শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৩১

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৩১
সুমাইয়া সুলতানা

সকালবেলার কোমল ঝলমলে রোদ যেন জোছনার মতো। এক ফালি সোনালী রোদ্দুর মনের গহীনে লুক্কায়িত সত্তায় সুখকর অনুভূতি জাগায়। যা সকলকে উজ্জীবিত করে। ভ্রমণের দ্বিতীয় দিনটা মোমের নিকট অন্যরকম লাগছে। হোটেলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে সে। প্রাণবন্ত, সতেজতায় ঘেরা সকালটা খুব করে অনুভব করছে। লম্বা শ্বাস টেনে ভারিক্কি নিঃশ্বাস ছাড়ল। ভোরের অল্প-স্বল্প রোদের ঝলকানি গায়ে লগায় বেশ আরাম লাগছে।
কাঁধে স্পর্শ পেয়ে মোম পেছন ফিরে তাকায়। আগুন দাঁড়িয়ে আছে। ভ্রু যুগল কুঁচকানো। চোখেমুখে একরাশ বিরক্তিকর ছাপ স্পষ্ট। হঠাৎ করে কি হলো মানুষটার, যে মুখটা এমন করে রেখেছে? মোম বুঝতে সক্ষম হলো না। হাতে থাকা ফোনটা মোমের নিকট এগিয়ে দিল। শান্ত কন্ঠে জানাল,

” মা ফোন করেছে। কথা বলো। ”
মোম নিলো। আগুন গটগট কদমে রুমে চলে গেল। ফোন কানে ধরতেই ওপাশ হতে মিনা উচ্ছ্বসিত কন্ঠে শুধালেন,
” ভালো আছো, মোম? ”
মোম অধর জোড়া প্রসারিত করে হেসে জবাব দিল,
” জ্বি, মা। আপনারা সবাই কেমন আছেন? ”
” আমরা সবাই ভালো আছি। কেমন ঘোরাঘুরি হচ্ছে? কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো? ”
” না, মা। কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। ”
” সকালে খেয়েছ? ”
” জ্বি। ”
” আগুন খেয়েছে? ”
” উনি কফি ছাড়া আর কিছু খান নি। ”
” সময় মতো আগুন’কে খেতে না চাইলেও জোর করে খাওয়াবে। ছেলেটা সকালে বেশিরভাগ নাস্তা করতে চায় না। নিয়ম করে না খেলে শরীর খারাপ করবে। ”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” জ্বি, আমি খেয়াল রাখবো। ”
” কি করছো? ”
” তেমন কিছু না। ”
” ভালো থেকো। সোনারগাঁও থেকে ফিরে আসার পর একবার এসে আমাদের সাথে দেখা করে যেও। ভালো লাগবে। ”
” জ্বি। ”
” রাখছি এখন, হ্যাঁ! তোমার শ্বশুরকে নাস্তা দিতে হবে। ”
মোম সম্মতি প্রকাশ করল। ওদের কথা বলার মাঝে আগুন হাতে তোয়ালে নিয়ে মোমের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। মোম ফোন কান থেকে সরিয়ে চোখ তুলে চায়। আগুনের হাতে তোয়ালে দেখে অবুঝ গলায় শুধাল,

” এটা দিয়ে কি করবেন? ”
আগুন শক্ত চাউনী নিক্ষেপ করল। ধমকে বলল,
” গোসল করে ভালো ভাবে চুলের পানি মুছোনি কেন? চুলের পানি দিয়ে পিঠের জামা ভিজে কি অবস্থা হয়েছে, সেদিকে কোনো খেয়াল আছে? যদি ঠান্ডা লেগে যায়? দিনদিন বড়ো হচ্ছো, আর বুদ্ধি-শুদ্ধি বৃদ্ধি পাওয়ার পরিবর্তে হ্রাস পাচ্ছে। ”

মোম দেখলো, সত্যিই চুল হতে ফোঁটা ফোঁটা পানিরকণা নিচে পড়ছে। ইতোমধ্যে বারান্দার ফ্লোর কিছুটা ভিজে গিয়েছে। মোমের মুখটা চুপসে গেল। আগুন যত্ন নিয়ে নিজ দায়িত্বে ব্যস্ত হাতে মোমের ভেজা চুল মুছে দিচ্ছে। মোম মুচকি হাসল। আগুনের থেকে পাওয়া এই ছোট ছোট যত্নটুকু মোমের কাছে স্বর্গীয় সুখ মনে হয়। আনন্দের দোলা দিয়ে উঠে তার হৃদয়ে। আগুনের দিকে আড়চোখে চেয়ে মিনমিন করে বলে,
” ভালো করেই মুছে ছিলাম, তবুও যে পানি থেকে বুঝতে পারিনি। ”
আগুন কোনো প্রতিত্তোরে করল না। চুল মুছে সুন্দর করে চুলগুলো তোয়ালের সাহায্যে পেঁচিয়ে দিল। মোম পুনরায় মিহি কন্ঠে বলে,

