎ কী কারণে এমন হচ্ছে?’
তন্ময় কপালে আঙুল ঘষে,
‘অরু আমায় পছন্দ করা শুরু করেছে। অ্যাজ আ লাভার।’
মাহিন বড়সড় চোখে তাকায়। রিহান বলে,
‘তা তো আনন্দের। আর তোর মতো ছেলের ওপর ফল করা সাধারণ বিষয়। আচ্ছা, বুঝতেছিস কীভাবে অরু তোকে পছন্দ করছে?’

মাহিন ত্যাড়া চোখে তাকায় রিহানের দিক। ধমকের সুরে বলে,
‘গাঁধা ছেলে। বলদ একটা। অরুকে হাতেপিঠে চড়িয়ে বড়ো করল। তো ও বুঝবে না তো কে বুঝবে, তুইই?’
আচমকা তন্ময় হেসে ওঠে। হাস্যজ্বল হাসি। হাসতে হাসতে তাকায় বন্ধুদের দিক। হেসে হেসেই বলে,
‘অযথাই বারবার তাকায়। ডাইনিংয়ে খেতে বসলে ঘুরেফিরে তাকায়। সামনে ঘুরেফিরে বেড়ায়। আমার পছন্দের রঙের জামাকাপড় পরে। সারাদিন গোছগাছ-সাজুগুজু করে থাকে ইদানীং। ঘুড়তে নিতে বলে। আর এগুলো আমি একা দেখছি না। বাড়ির সবাই দেখছে। সেদিন বাবা আসলো রুমে। এসে বলতেসে, আমায় ডিফারেন্ট ভাবে চলতে। আমার চলাফেরার ধরণ দেখে নাকি অরুর কিশোরী মনে পরিবর্তন এসেছে।’
মাহিন শব্দ করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে চোখের কোণে জল জমেছে। তন্ময় দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে। অদূরে তাকিয়ে বলে,

‘নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে যেনে যে অরুও আমায় পছন্দ করে। ভিন্ন চোখে দেখে। আমি যেসব করিনি ইদানীং তাই করছি। সেদিন বাড়ি ফিরে বেয়াদবের মতো অরুর রুমে ঢুকেছি, ওকে দেখতে। যেটা আমি কখনোই করিনি। আগে যে চোখে দেখতাম আজকাল তার বিপরীত। বিষয়টা খুবই বিশ্রী হয়ে উঠছে, দিন বা দিন।’
রিহান সিরিয়াস গলায় বলে,
‘দোস্ত! আংকেলকে জানিয়ে দে। বলে দে তুই অরুকে চাস। অ্যাজ আ লাইফ-পার্টনার। তোদের এনগেজমেন্ট করিয়ে দেবে। অরু অনার্সে পড়া কালীন নাহয় বিয়ে দিবে। আমার বিশ্বাস অরুর বাবা-মা কোনোমতে অমত করবেন না৷ তুই বেস্ট অরুর জন্য!’
তন্ময় চুপ রইল। জবাব দিল না। সমস্যা তো মোস্তফা সাহেব। তিনি সবকিছুই জানেন। তন্ময়ের অনুভূতি বুঝেন। তার বাবার থেকে তন্ময়কে কে ভালো বুঝে? মানুষটা আগে থেকেই জানে এবং জেনেশুনে বিষয়টা এভয়েড করতে চাচ্ছেন। তন্ময় সেই বিষয়ে ভালোভাবেই অবগত।

