শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৩৮
সুমাইয়া সুলতানা
প্রতিটি সকাল সূর্য ওঠার সাথে প্রত্যেক মনুষ্য জাতির জীবনে নতুন বার্তা নিয়ে হাজির হয়। সেটা হতে পারে কারো জীবনে সুখ-শান্তি কিংবা কারো জীবনে দুঃখ-বেদনা। যেই বার্তাই হোক না কেন, হাসিমুখে মেনে নিতে হয়। কষ্ট হলেও আগামী সুদিনের পথ সুগম করতে লড়াই চালিয়ে সমাধান করতে হয়। যদি সংগ্রাম চালিয়ে না যায়, পিছু হটে তাহলে সুদিন কিভাবে আসবে? সুদিন না আসলে মনে শান্তি কিভাবে পাবে? তাই প্রতিটি মনুষ্যজাতির নিত্যকার এ সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হয়। কালের নিয়মের ঊর্ধ্বে যাওয়ার ক্ষমতা কারোর নেই।
এই যে সপ্তাহ পেরিয়ে মাস, মাস পেরিয়ে মোমের পরীক্ষা চলে এলো। সুখনীড়ে বসবাসরত কোনো মানব সময় কিভাবে চলে যায় টের পায় না। ঠিক তেমনি মোমের পরীক্ষা এসে পড়েছে সে বুঝতে পারেনি। আজকে মোম’কে নিয়ে মোমের বাবার বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছে আগুন। কলেজ থেকে ছুটি নেওয়া হয়নি। অবশ্য ছুটি নিয়েই বা কি করবে? শ্বশুর বাড়ি বেড়ানোর মনমানসিকতা নিয়ে তো আর আসেনি! এসেছে মোম’কে পৌঁছে দিতে। মোম’কে বাড়িতে রেখে পরপর ঢাকায় ব্যাক করবে। বাড়িতে যাচ্ছে মোমের খুশি আর ধরে না। কতগুলো মাস বাবা-মা কে দেখে না। ছোট বোন মুনিয়ার দুষ্টু মিষ্টি খুনসুটি দেখা হয় না। বান্ধবীদের সঙ্গে সময় কাটানো হয় না। নদীর তীরে যাওয়া হয় না। মাঠের ছোট ছোট ঘাসফুল ছোঁয়া হয় না। বাড়িতে গেলে ভেতরকার উত্তেজনা কার্যক্রম সম্পূর্ণ করতে পারবে, ভেবেই প্রাণপাখি বাক-বাকুম পায়রা তুলে নাচানাচি করছে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আগুন ড্রাইভিং করার ফাঁকে আড়চোখে মোমের স্নিগ্ধ মুখশ্রী পর্যবেক্ষণ করছে। কোমলমতির চোখেমুখে খুশির ঝলকানি দেখে আগুনের অধর কোণের হাসি মলিনতায় ছেয়ে গেল। বিরক্তিকর আভাস ফুটে উঠল শান্ত চাউনীতে! মুখভঙ্গিতে বিরাজমান করছে থমথমে আবহাওয়া! ফোঁস ফোঁস শব্দ তুলে ভারিক্কি নিঃশ্বাস ছাড়ল। কটাক্ষ করে মোমের উদ্দেশ্যে বিতৃষ্ণার বাণ ছুড়ল,
” তোমার ওই বিশ্রী দন্তপাটি বের করে হাসছো কেন? একদম হাসবে না! ”
মোম গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল। আগুনের বাক্য কর্ণকুহরে পৌঁছাতে ভ্রু কুঁচকে ফেলল। বুঝতে না পেরে মুখ ভার করে প্রশ্ন করলো,
” কি বললেন আপনি? ”
” একা একা হাসছো কেন? এত হাসার কি আছে? ”
মোম খিটখিটে মেজাজে বলল,
” আপনি আমার হাসি কে বিশ্রী বলেছেন? ”
” শুনতে যখন পেয়েছো তাহলে আবার জিজ্ঞেস করছো কেন? ”
মোম মুখ বাঁকায়। ভাবলেশহীন ভাবে জানালো,
” আমার ঠোঁট, আমার দাঁত, আমার ইচ্ছা যতখুশি হাসবো, তাতে আপনার কি? ”
” বাড়িতে যাবে বলে খুব হাসা হচ্ছে, তাই না? ”
