শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৬৮

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৬৮
নূরজাহান আক্তার আলো

-‘ আর কতবার বলব শখকে আমি যেভাবে কখনো দেখি নি। তোমার কসম, শখকে নিয়ে আমার মনে কোনো ফিলিংস নেই। তবুও কেন শুধু শুধু পাগল ক্ষেপালে, মম? এখন কি হবে বুঝতে পারছো তুমি? তাছাড়া
শুদ্ধই বা কি ভাবল?’
-‘ভুল কি করেছি? ঠিক ভুল যেটাই হোক আমরা সন্ধ্যায় যাচ্ছি, ব্যাস!’
-‘তুমি বুঝতে পারছো না কেন আ..আম।’
-‘তোর বুঝার তুই বুঝ আমি শখকেই তোর বউ বানাব। ওর মতো কিউট একটা মেয়ে চোখের সামনে থাকলে চোখেরও শান্তি। ‘

-‘আমার টেনশন হাই করে দিয়ে তুমি শান্তি খুঁজছো? শুদ্ধকে জানানোর আগে আমাকে জানাতে পারতে? ধুর ভাল্লাগেনা, এখন শুদ্ধ কে বোঝাব কি করে এসবের আগে-পিছে আমি নেই।’
একথা বলে অর্ক দ্রুতপায়ে বের হলেও শুদ্ধর নাগাল পেল না। দিশেহারা হয়ে ছুঁটল রুমের দিকে। চার্জে দেওয়া ফোন হাতে তুলে কল করল তার বিপদের সঙ্গীদের। কামরান কল রিসিভ করলে এড করল হাসান, স্যান্ডি আর হাসানকে। কামরান তখন অর্কের চুপসানো মুখে দেখে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-‘কি রে মামা সকাল সকাল খুব কষে গেছে? আসব নাকি পানের বোটা নিয়ে?’
কামরানের কথা শুনে বাকিরা হাসল। অন্যসময় হলে অর্কও ফাজিলামি করত কিন্তু এখন টেনশনে ঘামতে শুরু করেছে। রীতিমতো সব গুলিয়ে যাচ্ছে। শখকে নিয়ে তার মনে যদি সামান্যতরও ফিলিংস থাকত তাহলে
খুশিতে নাচত। কিন্তু সেরকম কিছুই না। বরং মেয়েটার বিয়ে ভাঙা নিয়ে যেমন খারাপ লেগেছিল তেমনি ভুল মানুষের হাত থেকে বেঁচে ফিরে খুব খুশি হয়েছিল। তাছাড়া শুদ্ধ বোনদের নিয়ে বরাবরই পজেসিভ। বোনকে নিয়ে কোনো ধরনের মজা পছন্দ করে না তাই তারাও এমনকিছু করত না। সেখানে তার মা তাকে না জানিয়ে শুদ্ধকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসে আছে। একপ্রকার লজ্জাও লাগছে। আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে, এখন যদি সে বিয়েতে না বলে তাহলে শুদ্ধ ভাববে সে শখকে নিয়ে মজা লুটেছে।
আবার যদি রাজি হয় তাহলে হয়তো ভাববে আগে থেকে শখকে পছন্দ করত। এখন দুদিকেই বিপদ! অর্ককে অন্যমনস্ত হয়ে পায়চারি করতে দেখে তখন স্যান্ডি বলল,

-‘কি হয়েছে বন্ধু? এত টেনস্ দেখাচ্ছে কেন?’
-‘ শুদ্ধ এসেছিল বিয়ের কার্ড দিতে।’
-‘তো?’
-‘তো আমি ঘুমোচ্ছিলাম। মম ওকে একা পেয়ে শখের জন্য বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। ‘
-‘শখ করে বিয়ের প্রস্তাব? শখ করে মানুষকে বাঘ পালতে দেখেছি, গাছ লাগাতে দেখেছি কিন্তু বিয়ের প্রস্তাব দিতে দেখি নি। বাহ্ ইউনিক ব্যাপার স্যাপার।’
-‘বাল, মজা নিস না তো। এখন কি করব বল?’
কামরানকে থামিয়ে এবার স্যান্ডি সিরিয়াস হয়ে বলল,
-‘কি হয়েছে ভাই ঝেড়ে কাশ দেখি।’