” পরবর্তীতে আর এমন হবে না। এখন থেকে সতর্কতা সহিত খেয়াল রাখবো। ”
আগুন এ বিষয়ে আর কথা বাড়াল না। রাশভারী গলায় বলে উঠলো,
” রেডি হতে শুরু করো। সকলে মিলে কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুরতে বের হবে। ”
” রাগ করেছেন? ”
আগুন ভ্রু কুঁচকে তাকায়। চোখ দুটো ছোট করে ফেলল। চওড়া গলায় জানতে চাইল,
” রাগ করবো কেন? ”
” মনে হলো। ”
আগুন রুমে গিয়ে গায়ে গেঞ্জি জড়াল। ব্যাগ থেকে ছোট্ট আয়নাটা বের করে চুল ঠিক করল। আড়চোখে মোমের দিকে দৃষ্টি তাক করে গমগমে গলায় বলে উঠলো,
” আমার তোমার মতো গাল ফুলানোর অভ্যাস নেই। আর না কথায় কথায় রাগ করার অভ্যাস! কথা না বাড়িয়ে ফাস্ট টু ফাস্ট রেডি হও। ”

” আঙ্কেল, ভেতরে আসতে পারি? ”
দরজায় দাঁড়িয়ে হাসিমুখে কথাটা বলে উঠল, আয়মান। বিছানায় কাত হয়ে শুয়ে আছে সানাউল্লাহ। দরজায় নজর রাখতেই অধর কোণে হাসি ফুটে ওঠে। মুচকি হেসে বললেন,
” আয়মান! এসো এসো, ভেতরে এসো। অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন নেই। ”
আয়মান এগিয়ে গেল। চোরা চোখে উঁকিঝুঁকি মেরে এদিক ওদিক নজর বোলালো। কাঙ্ক্ষিত মানুষটি নজরে আসলো না।

” দাঁড়িয়ে আছো কেন? বসো। ”
সম্মুখের চেয়ারটা দেখিয়ে দিলেন। আয়মান বসলো। সানাউল্লাহর স্বাস্থ্য সম্পর্কে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করল। দুজনের মধ্যে অল্প সময়েই ভাব হয়ে গিয়েছে। আনিকার কথা জানতে আয়মানের ঠোঁট জোড়া নিশপিশ করছে। দ্বিধাবোধ হচ্ছে, তার কথা জিজ্ঞেস করা উচিত হবে কি না! তক্ষুনি সানাউল্লাহ হাঁক ছেড়ে ডাকলেন,
” আনিকা, চা-নাস্তার ব্যবস্থা কর। বাড়িতে মেহমান এসেছে। ”
আয়মান স্বভাবসুলভ হেসে বলে ওঠে,
” এত ব্যস্ত হবেন না। ভার্সিটি আছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে যাবো। ভাবলাম যাওয়ার আগে আপনাকে একবার দেখে যাই। ”
” সেটা বললে তো শুনবো না। তোমার জন্য ব্যস্ত হতেই হবে। তুমি আমার যা উপকার করলে, ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করতে চাই না। ”
আয়মান ফট করে মুখ ফসকে বলে ফেলে,

” সবই আপনার মেয়ের খাতিরে। ”
সানাউল্লাহ কথাটা স্পষ্ট শুনতে পেলেন। ভ্রু উঁচিয়ে শুধালেন,
” আমি না থাকলে মেয়ে আসতো না। ভেবেছিলাম মানবতা দেখিয়ে আমাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলে, এখন দেখছি আমার মেয়ের জন্য! এরকম চিন্তাধারার ছেলেকে তো আমি আমার মেয়ের জামাই করবো না। ”
আয়মানের টনক নড়ল। হাস্যোজ্জ্বল মুখটা নিমেষেই থমথমে হয়ে গেল। সাফাই দেওয়ার ভঙ্গিতে দ্রুত ঠোঁট নেড়ে জবাব দিল,

” ইয়ে মানে আঙ্কেল, হয়েছে কি! আপনার মেয়েকে তো আমি চোখে হারাই, সেজন্য সবসময় যা-ই বলতে চাই আপনার মেয়ে আমার প্রতিটি কথায় মাথার মধ্যে ঘুরে বেড়ায়। ”
সানাউল্লাহ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে বললেন,
” প্রথম যেদিন আমাদের বাড়িতে আসলে, কোনো ভনিতা ছাড়াই সোজাসাপ্টা জানিয়ে দিয়েছিলে, তুমি আমার মেয়েকে ভালোবাসো। রাস্তায় ঘটা সকল ঘটনা জানিয়ে ছিলে। তোমার সরল-সাবলীল স্বীকারোক্তি আমাকে মুগ্ধ করেছিলে। তবে এর মধ্যে তুমি আমাকে একটা মিথ্যা কথা বলেছিলে! ”
আয়মান শুষ্ক ঢোক গিলল। জিভ দ্বারা ঠোঁট ভিজিয়ে প্রশ্ন করলো,
” সেটা কি? ”
সানাউল্লাহ গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলেন,