মোম উৎফুল্লতা সমেত বলে উঠলো,
” হ্যাঁ। অনেক খুশি আমি। ”
আগুন স্লেজ স্বরে আওড়াল,
” আমি তো খুশি হতে পারছি না, কোমলমতি। ”
মোম ভাবুকতা গলায় শুধাল,
” কেন খুশি না আপনি? ”
আগুন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
” তুমি যদি সেটা বুঝতে, তাহলে তো আমার কোনো দুঃখই ছিল না! ”
শ্বশুর বাড়ি পৌঁছে মোমের মা কে সালাম জানিয়ে কুশলাদি বিনিময়ের মাধ্যম বাড়িতে প্রবেশ করল আগুন। মোম এসে বাবার ঘরে চলে গেল। আগুন ভদ্রতাসূচক শাশুড়ির উদ্দেশ্যে বলল,
” মা, গাড়িতে আপনাদের জন্য কিছু আছে। কাউকে বলে সেগুলো বাড়িতে আনার ব্যবস্থা করলে ভালো হয়। ”
আতিফা বানু উদ্বিগ্নতা সমেত উত্তর দিলেন,
” হ্যাঁ বাবা, আমি দেখছি। তুমি ভেতরে যাও। ”
আগুন চলে গেলে, আতিফা গাড়ির কাছে আসেন। পরিচিত একজন অল্প বয়সি ছেলে’কে ডেকে ব্যাগপত্র গুলো বাড়িতে ঢোকানোর ব্যবস্থা করলেন। ব্যাগের মধ্যে হরেকরকমের ফলফলাদি, মিষ্টি সাথে কাঁচাবাজারে। তিনি বেশ অবাক হলেন। যদিও নিয়ম মোতাবেক শ্বশুর বাড়ি বিয়ের পর প্রথম আসলে এসব নিয়ে আসতে হয়, তাই বলে এতকিছু নিয়ে আসার কি প্রয়োজন ছিলো? আর কিছু না ভেবে ছেলেটার সাথে উনি নিজেও কাজে হাত চালালেন।
মোম ঘরে ঢুকে বাবাকে জড়িয়ে ডুকরে কেঁদে উঠল। মিষ্টি আচরণের মাধ্যমে বাবাকে বকাবকি করল। খলিল মেয়ের পাগলামো দেখে হাসলেন। মেয়ের কপালে চুমু দিয়ে মোলায়েম গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
” আর কতক্ষণ ধরে কান্না করবি? এসে থেকে কান্না করে চলেছিস। ”
মোম ঠোঁট ফুলিয়ে ভাঙা গলায় অভিযোগ জানায়,
” তুমি সেবার বৃষ্টিতে কেন ভিজে ছিলে? তারপর থেকে বেশিরভাগ সময় তুমি অসুস্থ থাকো। ”
” এই এক কথা আর কতবার বলে খোঁটা দিবি? ”
” যতক্ষণ না সুস্থ হচ্ছো। ”
” আমি এখন সুস্থ। তোকে দেখার পর যতটুকু অসুস্থ অনুভব করছিলাম, এখন সেটাও নেই। ”
বাবা মেয়ের কথা চলাকালীন সময়ে আগুন ঘরে ঢুকলো। খলিলের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠেছে। সৌজন্যবোধ সাক্ষাৎ করল দুজন। আগুন জানতে চাইল,
” বাবা, আপনার শরীরের অবস্থা কেমন? ”
” ভালো বাবা। ”
” পায়ের ব্যথা সেরেছে? ”
” পুরোপুরি সারেনি, তবে আগের থেকে ব্যথা কমেছে অনেকটা। একি! তুমি দাঁড়িয়ে আছো কেন? বসো বাবা। ”
আগুন মুচকি হেসে কাঠের আধ পুরোনো চেয়ারে বসে পড়ল। মোম, আগুন’কে একপলক দেখে ভেংচি কেটে বাবাকে নালিশ জানালো,
” তোমার জামাই খুব পঁচা। সারাক্ষণ আমাকে বকাঝকা করে। ধমক দেয়। ”
সহসা আগুনের হাসিটা মুছে গেল। অস্বস্তি অনুভব করছে। বউ তার শ্বশুরের সামনে এভাবে ইজ্জত খেয়ে দিলো? নিশ্চয়ই গাড়িতে দাঁত নিয়ে কটাক্ষ করে কথা বলায়, এখন সেটার শোধ তুলছে। তুলুক, সময় বুঝে আগুনও বুঝিয়ে দিবে সে কি জিনিস!