-‘শুদ্ধর বোন শখ আছে না? মম ওর সাথে আমার বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে তাও শুদ্ধর কাছে।’
একথা শুনে তিনজন একযোগে বলে উঠল,’ কিহ্! তারপর?’
-‘তারপর আর কি? শুদ্ধ আজ সন্ধ্যায় প্রস্তাব নিয়ে যেতে বলল। সেখানে ফাইনাল কথা বলবে। এখন আমি কি করে বোঝাব আমার মনে শখের জন্য কোনো ফিলিংস নাই। এটা বলতে গেলে যদি রেগে যায়? ‘
এবার হাসান মুখ খুলল,

-‘ এতে রাগার কি আছে? অবিবাহিত ছেলে-মেয়ের জন্য বিয়ের প্রস্তাব আসবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কথা হচ্ছে, আন্টি যখন চাচ্ছেন তাহলে তোর সমস্যা কি? এমন তো না তোর জীবনে স্পেশাল কেউ আছে। শখ যথেষ্ট ভালো সেটা তুই- আমি আমরা সবাই জানি। চৌধুরী বাড়ির মেয়ে নিয়ে কুটুক্তি করার প্রশ্নই আসে না। বড় কথা, পৃথিবীতে তুইও একমাত্র ছেলে না যে বন্ধুর বোনকে বিয়ে করতে যাচ্ছিস। এত হাইপার হোস না।’
হাসানের কথায় যুক্তি আছে দেখে অর্ক বলল,
-‘কিন্তু আমার সমস্যা শখ নয়;শুদ্ধ। আত্মীয়ের মধ্যে আত্মীয়তা করলে সম্পর্ক নষ্ট হয়। আর শুদ্ধর সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করার কথা ভাবতেও পারি না আমি।’
-‘যারা সম্পর্কের যত্ন নিতে জানে না তাদের সম্পর্ক নষ্ট হয়। আমাদের শুদ্ধ কেমন জানিস না তুই? আমার মতে রাজি হয়ে যা দিনশেষে ভালো একজন জীবনসঙ্গী পাবি।’

-‘কিন্তু। ‘
-‘কোনো কিন্তু না রাজি হয়ে যা।’
-‘তোদের ছাড়া যাব না কিন্তু মার খেলে তোদেরকে নিয়ে খাব। সব কটা সন্ধ্যায় রেডি থাকবি, নো এক্সকিউজ।’
এভাবে বন্ধুদের সঙ্গে আরো টুকটাক কথা বলে অর্ক মায়ের কাছে গেল। মায়ের হাতের উপর হাত রেখে নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে রইল। তারপর ধীরে সুস্থ বলল,
-‘তুমি কি সিরিয়াস মম?’
-‘ইয়েস, মাই সন।’
-‘খুশি হবে?’
-‘ভীষণ!’

-‘ভেবে বলো। আমি কিন্তু তোমাদের বউ-শাশুড়ির ঝগড়ার মধ্যে থাকব না। তোমরা কেউ আমাকে ঝগড়াঝাঁটির মধ্যে জড়াতেও পারবে না।’
-‘জড়াব না। ‘
-‘তাহলে রেডি হও আজই রিং পরিয়ে আসবে। ফল, মিষ্টি, জামা-কাপড় যা যা লাগে সব নিতে হবে।’
ছেলের কথা শুনে অর্কের মা হেসে অর্কের চুলগুলো এলোমেলো করে দিলেন। ছেলে উনার কথা রাখায় খুশি হয়ে কপালে চুমু এঁকে দিলেন।
তারপর অর্ক রেডি হয়ে মাকে নিয়ে শপিং মলে গেল। মা ও ছেলে মিলে
ঘুরে ঘুরে শপিং করল। ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ শুদ্ধর সঙ্গে দেখা। শুদ্ধ তখন জুয়েলার্সের দোকান থেকে বের হচ্ছিল। হাতে কয়েকটা শপিং ব্যাগ। সে মূলত নতুন বউয়ের জন্য বানাতে দেওয়া গয়নাগুলোই নিতে এসেছিল।
শুদ্ধ রাগল না হাসিমুখে টুকটাক কথা বলল। তাকে স্বাভাবিক দেখে অর্ক যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। মায়ের দিকে একবার তাকালে অর্কের মা হাসি মুখে বললেন,

