সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি পর্ব ১৪
Jannatul Firdaus Mithila
রৌদ্রের পিছুপিছু বাহিরে বের হয়ে কিছুটা অবাক হয় অরিন।আশেপাশে সব জায়গায় চোখ বুলিয়েও কাওকে চোখে পড়লো না তার।রৌদ্র গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করে এনে অরিনের সামনে ব্রেক কষে।অরিন তখনও দাড়িয়ে। কোন হোলদোল নেই তার মাঝে।অরিনকে এভাবে দাড়িয়ে থাকতে দেখে রৌদ্র গাড়িতে বসে থাকা অবস্থাতেই জিজ্ঞেস করে,
-এভাবেই দাড়িয়ে থাকবি নাকি?
অরিন কিছুটা আমতা আমতা করে প্রশ্ন করে,
-ইয়ে মানে,রোদ ভাই! বাকিরা কোথায়? তাদের দেখছি না যে!
-তারা অনেক আগেই চলে গিয়েছে। তোর তো আবার তৈরি হতে পুরো একদিন লাগে কিনা! তাই ওরা আমাদের আগে অন্য গাড়ি নিয়ে বের হয়ে গেছে।
অরিনের রৌদ্রর মুখে এমন কথা শুনে কিছুটা অভিমান করার কথা থাকলেও মনে মনে সে ভিষণ খুশি! আর খুশি না-হয়ে উপায় আছে? সে তার রোদ ভাইয়ের সাথে একা যাবে এটা কি কম বড় কথা! কিন্তু তার যে এই মানুষটার সাথে পাশাপাশি বসার বড্ড শখ! খোলা আকাশের নিচে হুড ফালানো রিকশায় গায়ে বাতাস লাগিয়ে ঘুরবার শখ।এই মানুষটাকে খুব করে কাছ থেকে অনুভব করার শখ!
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
অরিনকে নিজের ভাবনায় বেখেয়ালি দেখে রৌদ্র অরিনের মুখের সামনে তুড়ি বাজায়।
অরিন কিছুটা চমকে উঠে। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে রৌদ্রর পানে তাকায় সে।রৌদ্র গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
-তুই তোর এই অভ্যাসটা বাদ দিবি না? কথায় কথায় এমন স্ট্যাচু হয়ে যাস কেনো তুই? এখনকি যাবি নাকি এভাবেই দাড়িয়ে থাকবি।আমার কিন্তু এভাবে শুধু শুধু দাড়িয়ে থাকার মোটেও সময় নেই।
-আচ্ছা রোদ ভাই,আমরা গাড়িতে করে না গেলে হয় না?
রৌদ্র অরিনের এমন কথায় ভ্রুকুটি করে তাকায়। তাকে কিছু না ছোট্ট করে শ্বাস ফেলে গাড়ি থেকে বের হয়ে আসে সে। অরিনকে সাথে নিয়ে গাড়ি ছাড়াই বেরিয়ে পড়ে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।
পড়ন্ত সূর্যের উত্তাপও যেনো অনেকটাই তেজস্ক্রিয়। ইট-পাথরের রাস্তাটিতে পাশাপাশি হাঁটছে দুজন অব্যক্ত প্রেমি।জনমানবহীন রাস্তাটিতে মাঝে মধ্যে দু-একটি রিকশা ছুটে যাচ্ছে তাদের পাশ দিয়ে। কারো মুখে কোন রা অবধি নেই।রৌদ্র সামনে তাকিয়ে দুহাত পকেটে গুজে ভাবলেশহীনভাবে হেটে চলেছে। অন্যদিকে অরিন বারবার আড়চোখে তার পাশে থাকা সুদর্শন পুরুষটিকে অবলোকন করে যাচ্ছে। সে কি ভেবেছিলো এই মানুষটার সাথে কখনো এভাবে পাশাপাশি হাঁটতেও পারবে! অরিনতো হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো খুশি।বেশ কিছুক্ষনপর তারা একটি রিকশা পায়।রৌদ্র আগে উঠে পড়ে কিন্তু অরিন উঠতে গিয়ে পড়ে বিপত্তিতে।লং ফ্রক পড়ার দরুন উঠতে কিছুটা অসুবিধা হচ্ছিলো তার এমন সময় তার সামনে একহাত বাড়িয়ে দেয় রৌদ্র। অরিন কিছুটা অবাক চোখে তাকায় তার দিকে। রৌদ্র এবার খেঁকিয়ে বলতে থাকে,