” এটাই যে আমার মেয়ে তোমাকে ভালোবাসে, আমি কষ্ট পাবো বা আমার ভয়ে সে কথা স্বীকার করছে না। ”
আয়মানের মুখে অমাবস্যা নামল। এই লোক আবার পাল্টি খাবে না তো? আদোও তার কাছে মেয়ে বিয়ে দিবে তো? কত কষ্ট করে ভঙচঙ বুঝিয়ে আনিকার বাবাকে নিজের দিকে টেনে ছিল, যাতে ভদ্রলোক আয়মানের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে নিজে আনিকা’কে রাজি করিয়ে তার হাতে তুলে দেয়। এখন সবকিছু জলে চলে যাবে না তো? মিনমিন করে বলে উঠলো,
” আপনার মেয়েকে নিজের করে পাওয়ার জন্য কথাটা বলে ছিলাম। কিন্তু আঙ্কেল বিশ্বাস করুন, আমি সত্যিই আনিকা’কে পছন্দ করি। ”

আয়মানের কন্ঠে কাতরতা। ছেলেটার মুখটা পানসে হয়ে গিয়েছে। সানাউল্লাহ শব্দ করে হেসে উঠলেন। আয়মানের কাঁধে হাত রেখে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বললেন,
” আমার মেয়ের সুখ আমার কাছে সব। মা মরা মেয়ে আমার। নিজের আদর্শে যত্নসহকারে কোলেপিঠে করে বড়ো করেছি। আমি সবসময়ই চেয়েছি, এমন একজন আমার মেয়ের জীবন আসুক, যে আমার মেয়েকে মন থেকে চাইবে। আমার মেয়ে যেমন, সেটা হাসিমুখে মেনে নিয়ে তাকে সকল পরিস্থিতিতে আগলে রাখবে। আমার মেয়ে যদি তোমার সাথে থাকতে চায়, আমি কোনো দ্বিমত করবো না। ”
আয়মান এক লাফে বসা হতে উঠে দাঁড়ায়। উৎফুল্ল চিত্তে সানাউল্লাহ’কে জাপ্টে জড়িয়ে ধরে। খুশিতে গদগদ হয়ে বলে,

” আমার সোনামনা হবু শ্বশুর মশাই। আপনি শুধু আমার হ্যাঁ তে হ্যাঁ মেলাবেন। বাকিটা আমি সামলে নিবো। আপনার মেয়ে খুব শীগ্রই আমার প্রেমে পড়ল বলে! ”
এত জোরে ধরায় সানাউল্লাহর শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। শক্তি প্রয়োগ করে ঠেলে সরিয়ে দিলেন আয়মান’কে। লম্বা শ্বাস টেনে কটমট করে বলে উঠলেন,
” হতচ্ছাড়া! মেয়ের বিয়ে দেওয়ার আগেই অক্কা পাইয়ে দিচ্ছিলে! ”
আয়মান ফিচেল গলায় জবাব দিল,
” চিন্তা নেই। নাতি-নাতনীদের মুখ দেখার আগে আপনাকে রেহাই দিবো না। ”
সানাউল্লাহ চক্ষু হাসলেন। আনিকা চা, বিস্কুট নিয়ে রুমে প্রবেশ করল। চায়ের কাপ টা আয়মানের নিকট এগিয়ে দিল। আয়মান থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে পড়ে। ভারিক্কি গলায় বলে ওঠে,
” আমাকে যেতে হবে। অলরেডি অনেক লেট হয়ে গিয়েছে। ”
কাউকে পাল্টা প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে সে চলে গেল। আনিকা হা করে তাকিয়ে থাকল। অবাক হয়েছে ভীষণ। এভাবে চলে যাওয়ার মানে কি?