আতিফা ঘরে ঢুকে মোম’কে চোখ রাঙালেন। ধমকে বলে উঠলেন,
” একদম আমার জামাইয়ের দোষ দিবি না! তোর স্বভাব সম্পর্কে আমি খুব ভালো ভাবেই অবগত। তুই উল্টাপাল্টা কিছু না করলে শুধুশুধু তোকে বকাবকি করবে কেন? ”
মোম হা হয়ে গেল। তার নিজের মা তার পক্ষ না নিয়ে জামাইয়ের পক্ষ নিচ্ছে? গাল ফুলিয়ে বলে ওঠে,
” আমি কিছু না করলেও ধমকায়। তুমি ওনাকে চিনো না। ”
” একদম চুপ! আমার জামাই কেমন আমি জানি। তোর থেকে শুনতে হবে না। ”
আগুন মিটিমিটি হাসছে। আগুনের হাসি দেখে মোমের গা জ্বলে উঠল। পঁচা কুমড়ো মার্কা লোক!
এরইমধ্যে মুনিয়া স্কুল ব্যাগ টেবিলে ধারাম করে ফেলে, আপু বলে চিৎকার করে মোম’কে জাপ্টে জড়িয়ে ধরল। মোম হাসিমুখে বোন’কে নিজের সাথে আগলে নিলো। মুনিয়া হাস্যোজ্জ্বল মুখে আবদার ছুড়ল,
” আপু আজকে আমি তোমার সাথে ঘুমাবো। ”
মোম দন্তপাটি বের করে হেসে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলল,
” ঠিক আছে। ”
মুনিয়া, আগুনের দিকে চেয়ে ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
” দুলাভাই, আপনি কি খালি হাতে এসেছেন? আমার জন্য কিছু নিয়ে আসেন নি? ”
আগুন স্বভাবসুলভ হেসে জানালো,
” এনেছি তো। আমার একমাত্র শালীকা বলে কথা। খালি হাতে কিভাবে আসি বলো? ”
” কি এনেছেন? ”
” তুমি নিজে গিয়ে দেখে নাও। ”
” হ্যাঁ, সেটাই ভালো। ”
আগুন গলা পরিষ্কার করে খলিলের দিকে চেয়ে শান্ত কন্ঠে বলল,
” আমি সন্ধ্যার পরে রাতের দিকে ঢাকা চলে যাবো। ”
আতিফা বানু চমকে উঠলেন। খলিল জিজ্ঞেস করলেন,
” চলে যাবে কেন? কিছুদিন থাকবে না? ”
” সম্ভব না। আমার স্টুডেন্টদের পরীক্ষা এবং স্পেশাল ক্লাস আছে। ওদের গাইড লাইনের জন্য আমার কলেজে উপস্থিত থাকা অতি-আবশ্যক। ”
এ’কথার প্রেক্ষিতে আর কিছু বলতে পারলেন না মোমের বাবা-মা। দায়িত্বশীল একজন মানুষ কখনো দায়িত্ব অবহেলা করে না। আতিফা চলে যান রান্নাঘরে। জামাই চলে যাবে। ভালোমন্দ কিছু খাবার রান্না করবেন না, তা কি করে হয়? মোম’কে ডেকে নিয়ে যান রান্নার কাজে হাতে হাতে সাহায্য করার জন্য। আগুন ফ্রেশ হবে। যাওয়ার আগে মোম, আগুন’কে ওয়াশরুম দেখিয়ে দিয়ে যায়। নিজেও ফ্রেশ হয়ে চলে গেল রান্নাঘরে।
