শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৩৫

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৩৫
সুমাইয়া সুলতানা

আজ বৃহস্পতিবার। আগুন কলেজ থেকে দুপুরের আগে ফিরে এসেছে। বাসায় এসে মোম’কে নিয়ে নিজের আসল বাড়িতে চলে গিয়েছে। মিনা বারবার যাওয়ার জন্য তাগিদ দিয়েছেন। এতদিন যেতে পারিনি সুযোগ ছিল না। মাঝখানে এক দিন সাপ্তাহিক ছুটি পেয়েছে, তাই ভাবলো ও বাড়ি থেকে ঘুরে আসা যাক। মোম বেশ কিছুদিন ধরে যেতে চাচ্ছে। মেয়েটা সদ্য অসুস্থতা কাটিয়ে উঠেছে। আপনজনদের সাহচর্যে থাকলে ভালো লাগবে। আয়মানের সাথে সামনাসামনি কথা বলা দরকার। ফোন করে আনিকার বিষয়ে জানিয়েছে আগুন’কে। সবকিছুর কথা ভেবে আজ মোম’কে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল নিজ বাড়ির উদ্দেশ্যে।

মোম’কে পেয়ে সবাই খুশিতে ফেটে পড়ল যেন। কতদিন পর মেয়েটা’কে দেখছে। বাসায় থাকলে সবসময় মিনার কাছাকাছি থাকে। এই যে, এখানে এসেই মিনার সাথে এটা সেটা বলতে লাগলো। সোনারগাঁওয়ে গিয়ে কি কি করেছে, কোথায় কোথায় ঘুরেছে, কত নতুন মানুষের সাথে পরিচিত হয়েছে, রাজ্যের সকল কথা বিশ্লেষণ করতে বসে গিয়েছে। মোমের মিষ্টি কন্ঠে, তোতাপাখির মতো বুলি গুলো মিনার মনকে পুলকিত করে। মেয়েটা খুব সহজ-সরল। একাকিত্ব একদম পছন্দ করে না। মিনা ব্যস্ত থাকলে ময়ূরীর সাথে গল্পগুজব করতে থাকে।
” মোম মা? তোমার কপালে ওটা কিসের দাগ? ”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

শ্বশুরের কন্ঠে উদ্বিগ্নতা মূলক বাক্য শুনতে পেয়ে মোম চমকে উঠল। রাশেদের কথায় মিনা, ময়ূরীও দৃষ্টি তাক করল মোমের কপাল বরাবর। দুপুরের লাঞ্চ করে ড্রয়িংরুমে সবাই বসে আছে। আগুন নিজের রুমে। যাওয়ার আগে আয়মান’কে ডেকে তার রুমে যেতে বলেছে।
মিনা অস্থির গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
” মোম তোমার কপাল থ্যাতলেছে কিভাবে? ”
মোম স্মিথ হেসে আমতা আমতা করে জবাব দিল,
” পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছিলাম মা। ”
” দেখে শুনে হাঁটবে তো নাকি! দেখেছো, কতটা আঘাত পেয়েছো! ”
” চিন্তা করবেন না। এখন আমি ঠিক আছি। ”
রাশেদ নরম কন্ঠে বললেন,

” সাবধানে চলবে, তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই। ছোট আঘাত পেয়েছো, বেকায়দায় পড়ে যদি বড়ো রকমের এক্সিডেন্ট হয়ে যেত, তখন? আমার বড়ো ছেলের বউ তুমি। আমার ঘরের লক্ষী। তোমার ভালোমন্দ কিছু হলে এর দ্বায়ভার আমাদের উপর পড়বে। তোমার বাবা বলবেন, আমরা তোমার খেয়াল রাখতে পারছি না। সেজন্য নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নশীল হও। ”
মোম মিহি কন্ঠে উত্তর দিল,
” জ্বি, বাবা। ”
রাশেদ, মিনা রেস্ট নিতে নিজের রুমে চলে গেলেন। ড্রয়িংরুমে রয়ে গিয়েছে মোম, ময়ূরী। গালে হাত দিয়ে টিভি দেখছে ময়ূরী। মোম রিমোট দিয়ে টিভি বন্ধ করে দিল। ময়ূরী প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকায়। মোম অভিমানী গলায় বলে ওঠে,