সকালবেলায় শিক্ষকদের জন্য এই সময়টিতে একসাথে কফি বা চা পান করার সুযোগ মন্দ না, যা একটি সুন্দর বন্ধন তৈরি করে। প্রকৃতির এই শান্ত সময়টিতে তাদের কথোপকথন আর হাসিঠাট্টা অবিরাম চলে। গরমের সকাল যেন এক নতুন আশা ও সম্ভাবনার প্রতীক, যেখানে প্রতিটি দিন শুরু হয় নতুন উদ্যমে। এমন সকাল প্রকৃতিগত মানুষের মনে দোলা দেয়, এক নতুন দিনের শুরুতে, যা শেখার এবং বৃদ্ধির সুযোগ নিয়ে আসে।
ব্রেকফাস্ট করে সকলে মিলে ঐতিহাসিক স্থান গুলো পরিদর্শন করেছে। আজকের দিনটা ঘোরাঘুরি করে পার করেছে সকলে। দুপুরের খাবার খাওয়ার পর সামান্য পরিমাণ বিশ্রাম নিয়ে পুনরায় বেরিয়ে পড়েছে ঘোরার জন্য। মাঝে আর একটা দিন রয়েছে। অর্থাৎ কালকের দিনটির পর সবাই সোনারগাঁও ত্যাগ করে আপন নিড়ে ফিরে যাবে। প্রথমে প্রিন্সিপাল স্যার বলেছিলেন, এই ট্যুর পাঁচদিন পর্যন্ত অব্যাহত রাখবেন। তবে কিছু কারণে তিনি আজকে জানিয়েছেন, আর একদিন পর সবাই বাড়িতে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করবে। সেজন্য লাস্ট সময়টা সকলে ঘোরাঘুরি করে কাটাতে চায়।

সোনারগাঁওয়ের ঐতিহাসিক সৌন্দর্যের মধ্যে, দিন শেষে সন্ধ্যার নরম আলোয় মোম আর আগুন নিজেদের জন্য আলাদা হয়ে যায়। এক নিরিবিলি জায়গায় এসে থামল তারা। জায়গাটা এতটাই নিস্তব্ধতা যে আশেপাশে দূর পর্যন্ত জনমানবের দেখা মিলছে না। পাশে চিকন ধারায় অল্প পানিতে বহমান একটি খাল। খালটিতে ছোট ছোট পুঁটিমাছ আপন মনে খেলা করছে। মোম সেদিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। প্রকৃতিতে মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। আগুন, মোমের পাশে দাঁড়িয়ে মোমের খোঁপা করা চুল খুলে দিল। নাকমুখ ডুবিয়ে দিল উন্মুক্ত কেশে। মোম ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। এই মুহূর্তে চুল খোলায় মোমের বিরক্ত লাগছে। বাতাসের তোপে চুল উড়ে এসে মোমের মুখশ্রীতে পড়ছে। আগুন হাত বাড়িয়ে তা কানের পিঠে গুঁজে দিল৷ মোম’কে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে, কাঁধে থুতনি ঠেকিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। আগুন এবং মোমের এই সময়টা সত্যিই রোমাঞ্চকর এবং মগ্নকর। বাতাসে মোমের চুলগুলো নৃত্যের মতো দোল খায়। স্নিগ্ধ পরিবেশে এই দুই কপোত-কপোতীর মনে হচ্ছে জায়গাটা বিচিত্র দৃশ্যে ভরপুর, যেন আবার কখনো এখানে আসার সুযোগ হলে পুরনো গল্পগুলো জীবন্ত হয়ে উঠবে।

কাঁধে আগুনের উষ্ণ নির্গত গরম নিঃশ্বাস মোমের শরীরে কাঁপন ধরায়। আগুন গভীর ভাবে আলিঙ্গন করে রেখেছে মোম’কে। ওদের এই সুন্দর মুহূর্তে মোম আচমকা তীব্র আবেগ সমেত বলে ওঠে,
” মাস্টার মশাই, আমার খুব ভয় করছে। ”
আগুন, মোমের কানের লতিতে চুমু দিল। হাতের বন্ধন আরও দৃঢ় করে শান্ত কন্ঠে শুধাল,
” ভয় পাওয়ার কারণ? ”
মোম আগের থেকেও কন্ঠ উদ্বেগ ঢেলে বলে,
” বুঝতে পারছি না, তবে আমার মন কোনো অজানা ভয়ে ছটফট করছে। ”
” তুমি কি কোনো বিষয়ে চিন্তিত? ”
” না, কিন্তু আমার বুক কাঁপছে অস্বাভাবিক ভাবে। ভয় করছে ভীষণ। ”
মোমের কাঁধে মৃদু কামড় দিয়ে তাকে ঘুরিয়ে মুখোমুখি করল। চোখে চোখ রেখে ভরাট স্বরে আগুন বলল,
” কিসের ভয়? আমি থাকতে তোমার ভয় পাওয়ার কি আছে? অযথা টেনশন করে তোমার সাথে সাথে আমার মাথাটাও খারাপ করে দিও না। ”