-‘সন্ধ্যায় আসছি তাহলে।’
শুদ্ধ অর্কের দিকে তাকালে অর্ক এবার চোখ সরাল না। বরং হাসিমুখে সম্মতিসূচক মাথা নাড়াল। শুদ্ধ নিজেও হেসে তার বাঁ কাঁধে হাত রেখে ছোটো করে জবাব দিলো,
-‘আয়।’
তারপর বিদায় নিয়ে বের হতে গেলে অর্কের মাকে দোকানিকে বলতে শুনল,
-‘আমার ছেলের হবু বউয়ের জন্য রিং আর গলার চেইন দেখব। লেটেস্ট মডেলের কিছু দেখান।’
শুদ্ধ আর দাঁড়াল না নিজের কাজ সেরে বাড়ির পথে রওনা হলো। যেতে যেতে শারাফাত ও সাফওয়ান চৌধুরীকেও বাসায় ফেরার কথা জানিয়ে নিজেও বাসায় ফিরল। শুদ্ধ বাড়ি গিয়ে সর্বপ্রথম শখকে ডাকল। ডাক শুনে শখের সাথে বাকিরাও এসে দাঁড়াল ড্রয়িংরুমে। তখন শুদ্ধ মায়ের হাতে আগে সমস্ত গয়না তুলে দিয়ে সায়নের দিকে তাকাল। বলল,

-‘ সন্ধ্যায় অর্কের মা-বাবা শখ আর অর্কের বিয়ের প্রস্থাব নিয়ে আসবে।
অর্ককে তো সবাই চেনো আলাদা করে কিছু বলার নেই। আজ সকালে আমাকে জানিয়েছিল আমি বাসায় আসতে বলেছি। বড়রা সবাই মিলে
সিধান্ত নিক। তাছাড়া এর আগে একটা এক্সিডেন্ট হয়েছিল সেটা নিয়ে বসে থাকলে চলবে না। জীবন কারো জন্য থেমেও থাকে না বরং অল্পতে বেঁচে গেছি বলে লাখ লাখ শুকরিয়া।’
একথা বলে শুদ্ধ গলার স্বর খানিকটা নরম করে বোনকে ইশারা করে পাশে বসাল। তারপর বলল,
-‘এবার বল, তুই কি চাস? তুই হ্যাঁ বললে হ্যাঁ না বললে না। তোর বিয়ের জন্য আমাদের কোনো তাড়া নেই। আমাদের কাছে তোর সিধান্ত সবার আগে।’
শখ মিনমিন করে উত্তর দিলো,

-‘তুমি আর সায়ন ভাইয়া যা ভালো বুঝবে।’
-‘এটা কোনো কথা না। সংসার করবি তুই তোর যদি মনে হয় অর্ক ছেলে হিসেবে পছন্দসই তাহলে কথা এগোব নয়তো তারা এলে সুবিধা মতো কিছু একটা বলে পাঠিয়ে দেবো।’
শখ এই ব্যাপারগুলোতে খুব লজ্জা পায়। নিজের বিয়ের কথা মুখ ফুটে বলা যায়? তবুও সে বলল,
-‘তোমরা আমাকে সব সময় বেস্ট জিনিসটাই দিয়েছো এবারও… ।’
শুদ্ধ এবার মা-চাচীদের থেকেও মত জানতে চাইল। উনারা মা উনাদের মত নেওয়া জরুরি। উনারা একবাক্যে বলে দিলো অর্ককে ভীষণ পছন্দ।

