শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ২৭
সুমাইয়া সুলতানা
প্রতিদিনের ন্যায় যথাসময়ে আগুন কলেজে চলে গেল। কলেজের গেইট পেরিয়ে গাড়ি পার্ক করে পেছনে ঘুরার সাথে সাথে কারো সাথে ধাক্কা খেল। আগুন ধাক্কা খাওয়া মানুষটির দিকে দৃষ্টি তাক করতে করতে উদ্বেগ সমেত বলে উঠলো,
” সরি, আমি খেয়াল করিনি। ”
কথার ইতি টেনে মানুষটির দিকে সম্পূর্ণ দৃষ্টিগোচর হতেই আগুনের মুখভঙ্গি বদলে গেল। কারণ, সেই মানুষটি নাঈমা। তরতাজা নাদুস নুদুস মেয়েটা সপ্তাখানেক এর মধ্যে কতটা শুকিয়ে গিয়েছে। ফোলা ফোলা গাল দুটো সমান্তরাল ভাবে মুখশ্রীতে লেপ্টে আছে। গলার হাড় ভেসে উঠেছে। চেহারায় আগের সতেজতা নেই। সেথায় রয়েছে মলিনতার ছাপ। আগুন এক দৃষ্টিতে চেয়ে নাঈমার মুখবিবর কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করল। কিছু বলল না। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজ গন্তব্যে হাঁটা শুরু করল। নাঈমা সহসা আগুনের হাত চেপে ধরল। আগুন চকিতে পেছন ফিরে তাকায়। তড়িৎ বেগে হাত ছাড়িয়ে নেয়। নাঈমা ম্লান হাসল। আগুন আবারও লক্ষ করল, মেয়েটার হাসিটাও আর আগের মতো নেই। উচ্ছ্বসিত হাসিটা বিলীন হয়ে গিয়েছে। আগুন চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। নাঈমা নিস্প্রভ গলায় বলে ওঠে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
” কেমন আছিস আগুন? ”
আগুনের বাড়ন্ত পা থেমে যায়। স্বভাবসুলভ গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দিল,
” ভালো। ”
ছোট করে উত্তর দিয়ে চুপ থাকল। নাঈমা’কে পাল্টা ভালো আছে কিনা জিজ্ঞেস করল না। আগুন অন্য দিকে চেয়ে আছে। নাঈমা তাচ্ছিল্য হাসে। কন্ঠ খাদে এনে বলল,
” জানতে চাইলি না তো, আমি কেমন আছি? ”
আগুন তাকায় তার পানে। আগুনের চোখেমুখে একরাশ দ্বিধা। মুখে কোনো কথা ফুটতে চাইল না। চোখে নড়ন নেই ছেলেটির। কি বলবে? কি বলা উচিত? কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না। ভারিক্কি নিঃশ্বাস ছেড়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো,
” জিজ্ঞেস করার কি আছে? তুই তো ভালোই আছিস। ”
” সত্যিই ভালো আছি? ”
আগুন বিরক্ত কন্ঠে বলল,
” সেটা আমার জানার কথা নয়। তুই ভালো আছিস কি না, সেটা দেখার জন্য তোর পরিবার আছে। তোর আর কিছু বলার থাকলে জলদি বল। আমার ক্লাস আছে। ”
” তুই অনেক বদলে গিয়েছিস। অনেক পাষাণ হয়ে গিয়েছিস। ”
আগুন ভাবলেশহীন ভাবে জবাব দিল,
” আমি বদলাই নি আর বদলাবোও না। যেমন ছিলাম, তেমনই আছি। শুধু কারো ভুল ধারনা নিয়ে পাগলামো করার জন্য একটু কঠিন হয়েছি জাস্ট, আর কিছু না। ”
নাঈমা কাঁপা গলায় জানতে চাইল,
” বউ’কে খুব ভালোবাসিস? ”
আগুনের অকপটে স্বীকারোক্তি,