মোম, আগুনের বুকে মাথা রেখে শক্ত করে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল। এতটাই জোরে ধরেছে যেন মনে হচ্ছে ছেড়ে দিলে আগুন কোথাও হারিয়ে যাবে। মোমের চোখ দুটো ভিজে উঠেছে। কোনো কারণ ছাড়াই গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। আগুন, মোমের মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দেয়। নিজেও অর্ধাঙ্গিনীকে জাপ্টে জড়িয়ে ধরেছে। ফুঁপানোর আওয়াজ ভেসে আসতেই ভ্রু কুঁচকে ফেলল। জোর খাটিয়ে মোমকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিলো। মোমের চোখে পানি দেখে ধমকে বলল,
” অহেতুক কান্নার মানে কি? মেজাজ খারাপ করবে না, বলে দিলাম। ”
ধমক খেয়ে মোম ঠোঁট উল্টে শব্দ করে কেঁদে উঠল। নিচের দিকে তাকিয়ে ক্রমশ ফুঁপিয়ে যাচ্ছে। আগুন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। পুনরায় বুকে টেনে নিলো। কপালে প্রগাঢ় চুমু খেয়ে, শান্ত কন্ঠে বলল,
” কান্নার কোনো নির্দিষ্ট কারণ নেই, অথচ তুমি কাঁদছ! রাগ হবে না, বলো? ”
মোম নাক টেনে টলমল চোখে চেয়ে বলে,
” কান্না পেলে আমি কি করবো? ”

আগুনের বিরক্তির মাত্রা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। মোম’কে নিজের থেকে সরিয়ে দিল। গমগমে গলায় বলল,
” কাঁদো, যতখুশি কাঁদো। তুমি চাইলে কান্না করার কম্পিটিশনের আয়োজন করে দেই! কি বলো? তবে আমার থেকে দূরে সরে গিয়ে যতক্ষণ মন চায় কাঁদো। আমার বুকে থেকে অবান্তর কান্নাকাটি করা যাবে না। ”
নিমেষেই মোমের মুখটা চুপসে গেল। গাল ফুলিয়ে আগুন’কে ফেলে সম্মুখে হাঁটা ধরল। আগুন হতভম্ব হয়ে যায়, চোখ বড়ো বড়ো করে চেয়ে রইল। মানে টা কি? কারণ ছাড়া উলটোপালটা কাজ করবে, আর ধমক দিলেই অভিমান করে থাকতে হবে? এ কোন জ্বালায় পড়ল আগুন? রাগটুকু হজম করে মোমের পিছু চলল।
সন্ধ্যার শেষ সময়ে জায়গাটা গভীর সমুদ্রের মতো শান্ত থাকলেও হঠাৎ করে পরিবেশটা শোরগোলে ভরে উঠেছে। হুট করে কোথা থেকে একদল মানুষ এসে আগুনের চারপাশে ঘিরে ধরেছে। মানুষ গুলোর মুখ রংতুলি দিয়ে বিভিন্ন পশুপাখির চিত্র আঁকা। চিনা অসম্ভব এই মুখোশের আড়ালে তাদের আসল চেহারা কি! মানুষ গুলোর আচরণ, কাজকর্ম দেখে এমন মনে হচ্ছে যেন তারা জোঁকার সেজেছে জনসাধারণকে আনন্দ দেওয়ার জন্য। কেউ উচ্চ আওয়াজে বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছে, কেউ নাচানাচি করছে, কেউ সোনারগাঁওয়ের স্থানীয় খেলা প্রদর্শন করছে। এদের দেখে আগুনের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল।

আগুনের অভিমানী বউ এদের দেখলে নিশ্চয়ই খুশি হবে? তার কোমলমতি কে মানানো সহজ হবে? এই ভীড়ের মাঝে আগুন গলা উঁচিয়ে মোম’কে দেখার চেষ্টা করছে, কিন্তু দেখতে পারছে না। এইটুকু সময়ের ব্যবধানে কোথায় চলে গেল মেয়েটা? আগুনের রাগ হচ্ছে, এমনিতেই জায়গাটা মোমের জন্য নতুন। তারউপর এখন মোমের টিকিটাও নজরে আসছে না! না বলে কোথাও যেতে নিষেধ করেছিল, তবুও মেয়েটা আগুনের চোখের আড়াল হয়ে গেল কোন সাহসে? আদর দিয়ে মাথায় তুলে ফেলেছে! একবার হাতের কাছে পাক, ত্যাড়ামি করার স্বাদ আগুন হারে হারে বুঝিয়ে দিবে!