তার বিশেষ গুন সে ভদ্র-সভ্য, শিক্ষিত, কর্মঠ ছেলে। দেখতেও সুদর্শন।
সায়ন জানাল ছেলে হিসেবে ছেলেটা ভালো। সবদিক দিয়ে শখের সঙ্গে যায়। এত এত কথার মধ্যে শীতল হঠাৎ নক কাটতে কাটতে শুদ্ধর দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
-‘সবার আগে আপনি আপনার মত জানান কারণ বন্ধুটা কিন্তু আপনার। সে ভালো হলেও আপনার বন্ধু নেশাখোর হলেও। তবে দুজনই যদি এক ঘাটের মাঝি হোন তাহলে আমরা মেয়ে দিবো কি না সেটা ভেবে দেখব।’
শুদ্ধ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল তার থেকে তিন হাত দূরত্বে সোফার হাতলে বসা শীতলের দিকে। শীতল ভেবেছিল ধমক দেবে কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে শুদ্ধ বলল,
-‘একসাথে চলি। একই পেশায় আছি। যথেষ্ট লয়্যাল। বন্ধু হিসেবে যেমন বেস্ট বোন জামাই হিসেবেও বেস্ট হবে, ইনশাআল্লাহ। ‘

শীতল মজা করলেও শুদ্ধ তার কথাকে সন্মান করে সুন্দর ভাবে জবাব দিলো। কেননা মা-চাচীদের মতো সেও এখন চৌধুরী বাড়ির বউ। তার মত বা সিধান্তকে সন্মান জানাতে হবে। স্বামী যদি বউকে সন্মান না করে তাহলে অন্যরাও করবে না। শুদ্ধর মনোভাব বুঝে চৌধুরী গিন্নিরা একে অপরকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। খুশিও হলো। তারপর শুদ্ধ একবার শীতলের দিকে তাকিয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেল। এ তাকানোর মানে বুঝে শীতলও সুযোগ বুঝে হাঁটা ধরল রুমের দিকে। একমাত্র বর বলে কথা তার ডাক কি অমান্য করা সাজে?

এরপরের সময়টা যেন দ্রুত’ই কেটে গেল। সন্ধ্যার পর কামরান, স্যান্ডি, হাসান, অর্ক ও তার বাবা- মা এলো। একেক জনের একেক কাহিনিতে হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে গেল। মেয়ে দেখা নিয়ে বাড়াবাড়ি কোনো
আয়োজন করা হয় নি। হঠাৎ বেড়াতে এলে যেমন গল্প আড্ডা হয় ঠিক তেমন। এতে শখ কিছুটা হলেও স্বস্তি পেলো। না চাইতেও অর্কের সাথে দু’একবার চোখাচোখি হলো। দুই পরিবারের উপস্থিতিতে রিং আর চেইন পড়ানো হলো। অর্কের মা খুব করে ধরলেন শুদ্ধদের সঙ্গে শখ-অর্কের অনুষ্ঠানটাও সেরে ফেলার জন্য। জোর গলায় বললেন, উনাদের কোনো দাবী নেই। বরযাত্রী বিশ জনের বেশি আসবে না। উনারা সামনের মাসে চলে যাবে তাই এই তাড়াহুড়ো। তাছাড়া অর্ককে একা রেখে গেলে উনি চিন্তায় থাকবে শখ থাকলে আর কোনো চিন্তায় থাকবে না। অগত্যা দুই পরিবার মিলে রাজি হয়ে গেল। উনাদের কথার মাঝে সবাই হইহই করে ছাদে গেল। উদ্দেশ্যে হলো অর্ক আর শখকে সুযোগ করে দেওয়া। তবে সবাই গেলে তো হবে না তাই দোতলা অবধি গিয়ে বাকিরা ঢুকল শুদ্ধর রুমে। অর্কও ঢুকতে গেণে শীতল তখন শখ হাত ধরে সিঁড়ির দিকে যেতে যেতে বলল,

-‘ভাইয়া আপনি আমার সাথে ছাদে আসুন আজ আমাদের বাড়ির চাঁদ দেখাবেন। সবচেয়ে সুন্দর চাঁদ। দেখলে মন প্রাণ সব জুড়িয়ে যাবে।’
অর্ক শীতলের কথার মানে বুঝে নিঃশব্দে হাসলে শখ গাঁট হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। অতঃপর তাদেরকে কথা বলার সুযোগ করে দিতে ছাদে পাঠিয়ে
শীতল সিঁড়ি দিয়ে হুরমুড় করে নামতে গিয়ে দেখল মাঝ সিঁড়িতে শুদ্ধ দাঁড়িয়ে আছে। যাক এসেছে তাহলে। ভয়ে আর একটু হলে জ্ঞান হারাত।
শুদ্ধকে দেখে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে শুদ্ধর বুকে মাথা রেখে জোরে জোরে হাঁপাতে লাগল। তার অবস্থা দেখে শুদ্ধ আর কিছু বলল না কারণ সেই পাঠিয়েছিল শখ- অর্ককে কথা বলার সুযোগ করে দিতে। তবে সাহসের জাহাজ ব্যাঙাচির ভীতু রুপ দেখে খোঁচা মারতে ভুলল না।

অতঃপর সময়টা যেন তাড়াতাড়ি কাটতে থাকল। হাতে গোটা দিন নাকি তাড়াতাড়ি কাটে। তিন জোড়া বিয়ের জন্য যতটা না ব্যস্ততা ছিল সেটা আরো দ্বিগুন হলো। তিন ভাই ও বাবা-চাচারা মিলে পূর্বের আয়োজনের পরিকল্পনা পরিবর্তন করল। পুরো চৌধুরী নিবাস ডেকোরেশনের জন্য লোকবল বাড়িয়ে দিলো। এতে কাজও এগোতে থাকল। বিয়ের কার্ডও বিলানো শেষ। বাড়ির মেয়েদের বিয়ের পোশাক নিয়ে বাড়তি ঝামেলায় পড়তে হলো না। শুদ্ধ ফেমাস ডিজাইনার ডেকে মাপ অনুযায়ী সকলের ড্রেসকোড সিলেক্ট করে ফেলল। মজার ব্যাপার হচ্ছে, বরদের পছন্দের রং অনুযায়ী সিলেক্ট করা হয়েছে চার বউয়ের লেহেঙ্গা। আর বউদের পছন্দকে প্রাধান্য দিতে সিলেক্ট করা হয়েছে বরদের বিয়ের শেরওয়ানি।

আজ ১২ ই নভেম্বর। দেখতে দেখতে কেটে গেছে মাঝখানে কয়েকটা দিন। আগামীকাল চার দম্পত্তির গায়ে হলুদ আর তার পরেরদিন বিয়ে। আয়োজনের কাজ প্রায় শেষ। চৌধুরী নিবাস সেজেছে অন্য রুপে। কী সুন্দর দেখাচ্ছে বাড়িটি। আজ বিকাল থেকেই আত্মীয়তা আসতে শুরু করবে। বিয়ের আয়োজন দেখতে নিকট আত্মীয়রা এমনিতেই আসে।
অন্তরে বিষ রেখে কথায় মধু মিশিয়ে স্বর্ণ শীতলের সৌভাগ্যের প্রশংসা করে। বাড়ির সকলে সব শুনে তবে বাইরের কারো কথা পাত্তা দেয় না।

এখন বাজে বিকাল চারটা। ড্রয়িংরুমের সোফায় চার হাত-পা ছড়িয়ে টিভিতে সিরিয়াল দেখছে শীতল। পাকিস্তানি এ সিরিয়ালটা খুবই ভালো লাগে তার। বিশেষ করে সিরিয়ালের নায়কের গেঁজ দাঁতটা খুব বেশিই পছন্দ। হিরো যখন কথা বলে বা রোমান্স করে সেও মিটিমিটি হাসে। টিভিতে চুপ চুপ করে একবার দেখে আবার সেই পর্বটাই ফোনেও দেখে। টেনে টেনে রোমান্সটুকুই দেখে। এটা হচ্ছে গোপন তথ্য যদিও জানে না কেউ। এই যে এই সময় ড্রয়িংরুমে কেউ থাকে না দেখে সে সিরিয়ালটা দেখছিল। কিছুক্ষণ আগে ঘেমে নেয়ে এত এত কেনাকাটা করে যে শুদ্ধ বাসায় ফিরেছে দেখেছেও তবুও উঠে নি। শেষ করেই উঠবে ভেবে ঘাঁট হয়ে বসে আছে। তাকে টিভি দেখতে দেখে সিমিন শুদ্ধর খাবার গুছিয়ে রুমে চলে গেলেন।শখ দুপুরে খেয়ে এতক্ষণ নিজের রুমে বসে পড়ছিল। একটানা অনেকক্ষণ পড়ায় মাথা কেমন ঝিমঝিম করছিল বিধায় এসে বসল। এককাপ চা খেলে মন্দ হয় না ভেবে উঠতে গেলে সিরাত হুড়মুড় করে এসে একঝুড়ি ফল তাদের খেতে দিলো। অর্করা অনেক ফল মিষ্টি এনেছিল সেদিন, এখনো আছে। এত ফল না খেলে তো নষ্ট হয়ে যাবে।

