শ্রাবণ মেঘের রোদ্দুর পর্ব ৫

শ্রাবণ মেঘের রোদ্দুর পর্ব ৫
ইনায়া রোজ

মাহিদ বাড়িতে ঢুকেই সকলকে সালাম করে। এরপর এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে তার মাকে। এতদিন পর ছেলেকে পেয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন রাহেলা বেগম। কতদিন পর কাছে পেয়েছে ছেলেকে তিনি তাই নিজেকে আর সামলে রাখতে পারে নি। সকলেই একে একে মাহিদের সাথে কুশল বিনিময় করতে থাকে।
তখনই সবার পেছন থেকে ঘরে প্রবেশ করে রাব্বি আহমেদ।
– হ্যালো জনগণ, সকলের রাব্বি ফ্যান্টাস্টিক হাজির।
রাব্বি আহমেদকে দেখে আফসানা বেগম আর রাহেলা বেগম একে অপরের দিকে তাকায়। মাহিদ কিছুটা অবাকের স্বরে তার মাকে জিজ্ঞেস করে উঠে,

– মা ছোট চাচ্চু নিজেকে রাব্বি ফ্যান্টাস্টিক বলে চলেছে তখন থেকে কেন?
মাহিদের এমন কথা শুনে মুখ টিপে হেসে উঠে রাহেলা বেগম আর আফসানা বেগম। রাহেলা বেগম চুপিচুপি ছেলের কানের কাছে গিয়ে বলে ওঠে,
– যবে থেকে তোর চাচ্চুর চাকরি চলে গিয়েছে তখন থেকেই সে নিজেকে জিনিয়াস ভাবে।
– এটা কেমন কথা মা?
কিছুটা আশ্চর্য হয়ে বলে উঠে মাহিদ।
– সে অনেক কাহিনী পরেও শুনতে পারবি। এখন চল ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নিবি।
খাওয়ার কথা শুনতেই লাফিয়ে উঠে রাব্বি আহমেদ।
– চলো চলো জলদি খাওয়া যাক।
শ্রেয়া পাশ থেকে রাব্বি আহমেদের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
– তুমি না ডায়েট করো চাচ্চু?
শ্রেয়ার কথা শুনে রাব্বি আহমেদ বলে উঠে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

– হ্যাঁ করি তো প্রতিদিন সকালবেলা। কিন্তু এখন তো দুপুর হয়ে গেছে।
হেসে উঠে শ্রেয়া। এরপর বলে উঠে,
– তুমি আর তোমার ডায়েট।
– কি আর বলবো বল, খাওয়ার কথা শুনলে আমার মনে হয় পৃথিবীর সব সমস্যার সমাধান পেটের ভিতর ঢুকিয়ে দেই।
হাসতে হাসতে সবাই খেতে বসে পড়ে। মাহিদও ফ্রেশ হয়ে বসে পড়ে। মেঘকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মাহিদ বলে ওঠে,
– কিরে খেতে বস দাঁড়িয়ে আছিস কেন?
মাহিদের কথা শুনতেই এক গাল হেসে বসে পড়ে মেঘ। তখনই সেখানে উপস্থিত হয় শ্রাবণ। শ্রাবণকে দেখে মাহিদ বলে উঠে,

– ভাই জলদি এসো তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।
শ্রাবণ ও চুপচাপ কোন কথা না বলে খেতে বসে পড়ে। খেতে খেতে নানা ধরনের কথা বলতে থাকে সকলে। তবে মেঘ আর শ্রাবণ দুজনেই চুপচাপ বসে আছে। শ্রাবণ খেলেও মেঘ শুধু খাবার নাড়াচাড়া করে চলেছে। কিছুই খাচ্ছে না। হঠাৎই মাহিদ মেঘের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,
– বোন তোর গায়ে এগুলো কিসের দাগ? এত ব্যথা পেলি কি করে?
আচমকা মাহিদের কথায় থেমে যায় শ্রাবণের হাত। মিনিট খানেক নিস্তব্ধভাবে বসে থাকে সে। মাহিদের এমন কথায় সকলেই চুপ বনে যায়। তখনই শ্রেয়া বলে ওঠে,
– তাই তো মেঘ, কিরে কি হয়েছে তোর?
মেঘ একবার আড় চোখে তাকায় শ্রাবণের দিকে। শ্রাবণ কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবারও খাওয়ায় মনোযোগ দেয়। যেন এখানে কি হয়েছে সে শুনতেই পায়নি। মেঘ কিছুক্ষণ চুপ থেকে আমতা আমতা করে বলে উঠে,
– আসলে সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিলাম ভাইয়া তাই ব্যথা পেয়েছি।
– চোখ কি কপালে তুলে হাটিস নাকি তুই? দেখতে পাস না?
– খেয়াল করিনি ভাইয়া একটু তাড়াহুড়োতে ছিলাম।

মেঘকে সংকোচ পেতে দেখে আর কথা বাড়ায় না মাহিদ। এরপর রাব্বি আহমেদের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
– চাচ্চু তুমি তো দিন দিন অনেক সুন্দর আর স্মার্ট হয়ে যাচ্ছো।
মাহিদের কথায় হেসে রাব্বি আহমেদ বলে ওঠে,
– আর বলো না চাচ্চু আমি দিন দিনে এত সুন্দর হয়ে যাচ্ছি যে আয়নার সামনে দাঁড়ালে আয়না ও আমাকে দেখে হেসে ওঠে। আর তোমার ছোট মা তো আমাকে চোখে হারায় কোথাও যেতে দেয় না।। আমাকে নাকি অন্য মেয়ে মানুষেরা নজর দিবে।
তখনই শ্রেয়া পাশ থেকে বলে ওঠে,
– আর বলো না মাহিদ ভাই, চাচ্চুর স্মার্টনেসের গল্প বললে কেউ বিশ্বাস করবে না কারণ সেটা শুধু গল্পই থাকে।
বলে উচ্চস্বরে হেসে উঠে শ্রেয়া। তার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকায় আফসানা বেগম। সকলেই হেসে কথা বলতে বলতে সময় কাটিয়ে দেয়।

রাতের বেলা সকলে বসে আছে ড্রয়িং রুমে। মেঘের বাবা ফয়েজ আহমেদ এবং শ্রাবণের বাবা ইয়াকুব আহমেদ ঢাকা গিয়েছেন ব্যবসার কাজে। আর বাকি সকলে বসে আছে শুধু শ্রাবণ বাদে। মাহির একে একে সবার জন্য আনা গিফট গুলো বের করে দিচ্ছে।
– ছোট চাচ্চু ছোট মা ওরা কখন আসবে?
– কালকে আসবে হয়তো।
– আচ্ছা তাদের গিফট গুলো তারা আসলেই দিব।
মেঘ সোফার এককোণে বসে বসে নিজের জন্য আনা জিনিসগুলো দেখে চলেছে। তখনই মাহিদ বলে ওঠে,
– মেঘ যা তো শ্রাবণ ভাই কে ডেকে নিয়ে আয়।
আচমকা শ্রাবণের কথা শুনতে লাফিয়ে উঠে মেঘ।
– আ,আমি যাবো?
– না তোর ভূত যাবে।
মেঘ আহত দৃষ্টিতে তাকায় আফসানা বেগম আর রাহেলা বেগমের দিকে। রাহেলা বেগম ইশারায় মেঘকে যেতে বলে। মেঘ কিছুটা বিরক্তি আর ভয় নিয়ে পা টিপে টিপে শ্রাবণের রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়।

সন্তপর্ণে দরজা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করে মেঘ। কিন্তু আশেপাশে কোথাও শ্রাবণ নেই দেখে চলে আসতে নেয় সে। তখনই বারান্দা থেকে ভেসে আসে এক মৃদু কণ্ঠস্বর। আওয়াজ শুনে সেদিকে এগিয়ে যায় মেঘ৷ বারান্দার দরজার পাশে এসেই থমকে পড়ে সে । হালকা চাপানো দরজার ওপাশ থেকে গিটারের মৃদু সুর ভেসে আসছে। তারপরেই শোনা যাচ্ছে এক গভীর কন্ঠ ।
– প্রেমের মুরালি বাজাতে নাহি জানি
না পারি বান্দিতে সুর,,,,
– প্রেমের মুরালি বাজাতে নাহি জানি
না পারি বান্দিতে সুর,,,,
না পারি বান্দিতে সুররর
না পারি বান্দিতে সুরর,,,,,
হঠাৎ চারিপাশ এক লহমায় কেমন যেন অজানা আবেগে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। শ্রাবণের কণ্ঠে স্পষ্ট ব্যতিক্রস্ততা । কেমন যেন বিভীষিকাময় আর্তনাদের মত শোনাচ্ছে।

– নিথুয়া পাথারে নেমেছি বন্ধুরে
ধরো বন্ধু আমার কেহ নাই,,
– নিথুয়া পাথারে নেমেছি বন্ধুরে
ধরো বন্ধু আমার কেহ নাই,,
ধরো বন্ধু আমার কেহ নাই
ধরো বন্ধু আমার কেহ নাই,,,,
শ্রাবণের এমন কন্ঠে কেমন চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হচ্ছে মেঘের অন্তরে। কতটা কষ্ট নিয়ে মানুষ এমন বিষাদ সুরে গাইতে পারে জানা নেই মেঘের।
আচমকা কারো উপস্থিতি অনুভব হতে থেমে যায় শ্রাবণ। শ্রাবণকে থামতে দেখে কিছুটা ভড়কে যায় মেঘ। চোর ধরা পরার মতোই আমতা আমতা করতে থাকে সে। পিছনে না তাকিয়েই শ্রাবণ বলে ওঠে,
– কেন এসেছিস?

শ্রাবণ কিভাবে না তাকিয়ে বুঝতে পারল এটা সে? আজব! কিছুটা অবাকই হলো মেঘ। এরপর বলে উঠলো,
– তোমাকে ভাইয়া ডেকেছে, আমাকে বলেছে ডেকে নিয়ে যেতে তাই এসেছি।
হাতে থাকা গিটারটা কর্নারে রেখে পিছন ফিরে তাকায় শ্রাবণ। শ্রাবণকে দেখেই আতকে উঠে মেঘ। শ্রাবণের চোখ জোড়া অসম্ভব লাল হয়ে আছে। যেন বহু বছরের কান্না আটকে রেখেছে। ছেড়ে দিলেই টুপটাপ জলকণায় সমুদ্র বয়ে যাবে। মেঘের দিকে তাকিয়ে শান্ত কণ্ঠে শ্রাবণ বলে ওঠে,
– কখনো তো নিজের ইচ্ছাতেও একটু আসতে পারিস আমার কাছে।
– তোমার কাছে আমার কোন প্রয়োজন নেই কেন আসবো?
এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শ্রাবণ এগিয়ে এসে মেঘের সামনে দাঁড়ায়।
– আমি কি এতই খারাপ ফুল? আমাকে কি একটু ভালোবাসা যায় না?
তাচ্ছিল্য হেসে ওঠে মেঘ।
– না যায় না শ্রাবণ ভাই।
এরপর নিজের গায়ের ক্ষতগুলো দেখায় মেঘ। যেগুলো পড়ে গিয়ে পেয়েছিলো সে।

– এই যে দেখুন এগুলো দেখতে সামান্য ক্ষত হলেও এগুলো আমার কাছে কলঙ্ক সমান। কিন্তু এই কলঙ্ক আমি কখনো আপনার গায়ে লাগাতে পারবো না। কারণ পুরুষের গায়ে কখনো কলঙ্ক লাগে না। পুরুষ আজীবন শুদ্ধ থাকে। কলঙ্কের সৌভাগ্য শুধু নারীদেরই হয়।
এবার আরো কিছুটা এগিয়ে আসে শ্রাবণ। মেঘের দুবাহু চেপে ধরে বলে ওঠে,
– তোর গায়ে কলঙ্কও আমি দিবো আবার সেই কলঙ্ক যত্ন করে মুছেও আমিই দিবো, কারণ তুই শুধু আমার। আর আমার হওয়া এত সহজ না। আমার হতে হলে তোকে আমাকে সহ্য করার ক্ষমতা থাকতে হবে।
– কিন্তু আমি তো তোমার হতে চাই না শ্রাবণ ভাই।

শ্রাবণ মেঘের রোদ্দুর পর্ব ৪

– তোকে যে আমারই হতে হবে জান। পুনর্জন্ম হবে না বলেই তোকে এই জনমে পাওয়ার এত তীব্র আকাঙ্ক্ষা আমার। বিশ্বাস কর যদি আরো হাজারটা জনম পেতাম সেই জনমেও শুধু তোকেই চাইতাম।
– ভাইয়া ডাকছে তোমাকে সবাই অপেক্ষা করছে।
বলে শ্রাবণকে আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে শ্রাবণের হাত ছাড়িয়ে সেখান থেকে চলে আসে মেঘ। যেতে যেতে তার চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে বিষাদের অশ্রু কনা। মনে মনে সে আওড়ায়,
– কেন আমাকে এত কষ্ট দাও শ্রাবণ ভাই? তুমি জানো না তোমার ফুল যন্ত্রণা সইতে পারেনা,সামান্য আঘাতেই কুঁকড়ে যায়। তাও কেনো এত আঘাত করো?

শ্রাবণ মেঘের রোদ্দুর পর্ব ৬