মোমের নিঃশ্বাস আটকে আসছে। নিঃশ্বাস নিতে না পারায় চোখ দুটো বড়ো বড়ো হয়ে কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। ফর্সা মুখশ্রী লাল হয়ে গিয়েছে। ঘামে ভিজে ক্ষুদ্র শরীরটা জুবুথুবু হয়ে গিয়েছে। একটু শ্বাস নেওয়ার জন্য নিষ্পাপ শরীরটা ছটফটিয়ে উঠছে, কিন্তু পারছে না। কেউ একজন শক্তি প্রয়োগ করে তার মুখ চেপে ধরেছে। শুধু মুখ নয়, নাসারন্ধ্রের ছিদ্র পথ সহ মুখ চেপে ধরেছে। যার দরুন শ্বাসপ্রশ্বাস চালানো মুশকিল হয়ে পড়েছে। মোম মুখ থেকে হাত সরানোর চেষ্টা করছে, একটু শ্বাস নেওয়ার আশায়! হাতের মালিক ছাড়ছে না। মোমের ভীতিকর নেত্রদ্বয়ে জলকণা জমা হয়ে, টপাটপ গাল বেয়ে ক্রমাগত গড়িয়ে পড়ছে।
শোরগোলের আওয়াজে মোম ঘাড় ঘুরিয়ে আগুনের দিকে তাকাতেই অনেক গুলো মানুষদের দেখতে পেয়েছিল। পা চালিয়ে আগুনের নিকট ফিরে যাওয়ার আগেই কেউ তার মুখ চেপে, সেখান থেকে নিয়ে আসে। মেয়েটা চিৎকার দেওয়ারও সময় পায়নি।

নির্দিষ্ট স্থানে এনে আগুন্তকঃ মোমের মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিলো। মোম লম্বা শ্বাস টানল। দ্বিতীয় বার শ্বাস ত্যাগ করার সময় পেলো না, আগুন্তকঃ তাকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিল। জায়গাটা পাহাড়ি এলাকা নয়, তবে মোম বর্তমানে যেখানে আছে সেখানটা অন্য এলাকার দরুন তুলনামূলক উঁচু। এখান থেকে নিচে পড়ে গেলে মৃত্যু না হলেও হাত-পা ভাঙার সম্ভাবনা রয়েছে। তাছাড়া নিচে যদি পাথর খন্ড থাকে, তাহলে পাথর খন্ডে মাথায় আঘাত পেয়ে মৃত্যুও হতে পারে। কিছুসংখ্যক গাছপালা রয়েছে। গাছগুলো বিশাল আকৃতির। গাছের শিকড় মাটি উপরে ভেসে উঠেছে। ধক্কার চোটে মোম গিয়ে বড়সড় একটা গাছের শিকড়ের উপর মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। মুহূর্তে ক্ষীণ স্বরে “মা” বলে চিৎকার করে উঠে। শিকড়ে কপাল লেগে থেঁতলে গিয়েছে। গলগল করে তরতাজা রক্তের স্রোত প্রবাহিত হতে লাগলো। কোমল ঠোঁটের সাথে দাঁতের সংঘর্ষ লেগে নিচের ঠোঁট কিঞ্চিৎ কেটে গিয়েছে। সেখান থেকেও চুইয়ে চুইয়ে ফোঁটা ফোঁটা রক্তকণিকা বের হচ্ছে। থুতনির নিচের অংশ অল্প একটু থেঁতলে গিয়েছে। ব্যথায় মোমের শরীর অবশ অবশ লাগছে। মোম নিভুনিভু চোখ তুলে চায়। আগুন্তকের মুখ দেখা যাচ্ছে না, রাবারের তৈরী মুখোশের আড়ালে তার মুখ লুকিয়ে।

আগুন্তকঃ ধুপধাপ পা ফেলে মোম’কে টেনে তুলল। নরম হাতে নিজের সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে মোমের দু’গালে থাপ্পড় মেরে দিল। থাপ্পড়ের চোটে মোমের কান গরম হয়ে গিয়েছে, মনে হচ্ছে গালটা ছিঁড়ে গেছে। মোম গালে হাত দিয়ে আস্তেধীরে চোখ তুলে চায়। আগুন্তকঃ পুনরায় মোম’কে আঘাত করতে উদ্যত হতেই মোম নিজের পাতলা শরীরের বল প্রয়োগ করে তাকে ধাক্কা দেয়। আগুন্তকঃ নিচে পড়ে যায়, সেই সাথে মাথায় আটকানো মুখোশটাও খুলে যায়। আগুন্তকঃ এক আকাশ সমান রাগ নিয়ে তাকায়। আগুন্তকের মুখটা দেখে মোম চমকে ওঠে। বিস্ময় দৃষ্টিতে চেয়ে থাকল কিয়ৎপরিমাণ। কন্ঠে অবিশ্বাস ঢেলে বলে,

” আপনি? ”
আগুন্তকঃ উঠে দাঁড়ায়। হাত দিয়ে গা থেকে ময়লা ঝেড়ে ফেলে। মোমের দিকে চেয়ে হো হো করে হেসে উঠে। তাচ্ছিল্য হেসে বলে,
” চিন্তে পেরেছিস তাহলে? ভাবতে পারিনি তুই আমাকে চিনতে পারবি। ”
মোম জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে জানতে চাইল,
” আমাকে এখানে এনেছেন কেন? কি চাই? ”
” তোর মৃত্যু! ”
” কি ক্ষতি করেছি, আমি আপনার? ”