” বউ’কে ভালোবাসবো না তো কাকে বাসবো? ভালোবাসা না থাকলে নিশ্চয়ই চুটিয়ে সংসার করতে পারতাম না! ”
আচমকা নাঈমা, আগুনের হাত চেপে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠল। আগুন চমকে ওঠে। আশেপাশে নজর ফেরায়। না, এদিকে তেমন কেউ নেই। তবে বারান্দায় অনেক শিক্ষার্থী হাঁটাহাটি করছে। কেউ দেখে নিলে বিষয়টা খারাপ ভাবে নিতে পারে। আগুন হাত ছাড়াতে চায়। নাঈমা আরও শক্ত করে ধরে। আগুন কন্ঠস্বর নিচুতে নিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
” সিনক্রিয়েট করছিস কেন? কেউ দেখতে পেলে আমার ইমেজ খারাপ হবে। ভুলে যাস না, এটা আমার কলেজ। ”
নাঈমা তবুও ছাড়ল না। ভাঙা গলায় অবান্তর আবদার ছুড়ল,
” আমাকে বিয়ে করবি? আমাকে বিয়ে করে নে, প্লিজ। তোর বর্তমান বউ’কে ছাড়তে হবে না। সে থাকুক, আমার সমস্যা নেই। আমাকে বিয়ে করে দ্বিতীয় স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে তোর ঘরে তুলে নে। ”
আগুন নাকের পাটাতন ফুলিয়ে রক্তিম চোখে তাকায়। ঝাড়ি দিয়ে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো। গমগমে গলায় বলল,
” পাগল হয়েছিস? কিসব বলছিস কোনো খেয়াল আছে? ”
নাঈমা উদ্ভ্রান্তের ন্যায় বলল,
” আমি এত কিছু জানি না। তোকে আমার চাই। ”
আগুন ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
” মাথা বেশি খারাপ হলে ডাক্তারি বাদ দিয়ে তোর বাবা-মাকে বল পাবনা রেখে আসতে। অন্যদের কি চিকিৎসা করবি? তোর নিজের এখন চিকিৎসার প্রয়োজন। ”
নাঈমা কাতর গলায় জানাল,
” আমাকে একটা সুযোগ দিলে কি খুব ক্ষতি হয়ে যাবে? ”
আগুন বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ়। অবাক হলো কিঞ্চিৎ। পরমুহূর্তে চোয়াল শক্ত করে চওড়া গলায় বলল,
” আশ্চর্য! তুই কি আমার প্রেমিকা বা বউ? যে তুই কোনো ভুল করবি আর আমি তোকে নিজের জীবনে ফিরে আসার জন্য সুযোগ দিবো! আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিস না। নয়তো এত বছরের নিয়ম ভঙ্গ করে তোর গায়ে হাত তুলে ফেলবো। ”
আগুন আর দাঁড়াল না। ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে চলল নিজ গন্তব্যে। নাঈমা সেদিকে ব্যথাতুর দৃষ্টিতে চেয়ে রইল।
” চুমকি চলেছে একা পথে,
সরাসরি তার সাথে ধাক্কা খেলে
দোষ কি তাতে? ”
অশ্রাব্য বাক্য শুনে আনিকার চঞ্চল ছুটে চলা পা দু’টো থেমে যায়। মাথার ঘোমটা দেওয়া ওড়না আরেকটু ভালো ভাবে টেনে পেছন ফিরে চায়। ললাটে প্রগাঢ় ভাঁজ ফেলে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করল সম্মুখের মানুষটির দিকে। আয়মান দন্তপাটি বের করে উচ্ছ্বাস সমেত আনিকার সামনে দাঁড়িয়ে। আনিকা চোখ বুঝে লম্বা শ্বাস টানলো। কিছু বলতে চেয়েও বলল না। ছেলেটা চরম বেহায়া। কিছু বললে, রাস্তার মধ্যে কি না কি গন্ডগোল শুরু