শাহজাহান বাড়ির ভেতরটা নিত্যদিনের মতোই উজ্জ্বল ছিল। হঠাৎ সেই উজ্জ্বলতায় ছায়া প্রবেশ করল যেন! তন্ময় বাড়ি ফিরেছে মাত্র। তার ঢুকতে দেরি, ডাক পড়তে দেরি হয়নি। মোস্তফা সাহেব অত্যন্ত গম্ভীর এবং দাপুটে গলায় তন্ময়কে নিজের রুমে ডেকে নিয়ে গিয়েছেন। তন্ময় সেই যে গিয়েছে এখনো ফিরেনি। দুজন পুরুষ মানুষ আধঘন্টা ধরে কী ধরণের আলাপ-আলোচনা করছে, তার বোধগম্য হচ্ছে না আনোয়ার সাহেবের। তিনি থমথমে পরিবেশে ব্যস্ত পায়ে পায়চারি করছেন লিভিংরুমে। ক্ষনে ক্ষনে নজর ফেলছেন দেয়াল ঘড়িতে। এখন ১১ : ৩৫। চিন্তায় ভ্রু-দুয়ের মাঝে ভাঁজ পড়েছে সূক্ষ্ম। আহ! এই বয়সে এতো স্ট্রেস তো নেওয়া যাচ্ছে না। বিড়বিড় করে কপাল ধরে সোফায় বসলেন। তার বড়ো ভাই, এতটাই গাম্ভীর্যের সহিত তন্ময়কে ডেকে নিয়ে গিয়েছে যে, আনোয়ার সাহেবেরই বুকের ভেতরটা তিরতির করে কাঁপছে। কপালে ছোটো ছোটো ঘাম জমেছে। বড়ো ভাইকে বড্ড ভয় পান কি-না! সম্মান ও তো কম করেন্ না। ভালোবাসাও অগাধ। সুমিতা বেগম চায়ের কাপটা এগিয়ে ধরলেন,

‘চা’টা নাও।’
‘গরম মাথায় গরম চা খেলে, মেজাজটাও গরম হবে। রেখে দাও। পড়ে খাব।’
সুমিতা বেগম ভ্যাবাচেকা খেলেন যেন,
‘গরম চায়ের সাথে গরম মেজাজের সম্পর্ক কীভাবে হয়?’
‘তুমি বুঝবে না সুমিতা। ম্যাথম্যাটিকসে তুমি দুর্বল।’
মুহুর্তে থমথমে হয়ে ওঠে সুমিতা বেগমের মুখমণ্ডল। বিড়বিড় করে বললেন, গরম চা আর গরম মেজাজের মধ্যে ম্যাথম্যাটিকস কীভাবে গুরুত্বপূর্ণ? অদ্ভুত!

ওহী সাহেব ছেলেকে রামধমক মেরে ওপরে তুলেছেন। ওপরে বলতে দোতলায়, নিজের রুমে পাঠিয়েছেন। ছেলের প্যানপ্যানানি-তে বদহজম হচ্ছিল একপ্রকার। এতো কুকর্মের কথাবার্তা বলতে পারে ছেলেটা! হাতের ঘড়িতে দৃষ্টি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে হাসফাস করে ওঠেন। বড়ো ভাবীর দিকে তাকিয়ে বলেন,
‘থার্টি মিনিটস! এতক্ষণ ধরে নিশ্চয়ই মধু নিয়ে আলোচনা হচ্ছে না। সিরিয়াস ম্যাটার! ভাবী, আপনি কী কিছু জানেন?’

জবেদা বেগম চোখের ইশারায় জানালেন, কিছুই জানেন না। ওহী সাহেব ছটফট ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ায়। ওমন সময় পশ্চিম দিক হতে চেঁচামেচির শব্দ ভেসে আসে। নিশ্চুপ পরিবেশে এই দু-একটা চেঁচামেচির শব্দ, বজ্রপাতের ন্যায়। আনোয়ার সাহেব তড়িঘড়ি করে সেদিকে ছুটলেন। ছুটতে নিয়ে পড়তে নিলেন। ওমনি নিজেকে সামলে পুনরায় ছুটলেন।

মোস্তফা সাহেবের মুখশ্রী রাগান্বিত। থরথর করে কাঁপছে ঠোঁট। তন্ময় ও আজ শান্ত নেই। ক্রোধে নয়ন জোড়া লালচে হয়ে আছে। গলার রগ নিল হয়ে বেড়িয়ে। ডান হাত কে-টেছে৷ র’ক্ত চুইয়ে পড়ছে মেঝেতে। কাঁচের গ্লাসটিও ভেঙেচুরে পড়ে আছে সেখানটায়। শব্দ তুলে দরজা ঠেলে ঢুকেন জবেদা বেগম। ঢুকেই কিংকর্তব্যবিমুঢ় তিনি। আর্তনাদ করে ওঠেন। দ্রুততম গতিতে এসে দাঁড়ান ছেলের পাশে৷ কম্পিত হাতে তন্ময়ের রক্তাক্ত হাতটা জাপ্টে ধরেন। চোখ অশ্রুসিক্ত। গলার স্বর উঁচিয়ে বলেন,