” আমার সাথে কথা না বলে, তুমি টিভি দেখছো? তাহলে এখানে এসে কি লাভ হলো? যদি আমাকে কেউ গুরুত্বই না দেয়! ”
ময়ূরী মুচকি হেসে মোমের গাল টেনে দিল। হাত বাড়িয়ে গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
” কে বলেছে গুরুত্ব দেই না? আমার মিষ্টি ভাবী টা তো আমার কাছে সবার আগে। ”
মোম মুখ কালো করে বলে,
” কাছে আসলে ভালোবাসা দেখাও, দূরে থাকলে কি আমার কথা মনে পড়ে? ”
” অবশ্যই মনে পড়ে তোমার কথা। পড়াশোনার প্রচুর চাপ, সেজন্য প্রতিদিন ফোন দিতে পারি না। ”
মোম ঠোঁট উল্টে ধীর গলায় জানায়,

” পড়াশোনার কথা আর বলো না! মাস্টার মশাই এই পড়াশোনা নিয়ে যা প্যারা দেয়, মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে যে পড়াশোনা বানিয়েছে তার কপাল ফাটিয়ে দেই! ”
ময়ূরী খিলখিল করে হেসে উঠল। অধরের হাসি বজায় রেখে বলল,
” ভাইয়ার কাছে পড়ো তুমি? ”
” হ্যাঁ। ”
” টিচার হিসেবে কেমন সে? ”
” ভীষণ বাজে! ”
” কি করেছে আমার ভাই? ”
” পড়া না পারলেই শুধু বকে। কালকেও বকেছে। ”
” তুমি নিয়মিত পড়া দিবে, তাহলে আর বকবে না। ”
” আমি তো পড়ি, কিন্তু মাস্টার মশাই জিজ্ঞেস করলে কিছু বলতে পারি না। ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে কিসব প্রশ্ন করে, আমার সব উত্তর মাথায় ঘুলিয়ে যায়। উনি পঁচা স্যার! ”
ময়ূরী চকচকে দন্তপাটি বের করে শব্দ করে হেসে উঠল।

আগুন বেডরুমের সোফায় পিছনের দিকে পিঠ ঠেকিয়ে হেলান দিয়ে বসে আছে। আয়মান গিয়ে ভাইয়ের পাশে বসলো। পাশে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে আগুন মাথা তুলে চায়। আয়মান’কে দেখে সোজা হয়ে বসে। গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
” বল, কি বলবি? ”
আয়মান নড়েচড়ে উঠল। হালকা গলা পরিষ্কার করে মিহি কন্ঠে বলে উঠলো,
” ব্রো, আনিকা আমাকে মেনে নিয়েছে। আমি চাই, তুমি আজকেই আব্বু-আম্মুর সাথে কথা বলে এনগেজমেন্টর কথা জানাও। ভালো হয় যদি এক্ষুনি বলো। তাহলে বিকেলে আনিকাদের বাড়ির গিয়ে আমাদের এনগেজমেন্টা সেরে ফেলতে পারবো। ”

” এত তাড়াতাড়ি সম্ভব হবে কি করে? আজকে কথা বলে আজকেই এনগেজমেন্ট! আনিকার বাবার সাথেও তো কথা বলতে হবে নাকি? ”
” তুমি আব্বু-আম্মুর সাথে কথা বলো। আমি আনিকার বাবার সাথে কথা বলে নিচ্ছি। ”
” বেশি তাড়াহুড়ো করলে, মেয়ের বাড়ির লোক যদি মনে করে তোর কোনো সমস্যা আছে! ”
” কে কি ভাবলো, এতে কি যায় আসে? মৌস্ট ইম্পোরট্যান্ট পার্সোন আনিকা ও তার বাবা সানাউল্লাহ। তারা বাদে বাকি কারো কথা শুনতে যাবো কেন? ”
আগুন ভাবলেশহীন ভাবে বলে,
” আজকে পারবো না কারো সাথে কথা বলতে। আগামীকাল ভেবে দেখবো। ”
আয়মান লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। পা ভাঁজ করে আগুনের পায়ের কাছে ফ্লোরে বসে পড়ে। হাত দুটো নিজের হাতের মুঠো নিয়ে অনুরোধের স্বরে বলে,