মোমের ক্ষুদ্র মনের চঞ্চল সত্তাটা বিষাদে ভরে উঠেছে। ইতোমধ্যে ঘন পাপড়ি যুক্ত নয়ন জোড়া জলে টইটম্বুর হয়ে গিয়েছে। বিতৃষ্ণায় ছেয়ে গিয়েছে সর্বাঙ্গে। মনোহরণীর মনগহীনে হানা দিয়েছে সুক্ষ্ম ব্যথা। রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছুটে চলেছে বিষাক্তময় একপশলা জ্বালাতন স্রোত! থেমে থেমে নাক টানছে। কেঁদে কেটে টমেটোর মতো লাল হয়ে গিয়েছে ফর্সা মুখশ্রী। আগুন বিছানায় বসে, বুকে হাত গুঁজে ভ্রু কুঁচকে চেয়ে মোমের মুখাবয়ব অবলোকন করছে। আগুন, মোমের কান্না থামানোর চেষ্টা করছে না। বেশ হয়েছে! বাড়িতে আসবে বলে গাড়িতে দাঁত কেলিয়ে হাসছিল তখন। একবারও ভাবেনি আগুন ওকে ছাড়া থাকতে পারবে না! চিন্তা করেনি আগুনের তার কোমলমতি কে ছাড়া বাড়িতে মন টিকবে না। বাবার বাড়ি আসবে বলে খুশিতে ফেটে পড়েছিল তখন! আগুন বুঝতে পারছে না, তাহলে এখন ঢং করে কান্না করে চোখের জলে নাকের জলে এক করার কি আছে?
আগুন হাতঘড়ি’তে নজর বোলালো। তাকে যেতে হবে। সন্ধ্যার আগে বেরিয়ে পড়লে রাত নয়টা-দশটার সময় ঢাকা পৌঁছে যেতে পারবে। উঠে দাঁড়ায় সে। মোমের পড়ার টেবিল থেকে জগ উঠিয়ে গ্লাসে পানি ঢেলে ঢকঢক করে খেয়ে নিলো। মোমের দিকে তীক্ষ্ণ চাউনী নিক্ষেপ করে গমগমে গলায় বলে উঠলো,
” ফ্যাচফ্যাচ করে কান্না করবে নাতো! বিরক্ত লাগছে! ”
মোম তেতে উঠে। কটমট করে তেজি গলায় জবাব দিল,
” আমার কান্না পাচ্ছে আমি কাঁদবো, তাতে আপনার কি? আর বিরক্ত লাগছে আপনার? লাগবেই তো! আপনি তো আমাকে পছন্দ করেন না! ভালোবাসিও কখনো বললেন নি! কি ভেবেছেন? বুঝিনা আমি? আমি তো আপনাকে জ্বালাতন করি, তাই আমাকে একা ফেলে এখানে রেখে গেলেই আপনার শান্তি! ”
বাড়িতে আসা নিয়ে মোমের মুখশ্রীতে যে আবেগ উদ্বেগ ফুটে উঠেছিল, সেটা চিরস্থায়ী হলো না। দপ করে নিভে গেল, যখন শুনেছে আগুন চলে যাবে। তাও পরীক্ষা চলাকালীন পুরো সময়টা আগুনের থেকে দূরে থাকতে হবে! ভাবতেই কন্ঠ ফুঁড়ে কান্না পাচ্ছে মোমের।
আগুন ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
” বেহুদা কথাবার্তা বলবে না তো! আর তুমি এখানে আসা নিয়ে কতটা এক্সাইটেড ছিলে, এখন কি হলো? ”
মোম ছটফটিয়ে উঠে। ঠোঁট উল্টে সরল গলায় জানালো,
” এখানে এসে খুব খুশি লাগছে। কিন্তু আপনাকে ছাড়া থাকতে হবে ভাবতেই বুকের ভেতর চিনচিন ব্যথা করছে। ”
আগুন ঠোঁট কামড়ে একপেশে হাসল। শার্ট ইন করে মোমের সামনে এসে দাঁড়াল। গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
” আমাকে ছাড়া থাকতে কষ্ট হবে? ”
মোম কোনো ভনিতা ছাড়াই সোজাসাপটা জানিয়ে দিল,
” জ্বি। অনেক কষ্ট হবে। ”
আগুন চকচকে দাঁত বের করে মৃদু হাসল। মোমের কাঁধ জড়িয়ে শান্ত কন্ঠে বলল,
” আমারও কষ্ট হবে। ”
মোম টলমলে চোখে তাকায়। গোমড়া মুখে বলল,