করে দেয়। কলেজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে ছিল আনিকা। কলেজের কাছাকাছি আসতেই এরকম অদ্ভুত বাক্য শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে আয়মান দাঁড়িয়ে আছে। আনিকা চুপ করে আবার হাঁটতে থাকলো। আয়মান দৌড়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। আনিকা বুকে হাত গুঁজে রাগী লুক নিয়ে তাকায়। কটমট করে বলে ওঠে,
” পথ আটকাচ্ছেন কেন? আপনাকে না আমার পিছু নিতে নিষেধ করেছিলাম? তবুও কেন এসেছেন? ”
আয়মান ব্যাপক মুড নিয়ে হেসে বলল,
” আমি আসবো না তো কে আসবে? যাকগে, আসল কথায় আসি। শুনো লংকা মরিচ আনিকা, আমি এত ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে কথা বলতে পারি না। মনে যা থাকে ফটাফট বলে দেই। মনের কথা চেপে রাখা আমার কাম্য নয়। ”
আনিকা বিরক্ত হয়ে জানায়,
” যা বলার তাড়াতাড়ি বলুন। আমাকে যেতে হবে। ”
আয়মান উচ্চ বাক্যে বলে উঠলো,
” রাখো তোমার যাওয়া যায়ি। আমার মাথা বিগড়ে দিয়ে ওনার কলেজে যাওয়া হচ্ছে। আমিতো ভার্সিটির ক্লাস রেখে তোমাকে আমার মনের কথা জানানোর জন্য এত দূর ছুটে এসেছি। তার বেলা? তাই চুপ করে আমার কথা শুনবে। কথার মাঝখানে কথা বলবে না। ”
আনিকা ঝাঁঝ নিয়ে বলল,
” যদি না শুনি, তো কি করবেন? কেস করবেন? করুন। ”
আয়মান থুতনি চুলকে ফট করে নিরেট স্বরে বলল,
” আনিকা, আমি তোমাকে ভালোবাসি। কিভাবে ভালোবেসেছি? কেন তেমাকেই ভালোবেসেছি? এসব অবান্তর কথা জিজ্ঞেস করো না। এর উত্তর আমার নিজের কাছেও নেই। শুধু এতটুকু জানি, তুমি আমার। আমি খুব ছটফট টাইপের একজন ছেলে। আড্ডা, মাস্তি নিত্যকার কাজকর্ম। অনার্স এখনো কমপ্লিট হয়নি। তোমার সাথে দেখা হওয়ার আগে অনেক মেয়েদের সাথে রিলেশনশিপে ছিলাম। বাট ট্রাস্ট মি, তাদের সাথে ফোনে কথা বলা আর সামান্য ঘোরাঘুরি ছাড়া এর বেশি কিছু করিনি। কিন্তু তোমাকে দেখার পর, বিশ্ব সুন্দরী রমণী চোখের সামনে দিয়ে চলে গেলেও সেথায় আয়মানের চোখ আটকায় না। আমি একটু বেশিই দুষ্টুমি করি তবে আমি খারাপ ছেলে না। আমি সত্যিই তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি আনিকা। আমি চাইলে জোর করে তোমার সাথে কিছু করতে পারি। সেই ক্ষমতা আমার আছে। তবে শুধু শরীর নয়, মন সহ তোমাকে আমি চাই। ”
একদমে কথাগুলো বলে ভারিক্কি নিঃশ্বাস ত্যাগ করল আয়মান। আনিকা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে। ওর ভাবভঙ্গি বোঝা যাচ্ছে না। আয়ামন পুনরায় মিহি কন্ঠে বলল,
” আমি জানি তোমার কোনো বয়ফ্রেন্ড নেই। সব খোঁজ নিয়েছি আমি। তাই বাংলা সিনেমার মতো ডায়লগ দিতে পারবে না যে, সরি ভাইয়া আমার বফ আছে। তোমার মা নেই। বাবাই তোমার সব। এটাও জানি তোমরা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের লোকজন। তাতে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। বিয়ে করলে তো আর টাকা কে করবো না, করবো তোমাকে। ভাবার জন্য কয়েকদিন সময় দিচ্ছি। মন দিয়ে ভাবো। তবে দিন শেষে যেন উত্তর হ্যাঁ হয়! মনে থাকে যেন। ”
