শেষ বিকেলের প্রণয় পর্ব ১২

শেষ বিকেলের প্রণয় পর্ব ১২
হালিমা চৌধুরী

নিস্তব্ধ রাত, ঘড়িতে তখন সময় ১ টা ছুঁইছুঁই। ফারিশ চোখ মেলে এলোমেলো হাতে টি-টেবিলের উপর পানি খুঁজে, কিন্তু সে পানির নাগাল পায় না। তাই ফারিশ ফোনের লাইট অন করে দেখে টি-টেবিলের উপর পানি নেই। হঠাৎ ফারিশের মনে হলো একটা মেয়ে তার দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়েছে, মেয়েটার মুখটা দেখতে পায় না সে, কেমন ঝাপসা হয়ে আছে সবকিছু।

“নিধি।”
বলেই ফারিশ মেয়েটাকে ছুঁতে চায়, কিন্তু তার আগেই মেয়েটা হারিয়ে যায়। সবটাই নিজের কল্পনা ভেবে ফারিশ কেঁদে ফেলল। এতোদিন শুধু নিধি তাকে একপাক্ষিক ভালোবেসে গেছে, এখন যখন সে নিধির প্রতি দূর্বল হয়ে পড়ল আস্তে আস্তে, তখন নিধি মুখ ফিরিয়ে নিলো। নিজের প্রতি প্রচন্ড রাগ হয় ফারিশের, কেনো সে নিধিকে অবহেলা করেছে। কেনো সে সবসময় তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতো! যখন নিধি দূরে সরে গেলো তার থেকে, তখন সে বুঝতে পারলো সে নিধিকে কতটা চায়!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এই তো কিছুদিন আগে ফারিশের জ্বর হওয়াতে নিধি নাওয়াখাওয়া ভুলে দিনরাত জেগে ফারিশের সেবা করেছে। সে সুস্থ হওয়া পর্যন্ত তার কাছ থেকে একটু দূরে পর্যন্ত যায়নি। অথচ এখন ফারিশ অসুস্থ হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে, তাকে দেখার মত একজন মানুষ তার নেই! না আছে তার নিধি, আর না আছে তার দাদা দাদি। আজকে নিজেকে প্রচুর অসহায় মনে হচ্ছে ফারিশের। সে এলোমেলো পায়ে হেটে গাড়ির চাবি নিয়ে বের হয়ে গেলে পিয়াশদের বাড়ির উদ্দেশ্যে, হঠাৎ করে নিধিকে দেখার প্রচুর ইচ্ছে জেগেছে ফারিশের। জ্বরে চোখ খুলে রাখতে কষ্ট হচ্ছে তার, তবুও সে অসুস্থ শরীর নিয়ে বেরিয়ে পড়লো নিধি কে এক নজর দেখার জন্য।

দিনটা সোমবার, বাহিরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। পিয়াশ সকাল সকাল উঠে রেডি হয়ে অফিসের জন্য বের হয়ে যায়। বাসায় শুধু নিধি আর ইকরা। নিধি সোফায় বসে বসে ফারিশের কথায় ভাবছে, আজ থেকে ঠিক তিনদিন আগে ফারিশের সাথে তার শেষ দেখা হয়েছে। আজ তিন দিন হলো, ফারিশ নিধির একটু খোঁজ নেওয়ারও চেষ্টা করেনি। পরে নিধির মনে পড়লো, সে তো সিমই চেইঞ্জ করে ফেলেছে। খবর নিবেই বা কিভাবে। আজকে হঠাৎ করে ফারিশের জন্য নিধির খারাপ লাগছে। মনে হচ্ছে ফারিশ ঠিক নেই, সেই নিয়েই সকাল থেকে চটপট করছে সে। কিন্তু কাউকে কিছু বলতে পারছে না। কারণ সেই তো ফারিশকে ফিরিয়ে দিয়েছিলো সেদিন। এসব ভেবেই মন খারাপ নিধির। ইকরা রান্নাঘর থেকে এসে নিধির পাশে বসে। সে নিধির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,

“কি হয়েছে রে নিধু?”
“কিছু ভালো লাগছে না আমার।”
নিধির বিরস মুখে বলা কথা শুনে ইকরা তাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“জিজুর জন্য মন খারাপ নাকি? তার কথা মনে পড়ছে?”
ইকরা কথার জবাব দেয় না নিধি, সে চুপচাপ বসে আছে। ইকরা তার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে আবারো বলল,
“তুই শুধু শুধু দুলাভাই কে ভুল বুঝছিস! উনি একটু রাগী, কিন্তু মনটা ভিষণ ভালো। তুই হয়তো দুলাভাই কে এখনো ভালো করে বুঝতে পারিস নি।”

“আমি উনার সঙ্গে সংসার করেছি ইকরা, উনাকে আমি বুঝতে পারবো না কেনো? তুই জানিস, উনি অয়নের কথা শুনে আমাকে চ’ড় দিয়েছে, তাও আবার আমি সবকিছু বলার পরে। সে জায়গায় আমি তো তেমন কোনো রিয়েক্টই করিনি।”
“তুই যাই বলিস না কেনো, তোর ভাইয়ার সাথে কথা বলা উচিত। একজন আরেকজনকে বুঝতে পারাটা হলো আসল ভালোবাসা। জানিস, এখন না বিচ্ছেদ জিনিস টা সম্পর্কে সচরাচর হচ্ছে। বিচ্ছেদের থেকে ভালো, তুই তাকে বুঝে সবকিছু ঠিক করে নেওয়া।”

নিধি ইকরার কাঁধে হাত দিয়ে বলল,
“ছোটকাল থেকে বাবার রাজকন্যা হয়ে বড় হয়েছিস তুই, বিয়ের পর বরের রাজরানী তুই। আমার ছোট থেকে কষ্ট করে বেড়ে উঠার ব্যপারটা অন্তত তুই বুঝতে পারবি না। একটুখানি সুখের আশায় আমি কি না করেছি বল তো! ফারিশ নামক পাথর মনের মানুষটার মন পেতে চেয়েছি। সৎ মায়ের ভালোবাসা পেতে চেয়েছি। এ যেনো অলীক কল্পনা আমার! যেটা পাওয়ার নয় সেই জিনিসটাই কেনো যে সবসময় আমি পেতে চাই কে জানে! জিনিসটা তাদের হবে না জেনেও মানুষ সেই জিনিসটার উপরেই বেশি আকৃষ্ট হয়।”

নিধির কথা শুনে ইকরা বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, আসলেই তার কিছু বলার নেই। ছোট কাল থেকে ইকরা আর নিধির বন্ধুত্ব। কখনো নিধির মুখ থেকে তার মায়ের অত্যাচার ছাড়া ভালো কোনো কথা শুনেনি। মেয়েটা কতটা কষ্ট করে বড় হয়েছে সেটা ইকরা খুব ভালো করেই জানে।
“সকাল থেকে কি বৃষ্টি হচ্ছে, ওয়েদারটা জোস কিন্তু। ইচ্ছে করছে শাড়ি পরতে।”
ইকরার কথা শুনে নিধি তার দিকে ভ্রু কুঁচকে বলল,

“তোর মনে রঙ লেগেছে নাকি?”
নিধির কথা শুনে ইকরা কিছুটা মন খারাপ করে বলল,
“এমনি ইচ্ছে করছে, তোর ভাইটা থাকলে হতো। শাড়ি পরা অবস্থায় আমাকে দেখলে অনেক খুশি হতো।”
ইকরার কথা শুনে নিধি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সে ও ভেবেছে তার একটা সুখের সংসার হবে। তার একজন নিজের মানুষ থাকবে, যে তাকে কেয়ার করবে, ভালোবাসবে। তার একান্ত মানুষটাকে নিয়ে তার পছন্দের জায়গা পাহাড়ে হারিয়ে যাবে। কিন্তু তার কিছুই হলো না, মানুষ আসলে খুব করে যা চায়, তা কখনো পায় না।

পিয়াশ অফিসে এসে পৌঁছাতে না পৌঁছাতে হতভম্ব হয়ে গেলো! সবাই নিজের কাজ রেখে একজন আরেকজনের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। কেউ ফোন টিপছে, তো কেউ গল্প করছে। পিয়াশ একজন কর্মচারী কে ডেকে বলল,
“সবাই কাজ না করে এভাবে গল্পে মেতে আছে কেনো? স্যার দেখলে তো সবাইকে চাকরি থেকে বের করে দিবে।”
পিয়াশের কথা শুনে কর্মচারী টি ফিসফিস করে বলল,

“আরে স্যার আজকে আসেনি, তাই সবাই কাজ না করে গল্প করছে। এদেরকে বলার পরও ঠিক হয়নি। এদেরকে স্যারই ঠিক করতে পারবে!”
“স্যার আসেনি কেনো?”
“তা তো আমি জানি না।”
“আচ্ছা তুমি যাও আমি দেখছি।”

পিয়াশের কথা শুনে কর্মচারীটি চলে যায়, ফারিশ ফোন বের করে ফারিশের ফোনে কল দেয়, কিন্তু তার ফোন বন্ধ। পিয়াশ এবার বেশ চিন্তায় পড়ে যায়, ফারিশ কখনো অফিস মিস দেয় না, অযথা নাম্বারও বন্ধ করে রাখে না। তাই পিয়াশ ফারিশের একজন ক্লোজ ফ্রেন্ড কে কল দেয়। কল রিসিভ করতেই পিয়াশ চিন্তিত গলায় বলল,
“সাকিফ, স্যারের কি হয়েছে? অফিসে আসেনি কেনো?”
পিয়াশের কথা শুনে সাকিফ ব্যথিত গলায় বললো,

“ফারিশ এক্সিডেন্ট করেছে!”
সাকিফের কথা শুনে পিয়াশ হতভম্ব হয়ে যায়!
“কি বলছো কি! কিভাবে হলো এসব?”
“ফারিশের প্রচন্ড জ্বর ছিল কালকে, নিজের খেয়াল একটুও রাখেনি সে। তার ওয়াইফও তো বাড়িতে নেই, দাদা দাদি ও বাড়িতে নেই। রাতে আবার জ্বরের ঘোরে সে তার বউকে আনতে যায় তাদের বাড়িতে, সেখানে যাওয়ার সময়ই সে এক্সিডেন্ট করে। দূর্বল শরীর নিয়ে ড্রাইভ করেছে, হঠাৎ একটা ট্রাক সামনে চলে আসাতে ও ঠিক সামলে নিতে পারেনি, তাই অনেক আঘাত পেয়েছে ও।”
পিয়াশ আর কোনো কথা বলতে পারল না, সে তাড়াহুড়ো করে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।

কলিংবেলের আওয়াজ শুনে নিধি এসে দরজা খুলে দেয়। দরজার অপর পাশে পিয়াশকে চিন্তিত মুখে দাড়িয়ে থাকতে দেখে নিধি বেশ অবাক হয়ে যায়।
“কি হয়েছে ভাইয়া? এই সময় অফিসে না গিয়ে বাড়িতে কেনো?”
নিধির কথা শুনে পিয়াশ বেশ কঠিন গলায় বলল,

“আমার স্যারের মত মানুষ হয় না নিধি, আর তুমি তাকে কষ্ট দিয়েছো! লোকটা জ্বরের মধ্যে শুধুমাত্র তোমাকে একনজর দেখার জন্য মাঝরাতে ছুটে এসেছিল! তার পরিণাম কি হয়েছে জানো? তোমার বর এখন হাসপাতালের বেডে পড়ে আছে! শুধুমাত্র তোমাকে দেখার জন্য স্যার এতোরাতে অসুস্থ শরীর নিয়ে ড্রাইভ করছিল, কিন্তু সে আর বাসায় এসে পৌঁছাতে পারেনি! তুমি এখনো মুখ ফিরিয়ে রাখো তার থেকে! কিছু বলব না আমি।”

শেষ বিকেলের প্রণয় পর্ব ১১

পিয়াশের কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে আছে নিধি! নিধির ঠিক কি করা উচিত এই অবস্থায় সেটা সে ভুলে গেছে। সে দৌঁড়ে বাসা থেকে বের হয়ে যায়। পিয়াশ আর ইকরাও নিধির পিছন পিছন যায়।

শেষ বিকেলের প্রণয় পর্ব ১৩

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here