শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৬৬
নূরজাহান আক্তার আলো
বাজাও শিষ মারো তালি
নিঃশব্দে মুছে যাক গোপন কালি।
এসেছে রে, এসেছে চৌধুরী এসেছে__
হবে নাকি চুক্তি? দেবো নাকি উক্তি?
চোর-পুলিশ ভাই ভাই
চলো এসো হাত মিলাই?
উৎফুল্ল স্বরে উক্ত কথাটি বলতে বলতে ইগর এসে বসল শুদ্ধর সামনে। যদিও সুস্পষ্টভাবে বাংলা কথা বলতে পারেন না তিনি। ঐশ্বর্যের মায়ের বদৌলতে একটু আধটু শিখেছিল এই যা! তবে এই একটু আধটু দিয়েই বাঙালিদের খোঁচানোর কাজ ঠিকভাবে হয়ে যায়। বলা বাহুল্য, নড়বড়ে উচ্চরণ দিয়ে সামনে ব্যাক্তিকে আপমান করতে এক্সপার্ট৷ এখন যেমন ভাবছেন শুদ্ধকে খোঁচাবেন। কারণে অকারণে খুঁচিয়ে শুদ্ধ রেগে উনার গায়ে হাত তুললে কোনো অঘটন সৃষ্টি করবে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
বাইরের দেশ থেকে এসে উনার গায়ে হাত তোলার অপরাধে পুলিশের হাত তুলে দিলেও মন্দ হয় না। বাঙালি জাতি, বিদেশি জেলের ভাত কেমন জানে না। এই সুযোগে নাহয় জেল থেকে ঘুরে আসুক। মানুষের জীবনে সব রকমের অভিজ্ঞতা থাকা জরুরি। তাছাড়া কোথাও লেখা নেই সাইন্টিস্ট হলে জেলে যেতে পারবে না। উনার হাসি হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে আছে শুদ্ধ। বয়সটা থেমে না থাকলেও এখনো ইগরের শারীরিক গঠন যথেষ্ট স্ট্রং। পোশাক পরে রুচি সম্মত। তাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ইগর ওয়াইনের বোতল দেখিয়ে জানতে চাইল হোয়াইট নাকি রেড ওয়াইন নেবে। শুদ্ধ কোনো জবাব না দিলে নিজে থেকেই রেড ওয়াইনের গ্লাস এনে ধরল শুদ্ধর সামনে। শুদ্ধ এবারও ধরল না দেখে ইগর বলল,
-‘রাগ করে না ইয়াং ম্যান।’
শুদ্ধ হাসল। ঠোঁটের কোণে হাসি এঁটে খোঁচা মেরে বলল,
-‘ কেমন আছেন, স্যার.. উফ! বিগ মিসটেক চোর মহাশয়। ‘
মুখের উপর চোর বলায় ইগরের ভীষণ রাগ হলো। তবে রাগটুকু প্রকাশ না করে হাসি মুখে বলল,
-‘কী জন্য এসেছো?’
-‘ ভয় পাচ্ছেন বুঝি?’
-‘তুমি বাঘ নাকি ভাল্লুক যে ভয় পাব?’
-‘ আমি কী আপনার থেকে ভালো কে জানে?’
-‘ওটা আর পাবে না শোয়াইব।’
-‘ কে বলল?’
-‘আমি।’
-‘ আমার জিনিস হজম করার ক্ষমতা আপনার আছে?’
কথা বলতে বলতে আশেপাশে তীক্ষ্ণ নজর বুলিয়ে দেখে নিলো নির্জন জায়গাটা। এখন মধ্যেদুপুর। সুনশান এরিয়া। কাছে কোথাও একটা দ্বীপ আছে। এদিকটা পরিত্যক্ত এরিয়া বলা চলে। এজন্য আকাম কুমার সব
এই এরিয়ার মধ্যে হয়ে থাকে। তবে এই জায়গার কথা ঐশ্বর্য ছাড়া কেউ জানত না কারণ ঐশ্বর্যকে বেশিরভাগ সময় এখানেই আঁটকে রাখতেন।
ছোট্ট একটা রুমে বন্দী রেখে কষ্ট দিতেন। শুদ্ধ সুইডেনে এসেছে দুদিন হলো। তিনদিনের দিন এসেছে ইগরের সাথে দেখা করতে। হতেও পারে এটাই শেষ দেখা। শুদ্ধ কিয়ৎকাল চুপ থেকে ঠান্ডা চাহনি ছুঁড়ে ইংলিশে বলল,
-‘ ফর্মূলা কাজে লাগাতে পারলেন না, পারার কথাও না, তাহলে শুধু শুধু চুরি করলেন কেন?’
-‘ কোটি টাকা পেলাম। তোমাকে হারাতে পারলাম। অপমানের শোধ নিতে পারলাম।’
-‘ আমাকে হারালেন? কিভাবে?’
-‘তুমি জিনিয়াস আমি মানি। এটাও জানি সামনে আরো চমকপ্রদ কাজ করবে। কথা হচ্ছে, টাকা অফার করেও যখন আমার হয়ে কাজ করলে না তখন রাগ হচ্ছিল। এই কারণে আমি ঐশ্বর্যকে পাঠিয়েছিলাম তোমার কাছে, যাতে তোমাদের মাঝে কিছু ঘটে। নারীর সৌন্দর্যের কাছে পুরুষ কাবু। আর ঐশ্বর্যের রুপ ছিল ওইরকমই। ওর মায়ের জন্য বারবার বেঁচে গেছে আমার হাত থেকে নয়তো ওর ভার্জিনিটি আমিই..!’
-‘সে আমার ছোটো ভাইয়ের হবু বউ তাকে জড়িয়ে কোনো নোংরা কথা শুনতে ইচ্ছুক নই। কথা হচ্ছিল চুরি নিয়ে।’
-‘ সেটা নিয়েও কথা বাড়িয়ে লাভ নেই ফিরে যাও।’
-‘ স্কটল্যান্ডের সাইন্টিস্ট শেফার্ড ফ্লেমিং এর কাছে ফর্মূলা বিক্রি করতে চেয়েছিলেন। ফ্লেমিং সন্দেহ করায় তাকে না দিয়ে ডিসুশ বিনের কাছে চার কোটি তিপ্পান্ন লক্ষ টাকার বিনিময়ে বিক্রি করেছেন ৷ ভেবেছিলেন আজ রাতে অন্যদেশে পাড়ি জমাবেন যাতে আমার মুখোমুখি হতেও না হয়।’
-‘এসব কথা তুমি জানলে কিভাবে? সে আমাকে কথা দিয়েছিল ভুলেও তোমাকে জানাবে না।’
-‘ কিন্তু জানিয়েছে তো। শুধু জানাই নি, আপনার বিরুদ্ধে সাক্ষীও দেবে। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হচ্ছে, আমার জিনিস এখন আমার কাছে সুরক্ষিত। বিশ্বাস হচ্ছে না?’
ইগর থমথমে মুখে তাকিয়ে রইল শুদ্ধর মুখের দিকে। কাট কাট চেহারার সুদর্শন পুরুষটা আবারও তাকে ঘোল খাইয়ে ছাড়ল। সব কথা সে জানে, এর মানে এতদিন সিঙ্গাপুর থাকলেও তার নজর ছিল উনার গতিবিধির দিকে। অথচ উনি ভেবেছিলেন একের পর এক বিপদে পড়ে চৌধুরী পুত্র
এসব নিয়ে ভাবার সময় পাবেন না। আর যতদিনে বিপদ কাটিয়ে উঠবে ততদিনে ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যাবেন। কিন্তু শেষ চালটা দিয়ে শুদ্ধই যে চেকমেট দেবে সেটা কল্পনাও করেন নি। পুলিশের গাড়ির হর্ণ কানে পৌঁছাতেই বুঝতে বাকি রইল না ঘটনা। সাইলেন্স করা পিস্তলটা নিজের
কাছে না থাকায় উঠে দাঁড়াতেই কোথা একটা বুলেট এসে বিঁধল উনার বুকের বাঁ পাশে। চোখের পলকে লাল রক্তে ভিজে গেলে পরনের সবুজ
টি- শার্ট। তখনই পুলিশের গাড়ি থেমে ধপধপ শব্দ তুলে একদল পুলিশ ভেতরে প্রবেশ করল। ইগর ততক্ষণে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে নিতে লুটিয়ে পড়েছে শুদ্ধর পায়ের কাছে। শুদ্ধ ব্যাতীত এখানে আর কাউকে না দেখে পুলিশ ইগরের লাশের সঙ্গে সঙ্গে শুদ্ধকেও যেতে ইশারা করল।
শুদ্ধ যেতে যেতে পাথিমধ্যে দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে একবার তাকাল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রইল জঙ্গলের দিকে। কিন্তু কাউকে নজরে না পড়লে
চলে গেল পুলিশের সঙ্গে। পুলিশের গাড়ির শব্দ শোনা না গেলে ইয়াসির বের হয়ে এলো। হেসে হাততালি দিতে দিতে বিরবির করল,
-‘তোমার বিশুদ্ধ পুরুষ সাধু নয় চড়ুইপাখি। সে নির্মমভাবে আহনাফকে মেরেছে। এমনভাবে মেরেছে চেনা মুশকিল। তার হাতে খুনের রক্ত লেগে আরো আগে থেকে লেগেছে। কিন্তু প্রমাণের ভিত্তিতে কখনো তা সামনে আসে নি। কিন্তু এবার ঘটা করে তোমার শুদ্ধর গায়ে খুনীর ট্যাগ লাগবে। আমি খারাপ, মাফিয়া বলে রিজেক্ট করেছিলে, এবার? এবার কি করবে শীতলরাণী? এবার মানতে পারবে খুনী স্বামীকে? ভালোবাসা ওইরকমই থাকবে তো?’
একথা বলে ইয়াসির দুই পকেটে হাত গুঁজে শিষ বাজাতে বাজাতে হাঁটা ধরল বিপরীত পথ ধরে। এখানকার কাজ আপাতত শেষ। কিন্তু ইয়াসির হয়তো এটা জানত না, শুদ্ধ এখানে এসেছিলই প্ল্যান করে আর পুলিশরা
ছিল ফেইক। প্ল্যান ছিল ইগরকে থার্ড ডিগ্রি দিয়ে আরো কিছু কথা বের করার, কিন্তু হলো না। হলোই না যখন তখন আফসোস করে লাভ নেই।
তাছাড়া মানুষের জন্য কষ্ট পেলেও অমানুষের জন্য শোক পালন করার প্রশ্নই আসে না। ইগরের ঘটনা জানার জন্য রুবাব কল দিলো শুদ্ধকে। শুদ্ধ সেখানে একা যাওয়ায় রুবাব, সায়ন চিন্তাতেই ছিল। তাদের চিন্তা দ্বিগুন হলো যখন শুদ্ধ কল ধরছিল না। কয়েকবার কল করার পর কল রিসিভ হলে ফোনের ডিসপ্লেতে শুদ্ধর মুখটা ভেসে উঠল। সদ্য শাওয়ার
নিয়ে এসেছে শুদ্ধ। তাকে দেখে রুবাব বলল,
-‘কাজ হয়েছে?’
-‘হুম।’
-‘খোসা (লাশ)?’
-‘গায়েব।’
-‘আলহামদুলিল্লাহ। ‘
রুবাব ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলায় সায়ন ভ্রুঁজোড়া কুঁচকে তাকাল। বলল,
-‘ওই শালা তোর শশুর মারা গেছে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলিস কোন হুঁশে? কান্না কর। দু’মিনিট মন খারাপ করে থাক।’
-‘ জাতের শশুর হলে কান্না করতাম কিন্তু ওইটা ছিল অজাতের শশুর।
অবশেষে পথের কাঁটা সরলো ভেবে খুশি লাগছে।’
-‘তবুও মন খারাপ কর। এ্যাই শুদ্ধ তুইও কর।’
সায়নের কথা শুনে শুদ্ধ মাথা মুছতে মুছতে জবাব দিলো,
-‘তোমরা শুরু করো আমি খেয়ে এসে শোকে জয়েন হচ্ছি।’
-‘আচ্ছা।’
এই নিয়ে কথা বলতে বলতে শুদ্ধ অন্য প্রসঙ্গে কথা উঠাল। তার কথায়
রুবাব আর সায়ন হো হো করে হেসে ফেলল। এরপর প্রসঙ্গ এলো তিন ভাইয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান নিয়ে। বিয়ের কার্ড ছাপাতে দেওয়া হয়ে গেছে।
কার্ডটা নাকি ভীষণ সুন্দর। কার্ডের ডিজাইন সিলেক্ট করেছেন সিঁতারা।
শাহাদত চৌধুরী আগামী মাসে ছুটিতে আসবে তখনই শুভকাজ সম্পূর্ণ করা হবে। অথচ এখন থেকেই বাড়িতে বিয়ের তোড়জোড় লেগে গেছে।
বোনেরা কে কী করবে, কে কী পরবে, সেটার প্ল্যানও ডান। এমন আরো কিছু কিছু ব্যাপারে কথা বলতে বলতে তিনভাই খুব হাসল, মজা করল,
এরপর কল কাটল। শুদ্ধ খেয়ে পুনরায় বের হলো। কারণ যাদের দিয়ে কাজটা করিয়েছে তাদেরও পাকাপোক্ত একটা ব্যবস্থা করে যেতে হবে। নয়তো এখান থেকে আবার ঝামেলার ডালপালা গজাবে। এই ভুল তো বারবার করা যাবে না।
অতঃপর আরো কিছু জরুরি কাজ সেরে পরদিন শুদ্ধ সিঙ্গাপুর ফিরল।
রুবাব ঐশ্বর্যকে নিয়ে চেকআপ করিয়ে আনল আরেকবার। ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে প্রয়োজনীয় সবকিছু গুছিয়ে রাখল। শতরুপা চৌধুরীকে নিয়ে টুকটাক শপিং সারল। বাড়িতে ছোটো ভাই বোনরা আছে। তাদের জন্য কিছু নিতে হবে। বাড়িতে পা দিলেই ধরবে কী এনেছে জানার জন্য।
অগত্যা টুকটাক কেনাকাটার কাজে শুদ্ধকে আর টানে নি কেউ। কারণ এখানে আসার পর থেকে বিশ্রাম পায় নি ছেলেটা। এসে খেয়ে ঘুমাচ্ছে।
আগামীকাল তাদের ফ্লাইট একটানা বাইরে থেকে দেশের জন্য সবারই র মনটা আকুপাকু করছে। শারাফাত চৌধুরী জানিয়েছেন বাড়িতেই যেন উঠেন। ভাইয়ের মুখের উপর শতরুপা কিছু বলেন নি। দেখতে দেখতে
সময় কাটতে লাগল নিজের মতো। ঘড়ির কাঁটা ঘুরতে ঘুরতে রাতটাও পার হলো। পরেরদিন সকাল হলো, দুপুরটা পেরিয়ে বিকালে রেডি হয়ে সকলে নিজ দেশের উদ্দেশ্যে রওনা হলো।
আগে প্রতি সপ্তাহে চারদিন করে একজন মহিলা আসত সাম্য, সৃজনকে পড়াতে। উনি একটা স্কুলের ইংলিশ টিচার। নাম সুলতানা। উনি নিজেও
পড়াশোনার পাশাপাশি শিক্ষকতা করেন। বলা বাহুল্য, ভালো পড়ানও। সাম্য, সৃজনের সাথে বর্তমানে শীতলকে পড়াচ্ছেন, ইংলিশ সাবজেক্টটাই পড়ে শীতল। শীতলকে পড়ার চক্করে ফেলে গেছে শুদ্ধ। আগে বিকেলে কত সুন্দর ঘুরে বেড়াত, সাইকেল চালাত, গাছে উঠে ফল পাকড় পেড়ে খেতো, আহা, সেই দিনগুলো কত সুন্দর ছিল। আর এখন বিকেল হলেই বই খাতা নিয়ে বসে পড়তে হয়। তবে আজ অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও
ম্যম আসছে না। তাই তিনজনে মিলে শুয়ে বসে চিৎ কাত হয়ে গল্প করে সময় কাটাল। আজকে পড়া নেই তাই তিনজনে খুশিতে হইহই করে বের হলো। অনেকদিন পর শীতল গাছে উঠে পেয়ারা, তেতুঁল, আমড়া পেড়ে মাখামাখি করে খেলো। পুরো বাগানে কিছুক্ষণ তার সাইকেল চালাতো।
সন্ধ্যার আজানের পর তার উসকোখুসকো চুল দেখে সিমিন বকতে শুরু করল। শীতল মায়ের বকা শুনে ফুলোরাণী হয়ে মুখ ফুলিয়ে তেল নিয়ে বসল সিঁতারার কাছে। চুলে তেল দিতে একদমই ইচ্ছে করে না। কেমন মরা মরা লাগে। সিঁতারা ড্রয়িংরুমে বসেই যত্ন করে শীতলের লম্বা চুলে তেল দিয়ে দুপাশে দুটো বিনুনী করে দিলো। তার দেখে স্বর্ণ বসল। শখ পড়ছিল তাকেও ধরে চুল তেল দিয়ে চুল বেঁধে দিলেন সিঁতারা। এরপর
সন্ধ্যার নাস্তা সেরে শুদ্ধর রুমে গিয়ে বিছানায় কিছুক্ষণ গড়াগড়ি খেল।নিজের ফোন চেক করে দেখল শুদ্ধর মেসেজ এসেছে, ‘ রুমে যেন পাই।’
মেসেজটা নিয়ে কিছুক্ষণ গবেষণা করে বুঝল মহারাজ তারমানে বাড়ি ফিরছে৷ তবুও সিওর হওয়ার জন্য ছুটতে ছুটতে গেল সিঁতারার কাছে।
কোনোমতে আকাশ সমান আনন্দটুকু কোনোমতে গোপন করে সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়েই জিজ্ঞাসা করল,
-‘বড় মা রুবাব ভাইয়ারা কি দেশে ফিরছে?’
-‘হ্যাঁ।’
-‘কবে?’
-‘আজ রাতের ফ্লাইটে। ‘
-‘সবাই আসছে।’
-‘হুম।’
-‘আচ্ছা। ‘
একথা বলে শীতল সিঁড়ি থেকে সরে নেচে উঠল। ইস, এত খুশি লাগছে কেন? লজ্জাও লাগছে। মহারাজ আসছেন তাহলে। তিন সপ্তাহের নামে কত্তগুলোদিন সে বাড়িতে নেই। কত্তদিন ছুঁয়ে দেখে নি। দেশের বাইরে গিয়ে যেন ভুলেই বসেছে তারও একটা বউ আছে। বউটা তাকে খুব মিস করে। ঘুমের ঘোরে বিছানা হাতড়ে না পেলে ফুপিয়ে কাঁদে। তার বেলায় লবডঙ্কা অথচ নিজের বেলা ষোলোআনা বুঝে নিতে ওস্তাদ। নয়তো কি
ফেরার আগে ঠিকই হুমকি দিয়ে রেখেছে, রুমে যেন পাই। বললেই হবে নাকি? এসব নানান কথা ভাবতে ভাবতে লাজুক হাসল। গালদুটো লাল হয়ে উঠল একরাশ লজ্জায়।প্রবাসীর বউদের আনন্দটুকু আজ উপলব্ধি করতে পারছে। এই আনন্দটুকু যেন ঈদের সামিল। এসব ভেবে লাজুক হেসে দুই হাতে মুখ ঢাকতে যাবে তখন দেখে স্বর্ণ রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখে হাসি চওড়া হলো শীতলের। দ্রুত গিয়ে স্বর্ণকে বলল,
-‘আপু রুবাব ভাইয়া আসছে।’
বোনের মুখ দেখে বহুকষ্টে হাসি আঁটকাল স্বর্ণ। জবাব দিলো,
-‘হুম। সঙ্গে শুদ্ধ ভাইও।’
শীতল হঠাৎ মুখটা থমথমে করে অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,
-‘ কারো খোঁজ নিতে আমার বয়েই গেছে।’
একথা বলে শীতল নিজের রুমে ঢুকে গেল আর তাকে যেতে দেখে স্বর্ণ হেসে ফেলল। যার আগমনে তার চঞ্চলতা বেড়ে গেছে, লজ্জা পাচ্ছে, ঠোঁটে মিটিমিটি হাসি ভেসে উঠেছে তার খোঁজ নিতে নাকি বয়ে গেছে, ভাবা যায়!
_’আপনাকে আমি স্বামী হিসেবে মানি না। ছুঁবেন না আমায়। আপনার ছোঁয়া লাগলে গা গুলিয়ে আসে আমার। ঘৃণা হয়। আপনি আস্ত একটা জানোয়ার।’
চিৎকার করে বলা কিয়ারার কথা শুনে বুরাকের মধ্যে কোনো ভাবান্তর দেখা দিলো না। কনিষ্ঠ আঙুল দিয়ে কান ঘুঁচিয়ে নিলো। হাতের জ্বলন্ত সিগারেটে কয়েকটা টান মেরে অ্যাশট্রেই ঘঁষে নিলো। তারপর চট করে উঠে গায়ের শার্ট খুলে ছুঁড়ে মারল রুমের এক কোণে, প্যান্টের বেল্টটাও ছুঁড়ল আরেক দিকে। তার মনোভাব বুঝে কিয়ারা পালাতে গেলে বুরাক তাকে ধরে ফেলল। ফিচেল হেসে কানে কানে বলল,
-‘লুকোচুরি পরে খেলব ডালিং। আগে আদর আদর খেলার পর্বটা শেষ করি? আমরা হলাম ভিলেনের জাত; জোর করা, ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছে আমাদের ধর্ম। ভালো মানুষি আমাদের রক্তেও নেই। আমার ছোঁয়াতে গা গুলালে বমি করো সমস্যা নাই। সত্যি বলতে, তোমার বমির কারণ হতে পেরে আমার বরং ভালোই লাগবে।’
-‘যেতে দিন না আমায়? কেন করছেন এমন?’
-‘ভালো লাগে তাই।’
-‘আমি তো আপনাকে চিনতামও না, তবে?’
-‘আমি চিনতাম। শীতলের কাছের মানুষের সন্ধান করতে গিয়ে তোমায় পেয়েছি। কবুল যখন বলেছো এভাবেই নিজেকে মানিয়ে নাও। পারলে কনসিভ করো। বাবা ডাক শোনাও। নিজের সংসার সাজাও। তবে মুক্তি পাবে না।’
একথা বলে কিয়ারাকে ধাক্কা দিয়ে বিছানায় ছুঁড়ে পুরুষালি শক্ত দেহের ভার ছেড়ে দিলো বুরাক। ধীরে ধীরে গাঢ় থেকে গাঢ়তরও হলো স্পর্শ।
অসহায় কিয়ারা শব্দ করে কাঁদতে লাগল। মনের মিল না থাকলে বরের ছোঁয়াও বোধহয় বিষের মতো লাগে। ঘৃণা হয়। বুরাক যখন তার পোশাক খুলতে ব্যস্ত তখনও নিজেকে বাঁচাতে কিল, ঘুষি, খামচি, আঁচড় কেটে নিজের বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালাল। করুণ সুরে বারবার ডাকল তার প্রিয় বাবাকে, ডাকল মমতাময়ী মাকে, অশ্রুভেজা চোখেও ভাসল মন কুঠুরিতে লুকিয়ে রাখা প্রিয় পুরুষের মুখ। দুঃভাগ্যবশত কেউ শুনল না বিধায় বাঁচাতেও এলো না। প্রতিবারের মতো এবারও ছাড়া পেলো না সে। মনের দখল না পেলেও জোরপূর্বক শরীরের দখল ঠিকই আদায় করে নিলো। পুরুষত্বের জোর দেখিয়ে নিজের কাজ সেরে পাশে শুয়ে পড়ল বুরাক। ক্লান্ত দেহে ঘুমিয়েও পড়ল কিছুক্ষণের মধ্যেই। কিয়ারা নীরবে চোখে জল ফেলতে ফেলতে কষতে লাগল নিজের হিসাব। তবে আজ সে মানতে বাধ্য যারা সুইসাইড করে তারা সত্যিই সাহসী। নয়তো
কিভাবে সুইসাইড করতে পারে তারা? সে তো পারে না। সে তো ভীতু! কতবার মরতে গিয়েও পারে নি অথচ এভাবে বন্দিনী জীবনে বাঁচতেও তার ভয় আবার মরতেও।
পরেরদিন সকালে মিষ্টি একটা সকালের সূচনা হলো। রোজকার মতো চৌধুরীর গিন্নিরা রান্নাঘরে ব্যস্ত। শীতল সিমিনের রুমে এখনো ঘুমাচ্ছে।
গতরাতে খাবার খেয়ে মায়ের রুমে শুয়ে বাবার সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলেছিল। সেখানে শুয়েই ফোন টিপতে টিপতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে।
ঘুম ভেঙেছে ফজরের আজানের অনেক পর। তখনই উঠে নিজের রুমে ফ্রেশ হয়ে একবার শুদ্ধর রুমে উঁকি মেরে দেখে শুদ্ধ রুমে নাই। বিছানা ফাঁকা। তারমানে হাঁটতে বেরিয়েছে তার দেখা পেতে নিচে থাকতে হবে।
ফাঁকা রুমে একা পেলে তাকে পানিশমেন্ট দিবেই দিবে। একথা ভেবে সে ধীরে সুস্থে নিচে নামল। বাগানে কিছুক্ষণ হাঁটল তবুও শুদ্ধ আসছে না দেখে রান্নাঘরে গেল। মা-চাচীদের ব্যস্তহাতে কাজ করে দেখে পুনরায় ডয়িংরুমের দিকে যেতেই শুদ্ধর মুখোমুখি হলো। চোখাচোখিও হলো।
শুদ্ধ রান্নাঘরে মা-চাচীদের দেখে পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে নিচু স্বরে বলল,
-‘রুমে আসুন মিসেস শোয়াইব, এক্ষুণি!’
হঠাৎ তাকে ‘আপনি’ সম্বোধন করায় চোখ বড় বড় করে তাকাল শীতল।
এত সন্মান হজম হলো না তাই শুদ্ধর দেখাদেখি সেও ফিসফিস করে বলল,
-‘কেন?’
শুদ্ধ ফিচেল হেসে বলল,
-‘মিষ্টি খেতে।
একথা শুনে ঘটনা বুঝতে বাকি রইল না তার। তবে সকালবেলা শুদ্ধকে জ্বালানোর সুযোগ হাতছাড়া করল না সে। মুহূর্তেই শয়তানি বুদ্ধি খেলে গেল তার মাথায়। শুদ্ধর পেছন পেছন সিঁড়ি অবধি গিয়ে লাজুক মুখে বলল,
-‘স্বামী বলছিলাম যে, বিয়ে হয়েছে অনেকদিনই তো হলো বাপের বাড়ি যাওয়া হয় নি। মনটাও খুব একটা ভালো নেই। যদি পাঁচ কেজি কিনে দিতেন ঘুরে আসতাম।’
-‘ কদিন ধরে পিঠে মার পড়ে তাই না? রুমে চল মিষ্টি নিতে।’
-‘সাইন্টিস্টকে বিয়ে করেছি। তার এত এত টাকা। মিষ্টি ছাড়া বাপের বাড়ি গেলে কেমন দেখায় না? আপনি বরং মিষ্টিটা এখানেই দিয়ে দেন।’
তার শয়তানি মতিগতি বুঝে শুদ্ধ এবার প্রচন্ড বিরক্ত হলো। রাতে ফিরে শীতলকে রুমে না পেয়ে রেগে আছে যদিও। এখন আবার সকাল সকাল জ্বালাতে শুরু করেছে। তবে রান্নাঘরে মা চাচীদেরকে দেখে কিছু বলতে পারছে না। তবুও ধমকে বলল,
-‘সকালবেলা পড়তে বসা যায় না? এখানে কি, যা পড়তে বস।’
সিঁড়ির কাছে ওদের ঝগড়া করতে দেখে সিঁতারা খেয়াল করলেন। তিনি সিদ্ধ ডিমের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে বললেন,
-‘কি রে শুদ্ধ সকালবেলা ধমকাচ্ছিস কেন মেয়েটাকে?’
পালানোর পথ পেয়ে শীতল সিঁতারার কাছে গিয়ে মলিন মুখে বলল,
-‘বড় মা তোমার ছেলেকে মিষ্টি কিনে দিতে বলো।’
-‘ সকালবেলা মিষ্টি কি করবি?’
-‘ বাপের বাড়ি বেড়াতে যাব। নতুন নতুন বিয়ে হয়েছে খালি হাতে যাওয়া যায় নাকি? মান-সন্মানের একটা ব্যাপার না? ‘
একথা শুনে সিমিন পরোটা বেলতে বেলতে থেমে গেলেন। শুদ্ধর দিকে একবার তাকিয়ে পুনরায় তাকালেন শীতলের দিকে। না চাইতেও হেসে ফেললেন তিনি। উনাকে হাসতে দেখে শুদ্ধ তাকালে চোখাচোখি হলো।
মুখে না বললেও উনার হাসির মানে শুদ্ধ ঠিকই বুঝল,
-‘ বাঁধা দিয়েছিলাম বলে ভিলেন বানিয়েছিলে না? বেশ হয়েছে। পাজি মেয়েকে করো বিয়ে, আরো করো, আর সারাজীবন জ্বলতে থাকো।’ শুদ্ধ আর দাঁড়ালোই না গটগট করে সিঁড়ি বেয়ে রুমের দিকে হাঁটা ধরল।
তবে তার কানে ঠিকই পৌঁছাল মা-চাচীদের খিলখিল হাসির শব্দ। সেও বোধহয় মুচকি হাসল। অতঃপর শাওয়ার নিয়ে বের হতেই দেখে রুমের দুষ্টু মালকিন এসে হাজির। হাতে কফির মগ। সে তোয়ালে মেলে দিয়ে হাত বাড়িয়ে মগটা নিয়ে সেন্টার টেবিলের উপর শব্দ করে রেখে দিলো।
তারপর দুকদম এগিয়ে বিনাবাক্যে শীতলকে বাহুডোরে জড়িয়ে নিলো।
কতদিন পর! মনে হচ্ছিল এক একটা দিন নয় বছর কাটাচ্ছে। বুকটাও যেন খাঁ খাঁ করা শূন্য মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। এইটুকু দেহের মেয়েটা
দেশের বাইরে গিয়েও তাকে শান্তি দেয় নি। চারিদিকে সবই ছিল অথচ শান্তি ছিল না। কেমন শূন্যতা ভাব। এখন যেমন শান্তিতে বুক ভরে গেছে এই শান্তিটাই খুঁজে মরছিল। ভেতর ভেতর পাগলপ্রায় হয়ে উঠেছিল এই
ছোঁয়াটুকু পাওয়ার জন্য। শীতলের কম্পিত হাতটাও তখন উঠে এসেছে শুদ্ধর পিঠে। তখন হাতের বাধনটা দ্বিগুন শক্ত করে বুকের সাথে পিষে ফেলার পরিকল্পনা করল যেন বুকের মালিক।
শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৬৫
ব্যথা পেলেও শীতল চুপ করে রইল। ঠোঁটে লাজুক হাসি। চোখে একরাশ খুশি। এত ভালোলাগা, আনন্দ, কখনোই লাগে নি বিশেষ করে এই মানুষটার আগমনে। আগে বহুবার দেশের বাইরে গেছে এমনটা লাগে নি। তবে কী বৈধ সম্পর্কের টান নাকি এটা? নাকি তীব্র ভালোবাসার ফল? তাকে চুপ থাকতে দেখে সেভাবেই দাঁড়িয়েই শুদ্ধ বলল,
-‘এভাবে চেপে ধরে মেরে ফেলি?’
-‘আপনার বুকে মাথা রেখে যদি মরতে পারি তবে আমার মরণ সই।’