শীতল কি ভেবে যেন শখকে আড়চোখে একবার দেখে টিভির দিকে তাকাল। তারপর টিভির রিমোট দাঁতে ঠুকতে ঠুঁকতে আফসোসের সুরে বলল,
-‘বুঝলে আপু তোমার ভাইকে বিয়ে করে লস খেয়ে গেলাম।’
শখ থোকা থেকে আঙুল ছিঁড়ে পানিভর্তে বোলে রাখতে রাখতে বলল,
-‘কেমন লস?’
-‘অন্য কাউকে বিয়ে করলে আমার একটা শখ পূরণ হতো। কিন্তু তোমার
ভাইকে বিয়ে করে সেই শখটা জীবনেও পূরণ হবে না।’
-‘কি শখ শুনি? দরকার হলে আমি ভাইয়াকে বলব কষ্ট করে হলেও যেন তোর শখ পূরণ করে। তা বলতো শুনি কি শখ তোর?’

শীতল ফলের ঝুড়ি থেকে বড়সড় আঙুরের থেকে তুলে নিলো। মুখের উপর থোকাটা ঝুলিয়ে বলল,
-‘তোমার ভাই ভালো মানুষ হলে বাসর রাতে আমি এভাবে শুয়ে আঙুর খেতাম। আর ডিজে গান ছেড়ে দিয়ে তোমার ভাইকে বলতাম নাচ শালা নাচ, নেচে আমার মুড ঠিক কর।’
শীতলের কথা শেষ হতেই শখ বিষ্ময় নিয়ে তাকাল। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে নিচু স্বরে বলল,
-‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন।’
তাকে হঠাৎ বিরবির করতে দেখে শীতল পা নাচাতে নাচাতে বলল,
-‘পাগল হলে নাকি আপু? কেউ না মরতেই কিসব বলছো? আগে মরতে তো দাও।’
শখ কিছু বলল না। একবার শীতলের দিকে তাকিয়ে পুনরায় ডাইনিং টেবিলের দিকে তাকাল। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে শীতলও ডায়নিং টেবিলের দিকে তাকাতেই দেখল শুদ্ধ খাবার খাচ্ছে। শান্ত ধীরে গতিতে খাবার চিবাতে চিবাতে তার দিকে ঠান্ডা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তাদের
অবস্থা দেখে শখ আস্তে করে কেটে পড়ল। আশেপাশে কেউ নেই দেখে
শুদ্ধ বলল,

-‘ওহ হ্যালো এদিকে আসুন।’
শীতল গেল। তাকে পাশে বসতে ইশারা করলে বসল। মার খাওয়ার ভয়ে আগেভাবে সরি বলল। শুদ্ধ জবাব না দিয়ে ভাতের লোকমা শীতলের মুখের সামনে তুলে ধরল। শীতল বলল,
-‘খেয়েছি আমি।’
-‘আমি দেখি নি।’
-‘ আপনি আজকাল বেশি বেশি করে খাইয়ে কেমন কুমড়ো পটাশ করে ফেলছেন।’
-‘ বেশ করছি। হাঁড়গিলে টাইপ স্লিম বউ লাগবে না আমার, জড়িয়ে ধরে শান্তি নেই। আমার দরকার গলুমলু বউ। এখন যেমন আছেন একদম পার্ফেক্ট।’

