শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৩৭
সুমাইয়া সুলতানা
গরমের রাত্রিতে চারপাশে যে নীরবতা ছিল, তা ধীরে ধীরে জীবন্ত হয়ে ওঠে। সূর্যের রোশনাই যখন মাটিতে পড়তে শুরু করে, তখন মনে হয় সবকিছু নতুন করে প্রাণ পেয়ে উঠেছে। গাছের পাতাগুলো শিশিরের বিন্দুতে ঝলমল করে, যেন সারা রাতের পরিশ্রম শেষে তারা স্নান করেছে।
খোলা জানালর পর্দা ভেদ করে সূর্যের কিরণ আনিকার মুখশ্রীতে পড়ছে। আলোর সংস্পর্শে চোখমুখ কুঁচকে ফেলল সে। হাতের সাহায্যে আলো চোখে পড়া রোধ করতে চাইল। গতকাল রাতে ঘুমিয়ে ছিল দেরি করে। তাই তো এত বেলা গড়ালো অথচ সে এখনো বিছানায় লেপ্টে। আড়মোড়া ভেঙে হাত দু’দিকে ছড়িয়ে পুনরায় ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তবে তা সম্ভব হলো না। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কিছুর ইঙ্গিত দিতেই হতবিহ্বল অক্ষিপটে ওপাশে নজর ফেরাল। যা ভেবেছিল তাই! আয়মান কাত হয়ে মাথার নিচে এক হাত দিয়ে শুয়ে আছে আনিকার বিছানায়। ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো সে। চক্ষুজোড়া বড়ো বড়ো করে চেয়ে রইল কিয়ৎকাল। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে অবিশ্বাস্য গলায় প্রশ্ন করলো,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
” আপনি এত সকালে আমাদের বাড়িতে কি করছেন? ”
আয়মান মুখবিবর স্বাভাবিক। চনমনে চিত্তে হাসিমুখে জবাব দিল,
” প্রায় সাড়ে দশ-টা বাজে, তোমার কাছে এত সকাল মনে হলো? শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে কি এত বেলা করে ঘুমানো যাবে? আর রইল বাকি তোমাদের বাড়িতে কি করছি? লিসেন, এটা আমার শ্বশুর বাড়ি। আমি যখন খুশি আসতে পারি। ”
” আমার রুমে এসেছেন কিভাবে? আমি তো দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে ছিলাম। ”
” ভুল! তুমি দরজা বন্ধ করোনি। হয়তো কালকে আমার কথা ভাবতে ভাবতে দিনদুনিয়া ভুলে বসে ছিলে। ”
আনিকা চোখ ছোট করে চায়। ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
” এখানে এসেছেন কেন? ”
আয়মান নিষ্পাপ মুখশ্রী বানিয়ে নিরেট স্বরে বলল,
” তোমাকে দেখতে। মিস করছিলাম তো। ”
” দেখা শেষ? এবার চলে যান। ”
” যাবো না। ”
” বাবা দেখলে সমস্যা হবে। ”
আয়মান শরীর কাঁপিয়ে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে জানালো,
” আমি এসেছি বলে শ্বশুর মশাই আমাদের স্পেস দিয়ে বাইরে চলে গিয়েছে। ”
আনিকার মুখ হা হয়ে গেল। ললাটে পড়ল প্রগাঢ় ভাঁজ। বিস্মিত চোখে চেয়ে উদ্বেগ সমেত জানতে চাইল,
” আপনাকে দেখে বাবা কিছু বলেনি? ”
” কি বলবে? ”
” এই যে এখানে এসেছেন সে জন্য। ”
