শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৩৬
সুমাইয়া সুলতানা
অন্ধকার আচ্ছাদন রাতে সানাউল্লাহর বাড়ির ড্রয়িংরুমে বিরাজমান পিনপিনে নীরবতা। এরকম নিস্তব্ধতা কক্ষে ছাঁদ থেকে সিমেন্ট খসে পড়লে মনে হবে বড়সড় ব্লাস্ট হয়েছে। এতটাই শুনশান নিরিবিলি থমথমে হয়ে রয়েছে কক্ষ টা। হাসিখুশি মাখা মুহূর্তটা নিমিষেই ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছে। কারো মুখে কোনো কথা নেই। একরাশ বিষন্নতা নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছে। সকলের নজর আয়মানের উপর। বিস্ময়কর দৃষ্টিতে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে। মুখবিবর অস্বাভাবিক, কি প্রতিক্রিয়া দেখাবে সেটাই ভুলে গিয়েছে তারা।
এতক্ষণ আনিকা মাথা নিচু করে থাকলেও আয়মানের কথায় চমকে ওঠে, হতবিহ্বল চোখে তার পানে চায়। একাকীত্বের বেদনার মতো ছায়া স্বরূপ ধরা দিয়েছে মন গহীনে। দুরুদুরু বুক কাঁপছে। কম্পিত ঠোঁট নেড়ে কথা বলতে চাইছে কিন্তু কন্ঠনালী ভেদ করে তা পারছে না। বুঝলো শব্দভাণ্ডার থিঁতিয়ে এসেছে প্রায়। কাজল কালো চক্ষু জোড়া ছলছল করে উঠল৷ ছোট্ট মস্তিষ্কের ভেতর হানা দিল বিতৃষ্ণা দায়ক বিদঘুটে চিন্তা! শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেল উত্তালতা বেগবান স্রোতের হাতছানি!
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আয়মান যদি এনগেজমেন্ট না করে এসময় ওদের বাড়িতে এসেছে কেন? ফোন করে ছোটখাটো আয়োজন করতে বলেছে কেন? গুটিকয়েক পাড়াপ্রতিবেশি আনিকার এনগেজমেন্টের কথা জানে, তারা কি ভাববে? বর্তমান সমাজে ছেলের যতোই দোষ থাকুক না কেন, সবসময় সমাজ মেয়েদের দিকেই আঙুল তুলে। তারা ভাববে আনিকার নিশ্চয়ই অন্য কারোর সাথে চক্কর আছে, সেজন্য ছেলের বাড়ির লোক এনগেজমেন্ট না করে চলে গিয়েছে! সেসব বাদ দিলে, আয়মান? আয়মান এতদিন যা যা বলেছে, পাগলামো করেছে তবে কি সেগুলো সব মিথ্যে? অভিনয় ছিল কি? কোথায়? আনিকা তো কোনো অভিনয় করেনি! ও তো মন থেকে এই বেয়াদব, ফালতু ছেলেটার উপর দিনকে দিন দুর্বল হয়ে পড়ছে। তাহলে আয়মান হঠাৎ করে এসে হুট করে কেন বলছে এনগেজমেন্ট করবে না? আনিকা তো বলেনি ওর পিছু পিছু ঘুরতে! আয়মান নিজে থেকে ওকে জ্বালিয়েছে। বড়োলোকের ছেলে বলে কি মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে পেয়ে গেইম খেলতে চাচ্ছে? নাকি সেদিন রাস্তায় কপাল ফাটিয়েছে বলে, প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করতে প্রেমের নাটক করেছে? এরকম হাজারো হৃদয় ভাঙার সম্ভাবনাময় প্রশ্ন আনিকার মগজে কিলবিলিয়ে উঠছে।
