শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৬৫

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৬৫
নূরজাহান আক্তার আলো

সময় চলমান স্রোত! চোখের পলকে কখন যে দিন পেরিয়ে যায় বোঝায় যায় না। নিত্যদিনের দৈনন্দিন কাজের চাপে দেখতে দেখতে কেটে গেছে আরো একটি সপ্তাহ। শুদ্ধ চলে গেছে সিঙ্গাপুর। ঐশ্বর্যের অপারেশনটাও সে যাওয়ার পরপরই করা হয়েছে। তবে দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে গলার নিচ থেকে বুক অবধি ঝলসানো দাগটা পুরোপুরি ঠিক হয় নি, হবেও না।

সে যতদিন বাঁচবে ততদিন এই দাগ তাকে বয়ে বেড়াতে হবে। মেনে নিতে
হবে তার নিয়তি, তার পরিস্থিতি। তবে মুখে এসিড/ কেমিক্যাল জাতীয় কিছু পড়ে টুকরো টুকরো ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছিল সেটাও প্রায় ঠিক হয়েই এসেছে। ডাক্তাররা যথেষ্ট চেষ্টা করেছেন সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
শুদ্ধ আর রুবাব টাকার মায়া কখনো কেউ করে নি। যা বেস্ট তারা সেটা করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। এসব নানান ঝামেলার মধ্যে সিঙ্গাপুর কেটেছে
আরো তিন সপ্তাহ মানে শুদ্ধ যাওয়ার একমাস পেরিয়ে গেছে। সে মাত্র দুই সপ্তাহের কথা বলে আসলেও সব ঠিকঠাক করতে কেটেছে একমাস।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তাছাড়া চিকিৎসা জিনিসটা তো আর দিনগুনে কিংবা মর্জিমতো হয় না।
তবে শুদ্ধ আসায় রুবাব যেন শক্তি পেয়েছে। সাহস পেয়েছে। একা একা
খুব বেশি কষ্ট হয়েছে তার। দুটো মেয়েকে নিয়ে ঠিকঠাক ঘুমাতে অবধি পারে নি। এরিমধ্যেই ঐশ্বর্যের পাগলামিতে আরো ঘুম-খাওয়া সব যেন উঠে গিয়েছিল। শুদ্ধ যখন প্রথমবার ঐশ্বর্যকে দেখতে হসপিটালে আসে
তখন থমকে গিয়েছিল। ফুপি, রুবাব, ঐশ্বর্যের অবস্থা দেখে ভীষণ কষ্ট পেয়েছিল। রোগীর দেখভাল করা এত সোজা না। রোগী টানতে রোগীও হতে হয় সেটা রুবাবকে দেখে বোঝা যাচ্ছিল। সেসব কাউকে বুঝতে না দিয়ে স্নেহের সুরে ঐশ্বর্যকে বলেছিল,

-‘আমার জন্য তোমার যে ক্ষতি হয়েছে সেই ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। তবে তোমার ভালোর জন্য যতটুকু করা যায় আমি করব।
সারাজীবন করব। আর অনুরোধ বলো কিংবা রিকুয়েষ্ট রুবাবকে আর পুড়িও না। তোমার সাথে সাথে সেও যথেষ্ট পুড়েছে। হ্যাঁ কোনো পুরুষই সাধু নয় আবার সব পুরুষের ভালোবাসা সমানও নয়।’
অল্প কয়েকটা কথায় ঐশ্বর্যের মনোবল শক্তি আরেকটু বেড়েছিল।গিল্টি ফিলও হচ্ছিল। সে শতরুপা ও রুবাবের কাছে মাফও চেয়েছে। তার এই গুনটা বেশ। ভুল করলে মাফ চাইতে দ্বিধা করে না। অকপটে স্পষ্টসুরে সেটা স্বীকার করে। এরপর আর কিছুদিন হসপিটালে থেকে তারা এবার অর্কদের বাসায় উঠল। এতদিন পর বাসার পরিবেশে ঐশ্বর্যের মানসিক চাপ অনেকটাই কমে আসছিল। স্বাভাবিক হচ্ছিল। তবে আয়না দেখলে
ভেতর থেকে কান্না ঠেলে আসত। কিন্তু রুবাবের কাছে দেওয়া ওয়াদার কারণে কান্না সামলে নিতো। কষ্ট করে হলেও হাসত। অর্কদের বাসাতে সদস্য বলতে তারা চারজনই ছিল। বাকিরা আসে কাজ করে চলে যায়।
ওর রেগুলার চেকাপ, মেডিসিন,সেবাযত্নের প্রতি নজর রাখছিল সবাই।

যে যেভাবে পারছিল তাকে ভালো রাখার চেষ্টা করছিল। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল, গোটা চৌধুরী পরিবার। রোজ সন্ধ্যায় সবার সঙ্গে ভিডিও কলে কথা হয়। তবে ঐশ্বর্য লেপটপের সামনে যায় না ফোন কিংবা লেপটপের রশ্নির কাছে তার যাওয়া বারণ। আড়ালে বসেও সবার সঙ্গে সখ্যতা গড়ে উঠেছে। যে সময় টুকু কথা হয় একেক জনের কথা আর কাজ দেখে না হেসে পারা যায় না। বিশেষ করে সব ভাই-বোনদের খুনশুটি দেখে মনটা ভরে যায়। এই যেমন আজই কথা বলতে বলতে সৃজন দুষ্ট হেসে শুদ্ধকে বলল,
-‘ জানো ভাইয়া আজ কি হয়েছে?’

শুদ্ধ কফির মগে সিপ নিয়ে তাকাল লেপটপের দিকে। সবাইকে দেখা গেলেও শীতলকে দেখা যাচ্ছে না। তবে সে আশেপাশেই আছে সেটা খুব ভালো করে জানে। রাগ দেখাতে ইচ্ছে করে মেসেজ সিন করছে না, কল ধরছে না, ভিডিও কল দিলে সামনেও আসছে না। তাকে তাকাতে দেখে
সৃজন একবার ডানে তাকিয়ে ফিক করে হেসে বলল,
-‘ স্কুল থেকে ফিরে দেখি শীতল আপু ড্রয়িরুমে বসে বসে ফুসফুস করে কাঁদছে। এত কাঁদছে কাঁদতে কাঁদতে নাক দিয়ে পানি বের হচ্ছে সেটা সুড়ৎ করে ভেতরে টেনে নিচ্ছে আবার বের হচ্ছে আবার টেনে নিচ্ছে।’
-‘তা কাঁদছিল কেন?’

-‘ কতবার করে জিজ্ঞাসা করলাম বললোই না তো। বলল না যখন আমি আর না জ্বালিয়ে খেতে বসলাম। খেয়ে না উঠতেই একটু পরে এসে বলে সৃজন রে শুদ্ধ ভাইকে কল দিয়ে জিজ্ঞাসা কর তো কবে ফিরবে। আমি যে শিখিয়ে দিয়েছি বলবি না খবরদার।’
সৃজনের এইটুকু বলতে দেরি পাশ থেকে তার পিঠে কিল বসাতে দেরি হলো না শীতলের। সে কোনোমতে নিজের দোষ সৃজনের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে রাগ দেখিয়ে বলল,
-‘মোটেও কাঁদছিলাম না আমি। আসলে তখন আমার চোখে কি যেন পড়েছিল। তাছাড়া যার তার জন্য কাঁদার সময় নেই আমার, হুহ্।’

তার কথা শুনে সকলে একে অপরকে দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসল। কারণ শুদ্ধর যাওয়ার পরপর শীতলের অস্থিরতা সবার নজরে পড়েছে।
এর আগেও শুদ্ধ বহুবার বাইরের দেশে গেছে দিনের পর দিন এ বাড়ির বাইরে থেকেছে। কিন্তু তার থাকা না থাকা নিয়ে শীতলের মাঝে কোনো
ভ্রুক্ষেপ ছিল না। তবে এবার বাড়ির অনেকের চোখে অনেককিছু চোখে পড়ছে। হতে পারে বিয়ের কারণে। সম্পর্কের বৈধতার কারণে। নিজের অনুভূতি বোঝার কারণে। ভালোবাসা উপলব্ধি করার কারণে। তবে যার জন্য এত অস্থিরতা দূরে থেকে ভীষণ মজা পাচ্ছে। সে মূলত চাচ্ছিলই তার উপস্থিতিতে শীতল যেন তাকে ভাবে। তাকে নিয়ে অস্থির থাকে, চিন্তা করে। বিশেষ করে এজন্যই সম্পর্কের গভীরতা একটু দ্রুত টেনেছে সে। সে জানত এমন কিছু হবে। এতদিন নিজের অনুভূতি গোপন রেখে একা একা অনেক তড়পেছে এখন সময় এসেছে সেসব উসুল করার।
শুদ্ধ ঠোঁটের কাছে হাত রেখে আপাতত হাসি আড়াল করল। ততক্ষণে কথাটা বলে শীতল চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছে। তখন সিরাত ফট করে বলে বসল,

-‘তাই বলে কোথায় যাচ্ছিস তুই? এখানে আয় বস। আরে আমরাও বুঝি স্বামী দেশের বাইরে গেলে চোখে ঘনঘন কি যেন পড়ে। আমাদেরও কত পড়েছে।’
বাকিরা এতক্ষণ হাসি আঁটকে রাখলেও এবার কেউই হাসি আঁটকাতে পারল না। বড়-ছোট সবাই শব্দ করে হেসে ফেলল। শুদ্ধও ঠোঁটের কাছে হাত রেখে মুচকি হাসল। আর সবাইকে হাসতে দেখে শীতল রাগে দুঃখে
হনহন করে রুমের দিকে চলে গেল। সবাই ডাকল শুনলোই না। এভাবে লজ্জা দেওয়ার মানে হয়? একটু কেঁদেছে নাহয় তাই বলে সবাই এভাবে লজ্জা দেবে? তার কষ্ট কেউ বুঝে নাকি? শুদ্ধ যাওয়ার পর ঘুমাতে পারে না, বুকের উপর ঘুম পাড়িয়ে বদ অভ্যাস করে গেছে বিশুদ্ধ পুরুষ। আর নরম বালিশে ঘুম আসে না, আসবে কিভাবে? বালিশের গায়ে তো তার প্রিয় গন্ধটা নেই। খেতে পারে না, খেতে বসলে পাশের চেয়ারটার দিকে নজর যায়। তার রুমে এখন কম থাকে শুদ্ধর রুমেই বেশি থাকবে। তবে শুদ্ধর রুমটাও ভালো লাগে না কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে তাহলে কাঁদবে নাতো কি করবে? এভাবে থাকা যায় নাকি?

সে চলে যেতেই রুবার দৃষ্টি সরিয়ে ঐশ্বর্যের দিকে তাকাল। তার দৃষ্টি যেন বলেছে, দেখো বলেছিলাম না ভালোবাসতে জানলে ভালোবাসা সুন্দর। আর ভালোবাসা সুন্দর বলে এরা দুজনই ভেতর ভেতর অস্থির, অশান্ত।
এবং দু’জন দুজনকে মিস করছে বলে কেউ দেশে বসে তড়পাচ্ছে আর কেউ দেশের বাইরে বসে আকাশপানে তাকিয়ে দিন গুনছে। ঐশ্বর্য দৃষ্টি ফিরিয়ে একবার শুদ্ধর দিকে তাকাল। তারপর রুবাবের দিকে। আসলে ভালোবাসতেই জানতে ভালোবাসা সুন্দর। এরপর আর কিছুক্ষণ কথা বলে শুদ্ধ তার লেপটপ নিয়ে রুমে চলে গেল। ঐশ্বর্যের এদের সকলের বন্ডিং দেখে আজকাল লোভ হয় ;এমন একটি সুখী পরিবারের লোভ। সে মনে মনে কিছু ভেবে শতরুপা চৌধুরী কোলে মাথা রাখল। শতরুপা
তার চুলে বিলি কাটতে কাটতে চৌধুরী নিবাসের সদস্যদের নিয়ে পুরনো গল্প তুলল। ঐশ্বর্য মন দিয়ে শুনতে লাগল সেসব গল্প।

এভাবে কেটে গেল আরো কয়েকটাদিন। একদিন রাতের খাবারের পরে শুদ্ধ জানাল, সে কিছুদিনের জন্য সুইডেন যাবে। সেখানে কিছু কাজ সেরে একেবারে সবাই মিলে দেশে ফিরবে। এই নিয়ে ডাক্তারের সঙ্গেও কথা হয়েছে তার। শুদ্ধ কাজের মানুষ কাজ থাকতে পারে ভেবে কেউ বাঁধা দিলো না। তবে ঐশ্বর্য মলিন হাসল কথাটা শুনে। কারণ শুদ্ধ যে ইগরের ব্যবস্থা করতে যাচ্ছে বুঝতে বাকি নেই। কিছু বলারও নেই আর এসব নিয়ে। কি বলবে? শুদ্ধকে বারণ করা কিংবা কিছু বলার মুখ নেই তার। কারণ ইগর শুদ্ধর অনেক বড় ক্ষতি করেছে। যে ক্ষতি পূরণ সে কখনো দিতে পারব না। কেউ না জানুক সে তো জানে শুদ্ধর কত কষ্টের ফর্মূলা হাত ছাড়া হয়ে গেছে। শুধু শীতলের সুস্থতার কথা ভেবে এতদিন চুপ ছিল। তার অবস্থা দেখে কিছু বলতে পারছিল না। কিন্তু এখন আর তাকে থামানো যাবে না। ফর্মূলা ফেরত পাওয়া না পাওয়ার আশা রাখে না তবে ইগরকে একটা শিক্ষা না দিলেই নয়। তাছাড়া শুদ্ধর সঙ্গে কাজ
করে খুব ভালো করে বুঝেছে শোয়াইব শুদ্ধর অসংখ্য গুনের মধ্যে একটি বিশেষ গুন সে উপকারী অপকারী কাউকেই ভোলে না।

এখন দুপুর একটা। ঘন কালো মেঘে ঢেকে আছে আকাশ। ঝমঝমিয়ে
বৃষ্টি নামতে পারে যখন-তখন। বাসা থেকে বের হওয়ার পর আবহাওয়া দেখে শখের মনে পড়ল সঙ্গে ছাতা নেই। মেজো মাকে দিয়েছিল তারপর ব্যাগে ঢুকাতে ভুলে গেল। কথা হচ্ছে,বৃষ্টি নামার আগের ভালোই ভালোই
বাড়ি পৌঁছাতে পারলেই বাঁচে। মনে মনে এসব ভেবে সে দুটো ক্লাস করে
মেডিকেল কলেজ গেটের কাছে আসতেই হঠাৎ দেখা হলো আহনাফের বোনের সাথে, সঙ্গে আহনাফের বাবা-মা ছিল। তাকে দেখে উনারাও থম মেরে দাঁড়িয়ে গেলেন। মলিন মুখ আরো মলিন হলো। চোখাচোখি হলে শখ বিনয়ী স্বরে সালাম দিলে উনারা সালামের জবাব দিলেন। টুকটাক কথা বলতে বলতে কেঁদেই ফেললেন। আহনাফ বেঁচে থাকলে এতদিনে শখ উনাদের বাড়ির একমাত্র পুত্রবধূ হতো। কিন্তু সেসব কিছুই হলো না।
ছেলেটাকে কারা যেন তুলে নিয়ে গিয়ে মারতে মারতে মেরেই ফেলেছে।

এত পরিমান মেরেছে যে তাকে চেনা মুশকিল হয়ে যাচ্ছিল। কে বা কারা যে উনাদের এতবড় সর্বনাশ করেছে আল্লাহ জানে। তবে আহনাফের কেস চলমান। পুলিশ নাকি এখনো খুঁজে বেড়াচ্ছে অপরাধীকে কিন্তু ক্লু পাচ্ছে না। তবে উনারা আশাবাদী ছেলের খুনীদের একদিন খুঁজে বের করবেন।
এমন টুকটাক কথা হতে হতে মেঘ ডেকে উঠল। আকাশের অবস্থা দেখে উনারা চলে গেলেন হসপিটালের ভেতরে আর শখ এসে দাঁড়াল রাস্তার এপাশে। পাঁচ মিনিট দাঁড়ালে একটা রিকশা পেলে উঠে বসল। কাঁধের ব্যাগটা কোলের উপর নিয়ে চুপ করে বসে রইল। রিকশা চলতে লাগল
নিজ গতিতে। আপনাআপনি আহনাফের মুখটা মনে পড়ল। খুব খারাপ
লাগে মানুষটার জন্য। কিন্তু কিছু করার নেই মাকাল ফলের মতো কিছু মানুষ আছে যারা দেখতেই সুন্দর, কোনো কাজের না। মনুষ্যবোধটুকু যার মধ্যে নেই তাকে অবশ্য মানুষ বলাও চলে না। আজ খুন হয়েছে বলে কষ্ট লাগছে। কিন্তু মানুষ ওদের সঙ্গে যা করেছে সেটা ক্ষমা করার মতো না।

এসব ভাবতে ভাবতে দুঃভাগ্যবশত সেই রিকশা কিছদূর গিয়েই নষ্ট হয়ে গেল। রিকশা ওয়ালা মুখ কাঁচুমাচু করে জানালেন রিকশা ঠিক করাতে
নিয়ে যেতে হবে। কি আর করার শখ আশেপাশে তাকিয়ে রিকশা থেকে নামল। এইটুকু আসার পথের ভাড়া মিটিয়ে হাঁটা ধরল ফুটপাতের রাস্তা ধরে। হাঁটতে অবশ্য মন্দ লাগছে না। সমস্যা হচ্ছে ছাতা নেই বৃষ্টি নামলে আরেক বিপদ। একথা ভাবতে ভাবতে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। বড় বড় বৃষ্টিরফোঁটা আছড়ে পড়ল পিচঢালা রাস্তায়। ভিজিয়ে দিলো তাকেও।

আশেপাশেও দোকান নেই যে দৌড়ে গিয়ে গা বাঁচাবে। ততক্ষণে ভিজেও একশা অগত্যা হাঁটতে হাঁটতে ভিজতে থাকল। তখনই একটা গাড়ি এসে
ব্রেক কষল তার পাশে। চমকে উঠে সরে দাঁড়াতেই গাড়ির মালিক দ্রুত জানালা খুলে তাকাল। কৌতুহলী কন্ঠে জিজ্ঞাসা করল,
-‘আরে শখ না? ভিজছো কেন জ্বর আসবে তো?’
শখ এখন এখানে অর্ককে দেখে শখ সালাম দিলো। ভাইয়ের বন্ধুদের সে যথেষ্ট সমীহ করে চলে। যতটুকু কথা না বললে নয় ততটুকুই বলে নতুবা এড়িয়ে চলে। শখ জবাব দেওয়ার আগে গাড়ির এ পাশের জানালাটাও তুলে অর্কের মা বললেন,

-‘মামনি ভিজছো কেন?’
-‘রিকশা পাচ্ছিলাম না তাই..!’
-‘এসো এসো গাড়িতে উঠে বসো। এই বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বরে পড়বে।’
-‘না আন্টি সমস্যা নাই আর একটু এগোলেই রিকশা পেয়ে যাব। তাছাড়া আমার ড্রেস ভিজে গেছে গাড়িতে আর না উঠি।’
-‘আরে কিছু হবে না উঠো তো তুমি।’
উনার একপ্রকার জোরাজোরিতে শখ পিছনের সিটে বসল। কথা বলতে বলতে চৌধুরী নিবাসের গেট দিয়ে ডুকল গাড়ি। শখ নামলে উনারা চলে গেলেন। শখ এত করে ভেতরে যেতে বলল শুনলেনই না। আসলে উনারা
জরুরি কাজে বেরিয়েছিলেন বসলে আরো দেরি হবে আরেকদিন এসে ঘুরে যাবে বলে বিদায় নিলেন।

-‘ভাই আপনের বিয়াতে আমারে নতুন পাঞ্জাবি কিইন্না দিবেন।’
-‘বর তুই না আমি?’
-‘আপনে।’
-‘তাহলে তুই কোন দুঃখে নতুন পাঞ্জাবি পরবি?’
-‘আমার ভাইয়ের বিয়া আমি না পরলে কেডা পরবো কন?’
-‘শালা তুমি আমার বউ হারাইয়া দিসিলা মনে নাই? তোমারে দিবো নতুন পাঞ্জাবি? ওয়েলকাম ড্রিংকস খাবা না? চট্টগ্রামের কথা মনে নাই, হুম?
পাঞ্জাবি না তোমারে তো ওয়েলকাম ড্রিংকস গেলাব পাখি, কাছে এসো দেখি।’
আজম মুখ কাঁচুমাচু করে দুপা পেছনে সরে দাঁড়াল। এই নিয়ে কতবার যে একই খোঁচা শুনল হিসাব নাই। পার্টি অফিসের রুমে বসে আজম আর সায়ন কথা বলছিল। তখন একটা ছেলে এসে বলল,
-‘ভাই আপনের বুইন আইছে।’
সায়ন ভ্রুঁজোড়া কুঁচকে আজমকে বলল,
-‘বুইড়া বয়সে বোন কোথায় কুড়িয়ে পেলি?’
সায়নের কথা শুনে ছেলেটি ভুল শুধরে দিয়ে বলল,

-‘আজম্যের না আপনের ছুডু বইন আইছে। রাস্তায় কানতে কানতে যাইতেছিল আমি দেইখা দাঁড় করাইছি।’
সায়ন এবার তড়াক করে উঠে বাইরে গেল। শীতল বাইরে দাঁড়িয়ে চোখ মুছছে ঘনঘন। কাঁদতে কাঁদকে চোখ মুখ লাল করে ফেলেছে। এইরে কী হলো আবার? শুদ্ধ সারাদিনে তাকে কতশতবার ফোন করে। তার ঘুরে ফিরে ওই একটায় কথা ‘,ভাইয়া চোখ-কান খোলা রেখো। আমি যতবার দেশের বাইরে আসি ততবারই কিছু না কিছু ঘটে। শীতলের দিকে নজর রেখো। ওকে একা ছেড়ো না। ‘ শুদ্ধর কথা শুনে সে আজ সকালে নিজে শীতলকে কলেজে রেখে রেখেছে। আনতেও যেতো কিন্তু শীতল আগেই চলে এলো কেন? তার কলেজ তো ছুটি দিবে আরো আধাঘন্টা পর। সে দ্রুত শীতলের কাছে যেতে শীতলের চোখের পানি বাঁধ ভাঙল। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। শুদ্ধর জন্য কাঁদছে দেখে সায়ন তার মাথায় হাত রেখে আদুরে সুরে বলল,

-‘শুদ্ধ সামনে সপ্তাহেই চলে আসবে। কাঁদে না বোন। আইসক্রিম খাবি?’
শীতল না বোধক মাথা নাড়িয়ে হেঁচকি তুলতে তুলতে বলল,
-‘কিয়ারাকে খুঁজে দাও ভাইয়া।’
-‘ কোন কিয়ারা? কি হয়েছে তার?’
-‘আমার বান্ধবী।’
-‘রুবাব এলে ঘনঘন আসত ওই মেয়েটা?’
-‘হুম।’
-‘কি হয়েছে তার?’
-‘ ওকে চাঁদরাত থেকে খুঁজে পাওনা যাচ্ছে না। আমি জানি ওর কারো সাথে সম্পর্ক নেই। সে পালিয়ে যায় নি। ও ওইরকম মেয়েই না। আমার মন বলছে সে বিপদে পড়েছে। তুমি কিছু একটা করো ভাইয়া।’
-‘সে নাহয় করলাম। কিন্তু তুই কাঁদছিস কেন? এ খবর তোর প্রতিদেবের কাছে পৌঁছালে আমাকে যে শূরে চড়াবে। থাম বোন, কাঁদে না, আচ্ছা দুদিন সময় দে আমি খুঁজে দেবো তোর বান্ধবীকে।’
এমন টুকটাক কথা বলতে বলতে সায়ন দোকান থেকে আইসক্রিম নিয়ে
শীতলের হাতে ধরিয়ে দিলো। আজমকে কাজ দিলো কিয়ারার বাড়ির খোঁজ নিতে। তারপর নানান কথা বলতে বলতে এগিয়ে গেল বাড়ির দিকে।

শুদ্ধ যাওয়ার আগে শীতলকে নিয়ে নিজে গিয়েছিল শীতলের কলেজে।
এতদিন ক্লাস না করায় কথা বলে এসেছিল। এখন রেগুলার তাকে ক্লাস করতে হয়। কিন্তু আগে কলেজে যেতে যতটুকু ইচ্ছে করত এখন তাও করে না। কিয়ারাকে ছাড়া ভালো লাগে না। কিয়ারা কলেজে আসে না দেখে কিয়ারার খোঁজ করে জানতে পারে সে এক খ্রিষ্টান ছেলের সঙ্গে নাকি পালিয়েছে। ধর্মও চেঞ্জ করে ফেলেছে। একথা বিশ্বাস না করতে পারে নি সে তাই আজ তাড়াতাড়ি কলেজ ছুটি হওয়ায় একাই গিয়েছিল কিয়ারাদের বাসায়। এর আগেও গিয়েছিল তবে বাড়িতে কেউ ছিল না।
কিন্তু আজ কিয়ারার বাবা- মা কে কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই উনারা
যা নয় তাই বলে অপমান করেছে। বাড়ির মেয়েরা পালালে বাড়ির লোক ভাবে বান্ধবীরাই যত নষ্টের গোঁড়া। বান্ধবীরাই ভদ্র মেয়েদের মাথা খায়।

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৬৪

প্রেম টেম করার জন্য এরাই বখাটে, নেশাখোর ছেলেদের দিকে লেলিয়ে দেয়। কিন্তু এটা দেখে না সবসময় বান্ধবীদের দোষ থাকে না। বান্ধবীর মতো বান্ধবী হলে তারা কখনো ভুল কাজে প্রশ্রয় দেয় না। তাকে অযথা ভুল বুঝছে দেখে কিছু বলার সুযোগও দিলেন না উনারা নিজেদের কথা শেষ করে মুখের উপর দরজা আঁটকে দিয়েছে। এভাবে কখনোই কারো কাছে অপমানিত হয় নি শীতল। তাই কাঁদতে কাঁদতে এসেছে সারাপথ।
তবে মনের ভেতর কিছুটা অভিমানও জমে কিয়ারার উপর। তাকে খুঁজে পেলে সব অভিমান উগলে দেবে।

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৬৬

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here