সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি পর্ব ১২
Jannatul Firdaus Mithila
দেখতে দেখতে কেটে গেলো আরও ৭টি দিন।আজ অরিনের এডমিশন টেস্ট। সকাল থেকেই অরিন একটু পর পর পানি খাচ্ছে আর ওয়াশরুম যাচ্ছে। অরিনের এই এক সমস্যা, অতিরিক্ত নার্ভাসনেসের কারণে তার গলা শুকিয়ে যায় আর পেটে মোচড় দিতে থাকে,এখনো এমনটাই হচ্ছে মেয়েটার সাথে। রাফিয়া বেগম এটা-ওটা বুঝিয়েও মেয়েকে নার্ভাসনেস থেকে বের করতে পারছেন না।জুবাইদা বেগমতো একটার পর একটা সূরা পড়ে অরিনের গায়ে ফু দিয়েই যাচ্ছে। মাইমুনা বেগম হাতে খাবার নিয়ে অরিনের পিছু পিছু ঘুরছে, মেয়েটা এক জায়গায় স্থির থাকছে না কিছুতেই। রাইসা বেগম অরিনের ফাইল রেডি করাতে ব্যস্ত। রুহিতো অরিনকে বুঝিয়ে যাচ্ছে এতো টেনশন করতে না কিন্তু অরিন যে তাও মানতে নারাজ। শুধু যে বাড়ির মহিলারা ওকে নিয়ে আহ্লাদী হচ্ছে এমনটা না,বাড়ির পুরুষরাও এ ব্যাপারে তাদের চেয়ে কোন অংশে কম যান না।কবির এহসান এবং সাব্বির এহসান তো বলেই দিয়েছে,
” আমার অরি সোনা চান্স না পেলেও সমস্যা নেই, দেশের নামকরা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াবো আমাদের মেয়ে কে।”
অন্যসময় হলে হয়ত এমন আহ্লাদী কথায় গদগদ হয়ে যেতো অরিন কিন্তু আজ কেনো জানি তাও হচ্ছে না। তায়েফ সাহেব এবং তাশরিক সাহেব একযোগে বললেন,
— তোমরা যাই বলো না কেনো আমাদের বিশ্বাস অরিমা ঠিকি চান্স পাবে মিলিয়ে নিও।
ওনাদের এই কথায় সকলেই একসঙ্গে সায় দিয়ে ওঠেন। অরিনও আস্তে আস্তে নিজেকে স্বাভাবিক করতে থাকে।অরিন রেডি হয়ে নিচে নামলে অনিক তার কাধে একহাত দিয়ে বোনকে আগলে নেয়,অনিক বেশ নরম স্বরে বলতে থাকে,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
— দেখ বনু।life is not just a race. এখানে কেও কেও জিতবে কেও কেও হারবে এটাই স্বাভাবিক। সবসময় একটা কথা মাথায় রাখবি তুই নিজে যতটা সেরা পারফর্ম করবি রেজাল্ট ও ততোটাই সেরা পাবি।আমি খুব ভালো করেই জানি তোর প্রিপারেশন যথেষ্ট ভালো কিন্তু নার্ভাসনেসটা একটু বেশি। এই নার্ভাসনেসটাকে বেশিনা জাস্ট একটা ঘন্টার জন্যে ছুড়ে ফেল দেখবি you can gain your goal easily. তাই মনে রাখবি নিজের সেরাটাই দিতে যাচ্ছিস তুই। All the best bonu.