” ক্ষতি তো করেছিস! অনেক বড়ো রকমের ক্ষতি। তুই মরে গেলেই সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। ”
মোম ব্যথায় কাতরাতে থেকে, চোখের পানি সমেত বলল,
” আমাকে যেতে দিন। আমার মাস্টার মশাই জানতে পারলে আপনাকে ছেড়ে কথা বলবে না। ”
আগুন্তকঃ চওড়া হাসি দিয়ে, ক্রোধান্বিত কন্ঠে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
” আসুক তোর মাস্টার মশাই। সে এসে তোকে জীবিত দেখতে পাবে না! তোর জন্য আমার রাতের ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছে। তোর জন্য প্রতি মুহূর্তে আমার হৃদয় পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। আমার হৃদয়ের দহন কমাতে, মরতে তো তোকে হবেই! ”

বলেই মোমের পায়ে জুতো দিয়ে চেপে ধরল। চিৎকার দেওয়ার আগেই আগুন্তকঃ পুনরায় মোমের মুখ চেপে ধরে। মোম আবারও তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। আগুন্তকের একটি পা খাদে ছিল বলে উল্টে পড়ে যায় সে।
মোম আঘাত পাওয়া পা টেনে টলতে টলতে সামনের দিকে অগ্রসর হয়। মনে জোর এনে বাঁচার শেষ চেষ্টা করতে চাইছে। আজ ভাগ্য বোধহয় সহায়তা করতে চাইছে না! মোমের অস্তিত্ব বিলুপ্ত করতে সেও উঠেপড়ে লেগেছে! আগুন্তকঃ উঠে এসে মোমের গলা চেপে ধরে। মোম আগুন্তকের হাতের উপর হাত রেখে ছাড়ানোর চেষ্টা করে, কিন্তু সফল হলো না। মোমের যতটুকু শ্বাস চলছিল, এবার যেন সেটাও বন্ধ হবার উপক্রম।
পিটপিট করে আশেপাশে নজর বুলায়, চোখ দুটো তার আগুন’কে খুঁজছে। কাঙ্ক্ষিত মানুষটির দেখা মিলছে না। কিছুক্ষণ আগেও তো আগুন, মোম’কে বলেছিল,

” চিন্তা করো না, আমি আছি। আমি থাকতে ভয় কিসের? ” তাহলে এখন কোথায় সে? কেন আসছে না মোম’কে বাঁচাতে? মোম তো ভয় পাচ্ছে। নাকি কথা দিয়ে কথার খেলাফ করতে চাচ্ছে সে? মোম শুষ্ক ঢোক গিলছে। গলাটা শুকিয়ে আসছে। অত্যন্ত নিচু আওয়াজে ক্ষীণ স্বরে বলে উঠলো,
” মাস্টার মশাই, কোথায় আপনি? আপনার মোম হারিয়ে যাচ্ছে। কষ্ট হচ্ছে তার। যন্ত্রণায় বুক ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে। আপনি আসুন না! এসে আপনার কোমলমতি কে বাঁচিয়ে নিন না। ”

আর কিছু বলার শক্তি পাচ্ছে না মোম। শরীর সায় দিচ্ছে না। দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। কন্ঠনালী চেপে ধরায় শ্বাস নেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। বাঁচার জন্য শেষ বারের মতো কাতর গলায় আকুতি নিয়ে জানায়,
” দয়াকরে আমাকে যেতে দিন। আমার বাবা অসুস্থ। আমার মৃত্যু তিনি মেনে নিতে পারবেন না। আমি আপনাকে হাত জোর করে অনুরোধ করছি। ”
নির্দয় আগুন্তকের পাষাণ বক্ষে একটুও মায়া হলো না, বরং পৈশাচিক হাসি হেসে হাতের জোর আরও বাড়িয়ে দিল।

বিশুদ্ধ রক্ত গড়িয়ে মোমের মুখ, গলা, হাতে লেগে আছে। গায়ের জামা, ওড়নার একাংশ রক্তে মাখামাখি অবস্থা। মোম শরীর ছেড়ে দিয়েছে। শরীরে বিন্দু মাত্র শক্তি অব্যাহত নেই। চোখের সামনে আজরাইল রুপে আগুন্তক’কে দেখে, মৃত্যুর জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে নিয়েছে সে। আর তো কিছু করার নেই। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসছে। বাবা-মা, ছোট্ট বোনের মুখশ্রী ভেসে উঠছে বারংবার। মোম মরে গেলে মোমের বাবা-মা পাগল হয়ে যাবে। বড়ো আদরের মেয়ে কি না? আর মায়ের গায়ের গন্ধ পাবে না, মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে সুখ খোঁজা হবে না, বাবার গলা জড়িয়ে কতশত আদুরে বায়না করা হবে না। ছোট্ট বোন মুনিয়ার আপু আপু বলে ডাকটা আর শোনা হবে না। শ্বশুর, শাশুড়ির যত্ন নেওয়া, ময়ূরী আপুর বড়ো বোনের মতো ভালোবাসা আর পাওয়া হবে না। শাশুড়ি মা কত আশা নিয়ে বলেছিলেন, বাসায় ফিরে যেন তাদের সাথে দেখা করে। সেটাও আর সম্ভব হবে না! আর.. আর মোমের মাস্টার মশাই! তার বুকে মাথা রেখে প্রশান্তির নিঃশ্বাস নেওয়া হবে না।