” একদমই না। আমার শ্বশুর হ্যাব্বি বুঝলে? মেয়ের জামাইয়ের মন বুঝে কিন্তু তার মেয়ে আমাকে বুঝে না। ”
শেষের কথাটা আয়মান দুঃখী দুঃখী মুখ করে বলল। আনিকা বিরক্ত হলো। তিরিক্ষি মেজাজ নিয়ে বলে ওঠে,
” আমি বুঝতে চাই না। আপনি এক্ষুনি আমার রুম থেকে বের হোন। ”
” না গেলে কি করবে? ”
আনিকা ফোঁস করে তপ্ত শ্বাস ছাড়ল। বিছানা থেকে নামতে উদ্যত হতেই আয়মান ওর হাত টেনে আনিকা সহ বিছানায় শুয়ে পড়ল। আনিকা ছাড়া পাওয়ার জন্য মোচড়ামুচড়ি করছে। আয়মান জাপ্টে জড়িয়ে ধরে গলায় মুখ ডুবিয়ে দিল। ব্যস! আনিকার ছটফটানি নিমেষে গায়েব হয়ে গেল। আয়মান হেসে উৎফুল্লতা স্বরূপ ধীর গলায় বলল,
” ছটফটিয়ে লাভ নেই। দুপুরের আগে ছাড়ছি না।, ”
আনিকার শরীর কাঁপছে। থমকে থমকে শিউরে উঠছে। কম্পিত ওষ্ঠপুট নেড়ে নেড়ে আর্জি জানায়,
” এমন করবেন না। বাবা এসে আমাদের এক সাথে দেখলে কি ভাববে বলুন তো? ”
” দরজা বন্ধ দেখবে কি করে? ”
আনিকা মৃদু কিল বসিয়ে দেয় আয়মানের বাহুতে। ঝাঁঝ নিয়ে চওড়া গলায় বলে উঠলো,
” যেতে বলেছি আপনাকে। কথা না বাড়িয়ে চলে যান, নয়তো মাথার একটা চুলও আস্ত রাখবো না। সব উপড়ে ফেলে টাকলু বানিয়ে দিবো। ”
” পাবলিক তখন তোমাকে টাকলুর বউ বলে ডাকবে। ”
” ডাকুক। ছাড়ুন এবার। ”
আয়মান আরো শক্ত করে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো। আনিকার কানের পিঠে চুমু দিয়ে মৃদুস্বরে আওড়াল,
” সারা রাত দুচোখের পাতা এক করতে পারিনি। জ্বালিয়ে মেরেছো! এখন আমার ঘুম প্রয়োজন। ডিস্টার্ব করো না জান। ”
” আপনি ঘুমান, আমাকে ছেড়ে দিন। ”
আয়মান, আনিকার ঘাড়ে পুরো মুখ ডুবিয়ে পরম আবেশে চোখ বুঝে ঘোর লাগা গলায় বলল,
” তোমার জন্য ঘুমাতে পারিনি। তুমি চলে গেলে ঘুম আসবে না। সেজন্য তোমাকে আমার সঙ্গে শুয়ে থাকতে হবে। ”
” আপনি ক…. ”
আয়মান তর্জনী দ্বারা আনিকার ঠোঁট চেপে ধরল। গালে আলতো কামড় দিয়ে ফিসফিস করে বলল,
” আর একটা কথা উচ্চারণ করলে তোমার ঠোঁট সুরক্ষিত থাকবে না। জখম করে ছাড়বো। তাই একদম শান্ত হয়ে আমার সাথে শুয়ে থাকো। ”
আনিকা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। কাঁদো কাঁদো মুখভঙ্গিতে আয়মানের বুকের সঙ্গে মিশে রইল।
মোম’কে সাথে নিয়ে আশানুরের বাড়িতে এসেছে আগুন। আশানুর ফোন করে বলেছে, আফিফা অসুস্থ। আশানুরের বাবা-মা বয়স্ক মানুষ রুম থেকে তেমন বের হোন না। আশানুরের কোনো ছোট ভাইবোন নেই যে আফিফার সঙ্গে বসে দু’দন্ড কথা বলবে। মেয়েটা সারাক্ষণ মনমরা হয়ে বসে থাকে। মোমের সাথে আফিফার অনেক ভাব। তাই আশানুর মোম’কে নিয়ে ওদের বাড়িতে যেতে বলেছে।
