শেষ বিকেলে তুমি আমি সিজন ২ পর্ব ২৩
আলিশা
শুষ্ক গলা, গরমে আধ ভেজা হওয়া শাড়ি নিয়ে এই মুহূর্তে দাড়িয়ে আছি অথৈয়ের বাড়ির সম্মুখে। পরিষ্কার করে বললে অথৈয়ের বাবার বাড়িতে। কলিং বেল দুবার চাপতেই দরজা খুলে বেরিয়ে এলো অথৈয়ের মা। আমি সালাম জানিয়ে ঘরের ঢুকলাম। তিনি যেন আমাকে দেখে কিছুটা থতমত খেলেন। আমিও হুট করে ঘরে ঢুকে ধাঁধায় পরে গেলাম। অথৈয়ের মায়ের সঙ্গে কুশল বিনিময় হওয়ার পর তিনি আমাকে শুধালেন
— কোনো দরকার মা?
আমি আসলে এসেছি অথৈয়ের বিষয়ে গোপন কিছু তথ্য খুঁজতে। যদি তার ঘরে দু একটা ডায়েরি বা ছবি পাই তবে আন্দাজ করতে পারবো অথৈ কবে থেকে জরিত এই কাজের সঙ্গে। তবে সে কথা যে অথৈয়ের মা কে বলা যাচ্ছে না। আমি বুদ্ধি এঁটে বললাম
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
— আসলে ভার্সিটি ছুটির পর এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম। তাই ভাবলাম আপনাকে একবার দেখে যাই। বাবা কোথায়?
— সে তো বাইরে গেছে একটু বাজার করতে।
— ওহ। আমার একটু মাথা ঘুরছে আম্মা। একটু বিশ্রাম নিয়ে তারপর চলে যাই আমি?
অথৈয়ের মা আফসোস ও অনুরাগের সুরে বললেন
— এভাবে বলার কি আছে? তুমি থাকো। আমি তো তোমার মায়ের মতোই। তুমি ওই ঘরে যাও। ওঘরে একটু শুয়ে থাকো।
— ওটা কি অথৈ আপুর ঘর?
— হুম মা। মেয়েটার কথা মনে হলেই চোখে পানি আসে। একা থাকি। তুই মাঝে মাঝে আসিস। আসলে আমার ভালো লাগবে। স্মরণ তো আর আসেই না। ছোঁয়ার উছিলায় আগে তাও যেটুকু আসতো।
আমি মৃদু কম্পমান হাত পা নিয়ে উঠে দাড়ালাম। অথৈয়ের রুমের দিকে এগিয়ে গেলাম। আম্মা আমাকে ঘরের দরজা খুলে ভেতরে পাঠিয়ে কিছু নাস্তার ব্যাবস্থা করতে চলে গেলেন। তিনি যেতেই আমি ব্যস্ত হয়ে দরজা চাপিয়ে খুজতে লাগলাম কোনো একটা সূত্র। অনেক খুজেও যখন কিচ্ছু পাচ্ছিলাম না তখনই মাথায় এলো আলমারির কথা। একটু অস্বস্তি নিয়ে এগিয়ে গেলাম। আবার পেছন ফিরে পরখ করলাম আম্মা না এসে যায়। আমার ভাগ্য এবার আমার সাথে ছিলো। আলমারি খোলা। প্রথম তাকে কিছু শার্ট ও শাড়ি। বুঝলাম অথৈ আর স্মরণের। তার পরের তাকে কিছু কাগজ আর কিছু ওড়ানা, জামা। সেসব একটু ঘাটতেই বেরিয়ে এলো একটা ডায়েরি। পুরোনো সেটা। একটা শুকনো গোলাপ স্কচটেপ দিয়ে যত্নে আটকে রাখা। ডায়েরির প্রথম পাতায় বড় করে রেখা “অথৈ ইমরোজ”