বলেই বোনের কপালে পরম স্নেহের পরশ একে দেয় অনিক। ভাইয়ের কথাগুলো শুনে মনে মনে যথেষ্ট শান্তি অনুভব করছে অরিন।তাই নিজেকে কনফিডেন্ট করে বের হয় বাসা থেকে।কিন্তু অরিনের কাছে একটা অবাক করা বিষয় হচ্ছে রৌদ্র আশেপাশে কোথাও নেই। বলতে গেলে বাড়িতেই নেই সে।কোথায় গেলো সে? সে কি জানতো না আজ যে অরিনের পরিক্ষা? মনে মনে এসব ভাবতে থাকে অরিন পরক্ষণেই এসব ভাবনা থেকে নিজেকে একপ্রকার টেনে হিঁচড়ে বের করে আনে সে কেননা আজ উদ্ভট কোন ভাবনা ভাবার সময় নেই।অরিন গিয়ে গাড়িতে বসে, আজকে বাড়ির পুরুষরা সকলেই যাচ্ছে তার সঙ্গে। সেও অবশ্য না বলেছিলো কিন্তু তার “না” করাটা তারা শুনলে তো! প্রথম গাড়িতে অরিন, অনিক, কবির সাহেব আর দ্বিতীয় গাড়িতে তায়েফ এহসান, সাব্বির এহসান আর তাশরিক এহসান।গাড়ি চলতে শুরু করে তার যাত্রাপথে।
প্রায় ৪০ মিনিট পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে উপস্থিত হয় তারা।অরিন গাড়ির জানালার কাচ গলিয়ে একদৃষ্টিতে বাহিরে তাকিয়ে দেখতে থাকে তার স্বপ্নের বিদ্যাপিঠটি। অনিক তার পাশে বসা বোনের দৃষ্টি দেখে বুঝতে পারে সবটা। মৃদু কন্ঠে বলে,
— ইনশাআল্লাহ আমার বনুও একদিন এখানে পড়বে।
অরিন ভাইয়ের কথা শুনে মৃদু হাসে অতঃপর মনে মনে বলে উঠে,” ইনশাআল্লাহ ”
প্রায় পাঁচ মিনিট পর গাড়ি থেকে নামে সকলে।অরিন আশেপাশে তাকিয়ে দেখে প্রচুর মানুষের সমাগম চারিপাশে। কেও কেও হয়তো তার মতোই পরিক্ষার্থী আর কেও কেও হয়তো তাদের আত্মীয় স্বজন।এসব ভাবনার মাঝেই হুট করে অরিনের চোখ যায় অনেকটা সামনে দাড়িয়ে থাকা একটি মেজেন্টা কালারের গাড়ির দিকে।যার সাথে হেলান দিয়ে নিরলস ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে আছেন একজন। দুহাত বুকের কাছে ভাজ করে রাখা,চোখে তার আজকে গাঢ় নীল রংয়ের চিকন ফ্রেমের চশমা,ব্ল্যাক শার্ট পড়নে, হাতা গুটিয়ে রাখা প্রায় অনেকটা,সাথে ধূসর রংয়ের ফরমাল প্যান্ট।হাতে কালো রংয়ের ব্রান্ড ঘড়ি, চুলগুলো আজ কিছুটা এলোমেলো হয়ে কপালে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, এতেও যেনো বেশ লাগছে দেখতে। মনে হচ্ছে এই চুলগুলোও যেনো মানুষটার গেটআপের সাথে তাল মিলিয়ে মানানসই সাজে সজ্জিত হয়েছে। প্রায় মিনিট দুয়েক রৌদ্র কে ভালোমতো অবলোকন করে তার কাছে ছুটে আসে অরিন।এদিকে বাড়ির সকলে অরিনের এভাবে যাওয়া দেখে সামনে তাকাতেই রৌদ্রকে চোখে পড়ে তাদের। অরিন একদৌড়ে চলে আসে রৌদ্রর সামনে, এসেই হাঁটুতে দুহাত ভর দিয়ে কিছুটা হাপাতে থাকে।অরিনকে দেখে চোখ থেকে চশমাটা খুলে হাতে নেয় রৌদ্র, পরে গাড়ি থেকে পানির বোতল নিয়ে অরিনের সামনে ধরে। অরিনও নিজেকে স্বাভাবিক করে পানি খেয়ে নেয়। পানি খাওয়া শেষ হতেই অরিন চটপট কন্ঠে বলতে থাকে,
— রোদ ভাই আপনি বাসায় ছিলেন না কেনো? আর এখানে এভাবে দাড়িয়ে আছেন যে? আপনি কি আমার আসার অপেক্ষা করছিলেন?
অরিনের এমন প্রশ্নে স্মিত হাসে রৌদ্র, বলে,
— হুম তোর জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।আর সকালে একটা কাজ ছিলো তাই বাড়িতে ছিলাম না।হয়েছে প্রশ্ন করা? নাকি আরও কিছু জিজ্ঞেস করা বাকি আছে তোর?
এমন কথা শুনে পরপর মাথা ডানে-বামে ঘোরায় অরিন।
রৌদ্র আর কিছু বলে না। নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থাকে অষ্টাদশীর পানে।কয়েক মিনিট পর নিজেদের মাঝে নিরবতা ভেঙে রৌদ্র বলতে থাকে,
— অরি?