আনিকা ঠোঁট কামড়ে আয়মানের কথা শ্রবণ করল। মুখবিবর গাম্ভীর্য করে শুধাল,
” প্রপোজ করছেন নাকি থ্রেট করছেন? ”
আয়মান গা ছাড়া ভাবে জবাব দিল,
” তুমি যেটা ভাবো। ”
আনিকা চক্ষু হাসল। কিন্তু মুখে বলল,
” আপনার মতো অসভ্য ছেলেকে নিয়ে ভাবতে আমার বয়ে গেছে। ”
আয়মান, আনিকার চোখে দৃষ্টি তাক করে বলল,
” না ভাবলে তোমার লস। কারণ, ভাবার সময় চলে গেলে নির্দিষ্ট সময়ের পর তোমাকে আর সুযোগ দেওয়া হবে না। তোমার একটা ব্যবস্থা ঠিকই করবো। এটা পুরো কনফার্ম। ”
আনিকা ব্যাঙ্গাত্মক করে বলে ওঠে,
” কি করবেন? ”
” যখন করবো তখন দেখতে পারবে। আপাতত সামনে থেকে সরো। আমার মতো হ্যান্ডসাম ছেলে দেখলেই রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলতে ইচ্ছে করে, তাই না? ”
আনিকার মুখ হা হয়ে গেল। বলে কি এই ছেলে? দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
” আমি আপনাকে দেখে দাঁড়িয়েছি? আপনি নিজেই তো আমার পথ আটকালেন। ”
আয়মান স্মিথ হাসে। দু কদম এগিয়ে আনিকার মুখোমুখি হয়ে হিসহিসিয়ে বলল,
” জীবনে চলার পথে কখনো ফিরে তাকাতে নেই, তবে কোনো সুন্দরী মেয়ে পাশ দিয়ে পেরিয়ে গেলে সেটা আলাদা ব্যাপার। ”
বানিতে দ্য গ্রেট বিশ্ব কবি আয়মান শিকদার ~
ডোরবেল বাজতেই মোম গিয়ে দরজা খুলে দিল। আগুন গম্ভীর মুখভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। মোমের চোখ যায় আগুনের হাতে থাকা শপিং ব্যাগে। আগুন নিঃশব্দে ভেতরে আসে। মোম দরজা আটকে দেয়। আগুন বিছানার উপর ব্যাগ গুলো রেখে তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ল। মোম ব্যাগ গুলো উল্টে পাল্টে দেখতে লাগলো। ভেতরে জামা কাপড় রাখা। মোম কাপড় গুলো বের করল। গাউন, শাড়ি এনেছে আগুন। ভীষণ সুন্দর সবকটা ড্রেস। আগুন ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে আসতেই প্রশ্ন ছুড়ল,
” এই ড্রেস গুলো কার জন্য? ”
আগুন গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর দিল,
” তোমার সতীনের জন্য। ”
মোম বুঝতে পারলো আগুন তাকে জ্বালানোর জন্য বলছে। মোম মৃদু আওয়াজে জিজ্ঞেস করলো,
” হঠাৎ শপিং করে আনলেন যে? ”
আগুন চুলে ব্রাশ করে মোমের পাশে বসলো। ভরাট স্বরে বলল,
” কালকে আমাদের কলেজের সকল টিচার্স রা মিলে সোনারগাঁও ঘুরতে যাবে। বলতে পারো, ছোট খাটো গেট টুগেদারের মতো। বাসায় তো তোমার শাড়ি আর থ্রি-পিস রয়েছে। ঘুরতে গেলে শাড়ি পড়ে বেশি কামফর্ট্যাবল হতে পারতে না। সেজন্য গাউন নিয়ে এসেছি। পছন্দ হয়েছে? ”