আমি মনে মনে হাজার বার ক্ষমা প্রার্থনা করে পুরোনো ডায়েরিটা নিজের ব্যাগে ঢুকিয়ে নিলাম। অতঃপর পায়ের শব্দে তড়িঘড়ি করে বসে পরলাম রুমের একটা সিঙ্গেল সোফায়। মাথাটা এবার সত্যিই ঘুরছিলো। আম্মা এক কাপ চা দিলেন আমাকে। ওনার যত্নে আমার মন আবেগ ঘন হলো। প্রায় দু’ঘন্টার মতো সময় অথৈয়ের বাসায় কাটিয়ে বাড়িমুখো হলাম। পথে আবার দেখা হলো নীলিমার সঙ্গে। খোঁজ খবর নিলো আমার। সঙ্গে শান্তর। শান্তর কথা বলতেই আমি অপরাধীর মতো ব্যস্থতা দেখিয়ে চলে এলাম। ও অবাক দৃষ্টিতে আমাকে দেখলো।
বাসায় আসতেই স্মরণের মুখোমুখি হলাম। ভয়ে জবুথবু হয়ে গেলাম। না জানি কি বলে আমাকে। তবে অবাক করা বিষয় সে একটা শব্দও উচ্চারণ করলো না। আমি হাফ ছাড়লাম। দুপুর গড়িয়ে যাবে এখন। স্মরণের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম দুপুরের খাবার খেয়েছে কিনা। সে হ্যা সূচক জবাব দিলো। আমার অবাকের মাত্রা আরো বৃদ্ধি পেলো। আমি বিহীন দুপুরের খাবার খেয়ে নিলো সে? এমনকি ঠিকঠাক কথাও বলছে না আমার সঙ্গে। রাগ নাকি অবহেলা তা ঠাহর করতে নিজের মুঠোফোন পর্যবেক্ষণ করলাম।
এতোক্ষণ বাইরে ছিলাম তবুও সে একটা ফোনও করেনি। বুকের ভেতরটা শূন্যতায় ভরে উঠলো। সকালেই না সে ভালো ছিলো। হুট করে তার কি হলো? এমন অবহেলা কেন ছুড়ছল আমার দিকে? উত্তর জানা নেই। দুপুরের খাবার খেয়ে আয়েস করতে একটু বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। তখন সে বেলকনিতে চেয়ারে বসে কিছু ভাবতে ব্যস্ত। আমি আর আগ বাড়িয়ে কথা বললাম না। মনে একদলা অভিমান নিয়ে ঘুমিয়ে গেলাম। ঘুম ভাঙলো বিকেল চারটার নাগাদ। পাশ ফিরে দেখি স্মরণও ঘুমের দুনিয়ায়।
আজ স্মরণের ‘নাচ গার্ডেনে’ যাওয়ার কথা। বিষয়টা মাথায় আসতেই চিন্তা আমার বেড়ে গেলো তরতর করে। স্মরণ কে আমি কিভাবে আটকাবো? মাথায় আসছে না আমার। কেমন বিরক্ত, তিক্ত, অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি নিজের কাছে নিজে। ভাবনা যখন বিষাক্ত হয়ে উঠছিলো তখনই মনে হলো অথৈয়ের ডায়েরির কথা। সেখান থেকে অথৈয়ের বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ পেলে হয়তো-বা স্মরণকে আমি আটকাতে পারবো। সাথে খাইরুনের পাঠানো ছবি ও চিঠি। তবে স্মরণ কি বিশ্বাস করবে সেসব? পাঁচ বছরের সংসার, প্রায় দশ বছরের ভালোবাসার মানুষটাকে কি একদিকে অবিশ্বাস করতে পারবে? কিন্তু আমার যে দমে গেলে চলবে না।
দ্রুত চলে গেলাম আমার ঘরে। দরজা আঁটকে ডায়েরিটা ব্যাগ থেকে বের করে নিয়ে বসে পরলাম। একটার পর একটা পাতা উল্টে গেলাম। প্রথমের বেশ কিছু পাতা ফাঁকা। তারপর একটা পাতায় পেলাম স্মরণের নিকট তার প্রেমের আকুলতার প্রকাশ। তার পরের কিছু পাতা জুড়ে তাদের সুন্দর স্মৃতির কথা। আমি যেন পুরোটাই গুলিয়ে গেলাম। এতো ভালোবাসা! একজন মানুষ কি তার ডায়েরিতে মিথ্যা কিছু লিখে রাখতে পারে? সম্ভব না এমনটা। রাগ, ক্ষোভে ডায়েরিটা বিছানায় রেখে উঠে দাড়ালাম আমি।