— জি।
— কিছু কথা বললে শুনবি?
— জি বলুন।
রৌদ্র একদৃষ্টিতে অরিনের মুখপানে তাকিয়ে বলতে থাকে,
—” মনে রাখিস অরিন যার চাওয়াটা যতটা সুস্পষ্ট তার পাওয়াটা হয় ততোই সুনিশ্চিত। তুই আজকে যেই পরিক্ষাটা দিতে যাচ্ছিস এটাকে ওতো বড় করে দেখার কিছু নেই,তুই যতটুকু পারিস ততটুকুই দিবি। আর অবশ্যই নিজের সেরাটা দিবি।মনে থাকবে?
রৌদ্রর কথাগুলো শুনে মুচকি হাসলো অরিন, পরপর মাথা ঝাকায় সে।অরিন হাসতেই রৌদ্রর দৃষ্টিগোচর হয় তার গালে ফুটে ওঠা টোলগুলো।রৌদ্র একনজর সেদিকে তাকিয়ে অন্যদিকে নিজের দৃষ্টি ফেরায়।ফোস করে শ্বাস ছেড়ে টানটান হয়ে দাড়ায় সে। অরিন আর কি বলবে বুঝতে না পেরে সেখান থেকে চলে আসতে নিলেই রৌদ্র পেছন থেকে এক অদ্ভুত মোহনীয় স্বরে বলে ওঠে,
–” অরিন!”
সহসা পা দুটো থমকে দাড়ায় অরিনের। বেশ রয়েসয়ে পিছনে ফিরে সে।অতপর আবারও কানে আসে সেই একই মোহনীয় কন্ঠস্বরটি,
“দোয়া করি তোর মনের সকল চাওয়া -পাওয়া আল্লাহ পূরণ করে দিক।”
কথাগুলো বলে আর এক মুহূর্তও অরিনের সামনে দাড়ায় না সে,প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে গটগট পায়ে হেঁটে চলে যায় বাড়ির লোকেদের কাছে।অথচ পেছনে ফেলে যায় এক অনিমেষ বিভোরে আটকে থাকা মায়াবতীকে, অরিনের মনে রৌদ্রর কথাগুলো যেনো এক অন্যরকম ভালো লাগার অনুভুতি। এই মানুষটা কে সে যতই নিজের মন থেকে সরাতে চায় ঠিক ততই যেনো সে কোন এক অদৃশ্য মায়াবনে আটকে পড়ে।আর কিছু না ভেবে অরিনও মিনিট পাঁচেক পরে সকলের কাছে চলে আসে।
হলে প্রবেশ করার সময় হয়ে এলে অরিন সকলের থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায় হলরুমে। শুরু হয় বাড়ির সকলের প্রতিক্ষার প্রহর।
অরিন চলে যেতেই রৌদ্র তার বাবাকে বলে,
— আব্বু তুমি এখানে কি পুরো সময়টা থাকবে?আজকেও কি অফিস যাবে না?
— হ্যা না মানে, আজকে অফিসে তেমন একটা কাজ নেই।কি বলিস সাব্বির।
বড় ভাইয়ের মুখে হঠাৎ সম্বোধনে কিছুটা ভড়কে যায় সাব্বির সাহেব। পরে সেও ভাইয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বললেন,
— ওহ হ্যা ওই আরকি তেমন কোন কাজ নেই।বাকি অল্প যেটুকু আছে ম্যানেজার সবটা সামলে নিবে।
রৌদ্র আর তেমন কিছু বললো না। গুরুগম্ভীর কন্ঠে তাদের কে বললো,
— আচ্ছা বেশ।আমার আবার পেশেন্ট দেখতে হবে। সো যেতে হবে। আসছি তাহলে।
বলেই সকলের থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে বসে সে।এদিকে তার চলে আসার ঠিক পরপরই অনিকও চলে আসে। এই বেচারাও তো অন্যের অধীনে চাকরি করছে।হুটহাট তো আর চাইলেও ছুটি নেওয়া সম্ভব না।
তায়েফ এহসানও কিছুক্ষণ ভাইদের সাথে থেকে থানায় চলে যান।তার সাথে আবার তাশরীক এহসান ও যোগ দেন।এখন হলের সামনে আপাতত কবির সাহেব আর সাব্বির সাহেব দাড়িয়ে আছেন।তারা দুজন দিব্যি একে অপরের সাথে হেঁটে হেঁটে আশপাশ ঘুরে দেখছেন আর এটা সেটা বলে সময় কাটাচ্ছেন ।
দেখতে দেখতে ঘড়ির কাটায় বেজে যায় ১:৩০।আশে পাশে যেনো মানুষের ঢল নেমেছে। একে একে সকল শিক্ষার্থী বের হচ্ছে হল থেকে।সাব্বির সাহেব কিছুটা চিন্তিত হলেন এত ভিড়ে মেয়েকে কিভাবে খুঁজবেন তিনি? তার এমন ভাবনার মাঝেই অরিন হাসিমুখে হল থেকে বের হয়।সাব্বির সাহেব মেয়েকে উৎফুল্ল দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন।মনে মনে ভাবেন,
“যাক পরিক্ষা হয়তো ওতোটা খারাপ হয়নি।”
অরিন তাদের সামনে আসতেই দুভাই একটা মিষ্টি হাসি দেয়, কবির সাহেব অরিনের মাথায় হাত রেখে আলতো স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
“আমার পরি মা টার পরিক্ষা কেমন হলো?”