‘এসব কি করেছিস! অ্যাই তন্ময়! র…র-ক্ত পড়ছে। আল্লাহ!’
তন্ময় তখনো মোস্তফা সাহেবের দিক দৃষ্টি রেখে আছে। কণ্ঠনালি চেপে দৃঢ় স্বরে বলে,
‘আ..আই ওয়ান্ট হার। আমার মধ্যে কি প্রব্লেম? হোয়াট’স রঙ উইদ মি, হু? আমাকে বিশ্বাস কেন করতে পারছ না? আই নো হার ব্যাটার দ্যান ইউ বাবা। তাহলে কেন আমি ওর জীবনসঙ্গী হতে পারব না? হোয়াই দ্যা হেল নট?’
মোস্তফা সাহেব বাকরুদ্ধ। ঘনঘন শ্বাস ফেলে তিনি আঙুল তুলে স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বলেন,
‘তোমার ছেলেকে বলো, আমারে পরিবারের ওপর নজর ফেলতে না। ও চাচ্ছে এই পরিবার ভেঙে যাক। আমার ভাইয়েরা আলাদা হোক। এটা আমি কখনো হতে দিব না। কক্ষনো না।’

জবেদা বেগম আতঙ্কিত গলায় চেঁচায়,
‘হয়েছে কী? কি নিয়ে কথা বলছেন?’
মোস্তফা সাহেব তেড়ে আসে। গলা নামিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
‘তোমার ভদ্র ছেলে অরুকে বিয়ে করতে চায়। ওই ছোটো মেয়েটাকে। যাকে শাবিহার সমান ভালোবেসে বড়ো করেছি। নিজের মেয়ের ন্যায়। ছোটো থেকে ভাই-বোনের সম্পর্ক ওদের। আর.. আর কমপক্ষে ও অরুর দশ বছরের বড়ো। এসব ভাবে কীভাবে ও? আমাদের এই সুন্দর পরিবারের কি হবে এগুলো জানাজানি হলে, হ্যাঁ?’
স্তব্ধ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকেন জবেদা বেগম। বেশ-কিছুক্ষন চুপসে রইলেন। মোস্তফা সাহেব সন্তুষ্ট অনুভব করেন। ভেবে নিলেন স্ত্রী-ও অমত করছে। কিন্তু তার ধারণা পাল্টে জবেদা বেগম বলে ওঠেন অত্যন্ত গম্ভীর গলায়,

‘পুত্রবধূদের নিজের মেয়ের মতোই বড়ো করে। পরের বাড়ির মেয়ের মতো নয়। চাচাতো ভাইবোনের কী বিয়ে হয় না? একসাথে বড়ো হয়েছে তো কি হয়েছে? ছেলেমেয়ে দুজন দুজনকে পছন্দ করে। এরথেকে গুরুত্বপূর্ণ কী? আমার ছেলের থেকে ভালো জীবনসঙ্গী অরুর জন্য এই পৃথিবীতে নেই। ঘরের মেয়ে ঘরেই থাকবে সারাজীবন! আমি কোনো আপত্তির কারণ দেখছি না। আমার ছে…’
‘জবেদা!’
ধমকে ওঠেন মোস্তফা সাহেব,