তবে কি খাইরুন আমাকে ভুল তথ্য পাঠালো? উহু! সেটাও সম্ভব নয়। তাহলে কে এই অথৈ আর কে ওই ছবির অথৈ? ভাবনাগুলো আমাকে ধৈর্য্যচ্যুত করে ফেলল। এমন সময় স্মরণের ডাক এলো। ছোঁয়া ফোন করেছে। কথা বলবে আমার সঙ্গে। এঘর থেকে ওঘরে গিয়ে ছোঁয়ার সঙ্গে কথা বললাম। অতঃপর আবারও ঘরে ফিরে ডায়েরির পাতা তন্নতন্ন করলাম। তবুও সন্দেহজনক কিছু পেলাম না। হতাশ হলাম আমি। এবার অথৈকে সন্দেহ করতে দ্বিধা হচ্ছে। মনে হচ্ছে অথৈ সত্যিই মা*রা গেছে। কিন্তু এই ভাবনায় বাঁধ সাধছে খাইরুনের পাঠানো ছবি। একটা বিষয় খুব করে বুঝতে পারলাম। ভেতরে কোনো বড় ধরণের গোলমাল আছে। মনকে বুঝালাম ভালোবাসা শত্রুতায় রূপ নিতে কতক্ষণ লাগে? হয়তোবা অথৈ সত্যিই স্মরণ কে ভালোবাসে। আবার সে তার ব্যবসাকেও ভালোবাসে। দুইয়ের মাঝে আটকে গিয়ে সে বিপত্তিতে।
ঘড়ির কাটা সাড়ে ছয়টার ঘরে। স্মরণ ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে তৈরি হচ্ছিলো কোথাও যাওয়ার জন্য। বুঝলাম ‘নদচ গার্ডেনে’ যাবে। আমি তার মুখোমুখি দাড়ালাম। ভয়, জড়তা, আড়ষ্টতা নিয়ে বললাম
— আপনি কি ডিউটিতে যাচ্ছেন?
— হুম।
— আমার কিছু বলার ছিলো।
— তাড়াতাড়ি বলো।
গম্ভীর তার সুর। আমি মনে মনে সাহস সঞ্চয় করে বললাম
— জানি না আপনি বিশ্বাস করবেন কিনা তবে এটা সত্যি যে……. যে অথৈই এই সবকিছুর মূলে। আর আমার মনে হয় আপনাকে ওখানে নেওয়ার জন্য অথৈ নাটক করছে। আপনি গেলেই ওরা উল্টাপাল্টা কিছু একটা করে দেবে। আপনি প্লিজ যাবেন না।
কথাটা বলেই স্মরণের পানে চাইলাম। তার চোখ রক্তলাল। বুকটা ধ্বক করে উঠলো। হঠাৎই কানে বাজলো কিছু ভাঙার শব্দ। অতঃপর তার বজ্রকন্ঠ
— জাস্ট সাট আপ খেয়া…. এসব ফালতু কথা বলার সাহস হলো কি করে তোমার? আর তুমি ভাবলে কি করে যে আমি এসব বিশ্বাস করবো?
আমি সাহস নিয়ে গলা উঁচিয়ে বললাম
— আমি প্রমাণ দিতে পারি আপনাকে?
শেষ বিকেলে তুমি আমি সিজন ২ পর্ব ২২
কথাটা বলেই হাতের চিঠি ও ছবিটা তার দিকে বাড়িয়ে দিলাম। সে দু’টো বস্তুকে ছুড়ে ফেলে দিলো বেলকনির দরজা দিয়ে। আমি হতবাক হয়ে চেয়ে রইলাম। সে আচমকা আমার গলা চেপে ধরে বলে উঠলো
— একবারও আমি বলিনি আমার প্রথম বউ আসছে তুমি বাড়ি থেকে বের হও। তাহলে এইসব নাটক কেন সাজাচ্ছো তুমি? হোয়াই? কি চাও? আমাকে অথৈয়ের বিরুদ্ধে নিতে? আমার অথৈ কে আমার চাইতে তুমি বেশি চেনো?