” তাহলে থেকে যান এখানে। ”
” বোকার মতো কথা বলো না! তোমার পরীক্ষার সাবজেক্ট কতোগুলো জানো নিশ্চয়ই? তারউপর প্রত্যেক সাবজেক্ট পরীক্ষার আগে একদিন কোনটার ক্ষেত্রে দুইদিন করে বন্ধ। পরীক্ষা শেষ হতে এক মাস সময় লেগে যাবে। এতদিন কি থাকা সম্ভব? কলেজ আছে না আমার? ”
মোম চুপচাপ শুনলো, কিছু বললো না। আগুন মোমের মাথায় চুমু দিয়ে বুকের সঙ্গে মিশিয়ে নিলো। পুনরায় শীতল কণ্ঠে বলল,
” একদম মন খারাপ করবে না। মাথা ঠান্ডা রেখে শান্ত মেজাজে পরীক্ষা দিবে। যেমন পড়িয়েছি তেমন ভালো রেজাল্ট যেন আমি পাই। মনে থাকবে? ”
মোম মাথা নেড়ে বুঝালো থাকবে। আগুন মুখবিবর পরিবর্তন করে শুধায়,
” তোমার বাবাকে তখন আমার নামে বিচার দিয়েছিলে কেন? আমি শুধু তোমাকে ধমকাই? বকাবকি করি? তাহলে এত এত আদর কাকে দেই শুনি? ”
মোম সহসা জিভ কাটল। বুকে মিশেই মিনমিন গলায় বলে ওঠে,
” আমার হাসি’কে বিশ্রী বলেছেন কেন? সেজন্য বিচার দিয়েছি। ”
” তুমি জানো না? তোমার থেকে দূরত্ব আমার এক দন্ড সহ্য হয় না। বাড়িতে আসা নিয়ে তোমার কতশত আহলাদ! তাই ওকথা বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছি। ”
অধর প্রসারিত করে কিঞ্চিৎ মুচকি হাসল মোম। আগুনের বুকে নাকমুখ ঘষলো। উৎকন্ঠায় ছটফটানি মিয়ে এলো।
” ছাড়ো। যেতে হবে এখন। তুমি কান্না করলে যাওয়ার সাহস পাবো না। ”
আবারও মোমের ডাগর ডাগর আঁখি যুগলে নোনাজলে ভরে উঠল। নাক টেনে মৃদুস্বরে আওড়াল,
” ছাড়তে ইচ্ছে করছে না। ”
আগুন অঞ্জলিপুটে মোমের মুখশ্রী তুলে নিলো। ওষ্ঠপুট এগিয়ে দৃঢ় চুম্বন করল ললাটে। থুতনিতে চুমু খেয়ে মুচকি হেসে বলল,
” রোজ ফোন করবো। রক্তে মাংসে গড়া শরীরটা টেনে হিঁচড়ে শহরে নিয়ে গেলেও আমার বেহায়া বেপরোয়া আত্মাটা তোমার কাছেই থেকে যাবে। ছোঁয়াতে নয়, অনুভবে বুঝে নিও আমাকে। ”
প্রাইভেট শেষে কলেজের গেইট পেরিয়ে ফাঁকা রাস্তার মোড়ে রিকশা গাড়ির জন্য দাঁড়িয়ে আছে আনিকা। রাস্তাটা তেমন শুনশান নয়, আবার জনমানবে ভরপুরও নয়। গুটিকয়েক মানুষজন আর গাড়ি চলাচল করছে। বিকেলের শেষভাগ, এই সময়টাতে এই রাস্তায় গাড়ির চলাচল থাকলেও মানুষজন তেমন নজরে আসে না। মুখ ভার করে এদিক ওদিক গাড়ির আসায় চোখ বুলচ্ছে। এমন সময় গলায় প্যাঁচানো ওড়নায় টান পড়তে সহসা পেছন ফিরে তাকাল। বখাটে দুজন ছেলে দেখে পিলে চমকে উঠল। ছেলে দুজন’কে আনিকা কলেজের বাইরে অনেকবার দেখেছিল। এরা মেয়েদের একা পেলে উত্যক্ত করে। এদিকে কোনো মানুষজন নজরে আসছে না। ভয়ে শুষ্ক ঢোক গিলল সে। তবে ভয়টা বাইরে প্রকাশ করল না। তেজি গলায় চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
” কারা আপনারা? পথ আটকেছেন কেন? আমার ওড়না ছাড়ুন। ”
ছেলে দুজন আনিকার শরীরের ভাঁজে চোখ বুলায়। ওড়না ধরে রাখা ছেলেটি পৈশাচিক হেসে বিশ্রী ইঙ্গিত সমেত জানালো,
” ছাড়ার জন্য তো ধরিনি ফুলটুসি! আমরা তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী। একটু ছুতে চাই। ভালোবাসতে চাই তোমাকে। ”
আনিকার গা ঘিণঘিণ করে উঠল। ওড়না ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলো, পারলো না। চিৎকার করে ডেকে ওঠে,
” হেল্প, কেউ আছেন? ”
ছেলে দুজন অট্টহাসি তে ফেটে পড়ল। একজন ছেলে ব্যঙ্গ করে বলল,
” ওই ছেমড়ি চুপ! এটা আমাদের এলাকা। কি ভেবেছিস? সিনেমার মতো তুই চেঁচাবি আর তোর হিরো স্পাইডার ম্যান হয়ে উড়ে এসে তোকে আমাদের হাত থেকে বাঁচাবে? ”
” হ্যাঁ বাঁচাবে। কারণ সিনেমার মতো মেয়েটার হিরো এসে হাজির। আই থিংক, সিনেমার নায়কদের থেকেও ফাস্ট এসেছে। এম আই রাইট ব্লাইন্ড ইস্টুপিড বয়? ”
পেছন থেকে শক্তপোক্ত ভারিক্কি পুরুষালী কন্ঠস্বর কর্ণগোচর হতেই ছেলে দুজন ত্বরিত ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। চেনাপরিচয় স্বর কর্ণকুহরে পৌঁছাতে আনিকা দৃষ্টি তাক করল সেথায়। আয়মান চোয়াল শক্ত করে কাঠকাঠ হয়ে, ছেলে দুজনের দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দাঁড়িয়ে আছে। আয়মান’কে দেখে আনিকার চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ঠোঁটের কোণে ধরা দিল কিঞ্চিৎ মুচকি হাসি। আর কোনো ভয় নেই। আনিকার ভরসা যোগ্য অসভ্য বেহায়া স্বামী এসে পড়েছে। ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে এলো আয়মান। আয়মান’কে দেখে দুজন ছেলের মধ্যে একজন ছেলের চেহারা রক্তশূণ্য ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছে। আয়মানের চক্ষু জোড়া স্থির অন্য ছেলেটির হাতের উপর। ছেলেটি আনিকার ওড়না ধরে দাম্ভিক সহিত এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে। ভীতিকর ছেলেটি তুরন্ত অপর ছেলের হাত থেকে আনিকার ওড়না ছাড়িয়ে দিল। মরুভূমির ন্যায় গলাটা শুকিয়ে গিয়েছে। ভয় পাওয়া ছেলেটি দ্রুত ছুটে এসে আয়মানের পা জড়িয়ে ধরল। ব্যগ্রতা সমেত অনুরোধ করলো,
” ভাই মাফ করে দেন। আমি জানতাম না এই মেয়েটা আপনার গার্লফ্রেন্ড। এবারের মতো মাফ করে দেন, ভাই। ”
আয়মান সজোরে লাথি বসাল ছেলেটির বুকের উপর। দু’পা এগিয়ে গিয়ে আনিকার পাশে দাঁড়ানো ছেলেটির শার্টের কলার ধরে হুংকার ছেড়ে চিৎকার করে বলল,
” জা*উ** বাচ্চা! কার ওড়না ধরার স্পর্ধা দেখিয়েছিস জানিস? ”
বলেই ঘু’ষি মা’রলো ছেলেটির মুখ বরাবর। ছেলেটি ব্যথায় চোখ বুঁজে ” আহ্ ” শব্দ তুলল। লাথি খাওয়া ছেলেটি উঠে এসে আয়মানের কাছ থেকে অপর ছেলেটিকে ছাড়াতে ছাড়াতে বলল,
” ভাই, খোদার কসম! আমরা জানতাম না মেয়েটা আপনার। জানলে ওনার ধারে কাছে ঘেঁষতাম না! উল্টো কেউ ঘেঁষলে তার খবর কবে ছাড়তাম। ভাই দয়া করে ক্ষমা করে দেন। ”
আয়মান ধাক্কা দিয়ে ছেলেটা ছেড়ে দিল। রক্তিম চোখে চেয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
” স্যা সরি হার। ভাবী হয় তোদের। এই মেয়ে এই মেয়ে বললে পরের দিন থেকে কানে শুনতে পাবি না। আর হ্যাঁ, পায়ে টাচ্ করবি না! জুতো ছুঁয়ে ক্ষমা চাইবি। আই রিপিট, ওর শরীরে টাচ্ করা যাবে না। ”
ছেলে দুজন কোনোকিছু না ভেবে তাই করল। আনিকা কোনো প্রতিত্তোর করল না। তাই আয়মান বলল,
” তোদের ব্যাড লাক! আমার ডার্লিং তোদের ক্ষমা করতে চাইছে না মেবি। এবার তোদের হাত ভাঙার জন্য প্রস্তুত হ্! ”
ছেলে দুজন অসহায় মুখভঙ্গিতে কাতর গলায় আর্জি জানায় আনিকার নিকট,
” ভাবী, প্লিজ আমাদের ক্ষমা করে দিন। শুধু আপনাকে কেন, আজ থেকে এই কলেজের আর কোনো মেয়েকে আমরা বিরক্ত করবো না। ”
এবার আনিকা মুখ খুলল। গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
” আচ্ছা, ঠিক আছে। ”
ছেলে দুজন দৌড়ে ওদের সামনে থেকে চলে এলো। যেই ছেলেটি আনিকার ওড়না ধরেছিল, সেই ছেলেটি অপর ছেলেটা’কে প্রশ্ন করলো,
” ওটা কে রে? ”
” রাশেদ শিকদারের ছোট ছেলে। ওই যে গুল্টের মেয়ের সাথে ম’দখোর ভাতিজা বিয়ে দিয়েছে, আবার ভরা ক্যাম্পে একজন ছেলেকে পিটিয়েছিলো? এই সেই আয়মান শিকদার। সেদিন মাস্ক পড়া ছিল বলে হয়তো চিনতে পারিস নি। ”
” ওহ্। বড্ড বাঁচা বেঁচে গিয়েছি। আমার নাকের হাড্ডি টা মনে হয় আর আস্ত নেই। ”
এদিকে আয়মান উতলা হয়ে রাস্তার মধ্যে আনিকা’কে জড়িয়ে ধরে। ক্লিপ দিয়ে বাঁধা ঘনকালো চুলে একের পর এক চুমু খেয়ে উদ্বিগ্ন সমেত জিজ্ঞেস করে,
” তুমি ঠিক আছো? ”
” হ্যাঁ। ছাড়ুন, আমরা রাস্তায় আছি। ”
” এতে আমার কিছু যায় আসে না। অ্যাই! সমস্যা কি তোমার? ”
আনিকা ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
” কি? ”
” সিমেমা টিনেমা দেখোনা নাকি? সেখানে হিরো হিরোইন কে বাঁচালে, হিরোইন দৌড়ে এসে হিরোর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। কিন্তু তুমি তো এরকম কিছুই করলে না। কেন করলে না? ”
আনিকা ভেংচি কেটে কটাক্ষ করে বলল,
” কারণ আমি হিরোইন না। ”
” নাউ কিস মি। ”
” কিহ্! ”
” জড়িয়ে যখন ধরোনি, এত কষ্ট করে তোমার জন্য ভার্সিটির স্পেশাল ক্লাস না করে ছুটে এসেছি। না আসলে আমার বউয়ের কি হতো? তাই চুমু দেও। ”
” সন্ধ্যা নামছে, চলুন বাড়িতে ফেরা যাক। ”
” চুমু দেও, নাহলে আমি নিজেও যাবো না আর তোমাকেও যেতে দিবো না। ”
আনিকা পড়ল বিপাকে। শেষে কি-না এরকম নির্লজ্জ মার্কা ছেলে তার কপালে জুটেছে? ভাবতেই মুখভঙ্গি কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল। আয়মান তাড়া দিয়ে বলল,
” লেট হচ্ছে ডার্লিং। ফাস্ট! ”
আনিকা আশেপাশে নজর বোলালো। এখন এদিকে কেউ নেই। আনিকা পায়ের পাতায় ভর দিয়ে মুখ এগুলো, আয়মান তৎক্ষনাৎ বাঁকা হেসে গলা উঁচু করে নিলো। আনিকা কটমট করে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
” মাথা উঁচু করছেন কেন? একটা লম্বুকে বিয়ে করেছি। আমি তো আপনার কাঁধ পর্যন্ত। ”
মুহূর্তে আয়মান, আনিকার কোমর প্যাঁচিয়ে উঁচু করে সাইডের অন্ধকারময় দেয়ালে লেগে গেল। আনিকা চোখ খিঁচে বন্ধ করে আয়মানের কাঁধের শার্ট খামচে ধরল। আনিকার মুখ এখন আয়মানের মুখ বরাবর। দুজনের তপ্ত শ্বাস দুজনের মুখে আছড়ে পড়ছে। আনিকা জিভ দ্বারা ঠোঁট ভিজিয়ে, ভোঁতা মুখে চুমু খাওয়ার জন্য ঠোঁট এগোয় আয়মানের গালের নিকট। যেই গালে ঠোঁট ছুঁবে তক্ষুণি আয়মান গালের পরিবর্তে ঠোঁট এগিয়ে দিল। অতঃপর মিশে গেলে উত্তপ্ত চার জোড়া ওষ্ঠপুট। আনিকা ছাড়াতে চেয়েও পারলো না। চুম্বকের মতো টেনে ধরে রেখেছে আয়মান, আনিকার ওষ্ঠদ্বয়। আনিকার নিঃশ্বাস আটকে আসতেই বড়ো বড়ো নখ যুক্ত আঙুল দিয়ে খামচে ধরল আয়মানের গলার ভাঁজে। সহসা আনিকার ওষ্ঠদ্বয় মুক্তি পেলো, আয়মানের কবল থেকে।
শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৩৭
আনিকার হাত ধরে, রিকশা গাড়ি ডেকে আয়মান গাড়িতে উঠে বসলো। গাড়িতে চলতে শুরু করেছে। সামনে থেকে ধেয়ে আসা মৃদুমন্দ বাতাস গায়ে লাগছে। রিকশাওয়ালার থেকে নজর ফিরিয়ে, আয়মান ঝুঁকে আসে আনিকার কানের কাছে। ফিসফিস করে বলে উঠলো,
” এইটুকু’তেই হাঁপিয়ে গেলে হবে? আমার মতো বেপরোয়া হাসব্যান্ড’কে সামলানো মুখের কথা না! সেজন্য বলছি, এখন থেকেই প্রাকটিস করে এসব অভ্যাস করে নেওয়া ভালো। ”