” ভাই, এটা কেমন কথা? এরকম করো না প্লিজ। বহু কষ্টে ওই ত্যাড়া মেয়েটাকে পটিয়েছি, আমার সব আশাভরসা শেষ হয়ে যাওয়ার আগে কিছু করো৷ প্লিজ, ডু সামথিং ব্রো। প্লিজ প্লিজ প্লিজ। ”
আগুন চোখ ছোট ছোট করে তাকায়। ভ্রুক্ষেপহীন ভাবে গমগমে আওয়াজে বলে,
” তোর কাছে কি ব্যাপারটা এতোই সহজ মনে হচ্ছে? আমি বাবাকে গিয়ে কি বলবো? যে বাবা তোমার ছোট ছেলের পড়াশোনা রেখে তার মাথায় বিয়ের ভূত চেপেছে! তাকে জলদি জলদি বিয়ে করিয়ে দাও। আর বাবা হাসতে হাসতে তোকে বিয়ে করিয়ে দিবে! কি তাই তো? ”
আয়মান চুপসানো মুখে অসহায় মুখভঙ্গিতে বলল,

” বিয়ে পড়ে, আগে এনগেজমেন্ট করিয়ে রাখতে চাই। তুমি বুঝিয়ে বললে আব্বু শুনবে। ”
” তুই নিজে গিয়ে বাবাকে বল। ”
” পাগল নাকি? আব্বুকে এসব কথা বলতে গিয়ে, এই ভরদুপুরে উত্তম-মধ্যম খাওয়ার কোনো ইচ্ছা আমার নেই। যা বলার তুমি বলবে। ”
আগুন আড়মোড়া ভেঙে বিছানায় বসে বলে,
” রাতে বলবো। এখন তুই যা। ”

আয়মান আবার এসে আগুনের পাশে বসলো। কন্ঠ নিচুতে নিয়ে তিরিক্ষি মেজাজ সহিত বলল,
” আমার সাথে তুমি অন্যায় করছো! না না শুধু অন্যায় না, রীতিমতো মহা অন্যায়! ভুলে যেও না, আমি কিন্তু তোমার বাসরের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম। একটু কৃতজ্ঞতাবোধ তোমার থাকা উচিত। ”
আগুন ভ্রু উঁচিয়ে চওড়া গলায় শুধাল,
” আমি তোকে বলেছিলাম, আয় আমার বাসর ঘর সাজিয়ে দিয়ে যা? ”
আয়মানের টনক নড়ল। বুঝতে পারছে ভাইয়ের সাথে কড়াভাবে কথা বললে কাজের কাজ তো হবেই না, উল্টো চূড়ান্ত লোকসান হবে। নিষ্পাপ মুখশ্রী বানিয়ে অত্যন্ত নরম কন্ঠে বলল,

” তুমি বলোনি, ওটা ভালোবেসে দেওয়া ছোট ভাইয়ের উপহার ছিল। এবার তুমিও বড়ো ভাই হিসেবে আমার এনগেজমেন্টর ব্যবস্থা করে দেও। এটা তোমার পক্ষ থেকে আমার জন্য উপহার হয়ে যাবে। ”
আগুন ফোঁস করে তপ্ত শ্বাস ছাড়ল। ঠোঁট কামড়ে কিছুক্ষণ চুপ থাকল। অতঃপর শান্ত কন্ঠে বলল,
” আচ্ছা, আজকেই বাবার সাথে কথা বলবো। ”
খুশিতে আয়মানের শরীর দুলে উঠল। মনের মধ্যে বাক-বাকুম পায়রা নাচ্ছে। আগুনের কাঁধ জড়িয়ে হাসি মুখে বলল,
” কথা বলে আজকেই কনফার্ম করবে ওদের বাড়িতে যাওয়ার। আমি সানাউল্লাহ আঙ্কেলের সাথে কথা বলে নিচ্ছি। ”
” আগে বাবা কি বলে শুনি, তারপর আনিকার বাবাকে জানাস। ”
” ওকে। ”
আয়মান খুশিতে গদগদ হয়ে আগুনের গালে টুপ করে একটা চুমু দিয়ে শরীর টাকে হেলিয়ে দুলিয়ে চলে গেল। আগুন ঠোঁট কামড়ে হাসে। ছোট ভাইটার আচরণ একদমই বাচ্চা বাচ্চা, অথচ সে এখন বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে।

এখন সময় রাত সাতটা বেজে, যদিও এই সময় টাকে সন্ধ্যার সময় ধরা হয়। তবে হিসেব করলে এই সময়টা রাতেরই অংশবিশেষ। বিস্তৃত নীলিমাতে সূর্য ডুবে গিয়ে অন্ধকার হাতছানি দিয়ে ডাকছে। জানান দিচ্ছে, রাত হওয়ার। রাস্তার চারধারে সোডিয়াম আলো জ্বলছে। টেক্সি, বাস গাড়ি গুলো পেছনের লাল রঙের বাতি জ্বালিয়ে ছুটছে নিজ গন্তব্যে। গাড়ির টিটি, ভোভো শব্দ কানে আসছে অবিরাম। রাশেদ বিরক্ত হচ্ছেন, এসময় বাইরে বের হওয়াতে। তারা সবাই এখন আনিকাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছে। রাশেদের মেজাজ খারাপ হচ্ছে। রাগ বেড়ে যাচ্ছে তরতর করে। আগুন দক্ষ হাতে গাড়ি চালাচ্ছে। পাশে রাশেদ বসা। পেছনে মিনা, ময়ূরী, মোম, আয়মান বসেছে। রাশেদ বাদে বাকিদের মুখবিবর স্বাভাবিক। তাদের মুখভঙ্গিতে বিরক্তিকর আভাস নেই। আয়মানের খুশি আর ধরে না। খুশিতে ইচ্ছে করছে মাটিতে গড়াগড়ি করে কান্না করতে।

বিকেল-বেলা রাশেদের সাথে কথা বলেছে আগুন। রাশেদ বেশ অবাক হয়েছিলেন আগুন নিজে থেকে তার সাথে কথা বলতে আসায়। আগুন সচারাচর নিজ থেকে রাশেদের সাথে কথা বলতে আসে না। আগুনের ভাবভঙ্গি সিরিয়াস দেখে রাশেদ আগ্রহ সমেত তার কথা শুনতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু আগুনের মুখে আয়মানের এনগেজমেন্টের কথা শুনে দপ করে মস্তিষ্কে আগুন জ্বলে উঠে। চিৎকার করে আয়মান’কে ডেকে বকাবকি শুরু করেন। রাশেদের চিৎকারে বাকিরা ছুটে আসে রুমে। রাশেদের চ্যাঁচামেচিতে আয়মান তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে। যেহেতু আগুন ওর হয়ে বাবার সাথে কথা বলছে, সেখানে ওর চুপ থাকাকেই সঠিক বলে মনে হয়েছে।
আগুন শান্ত কন্ঠে রাশেদকে বলেছে, বর্তমান ছেলেমেয়েরা আবেগের বসে অনেক ব্যভিচার খারাপ কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে।

তারা সহজে কোনো কিছু আদায় করতে না পারলে অন্যায়ের পথ বেছে নেয়। তাদের সেই সুযোগ না দেওয়াই ভালো। হারাম ভাবে ছেলেমেয়েরা ফ্যামিলির চোখের আড়ালে লুকিয়ে প্রেম করা, ঘোরাঘুরি বা মেলামেশা করার থেকে দুই নরনারীকে হালাল ভাবে এক সাথে চলার পথ সুগম করে দিলে সবচেয়ে ভালো হবে। কিছুদিন পর কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে আয়মানের সাথে আমাদের ফ্যামিলির সম্মানও যাবে। বকাবকি বা মারামারি করে মানসম্মান ফেরানো যাবে না। তারথেকে বরং ঠান্ডা মাথায় ভেবে চিন্তে ছোট করে আয়মানের এনগেজমেন্ট টা করিয়ে রাখলে ভালো হয়। ওদের পরীক্ষা শেষে সকল বিধিমালা প্রাধান্য সমেত বিয়ে পড়ানো যাবে। তাছাড়া, মেয়ে খুব ভালো।