” জ্বি। ”
” দুপুরে খেয়েছিলে? ”
মোম মিহি কন্ঠে বলল,
” হুম। ”
আগুন ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে,
” সত্যি? ”
” হ্যাঁ। ”
আগুনের কলেজ থেকে ফিরতে দেরি হবে বলে মোম’কে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিল সে যেন খেয়ে নেয়। আগুন বাইরে থেকে লাঞ্চ করে নিবে। মোম, আগুনকে ছাড়া খায় না। যত দেরি হোক না কেন, দুপুরে আগুনের জন্য অপেক্ষা করে। আগুন বাসায় আসে তিনটার পরে। আগুন নিষেধ করেছে অপেক্ষা না করার জন্য। কিন্তু মোম তার কথা শোনে না। ধমক দিলেও কাজ হয়নি। সবসময় আগুনের জন্য না খেয়ে বসে থাকবে। তাই আগুন চেষ্টা করে যতদ্রুত সম্ভব ক্লাস শেষ করে দুপুরে বাসায় চলে আসার। আজকে বেশিই দেরি হয়ে যাবে বলে আগে আগেই ফোন করে বলেছে মোম’কে দুপুরে খেয়ে নিতে।
আগুন মোমের কোলে মাথা দিয়ে সটান হয়ে শুয়ে পড়ল। মোমের পেলব হাত টেনে নিজ মাথায় রাখল। মোম আলতো করে চুল টেনে দিচ্ছে। মিহি কন্ঠে শুধাল,
” মাথাব্যথা করছে? ”
” না। ”
” শরীর খারাপ লাগছে? ”
” না। ”
” এভাবে শুয়ে পড়লেন যে? বালিশে গিয়ে আরাম করে শুয়ে পড়ুন। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। ”
আগুন তিরিক্ষি মেজাজ নিয়ে বলল,
” তোমার অসুবিধা হচ্ছে? তাহলে সরে যাই। ”
মোম চঞ্চল কন্ঠে তুরন্ত জবাব দিল,
” একদম না। আমি এমনিতে জিজ্ঞেস করেছি। ”
দুজনের মাঝে বেশ কিছুক্ষণ নিরবতা বিরাজমান রইল। মৌনতা ভেঙে মোম ব্যগ্র কন্ঠে জানতে চাইল,
” ঘুমিয়ে পড়েছেন? ”
আগুনের কন্ঠস্বর নিচুতে নিয়ে মৃদু আওয়াজে উত্তর দিল,
” বলো। ”
” আপনার কি মন খারাপ? ”
আগুন পাল্টা প্রশ্ন করলো,
” কেন মনে হলো? ”
” আপনার মুখ দেখে মনে হচ্ছে। ”
আগুন উঠে বসলো। নিজের সেই তীর্যক চাউনী নিক্ষেপ করল। মোম ভড়কে গেল। দোলনার মতো দুলে উঠল তনুমন। শুষ্ক ঢোক গিলল। রেগে গেল নাকি মানুষটা? রাগার মতো তো কিছুই বলেনি সে। তাহলে? আগুন হাত টেনে মোম’কে বালিশে শুইয়ে দিল। ঝুঁকে ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রইল। মোমের বক্ষস্থল ঢেউয়ের মতো ছ্বলাত করে উঠল। গাত্রে গাত্রে যেন হিমশীতল রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে। ঠোঁট নেড়ে কিছু বলতে উদ্যত হতেই আগুন সেথায় তর্জনী স্পর্শ করল। মোম সহসা কথাটা গিলে নিলো। আগুন ভারিক্কি নিঃশ্বাস ছেড়ে মোমের বুকে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ল। লম্বা শ্বাস টেনে মোমের শরীরের মেয়েলি ঘ্রাণ নাসারন্ধ্রে টেনে নিলো।