অরিন তার বড় আব্বুর দিকে তাকিয়ে বেশ উৎফুল্লতার সাথে বলতে থাকে ,
— আলহামদুলিল্লাহ, অন্নেকককক ভালো হয়েছে। এই এত্তগুলা ভালো হয়েছে। বলেই দু’হাত প্রসারিত করার ভঙ্গি করে সে। অরিনের এমন কথাবলার ভঙ্গিতে হেসে ওঠে দুজনেই। তারপর তারা অরিনকে নিয়ে কিছুক্ষণ আশেপাশে ঘোরাঘুরি করে বাসায় ফিরে আসে।
অরিন বাসায় ফিরতেই তাকে ঘিরে বসেছে সবাই।
একে একে সবাই প্রশ্ন করতে থাকে পরিক্ষা কেমন হলো? সব ঠিকঠাক দিয়েছে কি না? তার কি আবারও নার্ভাস লেগেছে কি না?ইত্যাদি।
মা-চাচিরাতো তাদের এহেন প্রশ্নের বহরে রীতিমতো তাকে কিছু বলার সুযোগ অবধি দিচ্ছে না।
অরিন এদের একসঙ্গে এত প্রশ্ন শুনে কানে হাত দিয়ে মৃদু চেচিয়ে বলতে থাকে,
— আরেএএএএ থামো তো।এত প্রশ্ন একসাথে করলে উত্তর দিবো কিভাবে বলো তো?
অগত্যা এ কথা শুনে সকলেই চুপ করে যায়। অরিন সবার দিকে তাকিয়ে লম্বা একটা হাসি দিয়ে আবারও বলতে থাকে,
— আলহামদুলিল্লাহ আমার পরিক্ষা অনেক ভালো হয়েছে, আর আমি সবটা উওর ঠিকঠাক মতো দিয়েছি,কিচ্ছুটি ছেড়ে আসিনি। হয়েছে এবার?