বিশাল বহুল এক ফ্ল্যাটের বদ্ধরুমে হাঁটু ভেঙে ‘দ ‘ভঙ্গিতে বসে আছে ইয়াসির। এলোমেলো পরনের বেশভূষা। তার সামনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নামী-দামি ব্রান্ডের ফাঁকা কাঁচের বোতল। রুমজুড়ে ভ্যাপসা গন্ধ।
টিভি চলছে। টিভিতে ব্রেকিং নিউজে দেখা যাচ্ছে পুলিশ তার ডেরায় হানা দিয়েছে। খুঁজে পাচ্ছে অবৈধ টাকার পাহাড়, অস্ত্র, মাদকদ্রব্য সহ
কঙ্কালসাড় মৃত/জীবিত মানুষের লাশ। এত কষ্টের গড়া পাপের রাজ্য ধূলিসাৎ হয়ে যাচ্ছে দেখে তার কি কষ্ট পাওয়া উচিত? যে টাকার জন্য নিজের বন্ধুকেও এককালে শেষ করেছিল আজ সেসব অন্যদের দখলে। সেও জীবনভর আত্মসাৎ করতে পারল না। পারল না বললেও ভুল হবে বলা বাহুল্য করল না। কারণ সে নিজে পুলিশকে খোঁজ দিয়েছে। একটা সময় ভাবত, এ পৃথিবীতে টাকায় সব। টাকায় মানুষের জীবনের সকল অপূর্নতা পূরণ করে দেয়। সুখ থাকা টাকায়। যার টাকা আছে সেই হচ্ছে রাজা। নিজেকে রাজার হালে নিতে গিয়ে বিবেকের ধার ধরে নি কখনো।

পাপ পূর্ন্যের হিসাব কষে নি। কেন কষবে? টাকায় তার পকেট গরম যা মন চেয়েছে করেছে। শরীরে টান পড়লে টাকা ছিঁটালে কত মেয়ে। দেশ বিদেশ যখন যা নজরে এসেছে দখলে রেখেছে। শুধু দখল করতে পারল না শীতলকে। ওই ছোট্ট পুঁচকে মেয়েটা তাকে গোঁ হারান হারিয়েছে। কত্ত জেদ ভাবা যায়? সে কেবল ছুঁয়েছে বলে তার ছোঁয়া মুছতে হসপিটালেই শুদ্ধর নামে কবুল পড়েছে। যাতে তার জীবনের কোথায় ইয়াসির নামের ছায়াটাও না থাকে। সবাই তাকে বলে মাফিয়া, পাষাণ, নিষ্ঠুর তাহলে এ মেয়ে কি? সে তো বুলেট না ছুঁড়েও তাকে রক্তাক্ত করে ফেলেছে।

এমন ভাবে তাকে ভেঙেছে শিরদাঁড়া তুলে উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতাটুকুও নেই। এসব ভেবে সে সোফায় মাথা এড়িয়ে দিলো। সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল। একহাত বাড়িয়ে সেন্টার টেবিলের উপর থেকে ফ্রেম হাতে তুলে নিলো। ফ্রেমটিতে দুটো ছবি রাখার কেস রয়েছে। ডান পাশের কেসে তার মায়ের ছবি আর আরেকটাতে শীতলের। নেশা করে চোখে ঝাপসা দেখছে। অনেকদিন পর মায়ের ছবিতে হাত বুলিয়ে থম মেরে রইল। মা মরার পর আর কবে কেঁদে মনে পড়ে না তবে শীতলের বিয়ের দিন কেঁদেছিল। হাউমাউ করে অসহায় সুরে কেঁদেছিল। কাউকে আঁকড়ে ধরে কাঁদার মানুষটা তার জীবনে কখনো ছিল না। আজও নেই।
সে এবার শীতলের ছবির দিকে তাকাল। হাসল। তারপর বিরবির করে বলল,

-‘শখের পুরুষ খুন করলেও মাফ, তাই না বাবুই? যত দোষ সব আমাদের মতো হতভাগার। আমি মাফিয়া বলে রিজেক্ট করলে অথচ শুদ্ধর খুন করার দৃশ্য দেখেও তুমি নিশ্চুপ। ন্যায়-অন্যায়ের সাজা কি আমাদেরই প্রাপ্য, হুম?’
একথা বলে ইয়াসির থেমে গেল। মনে পড়ল শীতলের সঙ্গে তার পুনরায় কথা বলার মুহূর্তটুকু। ইগরকে মারার ভিডিও শীতলকে পাঠিয়েছিল সে।
ভিডিওটা এমনভাবে করা যেন শুদ্ধই ইগরকে মেরেছে কিন্তু শীতল দেখে কিয়ৎকাল চুপ ছিল। দেড় ঘন্টা পর তাকে হতবাক করে দিয়ে মেসেজ করেছে, ‘মাঝে মাঝে নিজের ভালোর জন্য দুু’একটা জঞ্জাল সরানো খুব দোষের কিছু না।’