বর্তমানে সকলে ড্রয়িংরুমে অবস্থান করছে। আগুন সোফায় বসে আছে। মোম বসে আছে আফিফার পাশে। এখানে এসে মোমের মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে গিয়েছে। কথা বলার এক পর্যায়ে আশানুর গলা খাঁকারি দিয়ে হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলল,
” আফিফা প্রেগন্যান্ট। ”
মোম চমকে উঠল। বার কয়েক পলক ঝাপটিয়ে সহসা হেসে আফিফা’কে জড়িয়ে ধরল। সুখকর অনুভূতিতে আফিফার চোখ দুটো চিকচিক করছে। একটা সন্তানের জন্য কত চেষ্টাইনা করেছে। অবশেষে আল্লাহ ওদের উপর রহমত দিয়েছেন। অপ্রাপ্তির খাতায় প্রাপ্তিতে ভরে দিয়েছেন। মা হওয়ার কোমল শ্রেষ্ঠ সুখ অনুভব করার তৌফিক দান করেছেন। নারী সত্তার পূর্ণতার সুযোগ করে দিয়েছেন। আগুন মুচকি হেসে ওদের দু’জনকে শুভেচ্ছা জানালো।
আশানুর কটাক্ষ করে আগুন’কে খোঁচা মেরে বলল,
” তোদের খুশির খবর কবে শুনতে পাবো বস্? ”
আগুন ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
” কিসের কথা বলছিস? ”
আশানুর কৌতুক স্বরে ব্যঙ্গ করে বলে,
” ব্যাটা আম খেয়ে বলে আটি ফেলতে পারি না! ”
আগুন বিরক্তিতে ‘ চ ‘ সূচক শব্দ উচ্চারণ করল। সজোরে আশানুরের পায়ে পদাঘাত করে। আশানুর চোখ বুজে ব্যথাতুর শব্দ তুলল। আগুন তিরস্কার সরূপ রাশভারী কন্ঠে বলল,
” ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে কথা বলিস কেন? সরাসরি বললে কি তোর ইজ্জত যাবে? ছাগল! ”
আশানুর এক চোখ খুলে অন্ধদের মতো তাকায়। ঠোঁট বাঁকিয়ে কটাক্ষ করে জবাব দিল,
” তাই বলে লাথি দিবি? ব্যথা পেয়েছি না? ”
আগুন ভাবলেশহীন ভাবে জানালো,
” ব্যথা পাওয়ার জন্যই দিয়েছি। এবার বল কি বলতে চাচ্ছিলি? ”
” বলতে চেয়েছি তোর বাবা হওয়ার খবর কবে পাবো? ”
মোম লজ্জা পেলো। অন্যদিকে চেয়ে হাঁসফাঁস করতে লাগলো। আগুন ফোঁস করে ভারিক্কি নিঃশ্বাস ছাড়ল। সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে ফিচেল হেসে বলল,
” যখন হবে তখন জানতে পারবি। কবে হবে অগ্রীম কিভাবে জানাই বল? ”
আশানুর ভাবুকতা গলায় বলে,
” তাও ঠিক। ”
আফিফা উঠে দাঁড়ায়। মোমের হাত ধরে বলে,
” আপনারা কথা বলুন। আমি মোম’কে আমার সাথে নিয়ে যাচ্ছি। ”
আগুন মুচকি হেসে চোখের ইশারায় সম্মতি প্রকাশ করল। ওরা চলে গেলে, নিত্যকার কাজকর্ম, সংসার জীবন নিয়ে কথা বলতে লাগলো আগুন এবং আশানুর।
আফিফা ওদের রুমে এসে মোম’কে বসতে বলল। আলমারি থেকে কিছু একটা বের করে মোমের সামনে আসে। একটা কাঠের ডিজাইনার মাঝারি সাইজের বক্স। মোম প্রশ্নবিদ্ধ চোখে চায়। আফিফা অধর জোড়া প্রসারিত করে হেসে আওড়াল,
” এটা কিসের বক্স জানো? ”
” আপনি না বললে কিভাবে জানবো? ”
আফিফা শব্দ করে হেসে উঠল। মোমের গাল টেনে দিল। বক্সটা খুলতেই মোম দেখতে পেলো বাচ্চাদের ছোট ছোট খেলনা। মোম অবুঝ গলায় শুধাল,
” এগুলো কার খেলনা? ”
অফিফার অক্ষিকোটরে জলে টইটম্বুর হলো। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তৃপ্তির হাসি হেসে বলল,
” আমার হবু বাবুর জন্য। ”
মোম অবাক হয়ে জানতে চাইল,
” এক্ষুনি এতসব কিনে রেখেছেন? ”
” না। ”
” তবে? ”
” আরো আগে কিনেছিলাম। মার্কেটে গেলে যখন যেটা পছন্দ হতো নিয়ে আসতাম। আফসোস তখন আমার বাবু হচ্ছিল না। একটা সন্তানের জন্য কত হাহাকার করেছি। ”
মোম স্নিগ্ধকর হাসি উপহার দিয়ে বলল,
” এখন তো হচ্ছে। ”
আফিফা একটা খেলনা হাতে তুলে নাড়াচাড়া করতে করতে বলে,
” হ্যাঁ। সবই খোদার রহমত। তোমাকে খেলনা গুলো দেখাতে ইচ্ছে হলো, তাই দেখালাম। ”
” খেলনা গুলো খুব সুন্দর আপু। ”
” শুনেছিলাম তুমি নাকি অসুস্থ ছিলে? ”
মোম হালকা হেসে উত্তর দিল,
” জ্বি, আপু। ”
” এখন ঠিক আছো? ”
মোম মাথা নাড়লো। আফিফা হাত দিয়ে মোম’কে স্নেহময় আদর করে দেয়। মেয়েটা ভীষণ মিষ্টি। কত মিশুক, অল্প সময়ের মধ্যে আফিফার কাছের একজন হয়ে উঠেছে। মোমের সাথে কথা বললে আফিফা ভিন্ন এক সুখ খুঁজে পায়। মোমের স্নিগ্ধতা ভরপুর মুখশ্রী যে কারো মন ভালো করে দিতে সক্ষম।
মিনা শুকনো ভাজা খাবার বানাচ্ছেন। সন্ধ্যায় খাওয়ার জন্য প্রায়ই এসব বানান তিনি। পরিবার নিয়ে সন্ধ্যার আড্ডাটা মন্দ না। মোম রান্নাঘরে ঢুকে শাশুড়ির পাশে প্লাস্টিকের মোড়া টেনে বসে পড়ে। মিহি কন্ঠে বলে উঠলো,
” মা কি করছেন? ”
মিনা কড়াইতে তৈল ঢেলে উত্তর দিলেন,
” এই কিছু ভাজাপোড়া বানাচ্ছি। ”
” সন্ধ্যায় তো পুরো জমে যাবে। ”
মিনা হাসলেন। ডালের বোড়া, বেগুনের চপ ছোট একটা হাফ প্রিজে তুলে মোমের হাতে দিলেন। মুচকি হেসে বললেন,
” খাও। ”
মোম দন্তপাটি বের করে একপেশে হাসল। ভাজাপোড়া মোমের সবসময়ই পছন্দ। বেগুনী’তে কামড় বসিয়ে মিহি কন্ঠে ঠোঁট নেড়ে তৃপ্তির শব্দ তুলল।
” মা, ভীষণ মজা হয়েছে। আরেকটা পাওয়া যাবে? ”
মিনা হেসে আরেক পিচ বেগুনী দিল। মোম আরাম করে বসে সবগুলো চপ সাবাড় করল। খাওয়ার মাঝে বউ শাশুড়ি মিলে টুকটাক কথা বলছে।
আগুন টেবিলে বসে একটা বই খুলে পড়ছে। মোম এসে কফি দিয়ে গিয়েছে। কফিতে চুমুক দিয়ে বই পড়ায় মনোযোগ দিল। তক্ষুণি ফোনটা বেজে উঠল। আগুন ভ্রু কুঁচকে ফেলল। এসময় আবার কে ফোন করেছে? নাম্বার দেখে চিনতে পারলো, এটা মোমের মায়ের নাম্বার। রিসিভ করে ভদ্রতা স্বরূপ সালাম দিল। আতিফা বানু সলামের জবাব দিয়ে বললেন,
” ভালো আছো বাবা? মোম কোথায়? ”
” জ্বি ভালো। মোম হয়তো মায়ের সাথে আছে। ”
” মোমের বাবার শরীর আগের থেকে খারাপ। বৃষ্টিতে ভিজে অসুখ বাঁধিয়েছেন লোকটা। মোম’কে দেখতে চাচ্ছে, তুমি একবার মোম’কে নিয়ে আমাদের বাড়িতে আসবে? ”
” এখন যেতে পারবো না, মা। তবে আপনি চাইলে মোম’কে পাঠিয়ে দিতে পারি। ”
” মোমের সাথে কথা বলতে চাই। ”
” জ্বি, দিচ্ছি। ”
আগুন কান থেকে ফোন সরিয়ে মোম’কে গলা উঁচিয়ে ডাকল। মোম আসতেই ফোনটা এগিয়ে দিল। স্বল্প আওয়াজে বলল,
” তোমার মা, কথা বলো। ”
মোম কথা বলতে বলতে বারান্দায় চলে গেল। বাবার অসুস্থতার কথা শুনে ক্রন্দনরত গলায় জিজ্ঞেস করলো,
” বাবা এখন কেমন আছে? ”
” তেমন ভালো নেই। তুই এসে দেখে যা। ”
” আমি আসবো। ”
আতিফার থেকে মোবাইল কেড়ে নিয়ে খলিল মোলায়েম গলায় বলে উঠলেন,
” আমার মা কাঁদে কেন? তোর মায়ের কথায় কান দিস না। আমি একদম ঠিক আছি। আসলে বৃষ্টিতে ভিজে ঠান্ডা লেগে জ্বর এসেছিল। এখন আগের থেকে ভালো। ”
মোম ভাঙা গলায় নাক টেনে বলল,
” তাহলে মা যে বলল তুমি অনেক অসুস্থ। ”
খলিল স্ত্রী’কে চোখ রাঙালেন। আতিফার মুখখানা চুপসে গেল। মেয়েকে বোঝানোর স্বরে বললেন,
” তোর মা’কে তো চিনিস, অল্পতেই বাড়াবাড়ি করে। বিশ্বাস কর তুই যেমন ভাবছিস তেমন কিছুই হয়নি। ”
” তবুও আমি যাবো, কতদিন তোমাদের দেখি না। ”
” জামাইর তো সময় নেই। বিয়ের পর প্রথমবার বাড়িতে আসবি তাও জামাই ছাড়া! বিষয়টা ভালো দেখাবে না। তারচেয়ে বরং জামাইয়ের সময় বুঝে তাকে নিয়ে আসিস। ”
বাবা-মা’র সাথে আরো কিছুক্ষণ কথা বলে মোম রুমে আসে। মোমের থমথমে মুখশ্রী দেখে আগুন ভ্রু উঁচিয়ে জানতে চাইল,
” তোমার বাবা অসুস্থ বলে মন খারাপ? ”
মোম চিন্তিত ভঙ্গিতে উত্তর দিল,
” হুম। ”
” তুমি চাইলে কালকে তোমাকে তোমাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিবো। ”
মোম তপ্ত শ্বাস টেনে মৃদুস্বরে বলে,
” না থাক। অন্যদিন যাবো। ”
” তোমার ইচ্ছা। ”
মোম রাতের খাবার খেয়ে এইমাত্র রুমে আসলো। আগুন বেডে বসে ল্যাপটপ নিয়ে প্রশ্ন তৈরী করছে। স্টুডেন্টদের এক্সাম নিবে। প্রশ্ন বানানো অলরেডি শেষ পর্যায়ে। আর তিনটা প্রশ্ন করলে হয়ে যাবে। মোম ড্রেসিং টেবিলে বসে চুলে বিনুনি করছে। আড়চোখে আগুনের দিকে চেয়ে ভোঁতা মুখে ধীর গলায় বলে ওঠে,
” বাড়িটা খালি খালি লাগছে। কেউ আসলে মন্দ হয় না। ”
আগুন ল্যাপটপে চক্ষু জোড়া স্থির রেখে ভরাট স্বরে বলল,
” এখন এই বাড়িতে আছি এবং এখানে সবাই আছে। বাবা-মা, ময়ূরী, আয়মান। তাহলে আর কার কথা বলছো? আনিকার কথা নাকি? ”
মোম বিরক্ত হলো। কটমট করে উঠে দাঁড়ায়। দপ করে আগুনের পাশে বসে পড়ল। ঠোঁট উল্টে বলে,
” আয়মান ভাইয়ার বউ না, আমি অন্য সদস্যের কথা বলছি। ”
আগুন ল্যাপটপ অফ করে ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মোম’কে পর্যবেক্ষণ করল। গম্ভীর আওয়াজে জিজ্ঞেস করলো,
” আমাদের পরিবারে তো আর কেউ নেই। ”
আগুনের তীক্ষ্ণ চাউনীতে মোমের আত্মা কেঁপে ওঠে। শুষ্ক ঢোক গিলল ও। জিভ দ্বারা ঠোঁট ভিজিয়ে মিনমিন করে বলল,
” বাবুর কথা বলছি। আমাদের বাড়িতে ছোট্ট একটা বাবু আসলে খুব ভালো হবে, তাই না? ”
” বাবু আসবে কোথা থেকে? ”
এ পর্যায়ে মোমের চোখ জ্বলে উঠল। কন্ঠ খাদে এনে তিরিক্ষি মেজাজ নিয়ে বলে,
” আমার পেট থেকে আসবে। যেমন আফিফা আপুর পেটে বাবু, সেরকম বাবুর কথা বলছি। ”
কথাটা বলে মোম নিঃশ্বাস নিতেও পারিনি, মুহূর্তে ব্যথায় কুঁকড়ে গেল। কারণ আগুন বলিষ্ঠ হাতে মোমের চোয়াল শক্ত করে চেপে ধরেছে। মোমর অক্ষিপুট ছলছল করে উঠল। ভীতিকর নজর বুলায় আগুনের কাঠিন্য মুখবিবরে। বুক ধড়ফড় করছে। আগুন রাশভারী গলায় ধমকে বলল,
” কি বলেছো? আবার বলো? ”
মোম উত্তর দিতে সক্ষম হলো না। গাল দুটো ব্যথায় টনটন করছে। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসছে নোনাজলে। বেহায়া পানি কণার তর সইল না। গাল বেয়ে ক্রমাগত গড়িয়ে পড়তে লাগলো। আগুনের মায়া হলো না, উল্টো আরও খেপে গেল। ঝাঁঝালো কণ্ঠে পুনরায় জিজ্ঞেস করলো,
” চুপ কেন? জবাব দাও। ”
মোম কন্ঠ ফুঁড়ে শব্দ করে কেঁদে দিল। আগুন হাত গুটিয়ে নিলো। গমগমে গলায় বলল,
” আর কয়েক মাস পড়ে ফাইনাল এক্সাম। স্টাডির প্রতি ফুল কনসেন্ট্রেশন হও। বেহুদা কথাবার্তা ছোট্ট মাথায় আসলে মাথা ভেঙে ফেলবো। তোমার সাহস হয় কিভাবে এক্ষুনি বেবির কথা বলো! ”
মোম গুনগুনিয়ে শব্দ করে কান্না করছে। থেমে থেমে হেঁচকি তুলে কোমলভাবে বলে,
” বাবু হলে কি হবে? আমার বান্ধবী রাহি ওর কথা মনে আছে? ওর ও তো বাবু হবে। ”
আগুন চোয়াল শক্ত করে মোম’কে বিছানার সঙ্গে চেপে ধরে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
” অন্য মেয়ের কথা জানি না, আর না জানতে চাই। আমি শুধু আমার বউয়ের কথা জানি। বাচ্চা একটা মেয়ে! একুশ বছর বয়স হওয়ার আগে বাচ্চার কথা ভুলেও মাথায় আনবে না। থাপ্পড় খেতে না চাইলে, এসব ভুল বাল চিন্তা মাথা হতে ঝেড়ে ফেলে দেও। নয়তো আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না। ”
মোম এখন হাতে ব্যথা পাচ্ছে। আগুন শক্ত করে ধরে রেখেছে। টলমল চোখে সুক্ষ্ম কন্ঠে আওড়াল,
” ব্যথা পাচ্ছি, ছেড়ে দিন। আর বলবো না। ”
আগুন ছেড়ে দিল। লম্বা শ্বাস টেনে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ল। সময় মতো শাসন না করলে এই ত্যাড়া মেয়ে পেয়ে বসতো। অল্প বয়সে বিয়ে করা আর বাচ্চা হওয়া অনেক পার্থক্য। আগুন একজন শিক্ষিত বুঝদার মানুষ হয়ে তার বাচ্চা বউ’কে নিয়ে কোনমতেই রিস্ক নিবে না।
