শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৬৩

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৬৩
নূরজাহান আক্তার আলো

-’স্যার..স্যার উঠুন! সকালে মেডিসিন আছে। টাইম টু টাইম মেডিসিন নিতে হবে।’
-‘(….)’
-‘স্যার? স্যার রুমে আছেন? ঘুমাবেন আরেকটু? ব্রেকফাস্ট কি তাহলে পরে আনতে বলব?’
-‘(….)’
-‘ মেডিসিন না নিলে পায়ের ব্যথা আরো বাড়বে। গতরাতে জ্বর টর আর এসেছিল? এখন কি একটু বেটার ফিল করছেন? নাকি ডাক্তার মনিকে ডাকব?’

বন্ধ দরজায় নক করতে করতে কথাগুলো বলছিল বুরাক। কিন্তু যাকে বলছে তার কোনো সাড়াশব্দ নেই। সাড়াশব্দ না পেয়েও হাল ছাড়ল না সে বরং পুনরায় নক করতে লাগল। কেন জানি এবার সন্দেহ হলো তাই দরজার নব ঘুরাতেই দরজা খুলে গেল। ভেতরে কাউকে না দেখে তড়িৎ বেডরুম, ওয়াশরুম, বেলকনিতে খুঁজে পকেট থেকে ফোন বের করতেই নজর বিঁধল সেন্টার টেবিলের উপরে কলম দিয়ে চাপা দেওয়া কাগজের দিকে। সে জলদি কাগজের ভাঁজ খুলতেই দেখল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-‘ দেশের বাইরে যাচ্ছি। ক্ষতিপূরণের হিসাব বুঝিয়ে দিতে যেতে হচ্ছে।খুঁজিস না আমায় পাবি না। তোকেও চিরতরে মুক্তি দিলাম নিজের মতো
করে কিয়ারাকে নিয়ে বাঁচ! শীতলকে আমি না পেলেও তোকে তো তোর ভালোবাসার মানুষ কিয়ারাকে পাইয়ে দিয়েছি।খুব ভালো রাখিস তাকে। ভাতের অভাব দিলেও ভালোবাসার অভাব কখনো দিস না তাকে। আর তোদের ভাতের অভাব যেন নাহয় তাই চেক সাইন করে দিলাম যখন যা প্রয়োজন ইচ্ছেমতো সংখ্যা বসিয়ে টাকা উঠিয়ে নিস। ভালো থাকিস তোরা, চির বিদায়!
___পৃথিবীর পাপ ইয়াসির খান।

বুরাক চিঠিটা পড়ে তাকাল অবহেলায় পড়ে থাকা চেকের দিকে। হাতে তুলে সাইন করা চেকটি উল্টে-পাল্টে দেখল। চেকের প্রতিটা পাতায় শো করছে ইয়াসিরের সাইন। সেটা দেখে সে চেকবুকটি টুকরো টুকরো করে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে গটগট শব্দে বেরিয়ে গেল। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ডন নামের কাউকে ডাকতে থাকল উচ্চস্বরে। তার ডাক শুনে গনাদশেক ছেলেপুলে হাজির হতেই সে চিৎকার করে বলল,
-‘স্যার বেরিয়েছে কখন? কেউ আমাকে ইনফর্ম করিস নি কেন?’
তার চিৎকার শুনে ছেলেদের মধ্যে একজন মিনমিন করে জবাব দিলো,
-‘ভাই আপনে ভাবির লগে ছিলেন দেইখা স্যার ডাকতে দেয় নাই। আর
স্যার কইছে কাছে আশেপাশে কোথাও যাচ্ছে তাড়াতাড়ি চইলা আসবে।’

ছেলেটার কথা শুনে বুরাক দাঁতে দাঁত চেপে কল দিতে থাকল ইয়াসিরের গাড়ির ড্রাইভারকে। বুঝতে বাকি রইল না ইয়াসির সঙ্গে লোক নিবে বলে এসব বলে বেরিযেছে। এদিকে একের পর এক কল দিলেও ড্রাইবারকল রিসিভ করছে না। করবে কীভাবে? ড্রাইভার নিষিদ্ধ পল্লীর এক মেয়েকে
জড়িয়ে ধরে আরামে ঘুমাচ্ছে। স্বপ্ন দেখে হাসছে মিটিমিটি। বাম কানের কাছে ভোঁ ভোঁ শব্দ শুনে মেয়েটির ঘুম ভেঙে যায়। বহুকষ্টে চোখ খুলে একবার ফোনের দিক তো আরেকবার তাকায় পাশে ঘুমানো চ্যাংরার দিকে। গতকাল রাতে খুব বেশি বেয়াদবি করেছে এই চ্যাংরা। আর মুখে কি গন্ধ! জীবনে এত কাস্টমারের সঙ্গে থেকে এর মতো খচ্চর কাস্টমার দেখে নি। বেশি কিছু বললে টাকা দিবে না আবার না বললেও সে শান্তি পাবে না। তাই মেয়েটি ফোন হাতে নিয়ে দেখে ফোনে কোনো লক নেই। তাই সে ফোন জেনারেল করে রাখল একদম তার কানের কাছে। এরপর মুখ টিপে হাসতে হাসতে চলে গেল ওয়াশরুমে। ওয়াশরুমের দরজা বন্ধ হতেই পুনরায় ফোনটা বেজে উঠল নিজস্ব স্বরে। ঘুমের ঘোরে কানের কাছে ফোনের রিংটোন শুনে হুড়মুড়িয়ে উঠে বসল ড্রাইভার। চোখ বড় বড় করে তাকাল ফোনের দিকে। এরপর দিশা না পেয়ে কলটা রিসিভ করে থড়বড় করে বলতে লাগলেন,

-‘কে? আমি নাই! কিছু নাই! আমি কিছু করি নাই।’
-‘গিয়াস স্যার কোথায়?’
বুরাকের কন্ঠস্বর শুনে গিয়াস নামের লোকটি কান থেকে ফোন সরিয়ে নাম্বার দেখল। বুকের ভেতর এখনো ধড়ফড় করছে। মাফিয়ার ড্রাইভার হয়ে পড়েছে মহামুশকিলে। সব সময় জান হাতে নিয়ে ঘুরা লাগে। যদিও
সে জানত না, এই ইয়াসির খান পাখি মারার মতো মানুষ মারে। এর মনে জানে রহম কম। ক্ষুণাক্ষরে যদি টের পেতো তাহলে কখনো এই চাকরির
অফার লুফে নিতো না। অনেক বেশি স্যালারি দেখে আর কিছু ভাবে নি।
কিন্তু কদিন যেতেই নিজ চোখে কতশত মানুষকে মারতে দেখেছে। এখন চাকরি ছাড়ার কথা বললে তাকে মরতে হবে কেননা চাকরির প্রথম দিন ইয়াসির তাকে বলেছিল,

-‘আমার গাড়ির ড্রাইভার হলে চোখে কম দেখবা কানে কম শুনবা। জান বন্দক রেখে কাজে লেগে পড়। জান বন্দক নিলাম যাতে দু’নাম্বারি করার আগে কলিজা কাঁপে।’
বুরাকের ধমকে তার ভাবনার ছেদ ঘটল। সে গলা খাঁকারি দিয়ে কিছু বলার আগে বুরাক বলল,
-‘এ্যাই শু;য়োরের বাচ্চা কথা কানে যাচ্ছে না? কখন থেকে জিজ্ঞাসা করছি স্যারকে কোথায় ড্রপ করেছিস? মুখে বাল ঢুকিয়ে রেখেছিস জবাব দিচ্ছিস না কেন?’
গিয়াস এবার মিনমিন করে বলল,
-‘আমি তো স্যারকে ড্রপ করি নি। স্যার কিংবা আপনিও আমাকে বের হওয়ার কথা বলেন নি তাই,,।’
বুরাক আর কিছু শোনার অপেক্ষা করল না ফোন পকেটে ডুকিয়ে হনহন করে ছেলে-পুলেদের নিয়ে বেরিয়ে গেল। এর পরপরই তিনটে গাড়ি বের হলো বাড়ির মেইন ফটক দিয়ে। আগে জানতে হবে ইয়াসির সত্যি সত্যিই দেশ ছেড়েছে কী না!

কিয়ারা তখন জানালার ধাঁরে বসে মনমরা হয়ে তাকিয়ে দেখছিল ওদের চলে যাওয়া। খুব ইচ্ছে করছিল চিৎকার করে ডেকে বলতে ওকেও সঙ্গে নিতে। কিন্তু ওদের বললেও সঙ্গে নেবে না একথাও জানে সে। বরং মুখ ফুটে বললে আজকে আর খাবার জুটবে না। ওদের যেতে দেখে সে হাত বাড়িয়ে জানালার কাঁচ ছুঁয়ে দেখল। এই রুমের জানালা খোলা যায় না।

জানটা বড্ড আনচান করে। মনে হয় কত বছর বাইরের আলো-বাতাস গায়ে মাখে না। প্রাণ ভরে শ্বাস নেয় নি। কোনোমতে বেঁচে আছে। কারণ দেড়মাস ধরে এখানে বন্দি অবস্থায় পড়ে আছে সে। এবং বলা বাহুল্য, একপ্রকার বাধ্য হয়ে ইচ্ছের বিরুদ্ধেই বুরাক নামের লোকটিকে বিয়েও করতে হয়েছে। না চাইলেও সব স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিয়ে তার নামে কবুল পড়তে হয়েছে। বাবা- মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ নেই। ছোটো বোনটাকে কতদিন দেখে না, ছুঁয়ে আদর করতে পারে না। মজার ব্যাপার হলো তার বাবা-মা তার কোনো খোঁজ করে নি। কারণ বাবা-মা ও পাড়া-প্রতিবেশি জানে সে খ্রিষ্টান ছেলের হাত ধরে পালিয়ে খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহন করেছে।
মূলত একথায় রটানো হয়েছে তাদের পাড়ায়। রাগে দুঃখে বাবা-মা মৃত ঘোষনা করেছে তাকে। জানিয়ে দিয়েছে এমন মেয়ের মুখ দেখতে চান না তারা।

অথচ মূল ঘটনা অন্যকিছু,,,,চাঁদ রাতের দিন অর্থাৎ ইদের আগের দিন রাতে স্বর্ণের কাছে মেহেদী পরার জন্য সে শীতলদের বাসায় যাওয়ার জন্য বের হয়েছিল। কিন্তু মাঝপথে তাকে তুলে আনা হয়।কেন আনা হয় তখনো কিছু জানত না সে, পরে ইদের দুদিন পরে বুরাক নামের লোকটি জোরপূর্বক বিয়ে করে তাকে। বৈধ স্বামীর অধিকার আদায়ের দাবিতে প্রতিরাতে তাকে ছুঁলে শরীর ঘিনঘিন করে তার। কতদিন পা ধরে মাফ চাইলেও ছাড় দেয় না তাকে। এভাবে টানা কয়েকরাত রাত্রিযাপন করার পর এখন আর বাঁধা দেয় না। তবে খুব করে টের পায় তার জীবন থেকে সুখপাখি বিদায় নিয়েছে। ভেতর ভেতর সে নিজেও মারা গেছে। হয়তো আর কখনো শীতলের ফুপাতো ভাই রুবায়েত এলে ঘনঘন যেতে পারবে না। লাজুক হেসে উঁকিঝুঁকি মেরে তাকে দেখা হবে না। কিছু বলতে গেলে কথা তুঁতলে যাবে না। কখনো বলা হবে না, ওই মানুষটাকে ভীষণ ভালো লাগে তার। এত ভালো লাগে দিন-রাত ভুল তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে।

তাকে দেখে আরো অনেক বছর বাঁচতে ইচ্ছে করত। মেরিনার পোশাকে শীতলের ফোনে সেদিন প্রথমবার ছবি দেখেছিল; সেদিনই প্রেমের পথে বিশ্রীভাবে পিছলে পড়েছিল। ফেইক আইডি দিয়ে কতদিন কথা বলারও চেষ্টা করেছে। সারাদিন-রাত তার আইডিতে ঘুরে ঘুরে সুন্দর সুন্দর ছবি,
ফানিগুলোগুলো পোস্ট দেখত। মানুষটা আকাশ ভালোবাসে বোধহয় খালি আকাশের ছবি পোষ্ট করে। এবং তার বিশেষ গুন সে ভীষণ ফানি, হাসাতে জানে! মানুষ হাসানোর গুন সবার মধ্যে থাকে না যার থাকে সে নিজে কেঁদে অন্যকে হাসানোর ক্ষমতা রাখে। তার এ গুনটি তাকে আরো বেশি প্রভাবিত করেছিল। তবে শীতলের সঙ্গে ওর ফ্রেন্ডশীপ নষ্ট হওয়ার ভয়ে মনের কথা সাহস করে জানানো হয় নি। ইচ্ছে ছিল এবারের ইদেই
যেভাবে হোক মনের কথা জানাবে। তাছাড়া মানুষটা ছুটি কাটিয়ে গেলে সহজে আসতে চায় না। চাতক পাখির মতো দিন গুনতে হয়। খুব করে ছটফট করতে করতে দিন কাটাতে হয়। এসব ঠিকই ছিল কিন্তু এরমধ্যে কি থেকে কী হয়ে গেল তারপর থেকে এ বন্দি জীবন।

কোন পাপে এমন শাস্তি পাচ্ছে এখনো জানে না সে। তবে বুরাক নামের লোকটি প্রথমদিন যখন তাকে ছুঁয়েছে সেদিনই সে মারা গেছে। শ্বাস নিলেই কী বেঁচে থাকা হয়? হয় না, জীবন্ত লাশরা নিঃশ্বাস নেয় তবে ভেতর ভেতরে মৃত লাশের মতো শেষ হয়ে যায়। সেই নিয়মে সেও মারা গেছে। মারা গেছে তার মন।
মারা গেছে খুব যতনে মনকুঠুরিতে পালন করা প্রেমপায়রা। মারা গেছে
তার স্বপ্ন-শখ- ভালোবাসা। আর আশা নেই মানুষটাকে পাওয়ার, আর আশা নেই তার সামনে দাঁড়ানোর মতো মুখ। কিভাবেই বা থাকবে? সে এখন অন্যের বউ ; সতিত্বহারা এক মেয়ে। তার মতো মেয়ের কি সাজে ওইরকম সুন্দর মানুষটার সামনে দাঁড়ানো!

শীতল সদ্য শাওয়ার নিয়ে ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়াতেই শুদ্ধও ফ্রেশ হয়ে বের হলো। মাথা মুছতে মুছতে তাকাল এলোমেলোভাবে শাড়ি পরা
শীতলের দিকে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে কোনোমতে গায়ে জড়িয়েছে শুধু।
তবে শাড়িটা কুচি করে নয় আটপৌরে স্টাইলে পরা। ফর্সা শরীরে চেরি কালার শাড়িটা যেন ফুটে উঠেছে। দেখা যাচ্ছে কোমরের কিছু অংশ।
শীতল নিশ্চুপ হয়ে ধীরে ধীরে মুছছে ভেজা চুল। গলা, কাঁধ, গাল, ঠোঁটে ভালোবাসার চিহ্ন। গতরাত থেকে একরাশ লজ্জায় কুঁকড়ে আছে সে। না কথা বলছে আর না পেরেছে শুদ্ধর দিকে চোখ তুলে একটু তাকাতে।
আর শুদ্ধ? এই মানুষটাকে ভাবত রসকষহীন মানব রোমান্টিকতার ‘র’ বোঝে না। তবে এটা তার সম্পূর্ণ ভুল ধারণা গতরাতে টের পেয়েছে তা।
বলতে নয় বরং মান্য বাধ্য বিশুদ্ধ পুরুষ চরম লেভেলের অসভ্য। এদিকে শুদ্ধ আনমনা শীতলের মনোভাব বুঝে ঠোঁট কামড়ে শুধু হাসল। হাতের তোয়ালে মেলে দিয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে থমথমে সুরে বলল,

-‘ বললি না তো?’
শীতল না তাকিয়ে ছোট্ট জিজ্ঞাসা করল,
-‘কি?’
-‘আমার বউ থাকবে তো এবার? না মানে এন্টিনা সচল কী না..!’
শীতল চোখ মুখ কুঁচকে লজ্জায় নতজানু হয়ে অন্যদিকে তাকাল। কান দিয়ে যেন গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে। গাল দুটো লাজে রাঙা হয়ে উঠেছে।
এসব নিয়ে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বার বার লজ্জায় ফেলছে তাকে। মানে হয় এসবের? সে খুব করে টের পাচ্ছে এখনো মিটিমিটি হাসছে তার অবস্থা দেখে। এদিকে সত্যি সত্যিই শুদ্ধ মিটিমিটি হাসতে হাসতে শার্ট পরল।
তারপর চাবি নিয়ে ড্রয়ার খুলল। খুটখাট শব্দে কিছু কাজ করে দাঁড়াল একদম শীতলের পেছনে শরীর ঘেঁষে। শীতল তখনো সেভাবে দাঁড়িয়ে।

শুদ্ধকে দেখে শীতল একদম স্থির। সরতে গেলে শুদ্ধ শীতলের ভেজা চুল পিঠ থেকে সরিয়ে খোঁচা খোঁচা দাড়ি ওয়ালা থুতনি রাখল শীতলের মৃসণ কাঁধে। মুগ্ধ চাহনিতে তাকাল আয়নার দিকে শীতলের চোখে চোখ রেখে। শীতলের লজ্জা মাখা মুখের দিকে কিছুক্ষণ অপলক তাকিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। তারপর শীতলের গলায় মোটা চওড়া লেটেস্ট মডেলের স্বর্ণের নেকলেস পরিয়ে দিতে দিতে বলল,
-‘চাঁদের গায়ের দাগ মোছার ক্ষমতা আমার নেই। তবে আমার ব্যক্তিগত চাঁদের গায়ের দাগ আমি স্বর্ণ দিয়ে ঢেকে দিলাম।’
একথা বলে শীতলকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল। ধীরে ধীরে পেটের উপর থেকে শাড়ি সরিয়ে স্বর্ণের কোমর বন্ধনী পরাতে পরাতে ফিসফিস করে বলল,

-‘ সামান্য একটু দূর্বলতা।’
শীতল ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল শুদ্ধর দিকে। একটা নেকলেসেই গলা ঢেকে গেছে। ঢেকে গেছে শুদ্ধর দেওয়া আদরের চিহ্ন। এতটাও আশা করে নি সে। এত সুন্দর একটা মুহূর্তে কেন জানি ভীষণ কান্না পেল ওর। ছলছল চোখে তাকালে গড়গড় করে কয়েকফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে গেল। তা দেখে
শুদ্ধ হেসে অশ্রু মুছে গয়নার বক্সের দিকে ইশারায় স্বর্ণের কানের দুল, কপালের টিকলি, হাতের চুর, রিং সব দেখাল। শীতল একবার তাকিয়ে পুনরায় তাকাল শুদ্ধর দিকে। শুদ্ধ হাত বাড়িয়ে কপালের টিকলি হাতে নিয়ে শীতলের ভেজা চুুলের মাঝসিঁথিতে পরিয়ে দিয়ে বলল,
-‘ শুনেছি বিশেষ রাতে নাকি ঘরের শত্রুকে বিশেষ কিছু উপহার দিতে হয়। আমি তো উপহার দেওয়ার আগেই শত্রুর গায়ে দাগ লেপ্টে দিয়েছি তাই সকাল বেলা আপনার জন্য এই সামান্য উপহার চৌধুরী কন্যা।’

-‘এটা সামান্য?’
-‘তা নয় কি?’
শীতল মুচকি হাসল। তারপর বলল,
-‘আমারও আপনাকে কিছু দেওয়া উচিত। তবে কি দেবো বুঝতে পারছি না?’
-‘সত্যি দিবি?’
-‘হুম।’
-‘ দিলে টাকায় কেনা জিনিস দিস না বরং মহামূল্যবান কিছু দে।’
-‘কি সেটা? কি চান আপনি? কোথায় পাব সেটা? কিভাবে দেবো বলুন?’
-‘শুধু কথা দে, আমি বেঁচে থাকাকালীন অন্য কারো স্পর্শ তোর শরীরে লাগতে দিবি না। প্রয়োজনে খুন করে হলেও নিজেকে বাঁচাবি, বাকিটা আমি সামলে নেবো।’
-‘কথা দিলাম তাই হবে।’

একথা শুনে শুদ্ধ একবার দেওয়াল ঘড়িতে সময় দেখে শীতলের দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘ নিচে যাবি? এক্ষুণি ডাকতে আসবে কেউ না কেউ।’
-‘না যাই প্লিজ!’
-‘হুম, আমি খাবার নিয়ে আসছি তুই এই রুমেই থাক।’
একথা বলে শুদ্ধ দরজার দিকে এগিয়ে কি যেন ভেবে দাঁড়িয়ে গেল। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে বলল,
-‘একটা কথা বলতে ভুলে গেছি।’
জরুরি কথা ভেবে শীতল শুনতে মনোযোগী হলো। কৌতুহলীস্বরে
জিজ্ঞাসা করল,
-‘কি কথা?’
শুদ্ধ এবার ঠোঁটে ফিচেল হাসি এঁটে বলল,
-‘গতরাতে ল্যাবের লাইট অন ছিল।’
শীতল এবার আরেকদফা লজ্জা পেলেও গুটিয়ে গেল না। বরং হাতের কাছে থাকা কুশন ছুঁড়ে মারতেই শুদ্ধ সেটা ক্যাচ ধরে বেডে ছুঁড়ে মারল।
তারপর এখানেই থাকার কথা বলে হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল। তাকে যেতে দেখে শীতল মিটিমিটি হেসে আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে বলল,

-‘ দেখলে তো এবার, আমার বিশুদ্ধ পুরুষ ভালোবাসতেও জানে।’
ঘড়িতে তখন সকাল আটটা। এ সময় চৌধুরী বাড়ির সকল সদস্য একে
নাস্তার টেবিলে হাজির হয়। রোজকার মতো আজও হাজির হয়েছে। যে যার মতো চেয়ার দখল করে বসেছে। সিঁতারা, সিমিন, সিরাত ব্যস্ত হাতে
সবাইকে নাস্তা পানি বেড়ে দিচ্ছে। খেতে খেতে সবাই টুকটাক কথাবার্তা বলছে। শীতলকে না দেখে শারাফাত চৌধুরী বললেন,
-‘সবাইকে দেখছি শীতল মা কোথায়? খাবে না?’
শীতল নেই সিঁতারা সবার আগে খেয়াল করলেও ইচ্ছে করে কিছু বলে নি। তবে কথা যখন উঠলই তখন কিছু একটা বলতে হবে। তাই বললেন,
-‘ খেয়ে আবার ঘুমিয়েছে।’
-‘ঘুমিয়েছে? শরীর খারাপ করছে নাকি?’
এবার স্বর্ণ আড়চোখে শুদ্ধর দিকে একবার তাকিয়ে বলল,
-‘সারারাত আমার রুমেই ছিল সারারাত মুভি দেখে এখন ঘুমাচ্ছে। ‘
-‘উঠলে মনে করে খাইয়ে দিস মা।’
-‘হুম।’

এ কথার ইতি ঘটলেও সায়নের মনে খটকা লাগল। সে ভ্রুঁ জোড়া কুঁচকে অনেকক্ষণ ধরেই শুদ্ধর দিকে তাকিয়ে আছে। কেন জানি শুদ্ধকে আজ অন্যরকম লাগছে। শাওয়ার নিয়েছে। ফেসটা একটু বেশিই গ্লো করছে।
এদিকে শীতলটাও ব্রেকফাস্ট করতে নামে নি সে নাকি আরো ঘুমাবে।
সায়ন পরোটা চিবাতে চিবাতে বোঝার চেষ্টা করছে মূল ঘটনা। কাহিনী
গড়বড় লাগছে। সায়ন তাকিয়ে আছে বুঝে শুদ্ধও একপলক তাকিয়ে নিজের খাওয়ায় আগ্রহী হলো। তবে বড় রা থাকায় কেউ কিছু বলল না।
এরপর নাস্তা সেরে শুদ্ধ আরেকটা প্লেটে নাস্তা সাজিয়ে উপরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই সায়ন শুদ্ধর পথ আঁটকে দাঁড়াল। তীক্ষ্ণ নজরে শুদ্ধর আপাদমস্তক দেখতে গিয়ে দৃষ্টি বিঁধল কানের নিচে। কেমন কালচে হয়ে আছে দেখে আঁতকে উঠল। ঝড়ের গতিতে শুদ্ধর খুব কাছে গিয়ে ভালো করে আরেকবার দেখে আর্তনাদ করে উঠল,

-‘একি, তুই ভাজা মাছটি উল্টে খেয়ে ফেলেছিস?’
সিরাত তখন এঁটো প্লেটগুলো রান্নাঘরের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলেন। তার কথা শুনে উনি দাঁড়িয়ে সরল মনে বললেন,
-‘মাছই তো রান্না করি নি খাবে কি করে? তুই খাবি মাছ? কোন মাছ খাবি বাপ?’
উনার কথা সায়ন এবার কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল,
-‘ ভাই আমাকে আবার পিছিয়ে দিয়েছে মেজো মা।’
-‘ পিছিয়ে দিয়েছে? কিভাবে? শুদ্ধ তো নিচে নেমে কারো সাথে কথাও বলে নি। চুপচাপ ভদ্রহয়ে নাস্তা সেরে রুমে যাচ্ছে। ‘

-‘মাছ খাওয়ার পর সব বিড়ালই ভদ্র হয়ে যায় মেজো মা। ও তুমি বুঝবে না এসব বড়দের ব্যাপার-স্যাপার।’
-‘ বিড়ালের পেট ভরা থাকে তাই বোধহয়। সমস্যা নেই, তুই বল কি মাছ খাবি? ফ্রিজে থাকলে তো হলোই নাহলে তোর চাচ্চুকে বাজারে পাঠাব।’
সায়ন অসহায় চাহনিতে তাকিয়ে রইল সিরাতে দিকে। এখন সে কি করে বোঝাবে এই মাছ সেই মাছ না। উনাদের কথার মাঝে শুদ্ধ আর দাঁড়াল না। তবে তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতেই ঘাড় ঘুরিয়ে একবার তাকাল সায়নের দিকে। ঠোঁট মিটিমিটি হাসি। চোখ জোড়া যেন চিৎকার করছে বলছে, ‘হেরো, হেরো।’ ছোটো ভাইয়ের থেকে পাওয়া খোঁচা সহ্য হলো না সায়নের। সে শারাফাত চৌধুরী উদ্দেশ্যে প্রায় চেঁচিয়েই বলে উঠল,

-‘বাবা আমার কি বিয়ে হবে না!’
শারাফাত চৌধুরী নাস্তা সেরে অফিসে যাওয়ার জন্য কেবল রুম থেকে
বের হচ্ছিলেন। সায়নের বলা কথা উনি ঠিকঠাক ভাবে শুনতে পান নি, যেটা শুনছেন ভুল হতে পারে ভেবে পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন,
-‘কিছু বললে?’
-‘বি..বি..বিল, ওই পানির বিল দেওয়া কি হয়ে গেছে?’
-‘ গতপরশু তোমার চাচ্চু দিয়ে এসেছে।’
-‘ওহ।’
একথা বলে সায়ন যাওয়ার জন্য পা বাড়াবে তখন শারাফাত চৌধুরী দরজার দিকে যেতে যেতে বললেন
-‘ এত বয়স এখনো হয় নি যে কানে কম শুনব। শুদ্ধ ফিরে এলেই বিয়ের আয়োজন শুরু হবে এত উতলা হওয়ার কিছু নেই।’

একথা বলে উনি চলে গেলে সায়ন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাথা চুলকাল। সে ঠিক বুঝে উঠতে পারল না হাসবে নাকি কাঁদবে? নাকি লজ্জা টজ্জা কিছু পাবে? এসব ভাবতে ভাবতেই নজর গেল স্বর্ণের দিকে। তার দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসছিল শাঁকচুন্নিটা। তাকে হাসতে দেখে রাগ হলো সায়নের। সে রাগী দৃষ্টিতে স্বর্ণের দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘খুব মজা লাগছে না? খুব হাসা হচ্ছে? আমার সময়ও ঘনিয়ে আসছে।
আধমরা যদি না করেছি তো তুই সায়নের ডালিং না পুরা বউ হবি বউ।’

টানা একমাস ধৈর্য্য ধরে থাকতে পারলেও আজকে রুবাব খুব অসহায় বোধ করছে। পাগল পাগল লাগছে নিজেকে। বুকের ভেতর এত জ্বলছে যে জ্বালাপোড়ার তীব্রতা অসহনীয় পর্যায়ে চলে যাচ্ছে,সে আর না পেরে
মায়ের কোলে মুখ লুকিয়ে কেঁদে ফেলল। শতরুপা চৌধুরীও পাথর হয়ে চুপ করে বসে আছেন। মেয়েটাকে এত করে বোঝানোর পরও মেয়েটা একই ভুল করল। আচ্ছা, সুইসাইড কি সব সমস্যার সমাধান হতে পারে?যে ছেলেটা তার জন্য চাকরির পরোয়া না করে দিনের পর এখানে পড়ে আছে।

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৬২

এত ভালোবাসছে। আগলে রাখছে। প্রতি মুহূর্তে মনোবল শক্তি বাড়াতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। যে চেহারা দেখে মানুষ ভয়ে দুই পা পিছিয়ে যাবে সেই চেহারাতে সে অনবরত চুমু খেতে দ্বিধা করে না। সেই ছেলের কি এই প্রাপ্প? এই তার ভালোবাসার মূল্য?

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৬৪

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here