আগুনের পুরুষালী চোয়ালদ্বয় শক্ত হয়ে উঠে। মেজাজ খারাপ হচ্ছে। শিরায় শিরায় রক্ত টগবগিয়ে উঠছে। অগ্নিচক্ষু নিয়ে আয়মানের দিকে চেয়ে রইল অনিমেষ। শক্ত গলায় দাঁতে দাঁত পিষে শুধাল,
” তুই কি মজা করছিস আমাদের সাথে? এটা কি মজা করার সময়? ”
আয়মান টানটান হয়ে উঠে দাঁড়ায়। হাত ঘড়িতে সময় বুলায়। ভাঁজ করা শার্টের কলার আবার টেনেটুনে ঠিকঠাক করে। দাম্ভিক সহিত চওড়া গলায় জবাব দিল,
” আমি মজা করছি না! আ’ম সিরিয়াস ব্রো। ”
” আমার পায়ে পড়ে দীর্ঘদিন ধরে ঘ্যানঘ্যান করেছিস আজকের দিনটার জন্য, আর এখন তুই বলছিস এনগেজমেন্ট করবি না! মানে টা কি? ”
আয়মান গা ছাড়া ভাবে বলে,
” করবো না এনগেজমেন্ট! এনগেজমেন্ট করার মুড নেই আমার। ”
আগুন রাগ যথাসাধ্য আয়ত্তে রাখল। কন্ঠ খাদে এনে গমগমে আওয়াজে জানালো,
” আমি নিজের হাত বেশিক্ষণ কন্ট্রোলে রাখতে পারবো না, আয়মান! রাতের বেলা ড্রামা শুরু করেছিস? থাপড়িয়ে তোর মুড ছুটিয়ে দিবো। এটা কি কোনো খেলা? যখন মুড হবে খেলবি, মুড নেই তো খেলা বন্ধ করে দিবি! ”
” আমার কথাটা শোনো। ”
আনিকার বাবার মুখটা পানসে হয়ে রয়েছে। তিনি একবার মেয়ের দিকে তাকাচ্ছেন তো একবার আয়মানের দিকে। মেয়ের জলে টইটম্বুর অক্ষিকূট নজরে পড়তেই বুকের ভেতর মুচড়ে উঠল। মেয়েটার মুখটা মলিনতায় ছেয়ে রয়েছে। আনিকার চোখে আয়মানের জন্য এক ধরনের মিষ্টি সুখকর অনুভূতি তিনি দেখতে পাচ্ছেন। কিন্তু আয়মান যে বলছে এনগেজমেন্ট করবে না! তবে কি তিনি মেয়ের জন্য ভুল ছেলে পছন্দ করে ফেলেছেন? সানাউল্লাহ ব্যথাতুর হৃদয়ে অসহায় চোখে আয়মানের দিকে চেয়ে শান্ত কন্ঠে বললেন,
” হঠাৎ এ কথা বলছো কেন বাবা? আমাদের দ্বারা কোনো অন্যায় বা ভুল হলে বলো? আমরা সেটা শুধরে নিবো। এভাবে এনগেজমেন্টের অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিলে আমার মেয়েটা কষ্ট পাবে। আজকের ঘটনা গোপন থাকবে না! ঠিকই পাড়াপ্রতিবেশি কানাঘুষা শুরু করে দিবে! আমার মেয়েটার বদনাম হয়ে যাবে। এনগেজমেন্ট করে নাও বাবা। ”
আনিকা বাবার পানে তাকায়। জীবনে প্রথম নিজের বাবা’কে কারো সামনে মাথা নিচু করে অনুরোধ স্বরূপ কিছু বলতে দেখছে৷ তাও সেটা ওর জন্য! হৃদয়গহীনে চিনচিন ব্যথা অনুভব হচ্ছে। টুপ করে গাল বেয়ে এক ফোঁটা নোনাজল গড়িয়ে পড়ল। কেউ দেখার আগে আঙুল দিয়ে ছিটকে ফেলে দিল। আনিকার চোখের জল কেউ না দেখলেও সানাউল্লাহ আর আয়মানের নজর এড়ায়নি। নিজের মনকে শক্ত করল আনিকা। লম্বা শ্বাস টানল। যে ছেলে বাড়ি বয়ে এসে অপমান করতে চায়, তাকে আনিকা কক্ষনো বিয়ে করবে না। নিজেকে প্রস্তুত করে আয়মান’কে তিক্ত কড়া কথা শোনানোর জন্য ধাতস্থ করল। সেই মুহূর্তে আয়মানের দীপ্তিমান সাবলীল বাক্য ড্রয়িংরুমে প্রত্যেক সদস্যদের মনে ঝংকার তুলল। আয়মান অত্যন্ত ধীর চনমনে কন্ঠে আওড়াল,