-হা করে তাকিয়ে না থেকে তারাতাড়ি ওঠ।
অরিনও তড়িঘড়ি করে মাথা ঝাকিয়ে হাতটিকে শক্ত করে ধরে উঠে বসে।অরিন রিকশায় বসতেই রৌদ্র অরিনের হাটুর ওপর দিয়ে হালকা হাতে তাকে আগলে ধরে।রিকশা চালকের উদ্দেশ্যে বলে,
-মামা আস্তে ধিরে চালাবেন।
-জি আইচ্ছা। বলেই তিনি রিকশা চালাতে থাকে।
এদিকে রৌদ্রর স্পর্শ পাওয়া মাত্রই যেনো অরিনের সমস্ত কায়া এক মুহুর্তে কেঁপে ওঠে। তার হৃদয়ের সকল ভালোলাগারা যেনো ডানা মেলে ঝাপ্টাতে শুরু করেছে।এ কেমন অনুভূতি! এতোটা এলেমেলো লাগছে কেনো তার? সামান্য একটু কাছে আসাতেই তার দমবন্ধকর অবস্থা অথচ মনে মনে এই মানুষটাকে সে সবসময়ের জন্য নিজের করে চায়।
অরিন নিজেকে স্বাভাবিক রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যায়।পাছে না তার রোদ ভাই কিছু বুঝে যায়!অন্যদিকে অরিনের এমন কাঁপা-কাঁপি সবটাই চক্ষুগোচর হয় রৌদ্রর। তবুও সে ভ্রুক্ষেপহীনভাবে অরিনকে একইভাবে আগলে ধরে বসে থাকে সে।
অরিনের দিকে একবার তাকায় সে পরক্ষণেই নজর ঘুরিয়ে মিটমিটিয়ে হাসতে থাকে। মনে মনে বলে,
-“আমার সামান্যতম ছোঁয়াটুকু এখনো সহ্য করতে পারিসনা সানশাইন অথচ একদিন তোর সমস্ত কায়াজুড়ে থাকবে শুধু আমার ছোয়া,আমার বিচরণ। তখন কিভাবে সামলাবি নিজেকে!
প্রায় আধঘন্টা পর তারা একটা পার্কের সামনে উপস্থিত হয়। রৌদ্র রিকশা থেকে নেমে অরিনকেও আগলে ধরে নামায়।রিকশা ভাড়া চুকিয়ে তারা ভিতরে প্রবেশ করে।ভেতরে প্রবেশ করে অরিন আশেপাশে চোখ বোলায়,পার্কটি দেখতে যথেষ্ট সুন্দর। চারিদিকে কত মানুষজনের ভিড়।অরিন কিছুটা সামনে এগোতেই একজন ঝট করে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে। ঘটনার আকস্মিকতায় অরিন কিছুটা ভড়কে যায়। জড়িয়ে ধরা মানুষটির দিকে তাকাতেই বুঝতে পারে এটা আহি।আহি অরিনকে ছেড়ে দিয়ে প্রশ্ন করে,
-এতো লেট করলে তুমি! বাব্বাহ আমরাতো ভেবেছিলাম আজ আর বুঝি আসবেই নাহ!
-ও কথা বাদদে।আগে বল বাকিরা কোথায়?
-বাকিরা ঐ যে। বলেই হাত দিয়ে ডানদিকে ইশারা করে আহি।অরিনও সেদিকে লক্ষ্য করে তাকাতেই সকলে তাকে হাত দিয়ে কাছে আসার ইশারা করে। অরিনও ছুটে যায় সঙ্গে সঙ্গে। অরিনকে এভাবে ছুটতে দেখে পেছন থেকে রৌদ্র বলে উঠে,
-আস্তে যা অরি!হোচট খাবিতো!
কে শোনে কার কথা! অরিনতো একপ্রকার ছুটেই সকলের সামনে উপস্থিত হয়।সকলকে দেখেই গাল ফুলিয়ে বলতে থাকে,
-তোমরা খুব খারাপ! আমায় একা ফেলে নিজেরা চলে আসলে! কেনো আমার জন্য কিছুক্ষণ দাড়ালে কি হতো শুনি?
অরিনের অভিমানি কথায় অনিক বোনের কাঁধ আগলে ধরে বলে,
-সো সরি বনু।আসলে এই রুহির জন্যই আমাদের আগেভাগে বের হতে হয়েছে। আর তাছাড়া এক গাড়িতেতো চাইলেও আমরা একসঙ্গে আসতে পারতাম না তাই ভাইয়া আমাকে ওদের সঙ্গে পাঠিয়ে দিয়েছে আর বলেছে ভাইয়া তোকে তার সঙ্গে নিয়ে আসবে।
-ওহ! আচ্ছা সেটা বাদ দাও।রুহিপুর জন্য আগে আসতে হয়েছে কেনো?
-কারন রেহান ভাইয়া রুহিপুকে তাড়া দিচ্ছিলো আর রুহিপু আমাদের। টিপ্পনী কেটে পেছন থেকে বলে উঠে মাহিরা।
-কিহ! রেহান ভাইয়াও এসেছে?
-হুম। ঐ দেখো হাতে আইসক্রিম নিয়ে ফিরছে। বলেই অরিনকে পেছনে তাকাতে বলে আহিরা।
অরিনও সেদিকে তাকায়।দেখতে পায় রেহান এদিকেই আসছে। রেহান অরিনকে দেখে চমৎকার হাসলো।
-কতক্ষণ যাবৎ অপেক্ষা করছি পরি।এত দেরি করলে যে!
-আসলে ভাইয়া..
-থাক এখন আর ওসব বলে লাভ নেই। নাও এটা খাও।তোমারতো এটা খুব পছন্দের তাইনা? বলেই একটা কোন আইসক্রিম অরিনের সামনে এগিয়ে দেয় রেহান।
অরিনও সেটা হাসিমুখে নিয়ে নেয়।
-থ্যাংকইউ ভাইয়া।
-মাই প্লেজার বিউটিফুল লেডি। কুর্নিশ করার ভঙ্গিতে বলে উঠে রেহান।পরে একে একে সকলকেই ভাগ করে দেয়।একটা আইসক্রিম নিয়ে কিছুটা দূরে দাড়িয়ে থাকা রৌদ্রর কাছে যায় রেহান।
-নে ধর।
আইসক্রিম হাতে নিয়ে রৌদ্র বলে,
-তুই এখানে কি করছিস?
-বারে বলদ নাকি তুই! আমার বউ যেখানে আমিওতো সেখানেই থাকবো তাইনা? এই ধর যেমনটা তুই এসেছিস।
-আমি এসেছি মানে?
-ইশশ! কচি খোকা ভাব এমন যেন কিচ্ছু বুঝে না! বেডা তোরে আজকে বিয়ে দিলে কালকেই ২ বাচ্চার বাপ হয়ে যাবি আর তুই কিনা এখন কচি সাজিস আমার সামনে।
রেহানের এমন উদ্ভট কথায় ভ্রুকুঞ্চন করে তাকায় রৌদ্র। বলে
-কিসব আবোল তাবোল বকছিস!
-কিসের আবোল তাবোল। তুই তোর বউয়ের জন্য এখানে আসিস নাই? অস্বীকার করতে পারবি বল?
-আরে আমি শুধু ওর জন্য আসি নাই। রুহি বললো তাই..
-আরে থাম শালা। রুহি আমাকেও বলছে অরিনের মন খারাপের কথা। আর কেও জানুক বা না জানুক আমিতো জানি ইফতেখার এহসান রৌদ্র কেমন বউ পাগল। তুই যে শুধু ওর জন্যই এসেছিস তা আমি বেশ ভালো জানি।
রৌদ্র রেহানের কথায় আর প্রতিত্তোর করলো না।শুধু গভীর দৃষ্টিতে কিছুটা দূরে হেসে হেসে কথা বলা অষ্টাদশীর পানে তাকিয়ে মুচকি হাসলো সে।ভাবছে রেহানের কোন কথাইতো মিথ্যা নয়।একমাত্র অরিনের জন্যই তো তার আসা।তার সানশাইনের মুখে হাসি মানায় মন খারাপের অন্ধকার নয়।
রেহান রৌদ্রর গভীর অবলোকন দেখে গলা খাঁকারি দিয়ে বলতে থাকে,
-আরে ভাই থাম।আর কত দেখবি! মানলাম ভাবি আমার সুন্দরী তাই বলে এমনে চোখ দিয়ে গিলে খাবি।
এবার যেনো রৌদ্র কিছুটা বিরক্ত হয়ে রেহানের দিকে ফিরলো।
-কি সমস্যা তোর?
-সমস্যা কি আর একটা।সে যাকগে। আমি আমার বউকে নিয়ে একা ঘুরতে যেতে চাই।
-কেন?
-কি কেন? আমার বউকে নিয়ে আমি একটু কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করবো না!
-হুম করবি তো। কিন্তু এখন না বিয়ের পর।
-এ কেমন বেইনসাফি।তুই নিজের বউকে নিয়ে এক রিকশায় ঘুরতে পারিস আর আমি আমার বউকে নিয়ে একটু ঘুরতে পারবো না।ও নিজের বেলায় ষোলআনা আর আমার বেলায় এক আনাও না!
-তুই কি করে জানলি আমি ওকে নিয়ে রিকশায় ঘুরেছি।
-জানি জানি।সবই জানি। এখন আমি তোর কোন না শুনছি না।আমি রুহিকে নিয়ে গেলাম।
বলেই রেহান রৌদ্রকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সেখান থেকে কেটে পড়ে।এতক্ষণ রৌদ্রকে যা যা বলেছে সে নিশ্চিত ও যদি এখন একা থাকতো তাহলে নির্ঘাত তার পিঠের ছাল আর আস্তো থাকতো না। মনে মনে অরিনকে একশো ধন্যবাদ জানায় রেহান।সে খুব ভালো করেই জানে রৌদ্র আর যাইহোক অরিনের সামনে কখনোই রাগ দেখাবে না।তাইতো সুযোগের সদ্ব্যবহার করলো রেহান।
রেহান রুহিকে নিয়ে পার্কের পাশে হওয়া মেলায় ঘুরতে যায়। এদিকে বাকি সবাই কিছুক্ষণ পার্কে হাটাহাটি করে। আহিরা একপর্যায়ে বলে উঠে সে নৌকায় চড়বে।মাহিরাও এক কথাতে রাজি হয়।অরিন প্রথমে ইতস্তত করছিলো কেননা সে একটু ভয় পায় সাতার না জানার কারনে কিন্তু সবাই যেহেতু আছে তাই আর তেমন ভয় পেলো না।অগত্যা সবাই মিলে নৌকায় চড়ার প্রস্তুতি নেয়।
নৌকায় চড়তে এসেও ঘটে আরেক বিপত্তি। তারা যে নৌকায় উঠবে সেখানে মানুষজন ভর্তি। রৌদ্র এসব দেখে বাঁকা হাসে।বলে,
-এখানে তো আর বেশি মানুষ উঠলে সমস্যা হতে পারে।অনিক তুই আহি মাহিকে নিয়ে এই নৌকা দিয়ে যা। আমরা পরের নৌকায় আসছি।
অনিকের মনে মনে আবারও কিছু একটা আচ করলো।অথচ মুখে মেকি হাসি দিয়ে বললো,
-ওকে ভাইয়া। বলেই সে আহি মাহিকে নিয়ে নৌকায় উঠে। এদিকে অরিনের মনটা আবারও খারাপ হয়ে যায়। ও একপর্যায়ে বলে
-না না আমিও তাদের সাথে যাবো। একজন মানুষ বেশি উঠলে কি আর এমন হবে! প্লিজ আমিও উঠবো তাদের সাথে।
অরিনের কথা শুনে মেকি রাগ দেখায় রৌদ্র।
-তোকে বললাম না আমরা আলাদা নৌকায় যাবো।ওরা যাক এই নৌকায়।তুই আমার সাথে আয়।
বলেই অরিনকে আর কিছু বলতে না দিয়ে তার হাত ধরে একটি খালি নৌকায় উঠে পড়ে। মাঝিকে বলে দেয়,
-মামা পুরো নৌকা আমি ভাড়া নিচ্ছি। আপনি বৈঠা তুলুন।আর হ্যা অবশ্যই সাবধানে চালাবেন।
মাঝিও রৌদ্রের কথামতো বৈঠা তোলে।
অরিনের যেনো অবস্থা যায় যায়।সে কোনরকমে হেলেদুলে দুলতে থাকা নৌকায় বসে পড়ে। কিছুটা ভীত কন্ঠে রৌদ্রকে বলে,
-রোদ ভাই।আমরা একা একটা নৌকায় কেন যাচ্ছি? বেশি মানুষ থাকলেতো অন্তত আমার ভয়টা কম লাগতো।
রৌদ্র অরিনের থেকে সামান্য দুরত্বে দাড়িয়ে। অরিনের কথা শেষ হতেই মেজাজ দেখিয়ে বলে,
– তুই কিভাবে ভাবলি আমি তোকে ওতোগুলো মানুষের মাঝখানে নিয়ে যাবো।আর রইলো বাকি তোর ভয়ের কথা, মনে রাখিস আমি থাকতে তোর কিচ্ছু হতে দিবোনা।
অরিন অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো রৌদ্রর পানে।এই মানুষটা তার কাছে বরাবরই এক মায়াজাল। বুঝা বড় দায়! কিন্তু এই মুহুর্তে অরিন কিছুতেই শান্ত হতে পারছে না।দুলতে থাকা নৌকায় তারা জান যায় যায় অবস্থা। মনে হচ্ছে এই বুঝি নৌকা টা উল্টে গেলো।অরিন ভয়ের চোটে চোখ বন্ধ করে নেয়।
হঠাৎ করে অরিন অনুভব করলো ও কারোর খুব কাছে।একটা পুরুষালী মনমাতানো সুঘ্রাণ তার নাকে এসে বারি খাচ্ছে। অরিন চট করে চোখ খোলে।কিন্তু পরমুহুর্তেই যেনো তার চক্ষু ছানাবড়া হয়ে যায়। রৌদ্র অরিনের খুব কাছে ঘেঁষে বসে এবং অরিনের কােমরে হাত দিয়ে তাকে নিজের বুকের খুব কাছাকাছি নিয়ে আসে। রৌদ্রর স্পর্শ পেতেই অরিন আবারও চোখ বন্ধ করে নেয়। বুকের খাচার ভেতরের বস্তুটি যেন এক্ষুনি লাফিয়ে বের হয়ে আসবে অরিনের। আবারও যেন কাঁপন ধরে যায় শরীরে। আচ্ছা এখন কি মাঘ মাস চলে? নাতো! এখনতো গ্রীষ্ম। কিছুক্ষণ আগেও তো অরিনের ঘেমে-নেয়ে একাকার অবস্থা। কিন্তু এখন তার শরীরে এমন কাঁপন ধরেছে যেন কোন এক শৈতপ্রবাহ তার ওপর দিয়ে মাত্রই বয়ে গেলো।
হঠাৎই অরিনের কানে আসে এক মন্ত্রমুগ্ধ ডাক।
“অরিন!”
ডাকটি শোনামাত্রই অরিনের শীড়দাড়া বেয়ে এক শীতল স্রোত নেমে যায়।নিজের মনের উৎপীড়নে অতিষ্ট হয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে।
এদিকে অরিনের বন্ধ চোখ,কাঁপতে থাকা শরীর,অবশেষে ঠোঁট কামড়ে ধরা সবকিছুই যেনো রৌদ্রকে এক ঘোর অমানিশায় ফেলে দিচ্ছে। বারেবারে তার মনে নিষিদ্ধ ইচ্ছেরা উকি দিয়ে যাচ্ছে। রৌদ্র অরিনের কোমর থেকে হাত সরিয়ে দ্রুত দাড়িয়ে পড়ে।অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে ঘনঘন নিশ্বাস ফেলে নিজেকে ধাতস্থ করার আশায়।কিছুক্ষণপর নিজেকে স্বাভাবিক করে অরিনের দিকে ফিরে রৌদ্র অরিনটা এখনো চোখ বন্ধ করে আছে। আবারও অরিনের পাশে গিয়ে বসে সে।এবার অবশ্য সামান্য দুরত্ব বজায় রেখে বসেছে। শান্ত নিরেট কন্ঠে বললো,
-চোখ খোল অরিন।
অরিন হালকা ঢোক গিলে ধীরস্থিরভাবে চোখ মেলে।
রৌদ্র ফের বলে,
-নৌকায় বসে যদি পরিবেশটাই উপভোগ না করিস তাহলে নৌকায় উঠে কি লাভ বলতো।
অরিনের ইচ্ছে করলো একবার বলতে,
“আপনি আর উপভোগ করতে দিচ্ছেন কই! আপনি জানেন না আপনি সামনে আসলেই আমি বাকহারা হয়ে যাই!”
কিন্তু মুখে কিছুই বলতে পারলো না।চুপ করে মাথানিচু করে বসে রইলো। রৌদ্র তার মৌনতা দেখে বুঝে নিলো যা বোঝার।এবার রৌদ্রর মাথায় এক দুষ্ট বুদ্ধি খেলে গেলো।সে হালকা কঠোর গলায় বললো,
-দেখ অরিন! এভাবে বসে থেকে কোন কিছুই উপভোগ করতে পারবি না।আই থিংক তোর ভয় হচ্ছে। তাহলে তুই এক কাজ কর আমার হাতটা ধরে বসে থাক। এতে তোর ভয় কিছুটা কমবে।
বলেই নিজের পকেট থেকে ফোন বের করে তার ওপর আঙুল চালাতে থাকে।কিন্তু তার মনোযোগ সবটাই অরিনের ওপর। অরিন কিছুক্ষণ ইতস্তত করে।কিন্তু পরিস্থিতির ভয়ও যেন মাথা চড়া দিয়ে বসে তার।তাই কোন উপায়ন্তর না পেয়ে রৌদ্রর একহাত জড়িয়ে ধরে সে।রৌদ্রও মুচকি হাসে কিন্তু পরক্ষণেই নিজের মুখভঙ্গি স্বাভাবিক করে নেয়। অরিনের ভয়টা এখন কিছুটা কমে আসে। সে সামনে তাকিয়ে মুগ্ধ নয়নে পরিবেশটা উপভোগ করে। মাথার ওপর সাদা নীল মিশেলের আকাশ নিচেই নদী, নৌকার বৈঠার তালে তালে হওয়া নদীর কলকল শব্দ। দূরে তাকালে মনে হচ্ছে যেন আকাশের সাথে নদীটিও মিশে একাকার। অথচ তারা যতটা সামনে যাচ্ছে ততই যেন সবটা ভ্রমে পরিনত হচ্ছে। অরিন সত্যি মুগ্ধ! অরিন পরম শান্তিতে রৌদ্রর কাঁধে মাথা রাখে। রৌদ্রও সেদিকে ফিরে, আলতো স্বরে জিজ্ঞেস করে
-ভালো লাগছে এখন?
-হুম।
-আর ভয় করছে?
-উহুম।
রৌদ্রও নিঃশব্দে হাসে।দূর আকাশের পানে চোখ রেখে মনে মনে বলে,
-“সানশাইন! তুই সারাটাজীবন এভাবেই আমার পাশে থাকিস! তোকে ছাড়া যে আমি শূন্য! একেবারেই শূন্য! ”
নৌকার ভাড়া চুকিয়ে নেমে পড়ে রৌদ্র অরিন। কিছুটা সামনে যেতেই একটা বাচ্চা মেয়ে কিছু ফুল আর ফুল দিয়ে বানানো ক্রাউন নিয়ে আসে তাদের সামনে। বলতে থাকে,
-ভাইজান! ফুল নিবেন? আফারে একটা ফুল কিন্না দেন আফার হাতে মানাইবো।
অরিনের ইচ্ছে করলো একটা ক্রাউন কিনে মাথায় দিতে কিন্তু রোদ ভাইকে বলতে কিছুটা ইতস্ততবোধ করে সে তাই চুপচাপ দাড়িয়ে থাকে। এদিকে রৌদ্র বাচ্চা মেয়েটির হাতে পাঁচশ টাকার একটি নোট দিয়ে বলে,
-এটা রেখে দাও।
-কিন্তু আফনে তো কিছু নিলেন না।আফনে কিছু না নিলে এই টেকা আমি নিমু না।
রৌদ্র কিছুটা কপাল কুচকে বলে,
-এগুলোও কেও পড়ে? কিভাবে পড়ে এগুলো! দেখি দাও তো।
-ভাইজান এই মুকুটটা এইডা আফামনির মাথায় পড়ায় দেন খুব ভালা দেহাইবো।আর এই যে এই গাজরাডা হাতে বান্ধে।
-ছ্যাহ্! এত কাহিনির কি আছে বুঝলাম না। এদিকে আয় তো অরি।
বলেই একটি গোলাপের ক্রাউন নিয়ে অরিনের মাথায় পড়িয়ে দেয় আর একটি বেলি ফুলের গাজরা নিয়ে হাতে বেধে দেয় তার। এদিকে অরিন মুগ্ধ নয়নে রৌদ্রর কার্যকলাপ দেখে যাচ্ছে। মনে মনে সে বারংবার চাইছে এই সময়টা এখানেই থেমে যাক! থাকুক না এই মুহুর্তটা আরো কিছুটা সময়।
রৌদ্র নিজের কাজ শেষ করে অরিনের দিকে কিয়ৎকাল তাকিয়ে বলে,
-উমম,খারাপ না মোটামুটি চলে।
বলেই অরিনকে নিয়ে সেখান থেকে চলে আসে।অরিন তখনকার কথায় কিছুটা অভিমান করে। কেনো রোদ ভাই কি বলতে পারতো না” অরিন তোকে সুন্দর লাগছে! ” তা না বলে কি বললো,
“খারাপ না মোটামুটি ” এরচেয়ে ভালো হতো যদি সে কুৎসিতই বলতো। অরিন হাটতে হাটতে থেমে যায়। রৌদ্রও অরিনের হঠাৎ থেমে যাওয়ায় দাড়িয়ে পড়ে।পিছনে ঘুরে ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-কি হলো! দাড়িয়ে পড়লি যে?
অরিন কাঠকাঠ গলায় জিজ্ঞেস করে,
-আমায় দেখতে কি খুব খারাপ লাগছে রোদ ভাই?
-আমি এমনটা কখন বললাম?
-তাহলে তখন যে বললেন মোটামুটি।
-তো মোটামুটি লাগছে বলেই তো মোটামুটি বললাম।
হঠাৎই রাগ উঠলো অরিনের। রাগ করে মাথা থেকে ক্রাউনটা যেই না নামাতে যাবে তখনই রৌদ্র বলে ওঠে,
-হেই খবরদার এটা মাথা থেকে নামিয়েছিস তো!
-কেনো? আপনি না বললেন এটা মোটামুটি লাগছে।তাহলে পড়ে কি করবো বলুন।এর চেয়ে বরং নামিয়ে ফেলি।
রৌদ্র অরিনের কাছে এসে আবারও ক্রাউনটা ঠিকঠাক করে পড়িয়ে দিয়ে বললো,
-মোটামুটি লাগুক আর যেমনই লাগুক এটা আপাতত মাথা থেকে নামাবি না।টাকা দিয়ে কিনেছি এগুলো। আর তাছাড়া আমার কষ্টের উপার্জন বুঝিসই তো! আমি কিন্তু অপচয় একদম পছন্দ করি না অরি।
বলেই সামনে ফিরে আবারও হাটা ধরে সে।
এদিকে অরিন হতবিহ্বল হয়ে দাড়িয়ে আছে। কি বললো রোদ ভাই! তার টাকা যাতে অপচয় নাহয় তাই সে এমনটা পড়ে থাকবে।বাহ! এটাই দেখা বাকি ছিলো।ভাবনা ছেড়ে সেও হাটা ধরে রৌদ্রর পিছুপিছু।
অরিনরা কিছুটা সামনে এগিয়ে অনিকদের পেয়ে যায়। আহি মাহি কি একটা নিয়ে কথা বলছে অরিনকে দেখেই তারা উৎফুল্লতার সাথে বলে,
সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি পর্ব ১৩
-এই অরিপু আমরা এখন মেলায় যাবো চলো।
-সত্যি!
-হুম। তোমাদের দুজনের জন্যই এতক্ষণ অপেক্ষায় ছিলাম। চলো এবার যাওয়া যাক তাহলে।
-ওকে।
বলেই তারা হাটা ধরে মেলার উদ্দেশ্যে।