সময় নিয়ে নিজেকে শান্ত করে মোমের দিকে নজর দিল আগুন। সে ওপাশ ফিরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ফুঁপানোর দরুন শরীরটাও কাঁপছে। আগুন হাত বাড়িয়ে কাছে নিয়ে আসে। মোম গুটিয়ে সরে যেতে চায়। আগুন জোর খাটিয়ে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিলো। কেঁদে কেটে ফর্সা মুখটাতে রক্তিম আভা ছেয়ে রয়েছে। গাল চেপে ধরায় তা লাল হয়ে গিয়েছে। আগুনের মনটা খারাপ হয়ে গেল। এতটা শক্ত করে না ধরলেও পারতো। আগুন আদুরে স্বরে ডাকে,
” কোমলমতি? ”
মোম নিশ্চুপ রইল। কথা বলবে না কুমড়ো মার্কা লোকটার সাথে। যখন তখন মোম’কে ব্যথা দেয়। ভালো ভাবে বুঝিয়ে বললেই হতো। এরকম কঠিন ব্যবহার কেন দেখাবে? মোম অভিমানে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। আগুন লাল হয়ে যাওয়া গালে কয়েকটা আদুরে চুমু খেল। বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে শান্ত কন্ঠে বলল,
” তুমি এমন সব উদভ্রান্ত মূলক কথা বলো, যার জন্য আমি রেগে যাই। আর এসব কথা বলবে না, কেমন? ”
মোম কিছু বলল না। আগুন, মোমের ওড়না টেনে চোখমুখ মুছে দিল। গালে হাত রেখে শীতল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,
” গালে ব্যথা করছে? ”
মোম তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। ব্যাটা কুমড়ো বলে কি? ব্যথা দিয়ে জানতে চাইছে, ব্যথা করছে নাকি! রাগে দুঃখে হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। আগুনের বুকে আলতো চাপড় মেরে ভারাক্রান্ত গলায় চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
” না ব্যথা কেন পাবো? ইটের শরীর আমার। ব্যথা লাগে না তো। ”
আগুন বুঝলো মোম রেগে গিয়েছে। নিস্প্রভ মুখশ্রী বানিয়ে নিচু স্বরে বলল,
” এবারের মতো সরি। ”
মোম গাল ফুলিয়ে রাখল। আগুন আরেকটু ঘনিষ্ঠ হয়ে স্লেজ স্বরে আওড়াল,
” আদর লাগবে? ”
মোম কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। আগুন, মোমের গলায় চুম্বন করে পুনরায় মিহি কন্ঠে শুধাল,
” আদর দিলে রাগ কমবে? ”
শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৩৬
মোম চোখ তুলে একপলক আগুন’কে দেখে নেয়। ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে জানালো,
” এখন আপনি এসব নির্লজ্জ মার্কা কথা বন্ধ না করলে আমি কিন্তু চিৎকার করে কান্না করবো। ”
আগুন মিটিমিটি হেসে মোমের ওড়না সরিয়ে দেয়। মোমের চোখের পাতায় চুমু খেয়ে দুষ্টু হেসে বলল,
” রাতের বেলা বিবাহিত নারী স্বামীর সঙ্গে রুমে থাকা অবস্থায় চিৎকার করে কাঁদলে লোকে কি বলবে, জানো নিশ্চয়ই? ”
মোম অসহায় মুখভঙ্গিতে তাকায়। আগুন বাঁকা হাসল। মোমের ঠোঁটে শব্দ করে চুমু খেল। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করল।