” আমি আনিকা’কে এনগেজমেন্ট নয়, ডিরেক্টলী বিয়ে করতে চাই! ”
বজ্রপাতের ন্যায় চমকে উঠল সকলে। একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে। আয়মান কি বলছে কারোরই সেটা বোধগম্য হচ্ছে না। আগুন তিরিক্ষি মেজাজ নিয়ে প্রশ্ন করলো,
” যা বলার সরাসরি বল। তোর কথা ঠিক বুঝতে পারছি না। ”
আয়মান অধৈর্য্য সহিত বলে,
” সরাসরিই তো বললাম। বাংলা ভাষাতে বলেছি। না বোঝার কি আছে? ”
আগুন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে,
” তুই কি বলছিস তুই জানিস? বুঝতে পারছিস? ”
” অবশ্যই। আমার ব্যাপার আমি বুঝবো না? ”
” পাগলের মতো কথা বলিস না। বিয়ে পড়ে, এনগেজমেন্ট কর আজকের জন্য। ”
” একবার যখন বলেছি বিয়ে করে তবেই যাবো। ”
আগুন ঝাঁঝ সমেত মৃদুস্বরে চেঁচিয়ে বলল,
” তোর বিয়ে করাও লাগবে না, এনগেজমেন্ট করাও লাগবে না। কার সামনে দাঁড়িয়ে ত্যাড়ামি করছিস ভুলে যাচ্ছিস? ”
আয়মান এ পর্যায়ে কিছুটা দমে গেল। অসহায় মুখভঙ্গিতে বলে উঠলো,
” ব্রো, তুমি অন্তত আমাকে বুঝো। আমার একমাত্র আশাভরসা তো তুমি। ”
রাশেদ বসা হতে উঠে দাঁড়ান। কর্কশ আওয়াজে বলে উঠলেন,
” তুমি কিন্তু এখন বেশি বেশি করছো আয়মান! বিয়ে কি হাতের মোয়া যে চাইলেই পাওয়া যায়? ঝামেলা না করে, এনগেজমেন্ট দ্রুত শেষ করে বাড়িতে চলো। ”
আয়মান ফোঁস করে তপ্ত শ্বাস ছাড়ে। মিহি কন্ঠে বলে,
” আব্বু এনগেজমেন্ট করি অথবা বিয়ে একই তো। আমাদের পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তো আনিকা’কে বাড়িতে তুলবে না। আবার আনিকা ভার্সিটিতে উঠলে পড়াশোনার চক্করে বিয়ের অনুষ্ঠান আটকে যেতে পারে। বাবার বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করার জন্য মনস্থির করতে পারে। তাই বলছিলাম বিয়েটা হয়ে গেলে সবচেয়ে ভালো হবে। ”
রাশেদ চিবিয়ে চিবিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
” এভাবে বিয়ে করা যায় না। বিয়ের জন্য কিছু সুনির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে, সেগুলো পালন করে বিয়ে করতে হয়। এখন রাতের বেলা তাড়াহুড়ো করে বিয়ের কার্যক্রম সম্পূর্ণ পূরণ করবো কিভাবে? তুমি তো বলোনি বিয়ে করতে চাও, আগে বললে সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতাম। ব্যবস্থা করতাম। তাছাড়া, তোমার দু’জন অপ্রাপ্তবয়স্ক। বিয়ের উপযুক্ত নূন্যতম বয়স প্রয়োজন, ছেলে হলে তেইশ আর মেয়ে হলে আঠারো। ”
” ভাইয়া বাল্যবিবাহ করেছে তার বেলা কিছু না? ভাবীর বয়স তখন মাত্র পনেরো ছিল। ”