নাঈমার সাথে কথা বলার পর থেকে মন মেজাজ ঠিক নেই। রাগ হচ্ছে খুব। কিন্তু রাগটা আসলে কার উপর বুঝে উঠতে পারছে না। নাঈমা তখন ওইরকম একটা কথা কিভাবে বলতে পারলো? ওর কন্ঠনালীতে এত জোর কিভাবে আসলো? মুখে উচ্চারণ কিভাবে করল মোম’কে ধোঁকা দিয়ে তাকে বিয়ে করার? এভাবে আর কতদিন চলবে? এতবার বোঝানোর পরও কাজ হচ্ছে না! ঘুরেফিরে নিজের সেই একঘেয়ে কথা নিয়েই পড়ে আছে! ভালোবাসা কি এতই সহজ যে চাইলেই কাউকে দিয়ে দেওয়া যাবে? তাহলে নাঈমা কেন বুঝতে পারছে না? কি চলছে তার মনে? আগুনের প্রতি ক্ষোভ আবার মোমের উপর দেখাবে না তো? এরকম কিছু হলে আগুন, নাঈমা’কে কক্ষনো ক্ষমা করবে না।
আগুনের কাজে মোম অবাক হলো ভীষণ। আগুনের পিঠে এক হাত রেখে নরম কন্ঠে শুধাল,
” হঠাৎ? ”
” কি? ”
” এভাবে শুলেন যে? ”
” ইচ্ছা। ”
” আমার মনে হচ্ছে, আপনি কোনো কিছু নিয়ে চিন্তায় আছেন। আমাকে বলুন। আমি শুনতে চাই। ”
আগুন গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
” কিছুই হয়নি। এত বেশি ভাবতে কে বলে তোমাকে? ”
মোম গোমড়া মুখে বলল,
” আমি ভাববো না তো কে ভাববে? ”
আগুন উত্তর দিল না। মোমকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করল। জবাব না পেয়ে মোম হতাশার নিঃশ্বাস ছাড়ল। আগুনের চুলের ভাঁজে হাত গুঁজে চনমনে চিত্তে বলে ওঠে,
” ঘুরতে যখন যাচ্ছি ময়ূরী আপুকে সাথে নিয়ে চলুন। পারলে আয়মান ভাইয়াকেও। সবাই মিলে গেলে খুব মজা হবে। ”
আগুন চওড়া গলায় বলল,
” আমার কলেজের টিচার্স রা মিলে ঘুরতে যাবে, সেখানে ফ্যামিলির সবাইকে কিভাবে নিয়ে যাবো? তুমি বউ তাই তোমাকে নিয়ে যাওয়া যাবে। অযথা বায়না করো না। ”
মোমের মুখটা চুপসে গেল। ভালো ভাবে বললেই তো হতো। এত রাগ দেখিয়ে বলার কি আছে? মোম ঠোঁট বাঁকায়। কথা বলবে না, কুমড়ো মার্কা লোকটার সাথে। আগুনের মাথা হতে হাত সরিয়ে নেয়। মোচড়ামুচড়ি করতে থাকে। আগুন ধমকে বলে ওঠে,
” এত নড়াচড়া করছো কেন? ”
মোম গাল ফুলিয়ে ত্যাড়া কন্ঠে বলল,
” সমস্যা হলে ছেড়ে দিন। আমি নড়াচড়া করবোই। ”
আগুন ফোঁস করে তপ্ত শ্বাস টানলো। মাথাটা কেমন চিনচিন ব্যথা করছে। মোম’কে ছেড়ে পেছন ফিরে অন্য দিকে মুখ করে শুয়ে পড়ল। মোম চমকে উঠল। বিস্ময়ে ছোট্ট মুখখানা আপনা-আপনি ফাঁক হয়ে গেল। রাগ করল কি কুমড়ো মার্কা লোকটা? মোমের দৃঢ় বিশ্বাস, কিছু তো একটা হয়েছে। নয়তো এই লোক মোম’কে কাছে পেয়ে না জ্বালিয়ে এত নিশ্চুপ থাকার মানুষ সে না। এখন কিছু জিজ্ঞেস করার দরকার নেই। পড়ে ঠান্ডা মাথায় জেনে নেওয়া যাবে। মোম নিজের বালিশ ত্যাগ করে আগুনের বালিশে শুয়ে তাকে পেছন থেকে জাপটে জড়িয়ে ধরল। মাথা কিঞ্চিৎ উঁচিয়ে আগুনের মুখভঙ্গি বোঝার চেষ্টা করল। বরাবরের মতো ব্যর্থ হতে হলো। খানিকক্ষণ পরে আগুনের ভরাট স্বর শুনতে পেলো,
শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ২৬
” রাতে সব গুছিয়ে নিও। ”
মোম মুচকি হাসল। যাক বাবা, কুমড়োটা কথা বলেছে। তারমানে বেশি রাগ করেনি। মোম হাতের বন্ধন দৃঢ় করে আগুনের কাঁধে মুখ গুঁজে শুয়ে রইল।