‘তুমি কী আদোও বুঝতে পারছ কি বলছ? আমার পরিবার! আমার এতবছরের স্বপ্নের পরিবার ভেঙে যাবে এই তুচ্ছতাচ্ছিল্য কারণে। ছেলেমানুষী চিন্তাভাবনা পাশে রাখো! শুধু নিজেদের কথা ভাবছ! এই বিষয়টা আদোও আনোয়ার কিংবা সুমিতার ভালো লাগবে নাকি ভেবে দেখেছ? কতটা লজ্জাজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে বাড়ির মধ্যে ভেবেছ? আরও বাচ্চারা আছে জবেদা!
হয়তো আনোয়ার আমার মুখের কথা ফেলতে না পেরে, এই বিষয়টা মেনে নিলো। তারপর.. তারপর কি হবে? যদি ভবিষ্যতে ওদের মধ্যে সমস্যা হয়? এই বয়সের ব্যবধানের কারণে যদি ওদের সম্পর্কের ভাঙন ধরে? তখন শুধু ওদের নয়, আমাদের পরিবারের মধ্যেও ধরবে। অনেক, অনেক সমস্যা আছে। ভেবেচিন্তে…. ‘

জবেদা বেগম অবাকের চূড়ান্তে যেন,
‘এই চেনো তুমি আমাদের ছেলেকে? তন্ময়… ‘
‘আমি এই বিষয়ে আমার বাড়িতে আর একটা শব্দ শুনতে চাই না। তোমার ছেলেকে বলো, আমার বাড়িতে থাকতে হলে আমার মতামত মেনে থাকতে হবে।’
তন্ময় শক্ত গলায় বলে,
‘থাকব না। আপনার মতামত মানব না আর বাড়িতেও থাকব না। এই বাড়িতে সেদিনই ফিরব যেদিন অরুকে আমার হাতে তুলে দেবেন।’
গটগট পায়ে বেরিয়ে যায় তন্ময়। দেখা হয়ে চাচ্চু-চাচিদের সঙ্গে। সবাই দাঁড়িয়ে। তন্ময় দ্রুতপায়ে ইতোমধ্যে ওপরে উঠে গিয়েছে। মোস্তফা সাহেব শব্দ করে সোফায় বসেন৷ পাশে বসেন জবেদা বেগম। গলার স্বর নামিয়ে তিনি বলতে নেন,

‘ছেলেটা অরুকে সত্যিই… ‘
কথাটুকু শেষ করতে পারেননি পূর্বেই খুব বাজে ভাষায় চেঁচিয়ে ওঠেন মোস্তফা সাহেব। রাগান্বিত তার মুখে যা এসছে বলে ফেলেন। ওদিকে স্বামীর কাছ থেকে কখনো এমন ব্যবহার না পাওয়া জবেদা বেগমের, পায়ের নিচ থেকে যেন মাটি সরে গেল। মুখ চেপে ডুকরে কেঁদে ওঠেন,
‘কি হবে এই বাড়িতে না থাকলে? কিছু হবে না। থাকুন আপনি আপনার স্বপ্নের পরিবার নিয়ে। এই স্বপ্নের পরিবারের কেউ নই আমি, আমার ছেলে।’

অপমানিত মুখশ্রী নিয়ে ল্যাগেজ গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন৷ নিজের বাবার বাড়ির জিনিসপত্র ছাড়া কিছুই নিলেন না। খুবই হালকা ওজনের ল্যাগেজ হাতে বেরিয়ে গেলেন। মোস্তফা সাহেব এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন মেঝের র-ক্তের পানে। স্পষ্ট শুনছেন ভাই-ভাই বউদের আর্তনাদ। তন্ময় – জবেদা বেগমকে থামানোর আপ্রান চেষ্টা তাদের। চোখের কোণ ঘেঁষে গড়িয়ে পড়ল একফোঁটা জল। ওহী সাহেব দরজায় করাঘাত করছে সমানে,

শাহজাহান তন্ময় পর্ব ৫+৬

‘ভাই.. ভাইয়া। ভাবী আর তন্ময় এসব কি করছে! ওরা বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে চাচ্ছে। আপনি কেন কিছু বলছেন না?’
পাথরের ন্যায় জবাব দিলেন মোস্তফা সাহেব,
‘যেতে দে।’
থমকে গেল শাহজাহান বাড়ি। সবকিছু স্তব্ধ, বিমুঢ়। হুটহাট হেঁচকি তুলে মেয়েলি কান্নার স্বর ছাড়া আর কিছুই শোনা গেল না।

শাহজাহান তন্ময় পর্ব ৯+১০

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here