” গ্রামের সাথে তুমি শহরের তুলনা করছো? ”
আয়মান বেশ ভাব নিয়ে বলে ওঠে,
” আমার কাছে এটার সাজেশন আছে আব্বু। ”
” কি সাজেশন? ”
আয়মান সবার দিকে এক পলক তাকায়। সকলে ওর দিকেই আগ্রহ সমেত উত্তরের আশায় তাকিয়ে আছে। আয়মান শুষ্ক ঢোক গিলল। জিভ দ্বারা ঠোঁট ভিজিয়ে মিনমিন করে বলল,
” কোর্ট ম্যারিজ! ”
মিনা, রাশেদ, সানাউল্লাহ, ময়ূরী হতভম্বের ন্যায় এক সাথে বলে উঠলো,
” কিহ্! ”
আয়মান ছোট করে উত্তর দিল,
” হুম। ”
সানাউল্লাহ হতবিহ্বল অক্ষিপটে চেয়ে আশ্চর্যজনক গলায় শুধালেন,
” তুমি বিয়ে করতে চাচ্ছো? কিন্তু কেন? আগে আংটি পড়িয়ে রাখো, পড়ে না হয়…. ”
বাদ সাধলো আয়মান। রাশভারী কন্ঠে বলল,
” না আঙ্কেল, পড়ে না। আজকে এক্ষুনি আনিকা’কে বিয়ে করবো। ”
” কাজী ডাকা, উকিল ঠিক করা অনেক ঝামেলার ব্যাপার-স্যাপার রয়েছে। কিভাবে কি হবে? ”
আয়মান বাঁকা হাসল। অধর কোণে রহস্যজনক হাসি ঝুলিয়ে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে জানালো,
” এসব নিয়ে আপনাদের ভাবতে হবে না আঙ্কেল। আমি সকল ব্যবস্থা করে রেখেছি। শুধু সঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষা করছিলাম এতক্ষণ যাবত। ”
সকলে সদস্য আরেক দফা চমকে ওঠে। হতভম্ব নেত্রদ্বয়ে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকল। মুখে কুলুপ এঁটে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে সবাই। কি বা বলবে? কি বা বলার থাকতে পারে? মাথা কাজ করছে না কারোর। তবে আগুন শান্ত, শৈত্য প্রবাহের ন্যায় শিথিল। ব্রীড়ানতায় উদ্বেগের রেশ পর্যন্ত নেই। কপালে প্রগাঢ় ভাঁজ ফেলে তীক্ষ্ণ চাউনী নিক্ষেপ করল আয়মানের উপর। ভারিক্কি নিঃশ্বাস ছেড়ে আয়মানের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়ল,
” এনগেজমেন্ট করতে এসে সরাসরি বিয়ে করতে চাওয়ার কারণ কি? ”
আয়মান মুখবিবরে সাবলীল ভাব ফুটিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল,
” অনেক বড়ো কারণ ব্রো। এই আনিকা’কে আমার বিন্দু মাত্র বিশ্বাস হয় না। মিনিটে মিনিটে মুড বদলায় এই মেয়ে। কথায় কথায় পাল্টি মারার অভ্যাস! এখন খুশিখুশি এনগেজমেন্ট করবে। দেখা গেল কিছুদিন পর অহেতুক কারণ দেখিয়ে হাত থেকে আংটি খুলে আমার মুখের উপর ছুড়ে মেরে বলবে, এই নাও তোমার আংটি আমার তোমাকে আর ভালো লাগে না। সেজন্য ভাবনা চিন্তা করে ঠিক করেছি, এসেছি যখন এই ঝাঁঝ ওয়ালা মেয়েকে খাঁচায় বন্দি করে তবেই ক্ষান্ত হবো। ”