মিডলক্লাস ফ্যামিলির মেয়ে হলেও তাদের নামে কোনো খারাপ কিছু শোনা যায়নি, সম্মানের সঙ্গে বসবাস করে চলেছে। ছেলেমেয়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে না গিয়ে তাদের কথায় সম্মতি প্রকাশ করা ভালো। রাশেদ, আগুনের কথা মনোযোগ সহকারে শুনলেন এবং সিদ্ধান্ত নিলেন আজকেই যাবেন আনিকাদের বাড়িতে। মূলত আয়মানের জোরাজোরিতে আজকেই যেতে হচ্ছে। রাশেদ সময় চাচ্ছিলেন। সেটা তার ছেলে হতে দিলে তো! রাশেদ রাজি হয়েছে খবরটা শোনা মাত্র আয়ামান, সানাউল্লাহ কে ফোন করে জানিয়েছে তারা সবাই ওনাদের বাড়িতে আসছে।
এভাবে হুট করে বলায় সানাউল্লাহ বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে গেলেন। ওনাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই আয়মান কল কেটে দিয়েছে।

জোগাড়আত্তিরও তো একটা ব্যাপার আছে? এই অল্প সময়ে কিভাবে ম্যানেজ করবেন তিনি? কত বড়োলোক বাড়ীর মানুষ তারা, সানাউল্লাহর আয়োজন কি আজো পছন্দ হবে তাদের? আয়মানের কোনো সমস্যা নেই। বাবার টাকা আছে। শুধু আংটি আর আনিকার জন খুচরো কিছু কসমেটিক কিনে নিয়েছে। আগুন এক ফাঁকে গাড়ি দাঁড় করিয়ে মিষ্টি, ফ্রুটস, বিস্কুট, চানাচুর, চিপস কিনে মোটামুটি একটা বড়সড় ব্যাগ বানিয়ে ফেলেছে।
আনিকাদের বাড়িতে পৌঁছে গিয়েছে সবাই। সোফায় বসে আছ। রাশেদ মোটা ফ্রেমের চশমার আড়াল থেকে আধবুড়ো চক্ষুজোড়া ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বাড়িটা অবলোকন করছেন। একতলা বিশিষ্ট বাড়ি। দেয়াল টানা, তবে উপরের ছাঁদ টিনের তৈরী। তিনটা রুম, আসবাবপত্র, ফার্নিচার দিয়ে সুন্দর পরিপার্টি করে সাজানো গোছানো। বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন লাগছে দেখতে। ওদের সামনের ছোট টী-টেবিলে হরেকরকমের খাবার সাজানো। কয়েক ধরনের ফল, মিষ্টি, শুকনো খাবার। সবার সাথে সানাউল্লাহ বসে আছেন। ওনার ভীষণ হাঁসফাঁস লাগছে। কিছু বলতেও দ্বিধাবোধ করছেন। সময় নিয়ে ভদ্রতা সরূপ নম্রতা সহকারে বলে উঠলেন,

” আপনারা কিছু খাচ্ছেন না যে? ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখবেন, আপনাদের চাহিদা অনুযায়ী ব্যবস্থা করতে পারিনি। আসলে সময় স্বল্পতার জন্য যা পেরেছি ততটুকু করেছি। ”
মিনা মুচকি হেসে বললেন,
” এসব কি বলছেন ভাই? আপনাদের প্রতি আমরা অসন্তুষ্ট নই৷ আমাদেরই উচিত হয়নি হুট করে চলে আসার৷ ছেলের পাগলামোর জন্য আসতে বাধ্য হয়েছি। ”
সানাউল্লাহ স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন। সবাই হালকা খেলো। মোম দু টুকরো কমলার পিচ খেয়েছে আর আমের জুস। মোম, আনিকাকে দেখার জন্য এদিক ওদিক নজর বুলাচ্ছে। মোম যেই পোশাকই পড়ুক না কেন, তাতেই দারুণ লাগে। আগুন বউয়ের ব্লাশিত রক্তাভ গালে আর পীবর ঠোঁটের দিকে চেয়ে আছে। ইচ্ছে করছে টপাটপ গুটিকয়েক চুমু খেতে। মোম জুসের গ্লাস রেখে আগুনের দিকে আঁড়চোখে তাকায়। আগুন’কে নেশাক্ত চোখে তাকাতে দেখে দ্রুত নজর ফিরিয়ে নেয়।
টিস্যু দিয়ে মুখ মুছে রাশেদ গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
” আপনার মেয়েকে ডাকুন। ”

সানাউল্লাহ পাশের বাসার এক খালা সম্পর্কে ভদ্রমহিলাকে ডেকে বললেন, আনিকা’কে নিয়ে আসতে। আয়োজনের কাজের সুবিধার্থে ভদ্রমহিলাকে ডেকেছেন তিনি। আয়মানের উশখুশ লাগছে। মুষ্টিবদ্ধ করে রাখা হাতের তালু ঘামতে শুরু করেছে। উত্তেজনায় মন ছটফট করছে। কিছুক্ষণ পর ধীর কদমে আনিকা ড্রয়িংরুমে এসে হাজির হলো। মিনা তাকে পাশে বসতে বললেন। আনিকা বসলো। মাথা নিচু করে ফ্লোরে তাকিয়ে আছে। গায়ে হলুদ রঙের থ্রি-পিস। চোখে কাজল, মাথায় ওড়না দিয়ে ঘোমটা দেওয়া। মুখে আর কোনো সাজ নেই। আনিকার শ্যামলাটে মায়াবী মুখশ্রী থুতনিতে হাত রেখে পর্যবেক্ষণ করলেন মিনা। মেয়েটা দেখতে মাশা আল্লাহ। আয়মান এক দৃষ্টিতে আনিকার দিকে চেয়ে আছে। আনিকা আয়মানের দিকে তাকায়নি। নিরবতা বিরাজমান কক্ষে তা ভঙ্গ করে ভরাট স্বরে রাশেদ বলে উঠলেন,

” আপনাদের ফ্যামিলি স্ট্যাটাস নিয়ে আমার তেমন মাথাব্যথা নেই। আমার বাড়ির লক্ষী ভালো হলেই ভালো। আপনার সম্পর্কে টুকটাক আয়মানের থেকে জানতে পেরেছি। আপনি রাজি থাকলে আমরা আজকেই আপনার মেয়েকে আংটি পড়িয়ে দিয়ে যাবো। ”
সানাউল্লাহ হেসে জবাব দিলেন,
” আমার মেয়ে রাজি, এতে আমার আপত্তির কোনো কারণ নেই। ”

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৩৪

সানাউল্লাহর সাথে রাশেদ, মিনা একের পর এক কথা বলে যাচ্ছেন। ময়ূরী, মোম দুজন কানেকানে কিছু বলছে আর মিটিমিটি হাসছে। আগুন সকলের দৃষ্টির অগোচরে মোম’কে দেখে চলেছে। আনিকা একবার মাথা তুকে আড়ঁচোখে আয়মান’কে দেখেছে। নির্লজ্জটা’কে দেখতে অনেক হ্যান্ডসাম লাগছে। হঠাৎ আয়মানের ফোনে টুং করে একটা শব্দ হলো। আয়মান ভ্রু কুঁচকে ফোনের দিকে তাকায়। একটা মেসেজ এসেছে। সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে বোমা ফাটানোর মতো করে বলে উঠলো,
” আমি আনিকার সাথে এনগেজমেন্ট করতে পারবো না! ”

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৩৬