শেষ বিকেলের প্রণয় পর্ব ৫

শেষ বিকেলের প্রণয় পর্ব ৫
হালিমা চৌধুরী

দুশ্চিন্তায় প্রবল পীড়ায় পিষ্ট হয়ে আছে নিধির অবুঝ মন। অয়ন যে তার সংসারে ঝামেলা তৈরি করার জন্য এসব করছে সেটা বুঝতে আর বাকি রইলো না নিধির।
“এখনো ঘুমাচ্ছো না কেনো? আমাদের বাড়িতে আবার চো’র টো’র আসে না যে তোমাকে রাত জেগে পাহারা দিতে হবে।”

তড়াক করে বাঁ পাশটায় ইতস্তত নজরে তাকালো নিধি। ফারিশকে তার পাশে দেখে কিছুটা অবাক হয় সে। নিধি ফারিশের কথাকে তোয়াক্কা না করে মুখ ফিরিয়ে নিজের গায়ের ওড়না ঠিক করতে করতে বলে,
“আপনি জেগে আছেন কেনো?”
নিধির পাল্টা প্রশ্ন শুনে ফারিশ নিধির দিকে অবাক চোখে চেয়ে বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“দিন দিন তুমি মুখে মুখে অনেক তর্ক করছো! তুমি কি ইচ্ছে করে আমার মধ্যে থাকা হিংস্র রুপটাকে জাগিয়ে তুলতে চাও নাকি? আমি তো তোমার সাথে শান্ত ভাবে কথা বলতে চাই!”
ফারিশের কথা শুনে নিধি মুখ ভেঙচিয়ে বলে,
“আপনি শান্ত ভাবে কথা বলেনই বা কখন? যখনই কথা বলেন মনে হয় পাশের বাসায় ঝগড়া লেগেছে, এতো জোরে জোরে হম্বিতম্বি করেন আপনি!”

নিধির কথা শুনে ফারিশ হাসবে নাকি রাগ করবে বুঝতে পারলো না। সে নাকি শান্ত ভাবে কথা বলতে পারে না! ফারিশ রুষ্ট হয়ে বলল,
“আমার সাথে ভালো ভাবে চলবে তো ভালো ব্যবহার পাবে! বাঁকা ভাবে চলতে গেলে এর পরিণাম খুব খারাপ হবে বলে দিলাম। তোমার সাথে ভালো ভাবে কথা বলেছি বলে ভেবো না, তোমার সব ভুল আমি ফুল ভেবে ক্ষমা করে দিবো!”

ফারিশের কথা শুনে নিধি তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে,
“সবাই শুধু আমার উপরে অকারণেই চেঁচামেচি করে। কেউ আমাকে বুঝতে চেষ্টা করে না। আমাকে বুঝতো শুধু অয়নই, কখন আমার মন খারাপ, কি করলে আমার মন ভালো হবে সবদিকে খেয়াল রাখতো সে। আফসোস…. ”
নিধির পুরো কথা শেষ হওয়ার আগেই ফারিশ হুঙ্কার দিয়ে বলে,

“বাহিরের লোকের কথা আমাকে বলো না, আমি আর দশজন ছেড়ে যাওয়া মানুষের মত আলগা দরদ দেখাতে পারবো না। নেক্সট টাইম যদি ওই ছেলের কথা তোমার মুখে শুনি আমি তাহলে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না নিধি! আমাকে রাগিয়ে দিও না তুমি! অয়ন যখন তোমাকে এতোই ভালোবাসতো, কেয়ার করতো তাহলে ছেড়ে গিয়েছে কেনো?”
ফারিশের কথা শুনে চুপসে যায় নিধি, নিজের কথার জালে নিজেই জড়িয়ে গেছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে নিধি নিভু সুরে বলে,

“সবকিছু সবার ভাগ্য থাকে না, বাদ দিন। কোথায় ঘুমাবো? কালকে নাকি আপনি আমার জন্য ঘুমাতে পারেননি, আমি কি অন্য রুমে কি ঘুমাবো?”
“বিয়ে করেছি কি অন্য রুমে ঘুমানোর জন্য নাকি? এতো বড় একটা বিছানা রয়েছে রুমে, দুজন দুইপাশে ঘুমালেই হবে। মাঝখানে কোল বালিশ দিয়ে দিবো।”
নিধি বিস্মিত হয়ে বলল,

“আপনি মানুষ একজন, কিন্তু এতরকমের কথা কিভাবে বলেন একমুখে? আমি আপনাকে যত দেখছি ততোই যেনো নতুন করে চিনছি!”
ফারিশ দীর্ঘশ্বাস ফেলল, আজ পর্যন্ত কেউ তাকে বুঝতে পারেনি। সবাই শুধু তার বাহিরের রাগারাগি টুকুই দেখেছে, ভিতরে যে তার একটা কোমলপ্রাণ রয়েছে সেটা কেউই বুঝতে চেষ্টা করে না। এটা ভেবেই আফসোস ফারিশের, সে খুব করে একটু সুখে থাকতে চায়, পুরনো সবকিছু ভুলে মুভ অন করতে চায়, কিন্তু কেউ তাকে বুঝতে চেষ্টা করে না সে আসলে কি চায়!