তখন আয়মানের ফোনে ওর এক বন্ধু মেসেজ পাঠিয়ে ছিল। ওর বন্ধুর বাবা পেশায় একজন উকিল। আয়মান ওর বন্ধুকে বলেছিল ও আজকে বিয়ে করবে। কাজী এবং ওর বন্ধুর বাবাকে সাথে নিয়ে কাবীননামার কাগজপত্র যেনে আগে থেকেই রেডি করে রাখা হয়। বন্ধু আয়মানের কথা ফেলতে পারেনি। আয়মান জানতো অপ্রাপ্তবয়স্ক বলে কোর্ট কাবীন করা লাগবে ওদের। তাই আগে থেকে ব্যবস্থা করে রেখেছিল। আয়মান আজ বাড়ি থেকে মনস্থির করে বেরিয়েছিল, এনগেজমেন্ট এর নাম করে বিয়ে করবে। বন্ধুকে বলেছে কাজ হয়ে গেলে ওকে যেন মেসেজ করে জানিয়ে দেওয়া হয়। ফোন দিতে নিষেধ করেছিল আয়মান। বলেছে, তখন ও মেয়ের বাড়িতে সবার সম্মুখে থাকবে। শুধু মেসেজ করলেই চলবে।
আগুন ভ্রু উঁচিয়ে জানতে চাইল,
” তুই এত এডভান্স হলি কবে থেকে? ”
আয়মান কপালে আসা চুলে হাত চালিয়ে পেছন দিকে ঠেলে দেয়। হাতের সাহায্যে চুলে ব্রাশ করে বেশ ভাব নিয়ে বলল,
” আমি সবকিছুতেই ফাস্ট। তোমার মতো লৌ কোয়ালিটির মানুষ না! আনিকা রাজি থাকলে তোমার আগে বাবা হয়ে দেখাবো। প্রমিজ। ”
আগুন কটমট করে চোখ পাকায়। আয়মানের এতে কোনো ভাবান্তর হলো না। আনিকার চক্ষুদ্বয় বড়ো বড়ো হয়ে গেল। সানাউল্লাহ কেশে উঠলেন। মিনা এদিক ওদিক নজর ঘুরায়। মোম, ময়ূরী ঠোঁট টিপে হাসে। রাশেদের মাথা ঝিমঝিম করছে। বুকে হাত দিয়ে তিনি সোফায় বসে পড়লেন। বলার মতো কোনো কথা খুঁজে পেলেন না। তার ছেলে এতটা ধুরন্ধর! এই ছেলে উনি জন্ম দিয়েছেন? কার মতো হয়েছে তার ছোট ছেলে? তার পরিবারে এরকম চিন্তাভাবনার মানুষের কথা তো মনে পড়ছে না, যে ছোট ছেলে তার মতো হবে! তাহলে কার স্বভাব পেয়েছে এই ছেলে? লজ্জায়, ছেলের পাগলামোতে প্রেশার তরতর করে বেড়ে যাচ্ছে।
অবশেষে আয়মানের পাগলামো জয় হলো। কোর্ট কাবীন, তিন কবুল বলে আনিকার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলো। পা রাখল বৈবাহিক জীবনে। শুরু হলো নতুন দুই সাপে নেউলের জুটি। যাদের শুরুর অধ্যায় টা সুন্দর তবে সমাপ্তি কেমন হবে সেটা তো সময়ের সাথে সাথে বোঝা যাবে।
কোর্ট থেকে বেরিয়ে সবাই গাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। এখান থেকে যে যার বাড়ি ফিরে যাবে। আয়মানরা বাড়ির গাড়ি করে এসেছে, সেই গাড়িতেই বাড়ি ফিরে যাবে। কোর্টে আসার সময় টেক্সি গাড়ি করে আনিকা, মোম, ময়ূরী এবং সানাউল্লাহ এসেছিল। আগুন গাড়িতে বসে তাড়া দিতেই আয়মান বলল,
” ভাই তোমরা চলে যাও। আমি আঙ্কেল, আনিকা’কে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসছি। ”
” তুই কি গাড়ি এনেছিস নাকি? ”
” গাড়ি আনিনি তো কি হয়েছে? টেক্সি করে ওদের বাড়ি পর্যন্ত যাবো, তারপর ওই টেক্সি করেই বাড়ি ফিরে আসবো। ”
” ঠিক আছে। সাবধানে আসিস। ”
আয়মান মাথা নাড়লো। আগুন বাড়ির উদ্দেশ্যে গাড়ি স্টার্ট দিল। আয়মান টেক্সি গাড়িতে উঠে আনিকা ও তার বাবা’কে নিয়ে শ্বশুর বাড়িতে যাত্রা শুরু করল।