সকলেই যেনো এতক্ষণে শান্তি পেলো অরিনের একথা শুনে। তাই তারা আর কিছু জিজ্ঞেস করলেন না।অরিন ও আর কিছু না বলে চলে যায় নিজের রুমে।রুমে এসেই ফ্রেশ না-হয়ে ধপ করে শুয়ে পড়ে খাটে। বিছানায় এপাশ ওপাশ গড়াগড়ি দিয়ে বলতে থাকে,
—আহ! শান্তি। আজ থেকে কয়েকদিন একদম চিল থাকতে পারবো।ঘুরবো ফিরবো, ইনজয় করতে পারবো। বলেই বুকে বালিশ জড়িয়ে ধরে স্বস্তির নিঃশ্বাস টানে অরিন। হঠাৎই তার মনে পড়লো মোবাইলের কথা।আজ বহুদিন পর আবারও ফোন হাতে নিলো সে।ঐদিন রাতে রৌদ্রর ওমন স্ট্যাটাস দেখে রাগে দুঃখে মোবাইল থেকে শখের ফেসবুকটাকেই আনইন্সটল করে দিয়েছিলো সে।এখন আবার ইনস্টলেশন করে চলে যায় স্ট্যাটাস দিতে।বেশকিছুক্ষন ভাবার পর একটি পোস্ট আপলোড করে অরিন।পরে মোবাইলটা বিছানার পাশে রেখে ছুটে যায় ফ্রেশ হতে।ক্ষুধায় পেটে ইদুর দৌড়াচ্ছে তার।
প্রায় ২০ মিনিট ধরে লম্বা শাওয়ার নিয়ে বের হয় অরিন।ভেজা চুলগুলোয় টাওয়েল পেচিয়েই চলে যায় খাবার খেতে। অরিন ডাইনিং রুমে উপস্থিত হতেই তার জন্য খাবার সার্ভ করে দেন মাইমুনা বেগম। রাফিয়া বেগম মেয়ের মাথায় টাওয়েল দেখে আবারও কিছু বলতে যাবেন তার আগেই জুবাইদা বেগম তার পাশ কাটিয়ে চলে যায় অরিনের কাছে। অরিনের চুলগুলো সযত্নে মুছে দেন তিনি।অরিনও বিনিময়ে মিষ্টি করে হাসে। রাইসা বেগম পাশে বসে পুতুলকে খাইয়ে দিচ্ছেন। ছেলে ক্লাস ৮ এ পড়লেও মাঝে মাঝে মায়ের হাতে খাবার খাওয়ার বায়না ধরে সে।আজও তার ব্যাতিক্রম নয়।
খাওয়া-দাওয়া শেষ করে রুমে চলে আসে অরিন। বহুদিন হলো দুপুরে ভাতঘুম দেয় না ও।দিবেই বা কিভাবে? সময় পেলেই তো পড়তে বসতে হতো,ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায়। ভাবতে ভাবতেই বিছানায় ধপ করে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ে অরিন।কিছুক্ষণের মধ্যেই যেনো ঘুমেরা চোখে এসে হানা দেয় তার।
রুহি ভার্সিটি থেকে বের হতেই কোথা থেকে যেনো রেহান এসে হাজির। প্রথমে সে কিছুটা চমকালেও পরক্ষণেই নিজেকে স্বাভাবিক করে নেয়।রেহান রুহির কাছে এসে সযত্নে তার হাতটি আঁকড়ে ধরে। রেহানের হুট করে এমন হাত ধরাতে রুহি আশে-পাশে তাকিয়ে কিছুটা অপ্রস্তুত কন্ঠে বলে ওঠে,
— কি করছেন টা কি? লোকে দেখলে কি বলবে বলেন তো?
রুহির মুখে এই কথা শুনে রেহান তার দিকে ভ্রুকুটি করে তাকায়, হাত ছেড়ে দেয় রুহির।রুহি যেই না স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে তার আগেই আচমকা রেহান তার কোমরের পাশে হাত দিয়ে তাকে হেচকা টানে নিজের দিকে টেনে আনে।রেহানের হঠাৎ কান্ডে রুহি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে চোখ বড় করে তাকিয়ে থাকে তার পানে।রেহান রুহির এমন তাকানোতে পাত্তা না দিয়ে তার কানের কাছে নিজের ওষ্ঠপুট নিয়ে ফিসফিস করে বলে,
— আমার বউয়ের হাত ধরবো,কোমর ধরবো দরকার পরলে আরো অনেক কিছুই ধরবো তা লোকে দেখলেই কি আর না দেখলেই কি শুনি।
— আমিতো এখনও আপনার বউ হইনি।
— ওহ তাই! তাহলে কি ম্যাম এখনও বউ হননি বলে আফসোস হচ্ছে? তা আপনি কি আজই বিয়ে করতে চাচ্ছেন নাকি? আপনি বললে যখন তখন বিয়ে করতে প্রস্তুত আমি।কিন্তু মনে রাখবেন বিয়ের পরের যে কাজ সেটা কিন্তু আমি যখন বলবো তখনই।