একথা শুনে কে বলবে এভ মেয়েটাই চৌধুরীদের ছোটো কন্যা? ওই মিষ্টি মুখের মেয়েটা এত কঠিন কথাও বলতে পারে। কি অদ্ভুত! বয়সে ছোটো মেয়েটা তাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বার বার বুঝিয়ে দিচ্ছে , ভালোবাসা মানে কখনো অধিকার দেখিয়ে জিতে নেওয়া কখনো ভালোবাসার তীব্র তাগিদে অনেককিছু জেনেও না জানা; না দেখা। সে হাসল। বড্ড লোভ হলো পাজি মেয়েটা কেন যে তাকে একফোঁটা ভালোবাসা ভিক্ষা দিলো না। না দেওয়াতে আজকে নেশায় টাল হয়ে মায়ের কাছে অভিযোগের পসরা খুলে বসল। মায়ের ছবিতে হাত বুলিয়ে কান্নাভেজা সুরে বলল,
_’পৃথিবীতে পাপীদের কোনো মূল্য নেই, মম। সবাই মুখেই বলে পাপীকে নয় পাপকে ঘৃণা করো। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা পাপের থেকেও পাপীকে ঘৃণা করে। যে পাপ দিনে ঘৃণা করে সেই পাপের টাকায় রাতে ভাগাভাগি করে। ভাগে কম পড়লে খুনাখুনিও হয়ে যায়। আমার দোষ আমি পাপী।

পাপীর তকমা গায়ে লেপ্টানোর কারণে আমার নাকি ভালোবাসতে নেই। ভালোবাসার মানুষ চাইতে নেই। আমার জন্য ভালোবাসা নিষিদ্ধ। চাওয়া-পাওয়া নিষিদ্ধ। কিন্তু ভিলেনকে তো আর কেউ আগ বাড়িয়ে ভালোবাসা না। পেতে চায় না। পূর্নতার যুদ্ধ ঘোষণা করে লড়াইতে নামে না। অথচ ভিলেনরাও হারাতে হারাতে ক্লান্ত এটা কেউ দেখে না। বুঝে না, ভিলেনদের জীবনে আচমকা মধুমাস আসতে পারে। আর আসাটা কি অন্যায়, বলো? ভিলেনেরও তো মন থাকে। মন বলে প্রিয় বলে কাউকে ডাকতে। পাশে রাখতে। বুকে আগলে রাখতে। কিন্তু নিষ্ঠুর প্রিয়রাও ওই পাপের দোহায় দিয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয়। মুখ ফেরানো প্রিয়কে যখন নিজের কাছে রাখতে উঠে পড়ে লাগে তখন আমাদের নাম রচিত হয় ভিলেন নামে। এ সমাজ; সমাজের মানুষগুলো শুধু পারেই আঙুল তুলে তীরবিদ্ধ করতে পারে। এতে রক্ত ঝরলো নাকি পুরনো দগদগে ঘাঁ পুনরায় দগদগে হলো কেউ দেখে না; কেউ না।’

এটুকু বলে ইয়াসির থেমে গেল। চোখের পাতা দুটো ভারি হয়ে বুজে আসছে। নেশার তালে মায়ের কাছেও ঠিকঠাক ভাবে অভিযোগ করতে পারল না। অথচ বুকের ভেতর অসহ্য ব্যথায় জর্জরিত। সে সোফা থেকে মাথা তুলে উঠতে গিয়ে পা হড়কে নিচে পড়ল। ব্যথাও পেল ভীষণ। তবে আর উঠার চেষ্টা করল না হাত পা ছড়িয়ে মেঝেতেই শুয়ে রইল। একটু পর বিরবির করে তার ভীষণ পছন্দের একটা গানের লিরিক্স আওড়াল,

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৬৭

“One day I’m gonna fly away”
“One day when heaven calls my name”
“I lay down I close my eyes at night”
“I can see morning light”

শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৬৯

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here