আচ্ছা, মোম মরে গেলে কুমড়ো মার্কা লোকটা কি আবার বিয়ে করবে? পারবে তার কোমলমতি কে ভুলে যেতে? মোমের জন্য কষ্ট পাবে কি তার মাস্টার মশাই? মোমের পরে যে আসবে কুমড়োটার জীবনে, সে কি মোমের মতো আগুন’কে মানিয়ে নিতে পারবে? লোকটা যা রাগী! কথায় কথায় ধমক দেয়, সে কি সহ্য করে থাকতে পারবে? দ্বিতীয় কাউকে পেয়ে লোকটা কি মোম’কে ভুলে যাবে? মোমের জন্য রাখা সকল আদর, ভালোবাসা তাকে দিয়ে দিবে কি? নাকি মোমের জন্য দেবদাস হয়ে সিনেমার হিরোদের মতো রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াবে?
এত যন্ত্রণার মধ্যেও রক্তে ভরা দন্তপাটি বের করে এক পেশে হাসল মোম। চোখ দুটো খুলে রাখা আর সম্ভব হচ্ছে না। নিঃশ্বাস তো নিতে পারছেই না। হা করে কোনোরকম একটু শ্বাস টানল। মুখে কথা ফুটলো না। অস্পষ্ট শব্দে বিড়বিড় করে আওড়াল,

” আমাদের পথ চলা হয়তো এপর্যন্তই ছিল, মাস্টার মশাই। আপনার সাথে আরও অনেক বছর বাঁচার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু ভাগ্য আমাদের সহায়তা করতে নারাজ। আপনার কোমলমতি ডাকটা খুব মিস করবো। এই নামে আর কাউকে ডাকবেন না কিন্তু, বলে দিলাম! এই নামে শুধু আমাকেই ডাকবেন। আপনার বুকজমিনে নিশ্চিন্তে মাথা রেখে আর ঘুমানো হবে না। আপনার পারফিউম এখন থেকে পুরো এক মাস যাবে, সপ্তাহ খানেকের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে না। আর কেউ বকবক করে আপনার কান ঝালাপালা করে দিবে না। আমার আর পরীক্ষা দেওয়া হবে না। আপনি কত কষ্ট করে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেওয়াচ্ছিলেন। পরীক্ষা না দিয়েই বিদায় নিতে হচ্ছে। যখন আমাদের পরীক্ষা শুরু হবে, আমার বয়সী মেয়েদের দেখে একদম মন খারাপ করবেন না। সবসময় হাসবেন। আপনার হাসিটা আমার ভীষণ পছন্দ। আমি দূর থেকে আপনাকে দেখবো। ভালোবাসি, মাস্টার মশাই। অনেক অনেক ভালোবাসি আপনাকে। আমি….. ”

বাতাসের তান্ডবে বস্তু মোমের উপর আগুনের জ্বলন্ত শিখ যেমন ধপ করে নিভে যায়? ঠিক তেমনি মনুষ্য মোমের অস্পষ্ট ভাবে চঞ্চল কিশোরীর বলা কথাটাও ধপ করে নিভে গেল। ভাগ্যের চাকা এত নিষ্ঠুরতম কেন? আগুনের কোমলমতির নিষ্পাপ প্রাণটা এই সোনারগাঁওয়ের মাটিতে ত্যাগ করতে হলো? এই দুই ভালোবাসার দম্পতি’কে আরো কিছু সময় এক সঙ্গে রাখলে কি খুব ক্ষতি হয়ে যেত?

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৩০

তক্ষুনি কোথা থেকে চিরন্তন সত্য বাক্য ভেসে আসে। এটাই তো প্রকৃতির নিয়ম। জন্ম থাকলে মৃত্যু অনিবার্য। মৃত্যু মনে করিয়ে দেয় জীবনের অস্থিরতা এবং সময়ের নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহের কথা। অথচ সুখের সাগরে ভেসে থাকা মানুষ মৃত্যুর মতো সত্য এবং ছোট শব্দ বলে বেমালুম ভুলে যায়! পৃথিবী ছাড়া এর পরে যে নিঃশব্দ অন্ধকার একটি দুনিয়া আছে, সেই সমগ্র প্রক্রিয়া আমাদের মানব অস্তিত্বের একটি গভীর প্রতিচ্ছবি, সেটাও স্মরণে রাখে না।

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৩২