আনিকাদের বাড়িতে গাড়ি থামতেই সানাউল্লাহ গাড়ি থেকে নেমে ভেতরে চলে গেলেন। আনিকা নিঃশব্দে বাবার সাথে চলে যেতে উদ্যত হতেই আয়মান পেছন থেকে হাত টেনে ধরল। আনিকা চকিতে তাকাল। আয়মান হাত টেনে একটু সাইডে নিয়ে আসলো। আনিকা হাত ছাড়াতে চাইল কিন্তু সফল হলো না। আয়মান তিরস্কার স্বরূপ খোঁচা মেরে বলল,
” এত ছটফট করলে বাসর করতে দু’বারও ভাববো না। মাইন্ড ইট! ”
আনিকা অন্য দিকে চেয়ে মোচড়ামুচড়ি করতে করতে খিটখিটে মেজাজ সমেত বলল,
” ছাড়ুন! বাবা এক্ষুনি ডাকবে আমায়। ”
আয়মান ছাড়ল না উল্টো আনিকার কোমর প্যাঁচিয়ে ধরল। এক টানে নিজের বক্ষের সঙ্গে মিশিয়ে নিলো। কানের কাছে মুখ নিয়ে হিসহিসিয়ে হুমকি স্বরূপ কটাক্ষ আওয়াজে জানালো,
” কিসের ছাড়াছাড়ি? এখন শুধু ধরাধরি ডার্লিং। ”
” চুপ করুন। ”
” করলাম। এখন বলো, তোমার কি গিফট চাই। ”
” কিসের গিফট? ”
” বা রে! বিয়ে করেছি বউ’কে গিফট দিবো না? ”
আয়মানের মুখে বউ শব্দটা শুনে আনিকার শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। বার কয়েক পলক ঝাপটায়। মৃদুস্বরে কাঁপা গলায় বলে,
” আমার কোনো গিফট চাই না। ”
” তুমি নিতে না চাইলে আমি শুনবো কেন? গিফট তো দিবোই। ”
” আপনার দেরি হচ্ছে। বাড়ি ফিরবেন না? ”
আয়মান কোমরে আরেকটু চাপ দিয়ে স্লেজ স্বরে আওড়াল,
” বলতে পারো না? আয়মান এখানে যেকে যান। ”
আনিকা নিশ্চুপ রইল। ধাক্কা দিয়ে আয়মান’কে নিজের থেকে সরিয়ে দিতে চাইলে, বরাবরের মতো এবারে ব্যর্থ হতে হলো তাকে। আয়মান ঝুঁকে আসে কিঞ্চিৎ। আনিকার গালে নাক ঘষে সাফাই দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল,
” গিফট দিয়েই চলে যাবো। তুমি গিফট নিতে যত দেরি করবে, আমার তোমাকে ছেড়ে বাড়ি ফিরতে ঠিক ততটাই দেরি হবে। ”
আনিকার শরীর কাঁপছে অস্বাভাবিক গতিতে। আয়মানের গরম নিঃশ্বাস ওর চোখেমুখে উপচে পড়ছে। হা করে কিছু বলতে চাইল তার আগেই আয়মান ওর কমলকোষের ন্যায় ঠোঁট জোড়া দখল করে নিলো। সহসা আনিকা চোখ খিঁচে বন্ধ করে নেয়। আয়মানের বাহু খামচে ধরে। দুলে উঠল মেয়েলি তনুমন। ঠোঁটের মিষ্টি স্বাদ নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ পর আয়মান আনিকা’কে ছেড়ে দিল। কন্ঠ নিচুতে নিয়ে বলল,
” নাইস টেস্ট। ”
আনিকা লজ্জাকর দৃষ্টিতে আয়মানের দিকে তাকায়। আয়মান চেয়ে ছিল তার পানে। আনিকার বিস্ময়কর দৃষ্টি দেখে চোখ মেরে দিল। আনিকা থমথমে খায়। নজর ফিরিয়ে নেয়। আয়মান ঠোঁট কামড়ে মিটিমিটি হাসল।