— কোন কাজ। অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করে রুহি।
রুহির এমন কথায় দুষ্ট হাসে রেহান।বলে,
— সেটা টপ সিক্রেট! এভাবে যেখানে সেখানে বলা যায় না।বিয়ের পর বলবোনি ওকে।শুধু বলবই না প্র্যাকটিক্যালি বুঝাবো সোনা।আপাতত লেটস গো।আ’ম ফামিসড।
— ওকে চলুন তাহলে।
বলেই তারা চলে যায় পাশের একটি রেস্টুরেন্টে।
খাওয়া দাওয়া শেষে রুহিকে তার বাড়িতে পৌছে দেয় রেহান।পরে নিজেও চলে যায় নিজ বাড়িতে।
গরম গরম চায়ের সঙ্গে হালকা কিছু ভাজাপোড়ায় ড্রয়িং রুমে মেতে উঠেছে বাড়ির বউদের এবং ছেলেমেয়েদের সন্ধ্যার সময়টা। অরিন টিভির দিকে তাকিয়ে চা’য়ে হালকা জিপ নিচ্ছে।রুহি একটা পিয়াজু মুখে তুলে মনের সুখে চাবাচ্ছে আর রেহানের সঙ্গে চ্যাট করছে।আহি মাহিও অরিনের সাথেই টিভিতে মগ্ন। পুতুল বিরতিহীনভাবে ওদের বিভিন্নভাবে বিরক্ত করেই যাচ্ছে। অন্যদিকে বাড়ির বউরা মগ্ন নিজেদের আড্ডায় -খুনসুটিতে। মেহরিন বেগমের সাথে ভিডিও কলে কথা বলছেন তারা।মেহরিন বেগমতো একাধারে আফসোস করছেন রুহির বাগদানে থাকতে না পারার জন্য। অবশ্য থাকবেই বা কি করে? মেহরিন বেগমের স্বামী হঠাৎ করেই কি আর ছুটি পাওয়ার মানুষ! আর রিমিরও স্কুলে পরিক্ষা হওয়ায় একা আসতে পারেননি তিনি।এসব নিয়েই তাকে সেই কখন থেকে এহসান বাড়ির বউরা বুঝিয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু মেহরিন বেগম বুঝলে তো!
দূর আকাশে আজ একটা বাঁকা চাদ।চাঁদের মৃদু আলো যেনো বারান্দায় গর্বের সঙ্গে দাড়িয়ে থাকা শিউলি ফুলের গাছটার গায়ে লেপ্টে পড়ছে।বারান্দার চারপাশে কেমন মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।রাতের খাবার শেষ করেই অরিন চলে আসে বারান্দায়। আজ কেমন ইচ্ছে করছে চন্দ্রবিলাস করতে।চোখ বুজে বুক ভরে নিশ্বাস নিচ্ছে অরিন।চোখ বন্ধ থাকা অবস্থায় ভাবতে থাকে,
“আচ্ছা রোদ ভাইকে আমার, কেনো এত ভালো লাগে? কি আছে ঐ মানুষটার কাছে? যত চাই মানুষটার থেকে দূরে থাকবো ততই যেনো এক ঘোর অমানিশায় হারিয়ে ফেলি নিজেকে।আচ্ছা উনি তো আমার জীবনের প্রথম অনুভুতি। তাই বলেই কি এমন হচ্ছে আমার সাথে।যেদিন থেকে বুঝতে শিখেছি সেদিন থেকে শুধু তার কথাই ভেবেছি। আচ্ছা সে কি সত্যি অন্য কাওকে পছন্দ করে? আমি কি তাহলে তার জীবনে তার ভালোবাসার মানুষ হতে পারবো না।আচ্ছা আমার কি উচিত তাকে ভুলে যা-ওয়া।কিন্তু ভুলে যাওয়ার কথা ভাবতেই এমন দম বন্ধ হয়ে আসে কেনো?”
এসব ভাবতে ভাবতেই চোখ মেলে অরিন। দূর আকাশের মেঘের আড়ালে লুকিয়ে থাকা চাদের দিকে একটি শ্লেষাত্মক হাসি দিয়ে মনে মনে আবারও বলতে লাগলো,
“রোদ ভাই, এমন যদি হতো খুব বেহায়া হলে আপনাকে পাওয়া যেতো, তাহলে আমি হতাম পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বেহায়া।যদি এমন হতো চিৎকার করে কেদে হলেও আপনাকে পাওয়া যেতো তাহলে আমি চিৎকার দিয়ে কাঁদতাম। কিন্তু আপনি যে আমার জীবনে শুধু চাঁদ হয়ে রইলেন। যাকে অনুভব করা যায়,দেখা যায়,যার প্রতি মুগ্ধ হয়ে সারাজীবন তার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকা যায় কিন্তু তাকে যে কাছ থেকে ছোয়া যায় না।কেনো ছড়ালেন এতটা মুগ্ধতা আমার জিবনে? কেনো এমন যত্নের অদৃশ্য মায়ায় আটকালেন আমায়?
অরিনের খেয়াল হলো তার চোখ থেকে অনবরত পানি ঝড়ছে।কিন্তু তবুও সে মুছলো না।ভাবছে,ঝড়ুক না!ক্ষতি কি তাতে।
এমন সময় পাশের বারান্দায় দাড়ায় রৌদ্র।মোবাইলে কিছু একটা টাইপ করছিলো সে,হঠাৎ তার পাশের বারান্দায় অরিনকে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে কিছুটা ভ্রু কুচকায় সে।গম্ভীর কন্ঠে বলতে থাকে,
“কিরে তুই এত রাতে এভাবে এখানে দাড়িয়ে আছিস কেনো? ”
হঠাৎ কথায় কিছুটা ভড়কে যায় অরিন।কথা শুনে পাশে তাকাতেই দেখে রৌদ্র তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অরিন কিছু বললো না।কেনো যেনো কথা বের হচ্ছে না গলা দিয়ে।অরিনকে চুপ থাকতে দেখে রৌদ্র ফের বলতে থাকে,
— কিরে,কথা কানে যায় না।কি বলছি তোকে?
— এমনি দাড়িয়ে আছি রোদ ভাই।
— এমনি এমনি কেও দাড়ায়?
— হয়তো দাড়ায়।
— কিহ!
— না কিছু না।
— যা রুমে যা।
— আরেকটু থাকি প্লিজ।
রৌদ্র এমন অনুনয়ে আর কিছু বলে না।অগত্যা সেও অরিনের মতো চাঁদ দেখতে ব্যস্ত হয়ে যায়।
হুট করেই অরিন প্রশ্ন করে বসে,
— রোদ ভাই! পরিক্ষা কেমন হলো জিজ্ঞেস করলেন না যে!
— জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। আমি অলরেডি জানি পরিক্ষা কেমন দিয়েছিস।
— তাই! তা কি করে জানলেন?কে বললো আপনাকে?
— এই ছোটো খাটো বিষয়ে আমার অন্যের থেকে জানার প্রয়োজন হয় না।আমি নিজে থেকেই জানি সবটা।
— এতটা চিনেন আমায়?
–হয়তো!
— আচ্ছা কতটা চিনেন আমায়?
— তোর চেয়ে বেশি।
— আমার চাইতেও বেশি? কিভাবে?
— তুই জেনে কি করবি?
— জানলে কি খুব ক্ষতি হবে?
— হয়তো।
এরপর দুজনেই চুপ করে যায়। বেশকিছুক্ষন পর আবারও অরিন বলে উঠে,
“আচ্ছা রোদ ভাই সকালে আপনি আমায় যেই দোয়াটা করেছিলেন সেটা কি মন থেকেই করেছিলেন?”
— কোনটা? ভাবলেশহীনভাবে আকাশের পানে চোখ রেখেই জিজ্ঞেস করে রৌদ্র।
— ঐ যে আল্লাহ যাতে আমার সকল চাওয়া পাওয়া পূরণ করেন।সেটা।
— ওহ। হুম দোয়াতো মানুষ মন থেকেই করে।
— সত্যি রোদ ভাই, আপনি চাইছেন আল্লাহ আমার সকল চাওয়া পাওয়া পূরণ করে দিক?
অরিনের এমন কথায় ভ্রুকুটি করে তার দিকে তাকায় রৌদ্র, বোঝার চেষ্টা করে এই কথা দ্বারা কি বুঝাতে চাইলো অরিন!
রৌদ্র কে চুপ থাকতে দেখে অরিন মৃদু হেসে সেখান থেকে চলে আসে নিজের রুমে । মনে মনে বলতে থাকে,
সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি পর্ব ১১
—“রোদ ভাই আমার এই অবচেতন মন যে শুরু থেকেই আপনাকে চেয়ে আসছে। তাহলে কি আপনার দোয়া কবুল হিসেবে আমি আপনাকে পাবো?
এদিকে রৌদ্র এখনও একইভাবে দাড়িয়ে আছে বারান্দায়। ভাবছে,
“হঠাৎ আবার কি হলো ওর?”