“তর্ক কোরো না মেয়ে, যা বলেছি তাই করো।”
ফারিশের কথা শুনে নিধি আর দাঁড়িয়ে থাকে না বেলকনিতে, সে রুমে এসে বিছানায় দুইপাশে সমান জায়গা রেখে কোলবালিশ মাঝখানে দিয়ে দেয়। ফারিশ রুমে এসে অবাক হয়ে যায়, ফারিশ একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে বলল,
“কত ডিস্টেন্স মেইনটেইন করে বিছানা তৈরি করেছে এই মেয়ে!”

নিধি কিছু বলে না ফারিশের কথা শুনে, অপরিবর্তিত কঠোর মুখাবয়ব দেখে ভয় পেয়ে যায় সে। চোখ বুজে লম্বিত শ্বাস ফেলল নিধি। মাঝে মাঝে নেওয়া কিছু সিদ্ধান্ত জীবনকে কোথায় নিয়ে যায় মানুষের। এইযে, ফারিশের আগে আরো পাত্রপক্ষ তাকে দেখতে এসেছে, অথচ সে সব পাত্রপক্ষ কে বিনা কারণে নাকচ করে দিয়েছে। ফারিশের বেলায় নিধি আর কোনো অজুহাত দিতে পারেনি। তার মা এক প্রকার জোর করেই বিয়ের কথা পাকাপোক্ত করে ফেলে ফারিশের পরিবারের সাথে।

“ভাবনার জগতে হারিয়ে গেছে ভাবনা কুমারী!”
ফারিশের কথা শুনে হুশ ফিরে নিধির, ফারিশের খোঁচা দিয়ে কথা শুনে মাঝেমধ্যে হেসে ফেলে সে।
“হয়েছে, এবার লাইটটা একটু অফ করে দাও, একটু ঘুমাই। অনেকদিন শান্তিতে ঘুমাতে পারি না।”
বলেই ফারিশ বিছানায় গা এলিয়ে দেয়, নিধিও বাধ্য মেয়ের মত উঠে গিয়ে লাইট অফ করে দিয়ে এসে শুয়ে পড়ে।

সকালের স্নিগ্ধ নরম আলো চোখে পড়তেই ঘুম ভাঙে নিধির। সে উঠে ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরে যায় সবার জন্য ব্রেকফাস্ট তৈরি করার জন্য। ব্রেকফাস্ট তৈরি করে নিধি এক এক করে সব ডাইনিং টেবিলের উপর এনে সাজিয়ে রাখে। হঠাৎ নিধির নজরে আসে সোফায় বসে থাকা অয়নের দিকে। অয়ন কে দেখে নিধি কিছুটা ভয় পেয়ে না, না জানি আবার কি গন্ডগোল করতে এসেছে অয়ন! নিধি কে অবাক করে দিয়ে অয়ন তার দিকে এগিয়ে আসে। নিধি ঘাবড়ে গেল, অয়ন ভ্রু উঁচিয়ে বলল,

“এতো ভয় পাওয়ার কি আছে জানে মান? আমি তো তোমার সেই ভালোবাসার অয়নই নাকি! এতো ভয় পেলে চলবে?”
নিধি আগের চেয়েও ইতস্তত, কপালে তার বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে।
“দেখুন, আপনি এখানে কোনো ঝামেলা করবেন না। আপনি আমাকে ছেড়ে গিয়েছেন, আমি আপনাকে বাঁধা দিইনি, আপনি আপনার মত সুখে থেকেছেন। এখন আমাকে একটু ভালো থাকতে দিন প্লিজ!”
রিধির কথা শুনে অয়ন হো হো করে হাসতে হাসতে বলে,
“তুমি থেকে এখন আপনি হয়ে গেলাম আমি?”

ভয়ে নিধির চোখ ছলছল করে উঠল, কে না কে দেখে ফেলে সে ভয়ে। ফারিশ দেখলে তো তার আর রক্ষে নেই।
“আরে অয়ন যে, কখন এসেছো তুমি?”
হঠাৎ রাহাত শিকদারের কথা শুনে ভড়কে যায় নিধি, পরক্ষণে বুঝতে পারলো পরিস্থিতি স্বাভাবিকই আছে। নিধি যেনো হাঁপ ছেড়ে বাচলো।

“অফিসের একটা কাজ ছিল দাদু, ফারিশের সাথে একসাথে বেরিয়ে যাবো সেজন্যই এসেছি।”
“আচ্ছা, এসেছো যখন নাস্তা করেই যেও। নিধি সবাইকে খাবার দাও তো।”
রাহাত শিকদার আর অয়ন গিয়ে চেয়ার টেনে বসেন, এরমধ্যে ফারুল বেগমও চলে আসেন। নিধি সবাইকে খাবার বেড়ে দিয়ে অয়নের পাশে যায় তাকে খাবার বেড়ে দিতে। খাবার দেওয়া শেষ করে নিধি চলে যেতেই অয়ন তার পা বাড়িয়ে দেয় নিধির দিকে। নিধি সেটা খেয়াল না করেই হেঁটে যেতে নিতেই পড়ে যেতে নেয়।

আচমকা একজোড়া হাত এসে নিধিকে আগলে নেয়। ভয়ে নিধি চোখ বন্ধ করে ফেলে, নিজেকে কারো বাহুবন্ধনে আবদ্ধ দেখে চোখ মেলে ফারিশ কে দেখে ভড়কে যায় সে। এদিকে ফারিশ এসে নিধিকে ধরে ফেলাতে অয়ন রক্তিম চোখে তাকিয়ে তাদের দেখছে। নিজের করা বোকামির জন্য নিজেরই আফসোস হচ্ছে তার। সে তো চেয়েছে নিধিকে ফারিশের কাছ থেকে দূরে সরাতে, তার ফাঁদ উল্টো ঘুরে নিধি আর ফারিশ আরো কাছাকাছি চলে এসেছে।
“আরে নিধি, দেখে চলবে তো। তোমার কোথাও লাগেনি তো?”

অয়নের দিকে রক্তিম চোখে তাকিয়ে শান্ত গলায় কথাটা বলে ফারিশ। এদিকে ফারিশের এতো শান্তশিষ্ট আচরণ নিধি যেনো ঠিক হজম করতে পারলো না। ফারিশ সেসবে পাত্তা না দিয়ে নিধিকে ধরে চেয়ারে বসিয়ে দেয়। ফারিশ নিজেও নিধির পাশের চেয়ার টেনে বসে। ফারিশ যত্নসহকারে নিধির প্লেটে খাবার বেড়ে দিতে দিতে বলে,
“খাবার খেয়ে ঔষধ খেয়ে নিও ব্যথার।”
ফারিশের একের পর এক চমক যেনো নিতেই পারছে না নিধি। একটু অন্যমনস্ক হয়েই ফারিশের কথায় সায় মিলায় সে।

“অয়ন তোর কোনো কাজ আছে নাকি রে?”
ফারিশের কথা শুনে হুশ আসে অয়নের, নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে অয়ন বলল,
“অফিসের একটা কাজের ব্যপারে কথা বলতে এসেছি, অফিস যাবি না তুই?”
“না রে, আজকে আর অফিসে যাবো না। তোর ভাবিকে নিয়ে একটু বাহিরে বের হবো, কিছু কেনাকাটা করার ছিল। আর আমি না তোকে বলেছি আমার কাজের ব্যপারে তুই আর কোনো কষ্ট না করতে। আমি আমার অফিসে অনেক কর্মচারী রেখেছি, তোর তো আর এক্সট্রা কষ্ট করার দরকার নেই নাকি!”

শেষ বিকেলের প্রণয় পর্ব ৪

ফারিশের কথা শুনে হেঁচকি উঠে যায় নিধির। ফারিশ তাড়াতাড়ি পানি ঢেলে নিধির মুখের সামনে ধরে। নিধি পানির গ্লাস নিয়ে ডগডগ করে পানি পান করে। ফারিশ নিধিকে আলতো ধমক দিয়ে বলে,
“তোমাকে কতবার বলেছি একটু সাবধানে থাকবে, কেনো যে তুমি আমার কথা শুনো না কে জানে!”
ফারিশের হঠাৎ এতো পরিবর্তন দেখে নিধি সহ ফারিশের দাদা দাদি ও হতভম্ব হয়ে যায়। শুধু অয়নই জ্বলছে ফারিশ আর নিধির কথাবার্তা শুনে!

শেষ বিকেলের প্রণয় পর্ব ৬

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here