বাড়িতে ফিরে আগুন বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে। কপালে হাত ঠেকিয়ে চুপ করে শুয়ে আছে। মোম শাশুড়ির সাথে টুকটাক কাজ সেরে রুমে আসলো। দরজা লাগিয়ে লাইট বন্ধ করে বিছানায় আসে। জানালা খোলা। পর্দা সরানো। দূরের সুক্ষ্ম আলোকরশ্মি রুমে আসছে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না কিছু, সব ঘোলাটে দেখাচ্ছে। মোম ফোনের ফ্লাশলাইট জ্বালিয়ে আগুনের মুখের সামনে ধরে। মিহি কন্ঠে ডাকল,
” শুনছেন? ”
আগুন গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দিল,
” বলো। ”
” শরীর খারাপ লাগছে? ”
” উঁহু! ”
” কপালে হাত রেখে শুয়ে আছেন যে? ”
” তৃষ্ণা পেয়েছে। ”
মোম উঠে যেতে চায়। আগুন বাঁধা প্রদান করল।
” কোথায় যাচ্ছো? ”
” পানি আনতে। ”
আগুন অবাক হয়ে ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
” পানি কেন? ”
” আপনার নাকি তৃষ্ণা পেয়েছে? ”
” পানির তৃষ্ণা না। ”
মোম বুঝতে পারলো না। অবুঝ গলায় প্রশ্ন করে,
” তাহলে কিসের তৃষ্ণা? ”
” তোমার ঠোঁটের। ”
লজ্জায় মোমের কান দিয়ে মনে হচ্ছে ধোঁয়া ছুটছে। তুরন্ত ছিটকে ওপাশ ফিরে খাটের কার্নিশ ঘেঁষে শুয়ে পড়ল। আগুন ভ্রু যুগল কুঁচকে বলিষ্ঠ হাতে মোমের কোমর টেনে নিজের চওড়া শরীরের উপর নিয়ে নিলো। মোম গুটিয়ে আগুনের বুকের ভেতর ঢুকে গেল। আগুনের সহ্য হলো না। জবরদস্তি বুক থেকে সরিয়ে মোম’কে নিজের শরীরের নিচে ফেলে দিল। মোম জোরে জোরে নিঃশ্বাস ত্যাগ করছে। ঘনঘন নিঃশ্বাসের তোপে মেয়েলি আবেদনময়ী বক্ষবিভাজন উঠানামা করছে, যার দরুন আগুনের পৌরুষ সবকিছু এলোমেলো লাগছে। মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে বউকে কাছের পাওয়া তীব্র নেশা। চক্ষুজোড়া মোমের রক্তজবা ঠোঁটে তার একাগ্র নিবেশন। সময়ের পলকে মোমের ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে দিল। ঠোঁট দিয়ে স্লাইড করতে করতে হাস্কিস্বরে বলল,
শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৩৫
” সোনারগাঁওয়ের কথা ভুলে গিয়েছো? এখানে আসার পরও অনেক জ্বালিয়েছ। এবার আমাকে সামলাও। ”
বাক্যের ইতি টেনে মোমের পীবর ঠোঁটে পুরুষালী ঠোঁট জোড়া চেপে ধরল। ক্ষনিকের সময়ে আগুনের উত্তপ্ত ওষ্ঠপুট ছড়িয়ে পড়ল মোমের সর্বত্র। কপালে চুমু খেল। গালে ঠোঁট বুলিয়ে ভালোবাসা নামক উন্মাদনায় পিষে ফেলতে চাইল আগুনের হৃদয়ে প্রেমের ঢেউ উঠানো রমণী’কে। বেহায়া হাতের বেসামাল স্পর্শে মোমের টালমাটাল অবস্থা। পাতলা গড়নের শরীর বারংবার কেঁপে উঠছে। ঝংকার তুলছে সারা গায়ে। অন্ধকারময় রাত্রি যত গভীর হচ্ছে, আগুনের উৎপীড়নের তোপে মোম তত ভৎস হচ্ছে। বদ্ধ কক্ষে ঘনঘন শ্বাসপ্রশ্বাস জানান দিচ্ছে, দুই নরনারীর মিলনের অন্তীম মুহূর্ত সেই সাথে তাদের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ।