শাহজাহান তন্ময় পর্ব ৯+১০
Nabila Ishq
শাবিহা দুয়ারে দাঁড়িয়ে সমানে কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটার মুখমণ্ডল লাল। চোখের সামনে থেকে গায়েব হয়ে গেল মা-ভাই। হাজার আকুতি করেও থামাতে পারেনি। বাড়ির বাকি সদস্যদের অবস্থাও নাজেহাল। অরু ঘুমন্ত মুখশ্রী নিয়ে হন্তদন্ত ভঙ্গিতে নিচে নামছে। তাড়াহুড়ো পায়ে বেরিয়ে গেল দুয়ার খুলে। দীপ্ত ও তার পিছু পিছু ছুটেছে।
তন্ময় করুণ গলায় বলে,
‘আম্মু! প্লিজ, জেদ করে না। তুমি ভেতরে যাও।’
জবেদা বেগম অঝোরে কাঁদে। ল্যাগেজ হাতে হাঁটতে শুরু করে ছেলের সামনে,
‘তোকে একা যেতে দিব? কখনো না। কীভাবে থাকবি? কখনো একা বাইরে থাকতে পেরেছিস? হোম-সিক হয়ে পড়িস। একা থাকতে পারবি না।’
‘তুমি চলে এলে বাবাকে কে দেখবে? অসুস্থ হয়ে পড়বে। শাবিহার কথাও তো ভাবা দরকার।’
‘কোনো চিন্তা নেই। সুমিতা-মুফতি আছে। দেখেশুনে রাখবে।’
জেদি মায়ের সামনে তন্ময় হার মানল। অরু আর দীপ্ত তাদের সামনে এসে থেমেছে। ঘুমন্ত অরুর ঘুমের রেশ এখনো কাটেনি। মেয়েটার সদ্য ঘুম ভাঙা মুখশ্রী চোখের জলে লেপ্টে। তন্ময় সেই মুখপানে দৃষ্টিপাত করে রইল। অরু জবেদা বেগমের আঁচল টেনে ধরেছে,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
‘অ্যাই বড়ো মা! কোথায় যাচ্ছ আমায় ফেলে? কোথাও যেতে দিব না। চলো বাড়ি।’
জবেদা বেগম অরুকে বুকে টেনে নিলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
‘তোর চাচ্চুর খেয়াল রাখিস। খুব বড়ো দায়িত্ব দিয়ে গেলাম। পালন করবি, কেমন?’
অরুর সেই কী কান্না! হাউমাউ শব্দে কাঁদছে। জবেদা বেগমকে মানাতে না পেরে তাকায় তন্ময়ের পানে। তন্ময়ের শান্ত মন কিংবা তার শান্ত দৃষ্টি কিছুই আজ আর শান্ত নেই। অশান্ত এবং বেসামাল। অরু দু’পা এগিয়ে তন্ময়ের পেটের দিকটার শার্টের অংশ টেনে ধরে। আকুতি ভর্তি কন্ঠে বলে,
‘ফিরে চলুন না তন্ময় ভাই।’
তন্ময় নিজের পুরুষালি হাতটা অরুর মাথায় রাখে। অগোছালো চুলগুলো গুঁছিয়ে দেয়। এক আকাশসম মন খারাপ আড়াল করে, গভীর গলায় বলে,
‘বাগানে উদোম পায়ে যাবি না। ঘরের দরজা ঘুমানোর আগে বন্ধ করে শুবি। স্কুলে যাবার পথে গাড়ি নিবি। বি আ গুড গার্ল।’
অরুর কান্নার মাত্রা বাড়ল বলে। তন্ময় দীপ্তর মাথায় হাত বুলিয়ে এগিয়ে সদরদরজা পাড় করে। জবেদা বেগম শেষবার নিজেদের বাড়িটার দিক তাকালেন। আঁচলে মুখ চেপে ছেলের পেছন-পেছন চলে গেলেন।
বারান্দায় আড়াল হয়ে দাঁড়ানো মোস্তফা সাহেবের নয়ন ভর্তি জল। খুব গোপনে কোণ ঘেঁষে আসা জল মুছে নিলেন। লালিত করুণ চোখজোড়া দেখে গেল যন্ত্রণাদায়ক দৃশ্যটি।
ডেবিট-ক্রেডিট এমনকি গাড়ির চাবি সহ সবকিছুই তন্ময় রেখে এসেছে লিভিংরুমে। পকেটে হাজারের ওপরে কিছু টাকা। সে একা হলে বন্ধুদের বাড়ি উঠে যেত। তবে সঙ্গে তার মা রয়েছে। এজন্য তন্ময় বেশ চিন্তায় পড়ে। জবেদা বেগম ছেলের চিন্তা বুঝে নিলেন মূহুর্তে। তিনি কাঁধ ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে কিছু টাকা বের করে বলেন,
‘এগুলো আমার জমানো। দশ হাজার। তোর নানা দিয়েছিলেন। আপাতত নে। তারপর গয়না আছে। এগুলোও তোর নানীর। বিক্রি করে ফেলবি।’
তন্ময় মন খারাপ নিয়েও হাসে। মায়ের হাত থেকে ল্যাগেজ নিয়ে নেয়। তার কাঁধ চেপে নিজর সাথে নিতে নিতে বলে,
‘শাহজাহান মোস্তফা সাহেবের থেকেও তোমায় বেশি ভালো রাখব মা!’
জবেদা বেগম হাসেন অশ্রুসিক্ত নয়নে। আগ বাড়িয়ে ছেলের ঘামে ভেজা মুখশ্রী মুছে দিলেন আঁচল দিয়ে।
‘রানিং শপ’ রেস্টুরেন্টে ঢুকে প্রথমেই জবেদা বেগমকে বসিয়ে দিল সোফায়। মায়ের জন্য খাবার আর নিজের জন্য কফি অর্ডার করে, মোবাইল হাতিয়ে ফেইসবুক ঢুকল। চটজলদি ফ্ল্যাট খোঁজার জন্য, একটা পোস্ট করে ফেলল। খুব ভালো মানের ফলোয়ার থাকায় ভীড় জমে গেল মন্তব্য সেকশনে। তাদের এরিয়ার মধ্যেই ভালো মানের ফ্ল্যাট সম্পর্কে জানতে পেল। যেগুলো ইতোমধ্যে খালি। চাইলে আজই ওঠা সম্ভব। তন্ময় ফ্ল্যাটের ছবির সাথে উল্লেখিত কন্টাক্ট নাম্বারে কল দিতে লাগল, একেক করে। কয়েকটার সঙ্গে কথাবার্তা বলে দুটো ফ্ল্যাট বাছাই করে নিলো। আর দুটো ফ্ল্যাটই পাশাপাশি। যেকোনো একটা চুজ করবে দেখেশুনে। তাদের ফ্ল্যাট শাহজাহান বাড়ি থেকে বেশি দূরে যেন না হয়, তার খেয়াল রাখল দারুণ ভাবে।
জবেদা বেগম খাবেন না। তন্ময় তাকে একপ্রকার জোরপূর্বক ভাবেই খাওয়াল। তারপর মা-কে নিয়ে বেরোলো রেস্টুরেন্ট থেকে। রিকশা নিয়ে সোজা গন্তব্যে এসে থামল। আটতলা বিল্ডিংয়ের বাড়ি। খুব পরিপাটি এবং নির্জন। বাড়ির সামনে একটা কৃষ্ণচুড়ার গাছ। খুবই সুন্দর সেটি। জবেদা বেগম বলেন,
‘আমাদের বাড়ির সদর-দরজার সামনে এমন একটি গাছ লাগালে কেমন হয়?’
‘ভালো। বাড়ি ফিরলেই একটা লাগিয়ে নিয়ো।’
জবেদা বেগম মন খারাপ করলেন,
‘সে তো কত দেরি।’
‘তাহলে কাল এনে দিব, আপাতত বারান্দায় লাগিয়ে নাও।’
‘হ্যাঁ, ভালো বলেছিস।’
ফ্ল্যাটটি পছন্দ হলো জবেদা বেগমের। বারান্দা খানা ভীষণ বড়ো। সবথেকে ভালো বিষয় দুটো বেডরুমেই বারান্দা। বড়ো রান্নাঘর। লিভিংরুমে দারুণ স্পেস। সমস্যা হলো ভাড়া নিয়ে। ত্রিশ হাজার। তন্ময় অবশ্য গ্রাহ্য করল না। সে অগ্রীম দশ-হাজার দিয়ে, তৎক্ষণাৎ উঠে পড়ল। পুরো খালি ফ্ল্যাটে চোখ বুলিয়ে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। জবেদা বেগম ল্যাগেজ লিভিংরুমে মেঝেতে রেখে, রান্নাঘরে ছুটলেন। তড়িঘড়ি করে বললেন,
‘তন্ময়। আগে রান্নাবান্না কিছু করা দরকার। রান্নার জন্য আপাতত যেসব লাগবে লিস্ট করে দেই, নিয়ে আয়। তোর বন্ধুদের কল করে ডাক। খেয়েদেয়ে যাবে। নতুন ফ্ল্যাটে উঠলাম। ইনভাইটেশন দিয়ে ঘরের একটা আমেজ আনা দরকার।’
তন্ময় ভুলেও নিজের বিচ্ছু বন্ধুদের ডাকবে না। মা যতই বলুক না কেন! চুপচাপ বাজার করে আনলো দু’হাত ভরে। মায়ের হাতে সেগুলো ধরিয়ে সে বারান্দায় দাঁড়াল। চিন্তায় মশগুল। ফ্ল্যাটে এক্ষুনি কিছু ফার্নিচার লাগে। তার মায়ের কোমরে সমস্যা। নরম বিছানা ছাড়া ঘুমাতে পারবে না। চিন্তিত সে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে।
জবেদা বেগমের রান্নাবান্না তখনো চুলোয়। সেসময় কলিং বেল বেজে ওঠে। তন্ময় দ্রুত পায়ে লিভিংরুমে আসে। জবেদা বেগম দরজা ইতোমধ্যে খুলেছেন। দারোয়ান দাঁড়িয়ে। হেসে বলে,
‘নিচে অনেকগুলো ভ্যানগাড়ি নিয়ে বেশকিছু লোকজন এসেছে। তারা নাকি আপনাদের বাড়ির অতিথি। মানে পাঁচতলার। যদি একটু এসে দেখতেন।’
তন্ময় চমকালো, ভড়কালো। জবেদা বেগম ও অবাক। ছেলের সাথে তড়িঘড়ি নেমে এলেন নিচে। সদরদরজায় এসে আহাম্মক হয়ে গেল মা-ছেলে। মোট এগারোটা ভ্যানগাড়ি। এগারোটা ভ্যানগাড়ি জুড়ে ফার্নিচার। সোফার স্যাট, ডাইনিং টেবিল, বক্স বেড, কাবার্ড ধরে অনেককিছুই। একেকটা ফার্নিচারের ওপর বড়ো কাগজ লাগানো। সেখানে লেখা তন্ময়ের বিচ্ছু বন্ধু-বান্ধবদের নাম। যেমন, গিফট ফ্রম মাহিন। গিফট ফ্রম ইব্রাহিম। গিফট ফ্রম রিহান। গিফট ফ্রম শুহানি।
মাহিন হৈচৈ ফেলে এগিয়ে আসলো,
‘আন্টি দাওয়াত দিয়েছে। দাওয়াত খেতে এলাম। খালি হাতে তো আর আসা যায় না।’
তন্ময় নির্নিমেষ চোখে শুধু তাকিয়ে রইল। সে আসলে রাগবে নাকি কাঁদবে নাকি হাসবে বুঝে পেলো না।
বন্ধুবান্ধবদের আনা ফার্নিচার দিয়েই ফ্ল্যাট ফিল-আপ হয়ে গেল। খুব দারুণভাবে প্রত্যেকটা ফার্নিচার মিল করে নিয়ে এসেছে। লিভিংরুমের আকর্ষণীয় সোফার স্যাট খানা পুরো ফ্ল্যাটের নকশা পরিবর্তন করে ফেলেছে ইতোমধ্যে।
মাহিন ক্লান্ত ভঙ্গিতে হাত-পা ছড়িয়ে সোফায় বসেছে। রিহান, ইব্রাহিম ওরাও বসে। তিন ঘন্টা ধরে কাজ করেছে। ফার্নিচার ওঠানো, স্যাট করা থেকে ধরে এভ্রিথিং। তাই একেকজনের শ্বাসপ্রশ্বাস অস্বাভাবিক।
রান্নাঘরে জবেদা বেগমের সঙ্গে শুহানি রয়েছে। দুজন বেশ গল্পগুজব করে, রান্নাবান্না করছে। হুটহাট হাসছে শব্দ করে। এরমধ্যে রিহান দুবার উঁকি মেরেছে। ঘ্রাণে ম-ম করছে কি-না চারদিকে। ক্ষুধা কয়েকগুণ বেড়েছে। রান্নাবান্না শেষ হতেই শুহানি লিভিংরুমে এসে বলে গেল,
‘হ্যালো হ্যালো। ইটস ডিনার টাইম। ডিয়ার বয়েজ, ফ্রেশঅ্যান আপ হয়ে ডাইনিংয়ে চলে আসো চটজলদি।’
‘আসতেছি ভাই! ক্ষুধা লাগছে ভয়ংকর!’
তন্ময় গোসলে গিয়েছে সর্বপ্রথম। মাত্রই বেরিয়েছে গোসল সেড়ে। সারাদিন দৌড়াদৌড়ি করতে হয়েছে যেহেতু, শরীর ভীষণ ক্লান্ত ছিল। ঠান্ডা পানি ক্লান্তি বেশ খানিকটা দূর করতে সাহায্য করেছে। মাথা মুছতে মুছতে লিভিংরুমে আসতেই বন্ধুদের উদ্দেশ্যে বলল,
‘ফ্রেশ হয়ে নে।’
হুড়হুড় করে একেকজন গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এলো। ছুটে গিয়ে ডাইনিংয়ে বসে পড়ল। টেবিল ভর্তি খাবার। অনেক পদের রান্না করা হয়েছে। সেগুলো সার্ভ করছে শুহানি। জবেদা বেগমের রান্নার হাত দারুণ। খাবারের নকশাই তার প্রমাণ। চেটেপুটে খেয়ে মাহিন প্রসংশা করেই চলেছে। রিহান খাওয়ার একফাঁকে বলল,
‘আন্টি, আপনার হাতে জাদু আছে। এতো দারুণ খেতে হয়েছে যে, আমার পেট ভরেছে তবে মন না।’
জবেদা বেগম হেসে বলেন,
‘তাহলে প্রত্যেকদিন চলে এসো খেতে।’
‘আমি ভীষণ নির্লজ্জ। চলে আসব কিন্তু!’
‘আচ্ছা বাবা এসো। আমি খুশি হব।’
ছেলেমেয়ে গুলো আজ খুব পরিশ্রম করেছে। সেজন্য জবেদা বেগম চাচ্ছেন না, এমন রাত করে ফিরুক। তাই তিনি বললেন,
‘আজ বরং সবাই থেকে যাও। সকালে ব্রেকফাস্ট করে না-হয় যাবে?’
তন্ময়ের বিচ্ছু বন্ধুবান্ধব জবাব না দিয়ে তন্ময়ের দিক তাকায়। যেমন তন্ময় মাথা দোলালেই সবগুলো থেকে যাবে। আর মাথা নাড়ালে হুড়মুড় করে বেরিয়ে পড়বে। খেতে খেতে অগোচরে হাসে তন্ময়। খাবার শেষ করে উঠতে নিয়ে প্রশ্ন করে,
‘থাকতে পারবি সবাই?’
‘পারব মানে? আলবাত পারব।’
এবং খাওয়া দাওয়া করেই, তন্ময়ের বিছানায় চিৎপটাং হয়ে শুয়ে পড়ে একেকটা। বিছানার এককোণে ইব্রাহিম তো আরেককোণে মাহিন। তাদের মধ্যে রিহান আবার রিহানের পায়ের কাছটায় সৈয়দ। পুরো বিছানায় তাদের রাজত্ব।
তন্ময় দাঁড়িয়ে তাদের সামনে। সবগুলোর ওপর তার নজর। দৃষ্টি নরম। গলার স্বর মোলায়েম। সময় নিয়ে বলে সে,
‘খুব চিন্তায় ছিলাম। ভেবেছিলাম খুব কঠিন হবে এবার পথা চলাটা। অথচ তোদের জন্য সবকিছু কেমন সহজ হয়ে গেল। ধন্যবাদ!’
মাহিন বিছানা থেকে ঝাপিয়ে চড়ে বসে তন্ময়ের পিঠে। হঠাৎ আক্রমণে তন্ময় প্রায় পড়ে যেতে নেয়। কিন্তু পড়ে না। দেয়াল ধরে নিজেকে সামলে ওঠে। মাহিন সেভাবেই ভেঙচি কেটে বলে,
‘শালা! এখন এই সামান্য কিছুর জন্য ধন্যবাদ দিচ্ছস! আর তুই যে আমাদের জন্য এততকিছু করছস, কখনো ধন্যবাদ দিতে দিছস? বাটপার! এরপর সাহায্য করিস খালি আমারে। তোর চোদ্দগুষ্টি সহ আমি মাহিন ধন্যবাদ দিয়ে ভাসামু, মনে রাখিস।’
হেসে ওঠে সবাই। তারাও ছুটে আসে বন্ধুত্বের বন্ধনে বন্দী হতে। শুহানি তখন মিষ্টির প্লেট হাতে কেবলই দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। এমন দৃশ্য দেখতেই গলা ফাটিয়ে চেঁচায়,
‘আরে আরে, আমি কই! চাপ চাপ আমিইও ঢুকব।’
বলতে বলতে প্লেট পাশে রাখতে নেয়। যেমন রেখেই দৌড়ে ছেলেদের হাগিং সিচুয়েশনে ঢুকে পড়বে।
রিহান ধমক দেয়,
‘এই আসবি না তুই। খবরদার শুহানি। এখানে আমরা ছেলেরা!’
‘তাতে কী? আমি আসব। একশোবার আসব। দেখি সর মাহিন। জায়গা দেয়। আমায় ছাড়া কোনো গ্রুপ হাগ হবে না। বিগ নো!’
তন্ময় হাসে। মাহিনকে ঠেলে জায়গা করে। তারপর হাত বাড়ায়। শব্দ করে বলে,
‘আয় ঢোক।’
শুহানি দৌড়ে ঢুকে পড়ে বন্ধুদের মধ্যে। নিজেদের গ্রুপের ফেমাস গানটি ঘুড়তে ঘুড়তে গেয়ে ওঠে সবাই মিলে। এটা তাদের বন্ধুত্বের থিম সং। ভালো কিছু হলেই গেতে হবে। জবেদা বেগম দূর থেকে বাচ্চাদের এরূপ দৃশ্য দেখে হাসছেন। বাড়ি থেকে বেরোনোর শূন্যতা বাচ্চাগুলো কমিয়ে দিয়েছে।
ঘড়ির কাঁটা রাত তিনটায়। সকলে গভীর ঘুমে। তন্ময় ল্যাপটপের সামনে বসে। সবকিছু ফেলে আসলেও ল্যাপটপ ফেলে আসেনি। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আপাতত খুব ব্যস্ত ভঙ্গিতে বড়ো বড়ো কোম্পানির এভেইলএভল পজিশনে সিভি ড্রপ করছে৷ সেসময় তার ফোন বেজে ওঠে।
নাম্বারটি অরুর। লাস্টে বিরানব্বই। তন্ময়ের মুখস্থ নাম্বার। এবং সে নাম্বারটি সেভ করেছে ‘কালপ্রিট’ দিয়ে। যার মানে অপরাধী। খুব বড়ো অপরাধ করেছে অরু। আর সেটা হলো, তন্ময়ের শীতল হৃদয়ের জানালা খুলে ঢুকে পড়া। শুধু ঢুকে শান্ত হয়নি। সেখানে নিজের চঞ্চলতা দিয়ে রাজত্ব বসিয়েছে মেয়েটা।
তন্ময় ফোন হাতে উঠে দাঁড়ায়। স্লাইড ডোর খুলে বারান্দায় আসে। আকাশে বড়ো চাঁদ। বাতাস বইছে। আশপাশের দৃশ্য দারুণ। এখান থেকে মেইন রোডের দেখা যাচ্ছে। গাড়িঘোড়া নেই। সবকিছু শান্ত এবং নির্জন। কল রিসিভ করে কানে ধরতেই অরুর কান্নার স্বর শোনা গেল। এতে তন্ময়ের বিন্দুমাত্র খারাপ লাগল না। বরং সে চোখ বন্ধ করে চুপচাপ শুনছে। কান্নার একফাঁকে অরু ফুঁপিয়ে ডাকে,
‘তন্ময় ভাই।’
তন্ময়ের চিকন ঠোঁট ঘেঁষে হাসি ছুটে। গলার স্বর সাবলীল করে বলে,
‘হু। কি হয়েছে?’
‘আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। খুব মিস করছি বড়ো মাকে।’
‘শুধু বড়ো মাকে?’
অরুর কান্নার মাত্রা বাড়ল। ফুপিয়ে উঠল। নাক টানছে শব্দ করে। কান্নার তোড়ে নিশ্বাস আটকে আসছে যেন। তন্ময় নিঃশব্দে হাসছে। না দেখেই বুঝতে পারছে অরুর অবস্থা। রুম জুড়ে নিশ্চিত টিস্যু ফেলে রেখেছে। এই দাঁড়াচ্ছে না-হয় বসছে। মেয়েটা অশান্ত এবং অধৈর্য কি-না! অরু সময় নিয়ে জবাব দেয়,
‘আপনাকেও। ফিরে আসুন না।’
‘সময় হলেই ফিরব।’
‘কবে হবে সময়?’
‘খুব জলদি।’
‘কোথায় আছেন?’
‘কাছেই।’
‘আমিও আসব।’
‘আচ্ছা।’
‘প্রত্যেকদিন আসব।’
‘হু।’
‘সাইকেল করে আসতে পারব না?’
‘পারবি।’
‘পড়তেও চলে আসব।’
‘উম, ওকে।’
‘আমাকে পড়াবেন না?’
‘হু।’
‘প্রত্যেকদিন পড়ব।’
‘ঠিকাছে।’
শাহজাহান তন্ময় পর্ব ৭+৮
‘আজকে বাড়ির সবাই না খেয়ে। সবার মন খারাপ। আমারও। তাই আমিও কিচ্ছু খাইনি। আমার না খিদে পেয়েছে। কিন্তু খেতে নিলেই কান্না পায়।’
‘কাঁদতে কাঁদতেই খেয়ে নে।’
‘আচ্ছা।’
তন্ময়ের হৃদয়ের অরু নামক অসুখটা অনেকাংশে কমে এল। ভালো লাগায় দুলিয়ে উঠল সর্বশরীর। সুদূর আসমানে চেয়ে বিড়বিড়িয়ে বলে ওঠে,
‘ক্ষনিকের দূরত্ব যদি তোকে চিরতরে পাওয়ার রাস্তা হয়ে থাকে, তাহলে তাই সই!’
